শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

                        


অণুগল্প : ফেরা
                   
            বিয়ের কিছুদিন পরেই পলাশের মনে হলো ওর আর রিয়ার বিয়েটা 'মিস ম্যাচ' ! যত দিন যায় দাম্পত্যের বাকল খুলে খুলে পড়ে। সেখানে শুধু শরীরের নীরাজন। ভালোবাসা গুমরে মরে প্রতি মুহূর্তে। কষ্টের অন্তর্লীন স্রোত যাপনে অহর্নিশ। ফুলশয্যার রাতেই পলাশ বুঝেছিল,
রেখা শরীর বিলাসী। শঙ্খিনীর মতো ফণা তুলে সারা রাত ছোবল মেরে গেলো শরীরী রিরংসায়।ঐ রাত স্পষ্ট করে দিয়ে গেল, রমনে রেখা বেজায় পটু।ভয় পেয়েছিল পলাশ সে রাতেই।একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল ওর হৃদয়। বন্ধুদের মুখে অনেক ঘটনা যে ওর শোনা! 
            গড়াতে গড়াতে কাটলো একবছর। ছেলে সোহাগ এলো ওদের ঘরে। দাম্পত্যের শূণ্যস্থান কিছুটা ভরাট হতে থাকলো। সত্যিই কি তাই? বিধাতা বোধহয় মুচকি হেসেছিলেন অলক্ষ্যে। আস্তে আস্তে হাজার দুয়ারী কামনার আগুন পোড়াতে লাগলো দাম্পত্যের শব। প্রায়দিনই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সিগারেটের গন্ধ পেত।পলাশ ধূমপায়ী নয়। জিজ্ঞাসা করলেই জোর করে ওর ঘাড়েই দোষ চাপাতো রেখা।কোন কোন দিন 'পাগল' তকমাও দিত ওকে।"ওকে অহেতুক সন্দেহ করা হচ্ছে" বলে প্রচন্ড চিৎকারে পাড়া মাথায় করতো রেখা। লজ্জায় পলাশ চুপ থাকতো। মনে পড়তো বাবার কথাটা :"ইডিয়েটের সাথে তর্ক জুড়লেই প্রমাণ হবে সেখানে দুজন আছে"!পলাশ বুঝতো রেখা ওকে লোক চক্ষে ছোট করতে চাইছে।ওটা রেখার এক রাজনীতি। অভিজ্ঞ বাবা মায়ের মদত পেত রেখা সবসময়। মনে মনে সন্দেহ বাড়তেই লাগল।অফিস থেকে ফোন করলে ফোন ধরতো না সহজে। অনেক দিন ফোনে রাস্তায় রিক্সা বা গাড়ির আওয়াজ পেত পলাশ।খটকা লাগত। জিজ্ঞাসা করলে রিয়া বলতো ,পলাশ ভুল শুনেছে। রাতের বিছানায় রিয়ার সারা শরীরে নখের দাগে পলাশ উত্তর পেত সবকিছুর। বড়ো অসহায় লাগত ওর।এক কালো গহ্বর যেন ওকে গ্রাস করতো প্রতি রাতে। সাক্ষী থাকতো আকাশের তারারা অপলক।
        সেদিন যথারীতি অফিস বেড়িয়েছে ও। ব্যান্ডেল পৌঁছে শুনলো গাড়ি আর যাবে না।খন্যান ষ্টেশনে ওভারহেড তার ছিঁড়েছে।সারাতে সারাতে সেই বিকেল। অগত্যা বাড়ি ফেরা। বাড়িতে পৌছে দেখল,সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ নেই। চাপ দিতেই খুলে গেল। ব্যাগপত্র নীচে রেখে ও ওপরে উঠতেই নাকে সিগারেটের গন্ধ পেল। শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখল বিছানায় রিয়া আর ওর পিসতুতো দাদা বুবাই নগ্ন হয়ে শরীরী উল্লাসে। মাথা ঘুরে গেল ওর। ছিটকে বেরিয়ে এলো বাইরে। বুকফাটা কান্না চোখ থেকে শ্রাবণের ধারার মতো বেড়িয়ে আসছে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ওর মনাকাশ ! এতোটা বিশ্বাস ঘাতকতা ! লজ্জায় অসহায়তায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে ওর শরীর।কি রইল আর ওর? বেঁচে থেকে কি লাভ আর? শেষ করে দেবে এ জীবন ও। টলোমলো পায়ে এগিয়ে চললো রেল গেটের দিকে।
      রেলগেটে পৌঁছে দেখল ষ্টেশনের পাগলটা রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ছুটে আসা ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে :"আয়, আয়! আমার ওপর দিয়ে চলে যা "। কেঁপে উঠলো পলাশ । তাহলে কি পাগলটা ওর মতোই আত্মহত্যা করতে চাইছে ? ট্রেনটা কাছে আসতেই এক লাফে লাইন থেকে সরে এসে পাগলটা আবার চিৎকার করতে লাগলো ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে :"কি ভাবলি আমি মরবো? আমি কি বোকা যে শুধু শুধু তোর চাকার তলায় যাবো? আমার আরো অনেক কাজ বাকি জানিস "। হঠাৎ ঘুরে পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো :"আমি বোকা নাকি যে ট্রেনের তলায় মরবো? আমি কি বোকা" ? হা হা করে  হাসতে হাসতে এগিয়ে চললো সামনে।পাগলটার শেষের কথাগুলো যেন চাবুকের মতো পড়তে লাগলো ওর মনে।এক ধাক্কায় বাস্তবে ফিরলো ও। সত্যিই তো ,বোকা ছাড়া কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবে এভাবে? আর ও তো কোন পাপ করেনি। কারোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তাহলে মরবে কেন? সত্যিই তো,ওর ও অনেক কাজ বাকি। ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে।ও না থাকলে ছেলেটা যে ভেসে যাবে ওর মায়ের পাপের স্রোতে।ছেলেটার মুখটা মনে পড়লো ওর। বাঁচতে হবে ওকে। বাঁচতেই হবে ছেলের জন্য। বুকের ভেতর হারিয়ে যাওয়া আগুনটা জ্বলে উঠলো যেন। পাগলটাকে মনে মনে প্রণাম করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চললো ছেলের স্কুলের দিকে স্কুল ছুটি হলে ওকে বাড়ি নিয়ে আসবে বলে।

                                         ***************


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন