হিলষ্টেশন.....
হানিমুনে ঝাঁটিংগা এসেছে বিদুর আর বিভুঁই।
অন্তরীপের কাছেই প্রথম ঝাঁটিংগার কথা শুনেছিলো বিদুর।তখন তারা সবে মাধ্যমিক দিয়েছে।ছুটির সেইদিনগুলোয় অন্তরীপ একদিন এসে বললো সে তার বড়কাকার সাথে ঝাঁটিংগা যাচ্ছে।অদ্ভুত নাম,বিদুর সহ সব বন্ধুরা বেশ অবাক হয়েছিলো।বিস্ময়ের আকাশ আরো বড় হলো যখন অন্তরীপ ফিরে এসে ঝাঁটিংগার প্রাকৃতিক রূপ ও পাখিদের রহস্যময় সুইসাইডের কথা জানালো।তখন থেকেই বিদুরের খুব শখ ঝাঁটিংগা দেখার।
বিয়ের পরে সেই ঝাঁটিংগা দেখার সুযোগটা তাই লুফে নিলো বিদুর।এখানে এসে প্রথমেই যার কথা মনে পড়লো বিদুরের সে অন্তরীপ।উচ্চমাধ্যমিকের পরে অন্তরীপ যে দিল্লি গেলো তখন থেকে ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাথে অন্তরীপের যোগাযোগটা নষ্ট হয়ে গেলো।কোথায় আছে কি করছে আগে ওর মায়ের সাথে দেখা হলে জানা যেত বছর পাঁচেক হলো সেই সুযোগটাও বন্ধ হয়ে গেলো অন্তরীপের বাবা মা দিল্লি চলে যাবার পরে।
ওয়াচ টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বিদুর সিগারেট টানছে।
-বিদু না?
বিদুর বিস্ময়ে তাকায়।হ্যাঁ,কিন্তু আপনাকে ঠিক....
-আমায় চিনতে পারছিস না?ভাল করে তাকিয়ে দেখ।
বিদুর মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু না পেরে মাথা নাড়ে।না,সত্যিই চিনতে পারছি না।
-আমি কিন্তু তোকে একবার দেখেই চিনেছি।আরে পাগলা আমি রিদিশা।
-রিদিশা,মাই গড।তোকে এখানে দেখবো স্বপ্নেও ভাবিনি।সেই মাধ্যমিকের পর মেসো বদলি হলো তোরা জামশেদপুর চলে গেলি তারপর তো আর আমাদের যোগাযোগ নেই কি করে চিনবো।তা এখানে কি বেড়াতে?
-হ্যাঁ।আর তুই?
-মুচকি হাসে বিদুর,হানিমুন।
-সে কি হানিমুনে এসে তুই একা ঘুরছিস?
-না,ও ফ্রেশ হচ্ছে তাই আমি একটু বের হলাম।
রিদিশা আর বিদুর স্মৃতিমন্হন করতে করতে হাঁটতে থাকে।দুই শৈশব বন্ধুর হাসির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।
দুই
বিভুঁই কিছুতেই এই বিয়েটা করতে চায়নি।কেন না সে জানে সে আর কোনদিন ছেলেদের বিশ্বাস করতে পারবে না।তার মামা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অবশেষে তাকে এই বিয়েতে রাজী করিয়েছেন।বিয়ে সে করেছে যদিও কিন্তু আজো সেই ক্ষত থেকে বের হতে পারেনি।যদিও দুই ক্যালেন্ডার পাতা নিয়ে উড়ে গেছে সময়।বিভুঁইয়ের খুব ইচ্ছে একবার শুধু একবার যদি মানুষটাকে সে পেতো মুখোমুখি,শুধু জানতে চাইতো- সেদিন বিয়ের সব প্রস্তুতি সেরে কোর্টে না এসে কেন সে পালিয়েছিলো?বিদুরের ডাকে ঘোর কাটে।বাইরে তখন দুধ কফির মতো আলোয় ফিরে যাচ্ছে দুপুর।
-বিভুঁই,এ হচ্ছে রিদিশা,আমরা একই পাড়ায় থাকতাম।একই কিন্ডারগার্টেনে পড়েছি।মাধ্যমিকের পর আজ এতবছর পরে দেখা।
বিভুঁই হাত জোড় করে নমস্কার করতেই হাসিতে ফেটে পড়ে রিদিশা।এই রে, আমি বিদুর বন্ধু, মাসি না।তাই নো নমস্কার, বলেই বিভুঁই কে জড়িয়ে ধরে রিদিশা।
-বেশ লক্ষ্মীমন্ত বউ পেয়েছিস রে বিদু।বলেই দুই বন্ধু হাসতে থাকে।
-এতক্ষণ ধরে তো আমার কথাই শুনে যাচ্ছিস,তোর কথা তো কিছু বল।
-সারপ্রাইজ।বিভুঁই কে নিয়ে আমাদের ঢেঁড়ায় চল দেখবি কেমন অবাক করে দেই তোকে।এমন একজনকে দেখাবো তুই ভাবতেও পারবিনা।
বিভুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে আজ দশ দিন।বিদুরকে অনিচ্ছায় যত জানছে মন্দ লাগছে না বিভুঁইয়ের, ব্যাঙ্গালুরুতে একটি বিদেশী সংস্থায় উচ্চপদে চাকরীরত।বেশ ভাল সেলারি।এইটুকু সে আগেই জানতো,বৌভাতের দিন জেনেছে বিদুর গানটাও ভাল গায়।
-তুমি নাকি অফিসিয়াল ট্যুরে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো জুলাইয়ে?
বিদুর আর রিদিশার থেকে অনেকটা পিছনে হাঁটতে থাকা বিভুঁই রিদিশার প্রশ্নে থতমত খেয়ে পা চালায়,হ্যাঁ,তোমায় কে বললো?
-কে আবার তোমার বিদুর।তোমার কোন টেনশন নেই,শোন বিদু তুই ওর ফ্লাইট কনফার্ম হলেই আমায় একটা কল করবি।এই নে আমার কন্টাক্ট নম্বর।দুটো কার্ড দুজনকে বাড়িয়ে দেয় রিদিশা।
-জুলাই তো এখনো অনেক দেরি, ও তুই অট্রেলিয়া থাকিস?
-হুম।
সূর্য দেবতা অনেকক্ষণ আগেই ধ্যানে ফিরে গেছেন।ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ঘিরে আসছে শ্লেটরঙা সন্ধ্যা।দূর থেকে দূরে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মত আলো স্থির জ্বলে আছে।কুয়াশায় সে আলো ধীরে ধীরে আবছায়ায় মিশে যাচ্ছে।তিনজন হাটঁছে পাশাপাশি,কথা আর হাসির ফাঁকে জোৎস্না ফেলে জেগে উঠছে পূর্ণিমার সুবিশাল চাঁদ।
তিন
এখানে বিদুরের জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করছে বিদুর কল্পনাও করেনি।দরজা খুলে যে দাঁড়ালো তাকে বেশ চেনা মনে হলো বিদুরের।
-কি রে চিনতে পারছিস একে অপর কে?রিদিশা দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ।
বিদুর একপলক তাকিয়ে থেকে বললো, রীপ না?
মাথাটা ঝুঁকিয়ে মুচকি হাসে অন্তরীপ, তুই,তুই.....বিদু তো,বলেই অন্তরীপ জড়িয়ে ধরে বিদুরকে।বিদুরের পেছনে বিভুঁই দাঁড়িয়ে।বিভুঁইয়ের চোখে চোখ পড়তেই অন্তরীপ নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
-আরে কি হলো রে।বলেই বিদুর পেছনে তাকায়।
বিভুঁই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের তারায় বিস্ময়।দুই বন্ধুকেই যেন দেখছে কিংবা শুধুই অন্তরীপকে।রিদিশা এগিয়ে এসে বিভুঁইয়ের হাত ধরে।আয় তো,ওদের গলাগলি,বকবক ওরা করুক তুই ভেতরে আয়।এই রে তুই করে বলে ফেললাম।সরি,সরি।
-সরি কেন,বলতেই পারিস।ও আমাদের চেয়ে অনেকটাই ছোট, বিদুর বলে।বিভুঁই কেমন যেন গুম মেরে বসে আছে।
-রীপ,এ হচ্ছে বিভুঁই।আর বিভুঁই,অন্তরীপ আমাদের ছোট্টবেলার বন্ধু।তা রিদিশা,তুই রীপ কে জুটালি কি করে রে?
পাখির ডানা ঝাঁপটানোর মতো হাসি থামিয়ে রিদিশা হঠাৎ চুপ করে গেলো বিদুরের প্রশ্নটা শুনেই।বিভুঁই ঘরে ঢোকার পরেই চুপ মেরে গেছে তার সঙ্গে অন্তরীপ ও, বিদুর খানিক বিব্রত বোধ করলো।সে খেয়াল করলো ঘরে মৃত্যুর পরের নির্জনতা।
নীরবতা ভেঙে রিদিশা পলকেই উঠে দাঁড়ালো।চল বাইরে যাই সবাই মিলে।ঘুরে ফিরে তারপর ডিনার করে নেবো একসাথে।বিদুর খেয়াল করলো বিভুঁই চুপ করে বসে একদৃষ্টিতে অন্তরীপের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্তরীপ মাথা নামিয়ে বসে আছে যেন মাটিতে মিশে যাবে।বিদুর মুচকি হাসলো,অন্তরীপ চিরটাকাল লাজুক।বিদুরের মনে পড়ে স্কুল লাইফে অন্তরীপ শায়েরীকে খুব পছন্দ করতো।একদিন সকালে স্কুলে এসেই অন্তরীপ সব বন্ধুকে বললো সে যে মোটেই লাজুক না তা আজ স্কুল ছুটির পর শায়েরীর মুখোমুখি হয়ে শায়েরীকে তার পছন্দের কথা বলে সে প্রমান করবে।সব বন্ধুরা মিলে অন্তরীপকে নিয়ে শায়েরীর স্কুলের সামনে স্কুল ছুটির পরে গিয়ে দাঁড়ালো।যেই শায়েরী অন্তরীপের সামনে এসেছে সাইকেল ফেলে অন্তরীপের সে কি দৌড়।
-কি রে চল।
রিদিশার তাড়ায় সবাই মিলে বের হলো ঝাঁটিংগার পথে।
চার
ডিনার শেষ করে।বিদুর আর রিদিশা মিলে ঠিক করলো।রিদিশাদের রুমে বসে বাকী রাতটা আড্ডা দিয়ে কাটাবে তারা।
বিভুঁইয়ের একদম ইচ্ছে ছিলো না।কিন্তু মুখে সে কিছু বললো না।এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সে ভাবেনি।তিনবন্ধুর মিলনমেলায় সে বড় বেমানান।তবে তার নীরবতা যে কিছুটা হলেও ওদের তিনজন কে বিব্রত করছে বিভুঁই তা বুঝতে পারছে।অন্তরীপ রিদিশার বিয়ে হয়েছে কিনা এখনো ঠিক বোঝা গেলো না।বিদুরের প্রশ্নটা যে বেশ কৌশলে এড়িয়ে গেলো রিদিশা সেটা সে খেয়াল করেছে।দুজন বন্ধু কি তবে লিভটুগেদার করছে?অন্তরীপের চোখে মুখে যে অপরাধ বোধ ফুটে উঠেছে তা মনে মনে বেশ উপভোগ করছে বিভুঁই। জোছনা ঠিকরে পড়েছে ঘরময় আর রিদিশা গ্লাসে গ্লাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে লন্ডন ড্রাই।
পরের দিন দুপুর.....
-কাল রাতে কি বিদুর বউকে দেখে কম খেলি?
-না তো।
-ভোর রাতে একবার জেগেছিলাম,তুই হয়ত খেয়াল করিসনি।কাল একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি।
-হুম।
-মনে হলো তুই আর বিদুর বউ তর্ক-বিতর্ক করছিলি।ঘোর বোধ হয়।
-হ্যাঁ।ঘোর না ঠিকই দেখেছিস। তুই আর বিদু তো আউট হয়ে গেলি।তারপর...
-বিভুঁই কে দেখার পর থেকেই দেখলাম তুই কেমন গুটিয়ে গেছিস কিন্তু ভোরে তর্ক বিতর্ক করছিলি মানে কি?
-ওর নাম বিভুঁই।তুই হয়ত নামটা খেয়াল করিসনি।
-হ্যাঁ,জানি তো ওর নাম!বলেই রিদিশা থেমে গিয়ে উচ্চারণ করলো বি..ভুঁ..ই..পরক্ষণেই কি যেন আবিষ্কারের মতো বিস্ময়ে তাকালো অন্তরীপের চোখে।অন্তরীপের চোখে অসহায় দৃষ্টি।
-তুই বললি সব?
-না।যদিও বারবার জানতে চাইছিলো কিন্তু কি বলতাম।
-কি বলতি মানে।যা হয়েছিলো সেটা বলতি।
অন্তরীপ কোন উত্তর না দিয়ে উঠে গিয়ে সিগারেট জ্বালায়।রিদিশা অন্তরীপের এই রাগটা কে খুব ভাল চেনে।আড়াই বছর পর আজ আবার নিজেকে রিদিশার খুব স্বার্থপর মনে হয়। ঝাঁটিংগার পাহাড় পেরিয়ে উড়ে আসে বিভিষিকাময় একটি দিন রিদিশার চোখে মুখে।আড়াই বছর আগের সেই দিনে কিছু মাতাল অফিসফেরত রিদিশাকে ধর্ষণ করেছিলো।ধর্ষিতা রিদিশা সুইসাইড করতে মেট্রোর সামনে ঝাঁপও দিয়েছিলো কিন্তু কে যেন পেছন থেকে টেনে ধরলো।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে দূরের পাহাড়টা থেকে মনে হলো একটা পাখি ঝাঁপ দিলো।অন্তরীপের মনে পড়লো সেদিন মেট্রোতে অচেনা রিদিশা এভাবেই ঝাঁপ দিয়েছিলো।সে দ্রুত রিদিশাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছিলো।তখনো সে জানতো না যে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলো সে তার ছোট্টবেলার বন্ধু রিদিশা।রিদিশা যখন বুঝলো সে মরতে পারেনি ঘুরেই কষে এক চড় বসিয়েছিলো অন্তরীপের গালে।যখন মেয়েটি কেঁদে কেঁদে তার কলঙ্কিত রাতের কথা বলছিলো তখনো অন্তরীপ জানতো না এই মেয়েটি কে?রিদিশাও জানে না তাকে যে বাঁচালো সে তার শৈশবের খেলার সাথী।
রিদিশার মনে পড়ে যায় তাকে ঘরে পৌঁচ্ছে দেবার জন্য যখন টেক্সিতে বসে অচেনা মানুষটি তার মনযোগ অন্যদিকে ঘুরাতে তার ছোট্টবেলার বন্ধুদের গল্প শোনাচ্ছে তখন রিদিশার চোখের কোণায় চিকচিক করে উঠে তার শৈশব।অন্তরীপ যখন তার নিজের নাম বললো রিদিশার মনে পড়ে সে অন্তরীপ কে জড়িয়ে ধরেছিলো।তখনই তার মনে হয়েছিলো।এই সমাজ তাকে বাঁচতে দেবে না।অন্তরীপই হতে পারে তার উদ্ধার।সেটা আরো জোড়ালো মনে হলো যখন সে শুনলো আগামী কয়েকমাস পরেই অন্তরীপ অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড করতে যাচ্ছে।দেশ ছেড়ে নতুন করে বাঁচার হাতছানি রিদিশাকে সেদিন অন্ধ করে দিয়েছিলো।
সিগারেট শেষ করে ফিল্টারটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে অন্তরীপের মনে হলো,কাল যে বিভুঁই বারবার বলছিলো সে প্রতারণা করেছে।হয়ত সেটা ঠিক।সে বিভুঁইকে ঠগিয়েছে।কিন্তু বারবার মরতে যাওয়া একজন নারী,একজন বন্ধুকে নতুন একটা জীবন ফিরিয়ে দিতে এই যে আড়াই বছরের প্রবাসজীবন।তাতে কোন প্রতারণা নেই।
রিদিশার খুব ইচ্ছে করে এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে বিদুর কে বলে,বিদু আমি রীপকে জুটাইনি রে।আমি আজো স্বপ্নে ভয়ে কুঁকড়ে যাই,আমি এখনো পাশে কোন পুরুষের গন্ধ পেলে রিয়েক্ট করি।আড়াই বছর ধরে রীপ আমার চিকিৎসা করাচ্ছে।ইচ্ছে করে বিভুঁইকে চিৎকার করে বলে বিভুঁই এই দেখো তোমার অন্তরীপ যে আড়াইবছর ধরে বন্ধুত্ব পালন করে ফিরেছিলো তোমায় ফিরিয়ে নেবে বলে,অন্তরীপ সেই পুরুষ যে ভুল করেও কোনদিন আমার দূর্বলতার সুযোগ নেয়নি কেবল সে তোমার বলে।
দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে।দুজনের ঘোর কেটে যায়।
ঝড়ের রাত,ছাদ
হানিমুনে ঝাঁটিংগা এসেছে বিদুর আর বিভুঁই।
অন্তরীপের কাছেই প্রথম ঝাঁটিংগার কথা শুনেছিলো বিদুর।তখন তারা সবে মাধ্যমিক দিয়েছে।ছুটির সেইদিনগুলোয় অন্তরীপ একদিন এসে বললো সে তার বড়কাকার সাথে ঝাঁটিংগা যাচ্ছে।অদ্ভুত নাম,বিদুর সহ সব বন্ধুরা বেশ অবাক হয়েছিলো।বিস্ময়ের আকাশ আরো বড় হলো যখন অন্তরীপ ফিরে এসে ঝাঁটিংগার প্রাকৃতিক রূপ ও পাখিদের রহস্যময় সুইসাইডের কথা জানালো।তখন থেকেই বিদুরের খুব শখ ঝাঁটিংগা দেখার।
বিয়ের পরে সেই ঝাঁটিংগা দেখার সুযোগটা তাই লুফে নিলো বিদুর।এখানে এসে প্রথমেই যার কথা মনে পড়লো বিদুরের সে অন্তরীপ।উচ্চমাধ্যমিকের পরে অন্তরীপ যে দিল্লি গেলো তখন থেকে ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাথে অন্তরীপের যোগাযোগটা নষ্ট হয়ে গেলো।কোথায় আছে কি করছে আগে ওর মায়ের সাথে দেখা হলে জানা যেত বছর পাঁচেক হলো সেই সুযোগটাও বন্ধ হয়ে গেলো অন্তরীপের বাবা মা দিল্লি চলে যাবার পরে।
ওয়াচ টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বিদুর সিগারেট টানছে।
-বিদু না?
বিদুর বিস্ময়ে তাকায়।হ্যাঁ,কিন্তু আপনাকে ঠিক....
-আমায় চিনতে পারছিস না?ভাল করে তাকিয়ে দেখ।
বিদুর মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু না পেরে মাথা নাড়ে।না,সত্যিই চিনতে পারছি না।
-আমি কিন্তু তোকে একবার দেখেই চিনেছি।আরে পাগলা আমি রিদিশা।
-রিদিশা,মাই গড।তোকে এখানে দেখবো স্বপ্নেও ভাবিনি।সেই মাধ্যমিকের পর মেসো বদলি হলো তোরা জামশেদপুর চলে গেলি তারপর তো আর আমাদের যোগাযোগ নেই কি করে চিনবো।তা এখানে কি বেড়াতে?
-হ্যাঁ।আর তুই?
-মুচকি হাসে বিদুর,হানিমুন।
-সে কি হানিমুনে এসে তুই একা ঘুরছিস?
-না,ও ফ্রেশ হচ্ছে তাই আমি একটু বের হলাম।
রিদিশা আর বিদুর স্মৃতিমন্হন করতে করতে হাঁটতে থাকে।দুই শৈশব বন্ধুর হাসির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।
দুই
বিভুঁই কিছুতেই এই বিয়েটা করতে চায়নি।কেন না সে জানে সে আর কোনদিন ছেলেদের বিশ্বাস করতে পারবে না।তার মামা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অবশেষে তাকে এই বিয়েতে রাজী করিয়েছেন।বিয়ে সে করেছে যদিও কিন্তু আজো সেই ক্ষত থেকে বের হতে পারেনি।যদিও দুই ক্যালেন্ডার পাতা নিয়ে উড়ে গেছে সময়।বিভুঁইয়ের খুব ইচ্ছে একবার শুধু একবার যদি মানুষটাকে সে পেতো মুখোমুখি,শুধু জানতে চাইতো- সেদিন বিয়ের সব প্রস্তুতি সেরে কোর্টে না এসে কেন সে পালিয়েছিলো?বিদুরের ডাকে ঘোর কাটে।বাইরে তখন দুধ কফির মতো আলোয় ফিরে যাচ্ছে দুপুর।
-বিভুঁই,এ হচ্ছে রিদিশা,আমরা একই পাড়ায় থাকতাম।একই কিন্ডারগার্টেনে পড়েছি।মাধ্যমিকের পর আজ এতবছর পরে দেখা।
বিভুঁই হাত জোড় করে নমস্কার করতেই হাসিতে ফেটে পড়ে রিদিশা।এই রে, আমি বিদুর বন্ধু, মাসি না।তাই নো নমস্কার, বলেই বিভুঁই কে জড়িয়ে ধরে রিদিশা।
-বেশ লক্ষ্মীমন্ত বউ পেয়েছিস রে বিদু।বলেই দুই বন্ধু হাসতে থাকে।
-এতক্ষণ ধরে তো আমার কথাই শুনে যাচ্ছিস,তোর কথা তো কিছু বল।
-সারপ্রাইজ।বিভুঁই কে নিয়ে আমাদের ঢেঁড়ায় চল দেখবি কেমন অবাক করে দেই তোকে।এমন একজনকে দেখাবো তুই ভাবতেও পারবিনা।
বিভুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে আজ দশ দিন।বিদুরকে অনিচ্ছায় যত জানছে মন্দ লাগছে না বিভুঁইয়ের, ব্যাঙ্গালুরুতে একটি বিদেশী সংস্থায় উচ্চপদে চাকরীরত।বেশ ভাল সেলারি।এইটুকু সে আগেই জানতো,বৌভাতের দিন জেনেছে বিদুর গানটাও ভাল গায়।
-তুমি নাকি অফিসিয়াল ট্যুরে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো জুলাইয়ে?
বিদুর আর রিদিশার থেকে অনেকটা পিছনে হাঁটতে থাকা বিভুঁই রিদিশার প্রশ্নে থতমত খেয়ে পা চালায়,হ্যাঁ,তোমায় কে বললো?
-কে আবার তোমার বিদুর।তোমার কোন টেনশন নেই,শোন বিদু তুই ওর ফ্লাইট কনফার্ম হলেই আমায় একটা কল করবি।এই নে আমার কন্টাক্ট নম্বর।দুটো কার্ড দুজনকে বাড়িয়ে দেয় রিদিশা।
-জুলাই তো এখনো অনেক দেরি, ও তুই অট্রেলিয়া থাকিস?
-হুম।
সূর্য দেবতা অনেকক্ষণ আগেই ধ্যানে ফিরে গেছেন।ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ঘিরে আসছে শ্লেটরঙা সন্ধ্যা।দূর থেকে দূরে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মত আলো স্থির জ্বলে আছে।কুয়াশায় সে আলো ধীরে ধীরে আবছায়ায় মিশে যাচ্ছে।তিনজন হাটঁছে পাশাপাশি,কথা আর হাসির ফাঁকে জোৎস্না ফেলে জেগে উঠছে পূর্ণিমার সুবিশাল চাঁদ।
তিন
এখানে বিদুরের জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করছে বিদুর কল্পনাও করেনি।দরজা খুলে যে দাঁড়ালো তাকে বেশ চেনা মনে হলো বিদুরের।
-কি রে চিনতে পারছিস একে অপর কে?রিদিশা দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ।
বিদুর একপলক তাকিয়ে থেকে বললো, রীপ না?
মাথাটা ঝুঁকিয়ে মুচকি হাসে অন্তরীপ, তুই,তুই.....বিদু তো,বলেই অন্তরীপ জড়িয়ে ধরে বিদুরকে।বিদুরের পেছনে বিভুঁই দাঁড়িয়ে।বিভুঁইয়ের চোখে চোখ পড়তেই অন্তরীপ নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
-আরে কি হলো রে।বলেই বিদুর পেছনে তাকায়।
বিভুঁই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের তারায় বিস্ময়।দুই বন্ধুকেই যেন দেখছে কিংবা শুধুই অন্তরীপকে।রিদিশা এগিয়ে এসে বিভুঁইয়ের হাত ধরে।আয় তো,ওদের গলাগলি,বকবক ওরা করুক তুই ভেতরে আয়।এই রে তুই করে বলে ফেললাম।সরি,সরি।
-সরি কেন,বলতেই পারিস।ও আমাদের চেয়ে অনেকটাই ছোট, বিদুর বলে।বিভুঁই কেমন যেন গুম মেরে বসে আছে।
-রীপ,এ হচ্ছে বিভুঁই।আর বিভুঁই,অন্তরীপ আমাদের ছোট্টবেলার বন্ধু।তা রিদিশা,তুই রীপ কে জুটালি কি করে রে?
পাখির ডানা ঝাঁপটানোর মতো হাসি থামিয়ে রিদিশা হঠাৎ চুপ করে গেলো বিদুরের প্রশ্নটা শুনেই।বিভুঁই ঘরে ঢোকার পরেই চুপ মেরে গেছে তার সঙ্গে অন্তরীপ ও, বিদুর খানিক বিব্রত বোধ করলো।সে খেয়াল করলো ঘরে মৃত্যুর পরের নির্জনতা।
নীরবতা ভেঙে রিদিশা পলকেই উঠে দাঁড়ালো।চল বাইরে যাই সবাই মিলে।ঘুরে ফিরে তারপর ডিনার করে নেবো একসাথে।বিদুর খেয়াল করলো বিভুঁই চুপ করে বসে একদৃষ্টিতে অন্তরীপের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্তরীপ মাথা নামিয়ে বসে আছে যেন মাটিতে মিশে যাবে।বিদুর মুচকি হাসলো,অন্তরীপ চিরটাকাল লাজুক।বিদুরের মনে পড়ে স্কুল লাইফে অন্তরীপ শায়েরীকে খুব পছন্দ করতো।একদিন সকালে স্কুলে এসেই অন্তরীপ সব বন্ধুকে বললো সে যে মোটেই লাজুক না তা আজ স্কুল ছুটির পর শায়েরীর মুখোমুখি হয়ে শায়েরীকে তার পছন্দের কথা বলে সে প্রমান করবে।সব বন্ধুরা মিলে অন্তরীপকে নিয়ে শায়েরীর স্কুলের সামনে স্কুল ছুটির পরে গিয়ে দাঁড়ালো।যেই শায়েরী অন্তরীপের সামনে এসেছে সাইকেল ফেলে অন্তরীপের সে কি দৌড়।
-কি রে চল।
রিদিশার তাড়ায় সবাই মিলে বের হলো ঝাঁটিংগার পথে।
চার
ডিনার শেষ করে।বিদুর আর রিদিশা মিলে ঠিক করলো।রিদিশাদের রুমে বসে বাকী রাতটা আড্ডা দিয়ে কাটাবে তারা।
বিভুঁইয়ের একদম ইচ্ছে ছিলো না।কিন্তু মুখে সে কিছু বললো না।এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সে ভাবেনি।তিনবন্ধুর মিলনমেলায় সে বড় বেমানান।তবে তার নীরবতা যে কিছুটা হলেও ওদের তিনজন কে বিব্রত করছে বিভুঁই তা বুঝতে পারছে।অন্তরীপ রিদিশার বিয়ে হয়েছে কিনা এখনো ঠিক বোঝা গেলো না।বিদুরের প্রশ্নটা যে বেশ কৌশলে এড়িয়ে গেলো রিদিশা সেটা সে খেয়াল করেছে।দুজন বন্ধু কি তবে লিভটুগেদার করছে?অন্তরীপের চোখে মুখে যে অপরাধ বোধ ফুটে উঠেছে তা মনে মনে বেশ উপভোগ করছে বিভুঁই। জোছনা ঠিকরে পড়েছে ঘরময় আর রিদিশা গ্লাসে গ্লাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে লন্ডন ড্রাই।
পরের দিন দুপুর.....
-কাল রাতে কি বিদুর বউকে দেখে কম খেলি?
-না তো।
-ভোর রাতে একবার জেগেছিলাম,তুই হয়ত খেয়াল করিসনি।কাল একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি।
-হুম।
-মনে হলো তুই আর বিদুর বউ তর্ক-বিতর্ক করছিলি।ঘোর বোধ হয়।
-হ্যাঁ।ঘোর না ঠিকই দেখেছিস। তুই আর বিদু তো আউট হয়ে গেলি।তারপর...
-বিভুঁই কে দেখার পর থেকেই দেখলাম তুই কেমন গুটিয়ে গেছিস কিন্তু ভোরে তর্ক বিতর্ক করছিলি মানে কি?
-ওর নাম বিভুঁই।তুই হয়ত নামটা খেয়াল করিসনি।
-হ্যাঁ,জানি তো ওর নাম!বলেই রিদিশা থেমে গিয়ে উচ্চারণ করলো বি..ভুঁ..ই..পরক্ষণেই কি যেন আবিষ্কারের মতো বিস্ময়ে তাকালো অন্তরীপের চোখে।অন্তরীপের চোখে অসহায় দৃষ্টি।
-তুই বললি সব?
-না।যদিও বারবার জানতে চাইছিলো কিন্তু কি বলতাম।
-কি বলতি মানে।যা হয়েছিলো সেটা বলতি।
অন্তরীপ কোন উত্তর না দিয়ে উঠে গিয়ে সিগারেট জ্বালায়।রিদিশা অন্তরীপের এই রাগটা কে খুব ভাল চেনে।আড়াই বছর পর আজ আবার নিজেকে রিদিশার খুব স্বার্থপর মনে হয়। ঝাঁটিংগার পাহাড় পেরিয়ে উড়ে আসে বিভিষিকাময় একটি দিন রিদিশার চোখে মুখে।আড়াই বছর আগের সেই দিনে কিছু মাতাল অফিসফেরত রিদিশাকে ধর্ষণ করেছিলো।ধর্ষিতা রিদিশা সুইসাইড করতে মেট্রোর সামনে ঝাঁপও দিয়েছিলো কিন্তু কে যেন পেছন থেকে টেনে ধরলো।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে দূরের পাহাড়টা থেকে মনে হলো একটা পাখি ঝাঁপ দিলো।অন্তরীপের মনে পড়লো সেদিন মেট্রোতে অচেনা রিদিশা এভাবেই ঝাঁপ দিয়েছিলো।সে দ্রুত রিদিশাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছিলো।তখনো সে জানতো না যে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলো সে তার ছোট্টবেলার বন্ধু রিদিশা।রিদিশা যখন বুঝলো সে মরতে পারেনি ঘুরেই কষে এক চড় বসিয়েছিলো অন্তরীপের গালে।যখন মেয়েটি কেঁদে কেঁদে তার কলঙ্কিত রাতের কথা বলছিলো তখনো অন্তরীপ জানতো না এই মেয়েটি কে?রিদিশাও জানে না তাকে যে বাঁচালো সে তার শৈশবের খেলার সাথী।
রিদিশার মনে পড়ে যায় তাকে ঘরে পৌঁচ্ছে দেবার জন্য যখন টেক্সিতে বসে অচেনা মানুষটি তার মনযোগ অন্যদিকে ঘুরাতে তার ছোট্টবেলার বন্ধুদের গল্প শোনাচ্ছে তখন রিদিশার চোখের কোণায় চিকচিক করে উঠে তার শৈশব।অন্তরীপ যখন তার নিজের নাম বললো রিদিশার মনে পড়ে সে অন্তরীপ কে জড়িয়ে ধরেছিলো।তখনই তার মনে হয়েছিলো।এই সমাজ তাকে বাঁচতে দেবে না।অন্তরীপই হতে পারে তার উদ্ধার।সেটা আরো জোড়ালো মনে হলো যখন সে শুনলো আগামী কয়েকমাস পরেই অন্তরীপ অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড করতে যাচ্ছে।দেশ ছেড়ে নতুন করে বাঁচার হাতছানি রিদিশাকে সেদিন অন্ধ করে দিয়েছিলো।
সিগারেট শেষ করে ফিল্টারটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে অন্তরীপের মনে হলো,কাল যে বিভুঁই বারবার বলছিলো সে প্রতারণা করেছে।হয়ত সেটা ঠিক।সে বিভুঁইকে ঠগিয়েছে।কিন্তু বারবার মরতে যাওয়া একজন নারী,একজন বন্ধুকে নতুন একটা জীবন ফিরিয়ে দিতে এই যে আড়াই বছরের প্রবাসজীবন।তাতে কোন প্রতারণা নেই।
রিদিশার খুব ইচ্ছে করে এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে বিদুর কে বলে,বিদু আমি রীপকে জুটাইনি রে।আমি আজো স্বপ্নে ভয়ে কুঁকড়ে যাই,আমি এখনো পাশে কোন পুরুষের গন্ধ পেলে রিয়েক্ট করি।আড়াই বছর ধরে রীপ আমার চিকিৎসা করাচ্ছে।ইচ্ছে করে বিভুঁইকে চিৎকার করে বলে বিভুঁই এই দেখো তোমার অন্তরীপ যে আড়াইবছর ধরে বন্ধুত্ব পালন করে ফিরেছিলো তোমায় ফিরিয়ে নেবে বলে,অন্তরীপ সেই পুরুষ যে ভুল করেও কোনদিন আমার দূর্বলতার সুযোগ নেয়নি কেবল সে তোমার বলে।
দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে।দুজনের ঘোর কেটে যায়।
ঝড়ের রাত,ছাদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন