কলম
আমি পাগল নই। তবে পাগল দেখলে একটু দাঁড়িয়ে যাই। চেনা চেনা লাগে কি না দেখি। চেনা বলতে— নিকট আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, কিংবা আমার চোখ মুখ হাত পায়ের সঙ্গে, তার চোখ মুখ হাত পায়ের কোনও মিল পাই না কি দেখি।
পেলে আমার ভালো লাগে।
মনে হয় এই তো, আবার একটা মানুষ পাওয়া গেছে, এর কাছে থাকা যাবে দু দণ্ড। থাকা বলতে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকে দেখা। কী করছে দেখা, এই আর কী। আমার বন্ধুরা আগে বলত, এটা না কি আমার পাগলামী। ওরা বলে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন—। আমি কিন্তু কোনও অমূল্য রতনের খোঁজ করছি না। আমি শুধু স্রেফ পাগল দেখছি। তাই মানুষজন ঠাওরে নিয়েছে, আমিই না কি পাগল...।
চুপ করে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে থাকি। মাঝে মাঝে কেউ হয়তো বলল, এই পাগলা চা খাবি? আমি হ্যাঁ বা না বলার আগেই সে অর্ডার করে দিল, অ্যাই হারু, শিশু-পাগলকে একটা চা দে।
আমার দাদার নাম বিশু। আর যেদিন থেকে আমাকে ওরা পাগল মনে করল সেদিন থেকে আমি হলাম শিশু। শিশু-পাগল!
আমার দাদা বিশ্বনাথ, বিশু, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এ পাড়ার সবাই ওকে ভালোবাসে। আমি পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না, কিন্তু দাদার মতো ছিলাম না। আমার সেই দাদা হঠাৎ কেমন বদলে গেল। না, না, পাগল নয়, ভীষণ তার্কিক হয়ে উঠল। উরে বাপ রে বাপ! কী কথা, কী তর্ক, কী সমালোচনা! সবার চোখে আঙুল গুঁজে দিল। বড়রা ওকে নিয়ে হাসত। বলত, আমাদের বিশুটা চোখে আঙুল দাদা হয়েছে। চোখে আঙুল দাদা—খুব বিখ্যাত নাটক, জানেন নিশ্চয়। হ্যাঁ সেই চোখে আঙুল দাদা।
কী সব বলত! কী সব লিখত! দাদা ফেসবুকে কিছু লিখলেই হাজারে হাজারে লাইক। শ’য়ে শ’য়ে কমেন্টস। তারপর কত তর্ক বিতর্ক। আমিও দেখতাম। লাইক দিতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম দাদা কোন পার্টি করে? কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী? একদিন দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম—দাদা তুই কোন পার্টির হয়ে লিখিস?
দাদা ওর দাড়িতে হাত বোলাল— আমি মানুষের হয়ে লিখি।
মানুষের হয়ে লেখা হয় নাকি? লেখা তো হয় পার্টির জন্য, পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করার জন্যই লেখা হয়। তবু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আবার জিগ্যেস করলাম। এবার দাদা বলল, মানুষের পার্টি!
আমি সব রাজনৈতিক দলের মোদ্দা কথাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়লাম, আমিও বোঝার চেষ্টা করলাম—ঠিক কোনটা মানুষের পার্টি। দেখলাম সব পার্টি মানুষের কথা বলছে। তাহলে?
খুব ধন্দে পড়েছিলাম, জানেন। কী গেরো রে বাপ সে জট ছাড়াতেই পারলাম না। দিন রাত এক করে ফেললাম। তবু পারলাম না। দাদাকে আরও একদিন জিগ্যেস করলাম, দাদা আমার দিকে মিট মিট করে হাসল। দাদা আমার পাশে বসে ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত মাখছিল— আমাকে অবলীলায় কুসুমটা দিয়ে দিল। বলল, বুদ্ধি খাটা! বুদ্ধি খাটা!
আমি দাদার মতো ব্রিলিয়ান্ট নই। দাদা তার প্রিয় ডিমের কুসুমটা দিল কেন— আমার কি বুদ্ধি কম পড়িয়াছে! কুসুম খেলে কি বুদ্ধি হবে? আমি আগেই বলেছি, দাদা ব্রিলিয়ান্ট, আমি বোকা! এই দেখুন, আমাকে বোকা ভাবতে পারেন, কিন্তু আমি পাগল নই। এখন অবশ্য সবাই বলে শিশু-পাগল।
ছেলে বুড়ো সবাই বলে আমি নাকি পাগল। কী করে পাগল হলাম? ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ জানি। আমি দিন রাত টের পাই। আলো অন্ধকার, শীত গ্রীষ্ম, রোদ বৃষ্টি মালুম পাই। খুচরো পয়সা ও টাকা। সিপিয়েম তৃণমূল বিজেপি চা ও মদের তফাত জানি। তবু আমি পাগল।
এই শিশু পাগলকে একটা চা দে।
দে চা দে, বসে বসে চা খাই।
চা খাই। গান গাই। গুন গুন করে গান গাই। গলা ছেড়ে গাই। ওরা খবরের কাগজ পড়ে। চা দিয়ে খবর ভেজায়, চুক চুক চা আর খবর, ঢক করে গিলে নিয়ে, কিছুক্ষণ ঢেকুর তোলে, বক বক করে, তারপর যে যার মতো তাঁত ঘোরাতে চলে যায়। ওদের সর্বাঙ্গের কোথাও এক টুকরো খবর লেগে থাকে না। অথচ আমার দাদা কোথা থেকে কী খবর পায় কে জানে?
সবাই খবর থালায় ক্রিকেট দিয়ে ভাত মাখে। ফুটবল দিয়ে ভাত মাখে। খুন ধর্ষণ হল ভাজাভুজি। তারিয়ে তারিয়ে খায়। ভাতটাই হল রাজনীতি। সব কিছুর সঙ্গে মেখে, রাজনীতি দিয়েই সব কিছু মাখা হয়। খেতে খেতে বলবে সবাই যেমন বলে, মাংসটা চমৎকার হয়েছে, তেমন ভাবেই বলে দুরন্ত সেঞ্চুরি, চোখ জুড়ানো চার ছয়! বা, খুনটা কিন্তু বেশ টেস্টি, ধর্ষণটা মুচমুচে, এরপরে মাছের টুকরো— তেলাপিয়া মানে ভারতীয় ফুটবল, ইলিশ মাছের পেটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ! আর রাজনীতি হল ভাত। সবকিছুতেই একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে টেনে নিতে হবে। ভাজা দিয়ে, খুন ধর্ষণের সঙ্গে রাজনীতি। মাংসের সঙ্গে ভাত, ঝোলে মাখামাখি রাজনীতি।
রাতের বেলা দাদাকে পুলিস এসে তুলে নিয়ে গেল। দাদা কী সব লিখেছিল। বড় একটা ভ্যান ভর্তি পুলিস এসেছিল। তারা গলির মধ্যে ঢুকতে পারেনি। দাদার কোমড়ে দড়ি দিল না। ওকে বলল—আগে কান ধর শুয়োরের বাচ্চা, নইলে ফেলে পেটে লাথি মারব।
দাদা কান ধরতে ইতস্তত করছিল।
মা দৌড়ে এসে দাদার দু হাত নিয়ে ওর কানের কাছে তুলে দিল। বলল, ও কান ধরেছে বাবা—ওকে মেরো না।
পুলিসগুলো বলল, কান ধরে হাঁট! তারপর তোকে নিয়ে গিয়ে ল্যাংটা করে ঝোলাব!
সবাই ভাবল, নয় চুরি, নয় ডাকাতি, খুন ধর্ষণও হতে পারে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না।
এ এলাকায় যে মদ বিক্রি করে সেই ভুসোদা এসে পুলিসকে বলল, ‘কী হয়েছে স্যার?’
পুলিসস্যার কোনও উত্তর দিল না।
এলাকার সাট্টা পেনসিলার কালিদা এসে পুলিসকে বলল, ‘কী হয়েছে কুন্ডুবাবু!’
কুণ্ডুবাবু কালিদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মালডারে চিনস? ন্যাতা মন্ত্রীদের পন্দে কাঠি দিসসিল। গরম গরম কথা ল্যাখতাসিলো ফেসবুকে। সাইবার কেস— জটিল ঘা!’
পরে কালিদাই পাড়ার সব্বাইকে খোলসা করে বলল, ‘চুরি ডাকাতি খুন টুন নয়—এ হল সাইবার ক্রাইম— বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি হলে যা হয়!’
কালিদার কথা টপ করে বুঝে ফেলল, ভুসোদা। বলল, ‘বুঝেছি। বুদ্ধিবিচি কেস!’
আমার দাদা বিশ্বনাথ পুলিস লকআপেই পাঁচ দিন পড়ে থাকল। কোর্ট উকিল। মায়ের গলার হারটা বিক্রি করতে হল। প্রায় তেরোদিন থানা পুলিসের চক্কর কেটে দাদা ফিরল। ফিরে চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। ঘর থেকে যখন বেরুল তখন অন্য মানুষ। যেন কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। চুপচাপ বেরিয়ে পড়তে গেল ঘর থেকে। মা আটকাল, ‘কোথায় যাচ্ছিস বাপ?’
‘চায়ের দোকানে।’
‘চা খাবি? আমি তোকে করে দিচ্ছি।’
‘সিগারেটও খাব।’
‘সিগারেট!’ মা ঢোঁক গিলল। ‘শিবনাথকে বলছি ও এনে দেবে।’
বিশ্বনাথের ভাই শিবনাথ।
‘এখানে জমবে না—হারুর দোকান চাই।’ দাদা বলল।
‘হারুর দোকান কী করে এনে দেব বাবা?’
‘কেন ক্লোন করে।’
‘ক্লোন!’ মা ফোন জানে। ক্লোন কী জিনিস জানে না। মা বলল, ‘ক্লোন কী রে?’
দাদা নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘এই যে আমি!’
‘তুই কী?’ মা জানতে চাইল।
‘আমি বিশ্বনাথ নই, বিশুর ক্লোন। আমার নাম শিশু!’
মা ঘাবড়ে গেল। সেদিন থেকে দাদা মাকে পাখি পড়ার মতো করে বুঝিয়েই যাচ্ছে, সে বিশু না। সে বিশুর ক্লোন, শিশু।’
কিন্তু মা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। মাও বলে যাচ্ছে, ‘না তুই বিশু। কে শিশু আমি চিনি না।’
বিশু হাসে, ‘বিশু আর নেই, ভ্যানিস। এখন যাকে দেখছ, যে আছে সে বিশুর ক্লোন—শিশু!’
মা বিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেমন করে মানুষ কলম করা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা দাদার গায়ে মাথায় হাত বুলায়, বলে, ‘হ্যাঁ রে ওরা তোকে বুঝি খুব মেরেছে?’
‘ওরা আমাকে মারবে কেন?’
মা বলল, ‘তাহলে?’
বিশু হো হো করে হাসল, ‘বিশুকে ল্যাংটা করে শুধু ওঠবস করিয়েছে— বলেছে এখন থেকে তুই আর বিশু নোস, সব্বাইকে বলে দেব— বিশুকে দেখতে পেলেই ল্যাংটা করে ওঠবস করাতে। তুই বিশুর ভাই শিশু হয়ে যা। তুই ভালো ছেলে—নইলে তোকে খুন ডাকাতি রেপ নকশাল অনেক কেস দিতে পারতাম। দিচ্ছি না, সেরেফ কলম করে দিলাম। এবার তুই বিশুকে বাদ দে শিশু হয়ে বাঁচ।’
ছিলাম দুই ভাই। হলাম তিন। বিশু, শিশু ও আমি শিবনাথ।
শিশুর নামে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখানে শিশু গুডমর্নিং, গুডনাইট, বাজি পুড়লে মা কালী, শীত এলে কমলালেবু আর যিশুর ছবি দেয়।
আর বিশু নেই। তবে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা আছে। বিশুকে দেখতে পেলেই পুলিস বলেছে ল্যাংটা করে কান ধরে ওঠবস করাবে। তাই নেই হয়ে যাওয়ার আগেই সেই অ্যাকাউন্ট ল্যাংটা করে দিয়েছে। সেখানে কিচ্ছু নেই। শুধু একটা ল্যাংটা ছেলে হিসি করছে—।
মাঝে মাঝে শিশু জিগ্যেস করে শিবনাথকে—ওই বাচ্চাটার হিসি কোথায় পড়ছে? শিবনাথ বোকা। ফিসফিস করে জবাব দেয়, নেতাদের মুখে।
শিশু হাসে, হল না।
তবে?
পাবলিকের মাথায়। ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন