শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অনিন্দ্য পাল

              







সত্যসাধন

=========================== 
বহুদিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধূমায়িত  চা পেলেন সত্যসাধন। গত প্রায় সাত মাস ধরে শ্যামলিকে নিয়ে যে যমে মানুষে টানাটানি গেছে, তাতে সত্যসাধন প্রকৃত অর্থেই সবদিক দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। দিন পনেরো আগে সবাইকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছেন শ্যামলি। একেবারে একা হয়ে গেছেন সত্যসাধন, তাই শ্যামলির পারলৌকিক কাজকর্ম মিটে গেলে যাদবপুরে একমাত্র ছেলে সুমনের কাছে চলে এসেছেন। মেয়ে রুমা অনেকবার বজবজে তার কাছে যেতে বললেও কর্ণপাত করেননি। মেয়ের বাড়ির অন্ন মুখে তোলা যায় নাকি? তার চেয়ে গ্রামের বাড়িতে পচে মরা অনেক ভালো। 
          খবরের কাগজে মুখ গুঁজে অনেকটা সময় কেটে গেল সত্যসাধনের। বিকেলে নাতি রোহনকে নিয়ে একটু পার্কে গেলেন। সুমনের ফ্ল্যাটে দু'টো বেডরুম। একটাতে ওরা থাকে, আর একটাতে নাতি পুষ্কর। আপতত সত্যসাধনের জন্য ডাইনিং কাম ড্রয়িং-এর পাশের ছোট্ট একটা ঘরে ক্যাম্পখাট বরাদ্দ হয়েছে। ছেলে তার ঘরে একটা পুরোনো টিভির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সেটাতে সারা সন্ধ্যে হাবিজাবি সিরিয়াল আর খবর দেখে শ্যামলিকে  হারানোর কষ্ট ভোলার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সেই চেষ্টা যে একেবারেই বিফল হয়েছে সেটা বুঝলেন রাতের খাবার খাওয়ার সময়। দু'টো রুটি আর একটু সব্জি, এটুকুই খেতেন সত্যসাধন, তার ব্লাড-সুগার থাকায় শ্যামলি সব সময় চোখে চোখে রাখতেন। কখনও লুচি, পরোটা, আলু বা মিষ্টির ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। এখানে যখন বৌমা রাতে পরোটা আর আলুর দম, সঙ্গে দু'টো রসগোল্লা দিল খেতে, সত্যসাধন কিছুতেই মুখে তুলতে পারলেন না। ছেলে সুমন বিরক্ত হয়ে বললো, 
-- আরে একদিন খেলে কী হবে? আমাদের কলিগ অরুন তো মিষ্টি খেয়ে তুড়ে দেয়, দিব্যি আছে। তোমার যত ভয়। খাও খাও খেয়ে নাও। 
মনের সঙ্গে অনেক লড়াই করে সত্যসাধন একটা পরোটার খানিকটা খেয়ে উঠে পড়লেন। 
  ঘরে ঢুকে অভ্যাসমত সুগারের ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারলেন না। ছেলে-বউ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে একটু পায়চারি করবেন ভেবে ঘর থেকে বেরিয়েই শুনতে পেলেন, 
-- ওই যে অতটা খাবার নষ্ট হল, সেটার কি হবে? এই টু-বেড ফ্ল্যাট, নড়াচড়া করার জায়গা নেই, সেখানে আর একটা মানুষ কে কোথায় রাখা হবে না ভেবেই ... 
বৌমা লিপিকার ধারালো কথা শেষ হল না, সুমনের গলা পেলেন, 
-- একটু আস্তে তো বলতে পারো, সব বিষয়ে এত চেঁচামেচি কর কেন? আমার বিষয়টা তো জানো, অ্যাকাউন্টেন্সি, হিসেবটা আমি একটু ভালোই বুঝি। বাবা এখানে থাকলে লাভ বই লোকসান নেই। বাবার নিজের পেনশন আছে, প্লাস রুমা প্রতি মাসে বাবার জন্য দু-হাজার করে দেবে, ইভন গতকাল ও এই মাসের জন্য দিয়েছে, ওটা থেকেই তো তোমার জন্য জামদানীটা আনলাম। আবার গ্রামের জমি-জমার বিক্রিবাটা হলে কম করেও লাখ তিরিশের কম আসবে না, এসব তো ভাবো। আর কদিন বা আছে, একটু বুদ্ধি করে আদর যত্ন করে মিষ্টি, আলু খাওয়াও, দেখবে হুস করে ...
ছেলের খিলখিল হাসিটা বড্ড উষ্ণ মনে হল সত্যসাধনের। নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় বসতেই মাথার মধ্যে একটা জ্বালা অনুভব করলেন, গলার কাছটা কেমন যেন তেতো হয়ে গেল। পঁয়ত্রিশ বছর আগের একটা রাত ভেসে উঠলো চোখে। রুমা, তাদের প্রথম সন্তান জন্মেছিল সেদিন, সত্যসাধন মেয়েটাকে একবারের জন্য দেখতে যাননি। তিনদিন পর শ্যামলি রুমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে বলেছিলেন, আগে জানলে অ্যাবরশন করাতাম। 
বালিশের নীচ থেকে ফিচার-ফোনটা বার করে রুমার নম্বরটা ডায়াল করলেন। সত্যসাধন জানেন মেয়েটা মায়ের স্বভাব পেয়েছে, এখনও রাত জেগে বাবার কথাই ভাবছে। 
==============================

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন