#বোধন
ব্যস্ত জীবনে ছুটি খুব কম জোটে মন্দারের । রুগি-নার্সিংহোম-হাসপাতাল-ছুরি কাঁচি আর ওষুধের গন্ধের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ব্যক্তিজীবনটা । তাই এই পূজোর চারটে দিন আর চার দেওয়ালের মাঝে নিজেকে আটকে রাখতে চায়না কিছুতেই । শহুরে কোলাহল ছাড়িয়ে খোলা পরিবেশে নিজের মতো করে দিনগুলো কাটাতে বেরিয়ে পড়ে প্রতিবার । হৈম অবশ্য বলে মন্দার নাকি নিজের জীবনের থেকে পালাতে ঐ পূজোর সময়টা শহরের বাইরে থাকে ।
সমুদ্র বরাবরের পছন্দ মন্দারের । হৈম পাহাড় ভালোবাসলেও , কিন্তু এতবছর মন্দারের সাথে থাকতে থাকতে কখন যেন সমুদ্রটাকে আপন করে নিয়েছে । অগুনতি এই ঢেউএর সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন যেন ভারমুক্ত লাগে । ওদের জীবনেও একসময় কতো ঢেউ এসেছে , ঈশ্বরের আশীর্বাদে অনেক কষ্টে সামলে উঠেছে দুজনে । প্রতিদিন কত শিশু প্রথম পৃথিবীর আলো দেখছে মন্দারের হাত ধরে , অথচ নিজের সন্তানকে জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে আনতে পারেনি । নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল হৈম-র মা হওয়ার সব সম্ভাবনা টুকু । সারা শহর সেদিন দুর্গাপূজোর আনন্দ আর আলোয় মেতেছিল , শুধু অন্ধকার ছিল হৈম আর মন্দারের জীবনটা । হৈম খুব একটা ভুল বলেনা , আজ এতো বছর পরেও পূজোর দিনগুলো তাই বোধহয় পালিয়ে আসে চেনা সীমানাটা ছাড়িয়ে । সবটুকু মেনে আর মানিয়ে নিলেও এই পৌঢ়ত্বে এসেও উৎসবের দিনগুলোতে ফাঁকা ঘরটা যেন বেশি করে ফাঁকা লাগে ।
.
সব জায়গাতেই এতো মানুষের ভিড় , নিঃশ্বাসে প্রকৃতির গন্ধটাও যেন ভালো করে পাওয়া যায় না । এই তাজপুর জায়গাটায় মানুষের ভিড় এখনো তুলনাতে অনেকটা কম । পড়ন্ত বিকালের আলো গায়ে মেখে ভিজে বালি ধরে হাঁটছিল দুজনে । হৈমর হাতটা নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছে মন্দার । জীবনের এতগুলো বছর তো এইভাবেই নিজের কাছে আঁকড়ে রেখেছে পরস্পরকে , তবু হৈমর হাতটা ধরতে ভালো লাগছে মন্দারের । ছোট ছোট ঢেউগুলো আপনগতিতে এসে ভেঙে যাচ্ছে ওদের পায়ের কাছে । তারপর যেন একবুক অভিমান নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে । নোনা হাওয়া গায়ে মেখে এতোটা পথ যে হেঁটে ফেলেছে খেয়াল করেনি কেউ । হৈমর হাঁটুর ব্যথাটা জানান দিতেই ফেরার কথা মনে পড়ে । ইস অনেকটা পথ এসে পড়েছি !!!! এতোটা হেঁটে ফেরা হৈমর পক্ষে সত্যিই অসম্ভব । কিন্তু হোটেলে ফেরার বিকল্প ব্যবস্থাও তো নেই । দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে মন্দার , এতোটা আসার আগে একটু ভাবা উচিৎ ছিল ।
বালিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে হৈম । জলের বোতল খুলে একঢোকে অনেকটা জল খেয়েও হাফাচ্ছে যেন । এদিকে সূর্যও সমুদ্রের কোলে ঢলে পড়েছে । সম্পূর্ণ লোকালয় শূণ্য জায়গা , অন্ধকার হ্ওয়ার আগে যেভাবেই হোক ফিরতে হবে ।
ঐ দেখো একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে , ওখানে মনে হয় মানুষজন আছে । দেখো না ফেরার কোন একটা ব্যবস্থা হয় কিনা ।
হৈমর কথায় মন্দার খেয়াল করে সত্যি তো একটা গ্রাম , বেশিদূর ও নয় । ওখানে গেলে হোটেলে পৌঁছানোর একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে । তবে হৈমকে সমুদ্রের ধারে একা বসিয়ে যাওয়ার সাহস হয়না মন্দারের । পায়ে পায়ে গ্রামে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না ওদের ।
নিতান্তই ছোট একটা গ্রাম । রাস্তায় মানুষজন তো নেই , কাকে জিজ্ঞাসা করবো ফেরার ঠিকানা । একটু এগোতেই একটা ছোট গুমটি দোকান , সামনে প্রচুর লোক । সবাই-ই আদিবাসী প্রকৃতির মানুষ । কাছে গিয়ে বুঝতে পারে নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড বচসা চলছে । পুরো ঘটনাটা বুঝে চমকে ওঠে মন্দার । এতদিন খবরের কাগজে আর টিভিতেই দেখেছ , কিন্তু আজ চোখের সামনে সেই ঘটনা । একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও কি এমনটা হয় !!!! অতগুলো সশস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল মন্দার । কাজটা সহজ ছিলনা , তবু বাঁচাতে পেরেছিল মেয়েটাকে ।সদ্য স্বামীহারা মেয়েটাকে সবাই মিলে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধোর করে গ্রাম থেকে বের দিতে চাইছিল । অসহায় মেয়েটা তবু স্বামীর বসত ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি না হওয়াতে ওকে পুড়িয়ে মারতে চাইছিল সবাই ।
.
অজ্ঞান মেয়েটাকে হাসপাতালে দিতে চেয়েছিল মন্দার । কিন্তু হৈম রাজি হয়নি । অনেক রাতে হোটেলে ফিরেছিল তারা । নিজে একজন নামকরা ডাক্তার হওয়াতে , অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি । শারীরিক দুর্বলতা আর উত্তেজক পরিস্থিতির চাপেই জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা । প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে ঘুমতে গিয়েছিল মন্দার । হৈম ঘুমতে যেতে পারেনি , সারা রাত কোলের কাছে নিয়ে বসে অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে ।
.
ভোরের দিকে হয়ত চোখটা লেগে এসেছিল হৈমর । আচমকা "মা" ডাকে চমকে ওঠে হৈম । মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে .....
হৈমর ডাকে মন্দার ও ঘুম ভেঙে এসে দাঁড়িয়েছে বিছানার পাশে ।
নতুন পরিবেশে মেয়েটাও হতচকিত । তবু যেন পরম নিশ্চিন্তে শক্ত করে ধরে আছে হৈমর হাতটা ।
কাছাকাছি কোথাও বোধহয় পূজো হচ্ছে । ঢাকের বোলে ভেসে আসছে বোধনের বোল ।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন