শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

পিয়াংকী

                                             


    





 #গরমবাহার ( প্রথম পর্ব 


সৃজন ব্লগে রান্নাসংক্রান্ত এই  ধারাবাহিকের পোশাকী নাম গরম বাহার।বেশ কিছু রান্না গরম গরম পরিবেশন করলে তার স্বাদ বেড়ে যায় ৷"সৃজন" ম্যাগাজিনের রান্না বিভাগে আপনাদের সকলকে স্বাগত। প্রতি রবিবার এই বিভাগে থাকবে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের নামে পিয়াংকীর দখলদারি পরিভ্রমণ । যেখানে হিরো হিরোইন আর ভিলেন সব চরিত্রই হয়ে উঠবে রাঁধুনির হাতাখুন্তিগামলাবাটি।


'রাঁধ না'...প্রিয়জন তথা প্রিয়রাঁধুনির উদ্দ্যেশ্যে এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি এমন মানুষ হাতে গুনেও হয়ত বের করা যাবে না।অথচ  এই শব্দ দুটির মাঝে একটি যোগ চিহ্ন বসিয়ে দিন।দেখবেন তারা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে  একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে বানিয়ে ফেলবে জম্পেশ একটি রান্না।


আজ্ঞে হ্যাঁ। এতক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে বিনুনি পাকিয়ে আমি রান্না নামের শিল্পটির কথাই বোঝাতে চেয়েছি।সেইইইই মেয়েবেলা থেকেই রান্নাবাটি দিয়ে শুরু হওয়া পদযাত্রা কখন যে আপনার প্রোফাইলের বায়ো-তে আপনাকে আর্টিস্ট তকমায় জ্বলজ্বল করিয়ে দেবে, আপনি নিজেও জানতে পারবেন না।

আজ 'গরম বাহার' একটা এমনই রান্নার কথা বলব, যেটা পূর্ববঙ্গীয় সাথে পুষ্টিবর্ধকও।


পদের নাম ঃ ফরিদপুরি লাবণ্য 


রান্নার পেছনের গল্পঃ  


খুব সহজ একটা রান্না।ছবি  দেখে হয়ত সবাই বুঝতে পারছেন এটি একটি পাঁচমিশালী তরকারি, হ্যাঁ আমিও তাই জানতাম। কিন্তু বিয়ে হয়ে আসার পর একবার আমার মারাত্মক জ্বর হল, প্রায় চব্বিশ দিন ধরে,বুকে কফ বসে শুকিয়ে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় ওষুধের সাথে টোটকা হিসেবে মা(শাশুড়িমা) আমায় এই রান্নাটা করে খাওয়াতেন।


রান্নার জিনঃ


 এটি পূর্ব বাংলার বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের রান্না।শক্তিবর্দ্ধক হবার সাথে সাথে নিম্নমূল্যকও। 


পদ্ধতিঃ 

কাটোয়ার ডাঁটা  কুমরো  বেগুন  ঝিঙে  চিচিঙ্গা  পটল  আলু  কাঁকরোল ( সাথে আপনার মনমতো আরও কিছু সবজীও যুক্ত করতে পারেন।) এটুকু সবাই জানি। কিন্তু আসল বিষয় থমকে থাকে মশলাতে।


 শুকনো কড়াইতে গোটা ধনে, গোলমরিচ, আদা, জোয়ান, একটাদুটো  লবঙ্গ, কিছুটা মৌরি, কয়েকটা গোটা তেজপাতা আর সামান্য রাঁধুনি একসাথে ড্রাই রোস্ট করে নিয়ে তাতে সামান্য মধু আর গরম জল দিয়ে গুলে রেখে দিতে হবে রান্না শুরুর সময়,

তারপর কড়াইয়ে খুবই সামান্য তেল।  তাতে মেথি ফোরণ দিয়ে গন্ধ বেরোলে সেটা তুলে ফেলে দিয়ে সেই তেলে অল্প পাঁচফোরণ আর সামান্য কিছুটা মুগডাল ভেজে (মুগডাল কিন্তু অল্প ভাজা হবে)ধোয়া সবজি ছাড়ার পদ্ধতি।  তারপর ঢাকা।সব্জি থেকে জল বেরোবে সেই  জলেই মজবে সব, (ঠিক যেন করোনার লকডাউন উঠে গেছে, কোনো বিধিনিষেধ নেই, সব্বাই মাস্ক ছাড়া ঘুরছে।)প্রায় হয়ে এলে ওই গোলা পেস্ট দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঢাকা। কাদা কাদা হয়ে এলে নামানো। ভরপুর দেশীয় প্রোটিন সমেত ডালের পুষ্টি মিশ্রিত। 


ওই যে স্পেশাল মশলার মিলিত মিশ্রিত গুণাগুণ তাতেই শরীর স্ট্রং ।উপযুক্ত পরিমাণে প্রোটিন কার্বহাইড্রেট বিভিন্ন খনিজপদার্থ র সংমিশ্রণ । 


উপকারী কাজকম্মঃ


পুরনো কফের জন্য খুব ভালো। ভীষণ ভালো ইমিউন সিস্টেমের জন্য। এমনকি অনেকদিনের  সুগারের পেশেন্ট যাদের স্বাদকোরক গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের মুখেও এই রান্নাটা খুব ভালো লাগে(আমার বাবাকে দিয়ে প্রমাণ পেয়েছি)।



...আজ এই পর্যন্ত 


এর পরের পর্বে থাকবে এমনই খুব সহজ সারল্যে ভরা একটি পদ এবং তার পেছনের গল্প।

আপাতত এটুকুই।


চলুক রান্নাঘর, আসুক খুসবু...


(ক্রমশঃ)

অমিতাভ সরকার

                                     



বেজন্মা (ষষ্ঠ পর্বের পর)


লজের দোরগোড়ায় এসে রাবেয়া বিদায় নিল। কৃষাণও জোর করলো না তাকে, করার কথাও নয়। যাওয়ার আগে একটা কাগজে তার মোবাইল নম্বরটা লিখে হাতে দিল। আগামীকাল যদি ভুলে যায়, সেই কথা ভেবে।        

“এই নম্বরটা রেখে দাও, যদি কখনও প্রয়োজন হয় ফোন করো আমাকে। অবশ্য বিনা প্রয়োজনেও ফোন করতে পারো। পিসিমাকে বলো, কাল যাওয়ার আগে দেখা করে যাব”। হঠাৎ রাবেয়া প্রণাম করে কৃষাণকে। হকচকিয়ে যায় কৃষাণ। জীবনে প্রথম  কেউ  প্রণাম করল তাকে। তাও আবার রাবেয়ার মতো মেয়ে!     

“বললেন যখন, ঠিক ফোন করব। আমাদের তো কোনও ফোন নেই। সামনের মাসে মাইনা পেলে একটা মোবাইল কিনবো ইন্সটলমেন্টে, দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। কিনেই আপনাকে প্রথমে ফোন করবো…”। কৃষাণের চোখের দিকে তাকায় রাবেয়া। কৃষাণ তার দিকে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে সাইকেল ঘুরিয়ে প্যাডেলে পা দেয় রাবেয়া। চলে যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ থাকিয়ে থাকে কৃষাণ। একটা বেলায় তাকে কেমন করে যেন বেঁধে ফেললো এঁরা…!             

অভ্যাস বশতঃ সকাল পাঁচটা ঘুম ভেঙ্গে যায় কৃষাণের। হাতমুখ ধুয়ে সিকুরিটির ভদ্রলোককে ঘুম থেকে ডেকে দরজা খুলে রওনা দিল লাঘাটার দিকে। সকালের আঁধো অন্ধকারে কুয়াশার চাদরে ঢাকা আদুরে ঠাণ্ডায় হাঁটতে হাঁটতে লাঘাটা ব্রীজের ওপরে দাঁড়াল। এই ব্রীজের নীচ দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে ক্ষীণকায়া কোপাই নদী। বাঁদিকে দূর থেকে দেখা যায় লাল কাঁকুরে মাটির ওপর অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টার, আর একটু দূরে তাল, খেজুর আর অন্যান্য সবুজ গাছপালায় ঢাকা মনাচিতোর গ্রাম।    

ব্রীজের ডানদিক দিয়ে নীচে নেমে পড়ে কৃষাণ। চারপাশের সবুজ ক্ষেতের মাঝে ঝকঝকে সোনালী বালুকণার ওপর দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ চঞ্চলা কোপাই। দু’হাতের আঁজলায় হিমেল জল নিয়ে সারা মুখ ধুয়ে নেয়। এক অনাবিল সুখানুভূতি ছেয়ে গেল কৃষাণের সারা শরীর। তারপর নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা উঁচু ঢিপির ওপর এসে দাঁড়াল। যেখান থেকে দেখা যায় ক্ষীণতোয়া কোপাই আর বক্রেশ্বরের কাছাকাছি আসার অপূর্ব যাত্রাপথ। দিনের প্রথম সোনালী পরশে কোপাই যেন সোনার হাঁসুলি নেকলেস দিয়ে সাজিয়েছে চরাচর।             

কেমন করে যেন সময় বয়ে যায়…। কতক্ষণ…, জানা নেই তার। রোদ্দুরের আঁচ বাড়তেই উঠে পড়ে কৃষাণ। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগোয়। স্টেশনমাস্টার ভদ্রলোক বলেছিলেন, একবার লাভপুর স্টেশন ঘুরে আসতে। এমন স্টেশন নাকি খুব কম দেখা যায় এখন।   

সুরকীর গেরুয়া পথ দিয়ে যেতেই দেখা গেল ছবির মতো প্রাচীন বটের ছায়ায় লাল টুকটুকে স্টেশন, ‘লাভপুর’। আমোদপুর-কাটোয়া ন্যারো গেজের ছোট্ট লাইন। আদ্দিকালের গ্যাসবাতির মতো ল্যম্পপোস্ট। বসার জন্য ছোট ছোট বেঞ্চ। যেন শতাব্দী আগের এক টুকরো ছবি। ইচ্ছে করে জিরিয়ে নেই কিছুক্ষণ…। কিন্তু সময় নেই কৃষাণের, ফিরতে হবে আজই। যাওয়ার আগে পিসি’মার সঙ্গে দেখা করা দরকার।    

লজে পৌঁছে স্নান করে রুটি, তরকারি খেয়ে ইচ্ছে করেই সামরিক পোষাকটা পরে নেয় কৃষাণ। ফোর্সে একজন বলেছিল, এই জলপাই রঙের পোষাক সিভিল লাইফে খুব কাজ করে। নিজেকে আলাদা করে পরিচয় দিতে হয় না। কাছের একটা দোকান থেকে মোবাইলটা রিচার্জ করে নেয়, একবার শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। যদি শামসুদ্দিনের আব্বার ফোন নম্বর পাওয়া যায়, তাহলে পিসি’মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া যাবে। শামসুদ্দিনের বলেছিল, এক সপ্তাহ নাইট ডিউটিতে থাকবে…। বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর শামসুদ্দিনকে পেয়ে যায় কৃষাণ।          

“হ্যালো…শামসুদ্দিন… হ্যাঁ কৃষাণ বলছি”। গতকালের শামসুদ্দিনের ফুফুআম্মার সঙ্গে দেখা হওয়া বিস্তারে বর্ণনা করে তাকে। সেই সঙ্গে শামসুদ্দিবের আব্বার ফোন নাম্বার নিয়ে নেয়। কাছাকাছি মিষ্টির দোকানের নিয়ে একবাক্স মিষ্টি কিনে লজের হিসাব মিটিয়ে রওনা দেয় মনাচিতোরের পথে।    


“গুড মর্নিং ফৌজি ভাই”। ফিরে তাকাতেই দেখা হয় গ্রামের মেম্বারের সাথে।

“ও আপনি !” কৃষাণ এগিয়ে যায় তার দিকে।   

“আজকেই ফিরছেন বুঝি? না, মানে আপনার পোষাক দেখে মনে হল”।  

“হ্যাঁ, দাদা, আজকেই ফিরবো। আপনি তো আবার স্যার বললে রাগ করেন, তাই দাদাই বললাম”। ভদ্রলোকও হাসিমুখে এগিয়ে যায় কৃষাণের দিকে।  

“আপনার সঙ্গে তো ভালো করে আলাপই হয় নি। আমার নাম কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী, এখানকার পঞ্চায়েত মেম্বার। আসুন এখানে বসি…। চালাঘরে বাঁধানো উঁচু মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে কৃষাণ। ভদ্রলোক ফোর্সের নানা প্রসঙ্গ জিজ্ঞাসা করে। আলাপ করে দেয় উপস্থিত লোকজনদের সঙ্গে।   

“একটু চা খাবেন নাকি? এখানে তো দোকান নেই, আশেপাশের বাড়িতেই বলতে হবে”। না…, বলতে না বলতেই মাঠে খেলতে থাকা একজন কিশোরকে হাঁক দেয়। যদিও এখানে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তবু বাধ্য হয়ে… । কথা বলার মধ্যেই দুটি কাপে লিকার চা আর বিস্কুট দিয়ে যায় ছেলেটি।   

“এবারে উঠি দাদা, পিসিমার সঙ্গে দেখা করে ফিরতে হবে”।   

“দু’একদিন থেকে যান, কিছুই তো দেখলেন না এখানে। পরেরবার কয়েকদিন ছুটি নিয়ে আসুন…। আর একটা কথা, বন্ধুকে বলুন এঁদের এখান থেকে নিয়ে যেতে, মেয়ে বড় হচ্ছে, পরিস্থিতি ভালো নয়…”। ভদ্রলোক কৃষাণের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেন। চমকে তাঁর দিকে তাকায় কৃষাণ…। কী বলতে চাইছেন উনি…?        

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                     



সাইকেল ( সপ্তম পর্বের পর)

 #৮

পরদিন ভোর থেকে সামুয়েলকে আবার সাইকেল নিয়ে ভ্রমণে বেরোতে দেখল সবাই। সেই আগের মতো মুখে হাসি, আর সুরের গুনগুনানি। তবে বেলার দিকে সে বুলবুলের সঙ্গীদের ডেকে নিল সেই গাছের তলাতেই। তারপর ওদের সঙ্গে ঘন্টাখানেক আলোচনা চলল ওর। অভিজিৎ একটা খাতা, পেন নিয়ে বসে গম্ভীর মুখে কী যেন লিখছিল সেই সময়ে। দূর থেকে ওদের দেখছিল পথচলতি গাঁয়ের লোকজন। কেউ কেউ হেঁকে জিজ্ঞেসও করল, ‘কী গো, এখানে কিসের মিটিং চলছে তোমাদের?’ বুলবুল হেসে বলল, ‘কাকা, কাল তোমাদের বাড়ি যাব আমরা। গিয়ে সব বলব’। কাকাও ঘাড় নেড়ে হেসে চলে গেল। অভিজিতদের বাড়িতে একটা পরিত্যক্ত গোয়াল ঘর ছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে পুরো টিম সেই ঘর ছাইতে শুরু করল। ওদের দেখাদেখি আরও কয়েকটি খুদে এসেছে দুপুরে। কী হচ্ছে বা কী হবে, এই নিয়ে সকলের কৌতূহল খুব। অভিজিতের মা, বাবা, কাকা, কাকিমারা এখন পৃথক রান্নাঘরে রান্না করে। তবে তাদের একটি যৌথ রান্নাঘর ছিল আটচালার। সেই ঘর এতদিন বন্ধই পড়ে থাকত। আজ শেকল খুলে সেই ঘরকে পরিষ্কার করতে লেগে গেছে সারা পরিবার। সে এক হৈহৈ কাণ্ড! কেউ কেউ ভাবছে গাঁয়ের কারুর বিয়ে লাগবে নাকি? অভিজিতের বিয়ে হলে তো এতদিন সবাই জানতে পেরে যেত। যাইই হোক না কেন, এই লক ডাউন পর্বে কিছু একটা যে হতে চলেছে এই গ্রামে, সে নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলল সারা দিনভর।

বরবরুয়াদের জমিজমার অভাব নেই বটে, তবে নগদ টাকার জোগান কম। এদের গ্রামের বেশির ভাগ চাষীরাই এখনও বিনিময় প্রথায় কাজ মেটায়। ধানের বদলে তিসি, সর্ষের বদলে আনাজপাতি…এইরকম। এই আদানপ্রদানের ব্যবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছে সামুয়েল। বুদ্ধি তারই। তার কাজের ব্লুপ্রিন্ট রয়েছে অভিজিতের খাতায়। আর বাকি সদস্যরা যেমন বলা হচ্ছে তেমন ভাবে কাজে লেগে পড়ছে। প্রথমেই সামুয়েল ঠিক করে, স্কুল বন্ধ এদের এখন, তাই একটা অস্থায়ী স্কুল বানাবে। যেখানে সে স্প্যানিশ শেখাবে বাচ্চাদের। ওদের শেখার উৎসাহ দেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর সেও শিখে নেবে স্প্যানিশের অসমিয়া শব্দের প্রতিরূপ। এর জন্য অভিজিতদের গোয়ালঘরটিই প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। কাল থেকেই চালু হবে তাদের স্কুল। সকাল সাতটা থেকে দশটা স্কুলের সময়। এই তিনঘন্টায় ছেলেমেয়েদের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা করবে অভিজিতদের যৌথ রান্নাঘর। আপাতত খর্চা যোগানের দায়িত্ব এই পরিবার তুলে নিয়েছে। এরপর অন্য কেউ সাহায্য করতে চাইলে, নেওয়া হবে।

এই পরিকল্পনা প্রত্যকে বাড়ি ঘুরে ঘুরে জানানো হল পরের দিন। বেশিরভাগ পরিবারই রাজি। সম্পন্ন পরিবার যারা আছে, তারা নিজেরাই যেচে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিল। কয়েক ঘর অবশ্য সব শুনল, মুখে কিছু বলল না। জোর খাটানোর কোনো চিন্তাভাবনাই এদের নেই, সামুয়েলের ব্যস্ততায় সময় কেটে যাবে, ছেলেমেয়েগুলোরও একঘেয়েমি কাটবে। শিক্ষাও হবে কিছু—এই হল উদ্দেশ্য। পরের দিন সকালে বুলবুলের ছজন সঙ্গীরা তো এসেছেই, আরও বারোজন এসে উপস্থিত হল। সকলকে নিজের নিজের আসন, খাতা, পেন নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। এখানের মেয়ে, বউরা বাড়িতেই চমৎকার আসন বোনে। ফলে আসনের অভাব কারুরই নেই, কিন্তু বাড়তি খাতা কেউ কেউ আনতে পারেনি। তবে স্লেট, পেন্সিল সকলেই এনেছে না বলতেই। সামুয়েল স্লেট পেনসিল নিয়েই শুরু করল আজ। একজনের স্লেটে স্প্যানিশের প্রথম বর্ণ লিখে দিল। সেই অনুসারে কপি করতে থাকল সবাই। যেহেতু এরা বড় হয়েছে কিছুটা, তাই খুব বেশি দেরি হল না প্রাথমিক বর্ণ শিক্ষায়। কিছুক্ষণ লেখালেখির পর্বের পরে এবারে সামুয়েল কিছু চলতি শব্দের স্প্যানিশ প্রতিশব্দ শেখাতে শুরু করল ওদের। এই মৌখিক পর্বটা সবথেকে বেশি উপভোগ করল ওরা। মাঝখানে মুড়ি আর আলু, ছোলার তরকারি দিয়ে টিফিন পর্বও মিটে গেল সুন্দর ভাবে। আপাতত সময় শেষ। কাল আবার স্কুলে আসবে ওরা। উৎসাহে, আনন্দে ফুটছিল বাচ্চাগুলো। মনপ্রাণ ভরে উঠছিল সামুয়েলেরও। ওরা চলে গেলে গান ধরল সে-


জয়তী রায় (মুনিয়া)

                                                               




   আজকের আলোচনা করব মানবমন নিয়ে। এখন ২০২১ সাল। চলছে মহামারির তাণ্ডব। কি হবে তার মধ্যে এই মনের কচকচি কেন? 

প্রয়োজন বইকি! মন ঠিক না থাকলে শরীর নিয়ে লড়াই করা মুশকিল। মরণাপন্ন রুগী উঠে দাঁড়াতে পারে  মনের জোর থাকলে। আর শুধু রোগের কথা ই বা কেন? প্রতিদিনের জীবন চর্যায়  মনের ভুমিকা স্বীকার করতেই হবে। বিবাহিত জীবনে মন বড় ভুমিকা পালন করে। দাম্পত্য পুরনো হয়ে গেলেই পরকীয়া এসে হানা দেয়। কেন? মন কেন চায় অখণ্ড স্বাধীনতা? এটা কোনো দোষ নয়। ধর্ষণ বিদেশে এত বেশি হয় না। কারণ, মনের কোন জায়গা থেকে এইরকম ভযঙ্কর ইচ্ছের উত্পত্তি সে সম্বন্ধে ছোট থেকে বাচ্চাদের সচেতন করে দেওয়া হয়। এই দেশে বাচ্চারা যত মায়ের বেবি হয়ে থাকবে ততই ভারতীয় মা খুশি। শিশু কোনো অবোধ প্রাণী নয়। মাত্র তিন মাস থেকে যৌন আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার শরীরে। অথচ, মায়েরা ভাবে, শিশু অবোধ। আধো আলো  আধো অন্ধকারে থাকতে থাকতে একমাত্র sex  নিয়ে সারাজীবন কৌতূহলী থেকে যায়। 

মন খারাপে ভোগে। লেখাপড়া, সম্পর্ক সবকিছুতে ছাপ পড়ে। 

********



জন্ম নিয়েই কেঁদে ওঠে শিশু। 

  আগামী দিনের লড়াইয়ের কথা ভেবে হয়ত মন খারাপ হয়। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে না জানি কত  লড়াই করতে হবে? শুধু  বাইরের জগতের সঙ্গে তো নয়, কঠিন লড়াই হল নিজের সঙ্গে। ভিতরের আমি আর বাইরের আমি র নিরন্তর সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়।   তাই কেঁদে ওঠে শিশু। পারবে তো টিঁকে থাকতে? না কি , পরাজিত হতে হবে নিজের কাছে? নিজের অ- দেখা প্রবৃত্তির কাছে? 

    

***

  প্রবৃত্তি( Instinct) জন্মলগ্ন থেকে বহন করে আনতে বাধ্য হয় মানুষ। এই ব্যপারে তার কোনো  পছন্দ- অপছন্দ কাজ করেনা। বিষয়টিতে প্রথম আলোক পাত করেন বিখ্যাত মনো বিজ্ঞানী  সিগম্যানট ফ্রয়েড। এ একেবারে ধামকাধার আবিষ্কার। উপর দেখে নয় বিচার করতে হবে ভিতর দেখে! ভিতর মন। সেখান থেকে আরো আরো খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত। সেই শেষের ঘরে লুকিয়ে আছে যে মন,সে নাকি পশুর মত। কিম্বা তার চাইতেও আগ্রাসী। হিংস্র। লালসা পূর্ণ। 

ফ্রয়েড স্যারের এমন চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা ভালো করে জেনে চোখ কপালে উঠে গেল। মানুষ জন্ম হতেই হিংস্র? তবে সমাজ চলছে কি করে? 

   একটু গুছিয়ে বলা যাক। 

ফ্রয়েড স্যার বললেন যে, যাবতীয় মানসিক চিন্তা ভাবনা তিনটি পথ ধরে এগিয়ে চলে। ইড, ইগো , সুপার - ইগো। 

*****

ইড , মানুষের অচেতন মন। শিশুর মত, পশুর মত...উচিত অনুচিত বোধ থাকে না। খিদে পেলে খাবার, রমণ ইচ্ছে জাগল তো রমণ...আনন্দ চাই।  যেভাবে হোক। চাই। চাই আর চাই। ইড হল মানব মনের মৌলিক স্তর। যেখানে মানব মনের সকল শক্তি নিহিত থাকে।  ইড মূলত মানুষের জৈবিক দিক। মানব মনের স্বভাবজ চাহিদা পূরণ করে ইড। মন যা চায় তাই করো। এর কোনো মানবিক দিক নেই। পুরোটাই লোভ লালসা কাম চিন্তায় ভরপুর। ইড এমন তীব্র ভাবে মানুষকে প্ররোচিত  করে যে, সে প্ররোচনায়  মানুষ যে কোনো অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে খুন ধর্ষণ অবধি করতে দ্বিধা বোধ করে না। এক কথায় ইড হচ্ছে আমাদের ভিতরের সুপ্ত পশু। ফ্রয়েড স্যার বলেছেন যে, এই প্রবৃত্তি দখল করে আছে মানব চরিত্রের বেশির ভাগ জায়গা। 

      পাশবিক প্রবৃত্তির ভূমিকা মানুষের জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা গেল। 

   সুপার ইগোর কথায় আসি একটু।  এ হল আধা অচেতন বা অবচেতন মন।  সুপার ইগো হল মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা পূরণ করতে উদ্দীপ্ত হয়, সুপার ইগো একে বাধা দেয়। সুপার ইগো মানুষ কে সব সময় মানবিক দুর্বলতার উর্ধে উঠে ভালো কাজ করার জন্য মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। অর্থাৎ, পশু প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে এর অবস্থান। একজন অতি খারাপ তো অপরজন অতি ভালো। এই দুই অতি অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে ইগো বা চেতন মন। কি রকম?

যেমন, ইড বলবে পর্নোমুভি দেখো। দারুণ লাগবে। 

সুপার ইগো ওমনি  লাঠি উঁচিয়ে বলবে, খবর্দার। এটা নৈতিকতা বিরোধী। অতএব দেখা যাবে না। 

ইগো বলবে, পর্ণমুভি দেখো। তবে লুকিয়ে। কেউ যেন জানতে না পারে। 

ইগোর কাজের আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, ফাঁকা রাস্তা আর বাইক সহ কিশোর। এক্ষেত্রে, ইড প্রবৃত্তি উস্কানি দিয়ে বলবে তীব্র বেগে চালিয়ে যাও। যা হয় দেখা যাবে। হেসে নাও দুদিন বই তো নয়।  ফুর্তি করো। মজা লোটো। বাতাসের বেগে বাইক চলাও। সঙ্গে সঙ্গে তার অবচেতন মন বা সুপার ইগো বাধা দেবে। বহু অনিষ্ট হতে পারে সেটা বলবে। এই দোলাচলের মাঝে এসে পড়বে ইগো অর্থাৎ সচেতন সামাজিক মন।  মাঝামাঝি স্পিডে চালাতে নির্দেশ দেবে। 

*****

   আমাদের যখন তিনবছর বয়স তখন থেকে উচিত- অনুচিত বোধ তৈরি হয়। শিখে যাই অনুভূতি চেপে রাখার কৌশল। মন আর মুখ আলাদা করে ফেলতে পারি অনায়াসে। রেসের মাঠে গেলে লোকের নিন্দে, তবে লুকিয়ে যাওয়া যায়। পরকীয়া করা উচিৎ নয়। গোপনে করলে কে জানবে? ইগো সর্বক্ষণ এই ভূমিকা  পালন করে যাচ্ছে। মানুষের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে সামাজিক প্রবৃত্তির এমন একটা সহাবস্থান কাজ করছে। চেতন মন লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কাজটাই করছে, যেটা গোপন মন করতে চায়। প্রকাশ্যে না হলে, চিন্তায় করছে। স্বপ্নের মধ্যে আসছে। অচেতন মন ঘুমের মধ্যেও জাগ্রত থাকে। তাই, সারাদিন যেমন যেমন চিন্তা করি ,অচেতন মনের মধ্যে জমা হতে থাকে সব। স্বপ্নে বহুসময় প্রতিফলিত হয় সেগুলো।

  *****

     কথায় বলে, প্রবৃত্তির হাতে অসহায় মানুষ। নির্মম সত্য। আজকের সভ্য মানুষ সৃষ্ট হয়েছে সমাজের প্রয়োজনে। প্রকৃতপক্ষে সে তো অরণ্যচারী স্বাধীন। জবাবদিহির কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। শরীরের ক্ষুধা উদরের ক্ষুধা মেটানো ছিল জন্মগত অধিকার। নারী -পুরুষ জীবনে একজন হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি ছিল না। অথবা আইনগত সম্পর্কের বাঁধনে মোটেই  বাঁধা ছিল না সে। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হল পৃথিবীর। পরিবর্তন হল না মানুষের গোপন মনের। সেখানে সে রয়ে গেল স্বেচ্ছাচারী  আদিম।   স্বপ্নদোষ  দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষের। নিরীহ ভালমানুষ ব্যক্তি বহন করে চলে অবদমিত কাম। পতিব্রতা বৌটি  মনে মনে পরকীয়া করে। নিষ্ঠাবতী বিধবা  কান পেতে শোনে রসের গল্প। ধর্ষণের ভিডিও বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ভিডিও তারিয়ে তারিয়ে দেখে অনেকেই। আহা উহু করার মধ্যে দিয়ে সুখানুভূতি  চলকে পড়ে। খুন জখম দাঙ্গার খবর অনেক বেশি আগ্রহ জাগায় সাধারণ খবরের চাইতে। সরাসরি অপরাধ করছে না কিন্তু অপরাধ ঈর্ষা হিংসার ঘটনা শুনে তীব্র  আনন্দ পাওয়া নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির  কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া  আর কিছু নয়। 

   

  ****

   ফ্রয়েড স্যার অনেক উপকার করে দিয়েছেন আমাদের। তার কাছে  কৃতজ্ঞ থেকেও বলতে পারি এই পাশবিক মনের আক্রমণ সম্বন্ধে প্রাচীন শাস্ত্র ভালরকম চর্চা করে নানান উপদেশ দিয়ে গেছে। মন চাইছে অথচ পাচ্ছে না...চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যের ব্যবধান থেকে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় হতাশার।  দিনের পর দিন নিজেকে দোষ দিতে দিতে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। পীড়িত মন দুর্বল মন বহনকারী মানুষকে আত্মহনন থেকে সরে এসে আত্মোপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছেনভারতীয় ঋষি -মুনিগণ। 

   মানব চরিত্র সম্পর্কে প্রাচীন যুগের ঋষিকুল মানব চরিত্রের নাড়ি  গলি খুঁজে  ভালো রকম পর্যালোচনা করেছিলেন। প্রবৃত্তির হাতে বন্দী মানব মুক্তি কি করে পাবে? সুপার ইগো ( সুপার ego) অর্থাৎ মনের যে অংশে নীতিবোধ, মানবিকবোধ, নৈতিক চেতনা সুপ্ত থাকে--তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

ভিতর হতে ইচ্ছে জেগে না উঠলে  পশুপ্রবৃত্তি রোধ করা যাবে না। নৈতিক বোধ জাগরণের জন্য নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই জরুরি। প্রকৃষ্টতম  উদাহরণ মহর্ষি বাল্মিকী। দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী। রাম নাম করে একমনে তপস্যা বস্তুত এক্ধরণের কাউনসিলিং।   রত্নাকর অবস্থায় কিন্তু মানুষ হত্যা করতে হাত কাঁপেনি। অনুশোচনা হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই  নিয়েছিলেন দস্যুজীবন। তপস্যা শেষে ভিতর ঘরে জ্বলে উঠল আলো। স্পষ্ট অনুভব করলেন প্রাণ কত মহিমাময়। সামান্য পাখি হত্যা দেখে ঝরে পড়ল অশ্রু। উচ্চারিত হল কবিতা। এখানে সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত ইড প্রবৃত্তি। নিজের মনের সঙ্গে বসে ধ্যান করে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা যায় মানব জীবনের  উদ্দেশ্য রিপু বা প্রবৃত্তির হাতে হারিয়ে যাওয়া নয়। বরং, রিপুকে মহৎ কাজে নিয়োজিত করে জীবন সুন্দর করে তোলা। 

*****

  মানব মনের, অন্ধকার পাশবিক দিক অনেক বেশি শক্তিশালী। তার  অভিঘাত প্রবল প্রচন্ড। সুনামির মত। ভাবনার কথা এই যে, কতখানি পশু আমরা হয়ে উঠতে পারি, সে সম্বন্ধে নিজেরাই জানি না। এমন শক্তিশালী পিশাচের সঙ্গে লড়াই সহজ নয়। নৈতিক বোধ দ্বারা পিশাচ কে হত্যা করতে হলে, কঠিন জীবনচর্যা প্রয়োজন। নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে ধুলো ময়লা সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। 

পিশাচ মনের কাজ হল তাৎক্ষণিক খুশির দিকে মনকে চালিত করা। সাধারণ মানুষের ভালো লাগে সেটাই। মদ্যপান, অকারণ হুল্লোড়,ঈর্ষা , আড্ডা , পরনিন্দা, ধর্ষণ, ইভ টিজিং উলঙ্গ শরীর দেখা ...আরো নানা কাজে পিশাচমন উৎসাহ দিতে থাকে। তাৎক্ষণিক খুশির জাল রঙিন সুন্দর। 

ইড ধীরে ধীরে অধিকার করে নেয় মানবমন। প্রবৃত্তির দাস বানিয়ে হরণ করে শান্তি। ভুরি ভুরি ঘটনা আছে উদাহরণ হিসেবে। 

এই পিশাচ মনের ভিতর নিহিত আছে প্রচন্ড শক্তি। ভেঙে যেমন ফেলতে পারে, গড়েও তুলতে পারে। রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হতে গেলে অলৌকিক উপায় নয়, চাই নিরলস সাধনা। তবে, সেই প্রবৃত্তি ঘুরে যাবে সুন্দর দিকে, সৃষ্টি  করবে অতুলনীয় জীবন। আমাদের ভিতর ঘরের মন যেন উত্তাল নদী। বাঁধ দিয়ে উৎপদিত হবে বিদ্যুত। দূর করবে অন্ধকার। না হলে? ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। মৃত্যু অর্থ শারীরিক কেবল নয়। মানসিক সুস্থতা  না থাকাও মৃত্যুর সমান। 

******

গভীর অজানা মন লাগাম ছাড়া  ঘোড়ার মত। তাকে  লাগাম পরিয়ে সঠিক পথে চালিত করে ফেলতে হবে। তাৎক্ষণিক সুখের জন্য বহু ক্ষতি করে দিতে পারে বেয়াড়া মন। বহু সমস্যা, দুশ্চিন্তা দুঃ স্বপ্ন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শরীর খারাপ হতে থাকে। অচেতন মন সাংঘাতিক শক্তিশালী একথা জেনেছি। এই শক্তি বা এনার্জি কিন্তু নেতিবাচক। ক্রমাগত নেতিবাচক ইঙ্গিত করে পথ চ্যুতি  ঘটতে থাকে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কালে অর্জুনের অচেতন মনে এইরকম নেতিবাচক চিন্তার ঝড় উঠেছিল। ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ইতিবাচক মনোভাব  অর্জন করতে হলে  শ্রীমদ্ভগবত গীতা পড়া জরুরি।  নিরন্তর চর্চার দ্বারা এই নেতিবাচক মন যদি ইতিবাচক দিকে পরিণত হয়, তবে মানুষ হয়ে উঠবে ঈশ্বর। বহুগুণ বেড়ে যাবে জীবনী শক্তি।

*****

মানুষ ভালো - মন্দের ফারাক করতে পারবে। 

অচেতন মন( Id) সচেতন মন( ego) অবচেতন মন( super ego) --তিনটি এক সুতোয় গেঁথে ফেলে মানুষ হয়ে উঠুক নিজভূমে  রাজা। 







      

শোয়াইব শাহরিয়ার

                                          




এই  সংখ্যার কবি শোয়াইব শাহরিয়ার৷২৮শে এপ্রিল, ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার অন্তর্গত পূর্ব ইলশা গ্রামে জন্ম। পেশায় ছাত্র। আগ্রহ কবিতায়।প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ – কপালের কৌতুক (২০২১)


আহবান

তোমার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকালে, মুহূর্তেই অভ্যুত্থান ঘটে যায়। মনে হয়, কে যেন কোথাও অনবরত কেঁদে চলেছে। ফুলের পাপড়িতে যেন লেগে আছে নৈঃশব্দের নির্মমতা! মুহূর্তেই ভাঙচুর শুরু হয়; ভেতরে ভাঙচুর শেষে—নদী হয়ে ওঠো। নিঃশব্দে জল গড়ায়। অদূরে টুপটাপ ঝরে পড়ে—জীবন কিংবা জীবনের মতো কিছু! 

সেই নদীতীরে বসে, তোমাকে বলছি শুনো—যদি কখনো চোখের পাতায় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চুম্বন এঁকে দেই, যদিও-বা ভীষণ বিষণ্ণতার দিনে—সমুদ্র সাঁতরাবে?

বৃষ্টি শেষে

বৃষ্টি শেষে—
পাতা ও পথের মতো যুবতী হয়ে উঠবে;
বৃষ্টি শেষে—
যুবতীর মতো ব্যথাতুর নদী হয়ে উঠবে!

অন্তঃপুরে যেদিন বৃষ্টি থেমে যাবে
শুকিয়ে যাবে জীবনের ঠোঁট
যেদিন ফুরিয়ে যাবে জলের যৌবন
মনে করে সেদিন ইশারা দিও...

আমি জীবনের রঙমহলে—
বৃষ্টির পরিবর্তে শষ্য হয়ে নামবো!

দুঃখ

তোমার করতলে দুটি রাষ্ট্র দিলাম
একটি রাষ্ট্র জন্মের, আরেকটি মৃত্যুর
আমার অনুরোধ—তুমি দ্বিতীয়টি নাও
তোমার অনুরোধ—প্রথম জন্মটি চাই
...এই নাও তবে ঐতিহাসিক দুটি রাষ্ট্র!

প্রিয় ফৌজিয়া, 
বলো, মাঝখানে দুঃখের বদলে কী-বা পেলাম?

শীতকাল

যে গাড়িতে চড়ে চলে যাচ্ছেন
ওটাকে মাঝেমধ্যে নদী ভেবে ভুল করি
ভাবি, রক্তাক্ত লবণের মাঠ!

কোনো আলপথ ভেঙে গেলে—
দেখি, অপরিপক্ক শিশুর মৃত চোখ;
অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়িয়ে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে!
...আমি তখন মাঠের একপ্রান্তে দৌড়ে যাই!

এদিকে, দৌড়ে যাওয়া দেখে ভাবলেন পালাচ্ছি—
রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার দুঃসাহস আমার নাই!

অথচ জানেননি—
গাড়িটাই ছিল আমার মৃত শরীর!
যেখানে বসে—
হাসতে হাসতে পেরিয়ে যাচ্ছেন শীতকাল!

পথ

বনমল্লিকা, ভাগ্যরেখা যদি মন্দ হয়
সৌরভ ছড়িয়ে দিও;
কাঁটাকে উপেক্ষা করে, 
আমার চুম্বনগুলো সুপ্রসন্ন হবে।

হয়তো মুঠোভরতি মেঘ থাকবে
বেদনাভরতি বৃষ্টি থাকবে
তবুও, তোমার সৌরভ দিও;
...তোমাকে দেখাবে স্বর্গের পথ!

দহন

বৃষ্টি হচ্ছে, ভেজা চুলে
                উড়ছে মেঘ—
ঠোঁট ছুঁয়ে, হৃদয় মাঝে!

বৃষ্টি হচ্ছে, ঢুকছি ভুলে
               দেহের ভাঁজে;
জলের যৌবনে ঢুকছে আগুন!

বৃষ্টি হচ্ছে, পুড়ছে নগর;
                পুড়ছে শরীর;
ফৌজিয়া, বৃষ্টি হচ্ছে—
                মৃত্যু হচ্ছে—
               তোর ভেতর!

বোধগম্যতা

পা, ধীরে চলো
সামনে সমূহ অন্ধকার;
একবার যদি ডুবো
হারাবে মন দেবতার!
পা, এলোমেলো বৃষ্টি 
পাতায় পাতায় ফাঁদ
দূরে যদি দাও দৃষ্টি
কেন সব বরবাদ?
পা, ধীরে চলো
ধীরেধীরে চলো...
আর্জি খুদার;—
সামনে সমূহ যৌন অন্ধকার!

দূরত্ব

দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছো;
দূরত্ব যদিও তেমন না
এটুকু তো থাকেই—
যেটুকু থাকলে কোনো দূরত্বের প্রয়োজন পড়ে না!

...এটুকু থাকলে, জীবন আর জীবন থাকে না!

দূরত্ব কি জানে, তার অপর নাম প্রেম?
দুরত্ব কি জানে, তার অপর নাম নরক?

কেউ না জানুক, আমি তো জানি—
দূরত্বের অপর নাম বনমল্লিকা! 

প্রত্যুত্তর
(বনমল্লিকাকে)

তুমি হাত বাড়ালেই হাত চলে যায়
বুকের ভেতর; জোরে বৃষ্টি নামে হায়;
জল থৈথৈ জল থৈথৈ জলের অসুখ
তোমার পা-ছোঁয়া পথ অসুখে মরুক!

ঠোঁট বাড়ালেই পথ হয়ে যায় নদী
ইচ্ছা করে ডুব দিয়ে যাই নিরবধি!
তোমার মুখের লাল—যেন সর্বনাশ
ঠোঁট বাড়াতেই আহা—রূপান্তরে ঘাস!

ঘাসের উপর শুলে—গল্পগুলো জল
ঠোঁটের উপর ঠোঁট—জীবন উজ্জ্বল!
তোমার পরশ পেয়ে মৃত্যুমুখী হাসে;
বুক বাড়াতেই আহা—স্বর্গ পরবাসে!

খোঁজ

ম্যালা দিন দেখিনা তোমারে, তুমি এখন কই?
বুকের মইধ্যে একগোছা ধানের চারা দেখিয়ে বলেছিলা
ধানেরা যেদিন গর্ভবতী হয়ে তোমার ঘরে উঠবে
ঐদিন আমারে খুঁইজা নিও; পারলে একবার ঘ্রাণ নিও;

কৃষকের বাছা আমি;
মাথার মইধ্যে ডুইবা থাকে কালবোশেখির ভয়
ডুইবা থাকে শীতকালের জ্বর!
তোমারে তবুও খুঁইজা বেড়াই; সাহস কইরা 
ধানের কাছে গিয়া, নাকের আগা বাড়াই দিলাম
তোমারে তবুও পাইলাম না; তুমি কই থাকো এখন?

বুকের মইধ্যে ঠোকা দিয়ে একবার বলেছিলা—
ঐখানে যদি না পাও, তবে এইখানেই পাবা, খুঁইজা নিও...

এখন আমি তোমারে খুঁইজা বেড়াই...
খুঁইজা বেড়াই নিজের ভেতর!




শর্মিষ্টা দত্ত

                                                         


নবম পর্বের পর 


খোঁজ 
(১০)

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সিনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না শর্মিলার l সেজন্য উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে l উচ্চ মাধ্যমিকের পড়া, টিউশন সব সামলে গানের ক্লাস, রেওয়াজ সবকিছুতেই বেশ ফাঁক থেকে যাচ্ছিল l অগত্যা গানের স্কুল ছাড়তে বাধ্য হল শর্মিলা l গান শেখা একেবারে বন্ধ হয়ে যাক এটা অপর্ণা চাইছিলেন না l তিনি রবিঠাকুরের গানে নিবেদিতপ্রাণ, একনিষ্ঠ শ্রোতা l তাঁর মেয়ে হয়ে শর্মিলা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখবে না ! প্রধানত মায়ের ইচ্ছেতেই শর্মিলা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দময়ন্তী মুখোপাধ্যায়ের স্পেশাল ক্লাসে ভর্তি হল l বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে তাঁর বাড়ি l প্রতি রবিবার সকালে শর্মিলা একা একাই বাসে করে গানের ক্লাসে যাওয়ার অনুমতি পেল l এই প্রথম বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একা বেরোনো, তার উত্তেজনাই আলাদা l একা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে ওঠা, নিজে নিজে টিকিট কাটা l হঠাৎই যেন  অনেকটা বড় হয়ে গেল শর্মিলা l মৌলালি থেকে ঋতু নামে একটি মেয়েও ওই ব্যাচে গান শেখে l সে অবশ্য অনেকটাই বড় l ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এম এ ফাইনাল ইয়ারে পড়ে l কোনো কোনোদিন যাওয়ার সময় বাসে ঋতুদির সঙ্গে দেখা হয়ে যেত l ফেরার সময় দুজনেই এক বাসে ফিরত l ঋতু সঙ্গী হওয়াতে অপর্ণাও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন l যদিও শর্মিলা অনেকটা বড় হয়েছে, কিন্তু সেটা মাকে বোঝানোর সাধ্য ওর নেই l অপর্ণার কাছে মুন্নি আর মুনমুনের তেমন কোনো ফারাক নেই l 
ঋতুদির বয়ফ্রেন্ডের নাম স্বপ্নদীপ রায়চৌধুরী l ওদের পাড়াতেই থাকে l সে একজন কবি l বাংলায় এম এ পাশ করে টিউশন করে আর কবিতা লেখে l বিভিন্ন নামকরা কাগজে তাঁর  লেখা ছাপা হয় l শর্মিলাও পড়েছে,  তবে আধুনিক কবিতা একেবারেই মাথায় ঢোকে না ওর l ঋতুদি স্বপ্নদীপকে নিয়ে গর্বিত হলেও সম্পর্কটার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান l স্বপ্নদীপ কোনো স্থায়ী চাকরিবাকরির চেষ্টা করে না l বাউন্ডুলেপনা করে বেড়ায় বলে নিজের বাড়িতেও কোনঠাসা l এমন ছেলের সঙ্গে ঋতুদির বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইবেই বা কেন ! গানের ক্লাসে যাওয়া আসার পথে শর্মিলার এসব কথা প্রায় সবই জানা হয়ে গেল l রিজ্জুদার কথাও অবশ্য জানত ঋতুদি l ধ্রুবর ব্যাপারটাও বলেছিল l বেশ জমে উঠেছিল ওদের অসমবয়েসী বন্ধুত্ব l ঋতুদি একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল 
--রিজওয়ানের সঙ্গে তো তোর মাসে একবার মাত্র দেখা হয় l ধ্রুব বেচারা কি দোষ করল ! তুই ইচ্ছে করলে ওকে একটু সময় দিতেই পারতিস l তোরও সময় কাটত, ওকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত না l 
-- কি যে তুমি বল না ঋতুদি ! আমি জেনেশুনে একটা ছেলের সঙ্গে ফ্লার্ট করব ! ধ্রুব এখন খুব মন দিয়েই পড়াশোনা করছে l নতুন স্কুলে ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠতে ফার্স্ট হয়েছে l ওখানে গিয়ে ওর ভালোই হয়েছে l 

সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি l ক্লাসের শেষে ছাতা মাথায় দিয়ে দময়ন্তীদির বাড়ি থেকে বেরিয়েই বিপদে পড়ল ওরা l হাওয়ার তোড়ে ছাতা উল্টে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে চপচপে হয়ে কোনোরকমে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল l বাসস্ট্যান্ডে শেডের নিচে স্বপ্নদীপদা দাঁড়িয়েছিল l ঋতুদিকে  বলল 
---গড়িয়াহাটে সুনীলদার কাছে এসেছিলাম l ভাবলাম তোমার তো আজ গানের ক্লাস, একবার দেখা করে যাই l তা হঠাৎ এমন জোর বৃষ্টি এল, বাস পেলাম না, হেঁটে হেঁটে এতটা আসতে হল l  হলুদ পাঞ্জাবী ভিজে গায়ে লেপ্টে রয়েছে l রোগা তালপাতার সেপাইয়ের মত চেহারায় একমুখ দাড়িগোঁফ, চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা l ঋতুদির গোলগাল সন্ধ্যা রায়ের মত মিষ্টি চেহারার পাশে এক্কেবারে বেমানান l তবু এই প্রথম একজন জলজ্যান্ত কবি তার সামনে ! ওরা গল্প করছিল আর শর্মিলা সম্ভ্রমের চোখে স্বপ্নদীপদাকে দেখছিল l প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়ানোর পর স্বপ্নদীপদা বলল 
--স্ট্যান্ডে এখনও একটা  ট্যাক্সি রয়েছে, ওটাই ধরি বরং l আজ আর বাস চলবে বলে মনে হচ্ছে না l শর্মিলা তুমিও চল আমাদের সঙ্গে, তোমার স্টপেজে নেমে যেও l 
ট্যাক্সিতে উঠে ঋতুদির পাশে গা ঘেঁষে বসল স্বপ্নদীপদা l তুমুল বৃষ্টিতে চারদিক সাদা l ঋতুদির অন্যপাশে বসে শর্মিলা বুঝতে পারছিল ওরা ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে l ঋতুদির ভেজা শরীরের ওপর উঠে আসছে স্বপ্নদীপদার হাত l জানলার ঝাপসা কাচের দিকে প্রাণপণে তাকিয়ে শর্মিলা ক্রমশ সিঁটিয়ে যেতে লাগল l শর্মিলার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওরা নিজেদের মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকল l রীতিমত কান্না পাচ্ছিল শর্মিলার l বাইরে মুষলধারে  বৃষ্টি, ট্যাক্সি থেকে নেমে যাওয়ারও উপায় নেই l মুহূর্তগুলো এত প্রলম্বিত কেন ! প্রবল অস্বস্তি নিয়ে 
নিজের স্টপেজের অপেক্ষায় বসে রইল শর্মিলা l ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামাতে সম্বিৎ ফিরে পেল ওরা l ঋতুদি ঠেলে সরিয়ে দিল স্বপ্নদীপদাকে l একটাও কথা না বলে ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে গেল শর্মিলা l ওরা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে গেল l 
বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখল ছাতা হাতে উদ্বিগ্ন মুখে মা দাঁড়িয়ে রয়েছে l তাঁতের শাড়ির নীচের দিকটা বৃষ্টিতে ভিজে সপসপ করছে l বাড়ির গলিতে একহাঁটু জল l মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে উঠল শর্মিলা 
--তুমি এখানে এসেছ কেন? এতটা পথ আসতে পারলাম আর এইটুকু রাস্তা যেতে পারব না ! 
--কি হয়েছে তোর মুন্নি? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটাও বাস আসছে না l আমার বুঝি চিন্তা হয় না ! তোর সঙ্গে ট্যাক্সিতে কে ছিল... ঋতু?  ওর বাড়ির কেউ কি গিয়েছিল ওকে আনতে? 
--আজ রোববার l বাড়িতে তো সবাই ছিল l বাবা, ছোটকা কেউ আসতে পারল না ! তোমাকেই আসতে হল ! আশ্চর্য ! 
চুপ করে গেলেন অপর্ণা l মায়ের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার কথা এখন এ মেয়েকে বোঝানো যাবে না l অরুণের শরীর ভালো নয়, সর্দিকাশি - জ্বর l আর অলোক- শবনম আজকাল বাড়ির অন্যান্য সমস্যা একটু যেন এড়িয়েই চলে l সারা সপ্তাহ দুজনেই অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে l রবিবার ছুটির দিনে বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে   একটু নিজেদের মত মুনমুনকে নিয়ে সময় কাটায় l কোনোদিনই নিজের সমস্যা বা দুশ্চিন্তার কথা কাউকে মন খুলে বলতে পারেননি অপর্ণা l এখন তো আরো ইতস্তত বোধ হয় l 
মায়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েও গুম হয়ে গেল শর্মিলা l মাকে কিছুতেই ওর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারল না l 

বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু ধরলেও বাড়ির সামনের জমা জল নামল না l আজ মৈত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুবই দরকার ছিল l শম্পা এসেছিল বিকেলে, ওকেও কিছু বলতে পারল না শর্মিলা l বরং শম্পা খবর দিল সকালে মিষ্টি কিনতে গিয়ে ওর মেঘনার সঙ্গে দেখা হয়েছে l মেঘনার বিয়েটা  এখন ওর বাবা - মা মেনে নিয়েছেন l ও এখন কয়েকদিনের জন্য  বাপের বাড়িতে এসেছে l লাল শাড়ি, গয়না, একমাথা সিঁদুর পরে মেঘনাকে অপূর্ব লাগছিল l শম্পা বলল 
--- চল এরমধ্যে একদিন মেঘনাদের বাড়িতে যাবি? মঙ্গলবার তো টিউশন নেই তোর l আমিও ফ্রী l চল ওর সঙ্গে দেখা করে আসি l 
--হ্যাঁ, গেলে সৌমিলির সঙ্গেও দেখা হবে l অনেকদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে l 
--হ্যাঁ... তোর তো প্রাণের বন্ধু ! দেখা হলেই শুধু নিজের গুণকীর্তন করবে ! আমরা তো কেউ ওর পায়ের নখের যোগ্য নই কি না ! কি করে যে ওকে সহ্য করিস তুই !
খুব হাসল ওরা দুজন l মনটা একটু হলেও হালকা হল l 
সোমবার স্কুলে মৈত্রেয়ীকে ঘটনাটা বলল শর্মিলা l মৈত্রেয়ী শুনে বলল 
--বিষয়টাকে এতটা ইম্পর্টেন্স দিস না শর্মিলা l ঋতুদির কাছে এটা একটা খেলা l ও নিজেও কিন্তু ওই পরিবেশ আর স্বপ্নদীপদাকে ইউজ করেছে l 
--কি বলছিস তুই ! ওরা সিরিয়াসলি কমিটেড ! কিন্তু আমার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা হল ওদের প্রাইভেট মোমেন্টস ওরা পাবলিক করে ফেলল ! আমাকে একেবারে ইগনোর করল কেন !
-- তুই কি জানিস ঋতুদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ! 
--ক কই না তো ! তুই কি করে জানলি? স্বপ্নদীপদা তো কিছুই করে না তেমন l আজই তো ঋতুদি বলছিল... 
--আরে এটা অন্য ছেলে l ঋতুদির বাবা আমার বাবার আন্ডারে কাজ করেন l এই তো দুদিন আগে বাড়িতে বিয়ের কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেলেন l মেয়ের নাম আর ডেসক্রিপশন শুনেই বুঝতে পেরেছি এটাই তোর ঋতুদি l তখনই অবাক লেগেছিল l তোর কাছেই তো শুনেছি স্বপ্নদীপদার কথা ! ওর যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে ইঞ্জিনিয়ার, ইউ এসে থাকে l বিয়ের পরেই ঋতুদি বিদেশে চলে যাবে l 
শর্মিলা বুঝতে পারল ঋতুদি ধ্রুবকে নিয়ে সেদিন যা বলেছিল, সেটা নিছক ইয়ার্কি নয় l ও ওরকমভাবেই ভাবে l স্বপ্নদীপদা ঋতুদির কাছে নিছকই সময়কাটানোর উপাদান l হয়ত স্বপ্নদীপদারও তাই ! ঋতুদির বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে গেলে ও হয়ত অন্য  কোনো ঋতুদিকে খুঁজে নেবে l ওদের সম্পর্কটা আসলে অগভীর জলের ভাসমান শ্যাওলার মত l 

মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে শম্পা আর শর্মিলা মেঘনাদের বাড়ি গেল l ওদের হৈহৈ করে জড়িয়ে ধরল মেঘনা l একটা নীল রঙের চুড়িদার পড়েছে মেঘনা l হাতভর্তি শাঁখা - পলা, চুড়ি l সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর l অনেকদিন পরে দেখা হল, একদম অন্যরকম লাগছিল মেঘনাকে l শম্পা তো বলেই ফেলল 
--তোকে একদম শ্রীদেবীর মত সুন্দর দেখতে লাগছে রে মেঘনা l 
মেঘনার বর আউটডোর শুটিং এ গেছে, তাই মেঘনা এখন কিছুদিন বাবা - মায়ের কাছে থাকবে l 
ওর বর মেঘনার কাজের জন্যও খুব চেষ্টা করছে l এর মধ্যে দু - তিনটে প্রোডাকশন হাউজে অডিশনও দিয়েছে ও l শর্মিলা বলল 
--সব ঠিক আছে l কিন্তু তুই অন্তত মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দেওয়ার চেষ্টা কর l অভিনয় করতে গেলেও তো মিনিমাম পড়াশোনার দরকার হয় l পড়াশোনাটা ছাড়িস না l 
--তুইও দেখছি আজকাল সৌমিলির মত কথা বলছিস ! আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না, করব না ব্যস ! থাম দেখি ! এসব ঘ্যানঘ্যানানি আমার মোট্টে ভালো লাগে না l 

(চলবে )





সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

সুকন্যা সাহা

               




চেরাপুঞ্জী থেকে ...

              


ক্যালেন্ডার   মানলে   সেদিন 

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস 

উমিয়াম লেক থেকে উঠে   আসা 

এক শান্ত নদী মেয়ের  সঙ্গে আলাপ হল

গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা ...

মেঘ পাহাড়ির সবুজে 

হারিয়ে যাওয়ার  আগেই

তার দুচোখে  দেখতে  পেলাম

একটুকরো চেরাপুঞ্জীর  মেঘ ...

শিলং পাহাড়ে সেদিন  অঝোরে বৃষ্টি ...




 যারা  বৃষ্টিতে ভিজছে

         

            সুকন্যা সাহা

খোয়াই ধরে  হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম  তোমার কথা

শ্রাবনের নিভু নিভু দিনের শেষে, বিষন্ন একাকী সন্ধ্যায়

ইউক্যালিপটাসের মন  কেমন  করা  গন্ধ নিতে নিতে 

অস্ফুটে বলছিলাম ,"বৃষ্টি  তুমি আসবে  তো?"

তখনও ভাবিনি কালো মেঘের ওড়না  উড়িয়ে তুমি

কৃষ্ণকলি, ধবধবে  সাদা ফোঁটায় চারিদিক

ঝাপসা করে আমায় আদর করে ভিজিয়ে দেবে---

ভালবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যারা 

বৃষ্টিতে ভিজেছিল, ভিজছিল এবং ভিজবে

তাদের কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল।


মেঘলা দিন 



#সুকন্যা সাহা 


খিচুড়িতে  মেশানো ছিল 

খানিক চাল আর ডাল 

যেমন পানসে আজকের 

মেঘ মাখা সকাল ...


আকাশের  গায়ে লেগেছিল

কিছু স্লেট রঙা ছোপ

একটানা ভিজছিল পুকুড়পাড়ে

আকন্দের ঝোপ ...


তানসেন হোক আজ 

মিঞা কি মল্লার ...

কৃষ্ণকলি দিগন্তে 

ছেয়ে যায় সুর বাহার ?


রাস্তায় কারা যেন 

ঢেলে গেছে  জল 

প্যাঁচপেঁচে কাদামাখা 

বর্ষা র আঁচল 


দুরন্ত বর্ষা 

ঝাপসা চারিধার 

আজ  শুধু  আলাপ হোক 

মেঘ ও মল্লার ...




.

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                 


অষ্টম পর্বের 

খোঁজ (৯)

ক্লাস টেনে মৈত্রেয়ী এসে ভর্তি হল শর্মিলাদের স্কুলে l ওরা আগে থাকত বহরমপুরে l ওর বাবা পুলিশের বড় অফিসার, চাকরিসূত্রে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন l সাধারণত ক্লাস টেনে নতুন স্টুডেন্ট নেওয়া হয় না l কিন্তু মৈত্রেয়ীর আগের স্কুলে দুর্দান্ত রেজাল্ট আর ওর বাবার চাকরির শর্ত অনুযায়ী ওর  ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হল না l মৈত্রেয়ী প্রথমদিন থেকেই শর্মিলার পাশে বসতে শুরু করল l ছোট্টখাট্টো, টিংটিঙে রোগা, ঈষৎ উঁচু দাঁত আর চশমার মোটা কাচের আড়ালে ঝকঝকে দুটো চোখ সবসময় কৌতুক মাখানো l সকলের সঙ্গেই খুব তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারত মৈত্রেয়ী l শুধু শর্মিলা নয়, ক্লাসের সবাই খুব তাড়াতাড়ি ওর বন্ধু হয়ে গেল l থানার প্রেমিসেসে ওদের বিশাল কোয়ার্টার l শর্মিলাদের বাড়ির কাছেই l মৈত্রেয়ীর দিদি অনেকটা বড়, বিয়ে হয়ে গেছে, বম্বেতে থাকে l আর দাদা মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে l ওর মা কাবেরীকাকিমা শর্মিলাকে খুব ভালোবেসে ফেললেন l প্রায়ই  দারুণ দারুণ রান্না করে ওকে বাড়িতে ডাকতেন l এতদিনের এত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও মৈত্রেয়ীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতাটা অনেক গাঢ়  হল শর্মিলার l মৈত্রেয়ীর একটা স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল l মৈত্রেয়ী ওকে যতটা বুঝত, ও নিজেও বোধহয় নিজেকে তেমনভাবে বুঝতে পারত না l মৈত্রেয়ীরও অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট ছিল অঙ্ক l শনি রবিবার মাঝে মাঝে রিজ্জুদার কাছে অঙ্ক করতে শর্মিলাদের বাড়িতে আসত মৈত্রেয়ী l যে কথাটা শর্মিলা নিজেও বুঝতে পারেনি বা নিজের কাছে স্বীকার করেনি, অল্প সময়েই মৈত্রেয়ী সেটা ঠিক বুঝে ফেলল l এতদিনে নিজের মনকে একটু একটু করে পড়তে পারল শর্মিলা l এরই মধ্যে সাগরিকা, সুদেষ্ণাদের প্রেম বন্ধুমহলে নিত্যদিনের চর্চিত বিষয় l ওদের বয়ফ্রেন্ডরা কিভাবে ওদের প্রপোজ করেছে, চিঠি লেখা, মান -অভিমান, মানভঞ্জনের সব গল্পই  বন্ধুদের গ্রূপে শেয়ার করে ওরা l রিজ্জুদা ওকে কোনোদিন প্রপোজ করেনি, লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোনো আলোচনাও তেমনভাবে হয়নি ওদের মধ্যে কোনোদিন l একে কি প্রেম বলা চলে ! মনের মধ্যে সংশয়ের দোলাচল l রিজ্জুদা শর্মিলার থেকে অনেকটাই বড়, ওর শিক্ষক l তাই ওকে শ্রদ্ধা করে শর্মিলা l কেন যে অনুভূতিটা অন্য একটা মাত্রায় চলে গেল ! কিন্তু  ছাত্রী হিসেবে ওর প্রতি স্নেহ ছাড়া আর কোনো অনুভূতি কি আছে রিজ্জুদার? অসম্ভব একটা আলোড়ন শুরু হল  শর্মিলার মনের ভিতর l বয়ঃসন্ধির আবেগ যখন তখন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল l
সেদিন মৈত্রেয়ী আসেনি, শর্মিলা একাই বইখাতা খুলে বসেছিল l প্রিটেস্টের রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি, অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ অঙ্কই মেলাতে পারেনি শর্মিলা l ঘরে ঢুকে খাতা দেখতে দেখতে গম্ভীরমুখে রিজ্জুদা বলল 
--আজকাল মোটেই পড়াশোনায় মন নেই তোমার l কি ভাবো বল তো সবসময়? 
--জানি না 
--জানো না? না,  বলবে না?  
--বলব না 
--বলতে হবে না l তোমার কি হয়েছে, আমি  জানি l 
--কি জানো?  বল, কি জানো?  
--এই বয়েসে যা হয় আর কি ! কাউকে ভালো লেগেছে তোমার ! কিন্তু তুমি কি জানো, যাকে ভালো লেগেছে  রেজাল্ট খারাপ হলে সে ফিরেও তাকাবে না তোমার দিকে ! 
ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল শর্মিলা l ওর ভেজা গালে হাত ছুঁইয়ে  রিজ্জুদা বলল 
--তোমার ওপর আমার অনেক আশা মুন্নি l আমার কথা একটু কম ভাবো আর পড়াশোনায় মন দাও l আমি তো আছিই... শুধু একটা কথা মাথায় রেখো l আমাদের মধ্যে কিন্তু অনেক বাধা রয়েছে l সেটা অতিক্রম করতে গেলে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তোমায় l

সেবার মাধ্যমিকে শর্মিলাদের স্কুলের বেশ ভালো  রেজাল্ট হল l তিপ্পান্নজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একুশজন ফার্স্ট ডিভিশন, আর বাকি সবাই সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে l কেউ ফেল করেনি l একুশজনের মধ্যে পাঁচজন স্টার l দেখা গেল সৌমিলি নয়, মৈত্রেয়ী স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়েছে l এমনকি কুড়িজনের মেধাতালিকায়ও  জায়গা করে নিয়েছে l কম্পালসারি আর অ্যাডিশনাল ম্যাথসসহ চারটে সাবজেক্টে লেটার পেয়েও মাত্র দু নম্বরের জন্য স্টার পেল না শর্মিলা l 

রেজাল্টের দিন সকালেই  ছোটকা কলেজস্ট্রিট থেকে গেজেট  কিনে নিয়ে এল l বাড়িতে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল l বাড়ির প্রথম মেয়ের জীবনের প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট বলে কথা ! রেজাল্ট দেখে খানিকটা হতাশ হলেও মা বললেন  মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট ভালো করার চেষ্টা করতে হবে l পিসি, কাম্মা সবাই অবশ্য খুশি l শম্পাও ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল l কেয়ামাসিও খুব খুশি l আগের বছর শর্বরীদি ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি l ওদের সাফল্য উদযাপন করে দুবাড়িতে মিলে একদিন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল l মা, আর কেয়ামাসি দুজনে মিলে অনেককিছু রান্না করলেন l সেদিন রাতে হঠাৎই মায়ের শরীরটা খুব খারাপ হল l মাথা ঘুরে রান্নাঘরে পড়ে গেলেন l ডাক্তার জেঠু বাড়িতে এসে প্রেশার মেপে বললেন ব্লাডপ্রেশার খুবই বেশী l আগুনতাতে আর রান্না করা চলবে না l ঈষৎ হাসলেন অপর্ণা l দুদিন ছুটি নিয়ে কাম্মা রান্নাবান্না করল l তারপর একজন রান্নার লোক রাখা হল l কিন্তু বাড়ির সবাই অপর্ণার রান্না খেয়ে অভ্যস্ত, লক্ষ্মীমাসির রান্না তাদের ভালো লাগবে কেন ! তাই প্রথমে অল্পস্বল্প হলেও পরে পুরোদমে রান্নাঘরে ঢুকতে শুরু করলেন অপর্ণা l ইতিমধ্যে অবশ্য শবনমের উদ্যোগে রান্নার গ্যাস এসেছে বাড়িতে l  

নিজের জন্য মনখারাপ হলেও মৈত্রেয়ীর জন্য খুব গর্ব হচ্ছিল শর্মিলার l স্কুল থেকেও  মৈত্রেয়ীকে সংবর্ধনা দেওয়া হল l ইলেভেনে ওরা প্রায় সবাই নিজেদের স্কুলেই ভর্তি হল l শম্পা, সাগরিকা, সুদেষ্ণারা আর্টস সেকশনে আর মৈত্রেয়ী, শর্মিলারা সায়েন্স সেকশনে l সৌমিলি চলে গেল অন্য স্কুলে l ওর বোন মেঘনা বলল 
--সৌমিলি বলেছে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এক স্কুলে পড়বে না l 
মেঘনার তখনও  ক্লাস নাইন l চুটিয়ে প্রেম করছে একজন উঠতি অভিনেতার সঙ্গে l ছেলেটি নাটক করে l দু - একটা সিনেমায় হিরোর বন্ধু বা ভাইয়ের পার্টে অভিনয় করেছে l মেঘনাও নাকি গ্রূপ থিয়েটারে যোগ দেবে l এর মাসদুয়েক পরেই হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মেঘনা l সৌমিলির সঙ্গে দেখা হয় না শর্মিলাদের l ওদের ক্লাসের মেয়েদের কাছেই খবর পেল  মেঘনা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে l

রিজ্জুদারও ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেল l জামশেদপুরে একটা স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি পেয়ে গেল রিজ্জুদা l কোম্পানির কোয়ার্টারও পেয়ে গেল l মাসে একবার দুদিনের জন্য বাড়ি এলে শর্মিলার সঙ্গে দেখা হত l সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখত রিজ্জুদা l সেই চিঠিতে সুন্দর শহরটার বর্ণনা থেকে দেশের রাজনীতি, প্রতিবেশীদের কথা, শর্মিলার লেখাপড়ার খোঁজখবর সবই থাকত l কিন্তু কোনোভাবেই কোনো প্রেমের কথা লেখা থাকত না l মৈত্রেয়ী এই নিয়ে খুব রাগাত শর্মিলাকে l অবশ্য পোস্টে চিঠি এলে বাড়ির লোকজনের হাতে হামেশাই সে চিঠি পড়ত l শিক্ষক আর ছাত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক বলেই বাড়ির কেউ সন্দেহ করত না কখনও l শুধু রিজ্জুদার চিঠি এলেই  মা মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাত শর্মিলার দিকে l 

স্যান্যাল স্যারের কোচিংয়েই ফিজিক্স আর ম্যাথস টিউশনে ভর্তি হল মৈত্রেয়ী আর শর্মিলা l শুভ্রকান্তি, ধ্রুব, অর্ণব সবাই একই ব্যাচে ভর্তি হয়েছে l ওদের স্কুলের আত্রেয়ীদির  কাছে বাড়িতে  কেমিস্ট্রির টিউশন l প্রথম ফিজিক্স ক্লাসের দিনই  মৈত্রেয়ীর খুব জ্বর, শর্মিলা একাই ফিরছিল টিউশন থেকে l সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে l অর্ণব সাইকেল নিয়ে ওর সঙ্গে  বাড়ি অবধি এল l 
--শর্মিলা তোকে না একটা কথা বলার ছিল l মানে.. ধ্রুব তোকে একটা কথা বলেছে l 
--কি কথা ?  ধ্রুব নিজে না বলে তোকে বলতে বলল কেন?  
খুব অবাক হল শর্মিলা l 
--তোকে এই চিঠিটা দিয়েছে ধ্রুব l 
ঘরে এসে চিঠি খুলে শর্মিলার চোখ ছানাবড়া ! এ তো প্রেমপত্র ! প্রতি লাইনে আবেগের বৃষ্টি ! সেই জন্যই কি ধ্রুব আজকাল বিশেষ কথা বলে না ওর সঙ্গে ! চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত !
মৈত্রেয়ীকে বলার পর খুব হাসল ও l 
--এতদিনে তুই ঠিকঠাক প্রেমপত্র পেলি l রিজ্জুদাকে বরং পাঠিয়ে দে l কিভাবে প্রেমিকাকে চিঠি লিখতে হয় শিখে নিক l 
মজা করলেও এই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল দুজনেই l ধ্রুব ভালো ছেলে, ওদের ভালো বন্ধু l শর্মিলার রিজেকশনে যদি ওর মানসিক কোনো ক্ষতি হয়ে যায় ! শর্মিলা জানে এই পর্যায়ে লেখাপড়ার কতটা ক্ষতি হয় l তবু ওকে তো বলতেই হবে সত্যিটা l পরেরদিন ক্লাসের পর ধ্রুবকে ডেকে মৈত্রেয়ী বলল 
--ধ্রুব, শর্মিলা একজনের কাছে কমিটেড l তুই প্লিজ  একটু বোঝ ব্যাপারটা l 
ধ্রুব একটাও কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল l পরেরদিন থেকে আর ক্লাসে এল না l অর্ণব বলত ধ্রুব  একদম পড়াশোনা করছে না l কতগুলো বাজে ছেলের সঙ্গে মিশছে l সিগারেট, গাঁজা খাচ্ছে l খুব খারাপ লাগত শর্মিলার l বিশেষত অর্ণবরা যখন বলত ওর জন্যই এত ভালো একটা ছেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ! কিন্তু ওই বা কি করবে ! সেই মাসে রিজ্জুদা আসার পর সব কথা বলার পর ওকে অকারণ অপরাধবোধে বিক্ষত হতে দেখে রিজ্জুদা মৈত্রেয়ীকে বলল 
--তুমি ধ্রুবদের বাড়িটা চেনো? আমি আজ ওদের বাড়িতে যাবো l ওর গার্ডিয়ানদের সবটা খুলে বলব l ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলে হয়ত ওর পক্ষে ভালো হবে l এখানে থাকলে ওর ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যাবে l আর শর্মিলারও লেখাপড়া হবে না l অন্য পরিবেশে ও একটা ফ্রেশ স্টার্ট করতে পারবে l

কিছুদিন পরে অর্ণব বলল ধ্রুব ওর মাসির সঙ্গে যাদবপুরে চলে গেছে l এবার থেকে ওখানেই থাকবে l ওখানকার একটা স্কুলেই ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে l 

(চলবে )

অমিতাভ সরকার

                                            





বেজন্মা ( পঞ্চম  পর্বের পর )


 রান্না ঘরে ঢুকে কৃষাণ দেখে, বড় কাঠের পিড়ি পাতা, সামনে চকচকে কাঁসার গ্লাসে জল। ভদ্রমহিলার কথায় বসে পড়ে পিঁড়িতে। ঝকঝকে কাঁসার থালায় সাজানো ভাত, শাক, ডাল, দু’রকম ভাজা, কুঁচো মাছের টক আর মুরগীর মাংস। 

“বিশেষ কিছু করতে পারি নি, বাড়িতে যা ছিল, তাই দিলাম”। একসঙ্গে খাবারের এত পদ কোনোদিন দেখেনি কৃষাণ।  

“পিসিমা, এত খাবার…!! এত খাবার খেতে পারে কেউ…! আবার মাংস করেছেন কেন?    

“বাড়িতে যা ছিল, তাই দিয়েছি তোমাকে”। ভদ্রমহিলার কথায় সায় দেয় রাবেয়া। 

“ঠিক বলেছো মা, খাওয়া দাওয়া না করলে আমাদের রক্ষা করবে কে?” রাবেয়ার কথায় তাকায় কৃষাণ। পাশে একটা ছোট পিঁড়িতে বসে বাতাস করে রাবেয়া। সামনে বসে কৃষাণের খাওয়ার তদারকি করেন ভদ্রমহিলা। খাওয়ার পর শোওয়ার ঘরে ফিরে আসে কৃষাণ। রাবেয়া বিছানার চাদর, ঠিক দেয়।  

“এবারে একটু জিরিয়ে নিন। আমরা খেয়ে আসছি” 

একটু পরে খাওয়া সেরে ফিরে আসে রাবেয়া। বিছানার সামনে চেয়ার নিয়ে তাদের সামরিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তাদের প্রশিক্ষণ, থাকার ব্যবস্থা, ডিউটি… কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ফিরে আসে। তাই দেখে কৃষাণ উঠে পড়ে।   

“এবার আমি যাই পিসিমা। বেলা পড়ে এলো”।   

“এখনি যাবে? আজ থেকে গেলে ভালো হতো। আমাদের বাড়িতে তো আত্মীয়স্বজন কেউ আসে না…”। 

“হ্যাঁ পিসিমা, ফিরতে হবে, একটু অসুবিধা আছে। আগামীকাল ফেরার পথে দেখা করে যাব”। বারান্দায় রাখা মোড়ায় বসে জুতো পরে নেয় কৃষাণ। 

“রাবেয়া, দাদাকে এগিয়ে দিয়ে আয়”। রাবেয়া বারান্দা থেকে সাইকেল নামায়। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়াই প্রথম কথা বলে…।  

“আচ্ছা কৃষাণ’দা, লাভপুরে এসে প্রথমে আমাদের বাড়িতেই এসেছেন, কোথাও যান নি? কত লোক বেড়াতে আসে এখানে!”  

“আজই এসেছি সকালে, লজ থেকে সোজা তোমাদের বাড়ি। তোমাদের জন্যই তো এখানে আসা…। 

“তা বললে হয়, কতকিছু দেখার আছে এখানে। সাহিত্যিক তারাশঙ্করের বাড়ি, কোপাই নদীর হাঁসুলিবাঁক, ‘ফুল্লরা’ শক্তিপীঠ…। জানেন, লাভপুরে তেলেভাজা খুব বিখ্যাত! বাকুলমোড় আসতেই কৃষাণকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে উধাও হয়ে যায় রাবেয়া। হঠাৎ এভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়াতে খুব অবাক হয়ে যায় কৃষাণ কিছুটা বিরক্তও …। ভাবতে ভাবতেই হাতে দুটি খবরের কাগজের ঠোঙা নিয়ে ফিরে আসে রাবেয়া।      

“এই নিন কৃষাণ’দা আলুর চপ আর পেঁয়াজি। খেয়ে দেখুন, এমন তেলেভাজা খান নি কোনোদিন”। হাসতে হাসতে আলতো করে কামড় দেয় পেঁয়াজিতে। কৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে…।  

“ইস…, অনেকগুলি টাকা খরচ হয়ে গেল তোমার। আগে জানলে, আমি খাওয়াতাম”।

“পরেরবার খাওয়াবেন। আজ প্রথম দিন, আমি খাওয়ালাম। নিজের রোজগার করা পয়সা মশাই”। রাবেয়ার উচ্ছলতা দেখে ভালো লাগে কৃষাণের। পরক্ষণেই চুপ করে যায় রাবেয়া।  

“জানেন, আমাদের বাড়িতে কোনোদিন কেউ আসে নি। সবাই বাংলাদেশে, আমরা শুধু পড়ে আছি এখানে। আব্বুও আমাদের ছেড়ে চলে গেল, আম্মাও চলে যাবে একদিন”। রাবেয়ার কথা শুনে কৃষাণেরও মন ভারি হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে সামলে নেয় সামলে নেয় নিজেকে।  

“আপনি এসেছেন, তাই একটু…। এই শুনুন, সামনেই ফুল্লরা মায়ের মন্দির…, যাবেন?”  

 “তোমার দেরী হয়ে যাবে না? তাছাড়া পিসিমাও চিন্তা করবেন”।   

“ও কিচ্ছু হবে না, চলুন তো…।”। অসংকোচে কৃষাণের হাত ধরে রাবেয়া…।    

“কৃষাণদা আপনাকে সবাই দেখছে…। ভাবছে এই ছুটকীটার সঙ্গে এই হ্যান্ডস্যামটিকে…” হাঁটতে হাঁটতে চাপাস্বরে বলে রাবেয়া। কৃষাণ হো হো করে হেসে ওঠায় আশেপাশের লোকজন তাকাতে চুপ করে যায়।   

“কী যে বলো… ভাবছে, এই কেলটেটা এলো কোথা থেকে”!    

“দূর, আপনার মতো স্মার্ট, লম্বা, হ্যান্ডস্যাম কেউ আছে নাকি এখানে?” কথা বলতে বলতে ফুল্লরা মন্দিরের দিকে এগোয় তারা। পথে পরিচিত অনেকেই জিজ্ঞাসা করে কৃষাণকে দেখে। রাবেয়া হেসে দাদা বলে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের সঙ্গে।     


লোকালয় থেকে দূরে চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা ছায়াময় পরিবেশে কাঁকুড়ে মাটির টিলার ওপর ফুল্লরা মন্দির। একপাশে মহাশ্মশান, নীচে উত্তরমুখী কোপাই নদী। 

“কিরে রাবেয়া, এদিকে…”। প্রবেশ পথের তোরণ পেরোতেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাদের। মন্দিরের ম্যানেজার, রাবেয়াদের গ্রামে থাকেন। রাবেয়া তাকে দেখে এগিয়ে যায়। 

“কাকু, ইনি আমার দাদার বন্ধু। মিলিটারীতে আছেন। আমি নিয়ে এলাম দর্শন করাতে। কৃষাণ হাত জোড় করে নিজের পরিচয় দেয়।    

“আমার নাম কৃষাণ, বিএসএফ-এ আছি। আজই এসেছি রাবেয়াদের খোঁজ নিতে। রাবেয়ার চাচাতো দাদা আমার সঙ্গে কাজ করে”।  

“খুব ভালো করেছেন। দর্শন করে যান, খুব জাগ্রত দেবী। মনবাঞ্ছা যদি কিছু থাকে মানত করে যান। মেলা ছাড়া রাবেয়া তো এদিকে খুব একটা আসে না, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম…। মাঘী পূর্ণিমায় বড় মেলা হয় এখানে…। চলুন আপনাকে ঘুরে দেখাই”। ভদ্রলোক তাদের নিয়ে মন্দিরের সামনের চত্তরে নিয়ে আসেন।         

“পুরাণের মত অনুযায়ী এই স্থানে সতীর নীচের ঠোঁট পড়েছিল। দেবী এখানে ‘ফুল্লরা’ নামে পূজিতা হন”। কৃষাণ মন্দিরের সামনে দরজায় এসে দাঁড়ায়। মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। একটি কচ্ছপের আকৃতির শীলাখন্ড, শীলাখণ্ডের ওপরে তেল-সিঁদুর, জবাফুল, বেলপাতা। সেই শিলাখণ্ডের চারপাশে কয়েকজন মহিলা বসে পুজোর আয়োজন করছেন। 

ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে তাদের একটি বড় দিঘির কাছে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক জানালেন, দিঘির নাম দেবীদহ। কথিত আছে রামের অকাল বোধনের সময় হনুমান এই দিঘি থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। বীরভূমের প্রচন্ড দাবদহে যখন চারিদিকের জলাশয় যখন শুকিয়ে যায়, এই দিঘির জল একই রকম থাকে। তখন আশপাশের বহু মানুষের ভরসা এই দিঘী”। বিদায় নেবার সময় ভদ্রলোক পরেরবারে পরিবারের সকলকে নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। তাদের অতিথি নিবাসের কথা জানিয়ে মোবাইল নম্বর লিখে নিতে বলেন কৃষাণকে।       

( ক্রমশঃ)

পাপিয়া গাঙ্গুলি

        


                                   



 



পা


শহরে পরে থাকা বৃদ্ধ জলাশয়,
পাশের বেঞ্চে ঝোলানো দুটো পা,
একতারার তারের মতো একা।
পেছনে ফুটবল মাঠে হৈ হৈ,
গোল্লাছুট কয়েক জোড়া পায়ের হাসি ।
বাতাসে ঘামের গন্ধ,
দূরন্ত পায়ে জিতে যাওয়ার খিদে।
একলা নির্জীব পা দুটো দ্যাখে,
সূর্য জাগার আগে অবধি সবুজ মাঠ ছিল
শিশির ফোঁটাদের কবিতার পাতা
পেশীজাগা পা গুলোর কাদায়
কবিতাগুলো হয়ে গেল তার না মেলা অঙ্ক।

(২ নং)

জানলার চা
পাপিয়া গাঙ্গুলি
রোদের তুলিতে জানলাটা এসে বসেছে খাটে।
টানটান চাদর, পাশে বই, ঘড়িতে ছ'টা বাজবে
চায়ের জল... আমি রান্নাঘরে গেলাম
যেমন যেতাম রোজ ঠিক এই সময়ে।
এক কাপ চা'করে একটা ছোটো চুমুক
পরখ করতাম চিনি ঠিক হলো কিনা!
বুনি পিসী ধমকে উঠলো আজ
"পোড়ার মুখী মেয়ে, রঙ্গ করছিস নাকি!
ভাতারখাকি অপয়া মেয়েছেলে।"
তুমি তো আমরা জানলা ছিলে
খাটের ওপর তো জানলা বসেছে এসে
চা দেবো না কেন, বলো? 


সম্বৃতা দাস রায়

                           



চেনা অচেনা বৃষ্টি

   

(   1)

শেষ বিকেলের আলোটুকু
ঢেলে ফিরে গেল সূর্য
আগামী ভোরে দেখা হবে না জেনেও
হাসি দোলে সূর্যমুখীর পাপড়িতে।
সাঁঝ নরম আঙুলে ছুঁয়ে
গল্প করে খুব।
মেঘ করেছে আজ
বৃষ্টিও  আসবে বলেছিল
মৃত্যু ,একটু অপেক্ষা কর।
ঝরে পড়ার আগে
সূর্যমুখী বৃষ্টি ফোঁটার
আদর চায়।

   (  2)

মোহরকুঞ্জে বিকেল চারটে
বলেছিলে   বেণীমাধব
এখন  পাঁচটা বেজে পাঁচ।
ফিরব এবার।
হঠাৎ  মেঘ ডাকল,
হাওয়ায় বর্ফিলি শিহরণ!
উপুড় ঝুপুড় বৃষ্টি নেমে
ভিজল বেনী ভিজল ঠোঁট।
ভিজিয়ে তুমুল  নিভিয়ে দিল
বুকের ক্ষত গভীর যত।
চন্দনবৃষ্টি সঙ্গে  নিয়ে
ফিরছি এবার।
আগুন জ্বললে
বৃষ্টিকেই ডাকব না হয়।
আর এস না
বেনীমাধব।

              
                          (3)
      
   ভাঙা আয়না গোপন চিঠির বাক্স
  শ্যাওলা ঢাকা  আলসেরা
   জেগে ওঠে  পড়ন্ত বিকেলে।
   উলকাঁটার গল্পে আসর জমায়
   শুক্লা দ্বাদশীর  চাঁদ।
   তুহিনা জবাকুসুমের কুহকী ডাকে
    ভেসে যাওয়া   কৃষ্ণমেঘ
   থমকে দাঁড়ায় ।
   কোথায় যেন যাবার ছিল
   ভুল হয়ে যায়।
  কিছু দুঃখ কিছু স্মৃতি 
  টুপটুপ  ঝরে  পড়ে বৃষ্টি হয়ে।

   

সুচেতা বিশ্বাস

                      




জন্মদিন 


বৃষ্টি টা ধরে এসেছে, সকাল থেকে ই অসহ্য গরম ,তাতেও সব কাজ মুখ বুজে করে গেছে পুনম , মায়ের শরীরটা ভালো নেই তার উপর গরমে নাজেহাল.. তাও মা সোফায় বসে বসে সবজি কেটে , রুটির আটা  টা মেখে দিয়েছিলো , ছুটির দিন ভাই ভাইবৌ দেরিতে ই উঠেছে , সব রবিবার যেমন ওঠে ,ওদের আজ বন্ধুদের সাথে কোনো রিসোর্ট এ পিকনিক ,সেজে গুজে সকাল সকাল রওনা দিলো , লাঞ্চের পর  .স্কুলের বাচ্ছাদের . টেস্ট পরীক্ষার খাতা  গুলো সারা দুপুর বসে চেক করলো  .ছেলে কে নিয়ে পড়াতে বসলো  ,তার পরে ই হঠাৎ মনে পড়লো ,আজ তো রবিবার  ..নীল এখুনি বায়না করবে  মল যাবার জন্য ...সারা সপ্তাহের পর রবিবার মানেই . .মল এ গিয়ে    পেট পুরে  বার্গার খাওয়া,  ম্যাকডোনাল্ড থেকে .,এটাই নীলের একটু খানি জীবনে খুশিই মুহূর্ত ...সারা সপ্তাহ সে অপেক্ষা করে যায় দিনটার জন্য ..কিন্তু আকাশ এর অবস্থা  দেখে  পুনম বুঝেছে  আজ নীলের মন খারাপ হবে.. ..কিন্তু নীল গেলো কোথায় ? 
এখন নীল কে খুঁজতে যাওয়া মানে সারা বাড়ি খুঁজে দেখা ... ..গলা চড়িয়ে ডাক দিলো পুনম " নীল ...কোথায় গেলি " 
"আসছি মাম্মা "
একছুটে দৌড়ে এসেছে নীল ..জোরে জোরে  হাঁপাচ্ছে
হাতে একটা চার্ট পেপার না ? 
মিট মিট হাসছে ছেলেটা ..
মায়ের কাছে এসে  ই চার্ট পেপার এ এগিয়ে দেয় .
চার্ট পেপার  দুভাজ করে বানানো একটা বার্থডে কার্ড. 
বাড়ির কারুর মনে নাই আজ পুনমের জন্মদিন ..মা বাবার তো বয়স হয়েছে ..ওদের কথা পুনম ধরে না ..কত কথাই  তো ওরা ভুলে যায় ..ভাই ও ভুলে গেলো ..কাল রাতে ই পুনম ভেবেছিলো বিকেল হলে ই অন  লাইনে এ সবার মনের মতন কিছু খাবার দাবার আনিয়ে নেবে ..তখন ঠিক কারুর না কারুর মনে পরে যাবে ..
আজ 7 বছর হয়ে গেছে সন্দীপ সেই যে পুনম কে বাপের বাড়ি দিয়ে গেলো ...তখন পুনম অন্তসত্তা ..আর আসে নি সন্দীপ ..এই সাত বছরে একবার নিজের ছেলে কেও দেখতে আসে নি ..দুবাই এর  ভালো ব্যাবসায়ী পরিবার দেখে পুনমের বাবা খুব ঘটা  করে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম ...মন খুলে দুহাত উজাড় করে খরচ করে ছিলেন ..সন্দীপের ব্যাবসার জন্য কিছু টাকার দরকার ছিল ... তা ও তিনি দিয়েছিলেন বিনা দ্বিধায় ..না গয়না না টাকাপয়সা ..কোনো টাই  পুনম নিয়ে আস্তে পারেনি ..কোনো রকম যোগাযোগের রাস্তাই  ছিল না ..বড়ো আদরের মেয়ে তাদের ...কাছে টেনে নিলেন মা বাবা ভাই ....ভালো ছবি আঁকার  হাত 
ছিল পুনমের ...কনভেন্ট এ পড়াশুনা করেছে ....শহরের  নাম  করা একটা ইংলিশ মিডিয়াম এ বাবার চেষ্টাই পুনমের চাকরি হয়ে যায় ..ছেলে নীল কে সবার মাঝে ভালো ভাবে মানুষ করছে ...তাও ছেলেটার দিকে তাকালে ই ভিতর টা ডুকরে ওঠে ...বাবার জায়গাটা তো শূন্য  ..নীল কে সে ছোট বেলার থেকে যা সত্যি সেটা  ই বলেছে ..মাঝে মাঝে বড়ো মন মরা হয়ে থাকে ছেলেটা ..আর এটাই পুনম কে  কুড়ে কুরে শেষ করে দিচ্ছে ..
বার্থডে কার্ড টার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না পুনম ..কার্ড এ মা আর ছেলে ...নিচে লেখা আছে " মা আর নীল " কত বেলুন ,কেক ,চকলেট ....ভীষণ কান্না পাচ্ছে পুনমের ...নিজেকে সামলে নেয় , "তোর মনে ছিল " 
"না মাম্মা ..মামু  আমাকে কাল রাতে ই মনে করিয়ে দিয়েছে ..মামু তোমার জন্য রাতে সারপ্রাইজ পার্টি রেখেছে ",...কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে যাচ্ছে একনাগাড়ে কথা গুলো নীল ..."আমি তো তোমাকে সব বলে দিলাম যা হ ...."
এবার ও খুব সামলে নেয় নিজেকে পুনাম ...ওতো অন্য কিছু ভেবেছিলো ..."আমি কাউ কে কিচ্ছু বলবো না .ঠিক আছে ...যা হ সারপ্রাইজ পার্টির জন্য রেডি হয়ে নে "..
নীল খুশিতে এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ি করে বেড়াচ্ছে ..পুনম নীলের আঁকা কার্ড টার  দিকে তাকিয়ে থাকে ..বাইরে একটানা বৃষ্টি আজ সারাদিন 

ব্রততী


                            


বৃষ্টি ছোঁয়ার গল্প 



বৃষ্টি নামল অতঃপর- 
একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষা ভিজে গেল অকৃপণ সিঞ্চনে!
বজ্রবিদ্যুৎসহ ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা জানিয়েছিল আবহাওয়া দপ্তর ;
তবু বৃষ্টি আসার আগেও দমবন্ধ  হতাশায় ছিল না মেঘের প্রলেপ-
ঘন ঘন নিম্নচাপ পেরিয়ে, 
অবশেষে থৈ থৈ সুখ, নিশ্চিহ্ন দহনদাগ!
মেঘ যখন আবার ফিরতি পথে, বহুদূরে 
সবুজে সবুজে তখনও জলের কাঁপন 
অপেক্ষার গা বেয়ে তখনও ঝরছে বিন্দু বিন্দু অভিমান...

বৃষ্টিবাদল নিম্নচাপ 
ব্রততী

দমকা হাওয়ায় বৃষ্টিপাতে ধুইয়ে দিল দহনতাপ !
বর্ষা ফেরার! বৃষ্টিবাদল, কারণ হয়তো নিম্নচাপ-
বৃষ্টি ধোয়া একলা উঠোন একাই এখন কফির কাপ,
মেঘমাদলের ছন্দ ভুলে বসত করে মনখারাপ!

বৃষ্টি আসুক! বর্ষা না হোক, বৃষ্টি আনুক নিম্নচাপ ,
ভেজা মাটির নরম গালে লজ্জা রঙের আদরছাপ-
কোমল জলে ভাসছে তখন গতজন্মের মনস্তাপ,
অঝোর ধারায় ভিজতে থাকুক উঠোনজোড়া মনখারাপ!



বুকের ভেতর বৃষ্টি তুমুল তুমি নিরুদ্দেশ
ব্রততী 


কফি কাপ আর একলা মেয়ে-
ঘড়ির কাঁটায় ক্রমশ অসংযমী হচ্ছে অপেক্ষা ,
প্রতিটি অপরিচিত পদশব্দ তোমার অনুপস্থিতিকে প্রকট করেছে নির্লজ্জতায়-
পথ অপেক্ষার চোখে চোখ রেখে সহানুভূতি জানিয়ে থমকে আছে ,
বাতাস স্বাভাবিক তবু দমবন্ধ করা গুমোট -
মেঘ করেছে খুব, এরপর বৃষ্টি ...
সময় বয়ে গেছে নিজের মতোই..

বুকের ভেতর বৃষ্টি তুমুল তুমি নিরুদ্দেশ!




দেবলীনা চক্রবর্তী

                                         




বৃষ্টিকথা 




   ক)
ইদানিং সে প্রায় রোজই আসে ঠিক দুপুর নাগাদ, সে এলেই চোখ চলে যায় তার দিকে ! আমি যেই দ্যেখি ওমনি ছুটে যাই আর শরীরী দূরত্ব বজায় রেখেই কিছুক্ষণ আমরা পাশাপাশি হাঁটি , কোনদিন একটু বসি পরস্পর ব্যবধান রেখে !
না সে তেমন সুদর্শনকান্তি না হলেও তার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বেশ একটা তৃপ্তিদায়ক স্বস্তি মেলে !
তার আসাটা মন্থর , কোন পূর্বাভাস না থাকলেও বেশ বুঝতে পারি তার এসে পরা, সে এলেই কেমন একটা হালকা জলজ গন্ধ ছড়িয়ে যায় চারিদিকে তার সাথে মিশে যায় মাটির সোঁদা গন্ধ ! একটা আমোদ মিশে থাকে গাছের পাতায় , ঘাসের ডগায় ! যেন বন্দি জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে আতর্কিতে ছোঁয়াছোুঁয়ি খেলা, ওই সময়টুকু জুড়ে। 

 তারপর সে বিদায় নেয় নিয়মমাফিক । 
 কিন্তু কি আশ্চর্য সে কখনও কথা দ্যেয় না ফিরে আসার , দ্যেখা হওয়ার , আনন্দে ভিজিয়ে দেওয়ার ! 
 
 তবু তার আসার খবর আমি পেয়েই যাই — পারিপার্শ্বিক হাওয়ায় হাওয়ায়! 
 
 
  খ)
দু'এক পশলা রিনরিনে বৃষ্টির পর আকাশের অভিমানী মুখ ভার , আরো কিছুটা আবেগ ঝেড়ে ফেলে হালকা হওয়ার গোপন ইচ্ছে ছিলো বোধহয়  কিন্তু তবুও এমনি মেঘ ছায়া মাখা নিবিড় কোমল  প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে মনে হয় হারাই নিজেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক মনকে ছিঁড়ে খুঁড়ে উড়িয়ে দিই পালক পালক মেঘের সাথে। কি এক আশ্চর্য মৌজে শিহরিত মন দু'হাত মেলে লুটে নিতে চাই আকাশ।

 আকাশের এই বিষাদ জন্ম ভুলে গিয়ে তৃকোণ পাতা থেকে ঝরে-পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলের বিরহটুকু মেখে নিতে আমার সঙ্কোচ হয় নি কখনও, আমি যেন জলে ভেজা থোকা থোকা জোনাকির আগুন আলো ! যে নাবিক পথ হারালো তার দিকনির্দেশে পৌঁছে যাই সেই দূর বাতিঘরে যেখানে আলো ছায়া মাখা নীল জলে স্বপ্ন ভাসে। 
আসলে প্রকৃতির এই ফুসমন্তরের ডাকে সাড়া দিয়ে কবেই হয়েছি আমি ভবঘুরে। স্তরীভূত জীবনের বন্দরে ঋতু আসে ঋতু যায় ! ঢেউ খেলা করে , প্রাচীন  প্রস্তরে চির ধরে তবু ভাঙে না ,আর গোপন ব্যাধির মতো গাঢ় হয় অন্ধকার - সান্ধ্যভাষা নিয়ে!

গ)
ঠিক কবে প্রথম বৃষ্টির গন্ধ পেয়েছিলাম, আকণ্ঠ পান করেছিলাম ঝোড়ো বাতাসের ঘ্রাণ ঠিক মনে নেই তবে মনে পরে সেই ছলাৎছল উচ্ছ্বাসে বুকে বেজে ওঠা চৌরাশিয়ার মোহন বাঁশি মলহারের ঘনগম্ভীর সুরে — “কদম - বাহার ”
বর্ণিল রোদে আঁকা কৌণিক অস্তরাগ ।  

কুলকুল বয়ে যাওয়া শান্ত নদীটির মতো পাশ ঘেঁষে চলে এসেছি আজ বহুদূর 
ইচ্ছে বকুল এখন ম্লান  - স্মৃতি ধূসর হয়ে,শেষে পরে থাকে শুধু বিবর্ণ অস্থি কঙ্কাল। 

কিন্তু তবু মনে হয় বৃষ্টির গন্ধ এলে এখনও মননদী ফুলে ওঠে , দুলে ওঠে তার গোপন ঢেউ  - 
আছড়ে পরে পাথর ঘরে!
কত নামহীন ফুল ফোটার সম্ভাবনায় নদীমন হয় আকুল —
 
তবুও মনে পরে না সেই প্রথম দিনের বৃষ্টি সম্মোহন !