গুরু।।
পর্ব - ১
গুরুর কথা বলি। আমার গুরু। বাবা মা আর স্কুলের
শিক্ষক বাদ দিলে জীবনের প্রথম গুরু বাসায় আরবী পড়াতে আসা হুজুর।আমরা ছিলাম ছ’ভাই বোন। চারভাই দু’বোনের মধ্যে আমি পঞ্চম। আমার ছোট এক ভাই আর
সবাই বড়।চিরাচরিত কঠোর মুসলিম অনুশাসনে চলে আমাদের সংসার।মুসলমানের ছেলে মেয়ে
হিসেবে সবাইকে কোরআন খতম করতে হবেই্।আর তার জন্য একজন হুজুর নিয়োজিত আছেন। আমরা
পাঁচ’ভাইবোনই তাঁর কাছে
পড়ি।কুমিল্লায় বসবাস। লালমা্ই পাহাড়ের পায়ের কাছে কোটবাড়ি - সরকারী ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ান
থেকে ফা্ইভ পর্যন্ত সকাল সাতটা থেকে ১০টা পর্যন্ত ক্লাস।ঠিক বাসায় পৌঁছাতে না
পৌঁছাতেই হুজুর আসেন। তখন বয়স কত হবে, বড়জোড় ৬ কি ৭? অজু কর পাজামা পড় মাথায় বড় ওড়না দিয়ে হুজুরের কাছে পড়তে
বসো।সপ্তাহের ছ’দিন। এই ঘেনর ঘেনর করে আরবী
পড়া। বড় বিরক্তিকর। প্রতিদিন ভাবি আজ যদি হুজুর না আসেন খুব ভালো হয়। কিন্তু
হুজুরও এমন সহি পরহেজগাড় যে রোজগাড়েরর টাকায় কোন ভেজাল পছন্দ করেন না। নিত্য দিন
এসে হাজির। অদ্ভুত এক মানুষ। তার কি একটু জ্বর জ্বারিও হয়না। মেশিন না কি? আজ সত্যি করে বলি, মনে মনে খুব প্রত্যাশা করে থাকি যেদিন হুজুর না
আসুক অথচ চলে এলেন সেদিন মনে মনে তাঁকে গালাগাল দিতেও বাদ রাখিনি।তাঁর নাম সাদেক
হুজুর।কি অদ্ভুত স্বার্থপর মানব জীবন। সেই যে সাদেক হুজুর বলে ডাকতাম। যখন ছোট।
মানুষের পুরো কিংবা আধেক নামের বিষয়টা বোধে ধরা দেয়না তখন থেকেই তাকে এই নামে
ডেকেছি। কোনদিন তাঁর পুরো নাম জানা হয়নি আর। বাবা নিশ্চই জানতেন। অতচ আজ অবধি তাঁর
পুরো নাম আমি জানিনি।তিনি খুব আদর করে পড়াতেন। আমার ছোট ভাইটা তখন ফিডার দিয়ে দুধ
খায় আর হুজুরের কোলে বসে দোল খায়। হুজুর তাকে ডাকতেন ‘ভাইয়া’। আমরা যখন পড়ছি গুটি গুটি পায়ে সে এসে হুজুরের কাছে
ঘুরঘুর করতো। আর
ফিডারটা কে বলতো কোতল। বোতল বলতে পারতোনা তাই। হুজুর বলতেন ভাইয়া কি খাইছ? আমার ছোট ভাই বলতো কোতল। আবার কোন কোন দিন
হুজুর তাকে আদর করে কোলে নিতেন। কোলে নিয়ে বলতেন এখানে বস। আজকে কোতল খাওনাই
ভাইয়া।এমনই সুন্দর ছিল তার স্বভাব আর ভালোবাসা। আমাদের অসময়েও জায়নামাজে দাঁড়
করিয়ে শিখিয়েছেন পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ।আজ বহুবছর পর আমি যখন ছাত্র পড়াতে বসি।
ওয়াসীকে পড়াতে পড়াতে তার ছোট ভাই জায়ানকে কোলে নেই, খেলি ছড়া বলি তখন কেন যেন বারবার সাদেক হুজুরের কথা মনে
পড়ে।সেই যে জীবনের প্রথম গুরু। যাকে মনে মনে গালাগাল করতে করতে পড়তে বসতাম। তাঁর
অদ্ভুত মায়াময় চেহারাটা আজো ভেসে থাকে মনের পর্দায়। আর মানুষকে ভালোবাসার চর্চ্চা
টা বোধকরি তাঁকে গাল দিতে দিতে মনের ভেতর গভীর অনুরাগে বসে গেছে। সেটাই আজকের
আচরনে অলক্ষ্যে বের হয়ে আসে।আব্বা কুমিল্লা পলিটেকনিক ছেড়ে ট্রান্সফার হযে
ময়মনসিংহে এলেন।ততদিন ছোট ভাই ছাড়া আর সবার দু’তিনবার
করে কোরআন খতম শেষ।আর হুজুর পাওয়া গেলনা। আমরা এক অসাধারন গুরুর সান্নিধ্য
হারালাম। এখনো কোন নামাজ কোন কারনে পড়তে না পারলে হুজুরের কথা মনে হয়। আর মনের
পর্দায় একটা বিষন্ন অপরাধবোধ সহ জেগে থাকে সাদেক হুজুরের ছবি। আমার জীবনের প্রথম
গুরু।তারপর ক্লাস নাইনে পড়ি...........নতুন সাবজেক্ট যোগ হলো জ্যাকা। জ্যামিতি ও
কারিগরী...... (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন