রম্যে রবীন্দ্রনাথ
রম্য কথাটির আভিধানিক অর্থ হলো যা সুন্দর , মনোহর আর রমনীয়। ফরাসী শব্দ " Belles letters" এর প্রতিশব্দ হিসেবেই "রম্যরচনা" শব্দটির আবির্ভাব বলে ধরে নেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে যে ইংরেজি সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক জোনাথন সুইফট হলেন সেই লেখক যিনি "রম্যরচনা" বিষয়টির প্রথম অবতারণা করেন। তবে ফরাসী শব্দটি ব্যাপকার্থে কাব্য বা নাটক কেই বোঝাত। পরবর্তীকালে অবশ্য লঘু চালের শৈল্পিক রস সাহিত্যকেই রম্যরচনা রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আগে মনে করা হতো রম্যরচনায় আবেগ , অনুভূতি , পান্ডিত্য বা মেধা নিতান্তই কম; যা আছে তা অবান্তর এক প্রকারের ছ্যাবলামো। কিন্তু আমাদের প্রিয়তম লেখকের মতে " রম্যরচনা হলো বাজে কথার প্রবন্ধ",আর " অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়।"
বাংলা সাহিত্যের রম্যরচনার ধারাটি কিন্তু মোটেই ক্ষীণাঙ্গী নয় । বিস্মৃতপ্রায় প্যারিচাঁদ মিত্র , কালীপ্রসন্ন সিংহ , বিদ্যাসাগর থেকে শুরু হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র , প্রমথ চৌধুরী , সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায়, রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় , শিবরাম চক্রবর্তী , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় , তারাপদ রায় পেরিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিংবা নবনীতা দেবসেন পর্যন্ত প্রত্যেকের রচনাতেই সর্বোত্তম শ্রেনীর রম্যের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এইসব কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু রম্যরচনা নিয়ে সবিশেষ আলোচনা করবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবার জন্য মোটেই নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো রবীন্দ্রনাথের লেখায় রম্যচিন্তার প্রকাশ নিয়ে কিছু কথা লেখা যা নিশ্চিত ভাবেই একপ্রকারের গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো হিসেবেই ধরা যেতে পারে। তবে রম্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খুব একটা বেশি লেখা পড়িনি এ যাবৎ । হয়ত কোনও সময় এ বিষয় নিয়ে বিস্তৃত কাজ হবে । সে আশা নিয়ে ছোট একটি ফ্রেম ওয়ার্কের মধ্যে বিষয়টি ধরবার একটি ক্ষুদ্র এবং সীমিত প্রচেষ্টা করছি। আসলে কিনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু বহু কাজ হয়ে থাকে। অনেকেরই জীবন জুড়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ । আমাদের শহরের শামুদাতো রবীন্দ্রনাথের লেখার কোলাজ করে করেই কত যে অনুষ্ঠান করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাই একসময় তার নামই হয়ে যায় ভাঙা শামু। আমি কৌতুক প্রিয় তাই আমার কাছে বিশ্বকবির এই দৃষ্টিভঙ্গিটি বড্ড বেশি করে ধরা পড়ে। জানিনা আর কারও সাথে এটা ঘটে কিনা। হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যায় এ প্রসঙ্গে। কিন্তু আমার পরিসর সীমিত তাই আশা করছি এই অপ্রতুলতা পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
পাশ্চাত্য মত অনুযায়ী হাস্যরস মূলতঃ চারপ্রকার। হিউমার , উইট , স্যাটায়ার এবং ফান। সবাই হয়ত জানেন যে হিউমার মৃদু এবং গভীর , তার ভেতরে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে অশ্রুজল। সেখানে উইট মননশীল,পরিশীলিত ,তীব্র এবং তীক্ষ্ম। স্যাটায়ার অবশ্যই আক্রমণাত্মক এবং ফান অপেক্ষাকৃত স্থুল রূচির কৌতুকরস। আবার হিউমার যেখানে বিশুদ্ধ হাস্য রসাত্মক সেখানে উইট অবশ্যই কিছুটা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপাত্মক। হিউমার অনেকাংশেই নির্মল হাসি। "উইট হচ্ছে গোলাপ স্পর্শ করতে গিয়ে কাঁটার আঘাত"। আর রবীন্দ্র রচনাতে এই উইট এবং হিউমার দুটোই এসেছে বহুল পরিমানে। তার সাথে বিশ্বকবির প্রসন্ন দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়। এ সব কিছু খুঁজতে হলে ডুব দিতে হবে তার রচনাতে। আমরা আদার ব্যাপারী মাত্র। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গভীর আলোচনা করবার সামর্থ্য নেই ধরে নিয়েই ভয়ে ভয়ে কিছু প্রসঙ্গের উল্লেখ করতে বড়ই সাধ জাগে। কারণ আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে রবীন্দ্রনাথের রম্যচিন্তা বা রম্যলিখন বিষয়ক মুন্সিয়ানা শুধুমাত্র পঞ্চভূত বা বিচিত্র প্রবন্ধের লঘু চালের রচনাগুলির মধ্যেই আবদ্ধ নেই।
তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বিচিত্র প্রবন্ধ কিংবা পঞ্চভূতের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলোতে হিউমার আর উইট দুটোই ব্যবহৃত হয়েছে বহুল পরিমাণে। দুটো উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। জাহাজ ভ্রমণ বৃত্তান্তের বর্ননা দিতে তিনি বলছেন...
মরিলাম না বটে কিন্তু যমরাজের মহিষের কাছ হইতে একটা রীতিমতো ঢুঁ খাইয়া ফিরিলাম। কর্ত্তা বাবু রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “সমস্তই মাঝির দোষ,” মাঝি কহিল, তাহার অধীনে যে ব্যক্তি হাল ধরিয়াছিল তাহার দোষ। সে কহিল, হালের দোষ। হাল কিছু না বলিয়া অধোবদনে সটান জলে ডুবিয়া রহিল-গঙ্গা দ্বিধা হইয়া তাহার লজ্জা রক্ষা করিলেন।"
আবার পরনিন্দা প্রবন্ধটিতে বলছেন...
" পরনিন্দা পৃথিবীতে এত প্রাচীন এবং এত ব্যাপক যে, সহসা ইহার বিরুদ্ধে একটা যে-সে মত প্রকাশ করা ধৃষ্টতা হইয়া পড়ে।"
অথবা হিন্দু গায়নরীতিতে পাশ্চাত্য প্রভাবের বিরোধিতা প্রসঙ্গে লিখতে বসে ক্ষুরধার উইটের অবতারণা করা হয়েছে...
"আমরা স্পষ্টই দেখ্তে পাচ্চি আমাদের দেশে গান জিনিষটা চল্ছে না। ওস্তাদরা বল্ছেন, গান জিনিষটা তো চল্বার জন্যে হয় নি, সে বৈঠকে ব’সে থাক্বে তোমরা এসে সমের কাছে খুব জোরে মাথা নেড়ে যাবে।"
কিন্তু এইসব সুনির্দিষ্ট রম্যরচনার মধ্যে রসিক রবীন্দ্রনাথকে কখনই বেঁধে ফেলা যায়না। তার রচনায় রম্যরস বারে বারে এসেছে। এসেছে গল্পগুচ্ছে, এসেছে উপন্যাসে ,এসেছে নাটকে কিংবা জীবনস্মৃতির পাতায় পাতায়। রসিক কবি অবশ্য কৌতুক রস সম্পর্কে লিখে গেছেন যে চারিদিকের যথাযোগ্যতার মাঝে হঠাৎ করে যদি অসংগতির উদ্রেক হয় তবেই চিত্তপ্রবাহ দুর্নিবার হাস্যতরঙ্গে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এই হাস্যতরঙ্গ যে সবসময় উচ্চকিত হতে হবে তা তো নয়। রবীন্দ্রনাথ অতি সিরিয়াস কিছু গল্পের মধ্যেও অবতারণা করেছেন কিছু রম্যভাবের যা তার মেধা ও পরিশীলিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। মেঘ ও রৌদ্র গল্পে পাঠরত শশিভূষণের কাছে গিরিবালার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাটি অতি মনোগ্রাহী এবং মৃদু কৌতুকসূচক।
আবার ধরা যাক ছুটি গল্পটির কথা।গল্পের প্রথমদিকে বালকদের খেলাধূলার প্রকার ও ভাবসাব নিয়ে যে অদ্ভুত কৌতুকরসের সৃষ্টি করা হয়েছে তা লেখকের শিশুচরিত্রের অনবদ্য বিশ্লেষণ । পড়তে পড়তে মনে নির্মল আনন্দের সঞ্চার ঘটে। আবার এক একটি বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বকবির মেধা এবং কৌতুকপ্রিয়তা। যেমন গ্রাম থেকে শহরে যাবার সময় ফটিকের কার্যক্রমের বর্ণনা ।
" ফটিকছড়ির ফটিক অবশেষে যাত্রাকালে আনন্দের ঔদার্য-বশত তাহার ছিপ ঘুড়ি লাটাই সমস্ত মাখনকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া গেল।"
এই রকম প্রচুর বাক্যের ছড়াছড়ি গোটা গল্পগুচ্ছ জুড়ে। বাক্যগুলোর গঠন সৌকর্য এবং গভীরতর অর্থ পাঠককে শুধুমাত্র কৌতুকাপন্নই করেনা ভাবতে বাধ্য করে। যেমন হৈমন্তি গল্পে বিবাহের তাড়ার কারণ সম্পর্কে লেখা হয়েছে...
"মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া। "
আবার পাত্র ও পাত্রী গল্পে কথক নিজের সম্পর্কে বলছেন...
" আমি কৌমার্যের লাস্ট বেন্চিতে বসে শূন্য সংসারের কড়িকাঠ গণনা করে কাটিয়ে দিলুম।"
এইরকম প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যায় অতি সহজেই। আবার কৌতুক নাটিকার মধ্যে "চিরকুমার সভা" যেমন প্রতি পদে পদে ক্ষুরধার কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে রম্য আবহের সৃষ্টি করে তেমনই তাসের দেশ নাটকে খানিক উইট আর কিছু স্যাটায়ারের অমোঘ প্রবেশ লক্ষ্য করা যায়। শেষের কবিতা উপন্যাসে তো অমিতের মুখে দুর্দান্ত এক একটি রম্য ও বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যের ব্যবহার পুরো রচনাটিকেই একটি অপূর্ব স্তরে উন্নীত করেছে।
আবার লেখকের বয়ানে বক্র কৌতুকেরও কমতি নেই। যেমন ধরা যাক সিসি লিসির বর্ণনা । অমিতের বোন সিসি এবং লিসিকে দেখে মনে হয়...
"ফ্যাশানের পসরায় আপদমস্তক যত্নে মোড়ক করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট বিশেষ"।
সিসির উচ্চহাসির উচ্ছ্বাসে যোগ দেওয়াটাকে তাদের কুকুর ট্যাবিও তার সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করে ।
কবি তার ছোটবেলার কথাও যখন লিখতে যান এই ভাবেরই প্রাধান্য দেখা যায়। রসিয়ে রসিয়ে লেখা তার ছোটবেলার স্মৃতি বড়ই স্বাদু ।মাস্টারমশাইদের আচরণ , পোড়োদের কীর্তি , পুরোনো কলকাতার বিবরণ, বউ ঝিদের ফ্যাশানের গপ্পো, দুপুরবেলায় বঙ্গদর্শন নিয়ে কাড়াকাড়ি সবকিছুই লিখেছেন আদ্যোপান্ত রস মিশিয়ে। আসলে কিনা রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়লে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় জীবন নেহাতই বিশুষ্ক, গম্ভীর কিংবা কর্তব্যের নিগড়ে বাঁধা কোনও নৈতিকতার পাঠ নয় বরং অল্পবিস্তর রম্য ভাবেরও বিস্তারপথ। তাই বোধহয় রম্যভাবকে কখনোই উপেক্ষা করেননি তিনি।
অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ লেখ। এমন প্রবন্ধ তোমার কলমে আরও চাই।
উত্তরমুছুন