অন্ধকার গুহাপথ
সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ কলিং বেলের শব্দে অবাক হয়ে বেরিয়ে দেখলাম রীতিকা দাঁড়িয়ে আছে। এত সকালে রীতিকা কেন? কী এমন দরকার পড়ল এখন? মেয়ের পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে এলেও এত সকালে কখনও আসেনি আগে। দরজা খুলে দাঁড়াতেই ছলছলে চোখে রীতিকার প্রশ্ন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, দাদা শুনেছেন খবর?
খবর! মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কোনও খারাপ খবর বয়ে এনেছে। অজানা আশঙ্কায় আমার ভেতরটা নড়ে উঠেছিল। কীসের খবর? সংশয় নিয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিলাম।
শ্রাবস্তীর খবরটা… রীতিকার গলা কেঁপে যায়।
কে শ্রাবস্তী মনে করতে পারছিলাম না তখনই। তবু অশুভ সংবাদের ইঙ্গিত থাকায় শ্রাবস্তীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। তার বদলে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কী হয়েছে শ্রাবস্তীর?
কাল রাতে গলায় দড়ি দিয়ে… কথা শেষ করতে পারেনি রীতিকা। কান্নায় জড়িয়ে গিয়েছিল গলা। আমি ব্যস্ত হয়ে ওকে ঘরে আসার পথ করে দিয়েছিলাম। ততক্ষণে আমার স্ত্রী পুষ্পিতা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি খেয়াল করিনি। অস্ফুটে উচ্চারণ করেছিল, বাপ্পাদার মেয়ে?
ভেজা কণ্ঠে রীতিকার জবাব, হুঁ, বাপ্পাদার মেয়ে। কাল রাতে সিলিং ফ্যান থেকে… স্কিপিংয়ের দড়ি দিয়ে…
শ্রাবস্তী সুইসাইড করেছে? ঐটুকু মেয়ে! আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল পুষ্পিতার গলা।
কোনওমতে টলতে টলতে বাড়ি ফেরার আগে রীতিকা জানিয়েছিল ওর শোনা বৃত্তান্ত। কাল রাতে আত্মহত্যা করেছে মেয়েটা। দোতলায় নিজের ঘরে একাই ঘুমোয় শ্রাবস্তী। অনেক রাতে বাপ্পা ল্যাপটপে অফিসের কাজ সেরে ছাদে যাচ্ছিল সিগারেট টানতে। সেইসময় শ্রাবস্তীর ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়েছিল একমাত্র মেয়ের ঝুলে-পড়া দেহ। তারপর হইচই চেঁচামেচি করে, প্রতিবেশীদের সাহায্যে দড়ি কেটে নামিয়েও এনেছিল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
পুরো ঘটনাটা আমাদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। দ্রুত পায়জামার ওপরে টি-শার্ট গলিয়ে ছুটেছিলাম বাপ্পাদের বাড়িতে।
বাপ্পা আমার বাল্যবন্ধু। একই পাড়ায় থাকলেও একেবারে কাছাকাছি বাড়ি নয় আমাদের। যেতে মিনিট দু-তিন সময় লাগে। তাছাড়া আমাদের এলাকায় পাশাপাশি অনেকগুলো গলিপথ আছে। দুটো গলি পেরিয়ে বাপ্পাদের বাড়ি। এইসব কারণেই এইরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের কান পর্যন্ত তখনও পৌঁছয়নি।
রীতিকা আমার বন্ধু সুশান্তের স্ত্রী। সুশান্ত আর আমি আলাদা স্কুলে পড়তাম। কিন্তু নিকট প্রতিবেশী হিসাবে আমাদের দুজনের জমাট সম্পর্ক। চাকরি, সংসার প্রভৃতি নানা ব্যস্ততায় দেখাসাক্ষাৎ কম হত, ফলে সম্পর্কও আলগা হয়ে পড়েছিল। পরের দিকে আমার ছেলে আর সুশান্তর মেয়ে এক ক্লাশে পড়ে, এমনকি একই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার সুবাদে যোগাযোগটা বেড়েছে। আমাদের দুজনের থেকেও রীতিকা আর পুষ্পিতার সম্পর্ক অনেক বেশি জোরালো। ওরা দুজনেই ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে নানা আলোচনা হয়।
