রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                                  


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২২.
যাতায়াতের রাস্তায় কত রকমের মানুষের সঙ্গেই যে দেখা হয়!অন্তহীন কথা হয়।গল্প হয়।সেই গল্প জুড়ে পুরোন কোন ধনীবাড়ির খোলানে ঘুরে বেড়ানো হাঁস মুরগী কইতরের দল যেমন থাকে তেমন থাকে পাকঘর,পুরোন খড়ম আর ঢেঁকি পাড়ের শব্দ।
গঙ্গাধরের পারের চর গুলি থেকে ধান নিয়ে যান জামালউদ্দিন ভাই।তার জোড়া মহিষের "ভইসা গাড়ি"।সন্ধ্যের শেয়াল দৌড়ে বেড়ায়।একটা মেটাফিজিকাল ডার্কনেস জড়ানো পৃথিবীতে গান বাজে,গান ঘুরে বেড়ায়_
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
আর জামালউদ্দিন ভাইয়ের "ভইসা গাড়ি"_র নিচে দুলতে থাকে ভুসো কালি মাখা লন্ঠন।
আমি কূপি আর লন্ঠন হারানো হাটগুলোর কথা ভাবতে থাকি।
তখন ঘোড়া জোতদারের টাড়িতে চুপচাপ মস্ত এক ছায়াশরীরের মত এগিয়ে আসতে থাকেন মহি গিদাল।রাত ঘন হতে থাকে। নিশি পংখী উড়াল দেয় গঙ্গাধর পেরিয়ে বুঝি নদী গদাধরের দিকে।
মহি গীদাল তার দোতরার কান মোচড়ান আর গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন_
"ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
আমি গল্পের শরীরে হাত রাখি।
এভাবে গঙ্গাধরের পারে পারে জীবনের পর জীবন বেশ গুছিয়ে রাখা থাকে,হেমন্ত মাঠে শুয়ে থাকা পাকা ধানের আটির মত!
২৩.
তখন মরা দুপুরের  প্রাক শীতের নরম রোদে ভিজতে ভিজতে এমএলএর হাট থেকে হাতি হারানো জোতদারের জোতের দিকে হেঁটে যেতে থাকে ইজাজ মাস্টার। পাটের শনের মতন তার দীর্ঘ পাকনা চুল দোল খেতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়।চার কুড়ির এক জীবনে বাঁচতে বাঁচতে ইজাজ মাস্টার দূরাগত বাতাসের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে।তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মস্ত এক স্মৃতির খামার।
ইজাজ মাস্টার আসলে বাইচ খেলার দক্ষ বাইচার।
বাইচ খেলায় ইজাজের নাও কখনো হারে না।এই পঞ্চাশ সত্তর গ্রাম গঞ্জে সবাই তাকে ইজাজ মাস্টার বলেই ডাকে।জানে।চেনে।
ইজাজ তখন হাতি হারানো নরকান্ত জোতদারের
আখ্যানগুলির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে।ইজাজ তখন ১৫/১৬।রূপসীর জমিদারের চড়ক মেলায় ইজাজ তার নানার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।নানাই তাকে প্রথম জোতদারকে চেনায়।দীর্ঘ মেদহীন পেশীবহুল সেই জোতদারের রাজকীয় ছবি সুরত আজও ইজাজের
স্মৃতিতে জীবন্ত হয়েই রয়ে গেছে।
তারপর সেই বড় বন্যার বছর "লক্ষীমালা" নামের সেই জোতদারের হাতিটি হারিয়ে গেলে সেই জোতদার "হাতি হারানো জোতদারের" কিংবদন্তিতে
ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে যান।
এখন ইজাজ মাস্টার তার বেটার ঘরের বেটি, বেটির ঘরের বেটাকে সেই জোতদারের গল্প শোনান।
আর জোতদারটাড়ি জুড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে বাইচের গানের কলি_
"ওরে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
গঙ্গাধরের  কাছাড়ে
ওরে মাস্টার বেটার নাও ফাইনালে"


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন