মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী



অভিশপ্ত নীল 
জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী 
দ্বিতীয় পর্ব :

নিজের ডেস্কে বসে দরকারী ফাইল গুছিয়ে রাখছিল পিয়াস l সব কাজ সেরে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে অফিস থেকে ,তারপর রিম কে স্কুল থেকে পিক আপ করে কয়েকটা জিনিস কেনাকাটা করে তবে বাড়ি ফেরা l কাল সকালের ফ্লাইটেই ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর হেড কোয়াটার বিশাখাপত্তনম যাচ্ছে সে l প্রায় চার সপ্তাহের প্রজেক্ট ,এক্সটেন্ড হতে পারে l প্রজেক্ট টা অ্যাসাইন হওয়ার পর থেকে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে পিয়াস l কলকাতায় মা আরও রিম কে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না তার ,কিন্তু কিছু করারও নেই l সময়ে অনি' সাথে যদি একটু যোগাযোগ করা যেত ... কি জানে আমি কালই কলকাতা ছাড়ছি .....জানলে হয়ত বাড়িটায় একটু নজর রাখতে পারত .....এসবই মনে মনে আওড়াচ্ছিল .....এমন সময় উর্ধতন অফিসারের তলবে কিউ ছেড়ে উঠে যেতে হল তাকে l 
সন্ধেটা রিমের সাথেই কাটছে আজ l এরপর কতদিন হয়ত দেখতে পাবেনা মেয়েটাকে l দরকারী জিনিসপত্র সব মাকে গুছিয়ে দিতে দিতে আনমনে রিমের কথা শুনছিল পিয়াস l হঠাৎই একটা কথায় চমকে উঠলো সে l ছুটে গিয়ে রিমের কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিগেস করল সে , " কি বললে রিম ! পাপাই ?....পাপাইকে কোথায় দেখলে তুমি ?"
- "
এসেছিল তো ছুটির সময় ....তোমাকে রোড ক্রস করতে দেখে বাই বলে চলে গেল "
পিয়াস ততধিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিগেস করতে লাগলো , " কি বলল পাপা ? কিছু দিয়েছে তোমার হাতে ? আমাকে কিছু বলতে বলেছে ?"
এত প্রশ্নে রিম কেমন যেন হতোদ্যম হয়ে গেল ,কিছু বলতে পারছিল না l মেয়ের মুখের ভাব দেখে পিয়াসও আর কিছু জিগেস করেনি তখন l রাতে রিম ঘুমিয়ে পড়লে ওর স্কুলব্যাগটা টেনে নিয়ে বসলো সে l একটু আধটু নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতেই চোখ চিকচিক করে উঠল তার ......যা এক্সপেক্ট করেছিল তাই .........
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত্রি বারটা .....অনন্ত এতক্ষণে করমন্ডল এক্সপ্রেসে ....আর চারঘন্টা' মধ্যে ভাইজাগ !
এম ভি পি কলনি' ক্যাম্পাসেই গেস্ট কোয়ার্টার গুলো l সুন্দর গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট এরিয়া l ঘরের সামনে ছোট্ট ব্যালকনি l চেক ইন করার পর থেকেই ফ্রেস হয়ে লাঞ্চ সেরে এখানে এসে বসেছে পিয়াস l কয়েকটা দরকারী মেইল করছে ল্যাপটপ থেকে l এমন সময় একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসতেই আঁতকে উঠল সে l অনন্ত এভাবে তো .....একটু ইতস্তত করেই কল টা রিসিভ করল সে l ওদিকে কয়েকটা উদ্বিগ্ন নিঃশ্বাস এর পর যতটুকু বোধগম্য হল .....তেলেগু ভাষার টান অক্ষুন্ন রেখেই কেউ একজন বলতে চাইল , " পার্টনারকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান ....প্রজেক্ট অন্যকেউ সামলে নেবে l "
পিয়াস প্রায় আকাশ থেকে পড়ল l কল টা এন্ড হওয়ার পর চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো সে l খানিক সময় নিয়েই ট্রু কলার সার্চ করল .....ফোননম্বর টা এখানেরই নেভি' কোন অফিসিয়াল এর l কিন্তু তাকে এভাবে ফিরে যেতে বলা হল কেন ! আর পার্টনার ! পার্টনার মানে ......মানে অনন্ত ! চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত পায়চারি করতে লাগলো সে ....প্রচন্ড মেন্টাল প্রেসারে একটা সিগারেট না ধরালেই নয় ....সিগারেটটা প্রায় নিমেষে শেষ করে আবার মাথার মধ্যে অঙ্কের খাতা খুলে বসল সে l একেক করে গুছিয়ে নিতে লাগলো সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের প্রতিটি ধাপ l চোখের সামনে খুব স্পষ্ট হয়ে আসছিল কয়েকটা পুরানো অস্পষ্ট ছবি l অনন্তকে যেদিন নেভি' থেকে সাসপেনড করা হয়েছিল ,সাসপেন্শন অর্ডারটা নিয়ে এসেছিল ওরই টিম অফিসার ...স্থানীয় লোক ...কি যেন একটা বলতে চেয়েছিল অনন্তকে ....." মিউচুয়াল " বলে একটা শব্দ শুনেই কেমন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলো অনন্ত l আজ প্রায় একবছর হয়ে গেল সেদিনটা' l নেভি' স্পেশাল শিপ থেকে লুট হওয়া ওয়েপণস গুলোর এখনও হদিস মেলেনি l সেদিন চার্জ ছিল ক্যাপ্টেন অনন্ত রায় আর রুপম রাজপুত l তারপর চার্জশিট ....রিমান্ডে ফিরে আসার পরপরই রুপমের আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ল ,যদিও তার ডেডবডির খোঁজ মেলেনি আর অনন্ত সাসপেন্ড হয়ে নিরুদ্দেশ l কিভাবে সেই দিনগুলো কেটেছিল পিয়াস আর ছোট্ট রিম এর ,একমাত্র সেই জানে l পাবলিকলি অনন্ত এখনও নিরুদ্দেশ,হয়তবা মৃতও l ঘটনার চার মাস পর অনন্ত প্রথম যোগাযোগ করেছিল পিয়াস l এর আগে নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি সে l আর অস্ত্র লোপাট হওয়ার বিষয় নিয়ে নেভি সম্পূর্ণ নীরব ,আজও l দোষীর শাস্তি নাকি তারা তখনই দিয়ে দিয়েছে .l কিন্তু পিয়াস জানে অনন্ত এরকম করতেই পারেনা l করেও নি ,কিন্তু রুপমের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত আর আসল কালপ্রিট খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত পিয়াস কে চুপ থাকতে হবে ,নিজের ডিপার্টমেন্ট এর কাছেও l 
প্রায় রাত্রেই সেই নীল গাড়িটা .....পিয়াস কে ফলো করে অনন্ত' খোঁজ পাওয়ার জন্য l কিন্তু কোনদিনই খুঁজে পায়নি তাকে l কিন্তু আজ কিভাবে সে ধরা পড়ে গেল ! নাহ্ আর কিছু ভাবতে পারছিলনা পিয়াস l দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা গুজে বসে রইলো সে অনেক্ষণ l দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আলোয় সবকিছু বড় ম্লান মনে হচ্ছিল তার l এখনের হালকা শীতেও গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছিল তার l আঙ্গুলের পোখরাজটা নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে লাগলো , রুপমের আঙ্গুলে যে নীলা টা সে দেখেছিল একবার অফিসার্স পার্টিতে ......সেই রক্তমুখী নীলাটা ....সেটা অনি কাছে কি করে এলো .....তাহলে রূপম কে কি খুঁজে পেয়েছে ! কিছুই তো জানা যাচ্ছেনা ..... অস্থির হয়ে পড়ল পিয়াস l অস্ফুটে বলল , " please অনি ,talk to me please "

ভাইজাগ এর প্রথমদিনটা একরকম চাপা উত্তেজনার মধ্যে দিয়েই কেটে গেল l আজ সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ ...ছোটখাটো একটা নিম্নচাপ উঠেছে বঙ্গোপসাগরে ....ঠান্ডা সামুদ্রিক হাওয়ার দাপটে সূর্য' বুঝি কাবু l যদিও এই সামুদ্রিক আবহাওয়া' অভ্যস্ত পিয়াস l এখানে নেভি' কোয়ার্টার তো সমুদ্রের উপকণ্ঠেই ছিলো l স্মৃতির জাহাজ থেকে সেসব স্বপ্ন নীল দিনগুলো ভেসে উঠছিল একেক করে পিয়াস' চোখের বালিয়াড়ি'তে l নীল ....নীল .... প্রিয় রং ....গর্বের রং ......অস্তিত্ত্ব' রং ...নেভি' রং......এমনটাই বলত অনন্ত l অথচ এই রংই একদিন জীবনে অন্ধকার ডেকে আনবে এমন স্বপ্নে' ভাবেনি ওরা দুজনে l এখন তো নীল শুধুই একটা অভিশাপের নাম পিয়াস' কাছে l অনন্ত অবশ্য এসব শুনলে রেগে যায় .....কি অসম্ভব উদ্যমে সে নিজের লক্ষ পূরণ করতে ছুটে বেড়াচ্ছে l চাইলেই সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত নেভি থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর' l কিন্তু তার কাছে তার বন্ধু' দাম ....ওই নীল রং'টা দাম নিজের জীবনের থেকে অনেক বেশি l ওই রং কে যে বা যাঁরা কালো করেছে তাদের মুখোশ খুলে দিতে বদ্ধপরিকর সে l এসব ভাবনার মাঝেই ডাক পড়ল পিয়াস' l মেইড দরজার আড়াল থেকে জানিয়ে গেল কেউ একজন দেখা করতে এসেছেন l বারান্দায় বসিয়ে এসেছে তাকে l পিয়াস খানিক অবাক হল l এই area তো no entry zone ....বাইরের কেউ আসতে পারেনা এখানে ,এমনিতেও তার এখানে আসাটাও তো confidential ....যাই হোক ,শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে ফ্রেশ হতে গেল সে l প্রায় তিরিশ মিনিট পরে যখন বারান্দায় এসেছে ,বেতের চেয়ারে তখন একজন নেভি' পোশাকের ভদ্রলোক চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়ালেন l বিষয়টা আঁচ করতে সময় লাগেনি পিয়াস' l নেভীর অফিসার বলেই backing entry হয়ে গেছে restricted area তে l তবুও না বোঝার ভান করে একটু হতবাক হল সে l ভদ্রলোক মুখে ভদ্রতার রেশ টেনে বলল , " good morning madam how was your journey ?"
সামান্য সৌহার্দ বিনিময়ের পর দুজনেই স্তব্ধ l পিয়াস অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলো লোকটির মুখ থেকে আসার উদ্দেশ্য জানতে l অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে লোকটিই একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল , " actually we were together for long time ....we means captain roy and me ..."
- " please clear the intention ..."
কথার মাঝেই বাধা দিয়ে বলে উঠল পিয়াস l 
- " just return back ..you both are not safe here ."
- " what ! Is it a warning !...."
কথা শেষ হলনা পিয়াস' ....লোকটি ততক্ষণে বারান্দা ছেড়ে নিচে নেমে গেছে,দেখতে দেখতে চোখের সীমানার বাইরে l 

ক্রমশ .....

ছবির কৃতজ্ঞতা স্বীকার : জয়ীতা ব্যানার্জী গোস্বামী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন