রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০

তন্ময় রায়

                                         



এই সপ্তাহের কবি তন্ময় রায়।জন্ম ৯/১/ ৮৮ ।তার প্রকাশিত বইগুলি -  কমবেশি ক্রিয়া (২০১১), দৃশ্যাক্ষর (২০২০, সিদ্ধার্থ দাসের সাথে যুগলবন্দী)। 

ঘটনাহদ্দ  


তা দেওয়ার কথায়

মাথা খারাপ দিচ্ছে, খোলস ছেড়ে

চিরতায় গুঁজে থাকা বদনামখণ্ড।


ভেতর গুমোটে

লম্ফ জ্বেলে বসে আছে

তোমার ধিৎকার ধরানো কালি, কার্বাইড 

জন্মদোলে মেজাজ

অন্ত্র পরিষ্কার অর্থে পাকে পড়ে


বিষম রান্নাঘরে আলতো ধোঁকা এ মধ্যমা, ফুলে ঢোল...


সব খুলে বলতে গিয়ে

আমার লোম লবণ তছনছ।


পাকতে এসে ফুরিয়ে যাওয়া ঘটনা,

সীমায় জড়ানো সাপে লঙ্কাবাষ্প; 

গর্ত ছেনে ল্যাজে খেলাচ্ছে জাতভাইকে।

পেট ভর্তি অস্ত্র নিয়ে

জাতভাই আমার কথায় থাকেন

টুঁটি রঙ করতে আসেন অসময়ের শুরুতে…


মোড়ে নাকি মোচড়ে, কোথাও একটা লুকিয়ে আছে মণি,

দূরত্বে বেজায় সেজে ওঠে সে।

আতরগাঢ়।


প্রয়োজনের কাদা তখনো ডোবায় ফলছে।

চাপা দেওয়ার তাল ঠোকেন জাতভাই

বিরতির ধোঁয়া ও ঢেঁকুর সমেত।

কিছু একটা খোয়া যাচ্ছে এবং টেরও পাচ্ছে কেউ


বিষম রান্নাঘরে এবার ডালপালানো পত্র, হেজে একশা...


খোঁজ জুড়ে সেই জ্ঞান যেন ফোস্কা

ঝাঁঝ খেয়ে জল খসাবে

আমি এগিয়ে দেবো গলা, গ্রন্থিকথায় লেগে থাকা হরমোন

একটু ঘুরিয়ে নেবো

দূরবর্তী সংবর্ত নালিকা

তলপেট ব্যথা করা পাথর পাথর ভাব

অন্তঃগাত্রে কানে-পৈতে জাতভাই সাক্ষাৎ


পুরোটাই জলের ওপর ছিল। মনে না লাগার কারণ হিসেবে মোমের কথা তুলতে গিয়েও, পাঁকের কথা চলে আসে। পাঁক দিয়ে মণি অন্ধকার করা হয়ে ওঠে না। কারণ হিসেবে আমার কথা উঠলেও, ব্যবহারে পাঁক তখন ত্বক দখল নিয়েছে। আর জাতভাইয়ের ত্বকে মহাকাব্য লেপছি আমি...

 

খিদে থেকে বিষটুকু

ঝাড়ার কথা

মাথায় গোবর বাড়িয়ে দেয়; 

জাতভাইকে বড়লোকে পেয়েছে,

সে তার গন্তব্য খুঁজতে আসে আমার মাথায়।




দশা 


১.

নামে আতঙ্কের পিন

রাস্তা আগলে আছে।

এর বাইরে সময় দেখতে এসেছে যারা

তাদের মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা

আমার পকেটেই।

পকেটেই থাকে আমার বিজ্ঞ…


২.

গদ্যে কোন কলারের উল্লেখ রাখছি না

ইনিয়ে বিনিয়ে,

হজমের ব্যাপার মুখে ফুটে ওঠে।

কত ধাক্কায় কত কি সুন্দর...

হাতে শ্বাসনালীর ছাপ

কিঞ্চিৎ খিল ধরা পেট

বসত পেরিয়ে উঁকি দিলে 

কলারে খুন জখম নজরে আসে


৩.

জল ভুগিয়ে যাচ্ছে

কোমর এখানে শুকোতে চায় না।

এ ঘরের অন্ধকার

জট চাগাড় দেওয়া বর্ষাকাল;

বর্ষাকাল জুড়ে

গায়ে শাক হয়েছে

দেখা মিলেছে পাকিয়ে যাওয়া জ্বরের,

ঘাম ঘাম পথ

আলোর নিচে স্যাঁতস্যাঁতে পাকস্থলী।


৪.

সরু ক'রে ঢালার কথা ওঠে।

এর আগে

কষ দিয়ে চুইয়ে গেছে ঘিলু,

গলনাঙ্ক পেরনো হয়েছে সাবধানে।

রুমালে কথার মতো মিল 

আর চুমুকে যে শ্বাস সভ্য হচ্ছে 

তা একটু পরে সরু হবে…


৫.

গেলে দেখে নিচ্ছি

চোখের কাচময় মেজাজ।

উতল আসে সম্পত্তিতে,

ফেনাভাসনে গাঢ় করি।

মোজায় ভরে পাচার করি তোমায়,

এই তো হাল

বিষয় থেকে ম্যাদা মারতে যাই...


রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২০

সৌরভ বর্ধন

                               

সৃজন এই সপ্তাহের  কবি সৌরভ বর্ধন। কবি ও গদ্যকার। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শান্তিপুরে জন্ম। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নিজস্ব প্রতিবেদন'। এছাড়াও 'জলবিভাজিকা' (২০১৮) এবং 'স্তন ও হৃৎপিণ্ড' (২০১৯)। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ 'প্রসূতিকালীন পাঠ' ২০২০ সালের বইমেলায় 'কবিতা পাক্ষিক' থেকে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্টেড পত্রিকায় অনিয়মিত লেখেন। লেখায় চৈতন্যপ্রাপ্তিই হলো তার উদ্দেশ্য ও বিধেয়।

সৌরভ বর্ধন -এর কবিতা

মোক্ষ পর্ব

১.

শূন্য দশকের শেষ পরচুলা রঙা পাগড়ি বেঁধে
বৃত্তের পরিধি ধূমকেতু দিয়ে মাপি আমি, 
কাজ করে কোরিওলিস বল...
মেরুপ্রভায় বদল করি মনুমেন্ট, ম্যানসন
ছায়ামূর্তির মতো লোমকূপ ঘিরে তখন
ঘোটকী-পুরাণ-কাহীনি লেখে ফুল
পীতবর্ণের বিমূঢ়তা ভরা বালার্ক কবিতাগুচ্ছ!

রগভাঙা নাভিতে চেপে 
উঠে এসো ছাদের কার্নিশ
ফিরে এসো আঁকাবাঁকা ঋতুচাষ 
 -----  এ রক্তের গ্লোবিউলিন
হিম হয়ে আছে বিবাহিত গাছের পুরনো হাড়ে


২.

প্রথম যেদিন জরায়ুজ লিংক ফেলিওর গ্যাছে 
অশ্বক্ষমতার অতল গ্যাস উল্কাপাতে...
বালিবালি-ভাব মেদিনী থেকে সোজা ফেসবুক
জোড়া শৈশব  পোস্টিয়ে দাও সূর্যের ছাইয়ে

তিন রকমের বৃষ্টিপাত : এটুকুই সম্বল (?)

নিশাচর নেটিভ যারা তাদের মাথায়
ছেঁড়া সাইটোপ্লাজম ছোঁবে নয়জন রত্নাকর, রক্তে
জিলেটিন মাখা নাকের ছিদ্র, ভগ্ন বগল আর নয়
পত্তন হবে একরাশ মিস্তিরি গাঁথা বাড়িঘর


৩.

অর্ধেক পৃথিবী আর অর্ধেক আকাশ 
মেট্রোসিটির টানেলে
তমসার বুকের মাংস চোষে, কাপকাঠি বদল হয়
মহাপয়ারের মধ্যরাতে : সাবোধান!    সাবোধান!
ব্যস্ত অক্ষর, ব্যস্ত রং --- তুমি গুনতে যেও না পা
শুধু বেওয়ারিশি কিছু বিন্দু লিখে রাখো
হালখাতা --- দেরিপথ --- মুচলেকায়
পাঁজরে পাঁজরে ধ্বংস জড়িয়ে স্ফীত হয়ে যাক চুম।
গোস্পদে বিম্বিত বিশ্ব!   সর্বজন হিতায়! 

তথাপি রাস্তায় ভীষন যানজট, হাত ধরো ----
এমনভাবে ধরে থাকো যেন
তোমার তেষ্টায় আমি আকন্ঠ হয়ে যাই...


৪.

নিহত স্নানের গলায় ক্ষুর বেঁধে
ফেড়ে ফ্যালো স্বপ্নের চুল জান্তব অজুহাতে
সূর্যের দৈনিক আপাতগতি একটু ধীর   ধীর! 

বইয়ের তাকে হাঁ করা
দীর্ঘ অনিশ্চয়তার ঘাড় ধরে
উৎপাটনের খেলা লোমকূপে
শ্যামলা গায়ের আগানেবাগানে ভার্চুয়ালিটি
আমি আর ঝুলে থাকতে পারছি   
---- অব্যক্ত ছায়ারেখা বরাবর  -----  শুক্তির মতো
চুলের কথা, গর্তের সাপ, প্রত্যাখান 
চুপচাপ চালের পাপড় খেলা চন্ডালিকামাছ


৫.

ফ্রেমের ভিতর দ্যোতনাময় বটফল
আরেকটু একলা হওয়ার ফন্দি গ্যালারি মিছিলে।
আলপথ ধরে এগিয়ে এসো অপলক
সামাজিক বনে ক্যাম্প ফায়ারের পঙক্তি আঁকো

            সজোরে
                        হ্রেষা
                                ঢিমঢিম

উটের গ্রীবার মতো বই খুলে জীবন্ত পেন, টেনশন
ছড়িয়ে যাক ওজন স্তরে অ্যালবেডো সংরক্ষণ...
এক পোস্টার চাপদাড়ি এঁকে বাড়ি ফেরবার 
কপিরাইট  ------- জলবৎ তরলং... সর্বজন সুখায়!


৬.

উত্তাল দর্পণের ইকো শোনা যায় মুখবইয়ে
ঘরে ফেরে সাইবার কেঁচোর বাতাস।
হা-ঘরেরা না-ঘরেদের তোয়াক্কার বীজ রাখে না
শুধু ভয় হয় মেঘমাগিদের ঝিঙেফুল ঠাসা আয়না
খড়কুটো পেয়ে মরিয়া মিছিল করে ------
খুব রাগ হলে হেসে ফেলে দেয়
জিপসি মাঠের দূর্বাতে বেগুনি আপেল ফুল।

আঙুল দ্যাখাও
লাগে রোদ দেবে সমকামী সূর্য জ্যাঠা।
বিপজ্জনক মায়ার সফরে ঈশ্বরকণা মানুষ ইত্যাদিরা
সংকেত ছোঁড়ে, অস্তাচলের স্থির বিশ্বাসে ফণা! 


৭.

কলসপত্রী ঠোঁটে কাঠবাদামের জলকেলি
সাঁঝবাতি রোদ বিষুবরেখার কোলেপিঠে...
------- এই যা দ্যাখা নীলাচল
শ্বাসমূলে আরশিনগর, নাভিমূলে কশেরুকা ক্ষয়

অথবা...
একটা ছোট্ট ডিঙি, একটা লন্ঠন, খুব গভীর রাত
না হলেও চলবে মতন সাদা রিংলেট।

গোটা যৌবন অসতর্ক আংটির মতো
চাল দিয়ে গ্যাছে খুরখুরি বোর্ড ---- মহাবিবর রোডরানার 
আমাকে কাপালিক, আকাশপ্রদীপ ভেবে
পর্ণমোচী অনুভব তার অরণ্যের অধিকারে
অন্ধকারে নামে।


৮.

ওষ্ঠাধর হতে আঁকিবুঁকি খসিয়ে দাও পলেস্তারা
বলো, কত ক্ষুদ্র তরঙ্গ চাই সবুজ বাড়ি ছাড়তে...!
শীতের চেয়েও বড়ো
অনেক বড়ো গ্রিন-করিডর বাঁধা আছে রামধনুতে।
শুধু দু'চারটে ব্রাশের সমান খিস্তি আলোকবর্ষ ঘুরে দ্যাখে
বনডুমুরের হিন্দোল কিনা হরিণের হাঁটাহাঁটি...

ইতিউতি ভোর, নাছোড়বান্দা মাছির চাহনিযুক্ত ড্রিপড্রিপ
নীচু তলার বিচিশূন্য মেঘমিনসের আইন অমান্য মেশামেশি
     
------------ সেসব কিম্ভূতকিমাকার মুহূর্তরা বুমেরাং আজ!
বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে গোটা ঈশ্বরীয় বাস্তুতন্ত্র...


৯.

চশমার শীতলতা ভুলে যাও বাঁশিওলা
নিস্পৃহ শহর ফুৎকারে ফ্যালো কসমিক ঝোপে
রোমাঞ্চের ইউনিকোডে ছত্রাক...!
চৌকাঠে কাশফুল বকুল সুনসান সুড়ঙ্গ পথ
ছেড়ে প্লাজমায় হেঁটে যাই চলো.....

একগোছা বোরোধান রেখে মরে যাও সুন্দরী, 
তোমায় আর সুন্দর দেখতে চায় না 

                 সত্য ←ত্রেতা ←দ্বাপর ←কলি
      
অথবা ধূমকেতু গুঁজে রেখো ব্লাউজ বোঁটায়
নির্বাসিত গুল্মের শব্দে যেমন রসুইঘর ঝলসে ওঠে
ভনিতায় করাঘাত করে মঙ্গলসূত্র, সেভাবে


১০.

স্যাকারিন, কলাপাতা, স্যানেটোরিয়াম
কিংবা কক্ষপথের বিচারে ধন্য হওয়া মানব জনম
মফস্বলের পটভূমিতে মৈথুন করা কঠিন
নতুবা মুশকিল ঠমকি, মরচের ভয়ে লুকানো শিশ্ন
এক ঝাঁক কোঁকড়ানো চুল, মৌমাছি জাসুস।
ভাঙা মূর্তির হাতে পায়ে বেলোয়ারি রাজনর্তকী
কুঁজ-ওয়ালা ট্রাকের শ্যেনদৃষ্টির সুবাদে হয়রান
আর ফুটপাত মিহিন সাদা ধুলোয়
ধর্ষিত হয় অসহায়, বলো, কেমন আছো রাত?
চোঁয়া ঢেক তুলে সমাজবাবু বেসামাল শকট ছোটায়

                                                  হায় ছায়াবৃতা........!
প্রতিদিন গর্ভধারণ আর প্রতিরাত এঁটেল ভানুর তাপ।
বিপ্লব, সেজে আছি ফুলের মিছিলে, হাঁটো.......
    
                        __________________


সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

জয়ীতা ব্যানার্জী

                

তারাদের সার্কাসে আলো জ্বলে



মনখারাপের দিনে বৃষ্টিকে অন্ধের ফেরিওয়ালা মনে হয়
অন্ধ কেবল ওই স্বরটুকু চেনে। বোঝে
নক্ষত্রের পসরা সাজিয়ে ভাঙাচোরা সাঁকোটি পেরোলে

মেঘের ভিতর থেকে তার-ই দুয়েকটি ঝরে কি পড়ে না
মাটির উপর তাঁরা গাছ হয়, অন্ধ জেনেছে
আর সবচেয়ে কোমলটিকে 'মা' বলে ডাকে


তুমি সোনার কাঠির মতো। জ্বরের ঘোরেই বুঝি
কত কথা বলা হয়ে উঠলো না এবার-ও তোমাকে

দূরে তারাদের সার্কাসে আলো জ্বলে। সারারাত
এত আলো তবু কেন
তোমার হাতের ছায়া পড়ে না কপালে


তেরছা রোদ এসে ভরে দিচ্ছে শব্দছক। পেরে যাওয়া শব্দগুলিতে টিক দিতে দিতে বড় হয়ে উঠছে চাঁপাডালের ছায়াটি। আর সামান্য বড় হতেই উল-কাকু এসে দাঁড়ালেন। ঝরঝরে সাইকেল বোঝাই উলে আসল মানুষটিই ঢাকা পড়ে গেছেন যেন। মা-কাকিমারা পছন্দের রং বাছছেন। পুরনো রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে নতুন রং খুঁজছেন। তিনি টান মেরে বার করে আনছেন চকচকে শীতের ওম। হাতের কায়দায় ছুঁড়ে দিচ্ছেন শূন্যে! তারা নেমে আসতে আসতে সোজা-উল্টোয় কী সুন্দর সেজে উঠছে বাগান। রিনরিনে চুড়ির শব্দ কেড়ে বাবা বলে উঠছেন মায়ের হাতে না কি জাদু আছে। আমি তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। মায়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে।


নামতার সুর যতখানি একঘেয়ে ঠিক ততখানিই মধুর। দুলে দুলে নামতা পড়ার অভ্যেসে মা এসে গরম দুধের গ্লাস রেখে যান। শীতের বিছানা জড়িয়ে ধরে আরও কিছুটা সকাল পেরিয়ে যাওয়া যায়। বন্ধ জানালার ফাঁক গলে সোহাগী রোদ ছুঁয়ে নিচ্ছি, নেব -- ভাবতে ভাবতেই মায়ের আঁচলের গন্ধ দূরে সরে যেতে থাকে। দুহাতে মুখ গুঁজে চেনা ঘ্রাণ হাতড়ে বেড়াই, রোজ। সবার মতো আমার আর বড় হওয়া হয় না, বাড়ির সবার আগে ঘুম ভেঙে ওঠা হয় না, গুছিয়ে কাজ শেখা হয় না আমার। দিন জিতে যাওয়া বন্ধুটি যেন, অনেকটা এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে ভেংচি কাটছে।


পরমান্ন সাজিয়েছি। এসো সুখ পাত পেড়ে বোসো
তোমাকে একটি দিন আদরে খাওয়াই। আঁচলের
আলতো পরশে মুছি ছিটেফোঁটা নুনের দেমাক

তোমাকে দেখতে সুখ অবিকল মায়ের মতই

------------



মেঘশ্রী ব্যানার্জী

                  



বিজন ঘরে





আয়নার মুখোমুখি হলেই সিঁথির চেরাপথে সোহাগের সাথে অভিজ্ঞতার সহবাস। রূপালি রেখা দিনে দিনে সংখ্যা গরিষ্ঠ। ক'দিন ধরেই ফরসেপটা খুঁজে পাচ্ছি না। বড় বাক্স, ছোট বাক্স, বড় ব্যাগ, ছোট ব্যাগ সব তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ গিয়ে পৌঁছলাম পঞ্চাশ নম্বর সাতকড়ি চ্যাটার্জী লেনের বাড়িতে। 


একতলায় দিনের বেলা আলো তেমন ঢোকে না। তাও ছুটির দুপুরে হাফ পর্দা ফেলা জানলার দিকের খাটে দুটো নরম বালিশে মাথা দিয়ে এলোচুলে শুয়ে থাকতে তুমি। আর আমি ফরসেপ হাতে অপরাধী খোঁজার মতোই প্রখর দৃষ্টি দিয়ে ধরতাম আর কুট কুট করে উপড়ে ফেলতাম তোমার মাথার ছোট্ট ছোট্ট পাকাচুলগুলো।


'পাকা চুল তুললে আরও বেশি গজাবে' এই কথাটা হেন লোক নেই যে আমাদের বলে নি। তবু থোড়াই কেয়ার করতাম? আমার উৎসাহ ছিল তোমার তিন গুন। কারণ প্রতি পাকাচুল পিছু প্রথমে দু'টাকা করে পেতাম। তারপর চুল যখন চক্রবৃদ্ধি হারে পেকেই চলল তখন এক টাকা, পঞ্চাশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, এমনকি শেষে দশ, পাঁচ, এক পয়সায় এসে দাঁড়াল। কই পরোয়া নেহি। আমার লাভের খাতায় তাতেও বেশ ভালোই জমা হত। তখন আবার পাশে ঠোঙা নিয়ে বসতাম যাতে তোলা চুলগুলো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে না পড়ে। হিসেবে আমি বড় পাকা! 


তবে এই হিসেবের খেলাটায় তুমি সব সময় আমার গুণতি ভণ্ডুল করে দিতে। পঞ্চাশটা হয়ে গেলে বলতে সবে ত্রিশ। আর আমিও বুঝে শুনে ছদ্মকোপে ফেলে দিতাম সন্না 'যাও আর তুলে দেবো না'। তুমিও তখন 'লক্ষ্মী মেয়ে সোনা মেয়ে'র বন্যা বইয়ে দিতে। শেষে আমি বুদ্ধি বের করলাম ঢ্যাঁড়া কাটার। চুলের চুলচেরা হিসাবে কাঠের বিবর্ণ দরজার পিছনে চক দিয়ে দাগ টেনে দিতাম। পাওনাগণ্ডা না মেটা অবধি সেই দাগের পরের লাইনে আবার দাগ যোগ হত। হিসাব মিটলে যখন কাপড় দিয়ে মুছে দিতে দাগগুলো তখন দরজার পিঠটা ঘোলাটে সাদা হয়ে থাকত। তার উপরেই আবার নতুন করে দাঁড়ি কাটা হত পরের দিন। 


দাঁড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, ওই দরজার পিছনেই দাঁড়ি কেটে কেটে গুনতে শিখিয়েছিলে। দশ, কুড়ি, ত্রিশ মানেই আগের ন'টা দাগের পেট বরাবর একটা করে ঢ্যাঁড়া। দিনের আলোর ঘরে প্রবেশে যতটা দ্বিধা, রাতের ল্যাম্প পোস্টের ঘষা ঘষা হলদেটে আলোটার ততই উৎসাহ মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ার। আলো নিভিয়ে দিলেও দিব্য দেখা যায় কড়িকাঠ। যেন একটা মস্ত হারমোনিয়াম কেউ উল্টো করে টাঙিয়ে রেখেছে। তখন তো আর মোবাইল অ্যাপে কাউন্টিং শেখার সুযোগ তৈরি হয়নি। কড়িকাঠ একবার সোজা দিকে আরেকবার উল্টো দিকে গুণেই পঞ্চাশ অবধি রপ্ত হয়ে যেত। দুটোর পরে আর দুটো কড়িকাঠ এগোলে চার, আবার একটা পিছিয়ে এলে তিন - সে এক ভারি মজার যোগ-বিয়োগ। মনে মনে রিড চেপে কখনও বা সা-রে-গা-মা! 


সে বছর বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট ওঠার সময়ে উই লাগা কড়ি-বরগা সব ভাঙা পড়ল। বৃষ্টির জল ছাতে ঘর করতে করতে দেওয়াল বেয়ে নেমে এসে নানারকম ছবি এঁকে দিত। সেই ছবিগুলো কোনোটা মেঘ, ফুল, পরী হয়ে, কোনোটা চাঁদের বুড়ি, কোনওটা বা বিরাটাকার দৈত্য হয়ে দেওয়াল বেয়ে ছাত অবধি উঠে যেত। বাড়িটা ভাঙা পড়ার সময় সেই ছবিগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল। যেগুলোর লোহা-লক্করের বাজারে ভালো দাম সেইসব সিঙ্ক পাইপ কল পাম্প ট্যাঙ্ক আগেই বিক্রি হয়ে গেল। কুকুর ঢোকা বন্ধ করতে গলিপথের মুখে যে হুড়কো দেওয়া লোহার গেট, রক ঘিরে আর ওই যে দালানের ওইদিকের দরজা খুলে ছাতে ওঠার আগে ডানদিকের যে মস্ত বড় গ্রিলের দরজা লাগিয়েছিলে - যার এপারে দাঁড়িয়ে ঠায় কল্পনা করতাম বন্দিনী রাজকন্যের জন্য এক রাজকুমার ওই আকাশ পথে উড়ে আসছে - সেগুলোও সব ওরা বিক্রি করে দিল। শুধু দরজাটা পড়ে রইল ভাঙাচোরা স্তূপের উপর। 


ক'দিন পরপর বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ ছিল। সকালবেলা পায়ে পায়ে গিয়ে পড়লাম পুরোনো পাড়ায়। বাড়ি ভাঙার জায়গাটা আর ঘেরা নেই। দরকারও নেই। পুরোটাই ফাঁকা মাঠের মতো। ইতিউতি ভগ্নস্তূপ। তার মধ্যেই তুমি সকালে ভাত ডাল আর ঢ্যাঁড়শভাজা নামিয়ে স্নানে চলে গেলে। আপুমা মাছটা সামলে নিল। তারপর বাবা আর তুমি নাকেমুখে গুঁজে একসাথে বেরিয়ে পড়লে। বিকেলে ফেরার সময় সরাসরি দরজায় আসতে না। গ্রিল বসার আগে খোলা রকে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকতে! পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত বাবা। কত বড় হয়ে তবে জেনেছি দু'জনের অফিস দু'জায়গায়। 


ফিরেই জামাকাপড় পাল্টে চা বসাতে বসাতে রাতের রান্নার ফর্দটুকু আপুমার সাথে আলোচনা হয়ে গেল। ঠাকুরের সামনে শাঁখ বাজিয়ে একটা ঢিপ করে প্রণাম ঠুকে নিলে। ধূপের গন্ধটা আজও ধক করে নাকে এসে লাগে। দাদু, আপুমা, বাবার নির্দিষ্ট স্টিলের কাপ। আমার জন্য চা নেই, তবে কাপটা কাচের। দুধে বোর্নভিটা গোলা, সাথে চিংড়ির বড়া। প্রথম খোলের ভাজাগুলোয় আমার অধিকার। মেঝেয় বসে তখন স্কুলের পড়া করছি। তুমি পাশে বাটি রেখে গেলে। মাথায় একটা চকাস করে চুমু। সেদিনও মেঝেতেই বসে পড়ছিলাম। পাশের বাড়ির হাবুকাকু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, "জলকাদার উপর কোথায় বসছ! আমাদের ঘরে এসে বোসো!" শুনেছি কাকুদের বাড়িটাও দর করা হয়ে গেছে। আমি আজ বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অতীত দেখছি, আর কাকু দেখছেন ভবিষ্যৎ! 

 

দরজাটার উপর খুব মায়া হচ্ছিল। এই ক'দিনের টানা বৃষ্টিতে আরও ঝুরঝুরে হয়েছে কাঠগুলো। এখানে ওখানে খয়েরি সবুজ ছাপ। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে যুদ্ধে হারা সৈনিকের মতো। কিন্তু এখনও কেমন তেজ!  আগলে চলেছে নিচের ইট কাঠ পাথরের ডাঁইকে। আমাদের সেই চকের দাগগুলো এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। মলিন হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় মিলিয়ে এসেছে। যেন ছোট্ট ছোট্ট শ্বাস নিচ্ছে। এইবুঝি পরেরটা নিতে ভুলে যাবে। কিন্তু আমি ঠিক খুঁজে নিয়েছি। আস্তে আস্তে হাত বোলাই ওগুলোর উপর। ভিজে ভিজে ঠেকে হাত! বৃষ্টির জলই হবে হয়তো! কড়ার গোড়ায় মরচে পড়ে মেটে মেটে রঙ ধরেছে। সেইখান থেকে একসার পিঁপড়ে দল বেঁধে চলেছে। ভেজা কাঠের নির্যাসে জন্ম নিয়েছে একটা উজ্জ্বল সবুজ চারা। তুলতুলে সবুজ কান্ডটা নুইয়ে আছে দুটো কচি পাতার ভারে। মুখটা নামিয়ে লক্ষ্য করলাম, একটা পাতা একটু বড়, আরেকটা ঠিক বাচ্চার মতো জড়োসড়ো হয়ে ঘেঁষে আছে ওর কোলে। দরজাটা আমাদের ভোলেনি। এবড়োখেবড়ো একটা পাথর তুলে দাগ কাটতে গেলাম ওর পাশটায়। দাগ আর পড়ল না। কোন শব্দও হলো না। শুধু একটু দেবে গেল জায়গাটা। 


অঙ্ক তো শিখে নিয়েছি সেই কবেই। শুধু হিসেব মেলানোটা বাকি রয়ে যায়। এখনও দাঁড়ি কাটি। মনে মনে। তোমার জন্মদিনের বয়সটা আর দাঁড়ি কেটেও বাড়াতে পারি না। মৃত্যুদিনের বয়স বাড়ে কেবল। থামাতে পারি না।

দীপঙ্কর বেরা

                                            


মায়ের ভালোবাসা 
===========
শিশু আগুন আর গোলাপ
দুটোকেই ধরতে চায়,
তার মা তার সামনে এসে দাঁডায়।
বার বার মা তার শিশুকে
আগুন আর গোলাপের অবস্থান বোঝায়।

যারা মাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে
তারা গোলাপ বাগানে
আগুনের পরশমণি হয়ে যায়;
বাকীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়
যুগ সৃষ্টির গোলাপ।

ঠাঁই নাই   
======
মা দেখো, এ গাছটায় কি সুন্দর ফুল।
মা বলতো - ও গাছটা আমাদের না।
মা দেখো, এই মাটিতে কি সুন্দর চাঁদের আলো।
মা বলতো, ও মাটি আমাদের না।
মা দেখো, এই মাঠে কি সুন্দর সোনালী ফসল।
মা বলতো - ওই মাঠ আমাদের না।
মা দেখো, এই পুকুরে কি স্বচ্ছ টলটলে জল।
মা বলতো, এই পুকুর আমাদের না।

এভাবে সারা পৃথিবী
মানুষে মানুষে ভাগাভাগি হয়ে গেছে
বিনয় জানে না,
ও সব কিছু শুধু দু চোখ ভরে দেখে
আর দেখায়।
দেখতে দেখতে মায়ের হাত ধরে
আস্তানা খোঁজে, 
যেখানে যায় সেখানে সবাই বলে 
- যা সরে যা। ওদিকে যা। 
এখন বস্তিতে বিনয়
সবিনয় নমস্কার করে এই পৃথিবীকে।

হাঁটো মা হাঁটো 
=========
হাঁটো মা হাঁটো
না হলে থেমে যাবে পৃথিবীর চলা,
ঘুমিয়ে পড়ছে শিশু
ও শুয়ে থাক তোমার কোলে
না হলে ব্যাগের উপরে
তোমার জন্য নাই কোন গাড়ি ঘোড়া নাই যানবাহন
তুমি হাঁটো মা হাঁটো
না হলে তোমার সঙ্গ ছেড়ে যাবে পৃথিবীর বন্ধন।

হাঁটো মা হাঁটো
তোমাকে পৌঁছতে হবে পাঁচশ হাজার মাইল দূরে
তোমার বাড়ি
না হলে তোমার শিশু থাকবে না দুধে ভাতে
পাবে না এ পৃথিবীর ঘরে ফেরার স্বাদ,
পেটে খিদে তৃষ্ণার জল নেই
কংক্রিটের রাস্তায় একটুও ছায়া নেই
পায়ে পড়ছে ফোস্কা টান ধরছে পেশীতে
তবু তুমি হাঁটো মা হাঁটো
না হলে জীবনের জয়গান আর ধ্বনিত হবে না।

হাঁটো মা হাঁটো
তোমার জন্য ইট পাতা পুকুর ঘাট
লাউ মাচা ছাই গাদা মাটির উনুন ত্রিপলঘেরা গোয়ালঘর
ধান খেত আল বাঁশপাতা খড়ের চাল
একটা দুটো হাঁস পাড়া বেড়ানো মুরগী
নেড়ি কুকুর কচুর বন কলমী শাক
সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে
কবে আসবে এক বুক হাত পা ছড়ানো নিশ্বাস
তাই হাঁটো মা হাঁটো
না হলে এ যন্ত্রণা থেকে
পৃথিবীর এ কঠিন অসুখ থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

হাঁটো মা হাঁটো
এ সভ্যতার বুকে তোমার এ পদচিহ্ন করুক পদাঘাত
চেতনার উন্মেষ ঘটাক এ নিরেট পাথরের দেশে
যে ইট কাঠ পাথরের দেশ নির্মাণে তুমি
রাজ্যে রাজ্যে শহরে শহরে বাবুদের আলিশানে
মজদূর হয়ে পরিযায়ী হয়ে পেটের জন্যে
ঘুরে বেড়িয়েছো
সেই দেশের নির্মম নিষ্ঠুর নৃশংস পথে
হাঁটো মা হাঁটো
না হলে মানুষ মানুষকে চিনবে না
কেঁদে উঠবে না মানবতার কোন শ্লোগান।

হাঁটো মা হাঁটো
এ মহামারী চলে যাবে রেখে যাবে নতুন পৃথিবী
তুমি হাঁটবে আগামীর হাত ধরে
এমনি করে সদর্পে
রাষ্ট্রের নির্লজ্জ শাসন ত্রাশন উলট পালট করে
লজ্জা অপমান অন্যায় অবিচারের যোগ্য জবাব দিতে
বীর পুঙ্গবদের আবার একবার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে
ফুল ফোটানোর অঙ্গীকার নিয়ে
তুমি হাঁটো মা হাঁটো।
হাঁটো মা হাঁটো
আরও জোরে আরও জোরে
হাঁটো মা হাঁটো
হাঁটো মা হাঁটো

বিশ্বজিৎ দাস

                                           

                  

 

এই সপ্তাহের কবি বিশ্বজিৎ দাসl১৯৮৫ সালে উত্তর চবিবশ পরগনার ভবানীপুরে  জন্ম। ছোট থেকেই আশৈশব ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে এবং অর্থনৈতিক অবহেলায় এই জীবন ও জগতকে চিনতে চিনতে কবিতায় এসেছেন। বলা যায়, সব ব্যর্থতাই একদিন তাকে কবিতায় এনেছে। কবির প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : হ্যালোজেন ও স্পর্ধাগুচ্ছ। প্রথম প্রকাশ : ২০১৭। প্রকাশক : ধানসিঁড়ি। প্রথম দশকের কবি। 
পেশা : অধ্যাপনা 
গবেষক : কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
(বিষয় : পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি : ১৯৪৭-৭১) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গবেষণা করছেন, বাংলাদেশের কবিতা :১৯৭১-২০০০)

১.
প্রাজ্ঞ চাঁদের ঘোড়ায় চলে যাচ্ছে 
                    আমাদের তারকদা
হঠাৎই অসামঞ্জস্য ঘুমের ভিতর মুনসাইন

স্বপ্ন কিনতে বেরিয়ে পড়ে
সোজা রাস্তায়। কুড়ানো কাগজে দেখে

মাতৃবিয়োগের খবর! খুব জোরে ইংরেজি
আওড়ায়; যেভাবে উত্তরহীন জীবন কেটে যায়...

২.
নিউরোট্রান্সমিটার খেয়ে ফেলেছে ওপাড়ার
নিমাইদা। গাছে গাছে লুনাটিক মূর্তির আসর

খুলির সংসারে শুধু পাতা। সেও শুনেছে
সবুজ রঙের মধ্যে ভাদুটুসুর গান

খিদে পায়। দস্তার থালায় ভাসে
আদিবাসী পাজর চোয়ানো এক দুরন্ত ইয়ার্কি!

নিমাই সরদার আবারও একদিন 
গাছের মইয়ে আকাশে উঠে যায়...

৩.
গগেনদা কি করে পাগল হল জানি না
শুধু দেখেছি, বাঁশ বাগানে বসে থাকে

পাতার ফাঁকে সে দ্যাখে ফুলমুন
সাইকোসিস চিবোতে চিবোতে ঘুমিয়ে পড়ে

মুখভর্তি দাঁড়িতে জমিয়ে রাখে
ঘটনার পৌনঃপুনিকতা

আর
তিরিশ বছর আগের ভুল ঋতুর গ্যালাক্সি

৪.
কয়লা ব্যাপারীর মেয়ের 
প্রেমে পড়েছে বারাসাতের অভীক

খোঁজ নিয়ে জেনেছি এটি প্রেম নয়
ডোপামিন বেড়েছে খুলির ভেতরে

কালো রক্তের শৈশবে,
স্কুল আর বাড়িই বাইপোলার অসুখ!
বাড়ির প্লাস্টারে আটকানো তাঁর শরীর

কখনো জানতে চায়নি বাবা মা
কতটা মন খুলে দিলে, জ্যোৎস্না পাবে ছেলে
মুনস্ট্রাক হবে না; কতটুকু ভালোবাসা পেলে...

৫.
বেহুলা পাগলি কুঁই কুঁই শব্দ করলেই
লডসে সৌরভের জার্সি খুলে ওড়ানোর দৃশ্যে

দু'চোখের জল মোছে সুখ। ভাবে এই তো
ফিরে পেয়েছে সে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর

সেই বাড়ি! কিন্তু কিভাবে এসেছে সে?
ভুল তো ভাঙে না, ভাঙে কি নৈঃশব্দ্য?

ঘুম বঞ্চনার পথে; সে হারিয়েছে উৎসাহী সম্পর্ক!

৬.
একটি সুগন্ধি চাঁদের কাছে 
আশ্রয় চেয়েছিল নমিতা পাগলি

পায়নি। হ্রাসযুক্ত সম্পর্কের থেকে
সে পেয়েছে দুঃস্বপ্নের আদর

ছেড়ে গেছে স্বামী আর চাঁদ দেখা আয়না
পথে পথে এখন তাঁর বিছানা

কেউ খেয়াল করেনি, কোনো এক
অন্ধকারের জন্মগত ভয়; 
রাতের আশ্রয় হামলে পড়ে শরীরে...

মা, হয়ে গেল সে! অথচ জানল না
শুয়োরের বাচ্চা চাঁদের দ্রাঘিমা কত?

৭.
শুনেছি, 
উন্মাদ আচরণ দেখলে
যুবতী জ্যোৎস্নারা খুশি হয়!

যুবক নয়। পত্নী বিয়োগের পনেরো বছর পর
বিয়ে করে ছিলেন ভবনাদ দাশ

সুখেই চলছিল সব। একদিন রসে রাঙানো পানে
তিনি হয়ে উঠলেন মাতাল অজগর

খুন চেপে গেল মাথায়, করলেনও অবুঝে
শুধু ডুব দিলেন জলে। কেউ পেল না খুঁজে...

৮.
অসঙ্গতি কি জ্যোৎস্না ধোয়া জল?
নিজেকে দেখা এক বিশ্বাসের
ডিজাইন করা বিষণ্ন মখমল?

কেউ জানে না...

হাঁটতে হাঁটতে কোথায় থামতে হয়
কোথাও এমন সতী হওয়ার ষড়যন্ত্রে

খাওয়ানো হতো নিঝুম ধুতুরার ফল...
এও কি তবে চাঁদের উদ্যানে চাঁদের ডামাডোল?

কেউ জানে না, সেই তারাময়ীর চিতার আঁচল...

৯.
মস্তিষ্কের লুকানো হাত পা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে

খবর আসে কুঁকড়ে যাওয়া তৈমরের
রাস্তায় ছেলেরা পিছনে লাগে

সেও উলটে দেয় লজ্জার ঢাকনা
বলে 'দেখ দেখ, ঘুমানো আয়না'!

হারামিরা তাকেই করে রাজনীতির পোস্টার
তৈমুর ছুটে বেড়ায় ভুল রোদ্দুরকে রোদ্দুর...

১০.
না, আকবর মুঘল সম্রাট নয়
ম্যাথের ট্যালেন্টেড স্টুডেন্ট

বহুকোষী সংঘাতে ছাড়ে প্রেমে, ছাড়ে পরিবার
এখন ড্রিমল্যান্ডে ঘুরে বেড়ায়

মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে গণিতের সূত্র

নিজেকে কখনো সম্রাট ভাবে
তো, এইমাত্র বেড়ালের ব্যামো

ছিঁড়ে গেছে চাঁদ, পর্যায়ক্রমের ঘুম কাঠামো...

১১.
চন্দ্রাহত হয়ে এ জীবন কাটিয়েছে
ভবানীপুরের কোনো এক যুবক

নাম তার জেনে কি হবে?

চান্দ্রজন্মের প্রভাবিত জ্বর নিয়ে
সে হয়ে উঠেছে ক্রমশই আনসাউন্ড ম্যান

তাকে দিও পলাশীর অবশিষ্ট মেঘ
ফারাক্কার জলের স্রোতভাঙা ডানা

সেও তো চায়নি কিছু, হ্যালুসিনেশন ছাড়া...

১২.
যতটুকু পড়ে বুঝেছে সে
চাঁদের পোশাক বদলের সাথে

মানুষের হাত, পা, সোহাগ বদল হয়
বাইবেলের নেবুচাডনেজ্জারের কাহিনী

যদি প্রথম লিখিত পাগলামি হয়ে থাকে
যদি বিয়েট্রি প্রথম মানুষকে মুক্ত করে

তবে ফিলিপ পিনেলই তার পিতা
জঁ বাপ্টিস্ট পুসির কথাও তিনি

করেননি অস্বীকার, তবু তিনিই ছিলেন
অগঠিত পৃথিবীর সবচেয়ে সুপুরুষ পাগল

মানুষের হৃদয় স্পর্শের জন্য...

১৩.
নিজেকে পিছন থেকে দেখার সৌজন্যে
এই সুসজ্জিত হত্যার নির্বাক মাতন

নিয়ে গিয়েছে চন্দ্রলোকের দিকে
সে মেয়েটি, কখনো জানতো না

জোর পুরুষের শরীর কি?
অনিচ্ছুক মাংসের ভিতর হাঙরের নখ

ওই মেয়েই তো বুঝেছে, 
ধমনীতে রক্ত আর আবেগের মিস ইউজ!

১৪.
বাবা কিনেছে চাঁদের ঘুম
ছেলেও কিনেছে চন্দ্রাহত বাড়ি

দুজনই আপাতত মেঘের হলে সিনেমা দেখে
ছেলেটির মা যে দাঁড়িয়ে বিশ্বাসের তলদেশে

দেখে যাচ্ছে সাইন্যাপসের জানজট...

বলো, এ জীবনের 
হলুদ চশমায় আর কি কি দেখা বাকি থাকে?

১৫.
পরীদের সঙ্গ ওর ভালো লাগে
অদূর জ্যোৎস্নার উদ্যানে বসে থাকে

বাবা মা হ্রদের দরজায়
মরা স্বপ্নদৃশ্য আঁকে নীল অশ্রুজলে...

ভাতের কাঁকরই জোটে না
তো আবার আহত মেয়ের জন্য কি 

বোধ রঙের পালকি কিনে আনবে?

১৬.
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল কুড়ি বছর আগে
স্নায়ুর ভিতরে জমে আছে চাঁদরঙ

তবু একদিন নোঙরের টানে
বিষাদের নোলক পরে ছুটে গেছে

একটা মিথ্যে আয়নার সামনে
জেনেছে পাখিদের পুতুল নেই

নদীর বুকে ছাই হওয়া সব জল
বেহালা বাদকের প্রগাঢ় পাপড়ি

আর দেহমাংসের প্রত্যাশিত সম্বল
নিয়েছে ওই এক সন্ধ্যারসের পুচ্ছধারণ ফল!

বলো, এঁকে কি তোমরা পাগল পুতুল বলবে?

১৭.
সন্দেহের বাসনা থেকে যে রঙ ঝরে
সেখানে রেখো অনিশ্চিত সবেদা

ওর গায়ে ঝুরো চামড়ায় হাত দিয়ে
দেখো না সহস্র নদীর সিল্ক

ছেলেটি এখনো জানে না
স্ত্রীলোকের পাহাড়ে কত ফাটল

ধস নেমেছে মাঠের অবসরে

আর্কাইভ জড়ানো প্রাচীন ঈর্ষা
ছিন্নমস্তা বানিয়েছে ওই রমনীকে...

১৮.
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে
আজকাল এগিয়ে গেছে ধরাধাম

সাধকরা সুরের শিকড়ে নামে
সহজ কি বুঝে নিতে নিতে ফুরিয়ে যায়

এভাবে জেনেছি ভবা পাগলার কথা
তিনিও কি সত্যিই পাগল?

নাকি সম্মোহনের নজর এড়িয়ে
সোসাইটির হৃদয় থেকে উড়ে যাচ্ছে

এক একটি সুখগামী জোনাকির দল...

১৯.
বাড়ির ভিতরে গানঘর; দেহঘড়ি
সময়ে সময়ে গেয়ে ওঠে

নিউরোসিসের সমস্যার চাদরে
রাখা ছিল, 
'সব লোকে কয় লালন কি জাত'?

রিপোর্ট এলে জানা যাবে এই স্বপ্নঘরে 
চাঁদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বরাবরই

লালনও কি তবে
বাউলের একতারায় এক পাগলাঘর?

২০.
রবীন্দ্রনাথ পাগলের মহৌষধি নিয়ে
বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন

তাঁর উক্ত বক্তব্য অনুযায়ী 
আমরা কি ধরে নিতে পারি, তিনি পাগল?

উনি ক্লোরপ্রমাজিন খাননি! খেলে হয়তো
আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতেন!

আমরা হয়তো পেতাম না মৃতপুত্রের গান,
জ্যোৎস্নাহত না হলে কি গীতাঞ্জলি লেখা সম্ভব?





রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

সম্পাদকীয়

           .                           

যদি মায়াজন্ম পাই তবে যেন আবারও মা হতে পারি৷সারা বিশ্ব খুঁজলেও মা'র মতন শক্তিশালী সম্পদ মিলবে না ৷যখন চোখ ফোটে আমাদের ,কিছু বলতে ,বোঝাতে পারি তখন একমাত্র মা বোঝেন তার সন্তানটির চাহিদা ৷সন্তানদের মনের খবর একমাত্র জানে মা । মা হলেন এমন  এক প্রজাতি যা প্রকৃতির দেওয়া সর্বশ্রেষ্ট উপহার।প্রকৃতির জল, হাওয়ায় মা বড় হয়৷ নারী , পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যেমন  মা বেঁচে থাকে তেমন সকল জীবজগতে মা থাকে ৷ একটি গরু যখন সন্তান প্রসব করে তখন বাছুরটি বার বার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আর পড়ে যায় ৷ মা তখন অতি যত্ন করে দুধ খাওয়ায় তাকে ৷কুকুরের ছানা,বিড়াল ছানা তারা তাদের সন্তানকে নিরাপদ স্থানে রেখে আসে I যদি মা তাদের সন্তানদের খুঁজে না পায় পাগোলের মত করতে থাকে৷ চারিদিক খঁুজে খুঁজে সন্তানদের আবিষ্কার করে৷পাখিরা সকালবেলায় বাসা থেকে  বেরানোর আগে সন্তানদের নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে যায় ৷ 


আত্মরক্ষা করা সকল জীবকূলের মা'র একটা জিনগত বৈশিষ্ট্য বলা যায়৷পৃথিবীর সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা থেকে সন্তানদের রক্ষা করা তার কাজ ৷ যে ভাবেই হোক নিজের সন্তানের মাধ্যমে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে একজন মা।সকল প্রকার বর্হিশক্তি থেকে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখাটা একটা চ্যালেঞ্জ৷একটা পিঁপড়ে মরে যাওয়াকে ভয় করে৷ প্রকৃতি এভাবেই সৃষ্টি করছে জীবজগৎকে৷আর সেই ভাবে গড়ে তুলেছে জীবজগতকে৷প্রত্যেকটা জীবকে এমন ভাবে তৈরী করেছে যাতে ঝড় বৃষ্টি প্রাকৃতিক সকলপ্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা পায় ৷ প্রকৃতি.মানেই মা ৷ সে চায় তার সন্তান বেঁচে থাক ৷ হরিণ যখন বাঘের শিকার হয় তখন প্রাণপণ বাঁচিয়ে রাখতে চায় শাবককে ৷ আর মনুষ্য জাতির মধ্যে এরও ব্যতিক্রম হয় না৷তাই তো কয়েকশ বছর পরও মাটির তলায় চাপা পড়া ধ্বংসাবশেষে দেখা যায় এক জন পা তার সন্তানকে মাথায় করে  রখেছেন৷অর্থাৎ ধ্বংস হবার আগের  মুহূর্তে মা তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন৷ঠিক যেমন ঝড় ওঠার আগে পাখিরা তার সন্তানদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেয়৷ 


"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে" I এই দাবী যে শুধু মা করেন তা নয়। বাবাও করেন ৷পৃথিবীর সকল বাবার মধ্যে মা লুকিয়ে থাকে৷মা মানে স্নেহের ছায়া I একটা আড়াল।যে কিনা সকল প্রকার আদর ,আসকারা দিয়ে বড় করে তুলবে৷ নিজে না খেয়ে সন্তানের জন্য রেখে দেওয়া এটা সকল জীবজগৎ করে রাখে৷ বাঘ তার সাবকের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে৷ঘরে চাল বাড়ন্ত থাকলে মিথ্যে ঢেকুর তুলে মা এক গ্লাস খেয়ে শুয়ে পড়েন৷ এই চিত্র আমাদের পরিচিত৷ পাড়ার কুকুরকে যখন খেতে দেওয়া হয় সে মুখে বাচ্চাদের সেখানে নিয়ে আসে৷ পোকামাকড়দের মুখে করে খাবার নিয়ে যেতে দেখা যায়৷

সঞ্চয় শব্দটার উৎপত্তি পৃথিবীর সকল মার থেকে ৷ তাই অন্নপূর্ণাকে সারা জীবন সন্তানদের  দুধ , ভাতের অভাব থাকবে না এই বর দিতে হয় ৷ সঞ্চয় মানেই ভবিষ্যত ৷ তুলে রাখা উত্তরাধিকারদের জন্য ৷

মা মত করে ভালোবাসার
কেউ নেই 
পৃথিবীতে তাই আজও 
মা'র কোন প্রতিশব্দ নেই

আমাদের জীবন, আমাদের চেতনা সবই গড়ে তোলেন মা ৷ বাবা আর্শীবাদ করেন ," বড় হও ,মানুষ হও৷" মা বলেন, " ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক ৷ তিনি তোমাকে আশীর্বাদ করুন৷"মা চান তার সন্তানেরা যেন সর্বদা ঈশ্বরের শুভাশিসে থাকেন।আমাদের দুঃখ ,কষ্ট অনুভব প্রথম মা করতে পারেন৷তাঁর চোখে এড়ায় না কখনও।

দুঃখ বেদনা ,গ্লানি 
ধুয়ে, মুছে যায়
একটি মাত্র শব্দে
"মা" 

"মা " শব্দের মত পবিত্র শব্দ অভিধানে নেই৷সারদা মাকে ঘিরে সারা বিশ্বে উন্মাদনার শেষ নেই৷তিনি গর্ভে ধারণ না করলেও জগতের মা ৷কোটি কোটি মানুষ তাঁকে মা বলে ডাকেন৷
এক বার জয়রামবাটিতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্তদের গরম খিচুড়ি বিতরণ করার সময় (তখন মা সারদার অল্প বয়স) তাঁর মধ্যে প্রকৃত জনসেবা করার রূপটি ফুটে উঠেছিল। ওই গরিব মানুষদের পাশে বসে হাতপাখায় তাদের বাতাস করে দিয়েছেন। ওই মানুষগুলো তখন মায়ের পরম স্নেহ পেয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছিল। অভাব, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে সকলেই একাত্ম হয়েছিল সে দিন। আর মা সারদার এমন আচরণের নজির নানা উপলক্ষে রয়েছে একাধিক।আমরা মায়ের এক ভক্ত আমজাদের কথা স্মরণ করতে পারি। নিজের হাতে তাকে খেতে দিয়েছিলেন, এমনকী খাওয়া শেষে এঁটো থালা পরিষ্কার করতেও তাঁর কোনও দ্বিধা ছিল না। আমজাদের পরিচয় সম্পর্কে মাকে মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার শরৎ যেমন ছেলে, ওই আমজাদও তেমন ছেলে’। শরৎ, অর্থাৎ পরবর্তী কালে স্বামী সারদানন্দ মহারাজ। এই সামান্য ঘটনাটির তাৎপর্য মোটেও সাধারণ নয়। 

সুতরাং মা হলেন সকল প্রকার ধর্মীয় ভেদাভেদ, হিংসা ,লোভ ,ক্ষমতা সব কিছুর উর্দ্ধে ৷অনেকে ভাবেন মা মানে নারী ৷কিন্তু তা নয় ৷একজন পুরুষের  মধ্যে মা বেঁচে থাকে৷ আমর তাকে অনুভব করতে পারি না ৷ মা মানে নিরাপদ আশ্রয় ৷ যার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়৷ ভালোবাসার আর এক শব্দ মা৷

সৃজন এই সংখ্যায় থাকছে উপন্যাস, প্রবন্ধ ,গল্প কবিতা ৷ পড়ুন সবাই৷ সৃজনে থাকুন ।

পারমিতা চক্রবর্ত্তী
সম্পাদক




চিত্রঋণ - জয়িতা ব্যানার্জী

মলয় রায়চৌধুরী

                         

মলয়, ১৯৪১ সালে


 বাঁ দিক থেকে : মলয়ের বড়দি সাবিত্রী, দাদা সমীর, মেজজেঠিমা করুণা, মলয়, বড়জেঠিমা নন্দরাণী, মেজদা অরুণ, মা অমিতা, ছোড়দি ধরিত্রী

ধারাবাহিক

ছোটোলোকের জীবন

: মলয় রায়চৌধুরী


       চার বছর বয়সে ন্যাড়া ছাদে  উঠে ঘুড়ি উড়িয়ে পাতা-হাতে ছড়ির মার খেয়েও ওড়াতুম আর অন্যের ঘুড়ি কেটে নাচতুম  কপিলের দাদু একভাঁড় তাড়ি খাইয়েছিল আর মা মুখ শুঁকে গন্ধ পেয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল “তাড়ি নিশা নহি হ্যায় খোখা  ভুখ সে বচাতা হ্যায় বদন মেঁ তন্দুরুস্তি” কি করেছি আর কি করতে পেরেছি তার জন্য আপশোষ নেই অনেক মন্দিরে দেখতুম উপস্হিত সবাই মাটিতে  একেবারে বোবা হয়ে বসে আছে ঈশ্বরের শব রাখা রয়েছে সামনে পুরুষের আধ্যাত্মিকতা ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক তখন থেকেই যদিও মা-বাবা আদরযত্ন করে মানুষ করেছিলেন তবু একা রয়ে গেছি ইমলিতলার ছাদে প্যাকিংবাক্সে মাটি ভরে তাতে ফুলের গাছ পুঁতে ফুলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম কেন্নোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম উচ্চিঙড়ের সঙ্গে কাঠবিড়ালিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম গেঁড়ি-গুগলিদের সঙ্গে শুঁয়াপোকার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম ফাঁদে পড়া ইঁদুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম ঘরে আটক চড়ুইপাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতুম বড়ো হওয়া মানে কুৎসিত অনিশ্চয়তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ।  

ইমলিতলা বাড়ির ছাদে : মেঝেতে বসে মলয়, চেয়ারে দাদা সমীর, দাঁড়িয়ে মেজদা অরুণ, দুইপাশে জাঠতুতো বোন ডলি আর মনু ( উকুন হতো বলে ন্যাড়া করে দেয়া হতো )



         পাঁচ বছর বয়সে রাস্তার কলে চান করার সময়ে যাকে ইচ্ছে কনভেন্টে শেখা  ‘ফাক ইউ’ বলতুম আর ইংরেজিতে তার সঙ্গে কথা বলেছি বলে তার আনন্দ উপভোগ করতুম  ইমলিতলার গঞ্জেড়িদের মানে যারা গাঁজাচরস টানে তাদের জমায়েতে ছিলিম টানতে গিয়ে কেশেছি শুয়োরের মাংসের ঝোল খাইয়ে বনসি দুসাধ কাশি থামিয়েছিল “জিনদিগি ববুয়া য়হাঁ সে ওয়াহাঁ” শুয়োরের মাংস হয়ে যায় কতো কি শিখেছি কনভেন্ট ইশকুলে হ্যাম বেকন প্রোসিয়েটো সসেজ টেরিনস জেলাটিনো সালামি বোলোনা জামবন ট্যাকব্যাক মোরটাডেলা উইনার শুয়োর মানে গোলাপি শুয়োর যারা ঠোঁটে লিপ্সটিক মেখে জন্মায় আঘাতহীন শৈশব হয় না কখনও মা কখনও বাবা কি মনে করিয়ে দেননি তুই বাতিলের দলে তুই একটা ফালতু উধাও হবার আগে কেউই বিদায় জানিয়ে হাত নাড়ে না যেমন-যেমন বুড়ো হও তেমন-তেমন তুমি তোমার বুড়ির মধ্যে তোমার মা-বাবাকে খুঁজে পাও যে তোমাকে চিপকে থাকবে যা বুড়ো বয়সে তোমার বড্ডো দরকার ।

         ছ’বছর বয়সে সারাদিনে একবস্তা কয়লা একা ভেঙেছি প্রায়ই প্রায়ই প্রায়ই আর মামার বাড়ি পাণিহাটির পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছি বঁড়শিতে আটকানো মাছের লাফানি-ঝাঁপানি সে কী মজা “দেখি কী মাছ ধরেছিস ? কী মা্ছ ওটা?” জানি না বঁড়শিতে আটকাচ্ছে তুলে নিচ্ছি  “খোট্টা মেড়ো কোথাকার, মাছের নাম জানিস না বিভাস ওকে আজকে মাছের বাজারে নিয়ে গিয়ে মাছেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিস” আসলে ইমলিতলার সব রকমের আনন্দে ভোগার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি অথচ আমি আজও এই বুড়ো বয়সেও লেখালিখি করি তার কারণ আমি খুঁজে পাইনি যে আমি লোকটা কে প্রথম কবিতার বই “শয়তানের মুখ” কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বেরোলেও কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট এলাকার প্রেসগুলো আমার নাম দেখে ছাপতে চায়নি মানুষের মুখ আর শয়তানের মুখে পার্থক্য ছিল না  ছাপাতে হয়েছিল বহরমপুরে মণীশ ঘটক ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক কিন্তু যে-কবিতাগুলো ছাপার পর আমার ভালো লাগেনি তাতে “CANCELLED” রাবার স্ট্যাম্প মেরেছিলুম বলে সুনীল গাঙ্গুলি খাপ্পা অথচ নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর পত্রিকায় আমার কবিতার বই রিভিউ করাতে চাননি আমার গদ্য ছাপতে চাননি কেননা আমার “নামগন্ধ” উপন্যাসে যিশু বিশ্বাস নামে চরিত্রের বাবার মোটর গাড়ি চুরি হয়ে গিয়েছিল সেই থিয়েটার হলের সামনে থেকে যেখানে বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” অভিনয় হচ্ছিল ব্যাপারটা এতোই আনন্দদায়ক যে মনে হয় তা বুঝি দুঃখ সময়ের রঙ হয় কুচকুচে কালো চাইবাসার রোরো নদীর ঠাণ্ডা জলে  চান করতে গিয়ে একাকীত্বের মাতনে মেতেছি আসলে আমি তো একজন আউটসাইডার জেলের দেয়ালে কয়েদিরা যা লিখে রাখে তা আমাকে উদ্দেশ্য করে । আমি বুলগাকভ পড়িনি ।

         সাত বছর বয়সে ঘুঁটে ভেঙে তার তলায় প্যাকিং-বাক্সের কাঠের টুকরো সাজিয়ে কয়লা রেখে উনোন ধরাতে পারতুম  সকালে দাঁত মাজার জন্যে সাদা রঙের ছাই বড়োজ্যাঠার জন্যে আলাদা করে রাখতুম মহাদলিত গঞ্জেড়িদের তবেলায় হাতে তমঞ্চা নাড়িয়ে দেখেছিলুম তেমন ভারি নয় অনেক সময়ে দুর্ভোগ অদৃষ্টের কোপ থেকে বাঁচায় আদালতের জজ যখন জিগ্যেস করেছিলেন “আর ইউ গিল্টি” তখন মিথ্যে কথা বলেছিলুম যে না আমি গিল্টি নই কিন্তু কতো যে বেআইনি কাজ করেছি তমঞ্চার গুলি চালানোর মতন তা উনি জানতে চাননি  আসলে সবচেয়ে ক্ষতিকর হল মানুষের নাম যা গাঁজা ফুঁকে বা পাঁড় মাতাল হয়েও মগজ থেকে যায় না তার জন্য বদ্ধউন্মাদ হতে হয় চুল কাটার সময়ে সেলুনের আয়নায় নিজেকে আগন্তুক মনে হওয়ার সেই শুরু সকলকেই যে বুঝে উঠতে পারি তা নয় এই যে লিখতে বসেছি নিজের কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি না শুনতে পাচ্ছি পাণ্ডুলিপির গলার আওয়াজ আমার নিজের জীবন আমি বেঁচে নিচ্ছি ব্যাপারটা ত্যাবড়ানো নিঃশেষ না করে ছাড়ে না অস্হির অপরাধবোধে টইটুম্বুর তবুও  আমার জীবন একেবারে টানটান ।

         আট বছর বয়সে আলোয় গড়া চামড়ার কালো তেলালো কুলসুম আপার সঙ্গে প্যাণ্টুল খুলে লেংটুর ঘষাঘষি খেলেছি “কোশিশ কর  উল্লু কহিঁকা কোশিশ কর নহিঁ তো গোস্ত নহিঁ খিলাউঙ্গি” ওনার গায়ে জংধরা লোহার গন্ধ নোনতা তন্দুরি-চিকেন বুক ওনাদের বাড়ির গোরুর মাংসর মোগলাই খেয়ে বাড়ি ফিরে মাকে মিথ্যে কথা বলেছি  টাটকা মাংস আর রাঁধা মাংসের লোভে প্রায়ই মিথ্যে কথা বলেছি ইউ আর গিল্টি ইউ কেননা আমি তো দার্শনিক মিথ্যে কথা বলার অধিকার আছে আর খিদে তো জীবনশৈলী জেনেছি অন্ধকারে চোখের চরিত্র পালটে যায় আঙুলের ডগায় চোখ গজিয়ে ওঠে গির্জা মন্দির আর মসজিদের মধ্যেকার গন্ধ কিন্তু এক নয় রোমান্টিক প্রেম হল একেবারে অবাস্তব ব্যাপার নয়তো তক্ষুণি-চেনাকে স্পর্শ করলেই দুপক্ষের কালো জঙ্গলে কেন তরল ব্যাপার খেলা করতে থাকে  বুঝতে পারছেন এই যে হ্যালো শুনছেন ছায়াদের ভুতুড়ে জগত সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি তাতে কালো রঙের মাত্রা বেশি তখন জানতুম না কী কোশিশ করতে বলছেন কুলসুম আপা প্রেম জীবনকে থামিয়ে রাখে কিছুক্ষণ কিছুদিন কয়েকমাস কয়েকবছর ব্যাস কাফেরের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে কুলসুম আপাকে জন্নতে লুকিয়ে-চুরিয়ে যেতে হবে ।

         নয় বছর বয়সে ব্লেড দিয়ে মুর্গির গলা কেটে গলা চিপে থেকেছি যাতে রক্ত বেরিয়ে স্বাদ না নষ্ট হয় চুড়িঅলা শিখিয়েছিল মুর্গির মাংস জায়ফল দিয়ে রাঁধলে গন্ধ কেটে যায় ছাদে দাঁড়িয়ে পালক ওড়া দেখেছি বুক-ওঁচানো মেয়েদের দিকে চোখ চলে গেলে ফিরিয়ে নিইনি মনে হয়েছে ওর হাতে কাতলা মাছের চোখ খুবলে আশীর্বাদী আংটি পরিয়ে দিই বলি উইল ইউ ম্যারি মি তুমি কি ঝড়ের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াও প্রতিটি প্রেম তার এক্সপায়ারি ডেট নিয়ে আসে তবু আমার মনে নেই শেষ কবে অবিবাহিতা যুবতীর আদর খেয়েছি পাহাড় ধ্বসে পড়লে তার চূড়াটা নামে সব শেষে অথচ তার ভারেই পাহাড়ের অধঃপতন সৎ আর সত্যবাদী হলে প্রেম উবে যায় যুক্তিতর্ক আমার সহজপ্রবৃত্তিকে দুমড়ে-মুচড়ে কিম্ভুতকিমাকার করে দিয়েছে কেউই ব্যাখ্যা করতে পারে না কাকে আলোকপ্রাপ্তি বলে অথচ মানুষ ভয় পেলেও বোকার মতন হাসে যারা ড্রিফটার তাদের আমি পছন্দ করি না ।  

         দশ বছর বয়সে নমিতা চক্রবর্তী মানে নমিতাদিকে ‘ভালোবাসি তোমাকে’ লেখা চিরকুট দিয়েছিলুম যা উনি যত্ন করে বারো বছর রেখে দিয়েছিলেন চুমু খেতে চাইলে দিতেন হয়তো কিংবা নিশ্চই ওনার-আমার দুজনেরই সাহস হয়নি ইঁদুরের দিকে তাকিয়ে গোখরোও ভিতু হয়ে যায় অনেক সময়ে কেবল “পুঁজিবাদ নিপাত যাক”, “দুনিয়ার মজদুর এক হও” এই সব শুনতে নমিতাদির ভাল্লাগে ধুসসালা, “বই পড় বই পড় বই পড় বই পড় এই বইগুলো নিয়ে গিয়ে পড়” ফলে কাগজ পড়ি চিরকুট পড়ি ঠোঙা পড়ি পোস্টার পড়ি বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভোজপুরি মৈথিলি আর দাদার সঙ্গে গঙ্গায় সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিলুম বলে পরে চুমু খাবার মতনই সাঁতার শেখার সাহস হয়নি অথচ আমার জীবন আরম্ভ হয়েছিল নমিতাদির দেয়া প্রথম রবীন্দ্রনাথ থেকে তার আগে আনপঢ় ছিলুম ভাষাকে আক্রমণ করার গোপন চাবিকাঠি দিয়েছিলেন উনি  কর্তৃত্বকে আমি ইন্সটিংক্টিভলি ঘৃণা করি সমস্যা হল যে আমার নিজের কোনো বোন ছিল না ইসকুলের টিচাররা কোনোদিন শব্দের রহস্য বুঝিয়ে উঠতে পারেননি ।

              

বাবা রঞ্জিত ও মামা অমিতা


এগারো বছর বয়সে বাবার ফোটাগ্রাফির দোকানে বসে জিনিসপত্র বিক্রি করে তা ‘দিবসান্তে কতো টাকা রোজগার হইল’ ( Income ) বাঁদিকে আর  ‘দিনভর কি বিক্রয় হইল’ ( Items ) ডানদিকে খেরোর খাতায় লিখে রাখতুম বাবা কি পুঁজিবাদি উনি বলেন “বাড়িটা বানাবার জন্যে আর ভাইদের সংসারের জন্যে পুঁজিতে টান পড়ছে”  বাবা কি মজদুর আট ঘণ্টা ডার্করুমে কাটান অক্সিজেনের অভাবে প্লুরিসি হয়ে গেল মেজদা মারা গিয়ে আমাদের পরিবারে অমর হয়ে আছে জানেন কি আমার বাবা-কাকা-জ্যাঠা জীবন শুরু করেছিলেন ফিরিঅলা হিসেবে রঞ্জক সাবান জামের ভিনিগার পদ্মফুলের শুকোনো বিচি  নিচুতলায় বসবাস না করলে পুরো সমাজ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না পর্ণোগ্রাফির ফিল্মের চরিত্রদের মতন সাংবাদিকরা তাদের মালিকের অনৈতিকতায় ভোগে তারা বিমূর্ত ভাবনাচিন্তাকে ভয় পায় বিশেষ করে দোজখ-নাজেলের আতঙ্ক ।

. বাবা-মায়ের সঙ্গে মলয় ও সমীর ( দরিয়াপুরের বাড়িতে তোলা 

(ক্রমশঃ)


রোহিণী ধর্মপাল

                             

গৌরী ধর্মপালঃ বড় যখন ছোট হয় 

গৌরী ধর্মপাল। বাইরে যেমন, ভেতরে ঠিক তেমনটি। এ কিন্তু বড় সহজ নয়। ভেতরের সুরের সঙ্গে বাইরের সুরটিকে মেলানো। অত্মরাত্মার সঙ্গে বহিরঙ্গকে এক করে দেওয়া। দুই ক্ষেত্রেই শুধু এ সম্ভব। শিশু হলে অথবা ঋষি হলে। ভেবে দেখুন, শিশু আর ঋষির মধ্যে কতগুলি সাদৃশ্য আছে। শিশু সহজ সরল। যতক্ষণ না সমাজ তাকে জটিলতা কলুষতা শেখাচ্ছে। শিশুকে মিথ্যা বলতে আমরাই শেখাই কিন্তু। শিশু তার কল্পনার প্রসার ঘটায়। সেই কল্পনাকে মিথ্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে মস্ত ভুল হবে। শিশুর কাছে ওই কল্পনাই সত্যি। মনস্তত্ত্বে একটা দুর্দান্ত তত্ত্ব আছে। সর্বপ্রাণবাদ। এও কিন্তু ভারতীয় দর্শনেরই তত্ত্ব যেন; তবে তখন তা বড়দের তত্ত্ব। কিন্তু ছোটদের এই তত্ত্ব আর বড়দের দার্শনিক ভারিক্কি তত্ত্বের মূল ধারণাটি এক। আর তা হল, সব কিছুর মধ্যেই প্রাণ আছে। তা জীব হোক বা জড়। আর ছোটদের মধ্যে কিভাবে এই তত্ত্বটি কাজ করে? আপনাদের মধ্যে কে কে ভাবেন নি বলুন তো, যে চাঁদমামা আপনাকেই ভালোবেসে আপনার সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় যায়? হিসেব কষতে আমার সুবিধা হবে। অঙ্কে কাঁচা তো! কে কে ভেবেছেন বললে সংখ্যাটা এত বেড়ে যাবে যে গুণে উঠতে হাঁপিয়ে যাব! কারণ সারা পৃথিবীর শিশুরা চাঁদ নিয়ে ঘুরেফিরে এমনটাই ভাবে! বড় হওয়ার পরেও, একটু চিন্তা করুন, টানা বৃষ্টির পর রোদ উঠলে মনে মনে ভাবি, আমার জন্যেই এই আলো! আবার খুব কাজের দিনে অবিরল বৃষ্টিপাতে মনে ভাবনা আসে, আজ এত দরকারি দিনটা! আজকেই বৃষ্টি শুরু হল এমন! ঘুরেফিরে কিন্তু নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমরা বড়রাও যুক্ত করে দি! শুধু বাইরে বলি না। সচেতন মনে জানি, এ নেহাতই বোকা বোকা। সবাই শুনলে হাসবে! শিশু এসব ভাবনদারির তোয়াক্কা করে না। সে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, কী মজা কী মজা! আমিও যাচ্ছি, চাঁদমামাও যাচ্ছে। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল, প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামার পর, ভেতরে থেকে ট্রেনের জানলাতে যে ধাক্কাটা আমি দিই, তাতেই আবার ট্রেন চলে! নিজের বিপুল শক্তি সম্পর্কে গর্ববোধ হতো না, কারণ ওটাই স্বাভাবিক ছিল! আমি না ঠেললে ট্রেন চলবে কী করে!!!
আমার বিশ্বাস, আপনাদের অনেকেই ছোটকালে এমন শক্তিধর ছিলেন! ছোটদের শক্তিশালী হতে গায়ে জোর লাগে না! মনের সারল্য দিয়েই  ডানায়ালা পরীরা তাদের সঙ্গে কথা বলে যায়, পক্ষীরাজ ঘোড়া তাদের পিঠে চাপিয়ে তেপান্তরের মাঠে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর সঙ্গে দেখা করিয়ে আনে, ভাঁটার মত চোখ আর মূলোর মত দাঁত নিয়ে রাক্ষসেরা ভয় দেখায়! এ যদি মিথ্যা হয়, তবে এ মিথ্যা বড় মোহময়, বড় মধুর! কিন্তু গৌরীর এই সারল্য আজীবন ছিল! নয়ত এমন লিখলেন কি করে ----" কারিগর বানায় সব আজব আজব জিনিষ--
পিঁপড়েদের পায়ের নূপুর--
     সারাদিন আসবে যাবে
      ঝুমঝুম শব্দ হবে।
প্রজাপতি পাখার ঢাকা --
     সারা বছর রোদে জলে
      রঙ যেন না জ্বলে গলে।
ঘাসপোকা-পুকির ওড়না--
   আহা, ওরা বড্ড লাজুক 
   ওড়নায় মাথাটি ঢেকে
           সহজে চলুক ফিরুক।"
আর এসব বানাতে কারিগরের কি কি লাগে? গৌরী লিখছেন, 
       "নীল মাকড়সার জাল
সন্ধে মেয়ের এলোচুলে                              জোছনা জরির জাল।
       টাটকা দুধের ফেনা
ঝরছে ঝরুক ঝরছে ঝরুক 
ধান-শিশিরের কণা।
মেঘডম্বর কু  য়া  শা
শিমুলতলার তুলো।
ঘাসের বনে কে ছড়ালি রাঙা রোদের গুঁড়ো ।
   শিরীষ ফুলের রোঁয়া 
   পুজোবাড়ির ধোঁয়া 
    উড়াল পাখির পালক। 
     ভোরের হাওয়ার ঝলক।
   শোলার পঙ্খী শোলার ফুল সুখু মেয়ের রুখু চুল--এই সব।"
 
শিশু-মন ছাড়া রোদের গুঁড়ো জোছনা জরির জাল মেঘডম্বর কুয়াশা কি দেখা যায়? রাজকন্যা চাইলেই কি হাওয়ার মত হালকা আর রোদের মত শাড়ি, বৃষ্টি-রিমঝিম নূপুর আর সুরসুড়ি পাতার ঘন্টি লাগানো শুঁড় তোলা কাশ-ফুরফুরে জুতো বানাতে পারার মত কারিগর নির্মাণ করা যায়?

ঠিক একই রকম সৎ সহজ হলেন ঋষিও। সৎ চিৎ আনন্দ, এই দিয়ে তাঁর অন্তরাত্মার আকাশ গড়া। ঋষি কে? না যিনি সত্যবাক্। যিনি জ্ঞান ও সংসারের পারে চলে যান। জ্ঞানের পারে যাওয়া মানে কি? অর্থাৎ তুমি জেনেছ। অথচ জানার জন্য যে অহম্ হওয়ার কথা, সেটি হয় নি। হবেই বা কি করে! যে জানে, যে জেনেছে, সে এও বুঝে গেছে যে সেই সর্বশক্তিমান আর তুমি এক। যে ঈশ্বরের সাধনা ভজনা করে সবাই, যাঁর কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে; আর তুমি, একটা সাধারণ ময়লা মত, কোণের দিকে একটু ছেঁড়া মত, রান্না করছ বা আপিস করছ; আসলে এক! তখন আর অহম্ টি থাকে না। না জানলেই যত বড় বড় কথা আসে। নিজের সম্পর্কে বড় বড় ভাবনা আসে। যিনি জেনেছেন, তিনি সমাহিত হয়ে যান।
আর সংসারের পারে যাওয়া? শুনতে সহজ কিন্তু বড়ই দুরূহ। ঝগড়া ক্ষমতার লড়াই জটিলতা ঈর্ষা লোভ সব গিজগিজ করতে থাকে তো মনের মধ্যে! সেই সব নোংরা কাদা ঠেলে ক'জন পারে সেই গভীর অন্ধকারের পথ পেরিয়ে যেতে?
এই অন্ধকারটিকে আবার অন্ধকার বলে চেনা কঠিন। এই বাইরেটা চকচকে চোখ ধাঁধানো আলোতে আপাদমস্তক মোড়া। ভেতরটা ঢনঢনে। কিন্তু ঋষি যিনি, তাঁর মনের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলে প্রাণের প্রদীপ। সেই স্বল্প আলো দিয়ে তিনি বুঝে যান কোনটি অবিদ্যার আলো, কোনটি বিদ্যার আলো। গৌরী ছিলেন এমন এক ঋষি। সেই বেদের যুগের ঋষিদের মতোই। জ্ঞানের গরিমায় যেন বাক্, প্রতিবাদের তেজে যেন গার্গী, গৃহকর্মে সন্তান প্রতিপালনে যেন কাত্যায়নী। সবেতে খুশি। কোনো চাহিদা নেই। লোভ নেই। ঈর্ষা নেই। আড়ম্বর নেই। বাইরের সাজ নেই। যত মধু যত স্নেহ মায়া দিয়ে হৃদয়টি এদিকে সোনায় মোড়া। এমন মানুষই তো শিশুদের জন্য লিখতে পারেন অনায়াসে। এমন লেখনী না হলে শিশুদের জন্য ভালবাসার গল্প লেখা যায়? এই পৃথিবীর মাটিতে বড় হওয়া চাঁদনি আর আকাশের চাঁদের প্রেমের গল্প?
" শুধু একেকদিন পূর্ণিমার রাতে চাঁদের সাধ যায় চাঁদনীকে নিয়ে পাড়ি দিতে, সেই চাঁদ-দূরে দুটি রূপোলি মাছের মত নীল জোছনার শায়রে ভাসতে ভাসতে। ভুবন-মা বলেন, যাস নেরে, যাস নে। চাঁদ তবু যায়। অমনি মায়ের বুক টনটন করে ওঠে। শিরায় শিরায় টান ধরে।
বুকের সাগর উঠাল পাথাল করে। বট শিমুল দেবদারুর মাথা পর্যন্ত গিয়ে আটকে যায় চাঁদ। ভুবন -মা বাড়িয়ে ধরেন তাঁর অলখ রশির মই। তাই বেয়ে তারা নেমে আসে। একজোড়া চাঁদ ৷ চাঁদ আর চাঁদনী।" (চাঁদনি)

 



বাসব মণ্ডল

                           

খলিল গিবরানের অনুবাদ কবিতা - 
মুখ

----
আমি একটা মুখ দেখেছি
যার হাজার অবয়ব,
আবার এমন মুখ ও দেখেছি
যার একটাই অবয়ব,যেন
ছাঁচে ফেলা।

আমি এমন একটা মুখ দেখেছি
যার আস্তরণ সরালে
শুধুই নোংরামো,আবার
এমন মুখ ও দেখেছি
যার আড়াল সড়িয়ে
খুঁজে নিতে হয়েছে সৌন্দর্য্য।

আমি একটা বয়স্ক মুখ দেখেছি
যাতে ছিল অন্তহীন শূন্যতা
আবার, এমন তুলতুলে মুখ দেখেছি
যাতে খনিত ছিল অনন্ত।

আমি মুখগুলো চিনি,কারণ
আমি আমার চোখের বোনা
চাদর ভেদ করে দেখি,আর
নিহিত বাস্তবটা অবলোকন করি।

ওই কাকতাড়ুয়াটা
-----------------------------
একদা একটা কাকতাড়ুয়াকে
বলেছিলাম "এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
নিশ্চই ক্লান্ত লাগে?"

সে বলেছিল " লোককে ভয় দেখানোর

একটা আলাদা আনন্দ আছে, আমি তা

উপভোগ করি।"

আমি একটু ভেবে বলেছিলাম "ঠিক বলেছো,
আমি ও এই আনন্দ উপভোগ করেছি।"

সে বলেছিলো " হুঁ , যাদের ভিতরটা খড় দিয়ে ঠাসা,
তারা এটা বেশী বোঝে।"

আমি তারপর ওখান থেকে চলে গেছিলাম,
ভাবতে ভাবতে
যে সে আমায়
প্রশংসা করলো না ব্যাঙ্গ করলো।

এক বছর পর, আমি দেখলাম
কাকতাড়ুয়াটা দার্শনিক হয়ে গেছে,
আর তার টুপির নীচে
দুটো কাক
তাদের বাসা তৈরী করেছে।


ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

                                          

তিন মায়ের গল্প


এক অক্ষরের একটা শব্দ – মা, কিন্তু কি অনন্ত ব্যাপ্তি শব্দটার !গর্ভধারিনী জননী,দেশ মাতৃকা, ঈশ্বর । আমাদের পরম স্নেহের আশ্রয় মা।বিশ্বের তাবৎ অভিধানে একই অর্থ এই একটিমাত্র অক্ষরের শব্দ মা’র ।মায়ের কথা, মা কে নিয়ে কথার কোন শেষ নেই । আমি তিন মায়ের কথা বলব ।তিন ‘মা’ই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকার জগৎ থেকে এসেছিলেন, তারপর আপন নিষ্ঠা আর তন্ময় সাধনায় মহিয়সী নারীর মর্যাদা আদায় করতে পেরেছিলেন ।সুকুমারী দত্ত বা গোলাপসুন্দরী প্রথম মহিলা নাট্যাভিনেত্রী থেকে বাংলার প্রথম মহিলা নাট্যকার , নটী বিনোদিনী তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেত্রী এবং ইন্দুবালা সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ।এই তিন মায়ের গল্পে আছে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার কথা,অবহেলার অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করে আপন প্রতীভায় মাথা-উঁচু করা প্রতিষ্ঠার কথা । 

সুকুমারী দত্ত

১৮৭৩ নগর কলকাতা থিয়েটারের শহর হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে , এক বছর আগে  ধনি জমিদার বাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে মুক্তি পেয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে থিয়েটারের দরজা । ১৮৭২এর  ৬ই ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশানাল থিয়েটার ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ।বাংলা থিয়েটারের সেই শৈশবে ধনকুবের ছাতুবাবু বা আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎকুমার ঘোষ খুললেন বেঙ্গল থিয়েটার । শরৎকুমার মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নাটক লিখে দেবার জন্য ।মাইকেল নাটক লিখেদিতে সম্মত হলেন একটি শর্তে, তা হল তাঁর নাটকে স্ত্রী চরিত্রের অভিনয় নারী অভিনেত্রীকে দিয়েই করাতে হবে ।বেঙ্গল থিয়েটারের উদ্যোক্তারা বারাঙ্গনাপল্লী চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন তাদেরই একজন ছিলেন গোলাপসুন্দরী । মাইকেল তখন মৃত্যুসশয্যায় তবু মাইকেল বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য  নাটক লিখে দিলেন ‘মায়া কানন’ ।থিয়েটার উদবোধনের আগেই মধুসূদনের মৃত্যু হওয়ার কারণে তারা মায়াকানন দিয়ে থিয়েটারের উদবোধন করলেন না । ৮৭৭৩এর ১৬ই অগস্ট বেঙ্গল থিয়েটারের উদবোধন হল মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে ।অভিনয় করলেন বারাঙ্গনাকন্যা গোলাপসুন্দরী । বাংলা থিয়েটারের প্রথম নারী অভিনেত্রী ।শেষ হল নাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার ।এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা । মাইকেল মধুসূদন এই ঘটনা দেখে যেতে পারেননি ।

বারাঙ্গনাকন্যা গোলাপসুন্দরীর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম বিস্ময়কর ।সাহায্য পেয়েছিলেন এক মহতী হৃদয় মানুষের, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস । উপেন্দ্রনাথ গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তর সঙ্গে । এই ঘটনা তখনকার সমাজে প্রবল নিন্দাবাদ হয়েছিল । উপেন্দ্রনাথকে নিজের পিতৃসম্পর্কও ত্যাগ করতে হয়েছিল । গোষ্ঠবিহারী – সুকুমারীর মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্যজীবনের ব্যবস্থা উপেন্দ্রনাথ করেছিলেন । তারা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন । এই সময় উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্পর্ক পুণস্থাপিত হয় । তিনি উপেন্দ্রনাথকে বিলাতে পাঠিয়ে দেন । উপেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে গোষ্ঠবিহারীও জাহাজের খালাশি হয়ে বিলাত চলে যান । সুকুমারী স্বামী পরিত্যক্তা হন, তখন সে এক কন্যাসন্তানের জননী । 

স্বামী পরিত্যক্তা সুকুমারী থেমে থাকেননি । সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন । কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না ।  ন্যাশানাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন ।  ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন । অর্থকষ্ট সামাল দিতে  সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক । নাটকটি অভিনীতও হয়েছিল । বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে ।

একমাত্র কন্যার শিক্ষার বিষয়ে কোন অবহেলা করেননি সুকুমারী । কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে । কিন্তু একটা দুঃখ বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে । মেয়ের শশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখার অধিকার ছিল না সুকুমারীর ।

১৮৯০-৯১ পর্যন্ত গোলাপ নানান থিয়েটারে অভিনয় করেছেন । তারপর কবে চলে গেলেন তা জানা যায় না । অন্ধকার জগত থেকে আলোয় ফেরা গোলাপদের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ তখনকার সমাজ মনে রাখেনি । গোলাপ তার কন্যাকে পিতৃ ও মাতৃ পরিচয় দিতে পেরেছিলেন কিন্তু আর এক জননী বিনোদিনী তাও পারেননি ।

বিনোদিনী দাসী

বিনোদিনীর সঠিক জন্মতারিখ জানা যায় না, জানা যায় না তাঁর পিতৃপরিচয়ও । আনুমানিক ১৮৬৩তে তাঁর জন্ম। বিনোদিনীর জন্মবৃত্তান্তে নিশ্চিত ভাবেই আমাদের আগ্রহ নেই । তিনি তাঁর আত্মকথায় বারবার নিজেকে হীন বারাঙ্গনা বলে উল্লেখ করেছেন । বাংলা থিয়েটারের সেই আদিপর্বে,  সহায়সম্বলহীনা এক বালিকা সমাজের অন্ধকার স্তর থেকে ঊঠে এসে অসামান্য প্রতিভা ও মেধায় , থিয়েটারকে ভালোবেসে, আপন তন্ময় সাধনায় এক মহিয়সী নারীর মর্যাদা অর্জন করেছিলেন । থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চেয়েছিলেন । 

থিয়েটারের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন বিনোদিনী – নিজেকেও । মারোয়াড়ি যুবক গুর্মুখ রায় একটা স্থায়ী থিয়েটার নির্মাণ করে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। বিনিময়ে বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে । এবং সেই থিয়েটারের নাম হবে বিনোদিনীর নামে ‘বি থিয়েটার’ । সমস্ত আত্মগ্লানি দূরে সরিয়ে রেখে বিনোদিনী সম্মত হলেন ।  তাঁর নাট্যশিক্ষক গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীকে এক অর্থে বিক্রি করে দিলেন গুর্মুখ রায়ের কাছে । থিয়েটার নির্মিত হ’ল , কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতো ‘বি থিয়েটার নয় - বিনোদিনীকে বঞ্চনা করে গিরিশ বাবুদের কৌশলে সেই থিয়েটারের নামকরণ হল ‘ষ্টার থিয়েটার’ , ১৮৮৩’র ২১শে জুলাই । কারণ , এক বারাঙ্গনার নামে থিয়েটার নাকি সেকালের সমাজপতি ও ভদ্রসমাজের  অনুমোদন পেতো না । বিনোদিনী গুর্মুখ রায়ের সঙ্গে ছিলেন মাত্র ছ মাস ।  গুর্মুখ চেয়েছিলেন যার নামে থিয়েটার করেছেন তাকেই অর্থাৎ বিনোদিনীকে ষ্টার থিয়েটার’এর মালিকানা দিয়ে যাবেন , অন্তত ৫০ভাগ অংশ তাঁকে দেবেন । এ ক্ষেত্রেও গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল মিত্ররা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন, বিনোদিনী তাঁর অংশ পেলেন না । মাত্র ১১হাজার টাকায় ষ্টার থিয়েটারের মালিকানা হস্তান্তরিত হ’ল অমৃতলাল মিত্র সহ চার জনের নামে ।

বিনোদিনী শুধু নিজেই অভিনয় খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন তা নয় তাঁর অসামান্য অভিনয় সেকালের বাংলা থিয়েটারকেই মর্যাদামন্ডিত করেছিল । সে যুগে সম্ভ্রান্ত মানুষের চোখে নাট্যাভিনয় হীন কাজ বলেই বিবেচিত হতো ।  বিনোদিনীর অভিনয় দেখতে থিয়েটারে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র । তাঁর ‘মৃণালিনী’ নাটকে মনোরমার চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেম “আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ করিব আমন আশা করিনাই । আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল” । ১৮৮৪র ২রা আগস্ট গিরিশচন্দ্রের চৈতন্যলীলা মঞ্চস্থ হল স্টার থিয়েটারে । চৈতন্যের ভুমিকায় বিনোদিনী । রামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন নাটক দেখতে । শ্রীচৈতন্যের চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয়ে পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেব ভাববিহ্বল হয়ে বিনোদিনীকে আশির্বাদ করেন । বলেন “আসল নকল এক দেখলাম” । পঙ্ক থেকে পঙ্কজা হয়ে ওঠার মত বিনোদিনী শ্রীচৈতন্যের চরিত্রের সার্থক রুপায়নের মধ্য দিয়ে বারাঙ্গনা জীবনের আত্মগ্লানি মুছে ফলতে চেয়েছিলেন । শ্রীরমকৃষ্ণের স্পর্শে বারাঙ্গনা নটী বিনোদিনী কলুষমুক্তির আস্বাদ পেলেন, তেমনই রঙ্গালয়েরও অস্পৃষ্যতা মুক্তি ঘটলো, থিয়েটারকে মর্যাদার আসনে স্থাপন করলেন বিনোদিনী । 

১৮৮৬তে মঞ্চ ত্যাগের ২৬ বছর পরে বিনোদিনী তাঁর আত্মকথা ‘আমার কথা’ লিখতে শুরু করেন । আমাদের নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে বিনোদিনীর উল্লেখ নিতান্ত দায়সারা ভাবে একজন অভিনেত্রী রূপে উল্লেখ হয় । আত্মকথার ভুমিকায় বিনোদিনী লিখেছেন “ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয়-জ্বালার ছায়া ! পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা,শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরতা ! কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই ! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই – কেননা আমি জগত মাঝে কলঙ্কিনী, পতিতা । আমার আত্মীয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই” । সেকালের সমাজের কাছে বিনোদিনীর জিজ্ঞাসা ছিল “... বারাঙ্গনার জীবন কলঙ্কিত  বটে ! কিন্তু সে কলঙ্কিত ঘৃণিত কোথা হইতে হয় ? জননী জঠর হইতে তো একেবারে ঘৃণিত হয় নাই । ...অনেকেই পুরুষের ছলনায় ভুলিয়া তাহাদের বিশ্বাস করিয়া চির কলঙ্কের বোঝা মাথায় লইয়া অনন্ত নরকযাতনা সহ্য করে। সে সকল পুরুষ কাহারা ? যাহারা সমাজ মধ্যে পূজিত আদৃত তাহাদের মধ্যে কেহ নন কি” ?

অথচ কি হিমালয়প্রমাণ বঞ্চনা, প্রতারনা আর উপেক্ষার স্বীকার হয়েছিলেন পঙ্কজা থেকে মহিয়সী হয়ে ওঠা এই রমনী । মঞ্চ ও অভিনয় ত্যাগের পরও বিনোদিনী বেঁচে ছিলেন আরো পঞ্চান্ন বছর তার মধ্যে সাহিত্যচর্চা করেছেন চল্লিশ বছর । দুটি পর্বে তাঁর আত্মকথা ছাড়াও রচনা করেছিলেন ‘বাসনা’ ও ‘কনক ও নলিনী’  নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ । কিন্তু লেখিকা রূপে বিনোদিনীর অবদান এখনো গ্রাহ্য হয় নি । যদিও তিনিই ছিলেন বাংলার ২য় মহিলা আত্মচরিত লেখিকা । বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য ইতিহাস তন্নতন্ন করে খুঁজলেও সেকালের মহিলা লেখিকা রূপে বিনোদিনীর বিন্দুমাত্র উল্লেখ পাওয়া যাবে না ।

১৮৮৬’তে থিয়েটার থেকে বিদায় নেবার পর বিনোদিনী উত্তর কলকায় এক উদার হৃদয় ব্যক্তির আশ্রয়ে বধু জীবন যাপন করেন । সেখানেই তাঁর এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে, নাম দেন শকুন্তলা । কন্যাকে আশ্রয় করে বিনোদিনী পূর্বের অনেক ক্লেদাক্ত স্মৃতি ভুলে যান । বিনোদিনীর বাসনা ছিল কন্যা শকুন্তলাকে শিক্ষাদান করে সমাজের মুলস্রোতে নিয়ে আসবেন । কিন্তু সেকালের রক্ষণশীল সমাজ শকুন্তলার বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন । অথকথায় বিনোদিনী তীব্র ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন "... আবার এই বিপন্নাদের পদে পদে দলিত করিবারজন্য ঐ অবলা-প্রতারকেরাই সমাজপতি হইয়া নীতি পরিচালক হন । যেমন ভাগ্যহীনাদের সর্বনাস করিয়াছেন, তাহারা যদি তাহাদের সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের সত১১পথে রাখিবার জন্য কোন বিদ্যালয়ে বা কোন কার্য শিক্ষার জন্য প্রেরণ করে, তখন ঐ সমাজপতিরাই শত চেষ্টা দ্বারা তাহাদেরসেই স্থান হইতে দূর করিতে যত্নবান হন"। ... শত দোষ করিলে ক্ষতি নাই ; কিন্তু 'নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ' । কন্যাকে আশ্রয় করে বিনোদিনী তাঁর বারাঙ্গনা জীবনের গ্লানি ভুলতে চেয়েছিলেন ।  কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৮৯১এ সেই কন্যার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন বিনোদিনী । এর দুবছর পর তাঁর  শেষ আশ্রয়দাতারও মৃত্যু হয় , বিনোদিনী ফিরে যান তার ১৪৫ নম্বর কর্নোয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িতে । সেখানেই সবার অলক্ষ্যে অনাদরে অবহেলায় একদা পঙ্কজা থেকে বাংলা থিয়েটারের রাজেশ্বরী হয়ে ওঠা বিনোদিনীর মৃত্যু হয় ১৯৪১এ । না কোন শোক সভা হয়েছিল কিনা, কোন সংবাদ পত্র প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল কিনা তাও জানা যায়না । 

তিন মায়ের গল্পের তৃতীয় যে মায়ের কথা বলব তিনি সুকুমারী ও বিনোদিনীর চেয়ে আরো চল্লিশ বছর পরে জন্মেছিলেন । এদের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক প্রতিষ্ঠাও তিনি পেয়েছিলেন । কিন্তু নিষিদ্ধপল্লী রামবাগানের বাস ছেড়ে কোন সম্ভ্রান্ত অঞ্চলে চলে আসতে চাননি । বলতেন 'রামবাগান আমাকে যশ, খ্যাতি, অর্থ সব দিয়েছে । আমি রামবাগান ছেরে যাব কেন ? আমি রামবাগানের ইন্দু' । তিনি সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা যাকে চিত্র-মঞ্চ - যাত্রা-সাংস্কৃতিক জগতের শিল্পী_কলাকুশলীরা আজও 'ইন্দুমা' বলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন ।

এই লেখার অন্য দুই মায়ের মত ইদুবালা পিতৃপরিচয়হীনা ছিলেন না, বরং পিতা ছিলেন নামকরা মানুষ । মায়ের নাম রাজবালা । রাজবালার মা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা, স্বামীর অকালমৃত্যুর পরে অবস্থার বিপাকে এক ধনীর রক্ষিতার জীবন পান এবং আশ্রয় হয় রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতে । মায়ের মৃত্যুর পরে অন্য দুই বোনের সঙ্গে রাজবালারও আশ্রয় হয় নিষিদ্ধপল্লীতে । নিতান্ত বালিকা রাজবালা নিষিদ্ধপল্লীর ভবিতব্য মানতে চাননি । সেখান থেকে মুক্তির জন্য সুযোগ পান সার্কাশের দলে যোগ দেবার । সাত বছরের বালিকা যোগ দেন প্রফেশর বোসের সার্কাশে । মালিক ছিলেন মতিলাল বোস – সেকালের প্রসিদ্ধ নাট্যকার মনমোহন বোসের পুত্র । ছবছর পরে মতিলাল বিবাহ করের রাজবালাকে । ইন্দুবালার জন্ম হয় অমৃতশরে ।

মতিলাল চেয়েছিলেন মেয়ে ইন্দুকে নিয়ে রাজবালা সার্কাশেই থাকুন আর রাজবালা চেয়েছিলেন কলকাতায় স্বামী কন্যাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে ।রাজবালা আর সার্কাশে ফিরে যাননি । তিনবছরের মেয়ে ইন্দুকে নিয়ে রামবাগানেই বাসা বাঁধেন । সেকালে থিয়েটার ছিল বারাঙ্গনা কন্যাদের মুক্তির আশ্রয় । রাজবালা থিয়েটারে যোগ দিলেন, খ্যাতিও পেলেন যথেষ্ঠ । 

রাজবালা ইন্দুর লেখাপড়ার আয়োজন করেছিলেন, তাকে ভর্তি করেছিলেন স্কুলে । কিন্তু মায়ের অসুস্থ্যতার কারনে ইন্দুর স্কুলশিক্ষায় ছেদ পড়ে । জনৈক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় ইন্দু নার্সিং ত্রেনিং নিতে শুরু করেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে ।  কিন্তু সেখান থেকেও পালিয়ে আসেন । এরপর শুরু হল গান শেখা । ওস্তাদ গৌরীশঙ্কর মিশ্রের কাছে তালিম নিতে শুরু করলেন । সেকালের বিখ্যাত গায়িকা গহরজানের সান্নিধ্য লাভ করলেন । ক্রমে ইন্দু সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠা পেলেন । বিভিন্ন দেশীয় রাজার দরবারে দরবার গায়িকা রূপে ক্যাতি ও প্রতিপত্তি পেলেন ।

ইন্দুর সঙ্গীত প্রতিভাকে ব্যবহার করতে দেরি করেনি সেকালের বাংলা থিয়েটার ।সবকটি পেশাদারী থিয়েটার স্টার, মিনার্ভা মনমোহনে ইন্দু অভিনেত্রী ও গায়িকা রূপে খ্যাতি অর্জন করলেন ।এই সময়ে ইন্দু কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে আসেন । ইন্দুবালা থিয়েটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু গানেই ডুব দিলেন । ১৯১৬তে প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান করেন আর তারপরেই ক্রমে প্রবল জনপ্রিয়তায় হয়ে ওঠেন 'সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী' । একদিকে খেয়াল, দাদর্‌ ঠুমরি কিংবা ভজন, অন্যদিকে নজরুলের গান, ভক্তিগীতি, নাটক ও সিনেমার গান – ইন্দুবালার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হল । ১৯৭৫এ পেলেন সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা, পরের বছর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর সম্মানে প্রকাশ করলো গোল্ডেন ডিস্ক । কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে বসে উদবোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা । খ্যাতির শীর্ষ স্পর্শ করেও ইন্দুবালা কোনদিন মাটি থেকে পা সরিয়ে নেননি । দেশজোড়া খ্যাতি সত্তেও ইন্দুবালা রামবাগানের বাসা ছেড়ে যাননি । একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার । এই দিয়ের মাঝে সুরের আকাশে উজ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা – সকলের শ্রদ্ধার ইন্দু মা ।

সাহিত্যিক সমরেশ বসুর স্ত্রী গৌরী বসু, যিনি ইন্দুবালার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে তাঁর কাছে সঙ্গীতশিক্কা করকে, তাঁকে লেখা এক পত্রে ইন্দুবালা লিখেছিলেন " কেন আমি ভদ্র ঘর থেকে ইন্দুবালা হতে পারিনি । কিসের জন্য এই পল্লীর মেয়ে আমি ! জানো মা গৌরী । দুনিয়াসুদ্ধ সকলে বলে আপনি ভদ্র পল্লীতে যান, স্কুল করুন, আপনার জিনিস সব দান করুন, শেখান ইত্যাদি ইত্যাদি । তা কি হয় নাকি ? দিদিমা বনবিষ্ণুপুর থেকে এসেছিলেন, চাটুজ্জেবাড়ির মেয়ে মুখুজ্জেবাড়ির বৌ হয়ে । পরে বিধবা হয়ে এই পাড়ায় । তিন পুরুষের বাস কি ভাঙতে পারি ! পারবো না । কারণ ভগবান যে শাস্তি দিয়েছেন মাথা পেতে নিয়েছি...কিছু তো লুকুই নি মা ।... মানা অর্থাৎ প্রণব(ইন্দুমার পালিত পুত্র)সেও জানে যে তার জীবনে সে যখন অভিজাত পাড়ায় বাড়ি করবে তখন তার এই মা কোনদিন যাবে না "। এই রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতেই সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী – সকলের ইন্দূমা'র মৃত্যু হয় ১৯৮৪র ৩০শে নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে ।

তিন মায়ের অন্ধকার থেকে লড়াই যেন একাকার হয়ে গেছে । এই লেখা শুধু তিন মায়ের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার কথা নয়, সেই সময়ের অনেক মায়ের কথাই ধরা আছে এই লেখায় ।

তথ্যসূত্র (১) 'রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী'/ অমিত মৈত্র (২)'আমার কথা' / বিনোদিনী দাসী (৩) 'সুকুমারী দত্ত ও অপূর্বসতী নাটক' / সম্পাদনা বিজিতকুমার দত্ত, নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২ (৪)'ইন্দুবালা – স্মৃতি ও প্রণতি' / বাঁধন সেনগুপ্ত ।

 

পৌলমী দেব

                               

   
#বাঁধন

মাকে আমি সাঁকো বলি

যে জুড়ে রেখে দেয় হরেক নামের পাড়ের সাথে

সাঁকো ছুঁয়ে যাতায়াত চলে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়

সাঁকোর আয়ুর সাথেই কখন সমানুপাতিক হয়ে ওঠে সম্পর্কের আয়ু

পথ ঘাট একই থাকে
দূরত্বও সেই একই থাকে

শুধু সাঁকোর অভাবে আর পারাপার করা হয়না



#স্বরলিপি

মঞ্চে যখন মার  গান শেষ হতো
হাততালির জোয়ারে ভেসে যেত স্টেডিয়াম
মার মুখ যত উজ্জ্বল হয়ে উঠতো
তত মাকে অচেনা মনে হতো
আমার সাধারণ মা সুরের ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে উঠতো
 
আমার চোখ শিল্পী মায়ের থেকেও বেশি খুঁজতো, রোজকার আটপৌরে মাকে
মা বলতো,গান আমার খোলা আকাশ

মায়েদের জন্য তো বরাদ্দ চার দেওয়াল
খোলা আকাশ তো দেওয়া যাবেনা
দেওয়া হলোও না শেষপর্যন্ত

মা অভিমানী ছিল,প্রতিবাদী নয় 
সাদা কালো রিডের গায়ে লেগে থাকা সুরগুলোকে কাঠের বাক্সে কফিনবন্দি করেছিলো নিজের হাতে

তারপর,কতদিন মায়ের কাছে আব্দার করেছি
গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে
কোনোদিন মা পুরো গান গাইতে পারেনি
গলা বুঁজে এসেছে কান্নায়

তখন বুঝিনি 
কেন মায়েদের গান আভোগ স্পর্শ করেনা
থেমে যায় অন্তরা অথবা সঞ্চারীতেই



#ফাঁকি

মায়েরা অংক বোঝেনা

বোঝেনা ঠিক কতটা দিলে কতটা ফেরত নিতে হয়

কনকাঞ্জলির এক মুঠো চালেই তাই সমস্ত ঋণ শোধ করা হয়ে যায়
                    
                         ****
মায়েরা ভূগোল বোঝেনা

পাহাড়,সাগর,মালভূমি সবই খুঁজে নেয় চৌহদ্দির ঘেরাটোপে 

আহ্নিক গতি,বার্ষিক গতির চাকায় সংসারই  তাদের মানচিত্র হয়ে ওঠে
              
                       *****

মায়েরা ইতিহাস বোঝেনা

নিজের জমির জন্য বিদ্রোহকে রূপকথা মনে করে

জমির স্বত্ব হারাতে হারাতে কখন একদিন নিজেদেরই হারিয়ে ফেলে

                    ******
মায়েরা সাহিত্য বোঝেনা,তাই শখের বইগুলোর উপর পড়তে থাকে অবহেলার ধুলো

মায়েরা অর্থনীতি বোঝেনা,তাই দিনের শেষে তাদের ভাগে পড়ে থাকে একরাশ শূন্য

মায়েরা রাষ্ট্রনীতি বোঝেনা, তাই অধিকারগুলো  চিনে নিতে পারেনা কোনোদিনও


মায়েরা শুধু এটুকুই বোঝে,
কি করে সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থেকে যেতে হয় শুধুই মা হওয়ার জন্য....










               




গৌতম দত্ত

                                       



মা----


“খোকা মাকে শুধায় ডেকে–

‘এলেম আমি কোথা থেকে,

কোন্‌খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’

মা শুনে কয় হেসে কেঁদে

খোকারে তার বুক বেঁধে–

‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’।……

…………………

…………………

যৌবনেতে যখন হিয়া

উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া,

তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে,

আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে

জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে

তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে।……” - “জন্মকথা” – রবীন্দ্রনাথ।


এই পংক্তিগুলো যেসময় প্রথম পড়েছি বা আবৃত্তি করে শুনিয়েছি কাছের মানুষদের, তখন আমার ছেলেবেলা। এমন একটা দার্শনিক কবিতার অর্থ বোঝার বয়স তখন নয়। ছন্দে সুরে অকারণেই উচ্চারণ করেছি বারংবার। 


অনেক পরে, যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজে……যখন হাল্কা চটুল রসের গল্পে আস্তে আস্তে বুঝছি প্রকৃতির সৃষ্টি রহস্য। ফুল থেকে ফল। অঙ্কুরিত মুকুলের বৃক্ষ হ’য়ে ওঠা। যৌবনে ক্রমশঃ পেকে উঠছিলাম এক নিষিদ্ধ রহস্যময়তায়, নারীদেহের অদৃশ্য কল্পিত বর্ণনায়— হয়তো তার কিছু আগেপিছে হঠাৎ করেই আবৃত্তি করতে গিয়ে চেতনায় লাগল ধাক্কা !  “যৌবনেতে যখন হিয়া / উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া, / তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে,” এই পংক্তিগুলো বয়ে আনলো আলো… জীবনের, সৃষ্টির। 


“আঠাশ দিনের মাথায় আমার 

রক্তকলস পূর্ণতা পায় 

আঠাশ দিনের মাথায় গাছের 

ডগায় ফুটছে রুদ্রপলাশ 

এখন আমার সানুদেশ জুড়ে 

কুয়াশা জমছে নীরক্ত শ্বেত 

রক্ত নামছে ঊষর মাটিতে 

মাভূমি গুল্মগর্ভা হবেন।” - “মা-ভূমি” – মল্লিকা সেনগুপ্ত


জানলাম, কেমন ক’রে এলাম এ জগতে। কার দৌলতে ? অনুভব করতে পারলাম, কেন একজনের গায়ের গন্ধ না পেলে ঘুম আসতো না দু-চোখে—সেই আমার মা’কে। অন্দরমহলে মা’ই ছিল সবকিছু। বাইরে বাবা। আমার কিছু একটা বিপদ-আপদ হলেই যে উদ্বিগ্নতার ছায়া পড়তো তাঁদের দু-চোখে সেটা আবার অনুভব করেছি অনেক পরে। নিজে যখন বাবা হলাম। 


ছোট্ট থেকে তিল তিল ক’রে আঁকড়ে যে মানুষটা আমাদের বড় করে দিল সে আমাদের মা। মা-এর আরেক অর্থ জন্মভূমি। আমাদের দেশ। 


“………

নমোনমো নম সুন্দরী মম   জননী বঙ্গভূমি!

গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর,   জীবন জুড়ালে তুমি।

অবারিত মাঠ, গগনললাট  চুমে তব পদধূলি, 

ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়   ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।

পল্লবঘন আম্রকানন   রাখালের খেলাগেহ,

স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল--  নিশীথশীতল স্নেহ।

বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ   জল লয়ে যায় ঘরে--

মা বলিতে প্রাণ করে আনচান,   চোখে আসে জল ভরে।……”  - “দুই বিঘা জমি” – রবীন্দ্রনাথ।


আরো অনেক পরে, যখন চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যে’র সেই সংলাপ শুনেছি তা মর্মে মর্মে ধাক্কা দেয় এখনো এই বুড়ো বয়সে এসেও—রাজা চন্দ্রগুপ্তকে যখন তাঁর মা বলছেন যে পালিত ভাই নন্দ’কে শাস্তি দিতে, মায়ের কেশ আকর্ষণ করে মা’কে শূদ্রাণী বলার জন্য, চন্দ্রগুপ্ত কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না ভাইয়ের প্রতি বিরূপ হ’তে।  মা চন্দ্রগুপ্তকে বলছেন যে ভাই আজ তার কাছে বড় হলো মা’র চেয়ে !  সে সময়ে মন্ত্রী চাণক্য উপস্থিত চন্দ্রগুপ্ত’কে বলছেন—“এক মাতৃগর্ভে জন্ম ব’লেই ভাইয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ না ? মায়ের চেয়ে ভাই বড় ? জগতে এই প্রথম হ’ল যে, সন্তান মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেয় না !”  এর পরে মা মুরা’র দিকে চোখ ফেলে চাণক্য বলছেন—


“কাঁদো অভাগিনী নারী ! এই তোমার পুত্র ! মা চিনে না !— জানে না যে জগতের যত পবিত্র 

জিনিষ আছে, মায়ের কাছে কেউ নয় !

চন্দ্রগুপ্ত। তা জানি গুরুদেব।

চাণক্য। না, জানো না ! নইলে মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে সন্তান দ্বিধা করে ?—” 


এর পরেই চাণক্যের সেই বিখ্যাত সংলাপ যা পড়লে কেমন যেন ঘোর লাগে এখনো……  


“মা—যার সঙ্গে একদিন এক অঙ্গ ছিলে—এক প্রাণ, এক মন, এক নিশ্বাস, এক আত্মা--যেমন 

সৃষ্টি একদিন বিষ্ণুর যোগনিদ্রায় অভিভূত ছিল, তারপর পৃথক হ’য়ে এলে—অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মত, সঙ্গীতের মূর্চ্ছনার মত, চিরন্তন প্রহেলিকার প্রশ্নের মত ! মা--যে তার দেহের রক্ত নিংড়ে, নিভৃতে বক্ষের কটাহে চড়িয়ে স্নেহের উত্তাপে জল দিয়ে সুধা তৈরী ক’রে তোমায় পান করিয়েছিল--যে, তোমার অধরে হাস্য দিয়েছিল, রসনার ভাষা দিয়েছিল, ললাটে আশিস-চুম্বন দিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিল ; মা--রোগে, শোকে, দৈন্যে, দুর্দ্দিনে তোমার দুঃখ যে নিজের বক্ষ পেতে নিতে পারে, তোমার ম্লান মূখখানি উজ্জ্বল দেখবার জন্য যে প্রাণ দিতে পারে, যার স্বচ্ছ স্নেহমন্দাকিনী এই শুষ্ক তপ্ত মরুভূমিতে শতধারায় উচ্ছ্বসিত হ’য়ে যাচ্ছে। মা--যার অপার শুভ্র করুণা মানবজীবনে প্রভাত-সূর্য্যের মত কিরণ দেয়--বিতরণে কার্পণ্য করে না, বিচার করে না, প্রতিদান চায় না--উম্মুক্ত, উদার কম্পিত আগ্রহে দুহাতে আপনাকে বিলাতে চায় !—এ সেই মা !” 


মা’কে নিয়ে এই কটা শব্দের মধ্যে যে ঝংকার, যা ডি. এল. রায় লিখেছিলেন সেইই ১৯১১ সালে, তা আজো কতো বাঙ্ময়, কতোই না জীবন্ত !


এভাবেই বেড়ে ওঠা আমাদের। পায়ে পায়ে মা’কে জড়িয়ে জড়িয়ে। যাঁর কাছে সমস্ত ঐশ্বর্য্য তাঁর সন্তান। গোটা জীবজগতেই। মনুষ্যজন্ম এদিক থেকে ভাগ্যবান যে আমরা ‘মা’ বলে ডাকতে পারি যা অন্যন্য প্রাণীরা হয়তো সংকেতে বা অন্য উপায়ে ডেকে থাকে।


“আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে

-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।

টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে

কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু

-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত

আমার ভালাবাসার কথা

মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি। !….”    - “জননী জন্মভূমি” – সুভাষ মুখোপাধ্যায়।


আমাদের ভারতীয় সমাজে মা’র ভূমিকা অনেক সময় বৌদি’রাও নিয়ে থাকেন। যা আমরা দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ গল্পে। বৌদি নারায়ণী তাঁর মা-মরা দেওর রাম’কে ঘিরে রাখেন পরম মমতায়। মা’য়ের মত অপার স্নেহে, যত্নেই। তবে এ সম্পর্ক আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। 



ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালীর মা বলতেই চোখে ভাসে সেই লাল পেড়ে মিল কিংবা গরদের শাড়ী, সিঁথিতে সিঁদূর, কপালে কুঙ্কুম টিপ, পিঠে ফেলা শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা। যাঁদের অধিকাংশ সময়ই কাটে রান্নাঘরের চৌহদ্দিতে। পিঠে-পুলি-পার্বণে তৈরি হয় নাড়ু-মোয়া-পরমান্নের অপূর্ব সমন্বয়। যদিও আধুনিক সময়ে এ ছবি ক্রমশঃ ধুসর হয়ে যাচ্ছে। তবুও তো মা। শান্তির এক হাতের পরশ। মাথায় হাত রাখা সাদা হাত।


“…… হেরিলে মায়ের মুখ

দূরে যায় সব দুখ,

মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,

মায়ের শীতল কোলে

সকল যাতনা ভোলে

কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।…”       - “মা” – কাজী নজরুল ইসলাম। 


আরেক মা বাঙালীর প্রতি ঘরেই আসেন শরতের মেঘে চরে। ছেলে-বুড়ো-কচি-জোয়ান-মাসী-পিসি-জেঠা-খুড়ো সব্বাইকার বচ্ছরকার মা। মা গৌরী। ছানাপোনা নিয়ে সেই সুদূর কৈলাশ পর্বতের শ্বশুরগৃহ ছেড়ে মাত্তর চারটে দিনের জন্য পিতৃ-গৃহে বেড়াতে আসেন। 


“আশ্বিনের মাঝামাঝি         উঠিল বাজনা বাজি,

                  পূজার সময় এল কাছে।

      মধু বিধু দুই ভাই            ছুটাছুটি করে তাই,

                  আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।…”   - “পূজার সাজ” – রবীন্দ্রনাথ।


ষষ্ঠি সপ্তমী অষ্টমী পেরিয়ে আসে নবমীর রাত। ঘরে ঘরে বিষাদের শুরু। ঘরে ঘরে নীরব প্রার্থনা—


"যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে ! 

গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে !— 

উদিলে নির্দ্দয় রবি উদয়-অচলে, 

নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে ! 

বার মাস তিতি, সতি, নিত্য অশ্রুজলে, 

পেয়েছি উমায় আমি ! কি সান্ত্বনা-ভাবে— 

তিনটি দিনেতে, কহ, লো তারা-কুন্তলে, 

এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে ? 

তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে 

দূর করি অন্ধকার; শুনিতেছি বাণী— 

মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে ! 

দ্বিগুণ আঁধার ঘর হবে, আমি জানি, 

নিবাও এ দীপ যদি !" —কহিলা কাতরে। 

নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী।    - “বিজয়া দশমী” - মাইকেল মধুসূদন দত্ত।


পৃথিবীতে একটিমাত্র মানুষ যার কাছে আমাদের সকল আব্দার। সমস্তক্ষণ জুড়েই। ‘বৃদ্ধাশ্রমে’ গিয়েও মা পায়েস বানিয়ে রাখে যদি সন্তান আসে সেদিন…; যত কিছু সেই মায়ের অন্তরেই। আমাদের হাসি-কান্নায় মা’র সুখ-দুঃখ। পৃথিবীর সমস্ত ‘সর্বজয়া’-র কাছে তাঁদের ‘দুর্গা-অপু’ চিরটাকাল শিশু হয়েই বেঁচে থাকে। 

“………

“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে, 

রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে। 

খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে, 

ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।” 

ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত, 

বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।

…… …… …… …… …… …… ……

রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা। 

সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।……” - “পল্লী জননী”- জসীম উদ্‌দীন।


ক্ষুদ্র পরিসরে এ ব্যাখ্যান শেষ হবার নয় ! এতো বছরের এতো এতো মায়েদের হাসিকান্না-হীরাপান্না’র রঙ্‌ কি কম !  প্রত্যহ একখানি অনুচ্ছেদ লিখে গেলেও ফুরোবে না কোনোদিনই। মা’কে নিয়ে যেমন শুরুতেই চাণক্যের সংলাপ মনে আছে বলেছি, তেমনই আরেকটি নাটকের আরেকটি দৃশ্যের সংলাপ স্মৃতিতে আনাগোনায়। বাহাত্তর কি তিয়াত্তর সাল ! প্রায় অর্দ্ধশতাব্দী অতীত। তাও সেই রঙ্গনা মঞ্চে ‘নান্দীকার’ দলের ‘তিন পয়সার পালা’-র একটি খণ্ড স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। ব্রেখট এর ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’-র অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত সেই রূপান্তরিত নাটকে পারুল বলে এক ব্যবসায়ী কন্যা ভালবেসে বিয়ে করে ফেলে এক ডাকাতসর্দার মহীন্দ্রকে। বিয়ে মিটে যাবার পরে পারুল বাপের বাড়ি এলে তার মা মালতী ঝাঁঝিয়ে উঠে পারুলকে লক্ষ্য করে বলে—“ অ্যাদ্দিন ধরে খাওয়ালুম, পড়ালুম, বড়ো করলুম, আর মা-বাপের মুখে চুন-কালি মাখিয়ে তুই পালিয়ে গিয়ে একটা ডাকাইতেরে বিয়ে করে বসলি ? ছি ছি !”    


ফাঁকা মঞ্চে তিনজন কুশীলব। মা, বাবা আর মেয়ে। মা’র ভূমিকায় লতিকা বসু। আর পারুলবালা’র চরিত্রে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক দাপুটে অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। মঞ্চের ডানদিকে এগিয়ে আসে পারুল। মায়ের কথার উত্তর দিতে। মঞ্চ ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকে। একটা ছোট্ট স্পট লাইট সবুজ শাড়ি পড়া পারুলের মুখ ধ’রে। পারুল শুরু করে কৈফিয়ত…


পারুল ॥ মা গো, ছেলেবেলায় যখন আমি খুব ছোট্ট ছিলুম, তখন মনের দিক থেকে কী আশ্চর্য সরল 

ছিলুম মাগো। মনে আছে, আমার মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল ছিল, ছোট্ট রঙিন ডুরে শাড়ি পরতুম, পায়ে ছোট্ট রূপোর ঝুমুর, নাকে মিষ্টি তেঁতুলপাতা, তখন সবার কোলে উঠতুম, সবাই আদর করত। ছেলেবেলায় সবাই এমনি থাকে। তোমারও ছেলেবেলায়, তুমিও নিশ্চয়ই এমনিই ছিলে মা ; হায়রে আমাদের সেই সংশয়হীন সরল দিনগুলি। দূর সিন্ধুর পাখি সেই দিনগুলি সময়ের অনন্ত আকাশে ! আমি বড়ো হলুম। তুমি বলেছিলে, “এখন তোমার জীবনে অনেক ছেলে আসবে, তাদের অগ্রাহ্য কোরো। হতে পারে তারা গুণী, তারা জ্ঞানী, তারা ভদ্র; হতে পারে তাদের গায়ের চামড়া ফর্সা, তারা লেখাপড়া জানে, তারা গুছিয়ে কথা বলতে পারে, তবু কিছুতেই তাদের ফাদে পোড়োনা কক্ষণে। কেন না, এতেই মেয়েদের চরিত্র, এতেই মেয়েদের শক্তি, এই সতীত্ব। অনেক ছেলে এল। সত্যি সত্যিই তারা গুণী, তার জ্ঞানী, তারা ভদ্র ; যেহেতু তাদের গায়ের চামড়া ফর্সা, তারা লেখাপড়া জানে, তারা গুছিয়ে কথা বলতে পারে—আমি তাদের সবাইকে দৃঢ় অহংকারে দূরে সরিয়ে দিয়েছি মা ! তারা ছলোছলো চোখে ফিরে গেছে ! হায়, হতাশায় দুঃখে ক্ষোভে মাথা হেঁট করে চলে গেছে সেই সব নির্মল ছেলেরা।  [দীর্ঘশ্বাস]  কিন্তু হঠাৎ একদিন, বিশ্বাস করো মা, হঠাৎই একদিন, আমার ঘরে এলো এক উদ্দাম অতিথি ! আশ্চর্য! সে গুনী নয়, জ্ঞানী নয়, ভদ্র নয়, তার গায়ের রং কালো, সে লেখাপড়া জানে না, সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না কিছুতেই।••• এমন তো আমি কখনও দেখিনি মা। সে হতাশা জানে না, দুঃখ না, ক্ষোভ না, ভিক্ষে না, ভয় না। সে জোরে হাসতে জানে, সে চিৎকার করে কথা বলে, সে উদ্দাম, সে অদ্ভুত, সে সবল, সে পুরুষ ! কোনদিন তো বলো নি মা, এমন ছেলেও থাকতে পারে, এরা এলে কী বলব ?•••ও আমার সমস্ত শক্তি, অহংকার সমস্ত শিক্ষা তেজ ভাসিয়ে নিয়ে গেল, আমি অসহায় ঝাঁপ দিলুম। 


আবার মঞ্চ আলোকিত হয়। বাবা সংলাপ ধরেন। এগিয়ে চলে নাটক। নানান ঘাত প্রতিঘাতে এক সময় নাটক শেষ হয় !  কিন্তু এই নাটকের ওই দৃশ্য আর সংলাপ এখনো ঘাই মারে অসময়ে একলা বসে ভাবতে থাকলে। এত কিছুর মধ্যেও মা সেই সন্তানকে তো দূর করে দিতে পারে না। জীবন এভাবেই চলে। পৃথিবী ঘোরে। দিনের পরে রাত আসে। 


পাকিস্থানের বালুচিস্তান প্রদেশের মাকরান মরুভূমিতে রয়েছেন "হিঙ্গুলা" বা ‘হিংলাজ’ মা। এখানে নাকি সতীর সিঁদুর বা হিংগুল মাখা মাথা পড়েছিল। তাই এ শক্তিপীঠ মরুতীর্থ হিংলাজ বলেই খ্যাত। এখানে হিন্দু দেবীকে পুজো করেন বালুচ মুসলিমরাও। নিজেদের সাংসারিক সুরক্ষা ও মঙ্গল কামনায় এই দেবীর দরবারে আসেন মুসলিমরা। এই মন্দির দর্শন যাত্রাকে কেন্দ্র করে ১৯৫৯ সালে নির্ম্মিত হয় ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ চলচ্চিত্র। হিংলাজ মা-এর উদ্দেশ্যে যাত্রার পথে যাত্রীরা গলা মেলায় মা’র উদ্দেশ্যে…


“পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব / মাগো, বলো কবে শীতল হবো / কত দূর আর কত দূর বল মা ||

আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই, / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই, / আর আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই, / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই, / যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বেঁধে পায় / হাসিমুখে সে বেদনা সবো। কত দূর আর কত দূর বল মা ||

চিরদিনই মাগো তব করুণায় / ঘর ছাড়া প্রেম দিশা খুঁজে পায় / ঐ আকাশে যদি মা কভু ওঠে ঝড় / সে আঘাত বুকে পেতে লবো। / কত দূর আর কত দূর বল মা ||

যতই দুঃখ তুমি দেবে দাও / তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও, / মাগো যতই দুঃখ তুমি দেবে দাও / তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও, / মাগো তুমি ছাড়া এ আঁধারে গতি নাই / তোমায় কেমনে ভুলে রবো / কত দূর আর কত দূর বল মা ||”


পৃথিবীর সকল মা’কে স্মরণ করে ইতি টানি এ লেখার। শেষ করি আমাদের ছোটোবেলার সেই বিখাত গানখানি দিয়ে। প্রণব রায় রচিত এ গানের সুরকার এবং শিল্পী (প্রথম রেকর্ডিং) – বাংলাদেশের ফরিদপুরের সুধীরলাল চক্রবর্তী। মা’কে নিয়ে এ গান বাঙালির অন্তরে গাঁথা হয়ে আছে।


মধুর আমার মায়ের হাসি

চাঁদের মুখে ঝরে

মাকে মনে পড়ে আমার

মাকে মনে পড়ে॥


তার মায়ায় ভরা সজল বীথি

সেকি কভু হারায়

সে যে জড়িয়ে আছে

ছড়িয়ে আচ্ছে

সন্ধ্যা রাতের তারায়

সেই যে আমার মা।

বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা॥


মধুর আমার মায়ের হাসি

চাঁদের মুখে ঝরে

মাকে মনে পড়ে আমার

মাকে মনে পড়ে ॥


তার ললাটের সিঁদুর দিয়ে

ভোরের রবি উঠে

আলতা পড়া পায়ের ছোয়ায়

রক্ত কমল ফোটে ॥


প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে

কে জেগে রয় দুখের ঘরে

সেই যে আমার মা।

বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা॥

মধুর আমার মায়ের হাসি

চাঁদের মুখে ঝরে

মাকে মনে পড়ে আমার

মাকে মনে পড়ে॥ 

কৃতজ্ঞতা— 


কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর / মল্লিকা সেনগুপ্ত / সুভাষ মুখোপাধ্যায় / কাজী নজরুল 

ইসলাম / জসীম উদ্‌দীন / মধুসূদন দত্ত।

নাটক - ‘চন্দ্রগুপ্ত’ – দ্বিজেন্দ্রলাল রায় / ‘তিন পয়সার পালা’ – অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

গান - ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ – প্রণব রায় / 

‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ – গৌরীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।