মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

পিয়ালী বসু ঘোষ

সাঁঝবিহান ( দ্বিতীয় পর্ব )
পিয়ালী বসু ঘোষ


সতীশের বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার রাতে বাড়ি ফিরে তার বইগুলো নাড়াচাড়া করা ছিলো সতীশের অভ্যাস একসময় বাড়িতে বসে এই পরীক্ষা দেওয়া যেত তেমন ভাবেই একদিন সতীশও ডাক্তারি পাশ করেছিল এবং সে খবর কেউ খুব একটা জানত না মাঝে সাঝে বন্ধুদের মধ্যে ডাক্তারি করার চেষ্টা করতো কিন্ত সকলেই এমন হাসাহাসি করত যে নিজেই একসময় ক্ষান্ত দিয়েছিলো শাল্মলী মজা করে বলত ,"আমিই তোমার একমাত্র গিনিপিগ "

এখানে এসে সতীশের বেশ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে মানুষ কত সহজ সরল হতে পারে তা এদের না দেখলে বোঝা যায়না খাপরার চাল ,মাটির দেয়াল দড়ির চৌপাই তে বসে ভাবে দুপুরের খাওয়া সেরেই শাল্মলীকে একটা চিঠি লিখবে এই মানুষগুলোর সারল্যর কথা লিখবে কি করে যেন ওরা জেনে গেছে একটু আধটু চিকিৎসা করে সকাল সন্ধ্যা দূরের কাছের গ্রাম গুলো থেকে মানুষ আসে ওর কাছে 'ডাগদর বাবু' বলে ডাকে ওরা এই ডাক যেনো চাঙ্গা করে তোলে সতীশের ঝিমিয়ে পরা আত্মসত্ত্বাকে মানুষগুলোর ভালবাসা তেও কোনো খাদ নেই বোধহয় অর্থ নেই বলেই অহংকারও নেই ওদের গরম ধূলো শরীরে মাখামাখি করে পেটে খিল দিয়ে আস্ত একটা জীবন ওরা কেমন অনুযোগহীন কাটিয়ে দেয় ঘুমোয় খুব ওরা তখন ডাগদর বাবুর ওষুধেরও খুব একটা দরকার হয়না ওদের


সতীশের সঙ্গী এখানে ফজিরাম ধীরে ধীরে বিশ্বস্ত অনুচরও হয়ে উঠছে অঞ্চলের গোমস্তা সাহেব সতীশ কে খুব একটা পছন্দ করেনা ওর সম্পর্কেই নানা খবরাখবর সতীশকে এনে দেয় ফজিরাম সতীশ ওর মুখে গল্প শুনেছে নাকি একবার বাঘের খপ্পরে পড়েছিল কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধির কারনে সে যাত্রা নাকি রক্ষা পায় আরও বলে "ডাগদর বাবু আমি বাঘের গায়ের গন্ধ চিনি ,আর জানোয়ারেরও "বাঘ কে জানোয়ার বলতে নারাজ এই ফজিরামের চিকিৎসা করেছিলো সতীশ এখানে এসে প্রথম ম্যালেরিয়া হয়েছিল ওর প্যলুড্রিন জাতীয় ওষুধ দিত ওকে সতীশ সেরে উঠেই রীতিমত চেলা হয়ে গেলো ওর ফজিরাম অবশ্য তা একদিক থেকে ভালো রাতেও একেক দিন ওর কাছেই থেকে যায় ফজিরাম এই নতুন জায়গায় একজন সঙ্গী কথা বলার মানুষ থাকলে মন্দ কি তবে একটাই সমস্যা ; বড্ড নাক ডাকে

এমনিতে সতীশের কাজ হচ্ছে বাঁশ গাছ কাটা কাগজ কলে সেগুলো চালান করা বাঁশ গুলো সমান বারো ফুট করে কাটা হয় বাকি টুকরো কাগজ কল গুলোতে চালান যায় এই বাঁশের গোড়া দিয়েই স্থানীয় মানুষেরা আচার চাটনি বানিয়ে খায় সকালে সূর্যোদয়ের পর ওদের কাজ শুরু হয় আর দুপুরের মধ্যে শেষ হয় কাজ যাতে সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই কুলি কামিনরা ঘরে ফিরতে পারে
এরপর বাকি সময় সতীশ এই ফজিরামের সাথে নানান গল্প করেই কাটিয়ে দেয় আর মঝে মঝে শাল্মলী কে লেখে এখানকার মানুষদের কথা,জঙ্গল পাহাড়ের কথা ,ওর এই একাকীত্ব ভালবেসে ফেলার কথা এখানকার আশ্চর্য নিবিড় শান্ত জীবন ওর ভিতরের আমিটাকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে -সেই সব কথা


কলমীর বাড়িটা পাহাড়তলীর সমতলভূমিতে যেখানে ঝুপ করে পথটা শেষ হয়ে গেছে সেখানে পুরু ঘাস জমির ভিতরে এই বাড়িটা সংলগ্ন অঞ্চলটুকু খুব যত্ন করে সাজিয়ে নিয়েছে জমি সংলগ্ন পথে কুয়োতলির ধারে একটা পলাশ গাছ আছে এখন লাল ফুলে ভরে থাকে কুয়োপাড় সাঁঝ পেটে থাকার সময় আর হারান মিলে এই চারা টা লাগিয়েছিলো আর আজ যেন হারানের অনুপস্থিতির একমাত্র সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই হু হু রঙের বন্যা নিয়ে কলমী হারান কে বিয়ে করেছিল বাপের অমতে কলমীর বাপ মেয়ের সোমত্ত যৌবনের কারনে এদিক ওদিক পাত্র খুঁজছিলো ষোলো বছরের কলমী নিজের শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলো বাপের পছন্দ করা মাঝবয়সী লোক তার না-পসন্দ এদিকে হারান তখন অল্পবয়েসী হাট্টাকাট্টা জোয়ান পুরুষ ওকে দেখে ওর হাতছানিতেই কলমী একদিন সরে পড়েছিল হারানের সাথে

তারপর কিছুদিনের ছবি পলাশ রঙের মতই রঙীন কিন্তু হারানের ভাটিখানায় যাবার নেশাটা ওকে মাতাল ,অপদার্থ নচ্ছার করে তুলল ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কোনও কাজ তো করতই না মাঝে সাঝে যাওবা করতো সেই টাকার বেশিটাই শুঁড়িখানায় দিয়ে মাঝরাতে দুলে দুলে বাড়ি ফিরেই চড়াও হত কলমীর ওপর এভাবেই কখন দিনআনা দিন খাওয়া সংসারে জলপরীর মত তিন তিনটে মেয়ে ঘর আলো করে এলো হারান খুব খুশি মেয়ে পেয়ে কিন্তু প্রতিবেশীরা খোঁটা দিতে লাগলো বলল ,যে মরদ তার আওরত কে ভাত কাপড় দিতে পারেনা তার আবার মেয়ের শখ

কিন্তু হারানের এই নেশাটা বেড়েই চলল মেয়েগুলোকে খেতে দিতে পারেনা ,পরনের কাপড় থাকেনা এসবই দেখে হারান নেশা কেটে গেলে তবু সন্ধ্যের পর কি এক টানে ভাটিখানার দিকে হেঁটে যায় অন্ধের মত আর রাত বাড়লে পরিচিত রাস্তা ধরে চলে আসে ঘরে যেভাবে পরাজিত সৈনিক ডেরায় ফেরে তেমনই মাতাল পুরুষ দেখলে বড্ড মায়া হয় ওর

এমনই একরাতে কলমী আর সহ্য করতে না পেরে ওর ঘরে ঢোকার পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বলে আগে সবার ভাতের যোগাড় কর তারপর ঢুকবি ঘরে এই বলে ওকে ঠেলে সরিয়ে দোর দেয় দরজা বন্ধের শব্দে মেয়েরা ঘুম ভেঙে উঠে বসল কুপির দপ দপ আলোয় কলমী দেখল হারান চলে যাচ্ছে কুয়োতলির দিক দিয়ে উত্তরের জঙ্গলের দিকে ,আর বার বার ফিরে দেখছে ঘরের দিকে কলমী হুহু কান্নায় ভেঙে পরে জড়িয়ে ধরে মেয়েগুলোকে ওই যাবার পর আর ফেরেনি হারান হারানের না ফেরাটা কলমীকে শক্ত জেদী করে তুলেছে মানসিক ভাবে তীব্র অভিমানটা ঢেকে রাখে ওর চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে

এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরের দিকে হাঁটছিল কলমী মেয়েগুলো এতক্ষণে নিশ্চই ইস্কুল থেকে ফিরে এসেছে সাঁঝ 'দিন কেমন বেঘোরে ঘুমায়!আজও যদি এই ভর সন্ধ্যেবেলায় ওকে ঘুমাতে দেখে তবে চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে দেবে ঘর থেকে
দূর থেকেই দেখল মেয়ে দুটো বই খাতার ওপরে দুচোখে ঘুম নিয়ে ঢুলছে মনে হলো কি যেন নড়ছে একটা ছায়ামত কুয়োতলির দিকে কাছে যেতেই দেখল সাঁঝ বমি করছে ওখানে এই অবেলায় আবছা আলোয় দেখল সাঁঝের কপালে ঘাম ,হাফাচ্ছেও একটু কলমীর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো সাঁঝের কাছে গিয়ে নাক কুঁচকে চোখ ছোট করে বলল ,"কি হয়েছে রে পোড়ারমুখি "
সাঁঝ চোখ নামিয়ে নিল ক্লান্ত ভয়ার্ত কলমীর অবশ শরীরটা লুটিয়ে পড়ল কুয়োতলীর ধারে

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: চন্দ্রাণী বসু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন