অচিন আঁধার
— এতটুকু বাচ্চাকে তুমি মারলে!
গার্গী তার স্বভাবগত মৃদু কন্ঠস্বরের বদলে বেশ জোরেই বলে ফেললেন কথাগুলো।
— আমি এভাবেই শাসন করি।, থেমে থেমে কেটে কেটে এই কথা ক'টা বলেই অভিরূপ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
গত সাতদিন ধরে আনন্দের যে হাওয়া বইছিল সমস্ত বাড়ি জুড়ে, এক নিমেষে সবটুকু গুমোট হয়ে উঠল যেন।
গীত অবশ্য পরিস্থিতিটাকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল।
— আসলে কী জানো তো মা, সারাদিন এত কাজের প্রেসার থাকে অভিরূপের, নার্সিংহোমে, চেম্বারে রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। বাড়িতে একটু ওয়েল অর্গানাইজড চায় সবকিছু। এই আর কি ...
নাহলে তুমি তো জানোই মা, আহেরি অন্ত প্রাণ ওর পাপার।
গার্গী উত্তর দিতে গিয়েও চুপ করে যায়। আহেরি তখনও দিম্মার কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
— আহেরি, স্টপ ক্রাইং।গো ইনসাইড ।, গীত এবার মেয়েকে ধমকে চুপ করাতে চায়।
মল্লিকা... আহেরিকে ভেতরে নিয়ে যাও। ড্রেশটা পাল্টে স্লিপিং স্যুট পরিয়ে দাও। আর হ্যাঁ, ব্রাশ করাতে ভুলবে না।, পরমুহূর্তেই নির্দেশ ছুড়ে দেয় আহেরির জন্য যে মেয়েটি থাকে, তাকে।
মল্লিকা তৎক্ষণাৎ ত্রস্ত হয়ে বৌদিমণির নির্দেশ পালন করে।
গীত এবার বাকিদের নির্দেশ দিতে থাকে, কী করতে হবে না হবে। আহেরির জন্মদিনের পার্টি শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। অনেক কাজ বাকি এখন গীতের।
গার্গী নিজের ঘরে চলে আসে চুপচাপ।
নিজের ঘর বলাটা হয়ত ঠিক হল না। মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি এলে এই ঘরটিতেই বরাবর থাকেন।
একটু বসে নিজেও ভালো শাড়ি ছেড়ে হাউসকোট পরে ঘরে এসে দেখে, মল্লিকা সব কাজ সেরে আহেরিকে বিছানায় দিয়ে গেছে।
বেচারার সারাদিনের ধকলে এতই ক্লান্ত যে এক্কেবারে ঘুমিয়ে কাদা। অথচ অন্যদিন ঘুমোতে কি বায়নাক্কাই না করে।
বিছানায় এসে বসতেই চোখে পড়ল, আহেরির ফর্সা টুকটকে গালে অভিরূপের পাঁচ আঙুলের দাগ নীল হয়ে বসে আছে। রাগটা আবার নতুন করে দপদপিয়ে উঠল মাথার মধ্যেই।
তিনবছরের একটা বাচ্চাকে এভাবে কেউ মারে? আর মারার মত কী এমন ঘটেছিল!
জন্মদিন, সবাই নানা উপহার এনেছে। গেস্টরা থাকাকালীন আহেরি একটা উপহারের মোড়ক খুলে দেখেছিল। আহেরি হয়ত বাকিগুলোও তখনই দেখার চেষ্টা করত। কিন্তু ততক্ষণে গীত ওগুলো ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
ঘটনা এইটুকুই। কিন্তু গেস্টরা যেতেই অভিরূপ রাগে ফেটে পড়ল। ওর বক্তব্য এসব নাকি আনসিভিলাইজড বিহেভিয়ার। শেষ পর্যন্ত আহেরিকে এভাবে মারল!
অভিরূপের ওপর তো রাগ হচ্ছেই, তার থেকেও গার্গীর বেশি রাগ হচ্ছে গীতের ওপর। কি অদ্ভুতভাবে অভিরূপের ব্যবহারকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। গীতের কি মনে নেই, ওর মা-ও রেলের চাকরি সামলে ওকে মানুষ করেছে।
এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিল। কিছুক্ষণ পর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।
পাশের ঘর থেকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় কানে ওর কোনোরকম চেষ্টা ছাড়াই। অভিরূপ এখনও বন্য জন্তুর মত গরগর করছে। গীত স্পষ্টতই ওকে সন্তুষ্ট করতে চাইছে হাতে-পায়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে গার্গীর কেমন যেন মনে হল ব্যাপারটা আর শুধুমাত্র কথা কাটাকাটিতে নেই। গীত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, ঠিক যেমনভাবে আহেরি কিছুক্ষণ আগে কাঁদছিল। তবে কি অভিরূপ...!
বুকটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে গার্গীর। কত আদরে মানুষ করেছেন গীতকে ছোটো থেকে তনয় আর ও মিলে। প্রথমদিকে গার্গীর ইচ্ছা ছিল আরেকটা ইস্যু নেওয়ার। কিন্তু তনয়ের ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে ছিল গীত। মেয়েও ছিল তেমনি বাপ-সোহাগী। গীত এমনিতেও অবিকল ওর বাবার মত, দেখতে স্বভাবে।যারা তনয়কে চিনত না, তারা অনেকেই অবাক হত গার্গীর গায়ের রং আর ওর মেয়ের গায়ের রং দেখে। এমন ধবধবে ফর্সা মায়ের মেয়ে কারো হয় কি করে! কিন্তু গীত শুধুমাত্র দেখতেই ওর বাবার মত, স্বভাবেই ঐরকম নরম ও চাপা। তনয় যখন মারা গেল তখন গীত এক্কেবারে অবসাদে তলিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়েই অভিরূপের সঙ্গে পরিচয়। ওর কাছেই ট্রিটমেন্ট চলেছিল গীতের। তারপর যখন দু'জনকেই দু' জনকে বিয়ে করতে চাইল, তখন আপত্তি করেনি গার্গী। হ্যাঁ তবে ইচ্ছা ছিল, গীত আরও পড়াশোনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করুক। কিন্তু অভিরূপ এত তাড়াহুড়ো করল, বলল বিয়ের পরে পড়ুক না যত খুশি। সব মিলিয়ে বিয়েটা হয়েই গেল। কিন্তু তার পরিণতি যে এতটা ভয়ংকর হয়েছে, তা তো ঘুণাক্ষেরও বুঝতে পারেনি গার্গী। বুঝতে পারবেই বা কী করে। বিয়ে পর থেকে এই চারবছরে হাতে গুণে এসেছে মেয়ের কাছে, থেকেছে দু'টো দিন। এবারেই প্রথম দশদিন থাকার কথা। আর গীত যে নিজে মুখ ফুটে কখনও কিছু বলবে না, সে তো জানাই আছে। কিন্তু এতদিন যে গার্গী ভাবত গীত ভীষণ সুখী অভিরূপের সাথে, সে ধারণা এতখানি ভুল! নাকি নিছকই দাম্পত্য কলহকে মিছিমিছি এত বড় করে দেখছে গার্গী!
বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল গার্গী। ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। আহেরির আজ স্কুল ছুটি বলেই হয়তো বেলা অবধি ঘুমাতে দিয়েছে ওর পাপা। আগের রাতের রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তবু নিজেকে শান্ত করে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যোগ দিতে এল গার্গী। ততক্ষণে অভিরূপ বেরিয়ে গেছে। গীত টুকটাক কথা বললেও বোঝা যাচ্ছিল, মনের ঘরে মেঘ জমেছে।
সারাদিন কেটে গেল আহেরির সঙ্গেই। আগামীকাল সন্ধ্যায় গার্গীর ট্রেন।ফিরে যাবেন নিজের বাড়ি।
— তোমার ট্রেন তো কালকে, তাই না?,
নিরাসক্ত মুখে চা খেতে খেতে বলল গীত।
— হ্যাঁ রে, দিন দশেক তো হয়েই গেলো। আবার পরে আসব।
গীত কোনও কথাই বলল না, চুপচাপ উঠে চলে গেল।
গার্গী খুব আশা করেছিলেন মেয়ে আর কয়েকদিন থেকে যেতে বলবে। নিদেনপক্ষে একটু মনখারাপ করবে। এ তো মনে হচ্ছে গার্গী চলে গেলে গীত খুশি হয়।
নাহ, গীত বড় বদলে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নিজের ঘরে এসে প্যাকিং সেরে নেয় গার্গী চুপচাপ।। পরেরদিনও অভিরূপ বেরিয়ে গেছে। গীত উবের বুক করে দিয়েছে মাকে স্টেশন যাওয়ার জন্য। আহেরি বারবার ঝোঁক করছিল, স্টেশন পর্যন্ত আসার জন্য। গীত ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
বাড়িতেই তো থাকল। আসলে কীজানি হত!, একবুক অভিমান নিয়ে ট্রেনে উঠে বসেছেন গার্গী। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে এল আর।টু্ং করে মেসেজটা ফোনে ঢুকল তখনই।
গীত!
"আহেরির গালে পাঁচ আঙুলের দাগটা স্পষ্ট ছিল বলে দেখতে পেলে মা! কালো মেয়ের গালে বুঝি কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না?
আহেরিকে দেখো মা... "
মানেটা কী! গীত...এত বড় ভুল করতে যাচ্ছে। গীতের ফোন স্যুইচড অফ। পাগলের মত অভিরূপের ফোনে রিং করছেন। তার ফোন বেজেই যাচ্ছে।
কী করব এখন গার্গী!
এ কি, ট্রেন চলতে শুরু করেছে!কিন্তু ওকে তো ফিরতেই হবে।
টালমাটাল পায়ে এগোতে থাকে গার্গী, ট্রেনের চেন টানবে বলে।
ওদিকে সল্টলেকে সাইকিয়াট্রিস্ট অভিরূপ দাশগুপ্তের বাড়িতে অসময়ে রাত নামছে গুটিগুটি...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন