মহাপ্রভু ( দ্বিতীয় পর্ব )
গঙ্গার তীর বড়ো প্রিয় জায়গা নিমাইয়ের। পিতা জগন্নাথ মিশ্রের আকস্মিক মৃত্য নিমাইয়ের মধ্যে একটা দায়িত্ব বোধ তৈরী করেছে। আজ গঙ্গার তীরে একলা বসে ভাবছিলেন কিছু কথা। সংসারে শুধু মা ছেলে হলেও খরচ কম না। প্রতিদিন গৃহদেবতা গোপালের ভোগ। অতিথি সেবা। আত্মীয় স্বজন। লোক লৌকিকতা। অসুখ বিসুখ। নাঃ। হাত মুঠো করলেন নিমাই। তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। চারিদিকে মুসলমান অত্যাচার বেড়েই চলেছে। দেশের অবস্থা বড়ো গোলমেলে। তবু তার মধ্যেও নবদ্বীপ বিদ্যা চর্চার বড়ো কেন্দ্র। দেশ বিদেশ থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে। পন্ডিত হিসেবে নিমাই তথা বিশ্বম্ভর মিশ্রের নাম ছড়িয়েছে। পড়ানো যেতেই পারে। মৃদু হাসলেন নিমাই। যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে তাঁর নিজের মতবাদ।দেশের সমাজের সংস্কারে ছাত্ররা এক বড়ো হাতিয়ার । তাছাড়া অর্থ প্রয়োজন। গঙ্গার ঘাটে যে সুন্দরীটি দেখেছেন গত কয়দিন ধরে, তাকে বিবাহ করে সংসার শুরু হবে কি করে যদি অর্থ না থাকে?
নিমাইয়ের বয়স কম। সমস্ত অবয়বে এক অহংকারী শানিত ভাব মানুষকে আকৃষ্ট করতো খুব বেশী। উর্ধাঙ্গে একটি চাদর, পরনে ধুতি, গৌরবর্ন শরীরে অতিরিক্ত লম্বা দুটি হাত, তীক্ষ্ণ নাসা, ঝকঝকে চোখে কৌতুক আর বুদ্ধি --- নিমাই পন্ডিতের টোল ছাত্রের ভীড়ে উপচে পড়ে। প্রতিদিন তাঁর টোল বসে মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়ির বড়ো খোলা উঠোনে। বিনিময়ে তাদের ছেলে কে একটু পড়িয়ে দেবে। তবে স্বভাব বদলে রাতারাতি গোমড়ামুখো হবার মতো পন্ডিত নিমাই নন। বিদ্বান পন্ডিতে পূর্ণ নবদ্বীপ। সেখানে পন্ডিতদের যখন তখন কিছু না কিছু
" ফাঁকি"( ধাঁধা--শাস্ত্রের ধাঁধা) জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করায় কমতি ছিলো না নিমাইয়ের---"
" সর্বদাই পরিহাস মূর্তি বিদ্যা বলে
সহস্র পড়ুয়া সঙ্গে যবে প্রভু চলে।"
দৃশ্য কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয়না। কথায় বলে জন্মেই নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। নিমাই ছিলেন তেমন। মুসলমান অত্যাচারে ত্রাহি মধুসুদন করছেন ব্রাহ্মণ থেকে সাধারণ মানুষ। নিমাই একদিন সদলবলে গিয়ে জব্দ করে এলেন কাজী কে।
১৪৮৬ সালে মহাপ্রভুর জন্ম। সেই সময় বাংলাদেশ এক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়--" ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে" ১৪৯৩ ৯৪ সাল নিমাই যখন খুব ছোট , তখন অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল একথা যেমন সত্য, আবার চৈতন্যদেব যৌবনে পা দেবার পরে রাজনৈতিক ডামাডোল অনেকটাই শান্ত। ( চৈতন্যদেব/ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী)। কাজীরা অবশ্য ছোটখাটো গড়বড় পাকানোর চেষ্টা করতো। সে গুলো নিমাই আর তার দলবল সহজেই ঠান্ডা করে দিতো। কিন্তু নিমাইয়ের সমস্যা ছিল অন্য। বিয়ে করেছেন, নিজের পছন্দের পাত্রী লক্ষীপ্রিয়াকে । অভাব আছে। কিন্তু শান্তিও আছে। মা শচী দেবী এখন অনেকটাই শান্ত। এমন এক সময়ে লক্ষীপ্রিয়া দেবী হঠাৎ মারা গেলেন। আকস্মিক এই মৃত্যুকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে ঘরে এলো সবাই শুধু নিমাই চলে গেলেন তাঁর প্রিয় জায়গা সেই গঙ্গার ঘাটে।
দিগন্ত বিস্তীর্ণ গঙ্গা। অসীম জলরাশি। সন্ধ্যা সমাগত। দূরে কোনো মন্দিরে বেজে ওঠে ঘন্টা। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়ায় ওড়ে নিমাইয়ের চুল, উত্তরীয়। বিষণ্ন দুটি চোখ কি ভাবে বিভোর। অনর্গল জল পড়ছে। কত তো কাজ করছেন, সমাজের অযথা নিয়ম কানুন কে রোজ ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছেন, জাতি ধর্মের বেড়া ভাঙছেন, কিন্তু তবু এ অতৃপ্তি কেন? কোথায় খুঁজে চলেছেন নিজেকে? নিমাই আকুল হয়ে কেঁদে উঠলেন এবারে।
গঙ্গার তীর বড়ো প্রিয় জায়গা নিমাইয়ের। পিতা জগন্নাথ মিশ্রের আকস্মিক মৃত্য নিমাইয়ের মধ্যে একটা দায়িত্ব বোধ তৈরী করেছে। আজ গঙ্গার তীরে একলা বসে ভাবছিলেন কিছু কথা। সংসারে শুধু মা ছেলে হলেও খরচ কম না। প্রতিদিন গৃহদেবতা গোপালের ভোগ। অতিথি সেবা। আত্মীয় স্বজন। লোক লৌকিকতা। অসুখ বিসুখ। নাঃ। হাত মুঠো করলেন নিমাই। তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। চারিদিকে মুসলমান অত্যাচার বেড়েই চলেছে। দেশের অবস্থা বড়ো গোলমেলে। তবু তার মধ্যেও নবদ্বীপ বিদ্যা চর্চার বড়ো কেন্দ্র। দেশ বিদেশ থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে। পন্ডিত হিসেবে নিমাই তথা বিশ্বম্ভর মিশ্রের নাম ছড়িয়েছে। পড়ানো যেতেই পারে। মৃদু হাসলেন নিমাই। যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে তাঁর নিজের মতবাদ।দেশের সমাজের সংস্কারে ছাত্ররা এক বড়ো হাতিয়ার । তাছাড়া অর্থ প্রয়োজন। গঙ্গার ঘাটে যে সুন্দরীটি দেখেছেন গত কয়দিন ধরে, তাকে বিবাহ করে সংসার শুরু হবে কি করে যদি অর্থ না থাকে?
নিমাইয়ের বয়স কম। সমস্ত অবয়বে এক অহংকারী শানিত ভাব মানুষকে আকৃষ্ট করতো খুব বেশী। উর্ধাঙ্গে একটি চাদর, পরনে ধুতি, গৌরবর্ন শরীরে অতিরিক্ত লম্বা দুটি হাত, তীক্ষ্ণ নাসা, ঝকঝকে চোখে কৌতুক আর বুদ্ধি --- নিমাই পন্ডিতের টোল ছাত্রের ভীড়ে উপচে পড়ে। প্রতিদিন তাঁর টোল বসে মুকুন্দ সঞ্জয়ের বাড়ির বড়ো খোলা উঠোনে। বিনিময়ে তাদের ছেলে কে একটু পড়িয়ে দেবে। তবে স্বভাব বদলে রাতারাতি গোমড়ামুখো হবার মতো পন্ডিত নিমাই নন। বিদ্বান পন্ডিতে পূর্ণ নবদ্বীপ। সেখানে পন্ডিতদের যখন তখন কিছু না কিছু
" ফাঁকি"( ধাঁধা--শাস্ত্রের ধাঁধা) জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করায় কমতি ছিলো না নিমাইয়ের---"
" সর্বদাই পরিহাস মূর্তি বিদ্যা বলে
সহস্র পড়ুয়া সঙ্গে যবে প্রভু চলে।"
দৃশ্য কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয়না। কথায় বলে জন্মেই নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। নিমাই ছিলেন তেমন। মুসলমান অত্যাচারে ত্রাহি মধুসুদন করছেন ব্রাহ্মণ থেকে সাধারণ মানুষ। নিমাই একদিন সদলবলে গিয়ে জব্দ করে এলেন কাজী কে।
১৪৮৬ সালে মহাপ্রভুর জন্ম। সেই সময় বাংলাদেশ এক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়--" ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে" ১৪৯৩ ৯৪ সাল নিমাই যখন খুব ছোট , তখন অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল একথা যেমন সত্য, আবার চৈতন্যদেব যৌবনে পা দেবার পরে রাজনৈতিক ডামাডোল অনেকটাই শান্ত। ( চৈতন্যদেব/ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী)। কাজীরা অবশ্য ছোটখাটো গড়বড় পাকানোর চেষ্টা করতো। সে গুলো নিমাই আর তার দলবল সহজেই ঠান্ডা করে দিতো। কিন্তু নিমাইয়ের সমস্যা ছিল অন্য। বিয়ে করেছেন, নিজের পছন্দের পাত্রী লক্ষীপ্রিয়াকে । অভাব আছে। কিন্তু শান্তিও আছে। মা শচী দেবী এখন অনেকটাই শান্ত। এমন এক সময়ে লক্ষীপ্রিয়া দেবী হঠাৎ মারা গেলেন। আকস্মিক এই মৃত্যুকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে ঘরে এলো সবাই শুধু নিমাই চলে গেলেন তাঁর প্রিয় জায়গা সেই গঙ্গার ঘাটে।
দিগন্ত বিস্তীর্ণ গঙ্গা। অসীম জলরাশি। সন্ধ্যা সমাগত। দূরে কোনো মন্দিরে বেজে ওঠে ঘন্টা। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়ায় ওড়ে নিমাইয়ের চুল, উত্তরীয়। বিষণ্ন দুটি চোখ কি ভাবে বিভোর। অনর্গল জল পড়ছে। কত তো কাজ করছেন, সমাজের অযথা নিয়ম কানুন কে রোজ ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছেন, জাতি ধর্মের বেড়া ভাঙছেন, কিন্তু তবু এ অতৃপ্তি কেন? কোথায় খুঁজে চলেছেন নিজেকে? নিমাই আকুল হয়ে কেঁদে উঠলেন এবারে।
*
অদৈত্ব আচার্যের এক নিজস্ব গোষ্ঠী ছিল নবদ্বীপে। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত বৈষ্ণব সভা হতো। নিমাই পন্ডিত যাতায়াত করতে লাগলেন। এক কোণে হেলান দিয়ে দীপ্ত অহংকারের সঙ্গে কৃষ্ণ কথা, কৃষ্ণ নাম গান শুনতে লাগলেন। শুনতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। তিনি তালে তালে ঘাড় দোলাতে পারবেন না। তাঁর স্বভাব এক রোখা। লোক তাকে ভয় খায়। বিদ্যার ফাঁকি ধরা যার কাজ তাঁকে তো লোক ভয় পাবেই। তাতে নিমাইয়ের ভারী বয়ে গেল। তিনি যেমন এক কোণে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকতেন, তেমনি রইলেন। কিছু ভাবতেন হয়তো। একদিন ঐ আসরে উপস্থিত হলেন এক পরম বৈষ্ণব ঈশ্বর পুরী। নিমাই তাকিয়েও দেখলেন না কে এলো। সভার সকলে নড়ে চড়ে জায়গা ছেড়ে দিলো ঈশ্বর পুরীকে। পুনরায় শুরু হলো কৃষ্ণ নাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অঙ্গ ছেড়ে দিয়ে বিভোর হয়ে গেলেন ঈশ্বর পুরী। নিমাই রেগে গেলেন মনে মনে। কৃষ্ণ নাম শুনে জ্ঞান হারালো এই লোক? শুধু কৃষ্ণনাম শুনে? খুব বিরক্ত হয়ে ওখান থেকে উঠে চলে এলেন নিমাই।
রাস্তায় আবার একদিন দেখা হলো নিমাইয়ের সঙ্গে ঈশ্বারপুরীর। নিমাইকে জোর করে ধরে তাঁর ঘরে চলে এলেন। নিমাই ভাবলেন এতো আচ্ছা বিপদ। এখন খাবার দাবার বানাও। ভুরু কুঁচকে করলেন রান্নার জোগাড়। ভোজনের পরে মন্দিরের দাওয়ায় আরাম করে পা ঝুলিয়ে বসে ঈশ্বর পুরী শুরু করলেন কৃষ্ণ কথা। নিমাই পন্ডিত গম্ভীর । চুপ। তিনি দাম্ভিক স্বভাবের। অনর্থক নিজের অনুভূতি বলে ফেলবেন এমন বান্দা নন । কিন্তু এক্ষেত্রে নিজেই একটু অবাক হচ্ছেন এই গায়ে পড়া বৃদ্ধ বৈষ্ণব তাঁকে আকর্ষণ করছেন ? অদ্ভুত তো? ঈশ্বারপুরী চলে গেলেন গোপীনাথ আচার্যের বাড়িতে। নিমাইয়ের অদম্য ইচ্ছে করলো রোজ একবার করে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে আসতে। অহংকারী দাম্ভিক কঠোর নিমাইয়ের মনের ভেতরটা গলছে কেন?
বন্ধুদের এক বিরাট দল নিয়ে ওঠা বসা করেন নিমাই। বন্ধুরা অনুরোধ করে নিমাইকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে। পাত্রী হলো বিষ্ণুপ্রিয়া। সে পাত্রী খারাপ নয়। কিন্তু আবার বিয়ে? খরচ আছে বিয়ের। কোথায় পাবেন তিনি? তবে লক্ষী চলে যাবার পরে মা বড়ো একলা হয়ে গেছেন। দাদা বিশ্বরূপ সন্ন্যাসী, বাবা মারা গেছেন মা কেমন অসহায় বোধ করেন। তাঁর নিজেরও সময় এতো কম! কিন্তু বিয়ের খরচ? হৈ হৈ করে ওঠে বন্ধুরা। নিমাই তাদের প্রিয় বন্ধু। নেতা। তার বিয়ের খরচ দেবে বন্ধুরা সে আর এমন কী বড়ো কথা? তাই হলো। ধুম ধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো।
বেশ মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া। নিমাই পন্ডিতের সংসারে মানিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে। গরীবের সংসার। স্বামী ওমন তেজস্বী। স্বামী গর্বে বুক ভরে ওঠে বিষ্ণুপ্রিয়ার। অথচ নিমাই কেমন অন্যমনস্ক। বিবাহ করে ভুল হলো না তো? তিনি যে এক ভাঙ্গন টের পাচ্ছেন বুকের ভেতর? সংসার আর টানছে না যে! প্রেম ভরা চোখে টোলের পুঁথি এগিয়ে দেয় বিষ্ণুপ্রিয়া। চাদর তুলে দেয় হাতে। কপালে তিলক চন্দন -- নিমাইয়ের অহংকারী বুক মায়াতে টন টন করে ওঠে। এই ছেলেমানুষ মেয়েটি তাঁকে অবলম্বন করে জীবন শুরু করেছে, তাঁকে উপুযুক্ত মর্যাদা দিতে পারবেন তো? অন্যমনস্ক নিমাইয়ের সামনে শচী দেবী এসে দাঁড়ান। এখন এই ছেলে তাঁর সব কিছু। কিছুতেই একে হারাতে চান না তিনি।
ছেলের মাথায় আশীর্বাদী হাত রেখে বলেন --" বাবা! এবার একবার গয়া যেতে হবে তোমাকে পিতৃ শ্রাদ্ধ করার জন্
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন