প্রসঙ্গ : টেরাকোটা
ভজন দত্ত
ভজন দত্ত
১.
TERRA-COTTA শব্দটি ইটালিয়ান।ল্যাটিন থেকে এসেছে। যার অর্থ baked earth। বাংলায় 'টেরা' ও 'কোটা' শব্দ দুটিকে পৃথক ভাবে ব্যবহার করলে কি মানে হয় পাঠক তা জানেন। চিন দেশে terracotta army র কথা জানেন অনেকেই।
সে যাই হোক, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সর্বত্র টেরাকোটা দেখা যায়।মৃৎশিল্পের মাধ্যমেই পৃথিবীর আদিম এই শিল্প মাধ্যমের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এ বিশ্বের প্রযুক্তিবিদ্যার স্বাক্ষর। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস জানতে সাহায্য করে টেরাকোটা শিল্প।প্রমাণিত হয় আদিম আন্তর্জাতিক যোগসূত্র। টেরাকোটা আদিম মননচর্চার প্রমাণ হিসাবে আজো বর্তমান।ভারত ছাড়াও গ্রিস, মিশর, মেসোপটেমিয়া, চীন, প্রাক কলম্বিয়া আমেরিকা থেকে পাওয়া গেছে দগ্ধমৃত্তিকা বা পোড়ামাটির প্রচুর নিদর্শন।ঐতিহাসিকদের অনুমান প্রায় ছ-হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে (প্রোটো-ডাইনেস্টিক কাল)মানুষ টেরাকোটা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। টেরাকোটার জগৎ একদিকে আন্তর্জাতিক অপরদিকে সার্বজনীন। কারণ, সহজেই পাওয়া যায় মাটি। মানুষের আদি ইতিহাসের অকৃত্রিম রূপটি অনুসন্ধান করতে হলে,টেরাকোটা অনুশীলন করা ছাড়া উপায় নেই। হরপ্পায় পাওয়া গেছে একটি টেরাকোটা ফলক। বিস্ময়। অপার বিস্ময় জাগে শুধু ভেবে, কি অনন্ত ছিল কল্পনা শক্তি! J.N.Banerjee : Pautanic and Tantric Religion (1966) লিখেছেন- "An oblong terracotta seal from Harappa with impression on both sides shows on the right side of its obverse face a nude female shown upside down with legs wide apart, and a plant issuing from her womb" হে পাঠক ভাবুন সেই হরপ্পা আমলের শিল্পের,মানুষের কল্পনার কথা।
২.
গবেষণা থেকে জানা যায়,[Social Background of Ancient Indian Terracottas.(CIR.600B.C.- 600A.D.) Devangana Desai---HISTORY AND SOCIETY :Essays in honour of Prof.Niharranjan Roy. Ed.Devi Prasad Chottopadhyaya, K.P.BAGCHI & COMPANY, Calcutta, 1976.] ভারতে প্রধানত নগর বিকাশের ধারাকে কেন্দ্র করেই টেরাকোটা শিল্পের বিকাশ- তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। প্রাক মৌর্য যুগে টেরাকোটা ছিল হাতে গড়া, মানে অনুন্নত, শ্রীহীন, সাদামাটা। ষোড়শ মহাজনপদ থেকে তখনো মগধ ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছায়নি। নগরায়ণের সবে সূচনা হচ্ছে। নন্দবংশ মগধকে ক্ষমতাবান নগর করে তোলে।মৌর্য যুগে প্রধানত মগধ অঞ্চলেই শিল্পসুষমা মন্ডিত, ধর্মনিরপেক্ষ, শুধুমাত্র কলা- নিদর্শন হিসাবেই টেরাকোটা শিল্পের বিকাশ ঘটে। মৌর্য পরবর্তী যুগে (২০০ খ্রিপূ- ৫০খ্রিপূ) টেরাকোটা শিল্পের আরো উন্নতি হয়।এসময়ে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। একশ্রেণীর অর্থবান,শৌখিন মানুষেরা টেরাকোটা সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।ধর্মীয় প্রয়োজন ছাড়াও ঘরবাড়ি সাজাবার জন্যও তারা টেরাকোটা সামগ্রীর প্রতি আকৃষ্ট হয়।ক্রমবর্দ্ধমান চাহিদা মতো যোগান দেওয়ার জন্য টেরাকোটা শিল্পে ছাঁচের প্রচলন ঘটে। ফলে দ্রুত চাহিদামত যোগান দেওয়া সম্ভব হোলো এবং এটি একটি বিশিষ্ট শিল্প রূপে বিকাশ ও খ্যাতিলাভ করে।
ছাঁচ ব্যবহার শুরু হওয়ার ফলে এই শিল্পে একাধিক বিষয়ের সূচনা হয়। যার প্রভাব অন্য শিল্পের ক্ষেত্রেও পড়ে।
৩.
পশ্চিমবঙ্গের নানান জায়গায় টেরাকোটার কাজ দ্যাখা যায়, কিন্তু বিশিষ্টতায় সুনাম কেড়ে নিয়েছে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর। এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেসব শিল্পকর্ম। ছোঁয়া যায়, সামনে দাঁড়িয়ে তোলা যায় সেল্ফি। বিষ্ণুপুরের এই মন্দির টেরাকোটা সর্বভারতীয় বিশেষ করে পূর্বভারতের টেরাকোটা শিল্পরীতি থেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র ধারার নয়। ১৬ -১৭ শতকে এই কলানগরী বিষ্ণুপুরের পটভূমিকাটি সম্পর্কে চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত, 'ভারতের শিল্পসংস্কৃতির পটভূমিকায় বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা '- গ্রন্থে লিখেছেন ----
" মোগল ভারতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ক্লাসিক-উত্তর প্রাক্ মধ্যযুগের সর্বভারতীয় সংস্কৃতির বিবর্তিত ধারাটিরই এক মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। শুধু বিষয়বস্তুর দিক থেকেই নয়, একটি পরিণত সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় চিত্ররীতিও এর অধিকাংশ টেরাকোটা চিত্রকে যে বিস্ময়কর শিল্পবৈভবে শ্রীমন্ডিত করেছে তা ভারতীয় শিল্পকলারই এক সুসমৃদ্ধ রীতির বিবর্তিত রূপ। " তিনি বলেছেন " উড়িষ্যা এর মূল উৎসস্থল।" সে কারনেই বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটায় ---
" গুজরাতি, মোগল আর ওড়িশি চিত্রের বহু বহিরঙ্গ উপাদান একত্রিত। এখানের টেরাকোটা- চিত্রের বিষয়বস্তু, মোটিফ সবকিছুর মধ্যেই সারা ভারতের মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত।আঞ্চলিকতার চিহ্ণ এখানে নেই বল্লেই চলে। "
(চলবে)
ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বিপ্লব বরাট
পরের পর্ব গুলি মিলিয়ে লেখাটা কি একসঙ্গে করা যায় না?
উত্তরমুছুন