স্বপ্নহীনের সাপলুডো
(একাঙ্ক নাটক)
সৌমিত্র চক্রবর্তী
চরিত্র
:
জগাই
বিচারক
উকিল
মা
কনস্টেবল
চোর
ঘোষক
(১)
(মঞ্চের ডানদিকে ডাউন রাইট স্টেজে জগাই দাঁড়িয়ে গান গাইছে। একটি শাওয়ার আলো তার মাথার ওপরে। আধো আলো আধো অন্ধকার। জগাই কে স্পষ্ট দেখা যায় না। বাকি অংশ অন্ধকার।)
জগাই – আয় রে ভোলা খেয়াল খোলা দমদমাদম বাজিয়ে আয়
সোনায় মোড়া স্বাধীণতার ক্ষীর ননী সব গিলবি আয়,
তুই খাবি আর আমি খাব, আর খাবে সব চামচা
নেতার মাথায় সোনার টুপি, জনগনের গামছা।
সাত দশকে সাতশো রকম দেখলি ডাকাত চোর
রাত নেমেছে নাচ রে ভোলা, আসবে কি আর ভোর!
নেতার ছেলে নেতা হবে, চাষীর ব্যাটা চাষী
হায় ক্ষুদিরাম কার জন্য গলায় পরলি ফাঁসী।
(আপ সেন্টারে আলো পড়ে, সেখানে এক বিচারক, এক উকিল কাগজপত্র দেখছেন। বোঝা যায় আদালত। বাইরে থেকে ঘোষণা ভেসে আসে। গোটা মঞ্চই আলোকিত)
ঘোষক – আসামী চতুর্থ জগাই হাজিইইইইইর…!
জগাই – (খুব জোরে চিৎকার করে) হাজিইইইইইইইইইর…
বিচারক – (চমকে ওঠে) অ্যাই … অ্যাই … কি হলো! অ্যাঁ! ওরকম চ্যাঁচাচ্ছো কেন?
জগাই – আঁজ্ঞে স্যার, আজ আমার কি আনন্দ! ওহ্ এত মাণ্যিগণ্যি লোক রয়েছেন আপনারা! আমায় ডাকছেন! ভাবা যায়!
বিচারক – তোমার দশ টাকা জরিমানা হলো।
জগাই – কেন? কেন?
বিচারক – পনেরো টাকা ফাইন হলো।
জগাই – অ্যাই মরেচে! ফাইন কেন? আর বেড়েই বা যাচ্ছে কেন?
(২)
উকিল – অ্যাই মশাই চেপে যান না। বেশী বকছেন কেন? এই জন্যেই তো ফাইন বেড়ে যাচ্ছে।
জগাই – অ! (চুপ করে যায়)
বিচারক – আদালতে চ্যাঁচামেচি করে আদালতের পবিত্রতা নষ্ট করার চেষ্টার অপরাধে আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইয়ের পনেরো টাকা জরিমানা হলো। (বাইরে টাইপের শব্দ)
আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই! (জগাই চুপ করে থাকে) কি হলো! সাড়া দিচ্ছেন না কেন? (জগাই তবু চুপ করে থাকে) কি ব্যাপার! কথা বলছেন না কেন বলুন তো? একটু আগেই যা গলা ফাটালেন তাতে বোঝা গেছে বোবা তো নন? তবে? (জগাই নির্বাক) হুম। আমার প্রশ্নের উত্তরে কথা না বলে আদালত অবমাননা করার অপরাধে আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইয়ের দশ টাকা ফাইন হলো। (বাইরে টাইপের শব্দ)
জগাই – হুজুর! হুজুর! একি শাঁখের করাত!
বিচারক – কি?
জগাই – হুজুর! কথা বলার জন্যেও ফাইন! আবার না বলার জন্যেও ফাইন! এতো খুব খিটকেল কান্ড দাদা!
বিচারক – দাদা কাকে বলছেন? এটা পাড়ার রক নয় বুঝেছেন! এটা কোর্ট। দাদা টাদা নয়, এখানে স্যার বলবেন।
জগাই – আচ্ছা স্যার! আপনারা যেমনটি বলবেন তেমনটিই করব স্যার! কথা বলতে বললে বলব, চুপ করতে বলেছেন কি সঙ্গে সঙ্গে চুপ। আর কথাটি নয়। (গেয়ে ওঠে) তুমি যেমন চলাও তেমনি চলি, আমি যে তোমার গাধা হে…
উকিল – চুপ! চুপ! আবার গোলমাল করে!
(জগাই নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করে)
বিচারক – আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আপনি জানেন তো?
জগাই – স্যার! গতকাল থেকে ক্রমাগত সেই চেষ্টাই কররে যাচ্ছি। পুলিশ আমাকে ধরলো, থুড়ি, আমি পুলিশকে দিয়ে নিজেকে ধরালাম, কিন্তু কোন অভিযোগে ধরালাম সেটাই এখনো পর্যন্ত…
(৩)
বিচারক – আপনাকে যতটুকু জিজ্ঞেস করা হবে তার বাইরে একটা কথাও বলবেন না।
জগাই – না দাদা অ্যাই না না… না স্যার! একদম বলবো না।
বিচারক – আপনার উকিল কোথায়?
জগাই – উকিল! আমার তো কস্মিনকালেও কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, হেকিম, বদ্যি, মোক্তার, ওভারসীয়ার কেউ নেই স্যার! আমার দাদু, না না, নিজের দাদু নয় হে হে… এক পাতানো দাদুর ভায়রাভাই শুনেছি উকিল ছিলেন স্যার। কিন্তু…
বিচারক – না না তা নয়। এখানে আপনার উকিল কে?
জগাই – (মঞ্চে দাঁড়ানো উকিল কে দেখিয়ে) কেন? ওই যে উনি।
উকিল – ( চমকে ওঠে) আমি! আমি আবার আপনার উকিল হলাম কখন?
জগাই – আরে আমার আর তোমার বলে সত্যিই কিছু কি আছে? হে হে… আমি স্যার অত বোকা নই। এ সংসার মায়া, প্রপঞ্চময়। এখানে সবাই অনিত্য তা আমি জানি। হে হে… কা তব কান্তা কস্তে পুত্রহ্ … আপনি আমার কেন হবেন স্যার? আপনি আপনারই। তবে কিনা লোকে যে বাসে যায় বলে আমার বাস, যে কারখানায় কাজ করে বলে আমার কারখানা, তেমনই আর কি…!
বিচারক – আঃ! বাজে কথা নয়। উনি তো সরকারি উকিল। আমি জিজ্ঞেস করছি, এই মামলায় আপনার উকিল কে?
জগাই – মামলা! কোন মামলা! কার মামলা!
উকিল – আপনার বিরুদ্ধে মামলা।
জগাই – কেন? কেন? দাদা হুজুর স্যার! আমার বিরুদ্ধে মামলা কেন? আমি তো স্যার চিটফান্ডের মালিক নই কিম্বা স্যার নেতাও নই যে স্টিংবাজী তে টাকা নিতে গিয়ে ফেঁসে গেছি! কিম্বা আমার তো স্যার অনেক জমিজমাও নেই! তবে আমার বিরুদ্ধে...
উকিল – আপনি অসম্ভব অন্যায় করেছেন তাই।
জগাই – অন্যায়! অ! ন্যায়ই বা করলাম কখন আর অন্যায়ই বা করলাম কখন? যাচ্চলে! তাহলে আমি ছাড়া বাকী সবাই কি ন্যায় করে চলেছে?
(৪)
বিচারক – সেটা আপনার জানার কথা নয়। দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনাকে কি গ্রেপ্তার করার সময়ে জানানো হয় নি যে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি?
জগাই – হে হে স্যারদাদা! সে সুযোগ পেলে তবে তো! আমাকে তো গ্রেপ্তার করতেই পারেনি।
উকিল – তারমানে! আপনি ফেরার হয়ে গেছিলেন? (বিচারকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে) স্যার! এ ডেঞ্জারাস অপরাধী। সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল। আমাদের আইনের বুকে মানে ল এর বইয়ে আছে মানে টীকাতে লেখা আছে ফেরোশাস মিসক্রিয়েন্টরা প্রথমে পরিকল্পনামাফিক
ক্রাইম করে আর তারপরেই ফেরার হয়ে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যেহেতু এই পাগলা জগাইয়ের ক্ষেত্রে থুড়ি এই চতুর্থ জগাইয়ের ক্ষেত্রেও হুবহু তাই হয়েছে, অতএব ধরে নেওয়া যাক অপরাধ প্রমাণিত হলো এবং জগাইকে তার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি জনগনমঙ্গলদায়ক সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন জানাচ্ছি। জয় বজরঙ্গবলী!
বিচারক – অ্যাই কোর্টে ওসব বলবেন না। রাজনৈতিক শ্লোগান কোর্টে নিষিদ্ধ।
উকিল – সরি স্যার! অভ্যাসে বেরিয়ে গেছে। আর হবে না। কিন্তু স্যার এটা রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, এটা তো ধর্মীয়...
বিচারক – ওই একই হলো। এখন যাহা ধর্ম তাহাই রাজনীতি। যাইহোক, শুনুন অভিযোগ এত কম সময়ে প্রমাণ হয় না। এত তাড়াহুড়ো করলে আমার আপনার দুজনেরই নাম গিনেস বুকে উঠে যাবে। কাগজগুলো হইচই শুরু করে দেবে। আপনার কাচকলা। আমার প্রমোশনের বারোটা বেজে যাবে।
উকিল – কেন স্যার? কেন কেন? উল্টোটাও তো হতে পারে! আপনি স্যার রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন, কেসে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে পারেন বলে কর্মক্ষম জজ হিসেবে ডবল প্রমোশন পেতে পারেন।
বিচারক – আরে রাখুন তো ডবল প্রমোশন! জেলা জজের এজলাসে বারো তেরো বছর ধরে কত কেস ঝুলে আছে জানেন? তাকে টপকে তাড়াতাড়ি কেস নিষ্পত্তি করতে গেলে পেছনে হুড়কো দিয়ে দেবে।
উকিল – তা অবশ্য ঠিক।
বিচারক – আর তাছাড়া একসঙ্গে সব কেস যদি পরপর ফয়সলা হতে থাকে তাহলে এতএত লোককে রাখার মত এত জেল আছে নাকি? তখন একটা বিশৃঙ্খলা হতে পারে। সরকার পড়ে যেতে পারে, জানেন?
(৫)
উকিল – হ্যাঁ স্যার, তাহলে থাক। আবেদন উইথড্র করছি। কেস চলুক। কিন্তু স্যার ও তো ফেরার হয়েছিল।
বিচারক – (জগাই কে) কি! আপনি স্বীকার করছেন তো যে আপনি ফেরার হয়েছিলেন বলেই পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে নি?
জগাই – যাচ্চলে! আমি আবার কখন এ কথা বললাম!
উকিল – সে কি! আপনিই তো বললেন যে পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি!
জগাই – হ্যাঁ তাই বলেছি। কিন্তু ফেরার হয়েছিলাম এ কথা আবার কখন বললাম?
উকিল – বাহ্! আপনি জলজ্যান্ত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ পুলিশ আপনাকে ধরতে পারছে না, কেন? আপনি কি রাজনৈতিক নেতা নাকি?
জগাই – না না স্যার, আমি নেতা হব কেন? নেতা হওয়ার মত কোনো অযোগ্যতাই আমার নেই। আমি তো সামান্য একজন ডিমওয়ালা মাত্র।
উকিল – তাহলে আপনি কি ইয়ার্কি করছেন নাকি! জানেন এটা কোর্ট!
জগাই – হাড়ে হাড়ে জানি স্যার। রীতিমতো জানান দিয়েই এসেছি। আর এসেই জানতে পেরেছি যে এটাই সেই কোর্ট। যেখানে এলে মানুষের সাড়ে সব্বোনাশ।
বিচারক – বাজে কথা ছাড়ুন। আসল ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো।
জগাই – সেটাই তো অনেকদিন ধরে বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি হুজুর। কিন্তু বলার সুযোগ পাচ্ছি কই? একবার মুখ খোলা আর একবার মুখ বন্ধ করার দাপটে কথাগুলো ঠিকমত পেট থেকে স্লিপ করছে না।
বিচারক – আদালতে দাঁড়িয়ে অবান্তর কথা বলার অপরাধে আপনাকে আরও দশ...
জগাই – (আর্তস্বরে চিৎকার করে বিচারককে থামিয়ে দেয়) থামুন থামুন স্যার দাদা হুজুর! এত ঘন ঘন দশ করে চাইলে আমিই বা পাব কোথায় বলুন? আজকাল তো ছটা ডিম বিক্রী করলেও পুরো দশটা টাকা পাই না।
(৬)
উকিল – দেখুন দেখুন স্যার, পরিষ্কার রাষ্ট্রবিরোধী কথা। অসন্তোষ, বিক্ষোভ ইয়ে মানে ইয়ে... (কথার খেই হারিয়ে ফেলে)
বিচারক – ঠিক আছে, ঠিক আছে। শুনুন চতুর্থ জগাই, আপনি ক্রমাগত রাষ্ট্রবিরোধী
কাজ করে চলেছেন। সাবধান হন।
জগাই – কেন কেন হুজুর? কি করলাম আমি?
বিচারক – এইমাত্র আপনি আমাকে জরিমানার কথা বলতে বাধা দিলেন। জানেন, এতেও জরিমানা হতে পারে?
জগাই – স্যার, বরং এক কাজ করুন। আমাদের গোটা পরিবারটাকেই দশ বচ্ছর জেলে দিন। সেটা স্যার সহজ। কিন্তু ওই দশ দশ করে বাড়লে আমার পক্ষে দেওয়া খুবই কঠিন।
উকিল – ওহে এটা পাড়ার চায়ের দোকান নয় যে এখানে দর কষাকষি হবে।
বিচারক – যাইহোক, এবার আসল কথায় আসা যাক। পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি কেন?
জগাই – সেটা স্যার পুলিশই ভালো বলতে পারবে। আমি তো স্যার পুলিশকে সহযোগিতা করেছি। ওদের দিয়ে আমাকে ধরিয়েছি।
বিচারক – ব্যাপারটা কিরকম? খোলসা করে বলুন।
জগাই – এই তো পরশু সকালের কথা। আমি তখন আমার বাড়ীর রকে বসে বাফুমু খাচ্ছিলাম।
বিচারক – কি খাচ্ছিলেন?
জগাই – আজ্ঞে বাফুমু।
উকিল – সে আবার কি? কোনো জাপানী খাবার নাকি? কোন দোকানে পাওয়া যায় বলুন তো? নাকি শপিংমলে? আমার মিসেস আবার এইসব বিদেশী খাবার খুব লাইক করেন। বলুন বলুন, তাহলে আজই ফেরার সময় কিনেই ফিরব।
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার খুব প্রিয় এক জাপানী খাবার। আমি আমার চার পুরুষের ভিটের বারান্দায় বসে খাচ্ছি আর গান গাইছি। তখন...
উকিন – গান! এতবড় অন্যায় করেও গান গাইছেন?
(৭)
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ স্যারদাদা। গান আমার রক্তে দাদাস্যার। গান গাইতে আমি খুবই ভালোবাসি। তা আমি বসে আছি। খাচ্ছি আর গাইছি...
(জগাই গান গেয়ে ওঠে। গানের মধ্যেই মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। গান চলতে থাকে। আলো জ্বললেই দেখা যায় একটা ভাঙাচোরা বাড়ীর রোয়াকে বসে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের বাটি হাতে সে গান গেয়ে চলেছে আর খাচ্ছে)
কথা বলতে ভার দিয়েছ
বোবা কালার এই ভুবনে।
আমিই নিছক গণ্ডমূর্খ
আর সকলে সবই জানে।।
আড্ডা দেওয়ার বেঞ্চি দিলে
তার দু পায়া নড়ন চড়ন।
ডাকলে তবু কেউ আসে না
এক এক জনের এক এক ধরন।।
সাপলুডো কি দাবার ছকে
ঘড়ির কাঁটা অবিশ্রান্ত।
সময় এখন চালচুলোহীন
আগেভাগে কে আর জানতো!
স্বপ্নহীনের বুকপকেটে
(৮)
লাল নীল সব কলম থাকে।
স্বপ্ন ছাড়াই পদ্য লেখে
রাজা তাকেই বাঁচিয়ে রাখে।।
কথা বলতে দায় চাপালে
বাচাল আমি চিরটাকাল।
দাঁড়ের ময়না আমি তো নই
কোদাল কে তাই বলি কোদাল।।
ব্যাঘ্র আজও ব্যাঘ্র এবং
শকুন আজও শকুনই আছে।
মানুষ কেবল পালটে যাচ্ছে
নিত্য নতুন বাজার ধাঁচে।।
উলটে পালটে সব দেখেছি
তন্ত্র মন্ত্র গুরুর বিধান।
নানান পথে নানান মতে
কখনো বাম কখনো ডান।।
দিন কে যারা রাত্রি
ক্রমশ
ছবি : গুগুল
ছবি : গুগুল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন