শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

সম্পাদকীয়


বসন্তের দুয়ার খুলে গেল । খুলে গেল আমের মুখ ৷ যে মুখের মধ্যে সবুজ রঙ লেগে আছে তার কোন মা নেই ৷আছে কিছু শব্দ । ইদানিং শব্দহীনতায় ভুগছি ৷ কি লিখব বা লিখব না ভাবতেই সামনেই ২১ ফেব্রুয়ারি কথা মনে পড়ে গেল ৷ "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস "৷ 

১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে'র  ১৭নভেম্বর  ইউনেস্কোর প্যারিস 
অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে" আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।এখন প্রশ্ন হল মাতৃভাষা'র জন্য মাত্র ১টি দিন ! কেন ? যেখানে বার বার অবজ্ঞা স্বরে তাকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে ৷ মাতৃভাষা কি ? তাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য ইতিহাসের অবদান কি হয়তো জানেই না আজকে'র প্রজন্ম ৷ বিদেশী ভাষার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে চলছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ পড়ছেন কি ! প্রশ্নটা কিছুটা তর্কের উদ্রেগ ঘটাতে পারে ৷ তবুও চেতনায় আনা দরকার ৷



কিন্তু " সৃজন " পাঠকদের কাছে দায়বদ্ধ ৷ প্রতি সংখ্যায়  লেখক ,কবিগণ নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন কখনও ধারাবাহিক কখনও গল্প , প্রবন্ধ কিংবা কবিতা ৷ এই সংখ্যায় আমাদের ফেসবুক গ্রুপ " শব্দের হাতেখড়ি " আয়োজিত "মাতৃভাষা দিবস " উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতা সেরা লেখা স্থান পেয়েছে ৷ 
পড়ছেন কি কেউ ? নিশ্চই পড়ছেন
  ৷ না হলে পাঠক সংখ্যা বাড়ছে কিভাবে ? লেখা পাঠান আপনিও অবশ্যই ৷ ভালোবাসায় থাকুন ৷ আসন্ন বসন্ত উৎসব ৷ মার্চ সংখ্যাটিকে শব্দ রঙে ভরিয়ে তুলতে এগিয়ে আসুন আপনিও ৷



ছবি : অন্তর্জাল

অজিত রায়

বুদ্ধিজীবী
-------------------


'বুদ্ধিজীবী' কথাটা নিজের ক্ষেত্রে ভারি বকোয়াস আর বাওয়া মনে করি।  এমনিতেও শব্দটা যদৃচ্ছ ইস্তেমালের ফলে ঘষা আধুলি হয়ে গেছে, বাজারে ক্রেডিবিলিটি খুইয়েছে।  আচ্ছা, আপনারাই বলুন, বাঙালি লেখকরা কি প্রকৃতই বুদ্ধিজীবী?  না না, ভুল বললাম।  প্রশ্নটা হল, আমাদের ভাষায় যথার্থ বুদ্ধিজীবী-লেখক আছেন কি?  এদেশে দর্শনের অধ্যাপক মাত্রেই 'দার্শনিক', বিজ্ঞানের গবেষক মানেই 'বৈজ্ঞানিক'।  আর, যে-কোনও কলমচি মাত্রেই বুদ্ধিজীবী।  কিন্তু সেই কলমের সঙ্গে যে প্রতিভা, বোধ, বোধি, প্রজ্ঞা, মেধা, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা, অন্তর্দৃষ্টি আর সৃজনশীলতার কিঞ্চিৎ রসায়ন থাকা বাঞ্ছণীয় সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।

'বুদ্ধিজীবী' লুগাতটা যদিও ইংরেজি intellectual শব্দের  বাংলার্থে ইস্তেমাল হয়ে আসছে ঢের দিন থেকে, কিন্তু মোদ্দায় এটি তার যথাযথ সংজ্ঞার্থ নয়।  আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত ইন্টেলেকচুয়াল-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিশেবে ' বিজ্ঞজন' ও 'প্রাজ্ঞ' শব্দ দুটির তরফদারি করবেন।  কিন্তু স্যার, ভেবে দেখুন, intellection নামক মনন ক্রিয়াটিতে বুদ্ধিরই প্রাথম্য বিদ্যমান।  বিদ্যাচর্চা যদিও এর আবশ্যিক অঙ্গ, তথাপি ভিত্তি নয়।  প্রজ্ঞা অবশ্যই লভ্য।  তবে একজন ইন্টেলেকচুয়াল সঠিক অর্থে savant বা sage না-ও হতে পারেন।  সেজন্যই বলছি, বুদ্ধিজীবীর বঙ্গীয় অর্থে বিজ্ঞজন বা প্রাজ্ঞ প্রযোজ্য নয়।

উনিশ শতকের পরিশিষ্টে একটি উক্তি নিয়ে বঙ্কিম আর রবিবাবুর মধ্যে তুমুল কাজিয়া বেধেছিল, যা ছিল বাস্তবত ইন্টেলিজেশিয়া ও বুদ্ধিবাদের যোধন।  বঙ্কিমবাবু মহাভারতের দোহাই পেড়ে বলেছিলেন, 'প্রাণরক্ষার্থে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ অপরাধ নহে।'  রবিবাবু লাইক দিয়ে কমেন্ট করলেন, 'মিথ্যার বিনিময়ে জীবন রক্ষা পাইলেও তাহাতে সত্যরক্ষা হয় না।'  রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনের সন্ধিক্ষণে নিশ্চয়ন্তিকা বুদ্ধি দিয়ে সত্যকে পরখ করতে চেয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাটের সঙ্গে ওই বিতর্কে।

বস্তুত, ইন্টেলিজেন্সিয়া শ্রেণীর মধ্যে তাঁরাই পড়েন যাঁদের কাজ হাতে নয়, মাথা দিয়ে।  যদিও বিগত শতকে এঁরাই ছিলেন বাংলা রেঁনেশসের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী, কিন্তু বর্তমানে মার্কসীয় রাজনৈতিক চেতনায় শব্দটি ঘৃণিত।  এঁরা নীতিগতভাবে বিপ্লব ও প্রগতিকে স্বীকার করলেও কার্যত প্রাচীন রক্ষণশীল চেতনাকে  আঁকড়ে ধরে প্রগতিকেই বানচাল করে দেন।  তাই ভারতের নিজভূমিতে কোনো রেঁনেশস হয়নি।

এই ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবীদেরই এখন এদেশে বাড়বাড়ন্ত।  আজকের 'সফল' কবি-লেখক বলতে এঁরাই।  এঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরিজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির জলবাতাসে।  এঁরাই আপনার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শিল্প-সাহিত্যের ধারক ও বাহক বেশে।  এঁদেরি হাতে গোড়াপত্তন ঘটেছিল মনোপলি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান আর সাহিত্যের ব্যবসা।  এঁরা সাধারণ পাঠককে একটা নির্দিষ্ট ভাবনাচক্রে (পড়ুন, ঘোরচক্রে) ঘুরপাক খেতে বাধ্য করেছেন।  গভীর কিছু ভাবা থেকে তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন আর নিজেদের মুনাফার জন্যে একের পর এক সস্তা, গণতোষণকারী ফ্যাদানো গল্প-উপন্যাস সাপ্লাই দিয়ে এসেছেন।  এঁরাই আপনাদের 'মূল'-ধারার 'জনপ্রিয়' লেখক।  আজ যে ত্রিশূলে কন্ডম পুঁতে দিল বলে এত হা-হুতাশ, এবং তার সপক্ষে এমন ফেসবুকিয়া একজোট, এসবই আমরা করছি একটি বেনিয়া  কালচারকে গ্লোরিফাই করে তুলতে।  এতে বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির নতুন কোনো উন্মেষ ঘটবে না।

রীনা রায়



দ্বিতীয় পর্বঃ
স্কুল, বাড়ি, বাজার, কলিগদের সাথে সময় কাটানো, মাঝে মাঝে ঋকের সাথে দেখা করে আসা, এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল অনন্যার।
ক্লাস ফাইভের ক্লাসটিচার ছিলো ও।
সেদিন রোলকল শেষ করে সবে পড়ানো শুরু করেছে, 
পিছনের বেঞ্চ থেকে রিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, 'ম্যাম, অনিন্দিতা কাঁদছে', অনন্যা প্রথমে বুঝতে পারলোনা ঠিক কি হয়েছে, তারপর নিজেই উঠে দেখতে গেল কি হয়েছে, গিয়ে দেখে অনিন্দিতা নামের বাচ্চা মেয়েটা কাঁদছে আর চোখেমুখে প্রবল আতঙ্কের ছাপ।
বারবার জিজ্ঞেস করেও তেমন কোন সদুত্তর পেলনা,শুধু ওর ছোট্ট শরীরটা বারবার আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল ।
অনন্যা ওর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে চেষ্টা করলো ওর ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে, তারপর অনেক চেষ্টায় মেয়েটি যা বললো খানিকটা এইরকম, ও যে স্কুলভ্যানে করে আসে তার হেল্পার ও ড্রাইভার দুজনেই ওকে শারীরিক নিগ্রহ করে, আর ওকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে যে কাউকে কিছু বললে ও আর কোনোদিন মা বাবার কাছে ফিরতে পারবেনা।
যেহেতু ও সবার প্রথমে গাড়িতে ওঠে, আর সবার শেষে নামে তাই বেশ কিছুটা সময় ওকে একা থাকতে হয়, ওরা সেই সুযোগটাই নেয়।
ও ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেনি।
--
আর দেরি না করে অনন্যা সব ঘটনা স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে জানালো।
আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হল যে, মেয়েটির মা বাবাকে স্কুলে ডেকে পাঠিয়ে সব জানানোই শুধু নয়, ঐ পুলকারের ড্রাইভার ও হেল্পারকে দেরি না করে এখনই পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত ।
ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে বেশী সময় লাগলোনা।
সমস্ত অভিভাবকদের ভিড় জমতে লাগলো স্কুল চত্বরে। অনেকেই বলতে লাগলেন তাদের বাচ্চারাও এইধরনের কথা বাড়িতে বলেছিল, এমনকি কেউ কেউ তাদের পুত্রসন্তানদের মলেস্টেশনের কথাও জানালো।
কিন্তু ছোটোরা কি বলতে কি বলছে ভেবে তারা আর গুরুত্ব দেয়নি।
কিন্তু এখন তারা বিপন্ন বোধ করছে,সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবে আতঙ্কিত।
হঠাৎ করেই অনন্যার ঋকের জন্য খুব মন খারাপ করতে লাগলো। একটা ঘটনার কথা আচমকাই মনে পড়ে গেল।
ঋক তখন সবে প্রি নার্সারীতে ভর্তি হয়েছে, ওদের ক্লাস টিচার একদিন গার্জিয়ান কল করলেন। এসব ব্যাপারে অনন্যাকেই যেতে হত।গিয়ে দেখলো আরও দুজন বাচ্চার মাকেও ডাকা হয়েছে।মিস ওদের জানালেন ঐ তিনটি ছেলে ক্লাসে ড্রেস খুলে নিজেদের প্রাইভেট পার্টে হাত দিচ্ছিলো।ওরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিল। 
পরে ছেলের সাথে কথা বলে অনন্যা জেনেছিল, বাকি দুই বন্ধুর মধ্যে একটি ছেলে তাদের এটা করতে বলেছিল, তার মায়ের সাথে কথা বলে ওরা জেনেছিল ওরা নতুন এসেছে শহরে, ভালো জায়গায় বাড়ি না পেয়ে এমন এক জায়গায় ওদের বাড়ি ভাড়া নিতে হয়েছে যেখানে পাশেই একটা বস্তি, ওরা দুজনেই সার্ভিস করে, ছেলের দিকে ভালভাবে নজর দিতে পারেনা, ছেলে বলেছে কাজের মাসির ছেলেটা তাকে ঐরকম করতে বলেছিল।
ঋক ভালো আছে তো? আচ্ছা, ঋক ওর সবকথা মন খুলে ওর বাবাকে, ঠাকুমাকে বলতে পারে তো? নাকি, ওর মনের কথা কেউ শুনতেই চায়না? 
বড়দির কাছে একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে অনন্যা বাড়ি ফিরে ঝটপট ব্যাগ গুছোতে থাকলো।
আধঘন্টা পরেই একটা ট্রেন আছে, ওকে এক্ষুনি ঋকের কাছে যেতে হবে।
(ক্রমশঃ)

পিয়ালী বসুঘোষ

সাঁঝবিহান
#পর্ব-আট

বেলা গড়িয়ে গেলে সূর্যটা যখন গোলাপী ও কমলার মাঝামাঝি একটা ম্যাগনিটিউড রঙ মাখে গায়ে ঠিক সে সময়ই সতীশ গিয়ে দাঁড়ালো কলমির ঘরের দাওয়ায় । ওকে দেখেই কলমি হই হই করে উঠলো এতো বেলায় তুমি গরম ভাত কি করে খাবে বলো তো বাবু এতো দেরী কেউ করে ।যাও তুমি ঘরে গিয়ে বসো আমি তোমার জন্য আর দুটো গরম ভাত করে নে আসি । সতীশ হাত নেড়ে বাঁধা দেয় বলে যা আছে যেমন আছে তেমনই দাও । ও জানে এই শুকনো পাতা কুড়োতে কলমি কে জঙ্গলে যেতে হয় ।একবারের জ্বালানি বাঁচা মানে ওদের একবেলার খাবার বাঁচা ।
কলমি চলে যেতে ও ঘরের সামনের বসার জায়গাটা তে বসলো ।খেয়াল করলো বৈচি ঝিনুকের কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছেনা ।জায়গাটা একটু ঢাল মতো ।ওই খানেই দুটো কাগজি লেবুর গাছ ।ছোট ছোট সাদা ফুলের গন্ধ আসছে হাল্কা । কলমির ঘরদোর বেশ পরিষ্কার ।বৃষ্টি থেমে যাবার পর যেমন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে থাকে তেমনই ।

থালায় করে ভাত বেড়ে এনে সতীশের সামনে সাজিয়ে দিলে সতীশ অন্যমনস্ক ভাবে সাঁঝের কথা জানতে চায় ।জানতে চায় ওর ওষুধ ফুরিয়েছে কিনা । কলমির চোখ চকচক করে ওঠে ।ও বলে কেন বাবু ফজি দাদা বলেনি তোমায় কিছু বাবু ? ভাতের থালা থেকে চোখ সরিয়ে সতীশ জিগ্গেস করে কি বলবে ফজিরাম ?না তো সেতো কিছু বলেনি ।

কলমি হাত ধুয়ে চোখে মুখে খুশি নিয়ে বলে তুমি বাড়ি যাবার পর গোমস্তা এসেছিলো গো বাবু ।আমি তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেছলাম যে এ আবার কেন তার ওপরে তুমি নেই এখানে ।পরে তিনি প্রস্তাব দিলেন সাঁঝ কে ওর ছোট ছেলের বৌ করে নিয়ে যাবেন আসছে মাঘে । গোমস্তা সাহেব বলেছেন সাঁঝ কে নিয়ে যাবেন শহরে চিকিৎসা করতে ।আর তোমারও খুব প্রশংসা করছিলেন গো বাবু ।

সতীশের কাছে সর্ষে শাকের স্বাদটা কেমন তেতো ঠেকলো ।হয়ত অনেক সকালে রান্না বলে ।মুখে কিছু বললনা তা নিয়ে কলমিকে । থালাটা সারিয়ে হাত ধুয়ে নিলো থালার পাশে রাখা বাটিতে । আসন ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল গোমস্তার ছোট ছেলেটা একটু অন্যরকম বলেই তো জানি কলমি তাছাড়া ওরা লোকও ভালো নয় । তাছাড়া যে লোক নিজে সাঁঝ কে......
যাক দেখো যেটা ভালো বুঝবে ।মেয়ে তোমার । কলমি বলে ওঠে এমন কোনো ব্যরাম নেই ওই একটু ভুলো মনে রাখতে পরেনা মানুষজন ।তাছাড়া কি করব...এ মেয়ে কে সব জেনে কে বিয়ে করবে বাবু ? আমার আরও দুটো মেয়ে আছে যে ওদেরই বা কি হবে ?
সতীশ হঠাৎই বলে ওঠে ওরা পড়বে কলমি ।আমিও পড়াবো ওদের ।তারপর ওরা যা করতে চাইবে সেটাই ওরা করবে তা সে বিয়ে হোক বা জীবিকা নির্ধারণ ।
সতীশের কথার অর্থ বোঝেনা কলমি। বলে হা বাবু তাইতো মাস্টারও বলে গেল দুদিন আগে ।আজ তাই ওরা মাস্টারের বাড়ি পড়তে গেছে । সন্ধে নামছে আমি ওদের আলো দেখিয়ে ঘরে নিয়ে আসি ।তুমি সাঁঝের কাছে বসো একটু ।

সতীশ এতক্ষণ খেয়াল করেনি ।জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সাঁঝ ওদের কথাই শুনছিলো ।কলমি চলে যেতে খেয়াল হলো সতীশের । সাঁঝের দিকে চোখ পড়তেই ওর বুকের ডেকে উঠলো "ডিড ইউ ডু ইট" পাখিটা । শ্লথ পায়ে ও এগিয়ে গেল সাঁঝের দিকে । অদ্ভুত ভাবে দেখে সাঁঝের চোখদুটো ভরন্ত ।পোয়াতি পেটের মত ।যেন সামান্য কম্পনেই ভূমিষ্ঠ হবে ।
সাঁঝ এখন হাঁটতে পারে ধীরে ধীরে ।শুধু মুখের কথা এখনো ফোটেনি ।যাবার আগেই দেখে গিয়েছিলো ও ।

সুশান্ত বর্ধন



শব্দের হাতেখড়িতে থেকে নির্বাচিত

কিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল....

১) ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী কফি আন্নানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

২) সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের (যিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত) নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।

৩) সেই উপদেশ মোতাবেক রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।

৪) এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেলো। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস সাহেব রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করতে। তারা জোশেফের সাথে দেখা করার পর জোশেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে। এই আনা মারিয়া নামের এই ভদ্রমহিলাকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো, কারণ এই ভদ্রমহিলাই রফিক-সালামের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।

৫) সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তারা দিন রাত ধরে পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে।

৬) ১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। এখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। আসলে প্রস্তাবটিতে প্রধানমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিলো। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচীর পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছুবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।

৭) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছুলো।

৮) ১৬ই নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে (সময়াভাবে ?) বহুল প্রতাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন।

৯) পর দিন – ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়।

সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।

তথ্য সংগৃহীত................

দীপাঞ্জন মাইতি

চিরন্তনের ভাষা
-----------------------
               

শীতের শেষ.. গলে যাচ্ছে বরফ,
বরফ গলা জল বয়ে যাচ্ছে পাথর থেকে পাথরে,
ছড়িয়ে... ছিটিয়ে যাচ্ছে গাছের পাতায়,
পাতার ডগা থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে মাটিতে,
ঝর্ণার জল পেরিয়ে যাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ ডাকা জঙ্গলের পাশ দিয়ে,
অনেক উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে,
ফেনা কাটছে জলে, শব্দ হচ্ছে.. ভীষণ শব্দ হচ্ছে,
কথা বলছে পাহাড় - জলপ্রপাতের ধাপে ধাপে বিন‍্যস্ত পাথরগুলোর সাথে।
ঝর্ণার জল নদী হয়ে বয়ে আসছে অনেক দূরে ঐ পাহাড়টা থেকে,
আমার এখানে নদী শান্ত - আমি বসে থাকি নদীর পাড়ে,
যখন জোয়ার লাগে - নদীটা আমার সাথে কথা বলতে এগিয়ে আসে,
পাড়ে ছলাৎ ছল আওয়াজ হয়, আমরা গল্প করি।
এখন সন্ধ‍্যে নেমেছে, আমি বাড়ি ফিরছি,
নদীটা সমুদ্রের দিকে চলে গেছে;
অনেকটা পথ... ওর রোজ দেরী হয় বাড়ি ফিরতে,
সমুদ্র রেগে যায় রোজ, খুব রেগে যায়, খুব বকে.. অনেক তির্যক কথা বলে..
অভিমানে ঘর ছাড়া নদী একদিন মেঘ হয়ে যায়,
আকাশ তাকে ফিরে যেতে বলে ঘরে,
খুব তর্ক হয় অনেক কথা হয় অনেক কথা..
হেরে গিয়ে নদী বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে চেনা পৃথিবীর বুকে,
পাথুরে ঝর্ণা, গাছের পাতা, শুকনো চর বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে ফুটিফাটা মাটির বুকে,
মেয়ে ঘরে ফিরেছে.... ওরা সবাই আনন্দ করে..
জনে জনে বয়ে দেয় বাতাস সে আনন্দ বার্তা,
সবুজ ধানের ক্ষেত বেয়ে বয়ে যায় ওরা উৎসব করে,
ভিজে হাওয়া লাগে মরুভূমির গায়ে -
ওরা শুনতে চায় সুখবর ওরা শুনতে চায় জঙ্গলে ডাকা ঝিঁ ঝিঁ র শব্দ;
আকাশ সাগর বাতাস পাহাড় গাছ পাতা নদী বালি সবাই কথা বলে নিজের ভাষায়।
তখনও বলত যখন তুমি আমি ছিলাম না..
আজও বলে, কালও বলবে যখন আমরা নির্বাক হয়ে যাব।
যেদিন নিস্তব্ধ হয়ে যাবে প্রতিটি সংগ্রাম অপভ্রংশ অস্তিত্বের লজ্জায়,
সমাজ সেদিন এক মালিকের মুঠোয় -
তার অট্টহাস‍্য নিশ্চিত করবে বিজয় গর্বের অতিপৃক্ততা;
সবার অলক্ষ‍্যে অনেক দূরে কোন জঙ্গলে তখন ছোট কোন বস্তিতে মেঘের তালে বাজবে মাদল -
মাথা তুলে দাঁড়াবে বছর নয়েকের ওহিউল্লাহ,
শুরু হবে সংগ্রাম আবার অধিকারের, মাতৃভাষার অধিকারের;
একটা একটা করে আমাদের ভাষা একদিন.. হারিয়ে যাবে,
হয়ত সব সংগ্রামের শেষে হেরে যাবে সবাই,
অবশিষ্ট বিজয়ী রয়ে যাবে একা, থাকবে না কোন বার্তা, থাকবে না কোন শ্রোতা;
সেদিন নিষ্প্রয়োজন হবে পরিচিত অপরিচিত অক্ষর বর্ণ বর্ণমালা,
মরে যাবে আমার তোমার সবার ভাষা,
রয়ে যাবে শহীদের নাম আকাশ সাগর বাতাস পাহাড় গাছ পাতা নদী বালির কথায় রূপকথায়।

সুশান্ত বর্ধন



শব্দের হাতেখড়িতে থেকে নির্বাচিত

কিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল....

১) ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী কফি আন্নানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

২) সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের (যিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত) নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।

৩) সেই উপদেশ মোতাবেক রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।

৪) এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেলো। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস সাহেব রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করতে। তারা জোশেফের সাথে দেখা করার পর জোশেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে। এই আনা মারিয়া নামের এই ভদ্রমহিলাকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো, কারণ এই ভদ্রমহিলাই রফিক-সালামের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে।

৫) সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তারা দিন রাত ধরে পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে।

৬) ১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। এখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। আসলে প্রস্তাবটিতে প্রধানমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিলো। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচীর পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছুবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।

৭) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌঁছুলো।

৮) ১৬ই নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে (সময়াভাবে ?) বহুল প্রতাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন।

৯) পর দিন – ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। 

সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।

তথ্য সংগৃহীত................

যুগান্তর মিত্র

সন্ধ্যামালতী
…………………




এক-একটা সন্ধ্যা যেন
বিবিধভারতীর গানের আসর।
ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় সুরে।
কখনো বিষাদরঙ মুছে দেয় আলো,
গলিপথে একা বাঁশি বাজে।

#              #                #               #

আবার কখনো দেখি মুহূর্তের ঢেউ।
একটি চটুল গানে ভেসে উঠছে খলসে মাছ,
দু-একটা জিওল
লাফ দিয়ে হাওয়া টেনে নেয়।

#              #               #               #

এক-একটা সন্ধ্যা তবু
ভাষ্যহীন যন্ত্রণার কথকতা শোনায় একাকী।

#             #               #               #

সেই সন্ধ্যায় মালতী ফুল ফোটে
লতায় জড়ানো অন্ধকারে।



নোনাস্বাদ
………………


কোনো কোনো পালক আমাকে অম্ল স্বাদ বুঝিয়ে দেয়।
যেভাবে এক-একজন মানুষ আমাকে কাছে টানে,
অথবা দূরে ঠেলে।
এই টানা আর ঠেলার মধ্যে
কৌণিক দূরত্ব আছে জানি।
তবু তার স্বাদ ঠিক একইরকমের নোনা।

#         #            #                #

বিশ্বাস করো মেঘের আড়াল,
দূর আর কাছের কোনো
পার্থক্য বুঝি না আজকাল


ছাইভস্মের সনেট


আজন্ম বিশ্বাস দোলে নিষিদ্ধ উঠোনে,
থইথই জলে ভাসে নিজস্ব নির্মাণ।
কেউ কি দেখেছ তাকে ? শব্দজাল বুনে
একা একা হেঁটে যায় অনিদ্রা-বাগান।
শিশ্নচিহ্ন এঁকে রাখে গোপন অক্ষরে,
আর থাকে যাবতীয় হিসাবনিকাশ।
এইসব জমা থাকে ঝুলির ভেতরে,
দিনান্তে জন্মায় তাতে বুনো লতাঘাস। 

লতাজন্ম আঁকড়ে ধরে মুহূর্তপ্রতিমা,
ভাঙাচোরা সেতু লেখে ব্যথার মান্দাস।
যন্ত্রণার স্বরলিপি ধারাগান গায়,
সুরে সুরে বেজে ওঠে কালো দীর্ঘশ্বাস।

সেসব বৃত্তান্ত যেই লিখে রাখতে যাই,
পিছু ফিরে চেয়ে দেখি ছাইভস্মছাই…

পার্বতী রায়

*

কবিতার লিঙ্গ নির্ধারণ করেন না ঈশ্বর
কিছু ফুল ফুটলেই বসন্ত

***
সময়ের গভীরে প্রচলিত ধারায় 
কবিতা তুমি সুখী না অসুখী ?

***
শিকড় অমলিন 
অশৌচ পালন করে গাছ 

অনন্যা রায়


বৃত্ত


বিষন্নতা যখন আঁচল পাতে ,
তেজপাতা রং শব্দেরা ছড়ায় পান্ডুলিপির বুক জুড়ে।
হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় বোহেমিয়ান স্বপ্ন ।
বুকের উপত্যকা থেকে ছাউনি তোলে সময় ,
আর নখের আঁচড়ে কাটা রাস্তায় পা ফেলে আগামী ।
উত্তাপ জড়ো করা মুঠো ক্রমশ বেমানান ক্যানভাসে 
নিস্পৃহ কথারা গুঁড়ো হয়ে বিছিয়ে থাকে সাঁঝতলায়।
নীলাভ চৌহদ্দিতে স্বপ্নের অসহায় সমর্পণে 
আর একটা মৃত্যুর ইতিহাস রচিত হয়।

অনিন্দ্য রায়


হয়তো তোমারই


পিঠের প্রান্তরে আসি , অল্প ঘাস, ছায়া-মহাকাশ
ছড়িয়ে রয়েছে বাকি আটদিকে , আমিও আঙুলে
হাঁটি, নখে আঁকি গ্রহনক্ষত্রের স্থান, মৃত্তিকার শাঁস
দাঁতে ছিন্ন করি, জিভে রক্তের লবণ লাগে, চুলে
মুছে নিই স্বাদ, নিয়ে অতোটা ভূগোল পুনরায়
ভ্রমণ চেয়েছি, হেঁটে, হাঁপিয়ে উঠলে হামাগুড়ি
দিয়ে, হোক যেনতেন, জ্বলে উঠতে উল্কার ধাক্কায়
তোমাকে ছোঁয়ার আগে ধ্বংস হয়ে যেতে পুরোপুরি

তোমাকে ছোঁয়ার পর মনে হয় পুনর্জন্ম আছে
সকল শ্রমেই আছে ঘুমের চাদর, নগ্নতাকে
বারবার জাগরণ ভেবে চেপে ধরি, তার কাছে
বন্ধক রেখেছি বিম্ব, আয়নাটি ইশারায় ডাকে
দেখি, মাঠ শেষ হলে আপেল বাগান, দুই ঢিবি
নদীখাত, ওপিঠে অপেক্ষা করে আমার পৃথিবী

ছোট ছোট গাছ
গাছের তলায়
বারুদের কূপ
আগুনের নাচ
চোখ পুড়ে যায়
তুমিও তো চুপ
চাপ শুয়ে থাকো
হাওয়ার পোশাকও
ছিঁড়ে ফালিফালি
গাছ ছোট ছোট
যে ডালেই ওঠো
মাথা নীচু কুঁড়ি
যদি হাততালি
দিয়েছ হঠাৎ
যদি ধরো হাত
কোথাও মাধুরী
উঠবেই বেজে
ছোট ছোট গাছ
কী তামাশা এ যে
পুরুষের আঁচ
স্ত্রীর জলাশয়
নিয়ে বড়ো হয়

তোমার শরীর
ছুঁতে চায় শ্রীর
স্নানের লিরিক
কোনোদিন ঠিক
সে পাবে গানের
তুমুল বারিষ
সে অভিমানের
ওষুধ ও বিষ
ছোঁয়ালাম ঠোঁটে

ছোট ছোট গাছ
গাছে গাছে ফোটে
কুসুম কুসুম
আমাদের ঘুম

ঘুমের ভেতর
একখানি ঘর
একা মোমবাতি
একা একা ফুঁয়ে
নিভিয়ে দিলাম

প্রিয় ডাকনাম

বাসব মন্ডল


খিদে
.......



খিদে পেলে
আমি মায়ের মুখটা 
মনে করি-
তাতে লুকিয়ে আছে
হাজারো উপবাসের গল্প
সাবানের জিভে লেগে থাকে
অসংখ্য কলঙ্ক ভ্রূণ
তবু ও
প্রত‍্যক চানের শেষে
আমি নিভিয়ে নি
খিদের দাবানল
পরকিয়া প্রেমের ত্রিকোণমিতি
বেশ জটিল
ভূমিতে থাকে অনন্ত ধ্রুবক
বাকি দুটো বাহুর
একটা সহনাভূতি জ‍্য্া
আর অপরটা অনূভুতির নির্যাস
মাঝখানে আটকে থাকে
একটা অনিবার্য খিদে


তুষ্টি ভট্টাচার্য


শিকার / 

বাজপাখিটি উড়ে এসে বসেছে শিকারির ছাদে
শিকার অবশ্যম্ভাবী ভেবে তারা নিস্তব্ধ হয়েছে।
হায়নাও ছিল, আর চিতাবাঘটি
হরিণ হরিণ, তুমি কী বোঝ না
কস্তুরীঘ্রাণ নয়, মাংসর দোকান তোমায় ডেকেছে!
মানুষ স্বভাব বশত দেখতে শিখেছে
পাখির উড়ান যেমন নিয়ত হয়েছে।
এসবই আলোর খেলা
আঁধারের দোলাচল নেই
শিকার শিকারির জ্বলে ওঠা চোখ
দেখে অভ্যস্ত থেকেছে
এমনই এক সামগান
এমনই এক ঋজু জটিল কাঠামোয়
মানুষ থেকেছে


শুভশ্রী সাহা,



অক্ষর

তোমার সিঁড়িতে পা রাখতেই নরম আলোর ভোর
কারুর হাতে হাতে খড়ি এলোমেলো অক্ষর
অনেক আগেই মাতৃগর্ভে তোমার নাম ডাক
নুপুর পরা আলতা পায়ে তোমার জলছাপ
শেলেট নিয়ে আঁকিবুঁকি, সকালবেলার উঠোন
একচালাতেই প্রথম পড়া, সহজ পাঠে মন
সেই তো প্রথম ভালোলাগা ভালোবাসার সুর
একতারাতে এপার ওপার অক্ষরের গুন
ভাষার কোনো হয়না বিভেদ, বাংলা আমার চোখ
ভাষার কাছে ভেসে যায় শহিদ হবার শোক----

শুভশ্রী সাহা, সিলভিয়া ঘোষ

প্রেমে অপ্রেমে 

  

কলিংবেলটা  বাজাতেই  সাউন্ড অফ মিউজিকের শব্দ ভেসে এলো  পার্থর কানে। মনে মনে ও বলে উঠল বাহ সত্যি দারুণ রুচি তো। এসব এলাকায় এমনটাই আশাকরা যায়। দরজা খুলতেই বের হয়ে এলো বছর সতেরোর শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে। ঠোঁট ফাঁক করে জিজ্ঞাসা করল 'কাকে চাই?' দোহারা চেহারার,  চোখে মুখে দারিদ্র্যতা থাকা সত্ত্বেও একটা বুদ্ধিদীপ্ত  ভঙ্গীমা কাজ করে। পার্থ গলাটা একটু ঝাড়া দিয়ে বলল ঃ  ' মিসেস দেব বাড়ি আছেন? আমাকে এই সময় আসতে বলা হয়েছিলো! ' মেয়েটি চোখের ইশারায় ভিতরে ঢুকে হাত দেখিয়ে সোফায় বসতে বলল।  নরম সোফায় বসার পর সেন্ট্রাল এসির ঠাণ্ডায় পার্থের চোখটা  একটু  লেগে এসেছিলো  প্রায়, তার মিনিট তিনেক পর মিস্টার দেব এসে বললেন 'হ্যালো ইয়ং ম্যান হাউ আর ইউ? আসলে তোমাকে ডেকেছি আমি, মিসেস দেবের জন্য।' পার্থ খুব মন দিয়ে মিস্টার দেবের কথা গুলো শুনছে। কেমন যেনো রাজা  রাজরার মতোন  চালচলন ভদ্র লোকের ।কথার মাঝেই পার্থ বলে ওঠে ঃ ' হ্যা, বলুন তো আসল অসুবিধাটা কি মিসেস দেবের!' 

প্রায় এক সপ্তাহ এ বাড়িতে আসছে পার্থ। এই চৈত্রের দুপুরে তেতে পুড়ে বাইক চালিয়ে কামালগাছি থেকে বালিগঞ্জ প্লেসের এই বাড়িতে আসতে জীবনটা বের হয়ে যাবার জোগাড়। আজকাল  এখানে এসেই মিনিট পাঁচেক বসে যতক্ষণ না পিউ (কাজের  মেয়েটি) এসে এক গ্লাস ঠাণ্ডা সরবত না দেয়। পিউ এর সাথে চোখাচোখি হতেই আজ কেমন যেনো  ও রহস্যের হাসি হসলো চোখ দিয়ে  সেটা খেয়াল করল পার্থ। সরবতটা শেষ করতে করতে ও ভাবলো গত পরশু ফিজিওথেরাপির জন্য না কি অন্য কিছুর জন্য  সর্বাঙ্গ প্যারালাইজড এবং আংশিক  জিভের আড়ষ্টতা নিয়ে মিসেস দেব যে কথাটা বলেছিলেন,  প্রথম তিনবার বুঝতেই পারেনি ও ,পরে অবশ্য ওনার  মুখের কাছে  মুখ নিয়ে শুনতে পেয়ে  পঞ্চাশোর্ধ  অসম্ভব সুন্দরী নারীর সামনে কান লাল হয়ে  দাঁড়িয়ে থেকেছে মিনিট পাঁচেক। পার্থর পঁচিশ  বছরের জীবনে অনেক অভিজ্ঞতাই জমেছে। 

পিজিতে ট্রেনিং নেবার সময় স্যর অজয় পণ্ডিত  বলেছিলেন,  'তোমাদের কাছে এমন অনেক  পেশেন্টই আসতে পারেন যারা সেক্সচুয়াল অ্যাটাচমেন্ট আশা করেন বা বলতে পারো তাই চান। তখন কিভাবে তাকে হ্যান্ডেল করবে তাও জানতে হবে তোমাদের। এটাও শিক্ষার একটা অঙ্গ।' বছর বিশেক এক অঙ্গ প্যারালাইজড মিসেস  ঋক্তা দেবের  চেহারার গ্ল্যামার দেখে পার্থ ফিদা। তবুও ওমন প্রস্তাবে কেমন যেনো গুঁটিয়ে নিয়েছে দু দিন। 

শরীরের চাহিদা বড় অসহায় করে তোলে মানুষ কে। পার্থর জীবনে কী তার প্রভাব কম!  বছর পনেরো আগের কথা মনেহয়  পার্থর। মাঝ রাতে ছোটক্কু কে দেখতে পেয়েছিল বড় মামনির ঘরে যেতে,তখন মামনির বয়স প্রায় ৫৫। জ্যা এর সাথে  মামনির কোনদিন তেমন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত  পার্থর মনে নেই। জ্যা মারা গেলেন তাও বছর দশেক হবে। আর ছোটক্কু ম্যানেনজাইটিস এ মারা  গেলো বছর চারেক আগে,  ওর  মুখাগ্নি  পার্থকেই করতে হলো, গত বছর মামনি মারা যেতে মা বলল 'এখানেও মুখাগ্নি  তোকেই করতে হবে ধরা পরতে হবিষ্যান্ন রান্না করে খেতে হবে বড়দার সাথে।' বড়দা কথা বলেনা তেমন পার্থের সাথে, যবে থেকে ছোটক্কু তার ভাগের সম্পত্তি পার্থের নামে দিয়ে গেছে...  
আজ পার্থ প্রস্তুত হয়ে এসেছে দরকারে যা যা করণীয় তাই তাই করবে...  শুধু  শুধু  লোভ সম্ভরণ করে কী লাভ! 

দরজা দিয়ে ঢুকতেই পরিচিত রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নাকে এল পার্থর, বিশাল বেডরুম এর মাঝখানের একদম রোজউড কালারের খাট। এ ঘরের সব কিছুই ভিক্টোরিয়ান স্টাইল এর আগেই দেখেছে সে ,হয়ত মিসেস দেব কিছুটা পুরোনো দিনকে যেন মনে রাখতে চান। সম্বিত ফিরতেই পার্থ দেখল মিসেস দেব তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে, চোখের কোণে কিছু কি চিকচিক করছে!! দূর এমন সেক্সি আইজ এ যৌনতার আমন্ত্রণ ছাড়া আর কিই বা হতে পারে... 

অস্থির লাগছে পার্থর নিজের, অসহ্য ছটফটানি ।কেউ জানবে না  বলে  মিস্টার দেব কথা দিয়েছেন, কিন্তু তার বিবেক আছে তো, তৃণা কে কি বলতে  পারবে সে কোনদিন  একথা !! তৃণা লড়াকু মেয়ে, মরালিষ্ট সে কখনো মেনে নেবে না। কিন্তু পার্থর এখন টাকার দরকার...নিজের পায়ে তাকে দাঁড়াতেই হবে,  যতই ছোটক্কুর দেওয়া  পয়সা কড়ি থাকুক না কেন , তৃণা নিজের পায়ে  না দাঁড়ালে  বিয়ে তো দূরের কথা বাড়িতেও জানাবে না বলেছে!! ওর মনে এখন দোলাচল, পজেটিভ নেগেটিভ কারেন্ট! সে বুঝতে পারছে, প্রতিটি মুহূর্ত সে শকড...

ক্রমে গোঙানির শব্দ বেড়ে যাচ্ছে, মিসেস দেব কি যেন বলতে চাইছেন, পার্থ এগিয়ে আসতেই যে দিক টি একটু সবল হয়েছে সেই হাত দিয়ে নিজের বুকটাকে স্পর্শ করাতে  চাইছেন যেন, ঈঙ্গিত টা স্পষ্ট।  পার্থ কেঁপে উঠল-- পাতলা নাইটির ভেতর দিয়ে করমচার মত লাল স্তন টি সুস্পষ্ট তার বৃন্ত আর সেটি উদ্ধত, পার্থ র সেদিকে চোখ পড়তেই নিজেকে শক্ত অনুভব করল সে-- একি হচ্ছে এমন তো সে চায় নি-- গরীবের ছেলে সৎভাবে রোজগার করতে চেয়েছিল। মিসেস দেব ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন,  উত্তেজনা তার জন্যে একদম নিষেধ...পার্থ ছুটে গেল কাত হয়ে যাওয়া মাথা বালিশে তুলেদিল। ঋক্তা তাকে আঁকড়ে ধরে কি যেন বলতে চাইল -- গোঙানিটা হঠাৎ আস্তে হয়ে যেতেই মনে হল সে যেন শুনল জয়'-- চমকে উঠল সে, এবার ঋক্তার দিকে তাকাতেই দেখল হ্যাঁ তিনি কাঁদছেন -- হাঁপাচ্ছেন পালস বিট বেড়ে গেছে অনেক বেশি।ছুটে গিয়ে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই মিস্টার দেব নিজেই বাইরে থেকে খুলে দিলেন।
ভেতরে ঢুকে নিজেই গিয়ে মিসেস দেবের হাত ধরলেন আর বলতে লাগলেন, ঋক্তা,  ঋক্তা স্থির হও-- আমি বলছি, আমি বলছি ওকে....
ঘরের আলমারীর ড্রয়ার খুলে একখানি বাক্স নিয়ে এলেন, হাতির দাঁতের কাজ করা। তার মধ্যে থেকে একটি সাদা কালো ছবি বার করে সোজা করে ধরতেই পার্থ চমকে উঠল। তার ছবির মতন লাগছে। সে জানে এই ছবি জয়প্রভ বসুর-- তার  ছোটক্কুর...

মিস্টার অশিন দেব তার পর তাকে এক গল্প শুনিয়েছিলেন-- সিনেমার মত হলেও তার জীবনের চরম বাস্তব। জয়প্রভ আর ঋক্তার কলেজ জীবন থেকেই ভালোবাসা, জয়প্রভ আর্ট কলেজের কৃতি ছাত্র হলেও খ্যাপা আধ পাগলা, খ্যাপামী দিয়ে তো জীবন চলে না, আর আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে আর্টে পেট ও চলত না। চা বাগানের মালিক দেবদত্ত রায় মানেন নি, আর জয়প্রভ যেন আগে থেকেই হেরে বসে ছিল। বিয়ে হল ধনীর পুত্র সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী দেব পরিবারের ছেলে অশিনের সাথে। অশিন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিল ঋক্তাকে, ঋক্তা পারেনি একদিন ও। বেড়াতে গিয়ে লোকে জানত দুর্ঘটনা কিন্তু আসলে , ঋক্তা পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে চেয়েছিল, কোনক্রমে পয়সার জোরে প্রান বাঁচলেও তার সাড় চলে যায় চিরতরে।  স্বামীকে তিনি বিয়ের রাতেই বলে দিয়ে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন-- অশিন চেষ্টা করব ভেবে নিয়ে জেদ ধরে ছিলেন, ঋক্তা নিজে মুক্ত হতে চেয়ে বন্দী হয়ে গেলেন বিছানায়-- তার একটাই আবদার ছিল স্বামীর কাছে 'জয়প্রভ' -- একটি বার আসবেন তার বুকে মাথা রাখবেন। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে অশিন ঠিকানা জোগাড় করে জানতে পারেন জয়প্রভ মৃত। ঋক্তাকে বলতে পারেন নি। বদলে পার্থ কে এনে দিলেন ঋক্তার কাছে। পার্থ র চেহারার সাথে প্রচুর মিল জয়প্রভর। নতুবা পার্থর মতন অল্প বয়েসী ফিজিওথেরাপিস্ট  তারা নেবেন কেন!!

পার্থ চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। মিস্টার দেবের সামনে দিয়ে উঠে গিয়ে জড়তা হীন ভাবে আলতো করে বালিশ থেকে মাথা ঊঠিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ঋক্তাকে-- আজ যেন চোখের সামনে  ভেসে উঠল তার  জন্মদাত্রী মায়ের  মৃত্যু শয্যার চেহারাটা । পরিষ্কার গলায় ডাকলো-- মামনি--
কুল ছাপিয়ে জল কি এমন ই ভাবে আসে!! ঋক্তা বত্রিশ বছরে এমন ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রথম। নির্বাক দুটি পুরুষের সামনে। পার্থ জোড়হাত করল মিস্টার অশিন দেব কে।  "আর কোন দিন ডাকলে আসতে পারব না কিন্তু, মামনি কে দেখবেন" এই কথা বলে -- পার্থ বেরিয়ে এসেছিল...
 ছমাস বাদে তাদের কামালগাছির বাড়িতে চিঠি এসেছিল ঋক্তার মৃত্যু সংবাদের।যাবার আগে,  বেশ কিছু টাকা আর পাইক পাড়ার একটি বাড়ী তার পুত্র সম পার্থ বসুর নামে উইল করে দিয়ে যান।পার্থ বসু এখন পাইক পাড়ায়,' ঋক্তা ফাউন্ডেশন এ নিয়মিত চেম্বার করেন।'

বনবীথি পাত্র


আত্মীয়

.
শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে আদ্যন্ত শহুরে রাহুল বোস চলল গ্রামের স্কুলে চাকরি করতে । ডাক্তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান সুশিক্ষিত , সুদর্শন ও স্মার্ট রাহুল বোসের গ্রাম সম্পর্কে কোনও ঘৃণা বা নাকউঁচু ভাব কোনোদিনই ছিলনা । বরং হোস্টেলে থেকে পড়ার সময় গ্রামের ছেলেদের সরলতা রাহুলকে বেশ আকর্ষণ করত । 
তালডুংরী রাধানাথ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক রাহুল বোস নয় নয় করে ছ'মাস এই গ্রামে কাটিয়ে ফেলল। প্রথম কটা দিন হোস্টেলে কাটানোর পর রাহুলের আশ্রয় হয় গ্রামেরই মোড়ল, স্কুলের সেক্রেটারি অবিনাশ সেনের বাড়িতে। অবিনাশবাবুকে বেশ আকর্ষণ করেছিল সুদর্শন, সুশিক্ষিত রাহুলের ব্যবহার । যা তিনি কোনদিন করেননি, সাত পাঁচ না ভেবে রাহুলকে একেবারে অন্দরমহলে ঠাঁই দিয়েছিলেন । অন্য কোনো বাসনাও ছিলনা । কারণ দুই কন্যা সন্তানের পিতা অবিনাশের বড়টির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগেই । দুই পুত্রসন্তানের জননী শরৎশশী এখন পাকা গৃহিণী । আর কনিষ্ঠা কন্যা বিন্দুবাসিনী পূর্বেই বাগদত্তা । এই গ্রামেরই সম্পন্ন ব্যবসায়ী অবিনাশের বাল্যবন্ধু মণীন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র সুকুমার অবিনাশের ভাবি কনিষ্ঠ জামাতা । আগামী মাসের ১১ তারিখ বিবাহের তারিখ ঠিক করা আছে ।
আজ তালডুংরীর প্রাক্তন জমিদার অবিনাশ সেনের বাড়িতে সাজো সাজো রব । বিন্দুবাসিনীর বিবাহ উপলক্ষ্যে অতিথি আপ্যায়নের সমস্ত দায়িত্ব রাহুলের হাতে সঁপে দিয়ে অবিনাশ নিশ্চিন্ত । অবিনাশ কন্যা সম্প্রদানের জন্যে প্রস্তুত । আর ওদিকে বিন্দু পাড়ার অন্যান্য এয়োতি ও তার বান্ধবীদের নিয়ে সাজসজ্জায় ব্যস্ত । বর আসার সময় হয়ে এল প্রায় । অবিনাশ ঘরণী বরণের জন্য প্রস্তুত । এমনসময় মণীন্দ্রনাথের বাড়ীর চাকর দৌড়াতে দৌড়াতে এসে অবিনাশকে বললে " বাবু , বাবু সর্বনাশ হয়েছে ...." ॥
এখন আর দাঁড়ানোর সময় নেই । শিগগির গাড়ি বের কর , ওকে নিয়ে এখুনি সদরে ছুটতে হবে । শরৎশশীর ছোটপুত্র চন্দ্রদ্যুতি বিয়েবাড়িতে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে । রক্ত ভেসে যাচ্ছে পাঁচবছরের ছোট্ট জ্ঞানহীন শরীরটা । দুই নাতি অবিনাশবাবুর প্রাণ । মেয়ের বিয়ে , অতিথি আপ্যায়ন , কন্যাদান সবকিছু ভুলে নাতির শরীরটা বুকে জড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসেন । সদরে পৌঁছাতেও দুঘন্টা লাগবে । শিশুটা বাঁচবে তো ? আনন্দের হাটে মুহুর্তে শোকের বাতাবরণ । 
            অবিনাশ - পত্নী শোক সামলেও বধূবেশী ছোট মেয়ের কথাও ভুলতে পারেন না । উনি তো চলে গেলেন , এখন কন্যাদান কে করবে ? বংশে তো অবিনাশবাবু একা । আর আত্মীয়স্বজন তো বেশির ভাগ ই ওনার সঙ্গে সদরে গেছেন । মেয়েটা কি তবে লগ্নভ্রষ্টা হবে ? মা - মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে কান্নাতে ভেসে যাচ্ছে । তখনি ঘরে ঢোকে রাহুল । ঠাকুরমশাই বলছেন এবার বিয়ে শুরু করতে হবে ।
বিয়ে তো হবে কন্যাদান কে করবে ?
মাসিমা আমি শুধু আপনাদের অতিথি, এখনো আপন হতে পারিনি। শুধু রক্তের সম্পর্ক থাকলেই বুঝি আত্মীয় হওয়া যায়, আত্মার বন্ধন বুঝি কিছু না ? কেন আমি কি বিন্দুর দাদা হয়ে ওকে সম্প্রদান করতে পারি না ?
রাহুলের এতবড় আন্তরিকতার কাছে কোন যুক্তিতর্কে না গিয়ে অবিনাশ পত্নী বিয়ে শুরু করতে বলেন ।
বিয়ের সমস্ত কাজ শেষে নবদম্পতি প্রণাম করে রাহুলকে । সুকুমারের হাত দুটো ধরে রাহুলের মিনতি, আমার ছোট বোনটাকে তোমায় দিলাম , ওকে ভালো রেখো। আমি একটু সদর থেকে আসি, এখনও কোন খবর তো পেলাম না ।
ধুতিটা ছেড়ে কোনরকমে জামা - প্যান্ট পড়ে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সদর হাসপাতালের দিকে । অবিনাশবাবুর পাশে দাঁড়ালে উনি একটু মনের জোর তো পাবেন ।

স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক

স্বপন যদি মধুর এমন




মাঝে মাঝে এমন সব স্বপ্ন আমরা দেখি যা দেখার পর ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় যেন আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আবার উল্টোটাও হয়। ঘুম ভেঙে মনে হয় ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিল! স্বপ্নকে অবহেলা করার সাধ্য বোধহয় আমাদের কারোরই নেই। বিশেষ বিশেষ স্বপ্ন আমাদের ভাবনায় কিছুটা হলেও স্থান পায়। কেউ কেউ যদিও বলেন বটে যে তিনি মোটেও স্বপ্ন দেখেন না। এই দাবি কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল। আসলে কেউ কেউ স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন না। তাই হয়তো কারোর মনে হয় যে তিনি স্বপ্ন দেখেন না। বাস্তবিকই আমরা স্বপ্নে যা দেখি তার শতকরা নব্বই ভাগই আমরা ভুলে যাই। স্বপ্ন দেখে উঠে সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেললে তবু অনেকটা ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর পাঁচ মিনিটের বেশি স্বপ্নের স্পষ্ট স্মৃতি থাকে না। অর্থাৎ সব মানুষই স্বপ্ন দেখেন। একমাত্র যাদের খুব বেশি মানসিক সমস্যা বা psychological disorder থাকে তারাই স্বপ্ন দেখেন না।

স্বপ্ন আসলে কি? সাধারণভাবে বলা যায় ঘুমন্ত অবস্থায় মানসচক্ষে দেখা কিছু ইমেজ বা ছবির সিরিজের সাহায্যে কোন কাল্পনিক ঘটনাপ্রবাহকে দেখতে পাওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্রষ্টা নিজেই সেই কাহিনীতে ভূমিকা নিয়ে থাকেন। আমি নেই অথচ সবকিছু আমি দেখতে পাচ্ছি এমন স্বপ্ন সাধারণত মানুষ কম দেখে। মানুষ স্বপ্ন দেখে যে অবস্থায় তাকে বলা হয় rapid eye movement (REM)। এই অবস্থায় চোখের মণির নড়াচড়া বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে হাত পা অবশ হয়ে যায়। প্রায় পক্ষাঘাতের মতোই। চাইলেও হাত পা নাড়ানো যায় না এই অবস্থায়। অর্থাৎ স্বপ্ন আমাদের ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যদিও non rapid eye movement (NREM) এও কিছু স্বপ্ন আসে, তবে তা খুবই আবছা ও অস্পষ্ট। স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা নিয়ে তৈরী যে বিজ্ঞান তাকে Oneirology বলা হয়।

একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো স্বপ্ন হলো সম্পূর্ণ অন্য একটি দুনিয়ার ঘটনাবলী। আবার কেউ কেউ মনে করতেন ঘুমোবার সময় আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। সেই সময় সে শরীরের বাইরে যা কিছু প্রত্যক্ষ করে তাই আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। প্রাচীন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ধারণায় স্বপ্ন ছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেনা অচেনা সমস্ত ঘটনার প্রতিচ্ছবি। কিছু প্রাচীন উপজাতীয় ধারণায় স্বপ্ন ছিল আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপনের উপায়। কোন কোন ধারণায় স্বপ্নকে অপদেবতার অভিশাপ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ান স্নায়ুবিশেষজ্ঞ, সাইকো-অ্যানালিসিসের জনক, সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর "The Interpretation of Dreams" বইতে আগের সমস্ত স্বপ্নতত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে নতুনভাবে স্বপ্নের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলেন যুক্তির সাহায্যে। ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন যে এরপর থেকে স্বপ্নকে আর অযৌক্তিক, অজ্ঞান চিন্তাধারার ফসল বা জীবনের বাইরের কিছু বলে বর্ণনা করা গেল না। আগে এমনভাবে স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করা হতো যেন কোন ব্যক্তি পিয়ানো না জেনেই পিয়ানোর সামনে বসে যেমন খুশী বাজিয়ে চলেছেন। কিন্তু তা যে একেবারেই নয়, বরং স্বপ্ন প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয় তা এই বই থেকেই জানা গেল। অর্থাৎ স্বপ্ন হলো এমন কিছু যা আমরা দেখেছি বা শুনেছি, যার সঙ্গে কখনো হয়তো আমাদের যোগাযোগ ঘটেছে, অথচ তেমনভাবে আমল দেওয়া হয়নি। যা আমরা দেখিনি বা যে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনাই নেই তেমন কিছু আমাদের স্বপ্নে আসতে পারে না। সারা পৃথিবী আজও ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বকে একরকম প্রামাণ্য বলে মনে করে। আসুন একটু জেনে নিই ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব কি বলে। 

গবেষণা অনুযায়ী এক একটি স্বপ্ন দশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। অর্থাৎ পঁচিশ মিনিটের বেশি সময় ধরে স্বপ্ন স্থায়ী হয়না। আমরা প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে চার থেকে সাতটি করে স্বপ্ন দেখে থাকি। যদিও সব আমাদের মনে থাকে না। স্বপ্ন হলো কতগুলি ছবি ও আবেগের সমাহার যা একজন ঘুমন্ত মানুষের কল্পনায় ধরা দেয়। ফ্রয়েড আমাদের মনকে তিনভাগে ভাগ করলেন। সচেতন মন বা conscious mind, অচেতন মন বা unconscious mind এবং অবচেতন মন বা subconscious mind। স্বপ্ন হলো এই অবচেতন মনের কারবার। এই মন আমাদের সচেতন মনের চেয়েও বেশি জানে। যা কিছু আমরা দেখি বা শুনি বা যে কোন ভাবে বলা যায় experience করি, যেমন শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য, স্বাদ, স্পর্শ বা অনুভূতি এই সবকিছুই আমাদের অবচেতন মনে রেকর্ড হয়ে যায়। আমাদের অজ্ঞাতেই। স্বপ্নে এই নানান সময়ের ইমেজ বা ছবিগুলো পরপর জুড়ে গিয়ে একটা গল্প তৈরী হয়। কিন্তু এই ছবিগুলো আসে এলোমেলো, অর্থহীনভাবে। যেভাবে আমরা স্বপ্ন বর্ণনা করি তেমন নিটোল কোন গল্প হয়ে স্বপ্ন কখনোই আসে না। স্বপ্নের বর্ণনা করতে গেলে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেয়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। কারণ স্বপ্নের স্মৃতি খুবই স্বল্পমেয়াদি হয়। স্বপ্নে পরপর ছবিগুলি আসে পরস্পর সম্পর্কহীনভাবে। হয়তো অতীতে দেখা কোন জায়গায় সদ্য পরিচিত কোন ব্যক্তিকে দেখা গেল, যেখানে তিনি থাকতে পারেন না। স্বপ্নে এমনটা হয়েই থাকে। কখনো বা একজন মানুষের চেহারার সঙ্গে তার কাজের মিল থাকে না। মিল পাওয়া যায় অন্য কোন খুব চেনা কারোর সঙ্গে। তবে স্বপ্নে এমন কোন মুখ আমরা দেখি না যা আমরা কখনো দেখিনি। অর্থাৎ স্বপ্নে সর্বদা পরিচিত মুখ আসে। হয়তো কোন মুখ আপাত অচেনা মনে হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সেই মুখ আমরা রাস্তাঘাটে কোথাও না কোথাও দেখেছি। হয়তো সচেতনভাবে খেয়াল করিনি। কিন্তু অবচেতন মনে সেই মুহূর্তের ছবি রয়ে গেছে। সাধারণত সাম্প্রতিক ঘটনা বা আসন্ন কোন ঘটনা নিয়েই স্বপ্ন তৈরী হয়। তবে অনেক সময় শৈশব বা কৈশোরের কোন স্থান বা ঘটনা স্বপ্নে বার বার ফিরে আসে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, অন্ধ মানুষও কিন্তু স্বপ্ন দেখেন। যদি তিনি জন্মান্ধ না হয়ে থাকেন তাহলে দৃষ্টিশক্তি থাকা অবস্থায় তিনি যা কিছু দেখেছেন স্বপ্নে তাই আসবে। আর যদি জন্মান্ধ হন তাহলে যা কিছু তিনি অনুভব করেছেন সে সমস্ত স্পর্শ গন্ধ বা শব্দ তার স্বপ্নে আসবে। 


ফ্রয়েডের মতে সব স্বপ্নই ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন। যেসব ইচ্ছা বা কামনা বাসনা আমরা সচেতনভাবে পূরণ করতে পারি না তাই আমাদের স্বপ্নে রূপকের মাধ্যমে দেখা দেয়। যেমন এমন অনেক ইচ্ছা বা কামনা আমাদের থাকে যা নিয়ে হয়তো আমরা সচেতন অবস্থায় ভাবতেও চাই না। লজ্জা, ভয়, আড়ষ্টতা, সমাজের বিভিন্ন নিয়ম আমাদের এইসব ইচ্ছাকে অঙ্কুরেই অবদমিত করে দেয়। আমরা শুরু থেকেই বুঝতে পারি এমন কিছু ভাবতে নেই। যেমন যৌন ইচ্ছা বা অর্থ প্রাপ্তির ইচ্ছা। এই ধরণের ইচ্ছা আমরা কখনোই বাস্তবে প্রকাশ করি না। কারণ আমরা সকলেই নিজেদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ও যত্নশীল। এই সমস্ত ইচ্ছা আমাদের অবচেতন মনে স্থান পায়। সচেতন মন তাকে অস্বীকার করতে চাইলেও এই ইচ্ছাগুলি কখনোই একেবারে বিনষ্ট হয় না। এগুলোই স্বপ্নে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে আমাদের কাছে ধরা দেয় যাতে দ্রষ্টার সচেতন মনের আবেগে ধাক্কা না লাগে। কখনো তা সামান্য স্পষ্ট কখনো আবার অস্পষ্ট। যদিও ফ্রয়েডের এই ইচ্ছাপূরণ তত্ত্বকে সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল জং মেনে নিতে চাননি। তবে ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব সাধারণ মানুষের কাছেও গৃহিত হয়েছে কারণ যৌক্তিকতার বিচারে এভাবে আর কেউ স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। 

স্বপ্নে আমরা যে রঙ দেখতে পাই তা আমাদের বর্তমান জীবনের রঙ, যা আমরা রোজ দেখছি। জেগে থাকা অবস্থায় যেসব রঙ আমরা দেখতে পাই স্বপ্নেও সেসব রঙই দেখি আমরা। তবে ছবিগুলি হয় সামান্য অস্পষ্ট বা যাকে বলে out of focus। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সাদা কালো স্বপ্নও হয়ে থাকে। তবে সাদা কালো স্বপ্নের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম আসে। ফ্রয়েডের মত মেনে নিলে বলতে হয় সব স্বপ্নই কোন না কোনভাবে আমাদের ইচ্ছাপূরণ করে। যেমন একজন মেডিকেলের ছাত্র এমন স্বপ্ন দেখতেই পারে যে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে এবং তার চিকিৎসা চলছে। এই ভেবে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে যে সে ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। এই স্বপ্ন দেখার কারণ হলো তাকে সকালে তাড়াতাড়ি হাসপাতাল পৌঁছতেই হবে। 

শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিরাও কিন্তু স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্ন সাধারণত অন্য কোন প্রাণীকে তাড়া করা বা অন্যের আক্রমন ইহাকে বাঁচার জন্য পালানো নিয়েই হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমাদের স্বপ্নে কিছু বাস্তব ঘটনাও ঢুকে পড়ে। যেমন স্বপ্নে ট্রেনের ঝাঁকুনি দেখে ঘুম ভেঙে হয়তো দেখা গেল মা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছেন। সাধারণভাবে পুরুষ ও মহিলাদের স্বপ্ন আলাদা ধরণের হয়। গবেষণা থেকে জানা যায় কোন ব্যক্তি যখন নাক ডাকেন তখন তিনি স্বপ্ন দেখেন না। 

স্বপ্ন সত্যি হওয়া নিয়ে অনেক রকমের ব্যাখ্যা রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হলো আমাদের অবচেতন মন বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্নের তুলনা করতে চায়, তাই অনেক ক্ষেত্রে যা আমরা স্বপ্নে দেখি তা সত্যি হয়ে যায়। স্বপ্ন স্পষ্ট হোক বা অস্পষ্ট সব সময়েই একটা অনিশ্চয়তার বা দুশ্চিন্তার ভাব কাজ করে। স্বপ্নের অর্থ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। যেমন গর্ভবতী হওয়ার স্বপ্ন বোঝায় কোন নতুন ঘটনা বা কাজের সূত্রপাত। মৃত্যুর স্বপ্ন বোঝায় বহুদিন ধরে চলে আসা কোন ব্যক্তির বা কাজের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করাকে। বিভিন্ন প্রতীকও দেখা যায় স্বপ্নে। জল, লাঠি, সাপ এসব নানান প্রতীকের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ঘটনাকে বোঝানো হয়।

শেষ করার আগে স্বপ্ন নিয়ে কিছু মজার তথ্য দিই। স্বপ্ন শুধুমাত্র অবচেতন মনের রচিত গল্পমাত্র নয়। স্বপ্ন অদ্ভুতভাবে অনেক সমস্যার সমাধানও করে। হয়তো কোন কঠিন সমস্যার সমাধান জাগ্রত অবস্থায় হয়নি, স্বপ্নে তার সমাধান হয়ে যেতে পারে। কঠিন অঙ্কের সমাধানসূত্র স্বপ্নে হয়েছে এমনও শোনা যায়। আবার বিখ্যাত সব আবিষ্কার বা সাহিত্য রচনাও স্বপ্নের প্রভাবে হয়েছে এমন শোনা গিয়েছে বহুবার। যেমন বৈজ্ঞানিক নিলস বোর তাঁর পরমাণু তত্ত্বের মূল ভাবনা স্বপ্নে পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানী মেন্ডেলিভও তাঁর পিরিয়ডিক টেবিলের ছকটি স্বপ্নে পেয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। আবার বেনজিনের গঠন তত্ত্বও বিজ্ঞানী কেকুলে স্বপ্ন থেকেই পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের "রাজর্ষি" নাটকের কাহিনী যে স্বপ্নে পাওয়া তা আমরা অনেকেই জানি। আবার ইংরেজ কবি কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা "কোবলা খান"ও তিনি আফিমের নেশায় ঘুমিয়ে স্বপ্নে পেয়েছিলেন। এ তো গেল স্বপ্নে পাওয়া কিছু অমূল্য প্রাপ্তির কথা। অন্যদিকে স্বপ্ন নিয়ে অজস্র গল্প কাহিনী রচিত হয়েছে। শুধু স্বপ্নের ধারণাকে কেন্দ্র করেই বিশ্ব সাহিত্যের প্রচুর গল্প কবিতা নাটক নভেল লেখা হয়েছে। লুই ক্যারোলের লেখা বিখ্যাত কাহিনী "অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড", আমাদের অবন ঠাকুরের লেখা "বুড়ো আংলা" বা সুকুমার রায়ের অমর সৃষ্টি "হ য ব র ল" প্রভৃতি- এই সমস্ত সাহিত্যই বিশ্বের বিস্ময় এই স্বপ্নকে কেন্দ্র করেই রচিত। তাই সবশেষে এই প্রতিবেদনটির শিরোনামের সুরে বলতে ইচ্ছে করে, 'স্বপন যদি মধুর এমন হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিও না আমায় জাগিও না।'