স্বপ্নহীনের সাপলুডো
(একাঙ্ক নাটক)
সৌমিত্র চক্রবর্তী
চরিত্র : জগাই
বিচারক
উকিল
মা
কনস্টেবল
চোর
ঘোষক
(১)
(মঞ্চের ডানদিকে ডাউন রাইট স্টেজে জগাই দাঁড়িয়ে গান গাইছে। একটি
শাওয়ার আলো তার মাথার ওপরে। আধো আলো আধো অন্ধকার। জগাই কে স্পষ্ট দেখা যায় না। বাকি
অংশ অন্ধকার।)
জগাই – আয় রে ভোলা খেয়াল খোলা দমদমাদম বাজিয়ে আয়
সোনায় মোড়া স্বাধীণতার ক্ষীর ননী সব গিলবি আয়,
তুই খাবি আর আমি খাব, আর খাবে সব চামচা
নেতার মাথায় সোনার টুপি, জনগনের গামছা।
সাত দশকে সাতশো রকম দেখলি ডাকাত চোর
রাত নেমেছে নাচ রে ভোলা, আসবে কি আর ভোর!
নেতার ছেলে নেতা হবে, চাষীর ব্যাটা চাষী
হায় ক্ষুদিরাম কার জন্য গলায় পরলি ফাঁসী।
(আপ সেন্টারে আলো পড়ে, সেখানে এক বিচারক, এক উকিল কাগজপত্র দেখছেন।
বোঝা যায় আদালত। বাইরে থেকে ঘোষণা ভেসে আসে। গোটা মঞ্চই আলোকিত)
ঘোষক – আসামী চতুর্থ জগাই হাজিইইইইইর…!
জগাই – (খুব জোরে চিৎকার
করে) হাজিইইইইইইইইইর…
বিচারক –
(চমকে ওঠে) অ্যাই … অ্যাই … কি হলো! অ্যাঁ! ওরকম চ্যাঁচাচ্ছো কেন?
জগাই – আঁজ্ঞে স্যার, আজ আমার কি আনন্দ! ওহ্ এত মাণ্যিগণ্যি লোক রয়েছেন
আপনারা! আমায় ডাকছেন! ভাবা যায়!
বিচারক – তোমার দশ টাকা জরিমানা হলো।
জগাই – কেন? কেন?
বিচারক – পনেরো টাকা ফাইন হলো।
জগাই – অ্যাই মরেচে! ফাইন কেন? আর বেড়েই বা যাচ্ছে কেন?
(২)
উকিল – অ্যাই মশাই চেপে যান না। বেশী বকছেন কেন? এই জন্যেই তো ফাইন বেড়ে
যাচ্ছে।
জগাই – অ! (চুপ করে যায়)
বিচারক – আদালতে চ্যাঁচামেচি করে আদালতের পবিত্রতা নষ্ট করার চেষ্টার অপরাধে
আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইয়ের পনেরো টাকা জরিমানা হলো। (বাইরে টাইপের শব্দ)
আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই! (জগাই চুপ করে থাকে) কি হলো! সাড়া
দিচ্ছেন না কেন? (জগাই তবু চুপ করে থাকে) কি ব্যাপার! কথা বলছেন না কেন বলুন তো? একটু
আগেই যা গলা ফাটালেন তাতে বোঝা গেছে বোবা তো নন? তবে? (জগাই নির্বাক) হুম। আমার প্রশ্নের
উত্তরে কথা না বলে আদালত অবমাননা করার অপরাধে আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইয়ের দশ টাকা
ফাইন হলো। (বাইরে টাইপের শব্দ)
জগাই – হুজুর! হুজুর! একি শাঁখের করাত!
বিচারক – কি?
জগাই – হুজুর! কথা বলার জন্যেও ফাইন! আবার না বলার জন্যেও ফাইন! এতো খুব
খিটকেল কান্ড দাদা!
বিচারক – দাদা কাকে বলছেন? এটা পাড়ার রক নয় বুঝেছেন! এটা কোর্ট। দাদা টাদা
নয়, এখানে স্যার বলবেন।
জগাই – আচ্ছা স্যার! আপনারা যেমনটি বলবেন তেমনটিই করব স্যার! কথা বলতে
বললে বলব, চুপ করতে বলেছেন কি সঙ্গে সঙ্গে চুপ। আর কথাটি নয়। (গেয়ে ওঠে) তুমি যেমন
চলাও তেমনি চলি, আমি যে তোমার গাধা হে…
উকিল – চুপ! চুপ! আবার গোলমাল করে!
(জগাই নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করে)
বিচারক – আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আপনি জানেন তো?
জগাই – স্যার! গতকাল থেকে ক্রমাগত সেই চেষ্টাই কররে যাচ্ছি। পুলিশ আমাকে
ধরলো, থুড়ি, আমি পুলিশকে দিয়ে নিজেকে ধরালাম, কিন্তু কোন অভিযোগে ধরালাম সেটাই এখনো
পর্যন্ত…
(৩)
বিচারক – আপনাকে যতটুকু জিজ্ঞেস করা হবে তার বাইরে একটা কথাও বলবেন না।
জগাই – না দাদা অ্যাই না না… না স্যার! একদম বলবো না।
বিচারক – আপনার উকিল কোথায়?
জগাই – উকিল! আমার তো কস্মিনকালেও কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, হেকিম,
বদ্যি, মোক্তার, ওভারসীয়ার কেউ নেই স্যার! আমার দাদু, না না, নিজের দাদু নয় হে হে… এক পাতানো
দাদুর ভায়রাভাই শুনেছি উকিল ছিলেন স্যার। কিন্তু…
বিচারক – না না তা নয়। এখানে আপনার উকিল কে?
জগাই – (মঞ্চে দাঁড়ানো
উকিল কে দেখিয়ে) কেন? ওই যে উনি।
উকিল – ( চমকে ওঠে)
আমি! আমি আবার আপনার উকিল হলাম কখন?
জগাই – আরে আমার আর তোমার বলে সত্যিই কিছু কি আছে? হে হে… আমি স্যার
অত বোকা নই। এ সংসার মায়া, প্রপঞ্চময়। এখানে সবাই অনিত্য তা আমি জানি। হে হে… কা তব
কান্তা কস্তে পুত্রহ্ … আপনি আমার কেন হবেন স্যার? আপনি আপনারই। তবে কিনা লোকে যে বাসে
যায় বলে আমার বাস, যে কারখানায় কাজ করে বলে আমার কারখানা, তেমনই আর কি…!
বিচারক – আঃ! বাজে কথা নয়। উনি তো সরকারি উকিল। আমি জিজ্ঞেস করছি, এই মামলায়
আপনার উকিল কে?
জগাই – মামলা! কোন মামলা! কার মামলা!
উকিল – আপনার বিরুদ্ধে মামলা।
জগাই – কেন? কেন? দাদা হুজুর স্যার! আমার বিরুদ্ধে মামলা কেন? আমি তো স্যার
চিটফান্ডের মালিক নই কিম্বা স্যার নেতাও নই যে স্টিংবাজী তে টাকা নিতে গিয়ে ফেঁসে গেছি!
কিম্বা আমার তো স্যার অনেক জমিজমাও নেই! তবে আমার বিরুদ্ধে...
উকিল – আপনি অসম্ভব অন্যায় করেছেন তাই।
জগাই – অন্যায়! অ! ন্যায়ই বা করলাম কখন আর অন্যায়ই বা করলাম কখন? যাচ্চলে!
তাহলে আমি ছাড়া বাকী সবাই কি ন্যায় করে চলেছে?
(৪)
বিচারক – সেটা আপনার জানার কথা নয়। দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনাকে কি গ্রেপ্তার
করার সময়ে জানানো হয় নি যে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি?
জগাই – হে হে স্যারদাদা! সে সুযোগ পেলে তবে তো! আমাকে তো গ্রেপ্তার করতেই
পারেনি।
উকিল – তারমানে! আপনি ফেরার হয়ে গেছিলেন? (বিচারকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে)
স্যার! এ ডেঞ্জারাস অপরাধী। সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল। আমাদের আইনের বুকে মানে ল এর বইয়ে
আছে মানে টীকাতে লেখা আছে ফেরোশাস মিসক্রিয়েন্টরা প্রথমে পরিকল্পনামাফিক ক্রাইম করে
আর তারপরেই ফেরার হয়ে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যেহেতু এই পাগলা জগাইয়ের ক্ষেত্রে থুড়ি
এই চতুর্থ জগাইয়ের ক্ষেত্রেও হুবহু তাই হয়েছে, অতএব ধরে নেওয়া যাক অপরাধ প্রমাণিত হলো
এবং জগাইকে তার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি জনগনমঙ্গলদায়ক সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন
জানাচ্ছি। জয় বজরঙ্গবলী!
বিচারক – অ্যাই কোর্টে ওসব বলবেন না। রাজনৈতিক শ্লোগান কোর্টে নিষিদ্ধ।
উকিল – সরি স্যার! অভ্যাসে বেরিয়ে গেছে। আর হবে না। কিন্তু স্যার এটা রাজনৈতিক
শ্লোগান নয়, এটা তো ধর্মীয়...
বিচারক – ওই একই হলো। এখন যাহা ধর্ম তাহাই রাজনীতি। যাইহোক, শুনুন অভিযোগ
এত কম সময়ে প্রমাণ হয় না। এত তাড়াহুড়ো করলে আমার আপনার দুজনেরই নাম গিনেস বুকে উঠে
যাবে। কাগজগুলো হইচই শুরু করে দেবে। আপনার কাচকলা। আমার প্রমোশনের বারোটা বেজে যাবে।
উকিল – কেন স্যার? কেন কেন? উল্টোটাও তো হতে পারে! আপনি স্যার রাতারাতি
বিখ্যাত হয়ে যাবেন, কেসে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে পারেন বলে কর্মক্ষম জজ হিসেবে ডবল
প্রমোশন পেতে পারেন।
বিচারক – আরে রাখুন তো ডবল প্রমোশন! জেলা জজের এজলাসে বারো তেরো বছর ধরে
কত কেস ঝুলে আছে জানেন? তাকে টপকে তাড়াতাড়ি কেস নিষ্পত্তি করতে গেলে পেছনে হুড়কো দিয়ে
দেবে।
উকিল – তা অবশ্য ঠিক।
বিচারক – আর তাছাড়া একসঙ্গে সব কেস যদি পরপর ফয়সলা হতে থাকে তাহলে এতএত লোককে
রাখার মত এত জেল আছে নাকি? তখন একটা বিশৃঙ্খলা হতে পারে। সরকার পড়ে যেতে পারে, জানেন?
(৫)
উকিল – হ্যাঁ স্যার, তাহলে থাক। আবেদন উইথড্র করছি। কেস চলুক। কিন্তু স্যার
ও তো ফেরার হয়েছিল।
বিচারক –
(জগাই কে) কি! আপনি স্বীকার করছেন তো যে আপনি ফেরার হয়েছিলেন বলেই পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার
করতে পারে নি?
জগাই – যাচ্চলে! আমি আবার কখন এ কথা বললাম!
উকিল – সে কি! আপনিই তো বললেন যে পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি!
জগাই – হ্যাঁ তাই বলেছি। কিন্তু ফেরার হয়েছিলাম এ কথা আবার কখন বললাম?
উকিল – বাহ্! আপনি জলজ্যান্ত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ পুলিশ আপনাকে
ধরতে পারছে না, কেন? আপনি কি রাজনৈতিক নেতা নাকি?
জগাই – না না স্যার, আমি নেতা হব কেন? নেতা হওয়ার মত কোনো অযোগ্যতাই আমার
নেই। আমি তো সামান্য একজন ডিমওয়ালা মাত্র।
উকিল – তাহলে আপনি কি ইয়ার্কি করছেন নাকি! জানেন এটা কোর্ট!
জগাই – হাড়ে হাড়ে জানি স্যার। রীতিমতো জানান দিয়েই এসেছি। আর এসেই জানতে
পেরেছি যে এটাই সেই কোর্ট। যেখানে এলে মানুষের সাড়ে সব্বোনাশ।
বিচারক – বাজে কথা ছাড়ুন। আসল ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো।
জগাই – সেটাই তো অনেকদিন ধরে বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি হুজুর। কিন্তু বলার
সুযোগ পাচ্ছি কই? একবার মুখ খোলা আর একবার মুখ বন্ধ করার দাপটে কথাগুলো ঠিকমত পেট থেকে
স্লিপ করছে না।
বিচারক – আদালতে দাঁড়িয়ে অবান্তর কথা বলার অপরাধে আপনাকে আরও দশ...
জগাই – (আর্তস্বরে চিৎকার
করে বিচারককে থামিয়ে দেয়) থামুন থামুন স্যার দাদা হুজুর! এত ঘন ঘন দশ করে চাইলে আমিই
বা পাব কোথায় বলুন? আজকাল তো ছটা ডিম বিক্রী করলেও পুরো দশটা টাকা পাই না।
(৬)
উকিল – দেখুন দেখুন স্যার, পরিষ্কার রাষ্ট্রবিরোধী কথা। অসন্তোষ, বিক্ষোভ
ইয়ে মানে ইয়ে... (কথার খেই হারিয়ে ফেলে)
বিচারক – ঠিক আছে, ঠিক আছে। শুনুন চতুর্থ জগাই, আপনি ক্রমাগত রাষ্ট্রবিরোধী
কাজ করে চলেছেন। সাবধান হন।
জগাই – কেন কেন হুজুর? কি করলাম আমি?
বিচারক – এইমাত্র আপনি আমাকে জরিমানার কথা বলতে বাধা দিলেন। জানেন, এতেও
জরিমানা হতে পারে?
জগাই – স্যার, বরং এক কাজ করুন। আমাদের গোটা পরিবারটাকেই দশ বচ্ছর জেলে
দিন। সেটা স্যার সহজ। কিন্তু ওই দশ দশ করে বাড়লে আমার পক্ষে দেওয়া খুবই কঠিন।
উকিল – ওহে এটা পাড়ার চায়ের দোকান নয় যে এখানে দর কষাকষি হবে।
বিচারক – যাইহোক, এবার আসল কথায় আসা যাক। পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি
কেন?
জগাই – সেটা স্যার পুলিশই ভালো বলতে পারবে। আমি তো স্যার পুলিশকে সহযোগিতা
করেছি। ওদের দিয়ে আমাকে ধরিয়েছি।
বিচারক – ব্যাপারটা কিরকম? খোলসা করে বলুন।
জগাই – এই তো পরশু সকালের কথা। আমি তখন আমার বাড়ীর রকে বসে বাফুমু খাচ্ছিলাম।
বিচারক – কি খাচ্ছিলেন?
জগাই – আজ্ঞে বাফুমু।
উকিল – সে আবার কি? কোনো জাপানী খাবার নাকি? কোন দোকানে পাওয়া যায় বলুন
তো? নাকি শপিংমলে? আমার মিসেস আবার এইসব বিদেশী খাবার খুব লাইক করেন। বলুন বলুন, তাহলে
আজই ফেরার সময় কিনেই ফিরব।
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার খুব প্রিয় এক জাপানী খাবার। আমি আমার চার পুরুষের
ভিটের বারান্দায় বসে খাচ্ছি আর গান গাইছি। তখন...
উকিন – গান! এতবড় অন্যায় করেও গান গাইছেন?
(৭)
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ স্যারদাদা। গান আমার রক্তে দাদাস্যার। গান গাইতে আমি
খুবই ভালোবাসি। তা আমি বসে আছি। খাচ্ছি আর গাইছি...
(জগাই গান গেয়ে ওঠে। গানের মধ্যেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। গান চলতে
থাকে। আলো জ্বললেই দেখা যায় একটা ভাঙাচোরা বাড়ীর রোয়াকে বসে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের
বাটি হাতে সে গান গেয়ে চলেছে আর খাচ্ছে)
কথা বলতে ভার দিয়েছ
বোবা কালার এই ভুবনে।
আমিই নিছক গণ্ডমূর্খ
আর সকলে সবই জানে।।
আড্ডা দেওয়ার বেঞ্চি দিলে
তার দু পায়া নড়ন চড়ন।
ডাকলে তবু কেউ আসে না
এক এক জনের এক এক ধরন।।
সাপলুডো কি দাবার ছকে
ঘড়ির কাঁটা অবিশ্রান্ত।
সময় এখন চালচুলোহীন
আগেভাগে কে আর জানতো!
স্বপ্নহীনের বুকপকেটে
(৮)
লাল নীল সব কলম থাকে।
স্বপ্ন ছাড়াই পদ্য লেখে
রাজা তাকেই বাঁচিয়ে রাখে।।
কথা বলতে দায় চাপালে
বাচাল আমি চিরটাকাল।
দাঁড়ের ময়না আমি তো নই
কোদাল কে তাই বলি কোদাল।।
ব্যাঘ্র আজও ব্যাঘ্র এবং
শকুন আজও শকুনই আছে।
মানুষ কেবল পালটে যাচ্ছে
নিত্য নতুন বাজার ধাঁচে।।
উলটে পালটে সব দেখেছি
তন্ত্র মন্ত্র গুরুর বিধান।
নানান পথে নানান মতে
কখনো বাম কখনো ডান।।
দিন কে যারা রাত্রি বানায়
(৯)
রাত কে যারা দিন সাজালো
মহাপুরুষ তারাই নিজের
জয়ধ্বনির ঢাক বাজালো।।
কথা বলতে দিলেন যখন
কথার কথা বলব না আর।
কথায় আগুন জ্বালিয়ে তুলি
কথায় হবে ওস্তাদী মার।।
নটে গাছটি মুড়োয় তবু
কথা আমার ফুরোয় না।
মুখোশ ছিঁড়ে মুখ না দেখে
প্রাণ যে আমার জুড়োয় না।।
(ভেতর থেকে এক মহিলা চিৎকার করতে করতে আসেন। তিনি জগাইয়ের মা। চিৎকার
শুনে জগাইয়ের গান থেমে যায়)
মা – এই যে নবাবের ব্যাটা নবাব! এখনো বসে বসে কালোয়াতির আসর চলছে? এদিকে
বেলা কত হলো তা খেয়াল আছে? ডিমের গুমটি কি বেলা বারোটায় খুলবে? আর লোকে অতক্ষণ তোর
জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে? বাজারে এখন ডিমের একশোটা দোকান হয়েছে। যার যেখানে খুশি সেখানে
কিনবে।
জগাই – আঃ! মা! দিলে তো এই সাত সকালে মেজাজটা চটকে!
(১০)
মা – মেজাজ! তোমাদের ওই জমিদারী মেজাজ নিয়ে লালকেল্লায় গিয়ে থাকলেই তো
পারো। এখানে কেন? তিনবেলা গেলার সময়ে মা কে মনে পড়ে। কিন্তু গেলার জিনিসপত্র কোত্থেকে
আসবে সে খেয়াল আছে?
জগাই – উফ মা মা মা গো মা! একবার কমার্শিয়াল ব্রেক দাও মা! রুকাওট কে লিয়ে
একটুও খেদ নেহী হ্যায় মা?
মা – হ্যাঁ, মা তো তোমাদের শত্রু। বাপ চিরটাকাল হাড় জ্বালিয়ে গেছে, এখন
ছেলেও তাই করছে। যত কুঁড়ের বাদশা সব আমার কপালেই জোটে!
জগাই – মা! এরপরে ওই ডায়লগটা! (মায়ের নকল করে) চিতায় ওঠা পর্যন্ত আমার
কপালে এই আছে। হে ভগবান! বাবা জেনেশুনে আমার কোন ঘরে বিয়ে দিল!
মা – হ্যাঁ দিলই তো। এরচেয়ে গলায় কলসি বেঁধে জলে ভাসিয়ে দিলে ভালো হত।
জগাই – কিন্তু মা, তোমার বিয়ে তো সেই কত যুগ আগের ব্যাপার। তাছাড়া দাদু
বিয়েটা দিয়েছিলেন বাবার সাথে। আর বাবাও এখন ফুস। (ওপরের দিকে আঙুল দেখায়) তবে এখন আর
আফসোস করে লাভ কি?
মা – না না, আফসোস করব কেন? আমি তো এখন তোমাদের বোঝা। ও রেখে গেল আমাকে
এই জ্বালা সইবার জন্যে। হে ভগবান! কবে যে যেতে পারব! (কেঁদে ফেলে)
জগাই – (মা কে জড়িয়ে
ধরে) আঃ মা মা আমার সোনা মা! কাঁদছ কেন? এই দেখ না এক্ষুণি বেরোব আমি। বাজারে যতই দোকান
থাকুক আমার মত খাঁটি, পচা নয়, একনম্বর, এই উটপাখির ডিমের সাইজের মত এই এত্তোবড় ডিম
(দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ডিমের সাইজ দেখায়) খদ্দেররা আর কোন দোকানে পাবে বল? ঘুরেফিরে
সেই আমার দোকানেই আসতে হবে। (গেয়ে ওঠে) এ তো ডিম নয় গো এ যে ডিমডিমাডিমডিম ডিডিম ডিডিম
ডিম... (মা হেসে ফেলে) হ্যাঁ এই তো হাসি ফুটেছে মুখে।
মা – আমারও কি ইচ্ছে করে তোকে সকাল থেকে জোর করে দোকানে পাঠাতে। সারাদিন
ওই একভাবে বসে থেকে ডিম বিক্রী করা। আমি কি বুঝিনা? বুঝি সব। কিন্তু কি করব বল?
(১১)
জগাই – মা, মা গো, তোমাকে এতসব ভাবতে কি বলেছি আমি? আর তাছাড়া ডিম বিক্রী
করতে আমার ভালোই লাগে। কত রকম মানুষ আসে। তাদের সঙ্গে কথা হয়। পাশের চায়ের দোকানের
খবরের কাগজ পড়ি। সময়টা যে কখন সুড়ুৎ করে কেটে পড়ে বুঝতেই পারিনা।
মা – ওই দোকানটুকু করতে পেরেছিলি বলে বেঁচে গেলাম আমরা। নইলে যে কি হতো
ভগবানই জানেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মরতে হত হয়তো।
জগাই – হ্যাঁ বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল বল!
মা – হ্যাঁ মনে হয়েছিল যেন অথই জলে পড়েছি। কেউ কোথাও নেই। মানুষটা তো
একটা টাকাও জমিয়ে যেতে পারেনি। পাড়ার লোকেরা না দেখলে কি যে হতো!
জগাই – হ্যাঁ বাবা বেঁচে থাকলে কি আর আমাদের অভাব থাকতো!
মা – অভাব? না অভাব তো আমাদের চিরকালই ছিল। তোর বাবা কখনোও মিথ্যে কথা
বলতেন না আর লিখতেনও না। সে জন্যে যারা মিথ্যে দিয়ে কাগজ ভর্তি করে তাদের কাছে তোর
বাবার কোনো কদর ছিল না।
জগাই – তবুও বাবা তো কাগজের রিপোর্টার ছিল। আর রিপোর্টারের মাইনে খারাপ
নয়, তাহলে?
মা – ওই যে বললাম, তোর বাবার এক জেদ ছিল মিথ্যে খবর লিখবেন না। ওই জেদের
জন্যেই কাগজের মালিকদের সঙ্গে তোর বাবার বনিবনা হত না। আজ এক খবরের কাগজ তো কাল আর
এক। মাঝেমধ্যে আবার কাজ না পেলে বাড়ীতে বসে থাকা। এই করেই সঞ্চয় কোনোদিনও হয় নি। আর
তাছাড়া মারা যাওয়ার পরেও তো কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেল না।
জগাই – জানো মা, আমার মনে আছে। কোন সেই ছোটবেলার কথা, তবুও এখনো মনে আছে।
বাবা একটা কথা আমাকে প্রায়ই বলতেন, বলতেন জগাই রে লোভ বড় সর্বনেশে। প্রথমে যেটাকে অভাব
মনে হয়, পরে সেটা মিটে গেলেও চাহিদা থেকেই যায়। আর তখনই ওই পাঁক থেকেই জন্ম হয় লোভের।
বুনো আগাছার মত ওই বিষ ফলের গাছটা আমাদের মস্তিষ্কে, কোষে, দেহের প্রত্যেক কোণে শেকড়
ছড়িয়ে দেয়। মাকড়সার মত আঁকড়ে ধরে মানুষকে। মানুষ তখন ছটপট করে, কাঁদে, চিৎকার করে কিন্তু
মুক্তি পায় না। আস্তে আস্তে কিনারার শেষে খাদ জেনেও মানুষকে ঐদিকেই এগিয়ে যেতে হয়।
মা, বাবা তো লোভ করেন নি! তবে বাবাকে শেষ হয়ে যেতে হলো কেন?
(১২)
মা – (জগাইকে জড়িয়ে
ধরে) কে বললো তোর বাবা শেষ হয়ে গেছেন? ওই কথাগুলো যে এখনো সত্যি।
জগাই – কি জানি!
(বাইরে থেকে কথা বলতে বলতে এক কনস্টেবল ঢোকে। মা বেরিয়ে যায়)
কনস্টেবল – আচ্ছা, এখানে জগাই বাবুর বাড়ী কোনটা বলতে পারেন?
জগাই – কোন জগাইয়ের কথা বলছেন দাদা? এই কাটা ফটিকের ফাটা গলিতে সতের জন
জগাই থাকে।
কনস্টেবল – অ্যাঁ! এইটুকু জায়গায় সতের জন জগাই!
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ। (গড়গড় করে বলে যায়) টাকলু জগাই, রাতকানা জগাই, ভীম
জগাই, প্যাঁকাটি জগাই, চুল্লু জগাই, সাট্টা জগাই, লোহা জগাই, কয়লা জগাই, ময়লা জগাই,
মেম জগাই, ডিম জগাই...
কনস্টেবল – আরে থামুন...থামুন! ওরে বাপ্রে! মাথা একেবারে ভোঁ ভোঁ করছে। সকালে
কি যেন খেয়েছিলাম। পেটটা কেমন যেন করছে। দাঁড়ান, দাঁড়ান... (পকেট থেকে কাগজ বার করে
দেখে) হ্যাঁ পেয়েছি। এ হলো আটের বারো ফাটা গলির জগাই।
জগাই – অহ তাই বলুন। আটের বারো তো আমাদেরই বাড়ী। তা আপনি কোন জগাইকে চাইছেন?
কনস্টেবল – কোন জগাই মানে? যাচ্চলে! এ বাড়ীতেও কি ডজন ডজন জগাই থাকে নাকি অ্যাঁ!
জগাই – আজ্ঞে তা নয়। তবে কিনা জগাইয়ের রকমফের আছে।
কনস্টেবল – জগাইয়ের রকমফের!
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি হলুম চতুর্থ জগাই।
কনস্টেবল – মানে?
জগাই – আমার বাবা হলেন তৃতীয় জগাই। আমার দাদু দ্বিতীয় জগাই। আর তার বাবা
ছিলেন প্রথম জগাই।
(১৩)
কনস্টেবল – লেহ হালুয়া! গুষ্টিশুদ্ধু সকলের নামই জগাই!
জগাই – হ্যাঁ। ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত,
প্রথম পাণিপথ, দ্বিতীয় পাণিপথ এসব শোনেন নি? না শুনতেই পারেন, পুলিশ তো। এত জানবেন
কখন? আপনাদের যা কাজের চাপ!
কনস্টেবল – ও। হুম। তা আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। থানায় চলুন।
জগাই – থানায়! ওয়ারেন্ট! বলেন কি! কি সৌভাগ্য আমার! ওরে কে আছিস! হাবু,
কেলু, ঘেটু শীগগির শরবৎ নিয়ে আয়! আমার নামে ওয়ারেন্ট এয়েচে!
কনস্টেবল – একি! একি! আপনি তো মশাই আচ্ছা ঢ্যামনা! ওয়ারেন্ট শুনলে লোকে ভিরমি
খায়, আর আপনি দেখছি একেবারে আনন্দে দিশেহারা!
জগাই – কি যে বলেন পুলিশদা! ওয়ারেন্ট কি আর যার তার নামে বেরোয়? কাগজে
তো দেখি বড় বড় সব মন্ত্রী, বড় বড় সরকারি আমলা, বড় বড় নেতা, এদের নামেই ওয়ারেন্ট টোয়ারেন্ট
বেরোয়। বলুন ঠিক কি না? সে যাই হোক, আপনি ঠিক দেখেছেন তো? ওয়ারেন্ট আমার নামেই তো?
কনস্টেবল – মশাই, ছাব্বিশ বচ্ছর পুলিশে চাকরী হয়ে গেল। হু হু বাবা! একটা ওয়ারেন্ট
দেখতে ভুল এই শর্মার হবে না। (পকেট থেকে ওয়ারেন্ট বার করে) এই তো, আপনারই নামে ওয়ারেন্ট।
এই যে পরিষ্কার লেখা আছে জগাই মিত্তির।
জগাই – উঁহু, তবে তো হলো না। নাকের সামনে থেকে সুযোগ ফস্কে গেল। একি অসম্মান!
কনস্টেবল – তার মানে? কিসের অসম্মান?
জগাই – আরে এখানে তো লেখা আছে শুধু জগাই! কিন্তু আমি তো চতুর্থ জগাই!
কনস্টেবল – চতুর্থ! না এখানে কোথাও চতুর্থ বলে কিচ্ছু লেখা নেই। থাক আমি বরং
থানায় একবার ঘুরে আসি। বড়সাহেবকে একবার দেখিয়ে ভালো করে জিজ্ঞেস করে আসি।
জগাই – না-না-না, সেটি হবে না। এয়েচেন যখন তখন আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। আপনি
জানেন আমি কোন বংশের ছেলে? আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না? পুলিশ এল, ওয়ারেন্ট বার করল,
অথচ আমাকে গ্রেপ্তার করল না। কেন? আমি কি এলেবেলে? সমাজে কি আমার স্ট্যাটাস নেই নাকি?
কনস্টেবল – এ তো ভালো মুস্কিল! চতুর্থ জগাই লেখা না থাকলে আমি গ্রেপ্তার করব
কি করে? আইনে ব্যাপারটা টিকবে না।
(১৪)
জগাই – তাও তো বটে! আচ্ছা আপনি বসুন, আমি এই বাফুমুটা খেয়ে নিই। হু হু
জাপানী খাবার!
কনস্টেবল – জাপানী! কি বললেন? বামুফু?
জগাই – না না, বামুফু নয়, বাফুমু। মানে বাতাসা-ফুলুরি-মুড়ি। এই হলো গে
আমার জাপানী খাবার। হু হু দ্য গ্রেট জলখাবার অব দ্য গ্রেট জগাই দ্য ফোর্থ।
কনস্টেবল – ধ্যাত জাপানীরা ফুলুরি খায় নাকি! মুড়ি বাতাসা জাপানে পাওয়া যায়
নাকি?
জগাই – হ্যাঁ রে দাদা হ্যাঁ। সব পাওয়া যায়। পুলিশে চাকরী করেন বলে কি লেখাপড়া
একদম করেন না। যাকগে, বসুন। বলুন দেখি কত নেবেন?
কনস্টেবল –
(ভ্যাবাচ্যাকা) কিসের কত?
জগাই – মানে বসতে কত নেবেন? কত টাকা?
কনস্টেবল – মানে? টাকা মানে? বসতে টাকা নেব কেন?
জগাই – না, মানে বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকে দেখে আসছি পুলিশ মানেই হলো উঠতে
টাকা, বসতে টাকা।
কনস্টেবল – আমার বসে কাজ নেই। থানা থেকে ঘুরে আসি। আপনি অপেক্ষা করুন। আমি
এই যাব আর আসব।
জগাই – না দাদা! সেটি হচ্ছে না। যারাই বলে এক্ষুনি ঘুরে আসছি, তারাই আর
আসে না। এ আমার দেখে ঠকে অনেক শিক্ষা হয়েছে। দিব্যি ডিম নিল। হাতে নেওয়ার পরে বলে,
এই যাহ্! জগাই খুচরো আনতে ভুলে গেছি। এখুনি
এসে দিয়ে যাচ্ছি। ব্যাস! সেই যে যায় এক্কেবারে পগাড় পার। আর টিকিটি মেলে না।
কনস্টেবল – কেন? আমি আপনার কাছে ডিম নিয়েছি নাকি?
জগাই – না-না, ডিম নেবেন কেন? হে হে...আমি তাই বলেছি কি? অবশ্য ইচ্ছে হলে
নিতেও পারেন। পুলিশ তো সাবান টু সেফিটিপিন সবই নেয়। মানে... বলছি... আর... কি... যে...
ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। হাজার হোক আপনি পাড়ার পুলিশ। বাড়ী বয়ে এসে ডাকলেন। আপনাকে
কি খালি হাতে ফিরে যেতে দিতে পারি! আমাদের বংশে অতিথিকে কেউ খালি হাতে ফিরে যেতে দিয়েছে
কখনো? না-না, আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। এই আমার খাওয়া শেষ। চলুন।
(১৫)
কনস্টেবল – তারমানে! কি করে আপনাকে নিয়ে যাব? নামেই তো মিলছে না!
জগাই – তা হোক। তবুও আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। পুলিশ তো হামেশাই একে তাকে
তুলে নিয়ে যায়! ওয়ারেন্ট নিয়ে আর কজন কে ধরে? কতবড় সম্মানের ব্যাপার বলুন তো?
কনস্টেবল – হুম, আপনাকে নিয়ে যাই , আর তারপরে রাজ্যের যত দিদি আর দাদারা ঝাঁপিয়ে
পড়ুক। ভুল লোককে লক আপে কয়েদ! কাগজের হেডলাইন। মানবাধিকার কমিশন। ওরে বাবা! পেট টা
আবার কেমন মোচড় দিচ্ছে!
(জগাই হঠাৎ হাত তুলে নাচতে শুরু করে)
জগাই – ইউরেকা – ইউরেকা! পেয়েছি – পেয়েছি!
কনস্টেবল – এই রে! এই – এই মশাই! কি হলো? আরে হলোটা কি? এখনো তো এক ডান্ডাও দিইনি। এরকম
করছেন কেন?
জগাই – শুনুন, অপরাধীদের কি একটাই মাত্র নাম থাকে?
কনস্টেবল – কস্মিনকালেও না।
জগাই – অ্যাই ঠিক বলেছেন। কি রকম নাম হয় ওদের?
কনস্টেবল – ধরুন, কাটা ফটকে ওরফে ফটিক। কানা কেষ্ট ওরফে ফাটা বিষ্টু। গন্নাকাটা
শাকিল ওরফে লঙ্কাবাটা ভোকিল।
জগাই – জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই।
কনস্টেবল – অ্যাঁ! (উইকেট কিপিং এর ভঙ্গীতে কিছুক্ষণ জগাই এর দিকে অদ্ভুত ভাবে
তাকিয়ে থাকে। তারপর আচমকা দৌড়ে গিয়ে জগাইকে জাপটে ধরে চীৎকার করতে থাকে) পেয়েছি! পেয়েছি!
আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই প্রেপ্তার! স্যার! স্যার! ওপর থেকে তাকিয়ে দেখুন স্যার
ছাব্বিশ বছরের চাকরীতে এই প্রথম একজন সত্যিকারের আসামীকে ধরতে পেরেছি স্যার! নো প্রক্সি।
স্যার এবার কিন্তু থানায় ডাক তোলার কাজ আমাকে দিতেই হবে। হুঁউঁউঁউঁউঁউঁ... (বাচ্চাদের
বায়নার মত আওয়াজ করে)
জগাই – আরে ছাড়ুন ছাড়ুন মশাই! করছেন কি! কাতুকুতু লাগছে যে! হিহিহি...
(১৬)
কনস্টেবল – না না! ওসবে ভুলছি না। আসামীকে হাতে পেয়ে থুড়ি বগলে পেয়ে ছেড়ে দিই,
আর আপনি ফুড়ুৎ! এত বোকা নাকি আমি!
জগাই – আরে! এতজোরে চেপে ধরলে আপনার পেছন লিক করে যেতে পারে। সেটা ভেবেছেন!
আপনার পেট টা ঠিক নেই।
কনস্টেবল – ও হ্যাঁ, ঠিক আছে। (ছেড়ে দেয়) কিন্তু পালাবেন না প্লিজ!
জগাই – না না, পালালে আর ধরাবো কেন? ভয় নেই পালাবো না। আচ্ছা একটা কথা
বলবেন দাদা! থানা কি সেই আগের মতোই সেই রকমই আছে?
কনস্টেবল – আগের মত মানে? কি রকম ছিল আগে?
জগাই – হে হে... সে আরেক গপ্পো দাদা। বছর পাঁচেক আগে ডিমের গুমটি বন্ধ
করে দুপুরে বাড়ী ফিরছি। হঠাৎ ছ্যাড়াৎ করে একতাল কাদা আমার বুকে মুখে এসে ধেবড়ে গেল।
চেয়ে দেখলুম এক ব্যাটা মারুতি হাঁকিয়ে যাচ্ছে। সারা গায়ে পেন্টিং নিয়ে রে রে করে তেড়ে
গেলুম। পালাতে গিয়ে মারুতি ব্যাটা কাদায় গেল ফেঁসে। আর নামতে গিয়ে এক ব্যাটা ব্র্যান্ডেড
মাল কাদায় পা হড়কে হড়াৎ করে চিৎপটাং। হিহিহি...সে কি দৃশ্য! কিন্তু বলব কি মশাই, থানায়
গিয়ে সেই সেই ব্র্যান্ডেড মল মালটা উলটে আমার নামে কম্পেলেন করল, আর পুলিশও চোখের পলক
ফেলতে না ফেলতেই চোঁওওওও করে আমায় ধরে নে গেল!
কনস্টেবল – ও! থানায় ঢোকা ওব্যেস আচে তাহলে?
জগাই – ওব্যেস কোতায়! সেই প্রথম। হেঁ হেঁ... বললো খাঁচা খোলা আছে। ঢুকে
পড়।
কনস্টেবল – হুম লকআপ।
জগাই – হ্যাঁ সরকারি খাতায় তাই বলে। ভেতরে ঢুকে দেখি অন্ধকার, দুর্গন্ধ।
তারমধ্যে গোটা পাঁচেক ত্যাড়াব্যাঁকা লোক বসে আছে। ভেতরে মেঝেতে একপাশে জল জমে আছে।
একটা ষন্ডা মতো লোক ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখছিল। মুলোর মত দাঁত বার করে বলল, রাতে আমরা
সবাই হিসি করেছি, তারই জল। খারাপ কিছু নয়। চলে এসো দাদা! তারপর দেখি সারারাত ধরে একবার
করে ফোন বাজে, আর একজন করে ছাড়া পায়, একবার করে ফোন বাজে আর একজন করে ছাড়া পায়। পাঁচবার
ফোন পাঁচজন খালাস। হে হে... ওদের সব মাথারা মানে ওই হলুদ-বেগনী-কালো পার্টির দাদাদের
এক এক মোক্ষম ফোনে সব বেকসুর খালাস। তা দাদা, থানা কি এখনো সেরকমই আছে?
(১৭)
কনস্টেবল – হ্যাঁ, তাতে কি হলো? তোমারও কোনো দাদা কিম্বা দিদি ফিট করা আছে
নাকি?
জগাই – না না, দাদা দিদিরা আমাদের মত ফেকলুকে পাত্তা দেবে নাকি? ওই ভোটের
সময়েই যেটুকু দেয়। তারপরে তো হ্যাট হ্যাট ভ্যাট ভ্যাট...
কনস্টেবল – তাহলে? থানা নিয়ে এত তদন্তে কি দরকার হে চাঁদ?
জগাই – কিন্তু ও যে নরক!
কনস্টেবল – তা তোমার জন্যে কি থানায় স্বর্গ বানিয়ে রাখতে হবে নাকি হে? অপ্সরারা
নাচবে?
জগাই – ধুসসস... আমাদের লাইফে আবার অপ্সরা! হেঃ! অপ্সরা তো ওই ব্র্যান্ডেড
মালদের সম্পত্তি। সেজন্যে নয়। কিন্তু ওই বিচ্ছিরি গন্ধে যে আমার বমি হয়ে যাবে!
কনস্টেবল – উঠে এলে করবে। ওরা হিসি করলে তুমিও বমি করবে। নাও, অনেক হল, এবার
চল।
জগাই – হাহাহাহা... একটু আগে আপনি বলছিলেন, এখন ধরার পরে তুমি! বেশ-বেশ,
ভালোই। আমরা আবার মানুষ! তাঁর আবার আপনি আর তুমি! সে যাকগে, আচ্ছা আমার অপরাধটা কি
জানতে পারলে ভালো হত না?
কনস্টেবল – সেটা কাল কোর্টে গিয়েই জানতে পারবে। এত ইংরেজী পড়তে পারলে আমি কবেই
সার্কেল সাহেব হয়ে যেতাম। নাও, এখন চল তো! চল-চল...! অনেক দেরী হয়ে গেল। ঘুন্টি আবার
অপেক্ষা করছে। তোমাকে লকআপে ঢুকিয়েই তার মানভঞ্জনে দৌড়তে হবে।
জগাই – ঘুন্টি আবার কে?
কনস্টেবল – (সচকিত হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে
সামলে নেয়) না কেউ না। নিজের ডিমে তেল দাও। চল এবার।
জগাই – আচ্ছা চলুন। মা! আমি চল্লুম গো! বাইরে বাটি পড়ে রইলো। (গেয়ে ওঠে)
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি...
(মঞ্চে একটি Zone আলোর বৃত্তে কনস্টেবল ও জগাই হাঁটতে থাকে। আলো
ধীরে ধীরে নেভে। একই সঙ্গে মঞ্চের অন্যপ্রান্তে জগাইয়ের বাড়ীর ভেতর থেকে তার মা বেরিয়ে আসেন। আলাদা Zone এ আলোর বৃত্ত। মা জগাইয়ের
যাওয়ার রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আঁচল দিয়ে চোখের জল
(১৮)
মোছেন। তারপর দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকান। আলো নেভে। মঞ্চে সেই
প্রথম দৃশ্য। বিচারক, উকিল ও জগাই।)
বিচারক – হুম, ব্যাপারটা বোঝা গেল।
উকিল – হুম, বোঝা গেল।
বিচারক – তাহলে শুরু করা যাক।
উকিল – হ্যাঁ হুজুর, কারবাই শুরু হোক।
বিচারক – কি বললেন?
উকিল – আজ্ঞে কারবাই। বিশুদ্ধ হিন্দী, রাষ্ট্রভাষা স্যার। টিভি তে উকিলরা
বলে দেখেছি স্যার।
বিচারক – হুম ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাহলে আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই আপনি
কি আপনার অপরাধ স্বীকার করছেন?
জগাই – অন্যায়টা যে কি করলাম তাইই জানতে পারলাম না এখনো!
উকিল – (একটা কাগজ দেখে
পড়তে থাকে) আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই, পিতা জগমোহন মিত্তির ওরফে তৃতীয় জগাই নিবাস
আটের বারো কাটা ফটিকের ফাটা গলি, গত পাঁচই জুন রাত্রি প্রায় দুটোয় আসামীর বাড়ীতে পাঁচজন
চোর একত্রে ঢোকে ও সর্বস্ব চুরি করে। আজ সাতমাস অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও আসামী এই
বিষয়ে থানা বা প্রশাসনকে কিছুই অবগত করান নাই। চোরেরাও ধরা পড়ে নাই। আসামীর এবম্বিধ
দুঃসাহসিক আইন লঙ্ঘনের কারনে তাহাকে দন্ডবিধির চারশত একুশ নম্বর ধারার একশত চার নম্বর
উপধারার তিনশত বাহান্নর গ উপ উপধারা অনুসারে আদালতে তলব করা হইয়াছে।
বিচারক – ব্যাপারটা বুঝেছেন? কি মারাত্মক অপরাধ আপনি করেছেন! আপনার বাড়ীতে
ভয়ঙ্কর রকমের চুরি হয়ে গেল। আপনি কোথায় তৎক্ষণাৎ থানায় ডাইরি করবেন, ছুটোছুটি করবেন,
কান্নাকাটি করবেন, মাথার চুল ছিঁড়ে চীৎকার করবেন ওগো আমার সব চলে গেল রে…, প্রতিবেশীদের ঘুম আলটপকা ভাঙিয়ে
টেনে আনবেন আপনার বাড়ীতে! তা না, আপনি দিব্যি চেপে গেলেন! আশ্চর্য! এভাবে চোরেদের উৎসাহ
আর ওই ইয়ে কি যেন বলে ইয়ে… অনুপ্রেরণা জোগালেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে এ
তো মারাত্মক ষড়যন্ত্র!
(১৯)
জগাই – না মানে স্যার…
বিচারক – স্যার ট্যার ছাড়ুন। আপনি তো অদ্ভুত মানুষ! সাধারণ লোকে যা করে আপনি
তা তো করলেনই না উপরন্তু পরমসুখে বারান্দায় বসে চপ মুড়ি খাচ্ছিলেন!
জগাই – চপ মুড়ি নয় স্যার বাফুমু।
বিচারক – ওই একই ব্যাপার। আপনি একবারও ভাবলেন না দেশের দশের কতবড় কলঙ্ক আপনি
ঘটিয়ে তুললেন?
জগাই – না, মানে স্যার শুনুন…!
বিচারক – শুনব। শুনব বলেই তো পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করে হাজির করেছে। সরকারি
উকিল মশাই, আপনি কি ক্রশ করবেন?
উকিল – বলুন, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না।
জগাই – কি মুস্কিল! আমি এমনিতেই সত্য ছাড়া বলিনা। আমার বাবার শিক্ষা।
উকিল – আঃ! আপনাকে যা বলতে বলা হচ্ছে তাই বলুন।
জগাই – বেশ সত্য ছাড়া মিথ্যা বলব না। কিন্তু আপনিও বলবেন না বলুন!
উকিল – কি! এটা আমার জন্যে নয়, আপনার জন্যে।
জগাই – অহ! বা রে আজব নিয়ম!
উকিল – হ্যাঁ, তাহলে এবার বলুন জগাইবাবু আপনি ঠিক কিভাবে এতবড় ব্যাপারটা
চেপে গেলেন? বলুন তো!
জগাই – না মানে…
উকিল – মানে টানে নয়। স্পষ্টাস্পষ্টি বলুন আপনি ঠিক কি ভেবে এই মারাত্মক
ঘটনাটা হজম করে গেলেন? ভাবা যায়! স্বাধীন দেশের নাগরিক আপনি। দেশে গণতন্ত্র আছে, আদালত
আছে, থানা আছে, পুলিশ আছে, আপনি সেসবকে অগ্রাহ্য করলেন কিভাবে?
জগাই – আমি তো অগ্রাহ্য করিনি স্যারদা।
(২০)
উকিল – স্যারদা মানে! ওসব ভাঁওতা ছাড়ুন। অগ্রাহ্য করেননি? আপনার বাড়ীতে
এই এতবড় চুরির ঘটনা ঘটে গেল, আপনার সর্বস্ব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেল, আপনি সেটা থানায় জানিয়েছিলেন?
এফআইআর করেছিলেন?
জগাই – না না সেসব করিনি।
উকিল – অ্যাই ধরেছি। আপনি তাহলে স্বীকার করছেন যে আপনি জেনে বুঝে একটা
স্বাধীন দেশের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন সবকিছুকে উপেক্ষা করেছেন। হুজুর আমার আর
কিছুই জিজ্ঞাসার নেই। আসামীর জবাবেই তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণিত। এবার আপনি
দেশের আইনানুগ যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করে আদালত তথা বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্যকে উজ্জ্বল
করে তুলবেন এইটুকুই আমার প্রার্থনা।
বিচারক – হুম। আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই আপনার বাড়ীর দরজা জানলা ভেঙে
চুরি হয়েছে, পাঁচ পাঁচজন চোর আপনার বাড়ীতে ঢুকে আপনার পূর্বপুরুষের অর্জিত বিপুল সম্পত্তির
বহুলাংশ নির্ভয়ে নির্বিবাদে তুলে নিয়ে গেছে। আর আপনি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন। জেগে উঠে
যখন দেখেছেন চুরি হয়ে গেছে তখন কোনোরকম মনস্তাপে না ভুগে অন্য সব দিনের মতোই যথা নিয়মে
বাদাম মুড়ি খেয়ে…
জগাই – আজ্ঞে না স্যার! বাফুমু।
বিচারক – ওই হলো। খেয়ে আপনার ডিমের দোকানে গিয়ে বসেছেন। ডিম বিক্রী করেছেন।
পরের দিনও তাই। তারপরের দিনও তাই। এমনিভাবে চুরির এতবড় ঘটনা যা আমাদের সনাতন গণতন্ত্রের
স্বাধীন দেশের সমৃদ্ধ জীবনের ওপর এক বিরাট ধাক্কা। তা আপনি বেমালুম চেপে গেছেন। এর
ফলে চোরেরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। তাতে সমাজের সমূহ ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার কি কিছু
বলার আছে?
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, বলার অনেক কিছুই আছে। যদি অভয় দেন তো বলি।
উকিল – এখানে সবকিছুই সভয়ে বলো।
বিচারক – হিন্দী সিরিয়াল দেখে দেখে মাথাটা গেছে। সভয়ে নয়, ওটা নির্ভয়ে হবে।
জগাই – হুজুর যে রাতে চুরি হয় আমার ঘরে, আমি ঘুমাইনি। জেগেই ছিলাম। হুজুর,
পাঁচজন নয়, মোটে একজন ক্যাংলাপ্যাংলা লোক। নেহাতই হাড়হাভাতে মার্কা চেহারা। রাতের অন্ধকারে
চুরি করতে
(২১)
ঢুকলো আমি বুঝতে পারলাম। তবু ঘুমের ভান করে আমি পড়ে রইলাম। গরীব
ডিমওয়ালার ঘরে আর কি আছে?
বিচারক – হ্যাঁ, কি কি চুরি গেছিল?
জগাই – (ম্লান হাসে)
যা কিছু ছিল। সেই হাভাতে চোরটা হুজুর কিছু মুড়ি ছিল, সেগুলো জল দিয়ে মেখে গবগব করে
খেল। তারপর এক এক করে একটা অ্যালুমুনিয়ামের তোবড়ানো ফুটো ঘটি, বাবার আমলের একটা বন্ধ
হয়ে যাওয়া টেবিল ঘড়ি, ডিম বেচা তেতাল্লিশ টাকা সবই নিল।
বিচারক – তুমি তখনো কিছুই বললে না?
জগাই – আজ্ঞে না হুজুর। তবে ও চলে যাওয়ার সময়ে আমার ভাঙা ঘরের মাটির কুলুঙ্গিতে
একটা মাটির দোয়াত আর একটা খাগের কলম ছিল, সে দুটোও যখন ঝোলায় পুরে নেয় তখন আমার বুকের
মধ্যেটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।
বিচারক – কেন? কেন? কি মহামূল্যবান জিনিস সেগুলো?
জগাই – বাজারে ওর দাম এক পয়সাও নয় হুজুর। কিন্তু আমার কাছে অনেক। চোরটা
যে কেন ওটা নিল?
বিচারক – ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!
জগাই – হুজুর, আমার বাবা লিখতেন। যে সে লেখা নয়, খবরের কাগজে লিখতেন। এখনকার
মত ঘটনাস্থলে না গিয়ে হোটেলের এয়ারকন্ডিশনড রুমে বসে মদ খেতে খেতে খবরের গল্প লেখা
নয় স্যার। বাবা সত্যিকে সত্যি আর মিথ্যে কে মিথ্যে বলেই লিখতেন। সাদা কে বলতেন সাদা,
কালোকে বলতেন কালো। এখনকার ওপরতলার মানুষদের মত চালাকচতুর ছিলেন না উনি। সত্যি কথা
লিখতে গিয়ে একদিন খুন হয়ে গেলেন মানুষটা। সেই খুনের কোনো কিনারা হলো না। সব কেমন ধামাচাপা
পড়ে গেল। কাগজের মালিক কোনো ক্ষতিপূরণও দিলো না। আমি তখন বেশ ছোট।
বিচারক – তাই নাকি!
জগাই – হ্যাঁ স্যার, আমার সেই বাবা তাঁর লেখার টেবিলে রাখা দোয়াত আর কলমটা
দেখিয়ে বলতেন, জগাই এই হলো সত্য আর বিশ্বাস। এই দুটোতে মন রাখিস। লোভে পাপ আর পাপে
মৃত্যু। লোভ করিস না। লোভে যন্ত্রণা বাড়ে। হুজুর, বাবা ঠিক বলেননি বলুন! চোখের সামনে
দেখলাম লোভের বীভৎস চেহারা। চোরেরা তাদের লোভের থাবায় কেমন করে যেন আস্তে আস্তে গ্রাস
করে নিল
(২২)
চারপাশের জগৎটা। আমি দেখেছি হুজুর রাস্তার মোড়ে হুল্লোড় করা মস্তানদের
যারা মাথা, কেমন করে তাদের গায়ে উঠছে অন্য পোষাক! কেমন করে তারা ভদ্দরলোকদের ভয় দেখিয়ে
চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে ভদ্র পোষাক খুলে পরে ফেলেছে নিজেরা। থানা-পুলিশ-অফিস-কাছারী সর্বত্র
যে কেমন করে তারা গড়ে তুলেছে তাদের জমিদারী, আমি দেখেছি হুজুর! ডিমওয়ালা আমি চতুর্থ
জগাই, আমি সব দেখেছি। খাদ্য আন্দোলন, চালের জন্য মানুষের গুলি খাওয়া। দেখেছি কেমন করে
সোনার টুকরো উজ্জ্বল ছেলেরা আমার মায়ের মুখের ভাষাকে বাঁচানোর জন্যে হাসতে হাসতে বন্দুকের
নলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেখেছি সেইসব হীরের টুকরো ছেলেদের যারা পচে যাওয়া অবস্থার
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে বুকে পিঠে গুলি নিয়ে নোংরা খালের জলে ভেসেছে। আমি দেখেছি,
বদলে যাওয়া দিনের হাত ধরে কত চোর মস্তান রাজা হয়েছে। সভাপতির আসনে বসে বক্তৃতা দিচ্ছে।
আমি, হ্যাঁ হুজুর আমিই দেখেছি। দেখেছি আর ভেবেছি চুরি তো কবেই শুরু হয়েছে। চুরি হয়েই
চলেছে। মানুষের বুদ্ধি চুরি হয়ে গেছে। মানুষের মগজের চিন্তা ভাবনা চুরি হয়ে গেছে। বিবেক
চুরি হয়ে গেছে। সাহস চুরি হয়ে গেছে। সম্মান চুরি হয়ে গেছে।
বিচারক – এই! কি সব বলছ?
জগাই – না হুজুর, এই সমস্ত চুরির কোনো রিপোর্ট কেউ লেখায় নি। কোনো থানাতেই
কোনো রেকর্ডেই তার উল্লেখ নেই হুজুর! আর তাই ছুরি চালানো হাত কখনো আইন বানাচ্ছে, ধর্ষণ
করা শরীর কখনো দেশ আগলাচ্ছে। ওরা দেশটাকে কিনে নিয়েছে স্যার! চুরি করে নিয়েছে। আত আমার
মতো, এই চতুর্থ জগাইয়ের মত ঘরে ঘরে যত জগাই, সবাই জেগে জেগে দেখবে। বুকের মধ্যে তাদের
ব্যাথা মোচড় দিয়ে উঠবে। কিন্তু পাছে প্রাণ যায় সেই ভয়ে ঘুমের ভাণ করে পড়ে থাকবে। আবার
সকাল হবে। তারা খাবে, কাজে যাবে। দোল দুর্গোৎসব ঈদে নাচগান করবে। ১৫ই আগষ্ট ফ্ল্যাগ
ওড়াবে। কেউ কোনো এফআইআর করবে না।
বিচারক – রাষ্ট্রবিরোধী কথা বোলোনা।
জগাই – হুজুর! বাড়ী ফিরে ছেলের মুখের দিকে তাকাবেন হুজুর! আর তাকাবেন আইনের
কেতাবগুলোর দিকে। তারপর দয়া করে ভাববেন, আপনার ছেলের জন্যে ঠিক আছে তো সব! তার ঘর থেকে
চুরি যাবে না তো কিছু! আপনার মোটা মোটা কেতাব পারবে তো সবকিছু বাঁচিয়ে রাখতে! পারবে
তো আপনার আদরের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ থেকে শুরু করে আপনার বিচারের রায় লেখা ওই কলমটাকে
বাঁচিয়ে রাখতে! যে কলমের দিকে তাকিয়ে বাবা বলতেন, মিছিমিছিই বলতেন- জগাই! সত্য আর বিশ্বাস
এই দুইই হলো আসল। একে ছাড়িস না। পারবেন তো হুজুর! পারবেন তো!
(২৩)
(আলো জগাইয়ের ওপর উজ্জ্বল হয়। বিচারক ও উকিলের ওপর আলো কমতে কমতে
নিভে যায়। এর মধ্যেই বিচারক রায় ঘোষণা করতে থাকেন। কিন্তু রায়ের শেষ অংশ শোনা যায় না।
জগাইয়ের গানে চাপা পড়ে যায়।)
বিচারক – দেশের দন্ডবিধির সাতশো সাতাত্তর নম্বর ধারার সাতের সাঁইত্রিশ উপধারা
অনুযায়ী আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং তার… (কন্ঠস্বর ও বিচারক মিলিয়ে যায়)
জগাই – (গান করে) দিন
যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়
মানুষ কি খুঁজে চলে জীবনের আয়নায়
ছোট সুখ শান্তির স্বস্তির অম্লান
হাসি গানে জীবন্ত ছবি যাতে আঁকা যায়।
দিন যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়…
(এক চোর ঢোকে। আলোর বৃত্তের মধ্যে দুজন)
চোর – জগাই!
জগাই – কে?
চোর – আমি চোর।
জগাই – চোর! তার মানে?
চোর – হ্যাঁ আসলে আমি তোমারই মত একজন। (হাসে) আমি সব শুনেছি। ওই কোর্টঘরের
বেঞ্চিতে বসে সব শুনেছি তোমার কথা।
জগাই – তাই!
চোর – হ্যাঁ, পেটের জ্বালায় সেদিন আমি তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম ভাই।
জগাই – ও তুমিই সে!
চোর – হ্যাঁ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আমি তো সেদিন একা ছিলাম। তুমি
আমাকে ধরলে না কেন ভয়ে?
(২৪)
জগাই – না রে ভাই, মায়ায়। তোমার ওই চুরি করতে এসে গবগব করে মুড়ি খাওয়া
দেখে কেমন মায়া হল। তাই… কিন্তু তোমাকে দেখে খারাপ লোক মনে হচ্ছে না! তবে তুমি এই লাইনে
কেন গেলে ভাই?
চোর – (হাসে) এই লাইনে
কি বেছে বেছে খারাপ লোকরাই আসে?
জগাই – তাহলে?
চোর – আসলে কি জানো, তোমার আমার মত অবস্থার লোক যারা তারা আসে অবস্থার
বিপাকে পড়ে। যখন অন্য সমস্ত রাস্তা আমাদের সামনে বন্ধ হয়ে যায়, তখন।
জগাই – তবে যে শুনেছি যারা চুরি করে তারা খারাপ লোক?
চোর – ঠিকই শুনেছ। ন্যায় হোক, অন্যায় হোক যেকোনো উপায়ে রোজগার করা সম্পত্তি
বাঁচাতে সম্পত্তিওয়ালারা এরকম পোস্টার লাগিয়েছে বটে। তবে কি জানো, ওরাই হচ্ছে আসল খারাপ
লোক। ওরাই বড় চোর। আমরা চুরি করি পেটের দায়ে বাঁচার জন্যে। আর ওরা চুরি করে লোভে সম্পত্তি
বাড়ানোর জন্যে।
জগাই – সেকি! সব বড়লোক কি চোর হতে পারে নাকি!
চোর – না না না, তা কেন হবে? সম্পত্তিওয়ালাদের মধ্যেও অনেক ভালো মানুষ
আছে। তবে কি না আবার ওই খারাপ চোররাও সব সম্পত্তিওয়ালাই তো!
জগাই – তোমার কথা যেন কেমন কেমন ঠেকছে! ঠিক বুঝতে পারছি না।
চোর – (হাসে) বেশী
বুঝে কাজ নেই। (চোর ঝোলা থেকে দোয়াত আর কলম বার করে জগাই কে দেয়) এই নাও।
জগাই – (চীৎকার করে
ওঠে) একি! এ দুটো…এ দুটো তুমি…
চোর – হ্যাঁ, বিক্রী করার চেষ্টাও করিনি। তোমার ঘর থেকে ও দুটো নিয়ে গিয়ে
কেমন যেন অস্বস্তিতে ভুগেছি। বিশ্বাস কর, এই সাত সাতটা মাস চুরি করতে পারিনি। মিথ্যে
কথা বলতে পারিনি। কাউকে ঠকাতে পারিনি। কেন কে জানে!
জগাই – এ যে সত্য আর বিশ্বাস। হ্যাঁ, (কলম আর দোয়াত দুটোকে আদর করে) জানো
বড় কষ্টে পড়েছিলাম। না না, তুমি আমার অন্য জিনিস বা টাকা নিয়েছ তার জন্য নয়, এই দুটোর
জন্যে। এ দুটো যে আমার কাছে বড় জীবন্ত। চোরভাই, তুমি এগুলো নেওয়ার পরে আমি বিশ্বাস
হারিয়ে
(২৫)
ফেলছিলাম যে! কেবলই মনে হচ্ছিল তাহলে কি ছোট থেকে যেসব কথা শুনেছি,
যা ধ্রুব বলে জেনেছি, আসলে তা সত্যি নয়? মিথ্যে! আমার বাবা, যার জন্যে আমি গর্বে বুক
সাত হাত ফুলিয়ে বাজারে বসে মাথা উঁচু করে ডিম বিক্রী করি, সেই বাবার সমস্ত জানা মিথ্যে!
ভুল! বিশ্বাস কর আমি ছটপট করেছি। কেঁদেছি। বাবা! তোমার কথা মিছিমিছি নয় বাবা! সত্য
আর বিশ্বাস চুরি হতে পারে কি! পারে না। কিছুতেই পারে না।
চোর – আঃ! তোমার জিনিস তোমাকে ফেরত দিয়ে কি হাল্কা লাগছে! এবার আমি চললাম।
জগাই – চললে? আবার চুরি করবে?
চোর – নাহ, ওসব আর আমার দ্বারা হবে না ভাই। দেখি অন্য কিছু করা যায় কি
না। এই তোমার কাছে শ দু তিন টাকা হবে?
জগাই –কেন? কি করবে?
চোর – ধার নিতাম। ভয় নেই, শোধ করব। নাহলে তো ধার চাইতামই না। চুরি করতাম।
ওই টাকাটা দিয়ে গামছা কিনে বিক্রী করব।
জগাই – (পকেটে হাতড়ে
টাকা দেয়) এই নাও।
চোর – তুমি খুব ভালো মানুষ। চলি ভাই।
(চোর মিলিয়ে যায়। জগাই গান ধরে)
জগাই - নীল কপোতাক্ষের
দেখা নেই বহুদিন
সময়
নিয়েছে কেড়ে কত সুখ কত গান
সকালে
যা ভাবা গেল বিকেলে হলো না পাওয়া
সময়
নিঠুর বড় সে কেবল চলে যায়
দিন
যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়।
ছোট
হাসি আর ছোট ছোট সুখ শান্তির
আশা
নিয়ে পথ চলা আলোছায়া জীবনের
উঠানের
এক কোণে অযত্নে বেড়ে ওঠা
গাছে
ছোট ফুল জাগে অনুকূল আবহাওয়ায়
দিন
যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়।
(আলো গানের সঙ্গেই ধীরে নিভে আসে)
*শেষ*
ছবি : গুগুল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন