রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

              


মাঝে নদী বহে রে 
 

আমরা যখনই সুখ-দুঃখের গল্প করতে বসি (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যকে নিয়ে), আমাদের অজান্তেই সুখের পরিমাণ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকে। আর শেষে, ওই গল্প জীবনের প্রতি এক ব্যর্থ অভিযোগে রূপান্তরিত হয়। অদৃষ্ট নামক অদৃশ্য শয়তানের প্রতি এক বিরূপ মনোভাব জন্মায়। হালকা হাসি, অনুযোগ, অভিযোগ আর মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে চোখের জল সামলে নিতে নিতে জীবনের এক প্রান্তে এসে একদিন দেখা যায়, সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য ওইটুকু সম্বলই রয়ে গেছে। নিন্দুকেরা যাই বলুক, ওই সুখ-দুঃখের গল্পই সংসারীর পরম সম্পদ। ওটি না থাকলে তেঁতুলের আচার বিস্বাদ লাগে, বারবার চ্যানেল বদলেও টিভিতে কিছু ভালো লাগে না, স্কচ-হুইস্কি জোলো মনে হয়। এমন কি জনৈক সাহিত্যিকের লেখার রসদেও ভাঁটা পড়ে (চুপি  সাড়ে)।

রমাপদ পালিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন। পরবর্তীকালে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা হন এবং বর্তমানে সেই পরিবারেরই বসত বাড়ির উত্তর দিকের আমগাছে থাকেন। হ্যাঁ আমগাছেই থাকেন, হপ্তা খানেক আগে তাঁর গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। তবে, পিছুটান এখনও ছিঁড়তে পারেননি, তাই আপাতত আমগাছ। সংসারের হিতে যে সব পরিকল্পনা ফেঁদে বসেছিলেন তা জীবদ্দশায় ফিনিশ করা হয়ে ওঠেনি। তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় পূর্ণ সময়টাই প্রয়োজনীয়, আসল কাজ ফেলে এদিক ওদিক চড়ে বেড়ালে উত্তরপত্র অসমাপ্তই থেকে যায়। তাই বলে, প্রাণ থাকতে কি রমাপদবাবু কিছুই করেননি? খুব করেছেন! বাপের সুপুত্তুর হয়ে শাঁসালো ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়েকে ঘরের লক্ষ্মী করেছেন। কলেজ পাশ দিয়েই টুক করে মামার ধরে দেওয়া আপিশের কেরানী হয়ে সাপ-সিঁড়ি খেলতে খেলতে ক্রমে বড়োবাবুর চেয়ার অবধি উঠেছেন। তারপর কোম্পানি বলল “এবার ছাড়েন কত্তা, ভি আর এস নেন!” টেবিলের ওপরে-নীচে যা আসত তাই দিয়ে তার আগেই শহরতলি অঞ্চলে আড়াই কাঠা জমিতে নিজের লাগসই বাড়ি, পেছনে বাগানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ছেলে-বউ-নাতি-নাতনীদেরও তেমন কোনও অভিযোগ নেই রমাপদবাবুকে নিয়ে। তাঁর শ্রাদ্ধ-শান্তিও তাঁর ছেলেরা বাপের টাকাতেই দিব্যি চালিয়ে নিয়েছে। আর মেয়ে-জামাই কলোরাডো থেকে  ভিডিও কল করে পরোলোকগত পিতার আত্মার শান্তি কামনার কর্তব্য সেরে নিয়েছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তেমন কোনও অশান্তি ছিল না। কিন্তু শেষের দিকে এসে কেমন সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল... এখন এই সাধের আম গাছটা ছাড়া সবই আধখাওয়া মালপোয়ার মত। তবে কি, দেহই যখন রইল না, তখন সেই দেহের সংসারের প্রতি আবদ্ধ হয়ে থাকা কি সুবিবেচকের কাজ? মায়াডোর আর সুপুরিগাছের পাতা-বাকল... সে তো কখনো না কখনো খসাতেই হবে।

জীবদ্দশায় রমাপদবাবুর দুটো বিশেষণ জুটেছিল... ‘কুচুটে’ আর ‘কিপটে’। এখন সেই সব প্রতিবেশীদের একটু শিক্ষা দেওয়ার দুষ্টু-বুদ্ধি মনে জাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু, তখন ওইসব বাইরের আপদের টিটকিরি যতটা গা’জ্বালিয়েছিল, আজকাল নিজের পরিবারের আচরণ তার থেকে বেশি খোঁচা দিচ্ছে। বুকের মাঝখানটা ফাঁকা হয়ে গেছে বলে বোধহয় এখন বেশি হু হু করে! এখনও গাছের একটা ডালে ঠেস দিয়ে সেই অন্তঃপুরের দিকেই চেয়ে আছেন। মহামায়া সাতাত্তর বছরের মোহ-মায়ার জালে আটকে রেখেছিলেন, তা এই ক’দিনে ছিন্ন হওয়ার নয়।
শেষবারের মত চোখ বোঁজার আগে গিন্নি, আর বোধহয় কোনো এক ছেলের বউয়ের কান্নার শব্দ কানে এসেছিল, এছাড়া কিছু শুনতে পাননি। সূক্ষ্ম শরীর লাভের পর যখন আবার দৃষ্টি পরিষ্কার হল, তখন দেখলেন তাঁর এতকালের চেনা দেহর ওপর হালকা হয়ে ভাসছেন। আর সেই দেহটিকে, তাঁর বউমারা শেষবারের মত সাজিয়ে নিচ্ছে। লোকজনের অন্তিম যাত্রা দেখা রমাপদর কোনওদিনই ঠিক পছন্দ নয়, তাই নিজের খোলটার সামনে থাকতেও ইচ্ছে করল না। একলাফে খাট থেকে নামতে গিয়ে, পালকের মত ভেসে সদর দরজা অবধি এগিয়ে গেলেন, যেন ব্যোমযাত্রী! অল্প বয়সে কেউ কেউ বলতেন বটে “রমাপদ, তোমার গ্র্যাভিটি একটু বাড়াও... না হ’লে কোথাও পাত্তা পাবে না।” কিন্তু তাই বলে মরার পর যে এমন বায়বীয় হয়ে ভেসে বেড়ানো যাবে, একথা কে জানত? মৃত্যুর আগের যন্ত্রণা-কষ্ট, বিদেহী অবস্থার এই প্রাপ্তির আমোদে খানিকটা ফিকে হয়ে গেল। কিন্তু রমাপদ হিসেবী মানুষ, ছোটখাটো আনন্দে বড়ো চিন্তা ভুলে যান না। এতদিন যে গৃহিনীর পুষ্যি হয়ে ছিলেন, তার প্রতি আনুগত্য থেকে হোক অথবা অনুরাগ থেকেই হোক, একবার অন্দরমহলে তাকে দেখতে গেছিলেন ভেসে ভেসে। গিয়ে দেখলেন গিন্নি এক নিকট আত্মীয়ার কোলে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বিলাপ করছে। আর এক প্রতিবেশীর স্ত্রী তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই বিলাপের মাঝেই এক মহিলা গিন্নির গলা থেকে সোনার হারটা খুলতে গেল। রমাপদ ভাবলেন, এই বুঝি বুড়ি শোক ভুলে মারতে যায়! কিন্তু তাকে হতাশ করে একেবারে বিনা বাঁধায় তাঁর গিন্নিকে নিরাভরণ করে সেই মহিলা গয়নাগুলি সযত্নে অন্য ঘরে নিয়ে গেল। যে মানুষ সংসারে পা রাখার পর থেকে রমাপদকে একদিনও এক পয়সা বাজে খরচ করতে দেয়নি, চিরকাল নিজের বাপের বাড়ির লোক ছাড়া অন্য আত্মীয়দের উৎপাত এবং আতিথেয়তাকে আদিখ্যেতা বলে এসেছে, তার এমন আকস্মিক বৈরাগ্যে রমাপদ নিজের মৃত্যুর থেকেও বেশি মর্মাহত হলেন। তাঁর কষ্টার্জিত সম্পত্তি বারো-ভূতের পেটে যাওয়া থেকে আর ঠেকায় কে? আর সেখানে না থেকে, নিজের বাসা ত্যাগ করে ভেসে ভেসে পাড়ার মোড়ের কদমগাছটায় গিয়ে বসেছিলেন সেদিন। সেইখানে বসেই নিজের শব-যাত্রা দেখলেন। শ্মশান যাত্রার নামে পাড়ার ছোকরাদের ফূর্তি দেখে রমাপদর প্রেতজিহ্বা অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু  প্রেতমুখের খিস্তির সবটাই ‘বলো হরি’ রবে চাপা পড়ে গেল।


--- --- --- ---

আজকাল সাত-পাঁচ চিন্তা হয়। শরীরের মায়া গেলেও, জগতের মায়া যাচ্ছে না। না মরলে বুঝতেই পারতেন না যে পুরনো দিনের সব লোকগুলো এখনো এতজনএই পাড়াতেই রয়ে গেছে। যে যার বাড়ির ছাদে, বা কাছাকাছি কোথাও একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে। এই ঠাঁই খোঁজাও একরকমের অভ্যেস। না পেলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু, অশরীরী হলেও ঠাঁই-নাড়া হতে ভালো লাগে না। গাছ কমে গেছে, পুকুর কমে গেছে, পোড়ো বাড়ি কমে গেছে। মুক্তি না পাওয়া আত্মাগুলো এখনো বেরোতে পারছে না মায়া কাটিয়ে। অত দাপুটে ভোলানাথ বাঁড়ুজ্জে, কেমন মুখ চুন করে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে জলের ট্যাঙ্কের ওপর বসে থাকে। মাঝে মাঝে মাথা দোলায়, আর বলে -- 'স-অ-ব জলে গেল... স-অ-ব জলে গেল'। ফ্ল্যাটবাড়িটা ভোলা বাঁড়ুজ্জের চার-কাঠা জমির ওপর। ছেলেরা যে যার মত ফ্ল্যাট আর ক্যাশ পেয়েছে। নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে অন্য জায়গায়, আর এই ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। ভোলা বাঁড়ুজ্জেরও ইচ্ছে করে চলে যেতে, চেষ্টাও করেন। পারেন না, বেশি দূরে গেলেই কেমন জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খেতে শুরু করেন। মনে হয়ে 'আবার মরে যাব'। সে অসহ্য কষ্ট! অথচ, ওঁর স্ত্রী  নাকি পাকা আমের মত টুকুস করে খসে পড়ে মুক্তি পেয়ে গেছেন। বাঁধন কেটে উড়ে যেতে কোনো কষ্ট হয়নি। সুখেন, শঙ্করলাল...  এরা বলে আসলে সব ভ্যাজাল। কমিউনিস্ট হলেও, এদের ছেলেরা শ্রাদ্ধ-শান্তি নিয়ম মেনেই করেছিল। তাও আটকে আছে, ডাক পায়নি। জিনিসের ভ্যাজাল, নিয়ম-বিধিতে ভ্যাজাল, আচার-অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াতে ভ্যাজাল... কী ঠিক আর কী ভুল সেই পদ্ধতিটাই হারিয়ে গেছে। যা হয় সব তালে গোলে। ঠিকঠাক প্রতিক্রিয়াও হয় না, জীবাত্মাগুলোও সব আটকে পড়ছে মায়াজালে মাছ আটকানোর মত। ব্রজেনের মত দু-চারজন এসব শুনে হাসে, বলে 'তোরা না লাল ঝান্ডা ওড়াতি? তোরাও এখন বলবি আচার-বিধির দোষ?'  রমাপদ এসব শুনে হাসে না, সবে সবে অশরীরী হয়েছে বলে সব কিছু ঠিক মত বোঝেও না। অস্বস্তি হয়। বেমানান লাগে নিজেকে এসবের মাঝে। আর সবাইকে যে বেঁচে থাকতে পছন্দ করত এমনও তো না। বরং এখন আর এড়িয়ে যেতেও পারছে না, চারপাশে চেনা-পরিচিত লোকদের মাঝে অপছন্দের লোকও অনেক। তাদের শোক আর অপূর্ণতাও অনেক, ঝুপ করে আঁধার ঘনিয়ে আসা মেঘের মত। রমাপদবাবুর মাঝে মাঝে এসব দেখে মায়া আরো বেড়ে যায়। চোখ ফেটে জল আসার মত লাগে... চোখ নেই, দু-ফোঁটা জলও ফেলতে পারেন না। বাপ-ঠাকুর্দা থাকত সেই ডোমজুরে। তারাও এখনো সেখানেই পড়ে আছে কি না কে জানে! ঠিক-ঠাক শ্রাদ্ধ-শান্তি না হলেই কি শুধু এমন হয়? তাহলে তো রমাপদরও দায়... তেনাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারেন নি। তাই যদি হয়, তাহলে রমাপদরও তো কোনো গতি হবে না! কেউ নিতে আসবে না তাকে।  
আছি, অথচ নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি না... মানে আসলে নেই-- এই স্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতেও মনের জোর লাগে। মনকে শান্ত করে অনুশীলন অধ্যায়নের দরকার হয়। 
 
“ওহে রমা, এই ভর সন্ধ্যেবেলা মুখ পেঁচা করে বসে আছো কেন?” কথাগুলো একসাথে চার দিক থেকে ভেসে এলো। ব্রজেন ঘোষাল বছর দুয়েক হল চোখ বুঁজেছেন। জীবিতাবস্থায় রমাপদর সঙ্গে বেশ ভাব ছিল। আর এই ভাবের মূল উৎস হ’ল বিকেলে রক্ষেকালীতলার পাশে চায়ের দোকানে বসে সুখ-দুঃখের গপ্পো করা। দু বছর আগে বায়ুচড়া হয়েছেন, তাই হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো, ভাসতে ভাসতে কথা বলা-- এগুলো বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। রমাপদর চারপাশে দ্রুত একটা পাক খেতে খেতেই ওই কথাটা বলেছেন। রমাপদ প্রথমে টের পাননি, তারপর ঠাওর করে দেখলেন ব্রজেন ঘোষাল তাঁর ডালের সামনে ভেসে আছেন। ওঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরের খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন রমাপদ। ব্রজেন ঘোষাল সেই দিকে তাকিয়ে বললেন “ওদিকে আর দেখছ কী? ওখানে কি আর তোমার যাওয়া হবে? না, গেলে কেউ টের পাবে?... আর টের পেলেও, সেটা কি খুব একটা ভালো হবে?” রমাপদ সেই দিকে চেয়েই বললেন “আর যাওয়া... আসলে...”

- আসলে কী?
- একটা ভারী গোলমাল চলছে... সকাল থেকেই...
- কীসের গোলমাল?”
- ওই যা হয়... মৎস্যমুখের পর কদিন যেতে না যেতেই  মাথায় কদমফুলের মত চুল নিয়ে দুই ভাই বসে গেছে কবে সার্ভেয়ার ডেকে জমির মাপ হবে সেই নিয়ে!
- ওহ! এ আর নতুন কথা কী?
- মানে? বাপের জমিদারি নাকি!
- ছিল... এখন নেই।
- খোঁটা মারছ!
- দূর! এই আমাকেই দেখো না... পাকাপোক্ত দোতালা বাড়ি ছেলেদের জন্য রেখে চোখ বুঁজলুম... এমন মালমুগুর জিনিস এখন আর হবে?... শালারা বছর ঘুরতেই প্রমোটর কে দিয়ে দিলে!    
 - সেই, তাপ্পর দেখো-- ভবতোষ লাহা, মন্টু ঘোষ... ছেলে-মেয়ে তো নয়, শকুন... বাপ চোখ বুঁজলেই কাটাছেঁড়া স্টার্ট!
- কুণ্ডুবাবুর তো বেঁচে থাকতেই...
- কোন কুণ্ডু?
- আরে ওই যে... যার মেন রোডে তিন-তিনটে ড্রেস মেটেরিয়াল্‌সের দোকান।”
- অ... তাকে তো ওল্ডেজে পাচার করে দিয়েছে শুনলাম...”
- তাহলেই ভাবো...

 
ব্রজেন ঘোষালের কথা শেষ হ’ল না... রমাপদ’র বাড়ির একতলা থেকে আবার কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে এলো। দুই ভাইয়ের মধ্যে তর্ক চলছে, বেশ উঁচু গলায়। ব্রজেন ঘোষাল নিজের ভাসমান স্থিতিটা আমগাছের একটা ডালের আগায় জড়ো করে বললেন “ইয়ে, বলছি রমা... এভাবে তোমার বাড়ির ইন্টারনাল প্রবলেম দেখা... কিন্তু এখন আর কী তোমার, কী আমার... বলো?”
রমাপদ কোনও উত্তর দিলেন না... একাগ্র চিত্তে বোঝার চেষ্টা করছেন ঠিক কী চলছে দুই ভাইয়ের মধ্যে।

ঘরের ভেতরে দুই ভাইয়ের ক্যাচালটা রাস্তা অবধি শোনা যাচ্ছে এখন। তাদের বউরাও কেউ বাঁধা দিচ্ছে না, মনে মনে দু’জনেই চায় এর একটা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। সার্ভেয়ার আসবে, জরিপ হবে... কিন্তু দুই ভাইয়ের কার কতটা দাবী, অধিকার আর প্রাপ্য সেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তবে দু’জনেই মোটামুটি একটা ব্যাপারে এক মত-- সার্ভেয়ার আসছে। প্রেতরূপী রমাপদ দুই ভাইয়ের ডুয়েল দেখতে দেখতে কেবল একবার অস্ফুটে বললেন “ওরে, তোদের বাপ যে একটা উইল করেছিল... যার নামে সব কিছু, তাকে একবার জিজ্ঞেস করবিনি?” ছেলেরা সে কথা শুনতে পেলো কি না কে জানে, দু’জনেই হুড়মুড় ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় মায়ের ঘরে গিয়ে হাজির। রমাপদবাবুর সদ্য বিধবা স্ত্রী সুলেখা দেবী ফুলো ফুলো চোখ (কেঁদে না ঘুমিয়ে বলা মুশকিল) বন্ধ করে রাধামাধবের ছবির সামনে আসনে বসে ছিলেন। ছেলেরা একসঙ্গে ঘরে ঢুকে, মাকে দেখে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল। মা-র কাছ থেকে কোনও সারাশব্দ না পেয়ে নিজে থেকেই দুই ভাই পালা করে বুঝিয়ে দিল, এবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে... আগামী রবিবারই সার্ভেয়ার আসছে... ফয়সালা দরকার... তারা মাকে জানাবার কর্তব্য করতে এসেছে। সুলেখা দেবী সব শোনার পর চোখ খুললেন... কিন্তু কিছু বললেন না। 
     ব্রজেন ঘোষাল ডালের শেষ প্রান্তে হুমড়ি খেয়ে আছেন উত্তেজনায়, শরীরটা থাকলে নির্ঘাত গাছ থেকে পড়তেন, বায়ুচড়া বলে ভেসে আছেন। সত্তরের দশকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা দেখতে গিয়ে এমন উত্তেজনা হ’ত! রমাপদর বড়ো ছেলে মা’র দিকে দু-পা এগিয়ে গিয়ে বলল “কী গো, তোমার অমত নেই তো?” আর ছোটো ছেলে একটু গলা চড়িয়ে বলল “যদি কিছু বলার থাকে, এখনই বলে দাও!... মামার পারমিশন ছাড়া তো আবার চলে না!” রমাপদ আড়ষ্ট হয়ে অপেক্ষা করছেন এর পর কী হয়। তাঁর গিন্নি নির্মোহ দৃষ্টিতে একবার বড়ো ছেলে, তারপর একবার ছোটো ছেলেকে দেখে করুণ ভাবে বললেন “উনি যাওয়ার আগে একটা উইল লিকে গ্যাচেন... জানিস তো? ওতে লেকা আচে পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দিপুর... আর স্থাবর অস্থাবরের মালিকানা সবটাই আমার...” তাঁর কথা শেষ করতে না দিয়ে ছোটো ছেলে তড়পে উঠে বলল “সে যা আছে, আছে... কিন্তু আমাদেরটাও তো বুঝে নিতে হবে নাকি?” বড়ো ভাইও সায় দিয়ে বলল “হুম, ব্যাপারটা ক্লিয়ার হওয়া দরকার।” সুলেখা দেবী আসন পাট করে উঠতে উঠতে একই রকম ধরা গলায় ক্ষীণ স্বরে বললেন “হ্যাঁ... রাজপাট রেখে চলে গেল মানুষটা...  বুজে তো নিতেই হবে... দে, দিপুকে খবর দে তাহলে, ও আসুক।” দিপু রমাপদ’র একমাত্র শালা, ঘোড়েল চিজ্‌ আর রমাপদর থেকেও বড় কুচুটে (কারণ রমাপদ নিজেও তাকে কুচুটে বলতেন)। এক কথায় বাস্তু-ঘুঘু। কীভাবে যে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি করে ফেলল... রমাপদবাবু এখনো বুঝতে পারেন না। মনে হল, এতেই যেন সকলের ভালো। বাইরের লোক ছেলেদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে দাঁত ফোটাতে পারবে না। বাইরের লোক বলতে মূলতঃ বউমাদের বাপের-বাড়ির লোকজন আর কী! জীবদ্দশায় তার শালা দীপ্তিময়ের আসার কথা শুনলে রমাপদ মনে-মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। কিন্তু এখন যেন অশান্তি ঠেকাতে ওইটাই শ্রেয় মনে হ’ল। ‘দিপু’-র নাম শুনে দুই ভাইও কেমন একটু দমে গিয়ে এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি-পাতা বউমারাও ভুরু কুঁচকলো। মোবাইল ফোনে পটাপট কিছু ম্যাসেজ চলে গেল কোথাও। বুড়ি ছেলেদের উপস্তিতিকে পাত্তাই দিলেন না। দুটো বাতাসা খেয়ে গেলাসে রাখা জল দু ঢোক খেলেন। তারপর খাটে উঠে বসে এক পায়ের পাতা দিয়ে অন্য পায়ের পাতা ঘষে পা-দুটো খাটে তুলে নিলেন। এমন ভাবে নির্লিপ্ত হয়ে গেলেন, যেন এই বিষয়ে আর কোনো ভাবনাও নেই... কথাও নেই। এরপর মা-কে ম্যানেজ করতে কিংবা চ্যালেঞ্জ করতে বড়ো ছেলে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যেতেই হঠাৎ কী হল, হাতের কাছের স্টিলের গ্লাসটা পটাং করে মেঝেতে আছড়ে দিলেন সুলেখা দেবী। সেটা ঠং করে শব্দ করে ছিটকে দরজার দিকে চলে গেল। তারপর ধপাস করে খাট থেকে নেমে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন “বাপটা বেঁচে থাকতে তো হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দিল! এখন তোদের চলবে! কান খুলে শুনে রাখ--  কোত্থাও দাঁত-ফোটাতে দেব না... এই আমি বলে দিলুম!  বেশি জ্বালালে সব আশ্রমের নামে লিখে দিয়ে যাব! বউদের সঙ্গে ফন্দি কর, হাঁড়ি আলাদা কর, লোক ডাক... যা করবি নিজেদের ঘরে গিয়ে কর গে যা! বাপ মরেছে এক মাসও পেরোয়নি... বউগুলোও হয়েছে তেমনি!” 
শেষ কথাগুলো বলে বাঁ-পাটা একবার ঠুকলেন মেঝেতে। আরো উত্তেজিত করলে আরো বড়ো কিছু ঘটাতে পারেন... পাশের বাড়ির লোক চলে আসবে। 
বাইরে পায়ের শব্দ হল ধুপধাপ করে... বউমারা  সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিজের নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে। কয়েক সেকন্ড নীরবতার পর ছোটো ছেলে মাকে শুনিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে বলল "তাহলে কী করব? সার্ভেয়ার..." বড়ো ছেলে কোনো উত্তর না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। সুলেখা দেবী ততক্ষণে আবার খাটে বসে পড়েছেন, দেওয়ালে টাঙানো রমাপদবাবুর ছবির দিকে উদাস ভাবে  তাকিয়ে আগের মতই করুণ স্বরে বললেন, "শোন না, বলছি লনড্রির ছেলেটাকে কাল সকালে একটু ডেকে দিবি বাবা? আলমারি ভর্তি মানুষটার জামা-কাপড়, কত শখের... স-অ-ব রয়ে গেল!"
ছোটো ছেলে 'পারব না' বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বুড়ি আবার এক লাফে খাট থেকে নেমে চেঁচিয়ে উঠলেন "তা পারবি কেন? বউ কিছু বলুক... অমনি নেচে নেচে ছাগলের মত চলে যাবি তার বাপের-বাড়ি কুলির মত!"
রমাপদ টের পেলেন, গিন্নি পুরনো ফর্ম ফিরে পেয়ে গেছে। বুড়ি বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে দেখে, এবারে ছেলের বউরা ঘরে বসে অন্যভাবে মাথা খাটাবে... আবার পরে ছেলেদের পাঠাবে, কখনো আলাদা আলাদা, কখনো একসঙ্গে। তবে চিঁড়ে সহজে ভিজবে না। এরা শুরুতেই হুড়োহুড়ি করে ভুল করল। 
     বুড়ি উদাস চোখে কিছুক্ষণ রমাপদবাবুর ছবির দিকে তাকিয়ে রইল, তার একট হাই তুলে ঘরে রাখা টিভিটা চালিয়ে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পছন্দের বাংলা ধারাবাহিকের চ্যানেলে এসে থামল। একটা বেশ জমিয়ে পাক দিয়ে ওঠা ঝামেলা এমন সস্তা বাজির মত নিভে গেল দেখে ব্রজেন ঘোষাল ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “একবার চক্কোত্তিদের ছাদে যেতে হবে বুঝলে... দেরি হয়ে গেল, অপেক্ষা করছে।  আসছ তো?” রমাপদ ঘাড় নেড়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললেন "নাহ্‌! বরং পরে রাতের দিকে তোমাদের পুকুর পাড়ে... ওহ, সে পুকুর আর কোথায়, সেখানেও তো ফ্ল্যাট উঠে গেছে! সরি। " খোঁচাটা বুঝতে অসুবিধে হল না ব্রজেন ঘোষালের, আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোঁ করে ভেসে চলে গেল সেখান থেকে। বাতাসে দুলে উঠল আমগাছের ডালগুলো। 

     গিন্নি ভুরু কুঁচকে টিভির দিকে তাকিয়ে বসে আছে, টিভির যা ভলিউম তাতে পাশের বাড়ির লোকও শুনতে পাবে... আর রমাপদর তো এমনিই চোখ-কান খুলে গেছে শরীর থেকে বেরিয়ে আসার পর। অনেক দূরের কথাও কান পাতলে শুনতে পাচ্ছেন, অনেক দূরের জিনিসও একদম কাছের মনে হচ্ছে একটু মন-সংযোগ করলে। টিভির পেছনের দেওয়ালেই একটু ওপরে রমাপদবাবুর ছবিটা একটা সুন্দর চকচকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙানো হচ্ছে। সেদিকে চোখ গেলেই আবার অস্বস্তিটা জেগে ওঠে  রমাপদর। ব্রজেন বলেছে, এই ব্যাপারটা কাটতে মাস কয়েক সময় নেবে। অনেকের তারপরেও যায় না। 
     
     আসলে রমাপদর বেঁচে থাকতেও অনেক কিছু নিয়ে অনভ্যেস ছিল। অনেক কিছুই ধাতে সইত না। এখনো তা থেকে যাবে। তাই নিজেকে নিয়ে চিন্তাই হয়। আজকাল নিজেকে নিয়ে একটু বেশি-ই চিন্তা হয় রমাপদর। আগের মত দুশ্চিন্তা নয়, অন্যরকম। নিজের প্রতি একটা মায়া, যাকে ইংরেজিতে বলে এমপ্যাথি... যার জন্মও হয়ত এক প্রকার সেলফ-লাভ থেকেই। অথচ নিজের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গেলে আরো দুর্বল লাগে। চোখের সামনে তো দেখছে অন্যদের অবস্থা! মনে হয় সুলেখার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গেলেও ওকে আরো দুর্বল করে দেওয়া হবে। বরং স্মৃতি, অভ্যেস আর অতীত-বিরক্তি অতিক্রম করে এই বয়সে এসে ও কেমন থাকতে চায়... কেমন থাকতে পারে-- এটা দেখার ইচ্ছে বেশি। শুধু ছবিটা ওরা অন্য দেওয়ালে টাঙিয়ে দিক। বার বার চোখে পড়ে, অস্বস্তি হয়। আপনজনকে হারানোর ব্যথায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি... নিজে যে নিজের এতটা আপনজন, এতকাল বুঝতেই পারেনি এভাবে! হ্যাঁ... শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও অনুভূতি আর জমা কথাগুলো থাকে। বরং অনেকরকম অনুভূতি বাড়ে, অব্যক্ত... বেঁচে থাকতে যেগুলোর ব্যাপারে ধারণা ছিল না। মা বলতেন, 'অসহ্য কষ্ট হলে ঠাকুরের শেষ দিনগুলো মনে করিস... তারপর মা আর শিষ্যদের অবস্থা মনে করিস'। রমাপদর অত আধ্যাত্মিকতাও ছিল না, মনের জোরও ছিল না। ভাবেই নি এসব। শেষদিকে মা-কে আর মায়ের এই কথাগুলো মনে পড়ত। এখন মনে হয়... মা যেন ভোলা বাঁড়ুজ্জের বউয়ের মত এসব পিছুটান ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে থাকেন। মাকে যেন এভাবে দেখতে না হয়। 

ব্রজেনের জন্য খারাপ লাগল একটু। পুকুরের খোঁচাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। বড়ো সাধের পুকুর ছিল। একসাথে কত মাছ ধরেছে এক কালে। ঘাটে বসে চা-ফুলুরি খেয়েছে একসাথে। পুকুর, জীবজন্তু আর গাছগুলো মরে ভূত হয় না? সবাই কি সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পায়? সম্ভব? হয়ত ওরাও প্রেত হয়ত হয়... কিছু একটা কায়দা আছে তাদের অশরীরীদের খুঁজে বের করার। সেটা শিখতে পারলে ব্রজেনকে আর মন খারাপ করতে হবে না। পুরনো ব্যবস্থা আবার বহাল করা যাবে! ভূত পুকুর, তাতে ভূত মাছ, চারপাশে পরিচিত ভূত লোকজন... পাঁচিল টপকে এপাড়ে চলে আসা সকলের একটা আলাদা জগত। এইসব ভাবতে ভাবতে ব্রজেনের মতই ভেসে উঠে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ধপ করে ডালের ওপর পড়ে গেল রমাপদ। গাছের ডালগুলো হালকা মরমর শব্দ করল, বাতাস বইলে যেমন হয়। এতক্ষণে রমাপদর খেয়াল হল-- আকাশে থালার মত বড়ো একটা চাঁদ উঠছে, তবে নিটোল গোল না... হয়ত কাল পূর্ণিমা। দক্ষিণ দিকে হালকা বাতাসও বইছে। হালকা লালচে মেঘ দ্রুত ভেসে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে চাঁদের কাছ দিয়ে... মাঝে মাঝে তাকে আড়াল করে। টিভি, ছবি, গিন্নি, ঘর সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে তাকাল রমাপদ। আর অমনি... বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমগাছটা নীচে রেখে একটু একটু করে ওপরে চলে যেতে লাগল। নীচে তাকাল না, তাই বুঝতে পারল  না বাড়ি, বাগান, পাড়া... এসব ছেড়ে কতটা ওপরে উঠে এসেছে! জ্যোৎস্নার আলোয় কুয়াশার মত মিহি হয়ে বিন্দু বিন্দু ছড়িয়ে যাচ্ছে আসতে আসতে... আবার জড়ো হয়ে যাচ্ছে পুঞ্জিভূত মেঘের মত। 
আছি, অথচ নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি না... মানে আসলে নেই-- এই স্থিতিকে মানিয়ে নেওয়ার এ যেন এক অলৌকিক অনুশীলন। 
ছোটোবেলা বেসিক ডিস্কে শোনা কৃষ্ণ চন্দ্র দে'র কণ্ঠস্বরে সেই টান ভেসে আসে-- 
কেন কারাগৃহে আছিস বন্ধ
ওরে, ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ
ভবে সেই সে পরমানন্দ, যে আমারে ভালবাসে...



চিত্র- পারমিতা মন্ডল
 

৩টি মন্তব্য:

  1. বাহ্ বেশ ভালো গল্প। ভূতের গল্পের আড়ালে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা। বাস্তব পরাবাস্তবকে মিলিয়ে দেওয়া। সুন্দর ঝরঝরে লেখনী।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. এক অদ্ভুত ভাবনায় নিয়ে গেলে। সাংসারিক অধিকার যে আসলে এক অবয়ব শুধু, তা বারবার ফুটে উঠলো তোমার লেখায়। পার্থিব-অপার্থিব জগতের এক মসৃণ মিশেল প্রকাশ পায় তোমার বর্ণনায়। তৃপ্ত মন যেন মুক্তির খোঁজে।

    উত্তরমুছুন