(২)
শ্রাবস্তীর ডাকনাম বুচকি। আমি ওকে ডাকনামেই চিনতাম। আমার ছেলের থেকে দু-ক্লাশ নিচে পড়ত। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো মেয়েটি। চমৎকার নাচ করত। প্রতি বরিবার আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে নাচের ক্লাশে যেত মা-মেয়ে। মাঝেমধ্যে আমার বা পুষ্পিতার সঙ্গে ওদের দুজনেরই কথা হত।
বাপ্পার বাড়িতে গিয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল। আমার বন্ধুর মেয়ে; আমারই মেয়ের মতো সে। কী এমন যন্ত্রণা ছিল যে বয়ে বেড়াতে না-পেরে ঝুলে পড়তে হল? কীসের চাপ ছিল যে সহ্যই করতে পারল না? নানা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঝিঁঝিপোকার মতো বেজে চলেছিল। বাপ্পা বা ওর স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। হাত-পা কাঁপছিল আমার। বুকের মধ্যে হু হু হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। পুষ্পিতা বাপ্পাদের বাড়িতেই থেকে গেল, কিন্তু আমি আর থাকতে পারিনি সেখানে। ঘরে ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। স্বভাবতই অফিসে যেতে পারিনি, বুকের মধ্যে সারাদিন অবিশ্রাম বৃষ্টি ঝরে গেছে।
সন্ধ্যার আলোছায়া মুছে দিয়ে দিনটা যখন রাতের অন্ধকার গুহাপথে ঢুকে পড়েছে, সেইসময় বুচকির কাটাছেঁড়া করা দেহটা ফিরে এসেছিল ওদের বাড়িতে। দুঃসংবাদ হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় শিমুল তুলোর মতো। সেইরকমই ভেসে ভেসে আমার কানে পৌঁছল ‘বডি এসে গেছে’। একটা ফুটফুটে মেয়ের জীবন্ত শরীর ‘বডি’ হয়ে গেল!
আবার ছুটে গেলাম বাপ্পাদের বাড়ি। আমি গেলাম না ঠিক, কে যেন আমার পা দুটো টেনে নিয়ে গেল। সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যেই দেখতে পেলাম বুচকির মুখ ছাড়া সম্পূর্ণ শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। উঠোনের মাঝামাঝি শুয়ে আছে। ওর মুখে ঘুমের প্রশান্তি লেগে আছে যেন। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কান্না ঠেলে আসছিল। অত্যন্ত ক্ষিপ্র পায়ে ফিরে এসেছিলাম ঘরে। ফেরার সময় চকিতে কি একবার বুচকির সাদা ফ্যাকাসে পা জোড়াও চোখে পড়েছিল? আমার ঠিক মনে নেই।
লকডাউনের সময়কাল থেকে অনলাইন ক্লাশ শুরু হয়েছে ছেলের। সেই কারণেই প্রবল অনিচ্ছাতেও মোবাইল কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার চাইতে পুষ্পিতার অনিচ্ছা বেশি ছিল। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হলে এছাড়া পথ খোলা ছিল না আর।
আমাদের সময় মাধ্যমিকের পরের সময়টুকু আমরা বেশিরভাগই আড্ডা মেরে, ঘুরেফিরে বা নানাভাবে কাটিয়ে দিতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিকের পরেপরেই একাদশের পড়াশোনা শুরু করে দেয়। আমার ছেলেও শুরু করে দিয়েছে প্রাইভেট টিউশন পড়া। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইন ক্লাশও চলছে সমান তালে। ফলে ছেলের কাছেই থাকে তার মোবাইল। ছেলেকে কখনো-কখনো মোবাইলে গেম খেলতে দেখেছি। ইলেভেনে পড়ছে অথচ পড়াশোনায় তেমন মন না-দিয়ে গেম খেলছে বলে অনেক সময় বকাবকি করি। অভিমান করে কখনও খেতে চায় না পর্যন্ত। ওর মা বুঝিয়েসুঝিয়ে খাওয়ায়। এসব ভাবনা মাথায় ধাক্কা মারতে থাকে। একটু বকাবকিও করা যাবে না নিজের আত্মজকে!
ছেলে আমার মায়ের সঙ্গে ঘুমোয় অনেকদিন হল। ও ঠাকুমার সঙ্গে ঘুমোতে ভালোবাসে। আমরাও বাধা দিইনি। আমার মা নানা গল্প বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে নাতিকে প্রশ্রয় দেন। ফলে নাতির প্রতি ঠাকুমা যেমন দুর্বল, নাতিও ঠাকুমাকে বেশিই পছন্দ করে। হয়তো আমাদের থেকেও বেশি ভালোও বাসে।
সারারাত ঘুমোতে পারিনি। গতরাতেও তো ছেলেকে মোবাইলে গেম খেলা নিয়ে বকেছি খানিকটা! মধ্যরাতে উঠে গিয়ে মায়ের ঘরের জানালা দিয়ে দেখে এসেছি ছেলেকে। স্লিপিং লাইটের আবছা আলো ছেলের ঘুমন্ত মুখে পড়েছে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছি। ঘরে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেও ঘুম আসতে চাইছিল না। আবার উঠে গিয়ে ছেলেকে দেখে এসেছি। অনেক সময় চেনাপরিচিতের আত্মহননের প্রভাব পড়ে। তাই কি সতর্ক হচ্ছিলাম! অস্থির অস্থির লাগছিল। পাশে শুয়ে বারবার নড়াচড়া আর পাশ ফেরা দেখে মনে হচ্ছিল পুষ্পিতাও ভীষণ উদ্বিগ্ন। একবার চোখ লেগে এসেছিল। পুষ্পিতা তখন উঠে গিয়েছিল বাইরে। বাথরুমে, নাকি ছেলেকে দেখে আসতে, বুঝতে পারিনি। তারপর থেকে আর ঘুম আসেনি। নিজের ভেতরে মেঘলা আকাশ নিয়ে রাত কাটিয়েছি। অপেক্ষা করেছি ভোরের আলো ফোটার।
(৩)
প্রাইভেট টিউটরের সাম্মানিক ছেলের হাত দিয়ে কখনোই পাঠাই না। সাদা খামে ভরে নিজে হাতে দিয়ে আসি। সেইসময় ছেলের পড়াশোনার খোঁজখবরও নিতে পারি। পুষ্পিতাকে সেসব খবর জানাই। দুজন স্যার আছেন যাঁদের হাতে হাতে টাকা দিতে হয়। বাকি দুজনের অনলাইন পেমেন্ট।
রবিবারের সকাল। বুচকির আত্মহত্যার ঘটনা পনের-ষোলো দিন গড়িয়েছে মাত্র। ফিজিক্স স্যার মৃগাঙ্কবাবুকে টাকা দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ চোখ পড়ল ‘বন্ধু কজন’ ক্লাবের পিছনের জারুল গাছটার নীচে। গোল করে সিমেন্টের বেদি করা। বাপ্পা বসে আছে সেই বেদিতে। পাশে দাঁড় করানো সাইকেল।
এর মধ্যে একবারও বাপ্পাদের বাড়িতে যেতে পারিনি। পুষ্পিতা দু-তিনদিন গিয়েছিল। বাপ্পা বা ওর স্ত্রী পল্লবীর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল জানতে চাইনি। আমি বোধহয় এই প্রসঙ্গটা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই চেয়েছিলাম। তবু ঐ জায়গায় বাপ্পাকে বসে থাকতে দেখে বাইক দাঁড় করিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। একেবারে পাশে এসে দাঁড়ানোয় বাপ্পার চোখ পড়ল আমার ওপর। নির্লিপ্তভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বোস অঞ্জন। এখানে প্রতিদিন একবার করে আসি। সময় কেটে যায়…
এত দূরে আসিস কেন?
এই মাঠে একবার সারা বাংলা নৃত্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল জানিস! বুচকি খ বিভাগে ফার্স্ট হয়েছিল। আমার প্রশ্নের জবাবের বদলে বাপ্পা মেয়ের কথা বলে।
অনিবার্যভাবে বুচকির নানা প্রসঙ্গ তুলে আনে বাপ্পা। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে। কী বলব বুঝে উঠতে পারি না। চুপচাপ বাপ্পার পাশে গিয়ে বসি। এই শোক, এই যন্ত্রণার কোনও সান্ত্বনা হয় না। আমি আচমকা বলে বসি, তুই নাকি অফিসে যাচ্ছিস না?
নাহ্। এখনও যাইনি। যেতেই ইচ্ছে করছে না। কী করব বল!
সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে নয়, খানিকটা জ্ঞান দেওয়ার ঢঙে বলে ফেলি, নিয়মিত অফিসে যা বাপ্পা। কাজের মধ্যে থাক। ভোলার চেষ্টা কর ভাই। এভাবে কি চলে রে? তোর মা আছেন, পল্লবী আছে। অথর্ব ভাইটার কথাও ভাবতে হবে তো!
মৃত মাছের চোখের মতো স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে বাপ্পা। আমার ভেতরে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায়। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে, ভোলার চেষ্টা! ভোলা কি যায় অঞ্জন? মনে ঠিকই থেকে যায়। কাজের মধ্যে থাকলে মন কিছুটা অবসর পায়।
সেটুকুও তো দরকার ভাই! বোঝার চেষ্টা কর বাপ্পা। কথাটা বলেই চুপ করে থাকি। আর কী কী বলতে পারে সে ভাবনা আসে মাথায়। প্রতি-উত্তরে আমি কী জবাব দেবো, সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করি মনে মনে। তার মধ্যেই বাপ্পা বলে ওঠে, বড্ড চাপা মেয়ে ছিল আমার মেয়েটা। কিছুই বলত না। ওর মায়ের সাথে কিছু কিছু কথা হত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ধূপের আগুন ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল, সেটুকুও বলেনি ওর মাকে।
বাপ্পার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। মুখ ফিরিয়ে থাকি অন্যদিকে। বাপ্পা বিড়বিড় করে বলে যেতে থাকে মেয়ে সম্পর্কিত নানা কথা। যেন আমাকে নয়, নিজেকেই বলছে।
আমরা ওকে পাড়ার কারও সঙ্গেই মিশতে দিতাম না। একা একাই ঘরে থাকত। ছবি আঁকত। কী সুন্দর করে প্রকৃতি আঁকতে পারত! ওর ঘরের দেওয়ালে বাঁধানো ছবি আছে দুটো। ওর আঁকা।
নিজেই বলছে। নিজেই খানিকটা বিরতি নিচ্ছে। আমি মুখ ফিরিয়ে থাকা এক নিশ্চুপ শ্রোতা।
কী এমন কষ্ট ছিল বুচকির কে জানে! আমকে বা ওর মাকে বললে কি তার কোনও সুরাহা হত না? কোনও সমাধান কি বেরিয়ে আসত না?
অসহ্য লাগছিল বাপ্পার সঙ্গ। কিন্তু উঠে আসতে পারছিলাম না। খড়কুটোর মতো মনে ভেসে আসা শব্দগুচ্ছ আঁকড়ে ধরে বলি, আচ্ছা বাপ্পা, আমারও তো ছেলে আছে। আমার ধারণা আমি ওকে বুঝি। ওর চাহিদা জানি। ওর ভালোলাগা, মন্দলাগা বুঝি। সত্যিই কি বুঝি? আমরা কি এই প্রজন্মকে বুঝতে পারছি না? আমাদের বাবা-মা তো বুঝতেন আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে! তাহলে আমরা কেন বুঝতে পারছি না?
আমাদের বাবা-মাও বুঝতেন না অঞ্জন। আমাদের মতামত কি জানতে চাইতেন সবসময়? চাইতেন না। নিজেদের সিদ্ধান্তেই আমাদের চালাতেন বেশিরভাগ। তবু তো আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠিনি! অসুখী হতে পারিনি সেভাবে! আর ওরা, কীরকম অভিমানী দেখ!
অসহিষ্ণু! অভিমানী! কী অবলীলায় শব্দগুলো বলে ফেলল বাপ্পা! এভাবে তো ভাবিনি! সত্যিই কি ওরা অভিমানী? কী জানি! তাহলে কি আমিও আমার ছেলেকে ঠিকঠাক বুঝতে পারি না? ভাবনাগুলো আমার ভেতরে বুদবুদের মতো ভেসে ওঠে। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়, অতিমারির সময়কালে স্কুলযাত্রাহীন, প্রায় গৃহবন্দি ছেলেমেয়েরা কি নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ হারিয়ে একা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ?
সেইসময় বাপ্পার কথা যেন হাওয়ার ডানায় ভেসে এল। এখন বড্ড ফাস্ট লাইফ অঞ্জন। ওরা ফাস্ট লাইফের ঘোড়ার কেশর ধরে দৌড়োচ্ছে। আমরা ধরতে পারছি না ওদের। অবশ্য আমরাই ওদের ছুটতে উৎসাহ দিয়েছি বারবার, সেটাও ঠিক।
জেনারেশন গ্যাপটা বড্ড বড় হয়ে গেছে বাপ্পা! কিছুতেই ছুঁতে পারছি আমরা। সময় এতটা বদলে গেল? কথার পৃষ্ঠে কথা বসাতে চেষ্টা করলাম আমি। বাপ্পা কী ভাবছিল জানি না। আমিই-বা কী ভাবছিলাম এরপর মনে নেই। শুধু দুজন দুদিকে তাকিয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ।
বাপ্পা আর আমি এক স্কুলে পড়তাম। একই পাড়ায় বড় হয়ে উঠেছি। তবু বাপ্পার সাথে তেমন সখ্য ছিল না। ওর ছিল কমার্স। আমার সায়েন্স। মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটুকু মুছে গিয়েছিল পাশ করার পরে। আমরা যারা সায়েন্স নিয়ে পড়তাম, তারা মনে করতাম কমার্স বা আর্টস নিয়ে যারা পড়ে, তারা আমাদের থেকে খানিকটা নীচু। তাই ওদের এড়িয়ে চলাই ছিল আমাদের কাজ। সেই ভাবনা যে কতটা অসার ছিল, বড় হয়ে বুঝেছি নানা ঘাতপ্রতিঘাতে। সেই বোঝা-না-বোঝা ছাড়িয়ে আমরা দুই পিতা বসেছিলাম এক গাছের নীচে, একই বেদিতে।
নীরবতা ভাঙল বাপ্পাই। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো বাড়ি যাচ্ছিলি। আজ রবিবার। অনেক কাজ থাকে। বাড়ি ফিরে যা।
দুঃসহ আলোচনায় ইতি টেনে দিল বাপ্পা। আমি স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই বাড়ি যাবি কখন?
যাব। আর একটু বসি।
বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরতে থাকি আমি। বাড়ি নয়, আমি যেন বিরাট এক গহ্বরের দিকে এগিয়ে চলেছি। অন্ধকার গুহাপথে ঢুকে যাচ্ছে আমার বাইক। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো লাগে। বাইক দাঁড় করিয়ে প্রতিবেশী বঙ্কুদার বাড়ির সামনের কালভার্টে বসে পড়ি। বুঝতে পারি, কালভার্ট সমেত অন্ধকার গুহাগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছি আমি…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন