রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                 



সাইকেল

তৃতীয় পর্বের পর 

৪) 

   অভিজিতের সঙ্গে ওদের বাড়িতে পৌঁছল সামুয়েল। শহরে এসে বাইকস্ট্যান্ডে নিজের বাইক রেখে দেয় অভিজিৎ। সেই বাইকের পিছনে বসে প্রায় ঘন্টাখানেক জার্নির পর ওদের গ্রাম। এই সেই বরবরুয়া গ্রাম, ছবির মতো সবুজ ও সুন্দর। প্রথম দেখেই এই গ্রামের প্রেমে পড়ে গেল সামুয়েল। তারপর যে ওর বাড়িতেও আরেক দফা বিস্ময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল, সে ওর ধারনার বাইরে ছিল। ওদের বাড়ির এলাকা গাছের বেড়া দেওয়া। ভেতরে কিছুটা অংশ পাকা বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায়, নতুন তৈরি হয়েছে। আর পিছনের দিকে মাটির বাড়ি, মাটির দেওয়ালে আবার সুন্দর কল্কা, ফুল, বাঘ, হরিণের ছবি আঁকা। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। যদিও অভিজিৎ ওকে পাকা বাড়িতেই এনে তুললো। অভিজিতের ঘরেই এলো ওরা। সুন্দর, পরিপাটি, বাহুল্যবর্জিত ঘর। ঘরের একপাশে একটা খাট, আলনা, আর কাঠের চেয়ার, টেবিল। ব্যস্‌। কুলুঙ্গির মতো একটা জায়গায় আয়না টানানো রয়েছে। টেবিলে অভিজিতের ছোটবেলার ছবি একটা। দুচারটে বই। চেয়ারে বসল সামুয়েল। অভিজিতের বাবা মা এলে হাতজোড় করে প্রণাম করল ওদের সামুয়েল। অভিজিৎ জানাল, ওর এক ছোট বোন আছে, ইলেভেনে পড়ে, এখন স্কুলে সে। খুব পাজি নাকি সে! একটা সুন্দর হাসিখুশি পরিবারে এসে সামুয়েল সাতদিনের জন্য আস্তানা গাড়ল। অভিজিৎ রইল পাশের ঘরে, যে ঘর ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাল সামুয়েলকে ও। বাবা মায়ের ঘরের পাশেই এক চিলতে বারান্দা ঘিরে পড়ার টেবিল-চেয়ার। ওখানেই নাকি ওর বোন পড়াশুনো করে। মাছের ঝোল দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে টেনে ঘুমলো সামুয়েল। ওকে এভাবে তৃপ্তি করে খেতে দেখে অভিজিতের মাও খুব খুশি! ফলে একাত্ম হতে সামুয়েলের একটুও সময় লাগল না। বিকেলে চা দিতে এলো কাকিমা। অভিজিৎ তখন টেনে নিয়ে এলো বোনকে। রোগা, পাতলা গড়নের এক কিশোরী সে। টানা টানা চোখ, এক ঢাল কালো কোঁকড়া চুল কপাল ঢেকে রেখেছে তার। শ্যামলা মেয়েটির মুখে একটা আলগা শ্রী আছে, এটুকুই। আর রয়েছে চোখ ভর্তি বিস্ময় আর দুষ্টুমি। সামুয়েলের সামনে প্রাথমিক জড়তা কাটছিল না তার। যেহেতু ইংরেজি বলতে সে সড়গড় নয়, তাই কথাবার্তাও কিছু হল না। একটু ফিকে হাসি হেসে বসে রইল খাটের ওপর। আর অনবরত ঠ্যাঙ দুলিয়ে যেতে লাগল। চা পর্বের পর, একসময় সামুয়েল আর পারল না। বলেই ফেলল। ‘তুমি কি পা না দুলিয়ে থাকতে পার না?’ ওর কথায় হকচকিয়ে গেল সেই মেয়ে। আর অভিজিৎ হাহা করে হেসে উঠল। রাগে দাদার দিকে চোখ পাকিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ও। ওর নাম বুলবুল। সামুয়েল জানল যে বুলবুল এক পাখির নাম। যদিও বুলবুলের একটা পোশাকি নামও আছে। শ্রীময়ী।  

     রাতে খাওয়ার সময় এক ঝলক দেখা গেল বুলবুলকে। অভিজিৎ অনেকবার ডাকল একসঙ্গে খেয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেল না। আপন মনেই অভিজিৎ বলে উঠল, রাগ হয়েছে! এই এক রোগ ওর। এমনিতে সব ভাল, শুধু রেগে গেলেই তার মান ভাঙাতে ভীষণ সমস্যা। সামুয়েল বুঝল, একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে ও। আন্তরিক ভাবে তাই অভিজিতকে বলল, তুমি তোমার বোনকে একবার ডাক। আমি খুব লজ্জিত। ক্ষমা চাইব ওর কাছে। কিন্তু বুলবুলের আর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সে যে আশপাশেই আছে, এবং ওদের কথা কান খাড়া করে শুনছে সেও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল একটু বাদেই। খেয়ে হাত ধুতে যাওয়ার সময় সামুয়েল শুনল, বারান্দায় এক জোড়া পায়ের শব্দ দ্রুত পালিয়ে গেল। নিজের মনেই হাসল ও। ভাবল, থাক এখন। একটু মজা নেওয়া যাক বরং! হাত ধুয়ে গিটারে সুর তুলে গান ধরল ও-

Como cada noche desperté pensando en ti

Y en mi reloj todas las horas

vi passar

Porque te vas

(প্রতি রাতের মতো, আমি জেগে উঠব, আর তোমার কথাই ভাবব…আমার ঘড়িতে দেখব সমস্ত সময় পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…) 


রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

Prosenjit Kabasi প্রসেনজিৎ কাবাসী

 


প্রান্তিক সরকার

 


পলাশ কুণ্ডু

 






তুষ্টি ভট্টাচার্য

                             


দ্বিতীয় পর্বের পর 

৩) 

  খুব ভোরে উঠে পড়ে সামুয়েল। এ তার পুরনো অভ্যেস। ঘুম থেকে উঠেই সাইকেল নিয়ে কসরত করে সে। সাইকেলটাও যেন এই সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এইটুকু সময় শুধু তার আর সামুয়েলের। যেহেতু এই গ্রামের রাস্তার প্রায় সবটাই সমতলে, তাই চড়াই উতরাই ভাঙতে সে চলে যায় ওই দূরের পাহাড়ের দিকে। পাহাড় তো নয়, টিলার মতো। পাথুরে কিছুটা হলেও, সবুজে ঢেকে আছে এখন। পায়ে চলা পথ ধরে সামুয়েল আর তার সাইকেল সোজা উঠে যায় পাহাড়ের মাথায়। সূর্যটাও তখন পাহাড়ের মাথায় এসে হাজির হয়। এতদিনে আশেপাশের বসতির সবাই, মায় এই পথঘাট, গাছপালা, পশুপাখি, সবাই জেনে গেছে যে, এক বিদেশী ছেলের সাইকেলের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙবে আর সেই ছেলের গলায় থাকবে ভাঙা ভাঙা অসমীয়া গানের কলি। ঠিক এই যেমন এখন যদি কেউ ওই টিলার মাথায় এসে দাঁড়ায়, শুনতে পাবে…

নিবিড় বনে যে মাতিছে যা/ যা যা দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা/ সোনৰে সজাটি এৰি থৈ যা/ যা নীলিম আকাশলৈ/ সোনালী ৰদে যে মাতিছে যা/ জোনৰে জোনাকী মাতিছে যা/ যা পখী দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা

 এই একটি মাত্র গান সে আয়ত্ব করেছে। এই সুর তাকে খুব টানে। অবশ্য জয়ন্ত হাজারিকার বেশ কিছু গানই ভাল লেগেছে ওর, কিন্তু ভাষা আর সুর রপ্ত করতে সময় লাগবে। আর তুলতে হবে ভূপেন হাজারিকার কিছু গান। টিলার ওপর এসে সামুয়েল কিছু ব্যায়াম করে সাইকেল নিয়ে। শরীরে আর এই সাইকেলে জং ধরতে সে দেয় না কোনোমতেই। তাকে সব সময় প্রফুল্ল রাখে সুর আর গান। কত দেশে সে গেছে, কত রকম মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সব মানুষের মুখ যে ওর মনে থাকে, বা মনে রাখতে চায়, তাও না। কিন্তু সুর সে ভোলে না। কথা ভুলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু সুর মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কখন যে কোন সুরে সে গুনগুনিয়ে উঠবে বা গিটারে কী যে সে বাজাবে, সেও জানে না! 

  সেদিন অভিজিতের সঙ্গে আলাপের পরদিনই ওরা আবার এক ক্যাফেতে আড্ডা দিতে বসেছিল। অভিজিৎ গরগাঁওয়ে যুবা উৎসবে ওকে নিয়ে যেতে চাইছিল, চাইছিল বলা ভুল, একরকম জোর করছিল ওকে ওখানে যাবার জন্য। খুব বেশি ভিড় সামুয়েলের ভাল লাগে না, তবু অভিজিতের উপরোধে ওকে রাজি হতে হয়েছিল সেদিন। এখন মনে হয়, সেদিন যদি ওই উৎসবে না যেত ও, এই গ্রামে আসাও হত না ওর। অথবা মণিপুর থেকে সে যদি ফেব্রুয়ারিতে আসামের শিবসাগরে না আসত, তাহলেও অভিজিতের সঙ্গে দেখা হত না। সবই বোধহয় পূর্বনির্ধারিত। নইলে কোথাকার কোন বরবরুয়া গ্রাম, আজ তার নিজের ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে! ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল সামুয়েলের মন কেড়ে নিয়েছিল। অসমীয়ার বিহু নাচগান আর সুর, তাল, ছন্দে সে খুব একাত্ম বোধ করেছিল সেদিন। আসলে তার নিজের বাসস্থান যেখানে, সেও তো এমনই এক মায়াময় দেশ। কান্ট্রিসাইডে এক বিরাট খামার রয়েছে ওদের। চাষবাস তাদের পরিবারের রক্তে। আর সুর! তাদের পরিবারের সবারই রক্তের মধ্যেই সুর দৌড়ে বেড়ায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে মুখে হাসি লেগে থাকে স্রেফ এই অজস্র, অনর্গল গান আর সুরের জন্য। টনিকের মতো কাজ করে। 

  একটানা সাতদিন যুবা উৎসবে ভাগ নিয়েছিল ওরা। এমনও হয়েছে, নিজের গিটার নিয়ে নাচেগানে ওদের সঙ্গে মেতে উঠেছে সামুয়েল। এমন একটা প্রাণবন্ত ছেলেকে, বিদেশি হলেও কাছে টানতে কারুর দেরি হয়নি। শেষদিন অভিজিৎ আর সামুয়েল প্রচুর মদ্যপান করে একসঙ্গে। আর সেই সময়েই অভিজিতের সঙ্গে ওর গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকতে চায় ও। অভিজিৎ অবাক হলেও, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। যদিও একটু কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল ওর…একজন সাহেবকে নিয়ে গিয়ে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে, ওইরকম গ্রামে সাহেব কি থাকতে পারবে আদৌ…এইসব নিয়ে যখন মনে মনে ভাবছে অভিজিৎ, ভরপেট মদ খেয়েও সামুয়েল কী করে যেন ওর মনের কথা ধরতে পেরে গেছিল। নিজেই জড়ানো গলায় আশ্বাস দিয়েছিল, আমাকে নিয়ে ভেব না। এই সাইকেলে আমি কত যে দেশ ঘুরেছি, কত গ্রাম, জঙ্গল, পথঘাটে না খেয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে, জল পর্যন্ত ফুরিয়ে যেত একেক সময়ে, ফলে আমাকে নিয়ে টেনশন কর না। তোমরা যেমন ভাবে থাকবে, আমাকেও সেভাবেই রাখবে।

   তবুও দুরুদুরু বুকে সামুয়েলকে নিয়ে গ্রামে এসেছিল অভিজিৎ। ঠিক হয়েছিল সাতদিন থাকবে এখানে সামুয়েল। তারপর রওনা দেবে দেশের উদ্দেশ্যে। ততদিনে টিকিট কেটে রাখতে হবে। কারণ ওর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে।        


(ক্রমশঃ)

শৌনক দত্ত

                                       




সৃজন এই সংখ্যার কবি শৌনক দত্ত।জন্ম - ৭ ই আগষ্ট( ২১ শে শ্রাবণ ) কোচবিহারের ব্যাঙচাতরা রোড। স্কুল জীবন শুরু জেনকিন্স -এ আর সেই সময় থেকেই লেখালিখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিনের। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত।

প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ :

জল ভাঙে জলের ভেতর (২০১১)

ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ (২০১২)

ডুব সাঁতার (২০১৭)

নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ (২০১৭)

গল্প গ্রন্থ :

কারুময় খামে অচেনা প্রেম (২০১২)

শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা, ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন।

রা' প্রকাশন থেকে দুই মলাটে বন্দী হতে চলেছে তাঁর প্রবন্ধের সমাহার।


পরকীয়া

অন্য  বিছানায় শুয়ে 

সমুহ সময় 

ধাতস্থ হবার

 আগে অন্যকেউ

 মুখস্থ করে ফেলে 

নকশীকাঁথা বুনন।

বৃষ্টির নকশীকাঁথা তুমি আমাকে উপহার দেবে

আর

আমি তোমাকে উপহার দেব নিঝুম দ্বীপের শাড়ি।


কুয়াশা ভেজা রোদ,দুপুর

০৭ জানুয়ারি,২০১৮



আমার ছেলেবেলা

যে-শহরে বেড়ে ওঠা-তার ডাকটিকিট জুড়ে পাহাড়। যখন-তখন আমরা সর্ষে ফুলের গন্ধ পকেটে নিয়ে পাহাড়ে যেতাম। বড়রা যেত সমুদ্রস্নানে।তোর্ষার বাতাসে ভেসে বেড়াত তাদের অলৌকিক মেয়েবন্ধুদের শিহরণজাগানো সব ফিসফাস। ঢেউয়ের ডানায় চেপে ‘লাল দোপাট্টা’ উড়িয়ে তারা ফিরে আসতো।আমরা রঙধনু বোতাম খুলে উড়িয়ে দিতাম ঘুড়ির শৈশব।


শীত সন্ধ্যা,আশ্রম

১২ ফেব্রুয়ারি,২০১৮


আমার শরীর


তোমার সাথে কাটানো যে শরীরটা রোদ ভাঙলো ...

সে শরীর প্রতি রাতে পাহারা দিই, 

দেখি 

এক নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের দিকে দরজা খোলা

যেখানে ধ্যানী বয়স শিরার ভেতর বিশ্রাম নেয় 

অবসন্ন জাহাজ চোখে অবতরণ করলে

আমরা প্রতিবিম্বিত হই

জোছনায় বোনা লাইট হাউজে।



বেডরুম,মধ্যরাত

১২ আগষ্ট,২০১৮



নির্জনতার ডাকনাম মৃত্যু


জন্ম খুলে বসে আছে মৃত্যুর বিস্ময়,একটা প্রেমহীন আয়নায় প্রতিদিন মুখগুলো গলে যায় রোদের বিকালে মৃত ডুমুরের নীরবতায়। ক্রমশই রহস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে চিলেকোঠায় পুরোনো চিঠির বান্ডিলে শব্দের সিম্ফনি, নৈঃশব্দ্যের নিঃশ্বাস।

বল “মৃত্যু” এবং পুরো বাড়িটা জমে যায়—


পড়ন্ত বিকাল, স্টাডি

০৩ জানুয়ারি,২০১৯



হঠাৎ পাওয়া ছেলেবেলা...


রাফ খাতা ভর্তি দুপুর, সাইকেল নির্জনতা

সেই সব ছায়াপথ… সেই সব মুখরতা

হঠাৎ পাওয়া ছেলেবেলা!

ঘড়িপাড়ার পুল পেরিয়ে স্মৃতি বনের পাশ দিয়ে যে রঙ্গীন ঢালু পথ চলে গেছে, তার শেষ মাথায় সুনসান একটা ছেলেবেলা দাঁড়িয়ে । নয়নাপাড়ায় কুটুম্ব বৃষ্টি নামলে নির্জনতার বুকে জমা হওয়া সমস্ত বিষন্নতার সংগীত আমার মুখস্থ আমি তার স্বরলিপি লিখে রেখেছি জং ধরা নীল বেহালার তারে.

ফেরিওয়ালাঘুম দুপুরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা পথের উড়নচন্ডী ধুলোয় যত হাহাকার ডুবে থাকে,সোনালী, রুপালী আধুলির ছক আঁকতে আঁকতে খুব তাচ্ছিল্যে আটকা পড়েছে আমার যাবজ্জীবন আমার ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিলের পাশে,

সে পথ আমার সমগ্র সংসার হারিয়ে ঘরের দিকে ফিরে যাওয়া......

শীতে বেডরুম ঢাকা, 

মধ্যদুপুর

০৫ জানুয়ারি,২০১৯




শীত ২০১৯



দিন গুলো অ্যাজমাটিক… নিঃশ্বাসের টানাপোড়েন। আমাদের নাগরিক জনপদে শীত আসে দূরবর্তী মফঃস্বল থেকে উলাক্রান্ত জানালায় । শীত এলো আমাদের শহরে, শীতের গল্প নিয়ে....

আমাদের ক্যালেন্ডার শীত রঙের দাগে ভরে যাচ্ছে, হিমফুল চোখে প্রতিদিন দেখি। রঙিন শিশির বিন্দু বিন্দু মুগ্ধতায় নির্বাক বায়োস্কোপে ছবি হয়ে ফোটে। অমিলিত বিচ্ছেদে তুমি শেষমেষ দুরত্বপ্রবাল।

পায়ের ছাপ হারিয়ে যেতে যেতে হলুদাক্রান্ত দুপুর গুলো বাজেয়াপ্ত । শৈতপ্রবাহ শেখায় দুই অক্ষরের মাঝে বিচ্যুতির ব্যবধান। বার বছর আগের একটা শীতার্ত প্রেম কম ভোল্টেজের আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বুকের ব্যালকনিতে, প্রায়ই। খুব উসখুস ৷ একা একা এক কাপ লাল চায়ে ঊষ্ণতার ঘ্রাণ এবং কতিপয় দৃশ্যের বিষন্ন জলরঙ,

অথচ আমার কিছুই জানা হয়না…

শুধু শুধু সারাটা শীতঘুম জুড়ে সুনীতি হাইস্কুল

পুকুর ঘাটে সবুজ পাড়ের শাড়ি পুড়ে যায়, যাচ্ছেতাই....


সন্ধ্যা,বেডরুম

০৬ জানুয়ারি,২০১৯








শহরের শীতকালীন উৎসব

___________________________

আজকের আবহাওয়ায় কোন শোক নেই ।

জাহাজ ভিড়েছে 

নাবিকের সমুদ্র ভেজা নিঃশ্বাস ঢুকে পড়ছে... শহরে, অলিতে গলিতে ।


নিশুতি যাপন… খুব অগোচরে, 

যেমন করে পড়ে থাকে ঘুমের ভেতর বহুকাল আগের আধুলি স্বপ্ন ।

কবরের নৈঃশব্দ্যে সন্ধ্যা নামছে ৷গ্রীলে ঝুলছে তরুনী বউদের রাত্রিকালীন পোষাক । 

এখানে আমার কোন উপাসনালয় নেই ।


মাঝেমধ্যেই রানিপুরম ধরে ধরে একটা সুড়ঙ্গ পথে যেতে সাধ হয়

যে পাহাড়ের নিচে রেখে এসেছি সোনারঙ ‍দুপুর, 

রাতের ডুব, কিছু ভেজা আঙুল ।


আমি বাড়ি ফিরে এসেছি... অগোচরে 

দূরে... দূরে সরে যাচ্ছে বন্দর

ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে গুটিয়ে থাকা পথের রঙ ।

মধ্যদুপুর

১৬ জানুয়ারি,২০১৯


নগর

_______

ঝুপঝাপ সন্ধ্যা নামছে

গাছ মুছে দিয়েছে

রোদের যৌবন

করিডোরের অশ্রু চেটে নেয় অন্ধ স্ট্রীট লাইট

হেঁটে যায় জ্যামিতি-বক্সের দিকে-

ঠিকানাবিহীন এক চিঠি

গতি কামড়ে ধরেছে পা

পাতায় পাতায় ভেঙে পড়ছে ঘর-বাড়ি

উটের ছায়ায় ছায়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে নগর।


সন্ধ্যা,নগরের পথে

২০ জানুয়ারী,২০২০


ফ্যান্টাসি

__________

পেরেক আর দেয়ালের প্রেম নিয়ে কথা ফুরালে

চুমু থেকে উড়ে যায় ঠোঁট

শপিং মলের ভেতর জ্বল জ্বল করছে

এক আকাশ তারা।

জঙ্গল সাঁতরে ফিরে এসেছে ঘুম

যুবতীরা টুপটাপ ঢুকে পড়ছে আধ খাওয়া আপেলে

পাটিগণিতের প্রস্তাব থেকে

গড়িয়ে পড়ছে ঘুঙুর।

ভোরবেলা!

নদীর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পোড়াবাড়ির গন্ধ!


মধ্যরাত, ব্যালকনি

২৩ জানুয়ারী,২০২০



মাধুকরী হাতে নিয়ে

___________________________



পোয়াতি পালক থেকে ঝেড়ে ফেলো অতীতের সব পাণ্ডুলিপি। জানো তো-

সুতীব্র আলোও এক আজানা অন্ধকার।


যে শৈশব বন্ধু অলিন্দে সাগর হয়ে বেলাভূমি খোঁজে। তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছি পাখির শিস!আলোর ফেনিল থেকে মুছে নিয়ে বিদেহী আগুন। কুটিরের দায় মুছে সূর্যের প্রলেপ দিয়ে প্রতিদিন অন্ধকার লিখি। আর,চিরুনী জুড়ে তল্লাসী জীবন!


গোপন জ্বরের মতো পৃথিবীরও আজ স্বপ্নদোষ। ঐ দেখো,ভিক্ষার থালা থেকে শালিক খুঁটে খুঁটে খায় দিন।

চোখেতে বর্ষামঙ্গল লিখে আমার নিখোঁজ। অন্ধ চিত্রকর ক্যানভাসে হাসি ছড়িয়ে কান্না আঁকছে হাজার বছর।


আমরা জবা ফুলের মতোন মুখস্থ করেছি বিমুগ্ধ জলের ছাপ!



বাসা,মধ্যরাত

১৬ জুলাই,২০২০



রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

Brian Kitt





 

Saraswatiroa Korlapati




 

Abhishek Bhattacharjee

 




Raja Chenna




 

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                  


 সাইকেল 


  

প্রথম পর্বের পর 


২) 

  সামুয়েল কাঁধ ঝাঁকাল অদ্ভুত ভঙ্গি করে। যেন ও নিজেই ঠিক বুঝতে পারছে না—মন খারাপ লাগছে কিনা। এই বরবরুয়াদের গ্রামটাকে সামুয়েলের খুবই ভালো লেগে গেছে। আর সেই ভালো লাগার মাশুল গুণছে এখানে আটকে পড়ে। ভাগ্য যে এভাবে ওকে আসামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে এনে ফেলবে, এনে ফেললেও এখানেই সাময়িক আস্তানা গড়ে দেবে ওর, কে জানত! এই বাচ্চাদুটো ওর খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে। একজনের ক্লাস থ্রি, একজনের টু। বড়টার নাম রুবাই আর ছোটটাকে সামুয়েল ডাকে মাদাম বলে। আসলে ও সবার মুনিয়া। রুবাই ওর সাইকেলে উঠে প্যাডেলে পা পৌঁছনোর চেষ্টায় মত্ত। আর মাদাম এখন গিটারে টুংটাং করছেন। মেয়েটার তেলমাখা খোঁচা খোঁচা চুলে হাত বুলিয়ে দিল ও। আদর পেয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল ও। তারপর আবার গিটারে মন দিল। যেন এই মুহূর্তে জি শার্পে গিয়ে সে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। এটুকু প্রশ্রয় ওদের দেয় সামুয়েল। শুধু এই দুটি না, আরও কয়েকজন এসে জোটে ওর কাছে। বরাবর ছোটদের পছন্দ করে ও। ওদের পালস্‌ বোঝে, আর তাই যেখানেই যাক, ছোটরা ওকে ঘিরে রাখে। এই বরবরুয়া গ্রামে এসে ওদের ভাষার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল প্রথমটা। তারপর আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, ভাঙা ইংরেজিতে বস্তুর নাম বলে বোঝাতে পেরেছে কিছুটা। এভাবেই চলেছে দুপক্ষের ভাষা শেখার খেলা। এখন তো অসমীয়া, স্প্যানিশ আর ইংরেজির সহাবস্থানে গ্রামের বিকেলগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট স্কুলের মতো তৈরি হয়ে গেল এভাবে। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়! 

  জুন, জুলাইয়ের এই ভরা বর্ষায় অবশ্য মাঠেঘাটে ওদের স্কুল বসতে পারে না। কারুর ঘরে, বারান্দায় মায় পরিত্যক্ত গোয়াল বা রান্নাঘরেও চলে ওদের পাঠ। আজ তিনমাস হয়ে গেল এখানে এসে। তিন মাস তো না, যেন এক যুগ! গত বছর আগস্টে স্পেন থেকে উড়ান দিয়েছিল সে জাপানের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী ছিল তার সাইকেল। সেই জাপান থেকে সাইকেলে চড়ে একে একে কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে মণিপুরে। তারিখটাও মনে আছে! ২৭ জানুয়ারি। কারণ আর কিছু না, সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। বাড়িতে বাবামায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে এক সাইবার কাফেতে গিয়েছিল সন্ধেবেলা। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকেই জেনে গেছে সাইকেলধারী এই বিদেশী পর্যটকের কথা। অনেকেই আলাপ করছে, হাত মেলাচ্ছে, এরই মধ্যে যখন বাবামায়ের সঙ্গে ও কথা বলছিল স্কাইপে, উচ্ছাস হয়ত বেশি হয়ে পড়েছিল ওর। জন্মদিনে ওঁদের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে দূরে থাকলেও আজ এভাবে জাপান থেকে ইন্ডিয়ায় আসতে পারবে, নিজেও ভাবেনি কখনও। সেসময়েই এক যুবকের সঙ্গে চোখচোখি হয় ওর। সে নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয় আলাপের জন্য। শিক্ষিত অসমীয়া এই যুবকের নাম অভিজিৎ বরবরুয়া। কী এক প্রাণের টানে বন্ধু হয়ে যায় ওরা খুব সহজেই।

  অভিজিতের মূল আগ্রহ ছিল ওর পর্যটনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা। আর তাই দুজনের মধ্যে ভাব হতে সময় লাগেনি। নাহ খিদে পাচ্ছে খুব। ওরা হয়ত বসে আছে ভাত নিয়ে। অভিজিতের মাকে ও কাকিমা বলে। অনেকবার বোঝানো সত্ত্বেও কাকিমা ওরা দুজনে না খেলে খায় না। এখন আর আকাশকুসুম ভেবে দেরি করলে চলবে না। উঠে পড়ল ও। পুঁচকে দুজন বিদেয় নিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। গিটারটা পিঠে ঝুলিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল ও। আর গলা দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে এল-

Hoy en mi ventana

brilla el sol

Y el corazón se pone triste 

contemplando la ciudad

Porque te vas ……

(আজ আমার জানলায় রোদ এসে পড়েছে,/ আর মন হয়ে রয়েছে বিষণ্ণ/ এই শহরকে অভিযুক্ত করছি আমি/কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…)  


   সূর্য এখন আর ভোরের নেই। দুপুর গড়িয়ে সে খর হয়ে উঠেছে। কেউ এ শহর ছেড়ে আপাতত চলে যেতেও পারবে না লকডাউনের কারণে। ফলে দুঃখের কিছু নেই তার। গান তো এমনিই গাওয়া। এমনিই…তার অভ্যেস। আর দুঃখ কি কিছু আছে ওর? মনখারাপ? সে সত্যিই বোঝে না এসব। সামুয়েলের মন একটা আলগা পালকের মতো ভাসতে থাকে সব সময়। তুলোর মতো পেঁজা মেঘে ঢেকে আছে এখনকার আকাশ—ঠিক এরকম। যখন খুব মেঘ করে, আকাশ কালো হয়ে আসে, সামুয়েলের খুব ভয় লাগে। মনে হয় কারুর নরম বুকে মুখ লুকিয়ে যদি বেঁচে থাকা যেত নির্ভয়ে… 

)

অরিত্র চ্যাটার্জী

                                  |



 এই সংখ্যার কবি অরিত্র চ্যাটার্জী।জন্ম ১১ এপ্রিল, ১৯৯৪।  পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,  বর্তমানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে গবেষণারত। কবিতা লেখার সুত্রপাত স্কুল জীবনের শেষ দিকে। প্রকাশিত কবিতার বই একটি , "ঝরা পাতার সমাহার" (প্রকাশক - ৯ নং সাহিত্য পাড়া লেন, সন- ২০১৯)।


মবলগে মনোলগ

( ডিমেনশিয়া )

কে তুমি  

           জটিল জ্যামিতিতে

ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এসেছ

অনুজ্জ্বল ধ্বনির ভেতর

খসে পড়ে 

                 যৌগ অক্ষরছবি                

বিলীয়মান গেরস্তপ্রপাত

     ও সন্নিহিত মুখেদের ভিড়ে

আমি আবারো 

          গুছিয়ে নিতে ভুলে যাই 

যত ছিল বিগত দশকের স্খলন …


( পোর্ট্রেট অফ ভেনাস )

রাখা আছে নির্জন আপেল আর আমার এই শাদাটে তনুদেশ, একে তোমরা আরোহণ করবে ভাব, দড়ি ও কম্পাস সহযোগে তোমাদের এহেন নিষ্ফল অভিযান প্রতিবার উপত্যকার খাঁজে এসে থেমে যায় হায়, আর আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি কবে কেউ পেরিয়ে আসবে নীলচে ঠোঁটের সানুদেশ আর যাবতীয়  প্রজননবেলা ক্রমে বয়ে গেলে, প্রতি রাতে কিভাবে আরেকটু বেশি করে মরে যাই, ওহ্‌ মৃত্যু, সেকথা কারুক্কে বোলোনা কখনো!

কি প্রচণ্ড নির্বিকার

এই সারিসারি ধড় ও মুখোশরাশি

আমাকে লক্ষ্য করে  

পুঞ্জীভূত ধোঁয়ার আড়ালে 

অনায়াস সরিয়ে নেয় পাটাতন 

আর 

পতনোন্মুখ আমাকে 

টেনে তোলে 

আরেকটা অবাঞ্ছিত স্বপ্নের ভিতর

বিক্ষিপ্ত কিছু সত্য উদ্‌ঘাটনের হেতু আমি অবশেষে সেই ধর্মযাজকটির সন্নিকটে গেছিলাম এবং তাঁর লোল করতল স্পর্শ করে অভিবাদন জানিয়ে আমি বলতে শুরু করেছিলাম যা কিছু সত্য বলে মনে হয় সেইসব অনাকাঙ্খিত সংশয়ের কথা, পর্ণমোচীর বাগানে সেই বৃদ্ধ ধর্মযাজক আমার কথার ভেতর সহসা জানতে চেয়েছিলেন পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কিত আমার মতামত এবং আমাদের কথোপকথনের সাময়িক নীরবতা ভেদ করে সকাতরে একটি পাখি ডেকে চলেছিল এবং ধর্মযাজক চোখ বুজে সেই সকরুণ সুরের ভিতর সুখবোধ কিভাবে মানুষকে এড়িয়ে  চলেছে অনন্তকাল সে কথা বলে চলেছিলেন, এবং এমতাবস্থায়, তাঁর পশ্চাতে ডালা সাজিয়ে জনৈকা যুবতী এসে দাঁড়িয়েছিল, ধর্মযাজকের কথার ফাঁকেফাঁকে যার সুডৌল উরুদ্বয় আমি একাগ্র চিত্তে দেখেছিলাম… 

যে তুমি মনোলোভা,

                     এই আশ্চর্য নাচবুদ্ধি 

জ্যামিতিভঙ্গিমা দেখব বলে আমরা পেরোই

সাড়ে আট, সাড়ে আট কৈশোরের কাঁটাতার

আর তুমি উঠে আসো অনাবিল বিভঙ্গে 

                    কোন সামুদ্রিক পিপে হতে          

সাইরেনদের গানে দোল খাও যেন সহস্র সাপিনী

যাজকের হাঁসফাঁস, যা কিছু বীতংস তা ছুঁয়ে 

কাকে বলে রক্তাল্পতা

                    সে মুহূর্তে জেনেছি আমি


দুঃখ,

প্রতিটি ঠাণ্ডা আত্মার

অনভিপ্রেত শীতঘুম ভাঙ্গানোর  

পর্যাপ্ত বারুদের

রসদ না থাকার…


( সোয়ান সং)


‘হিপোক্রিসি ‘কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ আছে অনেক

তবু সচেতন ভাবে আমি এই শব্দটা ব্যবহার করি

‘হিপোক্রিসি’ শব্দটা ভারীবিশেষ, যেন বাটখারার মতন

যা ছুঁড়ে মারলে সামনের লোকটার কপালে লাগে

আর সেইসব আহত শ্রোতাদের থেকে তিন সেকেন্ড বেশী সময় পাওয়া যায়

বিজয়ীর মত দাঁড়িয়ে থাকার অথবা পরবর্তী শব্দসমুহ সাজানোর


মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

তোমাদের শব্দাঘাত করা আর সময়ে পরে নেওয়া লুকনো মুখোশ

তোমাদের সুখ দুঃখ আর সত্যিই নাড়ায় না আমায়

লঘু পায় আমি পেরিয়ে যাই মাটিদেশ,নগর,বন্দর 

আর আমার পেছনে পড়ে থাকে সারিবদ্ধ সিরিয়া আর আমলাশোল

আর আমার পেছনে পড়ে থাকে শ’পাঁচেক নব্য শারুক্ষান

আর এইসব ছেড়ে আমি ফিরে যাই নিজ্স্ব সুড়ঙ্গে

যেখানে সযত্নে সাজানো একান্ত ব্যক্তিগত সমস্ত দুঃখ

যেমন করে প্রিয় ক্ষত চেটে নেয় সমস্ত কুকুর

প্রত্যেকটি বিষাদ আর প্রত্যাখ্যান জড়িয়ে আমি সুখনিদ্রা যাই

আর স্বপ্নে এই ছোট্ট দেহ, অন্ধকার কুঠুরি এই সব ছাড়িয়ে 

অনেক অনেকটা বড় হয়ে ছেয়ে থাকি তোমাদের শহরের ওপর


মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

তোমরা যাকে ‘হিপোক্রিসি’ বল সেইসব দ্বিভাব আমার মধ্যে প্রকট

কাঁপা হাতে জনপ্রিয় শব্দ সাজাই, নিঃশব্দে চিৎকার করি 

লুটেপুটে নেই বিস্কুটের মত তোমাদের ছুঁড়ে দেওয়া সহানুভূতি

মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে

পারলে তোমাদের কথা ভেবে স্বপ্নের ভিতর একদিন ঠিক মরে যেতাম।

নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ভাবনা

১৯৬২ সালের অগাস্ট মাসে একদিন বেমালুম উবে গেল একটা লোক। 

তারপর কেটে গেল নির্ঝঞ্ঝাট সাত সাতটা বছর। তারপর একদিন আদালত তাকে ঘোষণা করে দিলে মৃত। এই নিয়ে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেললেন জাপান দেশের লেখক কোবো আবে। অথচ যতটা নির্লিপ্ত ভাবে এতদূর বললাম আদতে কিন্তু সেরকম নয়।

একবিংশ শতাব্দীর আমি ১৯৬২-র উপন্যাস পড়ি। ক্রমশ দ্বিধাগ্রস্ত হই। হারিয়ে যাওয়া তো হামেশাই ঘটে, নিরাসক্ত আবে লেখেন,  প্রতি বছর জাপানে ফেরার হয় শয়ে’শয়ে মানুষ। বিগত ৫০ বছরে সফল ভাবে নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রক্রিয়া কি হারে জটিল হয়ে উঠেছে, এই বিষয়ে আবের সাথে আমার বিতর্ক চলে। তারপর সমীক্ষা খুঁজে দেখতে পাই ২০১৯ সালে জাপানে নিরুদ্দিষ্ট সাতাশি হাজারের সামান্য বেশি কিছু লোক। অথচ যতটা সহজে এই তথ্যটুকু লিখলাম আসলে কিন্তু তা নয়। 

ভাবি অনায়াস প্রস্থান করব, তবু জোর করে কালো পোশাকের মানুষ। বালি চাপা রেখে যেতে বলে প্রত্নচিঠি ও বিগত ছাব্বিশ বছরের স্মারকসমূহ। বালিয়াড়ির ওপার থেকে দিকনির্দেশ করে সাতাশি হাজার নিরুদ্দিষ্ট হাত।  সাতাশি হাজারের ভিড়ে আরও একজন হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ-ই মনে পড়ে, এখন আমার নিরুদ্দেশের জন্য অপেক্ষা করে নেই আর কোন লেখক, ঔপন্যাসিক।

দূর থেকে দেখতে আমার সচরাচর বেশ ভাল লাগে।

রাস্তায় পরিচিতদের দেখলে আমি ইদানীং নিজে  থেকে ডাকি না; 

তাদের আত্মমগ্নতা উপভোগ করি

দেখেছি বৃষ্টির ফোঁটা কি সহজ প্রকারে পুকুরের জলে লীন হয়; হাত বাড়িয়ে 

সেই  পরিণতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করে না আমার, 

মনে আছে প্রিয় নারীরা যখন মৃদু হেসে এক এক করে তলিয়ে যাচ্ছিল 

তাদের চিৎকার করে বাধা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি

এখন আমার গলায় কোন আওয়াজ নেই…

প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে , শেষ বসন্তের এক বিকেলবেলায় আমার জন্ম হয়েছিল । অদ্ভুত কিছু নয়, তবু একটা ডুবন্ত সূর্য আর রাশি রাশি নিরুদ্দিষ্ট পাখিদের  নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে খানখান করে একটি সদ্যোজাত শিশু কাঁদছে;  এ দৃশ্যের কল্পনা আমায় আজও অভিভূত করে …

রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                       


সাইকেল 


১) 

  সাইকেলটা সামনের গাছে ঠেস দিয়ে রাখা।  উলটোদিকে অন্য এক গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক যুবক। দুধারে সবুজ ধানক্ষেতে দোলা লেগেছে আচমকাই। একটা ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে দুলিয়ে দিয়ে গেল সেই যুবকের মনও। গ্রাম বলতে যা ছবি আমাদের চোখের সামনে এসে যায়, অবিকল সেরকমই একটা পিকচার পোস্টকার্ডের ছবি তার চোখের সামনে। খেতের মাঝখান থেকে একফালি পাকা, বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে দুদিকে।  কোথাও কোনো বাড়তি আবর্জনা নেই এই গ্রামে। যখন তখন বর্ষা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উত্তর পূর্ব সীমান্ত এলাকার গ্রামে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা দূরেই, ফলে এই অঞ্চলে তেমন জল জমে না। কাদা জমে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে না চারদিক। আর সবুজ যে এত ঘন, নরম আর মোলায়েম হতে পারে এই ছেলেটির তেমন জানা ছিল না আগে। ছোটো ছোটো বাড়িগুলোর বেশিরভাগই পাকা, খড়ের বা টিনের চালে ছাওয়া, নয়ত পাকা ছাদ। ছাদের মাথায় লাউ, কুমড়ো শাক শনশন করে বেড়ে উঠছে এই তেজী হাওয়ায়। যুবক এখন লাউশাক, কুমড়ো শাকের ঘন্ট খেতে শিখেছে, খেতে শিখেছে ভাত, ডাল আর নদীর মাছও। সাইকেল এসবের সাক্ষী। ওর দিকে চোখ গেল তার। সাইকেলটা যেন চোখ মটকে কী একটা ইঙ্গিত করল ওকে। একটু কি আরক্ত হল যুবকের মুখ? সাদা রঙে তামাটে ছোপ পড়লেও তার টকটকে গালে লজ্জার ছাপ। লজ্জা পাওয়ার যে সহজাত বোধ, সেও কি এখানে এসে সে শিখে ফেলল এই ক’মাসে? 

অলস বসার ভঙ্গী ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এবারে সোজা হয়ে বসল সে। পাশে রাখা গিটারে টুংটাং বোল তুলতে গিয়েও থেমে গেল।  তারপর আবার দ্বিধা নিয়ে সুর তুলল, গেয়ে উঠল দু কলি- 

No puede ser

no soy yo

me pesa tanto el corazón

por no ser de hielo cuando el cielo me pide paciencia

  আর সেই সময়েই যেন মাটি ফুঁড়ে দুটি শিশু হাজির হল ওর সামনে। ওদের দেখে গান থামাল সে। কিন্তু শিশুদুটি সমস্বরে বলে উঠল, আবার গাও, আবার গাও। মানে কী এই গানের?

  সে এখন মোটামুটি বোঝে ওদের ভাষা। নিজের ক্ষমতায় যেটুকু কুললো, তাতে বলল, ‘মানে? মানে জেনে কী করবি তোরা? গানের সুরই হল সব। আর কথারও প্রয়োজন আছে বৈকি! তবে তার মানে যেমন খুশি ধরে নিলেই হবে। ওই যে আকাশ দেখছিস, ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে—কেন তোমার মন এত ভারি হয়ে আছে আজ? আমি ওকে বললাম—না, না এ আমি নয়, আমি হতেই পারে না। অন্য কেউ, যার মনে বরফ জমেছে, সে আমি নয়, অন্য কেউ, অন্য কেউ……’

এক ক্ষুদে কোলের কাছে ঘেঁষে এল যুবকের। ‘তোমার কি মন খারাপ করছে দেশের জন্য?’  


(ক্রমশঃ)

সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়

                                                     



এই সংখ্যার কবি সমিধ গাঙ্গুলি। ইতিহাসে  স্নাতকোত্তর হওয়ার পর আপাতত  সরকারি চাকুরে।পেশাগত সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময় ইতিহাস আর কবিতা নিয়েই কাটে।কবিতা সংক্রান্ত যে-কোনো আলোচনায় নিবিড় শ্রোতার ভূমিকায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে।

আর ছুটিছাটায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়াটা সোনামুগের

সঙ্গে আলুপোস্তর মতই অবশ্যম্ভাবী।



সুষুপ্তির জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে 

----------------------------------------------



১.

তার বিহনে পাগলাঝাঁপ ছুটি

দিনের শুরু, নিছক বাড়ি ফেরা

মহুয়াভীরু দাওয়ায় খুনসুটি

রোদে মিশছে পাহাড়বালকেরা


ভাল্লাগেনা বিরহী বিস্কুট

চুমুর আগে ঠোঁটের গলে যাওয়া

তোমার হাতে অচেনা মনছুট

আমার কাছে ধুলোর মত হাওয়া


আস্কারার জামায় মোছা ঘাম

সন্ধ্যেবেলা লুকিয়ে বাড়ি ফেরা

মেঘলা হ'লে পায়রা ওড়াতাম

রোদ শেখাত বিষাদপালকেরা...



২.

বাস্তুহারা বিগত সংসার

ইস্ত্রিহীন উঠোনে তানপুরা

আদায় করা ম্যাপের অধিকার

অভিনয়ের শর্ত আনকোরা


লাগাম যদি আগুনে বশ থাকে

শৌখিনতা কাহারবায় বুঁদ

শান্ত চাঁদ ঘুমোলে মৌচাকে

ঢিলের কাছে ব্যর্থতার সুদ


আগলে রাখা বেহুঁশ ক্যাথিটার

ঘোলাটে হয় বধির কানকোরা

আদায় জানে লাভের অধিকার

শিরদাঁড়ার শর্ত আনকোরা...



৩.

ক্যাকোফোনির বেহাগে আংরাখা

মগজরঙা হ্রদয় কাঁদে না

গুমটি। মাঠ। সদ্যোজাত পাখা।

মেজাজী ধোঁয়া জীবন বাঁধে না


দশমিকের বাঁ পাশে রাখা বিষ

দেরাজ খোলে আনপাড়ার ঠেকে

মেহফিলের মাহুত আনুবিস

পূর্বাভাস বুঝিয়ে সংক্ষেপে


উঠে দাঁড়ায়। প্রজাতিহীন চাকা

হেঁচকি তোলে নরম ছাঁদে না

দিঘি।বাগান। মেদুর। পটে আঁকা।

মাসকাবারি জীবন সাধে না...



৪.

শিশুআঙুল মগ্নতাকে ছুঁলে

খিচুড়িভোগে অনাদি তরী বাওয়া

গৃহপালিত জাবনা খুঁড়ে তুলে

জরুরী ছিলো তোমার কাছে যাওয়া


শুকনো চোখা মরসুমের দাঁড়ে

চশমাওয়ালা গর্জনের চাষ

নুনছালের শীলিত টংকারে

মাখানো ঝরা পাতার নির্যাস


অক্ষরের উলটো বাহুমূলে

মন্ত্রপূত অন্ধ হতে চাওয়া

কাফের,তবু ভেজা আগুন ছুঁলে

জরুরী হয় তোমার কাছে যাওয়া...



৫.

এবং থাকো গোপন শিরাপথে।

মজা পেলেই গুছিয়ে নাও খাট

ধর্ম লেখে যে যার প্রিয় গতে

মানুষ পাওয়া ভীষণ ঝঞ্জাট


এবং থাকো মোহিনী বিদ্যায়।

কেতাবী রুচি তোমার পরাধীন

ডুবতে পারো যে কোনো বন্যায়

প্রস্তাবনা পাঠাবে মরফিন


এবং দ্যাখো মাকাল,প্রতি বাঁকে

হাওয়াই চটি।চালাকি,রাজপাট।

বর্ম পেলে যে যার মতো থাকে

মানুষ হওয়া নোংরা ঝঞ্জাট...



৬.

যেমন কাঁচাকথন ভাতে পাই

লোহাকরুণ আংড়াভাসাতেই

জড়তা ভাঙে বন্ধুদের ছাই

এখনো আছি বাংলাভাষাতেই


মোরগঝুঁটি দোলানো বাস্কেট

বুড়ো হওয়ার দু-মুঠো নষ্টামি

হিয়ার মাঝে জিয়ল সংকেত

শোনো,তোমায় বলতে চাই আমি


জর্দা যদি পানের কিংখাবে

তুমিও শুধু সর্বনাশাতেই

সে-সব ব্যথা কালকে ভাবা যাবে

আজকে থাকি বাংলাভাষাতেই...



৭.

চোখের পাশে তাগড়া আস্তিন

গোটালে তুমি প্রেমিক হতে পারো?

চমৎকার আহত আস্তিক

মাংস নয় আবেগ দিয়ে মারো


জেহাদি পথ,বাঁধাকপির ক্ষেত

সীমানা ঘেরা যৌথ পরিবার

কথকতার বাক্সে রাখা বেত

বড় হলেই বলবে "জমি ছাড়"


আবহমান গোমড়া বাস্তিল

আবহাওয়ায় রসদ পেলে আরও

তিনভাঁজের ব্যহত আস্তিন

চাবুকে নয় পাঁজরে পিষে মারো...



৮.

ফিরতি নায়ে তোমার দেখা পাই

বাঁশরী যদি ভালোবাসায় ধরো

সভ্যতার নিহিত খাইখাই

অফুরবেলা ছিলিম টেনে মরো


বসেই থাকো চৌকাঠের দলে

তন্ত্রে আনো মহাদেবীর ছাঁচ

অপরিমিত বিশ্বাসের মলে

প্রাদেশিকতা রপ্ত করে নাচ


জলের দেহে খাস্তা জমি পেলে

সুজাত রাগ তুমিই সম্বরো

পাকস্থলী নির্বাসনে গেলে

দ্বিধালবণ ধোঁয়ায় কেশে মরো...



৯.

মেধা এখন বিষয়ভিত্তিক

কোন সোহাগে কটা বলদ জোটে

প্রশ্নমালা হাসলে ফিকফিক

অনধিকারচর্চা মজা লোটে


তুমিও প্রভু আমার মতো বেঁচে

থাকতে করো রেশন মঞ্জুর

বিশ্বাসীরা কবেই মিলিয়েছে

বুকে হাঁটার তর্ক কিছুদূর


আগাম কোনো ধৈর্য নেই মোটে

ডিগ্রী বশবর্তী হবে ঠিক

স্বভাবে তবু পঙ্গপাল জোটে

কারণ মেধা বিষয়ভিত্তিক... 



১০.

চারুপথ ভুলে যাও ক্রিসেনথিমাম

অ আ ক খ অভ্যাস পাঁশুটে হাওয়ায়

দেহপট সনে মাখো সুবচনী ঘাম

পাথেয় ফুরোতে পারে এটুকু চাওয়ায়


তুমি হবে বর্ণনা অতীতের মতো

ভজনালয়ের পাশে পাহাড়ি মাতাল

ওজনে সমান রেখো হিসেবের ক্ষত

মগজের ভাতঘুমে নিশুতি আকাল


কামিনী অঙ্গ তবু ভাঙে উদুখল

বসন্তে একা বীজগাণিতিক ট্রাম

তোমার বিশদে চেয়ে বসলে অতল

পোশাকটা ধুয়ে নিও ক্রিসেনথিমাম...

রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০

জয়ীতা ব্যানার্জী

                               



এই সংখ্যার কবি জয়ীতা ব্যানার্জী।নিবাস - বাঁকুড়া। ২০১৬ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও ব্লগে লেখেন। একক কোনও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। 



আতিথেয়তা ও শীতকাল
― জয়ীতা ব্যানার্জী



সেসব লোডশেডিং, আধখাওয়া চাঁদের কাছে
হাঁটুমুড়ে বসে থাকা। তারাদের উপকথা বেয়ে 
তখনও নামত নীল। মাকড়শার জালে আটকে 
শেষ হতে হতে ফের জ্বলে ওঠা। কাওকে না বলে

এমনি বেহায়া সিঁড়ি থেমে যেত। চিলেকোঠা একা
লোডশেডিং সেসব, রঙিন ছায়ার সমারোহ



আমাকে উঠোনে ফেলে উঠে গেছে ও বাড়ির সিঁড়ি
কলতলা বাঁয়ে রেখে চুপিচুপি সরেছে বয়স
আমার পায়ের থেকে বটগাছ দুহাত দূরেই- 
এখন অনেক বড়। ঝুরি বেয়ে ওঠে নামে স্মৃতি

কোথা থেকে জল আসে, পিছুটান ধুয়ে ধুয়ে শেষে 
পিছল শ্যাওলা আর একমুঠো ঘাস রেখে যায়



ঠিকানা লিখতে বসি। সহজ যদিও চিঠি লেখা
প্রতিবার ভুল হয়, খাম থেকে চোখ তুলে আনি
লাল ধুলো মনে পড়ে, বালিহাস, দুচারটে নামও
অনায়াসে বলে দিই। অথচ বাড়ির মেঠোপথ

ঠিকানা লিখতে বসে সদর দরজা ঢেকে যায়
নামের আখর খুঁজি, নেমপ্লেট ভেঙে পড়ে থাকে



কিছুটা রোদের মতো, একা একা জ্বলে আর নেভে
রাখতে শেখেনি তবু, পরিয়েছ স্মৃতির আগল
একটি মোটেই তালা ! বাঁধবে কীকরে ফিরে আসা
উঠোনের কাছাকছি শীত এলে বেশ বোঝা যায়

একদিন এখানেও ভোরের আজান শোনা যেত 
তুলসী মঞ্চের পাশে পরিপাটি আমপাতা, ঘট



আঁচল পেতেছে ঘাটে সোহাগী শিশির বোনা আলো
সাদা কালো ঘুম ভেঙে তুমি ফেরো ভোরের উঠোনে
নদী পেয়ে বর্তে গেছে, ভুলে থাকা জনপদ ভাবে
জল পেয়ে জল ভাবে বয়ে চলা কতটা সহজ

সফর রেখেছ হাতে। পরিযায়ী শীতের কাছেই
সে সফর শেষ হলে, ওইচোখে পালক চিনিয়ো



জানালা নিয়ম করে রঙিন শিশিতে রোদ ভরে
মেলে দেয় সারি সারি উপশম। প্রবীণ ব্যথারা
তখনও আলগা পায়ে রাত্রিদোষ জড়িয়ে রেখেছে
আপাত বিস্মৃত জ্বর। গরম জলের স্বাদ জিভে

তিক্ততাই সমঝোতা যতক্ষণে জেনেছে আত্মীয়
কোলের আতিথ্য ফেলে সোহাগী বিড়াল চলে গেছে



পিছল পাথর আর পাতায় মেশানো যত জল
নীল হয়ে আছে মেঘ। অথচ তেমন বর্ষা কই
মাঠের হরিণ দেখে শিকারী ডেরায় ফিরে আসে
নামতে নামতে রাত হরিণ-ও ঘুমোতে গিয়ে দেখে

উল্টানো চাঁদের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সাথে 
শিকারীর মরদেহ। এমনি হেলায় পড়ে আছে



ভুলবার মন্ত্র বল, দ্যাখো অনুরোধ করছি না
যতটা পেরেছ নিজে, ছিটেফোঁটা তার, বাকিটুকু
নেই বলে ধরে নেব কোনওদিন ছিল না আসলে
অথবা অতিথিসম। এসেছ খেয়ালে, চলে গেছ

আমিও লিখেছি কিছু আতিথেয়তা ও শীতকাল
প্রেমের আক্ষেপে নয়, ভালোবেসে অবজ্ঞা শেখাও



মায়া ফেলে গেছে ভোর। উঠেছ যখন ক্ষীণ আলো
সুতোর মতন যেন মেঝের চাদরে ছায়া আঁকে
কুড়িয়ে নিয়েছে খই। একপাশে নিকোনো উঠোন
শেষযাত্রার মতন বিসমিল্লাহ বেজেছে তার
 
প্রতিটি শ্বাসের সাথে। মায়াময় ফেরেনি তবুও
শুধু ছায়া সরে এসে প্রশ্রয়ের সদর পেরোয়


১০

সেদিনও নবান্ন ছিল। দুধসাদা আতপের ঘ্রাণ
নিকোনো উঠোন আর আলপনা মাটির সরায়
ধূসর শীতের সাথে বোঝাপড়া সয়েছে। রয়েছে
ধানের আলোর কোলে মাথা রেখে জমিয়েছে জল

মলমাস শেষ হল ? ফিকে হয়ে এসেছে হলুদ
আরবার রং দিয়ো। রং ছাড়া অপেক্ষা বাঁচে না



রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

অনিন্দ্য পাল

                                                 





 সৃজন এই সংখ্যার কবি অনিন্দ্য পাল। 


সাপের খোলস // অনিন্দ্য পাল 
=====================
মুখোসের উপর মুখোস চড়িয়ে 
লুকিয়ে পড়েছি সবাই 
গভীর 
ঘুরন্ত অন্ধকারে!

অন্ধকার কি শব্দহীন? 
না, খিদের শব্দ এখানে 
হিস-হিস...

অন্ধকার কি শর্তহীন ?
তাহলে তার পোষাক নেই কেন 
লজ্জাস্থানে!

অন্ধকার কি লোভহীন ? 
তবে এত মালা কেন গলায় 
সর্বাঙ্গে! 

আসলে আমরা সবাই বিবর্তনের শিকার 
সাপের ছেড়ে ফেলা খোলসের মত পড়ে থাকি 
চুপচাপ, 
ফাঁপা শরীরের খিদে এঁকে রাখি 
বেওয়ারিস খোলসের 
ভিতরপিঠে... 
================================ 
আঁকা মানুষ।  // অনিন্দ্য পাল 
===========
শেষ হয়ে যাওয়া সময়টুকু পেরিয়ে এসেছি সবে 
সব নাম-বেনাম বেরিয়ে গেছে শেষ নিঃশ্বাস হয়ে 
আমার "আমি"র মুখে বারবার এঁকে রাখা সব মুখোশ 
খরার আদরে ফাটাফুটি দোঁয়াশের মত চেয়ে আছে 
আকাশের দিকে, 
ধরো সেখানে ভেসে আছে একটাই মেঘ 
অথবা অভিশাপ 
বৃষ্টি হলে ,ধুয়ে যাবে রঙের পরত 
না হলে , ধূসর গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিশে যাবে 
আঁকা পরিচয় 
স্তরে স্তরে গড়ে তোলা বল্মীক জীবন 

এখন দেখছো এই সব শব যা চেয়ে দেখ 
আকাশের দেওয়ালে ফুটে আছে নাম 
আঁকা মানুষ ...
==================================
 বসন্তের শেষে //অনিন্দ্য পাল 
======!!!!=====
আজ বসন্ত চলে গেছে এই খানিকটা আগে 
চৌকাঠে ডানপা বাড়িয়ে দিয়েছে গ্রীষ্ম 
শীতকাল চলে গেছে বলে কষ্ট হচ্ছে না আর 
সিলিং-এ পাখাটা ঘুরছে, নামছে বাতাস আবার 

বসন্ত চলে গেছে বলে কোকিল ডাকলোনা আর 
অথচ 
কোকিলের ছানাপোনা সব এখনো কাকের বাসায় 
কোকিল কি ভুলে যেতে পারে সন্তানের কথা 
কোকিল কি ভুলে যেতে পারে সেই সব পথ 

আগামী বসন্তে আসতে হবে আবার 
বোকাসোকা কাকের মাতৃস্নেহ লুঠ করতে 
কোকিল ভোলেনা কাকের অপত্যপ্রেম 

তবে কাক ভুলে যায় বারবার বিগত বঞ্চনার ইতিহাস। 
========================= 
অনুরোধ // অনিন্দ্য পাল 
========
আমাকে ফেলে দিও না কাঁটাঝোপে 
ঘুলঘুলি থেকে পড়ে যাওয়া চড়ুই বাসার মত ,
বরং দিও এক সানগ্লাস সূর্যবাঁধ 
গুমটি মনের ফোস্কাতে দিও কিংশুক চুমু 

দহনরাগ জুড়াবো যখন অন্ধকার ঠাসা কোণে 
আলোকে দিওনা ঠিকানা লুকানোর 
কোন নদীজলে দিয়েছি ডুব 
মিশে গেছি কোণ বনে ...

অহল্যাঘুম ভাঙিও না আমার 
জীবনঘড়িতে দিওনা ঘুম ভাঙাবার চাবি 
আটকে দিওনা মোলায়েম শীতের বাতাস 
এ ভাবেই বাঁচি আমি এটুকুই আমার দাবী, 

সময় ফুরিয়ে এলে চলে যাবো ঠিক 
যেমন যেতে হয় হরিণকে মৃগনাভি ছেড়ে 
নাহলে প্রত্নবীজ হয়ে থেকে যাব হাজার বছর, 
যদি আসো তারও পরে, কালের সেচখাল পেরিয়ে 
ছুঁয়ে দেখো প্রথম বেরোনো কচিপাতা দুটো 

চারাগাছে পাবে নরম ভালোবাসা, 
                                            কাঁটার প্রেম এড়িয়ে। 
====================================
ভালোবাসার বাড়ি // অনিন্দ্য পাল 
===============
মোমের শিখার মত লাজুক আগুন
ছড়িয়ে দিয়েছ বুকের গভীরে 
সেখানে অনশনরত একগুঁয়ে ম্যাগমারা তখন 
একে অন্যের ইচ্ছা পানে ব্যস্ত, 
তবু তোমার এই পেলব দহন সয়ে নিতে পারি 
বেতাল জীবনের মত,
আরও পারি মৃত সভ্যতার শৌচাগার হতে 
অথবা অন্ধ দাবানল হয়ে গিলে নিতে পারি 
সবুজ কলমি লতা, 
অথবা যদি তুমি বলো, পুষ্পহীন করে দিতে পারি 
রাধার কুঞ্জবাগান,
শেষ লহমায় ছিনিয়ে আনতে পারি অ্যানুবিস হয়ে 
রতিমগ্ন প্রেমিকযুগল,

কিন্তু এত সব করেও কী পাওয়া যায়, পাওয়া গেছে 
কখনও কোনকালে বেহুলার প্রেম? 
তাই আর আদেশ নয়, নয় কোনো আইন জারি 
এস,লালরডোডেনড্রনের মত ঝরে পড়ি পাথরপাহাড়ে 
ফুলের শব দিয়ে বানাই ভালোবাসার বাড়ি। 
==================≠=========== 
ভালোবাসার বনসাই // অনিন্দ্য পাল 
=========
সেই প্রথম দিন, প্রথম দেখা 
একঝাঁক পায়রা এবং তুমি 
হাতে সোনালী শস্যদানা 
বানভাসি উপত্যকা আমি 

তুমি, আমি এভাবে গড়ায়নি আর দিন 
ক্যালেন্ডার নতুন হয়েছে বারবার 
ঘুমের মধ্যে তুমি লেডি আলাদিন
অর্ধেক দিন বেচে আমার রোজগার 

আমি দানা খুঁজি কবুতর জীবন 
চাঁদপ্রেমে উড়ে গেছ সমুদ্রশহর 
কুয়াশা বাষ্পে চুমুক দেয় তৃষ্ণা সৌরদিন 
পেয়ালায় ঢেলেছি স্মৃতি, রাত্রি উজাগর 
ইতিহাস অতীত কখনো ডাকেনি পিছনে 
তলানিতে ঘোলাটে সুখ, বসত করে মনে 


আমার বাগান জুড়ে আগাছা গুল্ম ঘাস 
তোমার দোলনাটবে বনসাই ভালোবাসার চাষ ...

================================
একফোঁটা সুখের জন্য // অনিন্দ্য পাল 
================
মুষ্টিবদ্ধ সুখ খুঁজে ছিলাম মরিচীকার মত 
বেলেমাটি লেপা মেটে দাওয়ায় 
সেখানে বসত ছিল হলুদ ঝরাপাতার...

নীলচে শিরায় উপভোগ শ্লথগতি 
আপেলশামুক বাসা বাঁধে স্পন্দনঘরে
দু-একফোঁটা সুখেই ভিজবো, ভেবেছিলাম 
মেঘের আদর ভেসে চলে গেল, হঠাৎ মরুঝড়ে 

এত বড় আকাশ এত বৃষ্টি ঝরে 
আমাকে ভেজাবে কে, আমার একলা ঘরে 
ভালোবাসা ফুটে আছে দেখি রাতের জ্যোৎস্নাতলায় 
একফোঁটা সুখ তোমার গন্ধ নিয়ে 
আমাকে উদাস করে ...
============================= 
আবার প্লাবন আসুক, ব-দ্বীপে // অনিন্দ্য পাল 
==≠=================
তোমার আধচেরা ব-দ্বীপে এখন 
অস্তরাগের বিষণ্ণ প্রতিলিপি 
তবে কি এবার দিন ফুরিয়ে এল? 

ঋতুহীন খনিগহ্বর চাঁদ গেলে গোগ্রাসে...

জোনাকিরা এখনও ছড়ায়নি দেহগত আলো 
তুমি কি নিতান্তই অমাবস্যা চেয়েছ, বীতকাম 
প্রতিরাত ভোরে, 

প্লাবন আসবে কবে তোমার ব-দ্বীপে আবার?
আলুনি উর্বরতা আর সুখ দেয়না, শান্তি দেয় 
স্নেহ আর উৎসবে কেটে যায় রাত, অচঞ্চল 
কঠিন বাঁধে কি আটকেছো মোহনার নোনাজল? 

তবু আমি আশাদীপ জ্বেলে রাখি প্রাণপনে 
তোমার পলিপল্বল উঠোনে 
আবার যদি ফিরে আসে সেই সব প্লাবিত উচ্ছ্বাস
থেকে যাবো তবে, এই দ্বীপে,আনাচে-কানাচে 
অথবা বিশুষ্ক হও যদি লবণ বালিয়াড়ি 

ফুরিয়ে যাবো তবে, একান্ত একা আনমনে... 
==============================
বন্ধুকে / অনিন্দ্য পাল 
=========
যে ভাবে হারিয়েছিল তোমার উত্তরকাল 
আজ সেই আলুথালু পথে 
যেতে হবে ঐন্দ্রজালিক পদক্ষেপে, 

না কোনো প্রশ্ন নয়, কৌতুহলের ওষ্ঠে রাখ 
ধৈর্যের বাটখারা 
তোমার শত্রু নয় কেউ, তুমিও নও বন্ধু সবার 
ভঙ্গুর পলিথিনে মুড়ে পুরসভার ডাস্টবিনে ফেল
ষড়যন্ত্র আর মিথ্যার মাসকারা

এ অভিশাপ এনেছ কিষ্কিন্ধ্যা থেকে 
বৈরিতা বিদূষক হয়ে শুয়ে আছে তোমার হারেমে 
মনসার সুড়ঙ্গ ভুলে তুমি তুলে নিয়েছ ধনুক
দেবতার লড়াইয়ে বলি হতে হয়, রাবন আর রামে 

সুগ্রীবের ছলনায় বধেছ সহোদর
এখন বদলেছে সব, আগের মত নেই কালের নগর 
তবু তোমাকে বলছি আমি বন্ধু হই তোমার 

তুমিও শত্রু নও, কেউ বন্ধু নয় তোমার! 
====================================
অদ্ভুত কথা // অনিন্দ্য পাল 
=========
ধরবো বলে ছুটেছিলাম একবগ্গা 
সময়ের পিছনে 
নীল লন্ঠন জ্বেলে এগিয়ে ধরেছিল 
অবসৃত আদিম আত্মীয়রা 
আত্মার আলোয় যেটুকু ছিল পূর্ণিমা 
ব্রহ্মাণ্ডের গাছেরা তাও নিয়েছিল শুষে 

তবুও গোড়ালির আঘাতে ভেঙে ফেলে 
সভ্যতার মাইলফলক 
পেরিয়ে এসেছি প্রজন্ম পারের পঞ্চভূতে 
এখানে এখন সমুদ্র সমতল 
গুল্মজাতীয়রা ছেঁটে দেয় বট-অশ্বত্থের ডানা 
হৃৎপিণ্ডের আবহবিকারে জন্মনেয় 
লঘু আর গুরু 
এখানে সবাই স্বাধীন, অথচ প্রশ্ন করতে মানা,

মেরুদণ্ড বন্ধক রেখে সিংহাসনে রাখা হয় চুমু 
উচ্চরক্তচাপে ভোগে তরুন সময় 
খোলাবাজার থেকে কিনে নেয় বোতলের লোভ 

কফিনে ঘুমিয়ে থাকে মরেও বেঁচে থাকা 
বাস্তু ঘুঘু ... 

রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০

মৌমিতা মিত্র

                                    




এই সংখ্যার কবি মৌমিতা মিত্র।জন্ম ১৯৯৫ । কলেজ জীবনে কবিতার হাত ধরেছেন।একটা সমস্যার মুখোমুখি ছেলেবেলা থেকেই হতে হতো — তা হল সকলের সাথে মিশতে না পারা। অনেক কথা থাকতো যা হয়তো বলার প্রয়োজন মনে করতেন কিন্তু বলা হয়ে উঠতো না। অনেকটা নিজের জগতে গুটিয়ে থাকা এই কবি কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজের না বলা কথাগুলোকে তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি কবিতায় নিজেকে জানতে চেয়েছেন সবসময়। 

সন্ধে নামলে

সন্ধের নিস্তব্ধতায় এক অচেনা সন্ধ‍্যার নিঃশব্দ চলাচল;
পোশাক বদলে মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা!
কত মানুষ ঘর চিনে ফিরে আসে নি।
একাকী ঘরের দরজাগুলোয় আঁচড়ের দাগ
যেন হিংস্রতায় গিলে নেবে সকলকে
আর আমরাও নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পা গুটিয়ে
বসে যাবো বিশাল হা মুখের ভেতর; চোখ বুজে।

সন্ধের অন্ধকারে কালো হতে থাকা গাছের পাতাগুলোয়
পিতৃসুলভ অস্থিরতা; নিষেধাজ্ঞা আর সতর্কবার্তা―
হাওয়ার বেগ বদল কিংবা দিক বদল হয়েছিল
একবার; দূরে কোথাও; তাপমাত্রার তারতম্যে
তারপর থেকেই আকাশে বরাবরের মতো কালচে নীল

অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় রাতজাগা পাখি আর হারানো শিশুদের গান
ঘরের সুচিন্তিত উষ্ণতায় ওরা আমন্ত্রিত নয় কারণ
তুমি আর আমি সময়কে নাকি বন্দি করেছি


*****************************



অপেক্ষার রঙ



মেঘরঙা পাখি আর
কাশফুলের প্রেমের
পরিণতিহীনতার স্পন্দনে
নদীতীর মুখর।

জীর্ণ গাছের গল্পে 
অপেক্ষার রঙ বদলে বদলে যায়।


*****************************



ঝরা পাতার গল্প


ভাতের দাগ মুছে গেছে অনেকদিন।
ফুটপাতে এখন শুধু 
ঝরাপাতার গল্প।
তারা পরিচয় খুঁজে পায়নি কোথাও
তারা গাছের পাশে বেঁচে আছে।


*****************************



চশমা




একটা চশমা উল্টো করে রাখা।

একটা ছায়া বড়ো হতে হতে
কাঁচদুটো চোখ হয়ে গেল।

সমীকরণ সহজ দেখে সেদিন সবাই
হাত তুলেছিল; দ্রুত সংখ‍্যা বসিয়ে
অনেক প্রকার সমাধানও উঠে এসেছিল।

বাগানের বালতিতে জমা জলে
মুখ দেখতে দেখতে গড়িয়ে যাচ্ছি ---
দেখে সে পেছন থেকে চুল টেনে ধরে।
কুসংস্কারের মতো। রোজ।

অনেক সরলরেখা ভেঙেচুড়ে, বাঁকিয়ে
নাম লিখে দিয়েছে ওরা সবাই ----
সকালগুলো বেঁধে দেবে বলে।

তারপরেও শ‍্যাওলা ধরা জলে মুখ ভাসে।
সবুজ হয়ে আসে জলের আকাশ।

চশমাটা উল্টো হয়ে পাশে থেকে যায়।


*****************************



ঘর





ছেলেটি নতুন জামা পেলে কাঁদতো।
মেয়েটি কোনোদিন জানতে চায়নি
বাড়ির নাম কেন কুয়াশা।

ডালভাত গড়িয়ে যেতে যেতে
থালার একপাশে একটা মাছি।
তারা ঘর বাঁধবে নৌকার
আলোছায়া আশ্রয়ে।

গল্পটা এগোতে থাকে।
সব কথা পাড় হয়ে যায় নদী;
মাছিগুলো এখন শহরের সেই দীর্ঘ পথে,
ছড়িয়ে ছিটিয়ে।


*****************************


আপোসের পথে




কিছু কিছু বিকেল আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।

ভাঙা ভাঙা কথা, দূরের হলুদ আলো, 
মাটির ভাঁড়, এলোমেলো আমি ---
সব ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পথ।

দিন-শেষের আলোয়
অচেনা রাস্তার কাছে এসে দাঁড়াই
নতুন গলিপথের সন্ধানে।

ভুলগুলোর সাথে আপোস করতে পা বাড়াই।


*****************************


ঘুণ ধরা গন্ধে




শেষ সারির মৃতদের একজন
চোখ খুলে সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিল
তারপর থেকেই আকাশের রং লাল
সোনালি ফল হাতে দুটো শরীর
পাশাপশি এলেই হিংস্র ডালপালা
চেঁচে নিতে থাকে সমস্ত শাঁস
বাইরের ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস আর
বন্ধ ঘরের সোঁদা ঘুণ ধরা গন্ধে
নতুন পৃথিবী একে একে হাত পা তৈরি করছে
ভূমিষ্ঠ শিশু গতকালের চির ধরা টুকরোগুলো
সঠিক শূন‍্যস্থানে বসিয়ে
গল্পকথা বুনবে আর ক'দিন পরেই
রাত্রিকালীন বৈদ‍্যুতিক তারাগুলো
গলে গলে নিভে এলে
দেবদূতের পুরোনো কেল্লার 
শেষ জানলা বন্ধ হয়ে যাবে নিঃশব্দে

প্রতিটা টোলে একেকটা স্বপ্ন ফেরত চাইছে সময়


*****************************


যুদ্ধভাঙা একটা শহরে




একে অপরের চোখে লুকিয়ে পড়ে নিলে
ভাতের থালার গন্ধ ভুলে যায় উত্তাপ
ত্রুটি আড়াল করতে শক্ত হয়ে ওঠা
বুকের ঠিক মাঝখানটায়
নিথর তখন সব ভাবাবেগ
সদ‍্য যুদ্ধভাঙা শহরে একটিমাত্র স্তব্ধদিবস
আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছি বলে।
কোনো এক ভবিষ‍্যতের বৃদ্ধ
তেল-নুন মাখাতে মাখাতে হিসেব দেয় সংস্কারের
আর তুমি, আমি একটা দাঁড়ি পেরিয়ে এসে
চোখ বুজে থাকার অভিনয়ে নামি।
প্রতিবেশীরা এখনও জানে না
আমাদের মায়ের আয় স্বল্প, বাবার আয়ে
একটাও আঙুল খরচ হয় না
আর আমাদের বুকের মাঝখানে শক্ত একটা কুণ্ডলী
তাই খবর ছড়িয়ে পড়ার আগে
আমরাই চোখ বুজিয়ে দিই
যাতে বোঝানো যায় আমরা কিছু বুঝিনি।


*****************************


সোমবারের বিকেলে

অনেকদিন পর আজ ক‍্যারাম খেলবো
বাবার সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি;
ক‍্যারামবোর্ডের পেছনে দুটো মাকড়শা
ওদের ঘরে চারদিকে হাওয়া;
লাল কালি দিয়ে পাতার ওপর
ভুল সংশোধন করতে করতে
জানলাগুলো আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি জানি ঘুটির আঘাতে
উল্টোদিকের ঘরগুলো ভেঙে যাবে না।
শুধু ওরা জানতে পারবে
দমবন্ধ একটা ঘরের হাওয়াই 
ওদের ছাদখোলা ঘরের চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
ওরা জানতে পারবে আমি ছিলাম এখানে।
একাই ছিলাম আর ওদের লক্ষ্য করছিলাম।
অনেকদিন পর আজ কাউকে ছাড়াই
নীল স্ট্রাইকারে কালো-সাদা রঙ চলকে পরবে
অথবা জার্সির অদলবদল হবে।


*****************************


একটা ঘরের খোঁজে





কথা বলার সংখ‍্যায় গভীরতা বাড়লে
সরে সরে আসে সব রঙপাখিরা
ছোটোঘাসে ফুল হবার আগে হাত ছুঁয়ে করা
যত ভোরের প্রার্থনা সাবেকি গন্ধে মিশে আসে
ছায়ারা পরতে ভুলে গেছে
সংজ্ঞাহীন পরিযায়ী পাখি ভেঙে যেতে যেতে
পথ দেখালে চোখের সামনে সে পথ এগিয়ে নেয়
নাকি উপহারে আসে একটা মৃত্যু?
কথা বলা ফুরিয়ে এলে কথা অনেক হয়
তখন গালিচাপাতা সন্ধেগুলো উত্তাপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে এলে
আমাদের ঘর একইরকম পরিচয়হীন
এক পৃথিবী মেঘে সীমাবদ্ধ এক দৃষ্টি।


*****************************




রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২০

অঙ্কুশ ভৌমিক

                                         



এই সংখ্যার কবি অঙ্কুশ ভৌমিক ।বয়স - উনিশ৷বসবাস: শ্রীরামপুর, হুগলী। অবসরে বই পড়তে, গান করতে, ছবি আঁকতে ভালোবাসে। শখে কবিতা লেখা।


 অরণ্য



(১)

প্রথমবার শিউলি ফুল কুড়িয়ে

                           হাতে নিলাম।

আকাশগুলো ফুরিয়ে গেল

শেষ হলো সমস্ত অকাজের সময়


দূর থেকে দেখলাম,

শহর পেরিয়ে

অরণ্য কাছে এসে পড়েছে


আর, ঘাড়ের উপর 

নিশ্বাস ফেলছে

দুটো সাদা বক


(২)

আকাশের অনেকটা উপর থেকে

একটা ছোট্ট সিকি

ধানক্ষেতের সবচেয়ে উঁচু শিষটাকে

                                আঘাত করল


কিছুক্ষণ সবটা চুপচাপ

তারপর বাঁধনছাড়া উচ্ছাস

পরপর নিমজ্জিত হল,

ঘাস, ফুল, পাতা...

অবশেষে অরণ্য


আমার আর কিছুই বলার থাকল না

দু'মুঠো আদর ছাড়া


(৩)

ঘাসের উপর, যেখানে

আমার হলুদ পায়ের ছাপ পড়েছে

তার থেকে খানিকটা দূরে

একটা শিউলি ফুলের গাছ। সাদা।


আমি অন্য ঘাসগুলো মারাতে চাইছি না।

কিন্তু কেন?


(৪)

পরশু রাতে বাজ পড়ে-

যে গাছটা ন্যাড়া হয়ে গেছে

তার মাথায় একটা চিল সবসময় পাহারা দেয়


যতবার শিকারি আসে,

চিৎকার করে জানান দেয় সে।

শুধু ফাঁকা আওয়াজ হয় বন্দুকের


আমি আরো বেশি করে ভালোবেসে ফেলি



(৫)

বেশ কিছুদিন পর

গড়গড় করে গাড়ি এলো;

পেট্রোলের গন্ধে 

কিছুক্ষণের জন্য অচৈতন্য...


তারপর, সামনে শুধুই বালি


টেবিলে বসে ডায়েরি খুলে দেখলাম

পাতাগুলোয় শ্যাওলা। ঘন। সবুজ।


ধানক্ষেত

অঙ্কুশ ভৌমিক


(১)

কালোজলের দীঘিটা পেরোতে পারলেই

                    অনেকটা সবুজ দেখা যায়

কবিতার ঝুলি ফুরোলে

তারপর, ধানক্ষেত আসে


সবুজ শিষের উপর

চোখ বোলাই।

বড্ড সুখ হয়


পাশ থেকে তাড়া আসে,

জল আসবে। ছায়ায় চল


(২)

একটা মেঘের কতখানি সাহস

নদী ছাড়িয়ে এপারে এসে গেল

একা!


আমিও হুঙ্কার করলাম,

পূবদিকের হওয়া আমার পাশে দাঁড়ালো।

শিষগুলো ঘাড় এলিয়ে একবার আমার দিকে

                                    একবার মেঘের


তারপর, আমার পরাজয়

              আমার শান্তি


(৩)

সেদিন জ্বর এসেছিল

তাই, জানালাই সম্বল


একটু ঠাট্টা তামাশা হলো

একটু পাগলামো

একটু বকাবকি


তারপর যা হয়,

থার্মোমিটার, জলপট্টি, প্যারাসিটামল

জ্বর কমল

রোদও


(৪)

রাস্তার ধারে থুতু ফেলে

এগোলাম সবুজের জন্য


চোখ ধাঁধিয়ে গেল নিমেষে

শান্ত, সোনালী আলো

ভয় পেলাম


মাঠের মাঝে

মৃত্যুর রঙ সোনালী


(৫)

মৃত্যু আমি দেখিনি,

দেখেছি

মৃত্যুর শেষটা


সর্পিল আলপথের উপর

বড্ড রোদ লাগছে এখন

পূবদিকের হওয়াটাও বেমামান


পাশ থেকে তাড়া আসে

বড্ড গরম। ছায়ায় চল

রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০

আবেশ কুমার দাস

                                     


  

এই সংখ্যার গদ্যকার আবেশ কুমার দাস৷জন্ম ৩০ মার্চ, ১৯৮৩। উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটিতে। প্রযুক্তিবিদ্যা শাখায় পড়াশুনো। কর্মসূত্রে বেসরকারি প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা।ছোটগল্প রচনার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু। লিখেছেন সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট বিষয়ক কিছু নিবন্ধ। বর্তমানে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ‘বাক্‌’ পত্রিকার গল্প বিভাগ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। তিনটি ছোটগল্প ও দু’টি নিবন্ধ সংকলন ইতিমধ্যে প্রকাশিত।


যখন লকডাউন



খবরটা আর বেরোয়নি শুক্রবারের কাগজে।

ছবিটা অবশ্য বড় করেই ছাপা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। ফটোগ্রাফির হিসেবেও কাজটা ছিল বেশ পাকা হাতেরই। মুখটা অল্প নামানো থাকলেও পরিচিতরা ঠিকই চিনতে পেরেছিল মৃত্যুঞ্জয়কে। উপরন্তু সাবজেক্টের যেমন ফ্রেমের ঠিক মধ্যিখানে থাকার কথা, সেভাবেই ছবিতে ছিল মৃত্যুঞ্জয়।

খবরের কাগজের পাতায় ছবি ছাপা হওয়া বলে কথা।

চার লাইনের খবর হওয়া কি তার চাইতেও বড় হল!


বাজার থেকে ফিরে জামাকাপড় গামলায় ফেলে খিড়কির চাতালে ব্লিচিং ছড়াচ্ছিল বাপি। একটু ঘষে দেবে এরপর ঝাঁটা দিয়ে। শেষে ঢেলে দেবে দু’ বালতি জল। সদর নয়, বাড়িতে ঢুকছে বেরোচ্ছে আজকাল খিড়কি দিয়েই।

সদর দিয়ে ঢুকে বাথরুমে আসতে হয় শোবার ঘর ডিঙিয়ে। কিছুতে হাত না-ই দিল। বাইরের কাপড়ে হেঁটে আসবে ঘর দিয়ে! ভয় পেতে মানা করেও যা ভয় দেখিয়ে দিচ্ছে টিভি-কাগজ! এখন তো বলছে হাওয়াতেও নাকি ভেসে থাকতে পারে আপদটা। তার চাইতে এই ভাল। চাতালের কলের তলায় বাজারের জামাপ্যান্ট ছেড়ে একেবারে চান করে ঢোকো ঘরে। সারারাত তারেই মেলা থাকে আগের দিনের কাচা কাপড়জামা। চাতালটা শেড দিয়ে ঢাকা বলে সাঁঝ পাওয়ারও ঝামেলা নেই যেহেতু। চান সেরে শুকনো কাপড় চড়িয়েই একেবারে ঘরে ঢোকে বাপি।

মাথায় জল ঢালার সময়ই খেয়াল করেছিল গতকাল। ভাল পা হড়কাচ্ছে চাতালে। তখন আর ঝাঁটা ধরতে ইচ্ছে করেনি। ভেবে রেখেছিল আজ চানের আগে ব্লিচিং ছড়িয়ে একপ্রস্ত ঘষে দেবে চাতালটা। এমনিতে মা-ই করে এসব। কিন্তু বাড়ি বসে বসে ক’দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছে বাপি। কলকবজায় না জং ধরে যায় এরপর!

বাজার করার বাইরে আর কোন কাজটা করার আছে হালে! তাও পৌঁনে দশটা বাজল তো মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াল কালো ভ্যান। তারপর আর দেরি হয় না ভিড় পাতলা হতে। এপ্রিলের ফার্স্ট উইক পেরোতে চলল। সবাই বলছে আরও নাকি বাড়বে লকডাউনের মেয়াদ। গোটা এপ্রিলটাই নাকি টেনে দেবে এভাবেই। বাড়ি বসে থাকতে যে এত বিরক্তি, ভাবতে পেরেছে কোনওদিন বাপি! মার্চের গোড়াতেও মনে হত, দু’দিন ছুটি নিয়ে স্রেফ শুয়েবসে থাকবে ঘরে।

রাতে ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা প্রায়দিনই ছুঁয়ে ফেলত এগারোর দাগ। মিউনিসিপ্যালিটি চত্বরে দোকান। সওয়া দশটা-দশটা কুড়ি অবধি থাকতই দু’-একজন খরিদ্দার। তারপর হিসেব মিলিয়ে ঝাঁপ ফেলে বেরোতে বেরোতে সেই যার নাম সাড়ে দশটা-দশটা পঁয়তিরিশ। একদিন বন্ধ ঠিকই দোকান। কিন্তু ছুটি বলতে যা বোঝায় সচরাচর সেটা থাকত না বাপির। মাসের মধ্যে কম সে কম দুটো বিষ্যুদবার ছুটতেই হত চাঁদনি। শিয়ালদার মেন লাইনের ট্রেন। মানুষ যেন বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। এই ছ’ বছরের অভিজ্ঞতায় তেমনই মনে হয়েছে বারেবারে বাপির। মফস্‌সলের দিক থেকে পেটের টানে কত লোক যে যায় রোজ কলকাতায়, টের পাওয়া যেত এই লোকাল ট্রেনের কামরাতেই। উলটোদিকের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত বাপি। পুরনো প্লাটফর্মগুলোকে ধরে ধরে বাড়ানো হচ্ছে স্টেশনে স্টেশনে। কাঁকিনাড়ায় প্রায় তৈরি হয়ে গেল আস্ত একটা নতুন প্লাটফর্ম।

সাড়ে সাতটা-আটটার দিক করে ট্রেন থেকে নেমেও তখনই বাড়ি ফেরা হত না বাপির। মাদারবোর্ড, প্রিন্টার, হার্ড ডিস্কের হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত দেবুদার বাড়ি গিয়ে। দু’-একটা বিষ্যুদবার হয়তো যেতে হত না কলকাতায়। কিন্তু শুয়েবসে ছুটি কাটাতে হলে কপাল করে আসতে হয়। কলকাতায় যাওয়া না থাকলে কাস্টোমারদের বাড়ি পাঠাত দেবুদা। কার পাঁচ বছরের পুরনো ল্যাপটপ অন হচ্ছে না। কার মনিটরে সবুজ ছোপ আসছে। পনেরো মিনিট থেকে তিন ঘণ্টা— কতক্ষণের কাজ না গেলে বোঝার জো নেই। অল্পক্ষণে মিটে গেলেও বিরক্তি ধরত। এটুকুর জন্য ছুটির দিনে টাইম বের করে আসতে হল ছুটে। শুক্রবার অবধি ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারল না লোকটা। বেশিক্ষণ লাগলেও গরম হত মাথা। বাড়ির একটা কাজ সেরে আসা যেত এই সময়ে। সেই বিকেলে আধাঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট দেরি করে টাইম দিতে হবে পৃথাকে। এখনও ম্যাচিয়োরিটি আসেনি মেয়েটার। গুম হয়ে বসে থাকবে মিনিট দশেক। আবার তেলাতে হবে...

কতদিন ভেবেছে তখন বাপি। একেবারে নির্ভেজাল ছুটি নিয়ে বসে থাকবে দু’দিন। কিন্তু শুয়েবসে থাকা যে এত বিরক্তির কে ভাবতে পেরেছিল! খুঁজে খুঁজে কাজ বের করছে ইদানীং বাপি। বাজার এতকাল করেছে বাবা-ই। কিন্তু বুড়ো মানুষটাকে তো আর ভিড়ের মধ্যে পাঠানো যায় না এখন। একেই সুগারের রুগি। চাতালের শ্যাওলা সাফ করেছে এতদিন মা-ই। কিন্তু এত কাচাকাচির পর আবার খাটাবে বুড়িটাকে। একেই হাঁপের সমস্যা।

নিজেই ব্লিচিং ছড়াচ্ছিল তাই আজ বাপি।

তখনই কানে এসেছিল। ফোনে কার সঙ্গে কথা চলছে মা-র। উৎকণ্ঠায় গলার আওয়াজ চড়ে যায় মানুষটার। ভেসে আসা কণ্ঠস্বর থেকে শব্দগুলোকে আলাদা করতে না পারলেও টের পাচ্ছিল মায়ের উত্তেজনা। কী আর হবে! কুলতলা বা সাহাপাড়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে হয়তো আবার কাউকে। বাড়ি সিল করে লোকজনকে বেরোতে মানা করে গিয়েছে চোদ্দো দিন। কাকিমাকেও বলিহারি। রোজ ফোন করে করে এসব গল্প না শোনালেই নয় মাকে!

অদ্ভুত একটা ব্যাপার টের পাচ্ছে হালে বাপি। মৃত্যুভয় যত নিশ্বাস ফেলে ঘাড়ের কাছে, রোগ-জরা-মৃত্যুর খবর রাখাও যেন ততই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র নেশা। বলে বলে যা হয়নি এত বছরে, সেই বিড়ির নেশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে বাবা। অথচ রোজের কাগজ তন্নতন্ন করেও যেন আজকাল শান্তি নেই মানুষটার। টিভি খুলে ঠিক সেই খবরের চ্যানেলগুলোই চালিয়ে বসে থাকবে দিনরাত। আর খবর তো এখন একটাই। জালিয়াতি, রাহাজানি, খুনজখমের কিছুও যেন আর ঘটছে না হালে ভূভারতে! খবর বলতে শুধু সারা পৃথিবীর কোথায় কত বাড়ল আক্রান্তের সংখ্যা আর মরে গেল কত মানুষ! অলিম্পিক পদকের দৌড় চলছে যেন! এক-একদিন আশ্চর্য লাগে বাপির। পানুর ক্লিপিংসও আর পাঠায় না কেউ শালা হোয়াটসঅ্যাপে...

ব্লিচিং ছড়িয়ে কতক্ষণ রাখে কে জানে! সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁটা টেনে দেয়! উপযাচক হয়ে হাত দিয়েছিল বটে কাজটাতে। এখন টের পাচ্ছে কোনও কিছুতেই অন্ধের মতো নেমে পড়লেই হল না। মাকে ডাকবে নাকি একবার...

গলার আওয়াজটাও এদিকেই আসছে না!

দাঁড়া, আমি বলছি। কী যে করিস না তোরা...

ফোন কাটতে কাটতে এসেও দাঁড়িয়েছে মা।

বাপিকে আর বলতে হয় না কিছু। মা-ই বলে ওঠে, কী করছিস? এখন রাখ এসব। বেরোতে হবে এক্ষুনি তোকে...

মানে! এখন আবার কোথায় বেরোব! সাড়ে দশটা বাজতে চলল...

আর বলিস না। পুচাই ফোন করেছিল। তোর কাকা রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে...

কী বলছ, ঝাঁটা ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় বাপি, কোথায় বেরিয়েছে এই লকডাউনের মধ্যে!

ওই তো। এত আড়বুঝো না বাড়ির এই পুরুষমানুষগুলো! ক’দিন ধরে শরীর ভাল যাচ্ছিল না। এখন হবেই। দোকান বন্ধ। তার এক টেনশন আছে। মালা বোধহয় বলেছিল, বাড়ি বসে রয়েছ একদম, হজমের গণ্ডগোল তো হবেই একটু। তাতেই তেজ করে নাকি বেরিয়ে গেছেন বাবু...

বাপির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বলে, ফোন নিয়ে যায়নি?

তাহলে কি আর ভাবনা ছিল! এদিকে দু’ ঘণ্টা হয়ে গেছে। পুচাই যতটা পেরেছে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে এদিক-সেদিক...

না না, ও আবার বেরোতে গেল কেন! পুলিশ ঘুরছে রাস্তায়...

বলতে বলতেই তার থেকে কাচা জামাকাপড় টেনে নিয়েছে বাপি। মাস্ক তো এসেই ছেড়ে দিয়েছিল গামলার জলে। একটা রুমালই গিঁট দিয়ে নেয় এখন মাথার পেছনে। এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছিল পুচাই। অভাবের সংসারেও বয়সের একটা স্বাভাবিক চটক লেগেছেই গায়েগতরে। দিনকাল ভাল নয়। অসুস্থতাকে ঢাল করে রাস্তাঘাটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রক্ষকই। ওদিকে ঘরে বসে থাকলেও ছ’ মাস দিব্যি এখন হেসেখেলে চলে যাবে যাদের, ফেসবুকে তারাই নিদান দিচ্ছে কড়া দাওয়াইয়ের। কী যে করে না কাকাটা! বুদ্ধিশুদ্ধি হল না এতদিনেও। নিজেও বিপদে পড়বে। মেয়েটাকেও ফেলবে। না না, একা-একা বেরোতে গেল কেন পুচাই! প্রথমেই ফোন করা উচিত ছিল বাপিকে। ফোন অবশ্য চার্জে বসিয়ে রেখে বাজারে বেরিয়েছিল বাপি। রুমালটাকে মাথার পেছনে গিঁট দিয়ে দাড়ির মতো ঝুলে থাকা অংশটাকে ঘুরিয়ে আবার নাকের কাছে তুলে আনে বাপি। কোন কোন রাস্তায় ঘুরপাক খেতে হবে এখন কে জানে! মামাদের মুখে না পড়াই বিচিত্র। মুখে ঢাকা থাকলে তাও কথা শুনবে মামারা।

মা গজগজ করে যাচ্ছে তখন, ঘরে বয়েস্থা মেয়ে। সেসব তো ভাবল না জীবনেও। পইপই করে বলা হয়েছিল তখন। ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকাগুলো তুলে বসিও না ওসব জায়গায়। এখন দোকান বন্ধ। কী করে চলবে সেই টেনশন। টাকাগুলো থাকলে বুকে বল থাকত তাও...

সাইকেলটা থাকে সিঁড়ির তলায়।

সেই চান না করেই ঢুকতে হল ঘরের ভেতর।


পাছায় হালকা রুলের গুঁতো দিতে দিতে হলদে দাঁত বের করে হাসছিল পুলিশটা, নামটা তো খাসা বে। মৃত্যুঞ্জয়। তাই বুঝি মরার ভয় নেই একদম...

যদিও পুলিশটার মুখ আসেনি ছবিতে।

ক্যামেরার ফোকাস ছিল বাপির মুখেই। বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে মাথা নামিয়েও নিয়েছিল বাপি। তবে বড় কাগজে চাকরি করা ফটোগ্রাফারের হাতের রিফ্লেক্স তো। সারা বাংলার লোক না হোক, বৃহস্পতিবারের কাগজ দেখে সারা শহরের লোক ঠিকই চিনে নিয়েছিল কান ধরে ওঠবোস করতে থাকা বাপিকে। আসলে খোদ মিউনিসিপ্যালিটি চত্বরে দোকান দেবুদার। দোকানে আসুক আর না-ই আসুক, কাজে-অকাজে বিগত ছ’ বছরে ওই চত্বরে একদিনও পা রাখেনি এমন মানুষ মাইক্রোস্কোপে খুঁজতে হবে শহর ঢুঁড়ে।

শুক্রবারের কাগজে অবশ্য আর বেরোয়নি বিষ্যুদবার দুপুরেই বাপির নিজের ঘরের সিলিংফ্যান থেকে ঝুলে পড়ার খবরটা।








রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০

পায়েল দেব

                                         


               



সৃজন এই সংখ্যার কবি পায়েল দেব৷ কবিতা যার বাঁচার রসদ।জন্ম- ২৭ শে জুলাই,  ১৯৮৭৷শিক্ষা- পদার্থবিদ্যায় স্নাতক,শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর, বি. এড ৷পেশা- শিক্ষকতা । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
কুয়াশার সানস্ক্রিন - ২০১৭
স্কেচবুক- ২০১৯
গাছের গোপন অসুখ - ২০১৯
নিমফুল -২০২০



আত্মাহুতি 
--------------

মৃত ঝাউবনে
সহজেই খুলে যায় বাতাসের অভিমুখ
অলৌকিক বয়ন- কৌশল

চড়ুইয়ের সৎকার শেষে
ওমহীন ডিম
বিরহী পালক
মিহি দানার আত্মস্বর
আগুনের লিপি
গোপন উরুসন্ধি
বৃত্তাকার মাঠে জমা দিতে আসে উলঙ্গ পাহাড়ী যুবক

স্ট্রীট- শো
-------------

কত- তম খোলস বদলেছে পৃথিবী
সাদা- কালো ঘর ঠেলে 
বিছিয়েছে প্রেম কুশনের মতো
কম বেশি উড়ছি সকলে
উড়ালপুলের ছায়ায়
আত্মহত্যা লেগে আছে মড়কের মতো
পিলারের গায়ে জলছবিটবি আঁকা
শিশুরা বিস্ময়ে গুনে 
ভুলভাল তারা গুনার মতো

এসব শব্দ- খোলশ, কুশন, ছায়া, উড়ালপুল, পিলার সমার্থক মনে হয়

পিলারে হেলান দিয়ে
উড়ালপুলের তলায়
কুশনের উপর 
খোলশ জড়িয়ে
ছায়ার মতোন
মড়কের গায়ে শিশুফুল ফুটে থোকায় খোকায়।

যীশু
-----------

পৌষের মাঝামাঝি এখানে প্রয়োজনের বেশি শীত পড়ে। সমস্ত স্ট্রীট লাইট নীরেন্দ্রনাথ হতে চায়। পারে না। কেননা তাদের ভাষারীতি জানা নেই, কবিতার ক্লাস তাদের ধাতস্থ নয়, বোঝাপড়া নেই বাতাসের সাথে, ভুলভাল বকা নেই, মারমুখী সত্যি বলা নেই। কেবল আন্দাজ করে- দূরে কোনও অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে ফুটে আছে পারিজাত।রাস্তায় রাস্তায় বড়দিনের কেক হাতে বেরিয়েছে পথ-শিশু। গোল্ডেন, পারপল্ কালারের ফুরফুর ঝালরের শখ নিয়ে হঠাৎ ডেকে উঠছে রুপোলী পাখির দল। তাদের ডানা নেই।তাদের কাছে বৃদ্ধ বাবার মতো একঘেয়ে লাগে এই স্ট্রীটলাইট আর শীতকাল।

আন্তর্জাতিক
-----------------

সত্যিই কি জোহানসবার্গ নিরাপদ ছিল, 
যেসময় সরলবর্গীয় চির হরিৎ বৃক্ষরা জন্ম নিচ্ছিল?
অক্সফোর্ড রোড থেকে এলোপাথাড়ি আলোছায়া আসত
তুমিও তো হারিয়ে গেছিলে
বেনামি হলুদ খাম খুলে বের করে আনতে হল মনের অসুখ 
যেদিন সমান রাস্তা হল,বনসাই করে নামিয়ে আনা হল গাছের পার্লার, 
বলেছিলে  প্রতীক্ষার মতো দীর্ঘ কোনও দূরত্ব নাই আর
আমাদের বিশুদ্ধ উন্মাদনার খাতিরে
যৌনতার মতো প্রিয় একটি শব্দ তখন অভিযোজনগ্রস্ত।

হে প্রিয় জোহানসবার্গ, তোমাকে সামনে থেকে দেখিনি
তবু  কত চকিতে ঢুকে গেছ কবিতায়
অসাড় পৃথিবীর কৃত্রিম সংসারে তোমার সুস্বাগতম!

তুমি জলপাই গাছ পাঠিও, আমি পাঠাব ম্যাপলের রঙ

প্রিয় জোহানস,
এখানে শিরিষ-শিমূল হতে নামে হেমন্ত
তুমি চিরপ্রেমিক,মৃত্যুর মতো চিরবসন্ত।

সম্বল
------

বিকলাঙ্গ শরীর এক নৌকায়,
পৃথক নৌকায় পদার্থবিদ্যা আর ভ্রমণের পাণ্ডুলিপি,
মাঝখানে নিথর জলের উপর সম্ভাবনাময় সেতু,
আলো থেকে দূরে সরে যাওয়া দিনের পরবর্তী সীমা,
এসব ফেলে রেখে
গাছের ছায়াজাত ঘুম চোখে
কেউ কেউ মাঝরাতে কবিতা পড়ে, আমি দেখেছি।

কাজ শেষে সব রাস্তার দুপাশে ঠেলে ফেলে, 
লোহার গেটে আঙুল ছোঁয়ালে বুঝি,
নিজের মৃতদেহ নিয়ে ঘরে ফিরছি।

এ শহরে আমার কোনো আত্মীয় নেই,
কে পোড়াবে আমাকে?
তাই প্রতিদিন ফিরিয়ে আনতে হয় মৃতদেহ,
আমার আর মুক্তির মাঝে এটুকুই দূরত্ব,বেঁচে থাকার পরিসীমা।

উপহার
---------------

রাত বারোটায় চুমুটুমু খাই
কেক কাটি ফুলেফুলে
মৃত সন্তানের কোলাজ জানে
দুজনেই দুজনের মতো একাকী
অন্তরে অন্তরে

তোষকের উপর, গোলাপের পাপড়িও জানে,
বিষাদের অহংকার নিয়ে 
দূর বসতির কাছে শুতে গেছে
অভিমানী আদর

বিবাহের ধুন থেকে দূরে 
আরও দূরে পালাচ্ছে আমাদের ফাল্গুন-বার্ষিকী


স্তুতি 
------

স্নানের জলে প্রতিদিন গাছের ছায়া মিশে 
গাছ থেকে কত দূরে রাখি স্নানঘর,তবু...

সুন্দর রাতের পর যে ভোর হয়,জলরঙে আঁকা হয় আমাদের কোমল গ্রাম,গুল্ম, কাঁটাঝোপ, চিরতা,
মনে মনে তুলে দেব তোমার হাতে
সারি সারি গাছ পেরিয়ে ৮ নং জাতীয় সড়ক 
রোদে জলের মতো গরম হয়
মাঝখানে শুয়ে থাকে মনু,নিস্তরঙ্গ হাঁটুজল,
গোপন চাঁদের টানে চুপচাপ জলের আশ্রয়

একটু একটু করে কত মনু তুলে ফেলেছি
এসব গাছ জল তুলে আনার সাক্ষী
আর জাতীয় সড়ক আমার নিরন্তর পাল্টে যাওয়া দেহের শ্রী

যদি পারো আমার প্রার্থনার সামনে একবার নতজানু হয়ো...

সমবেগ
----------

এই যে মনের মতো বিকেল ছেড়ে যাচ্ছে গাছের ছায়া
রাতের গায়ে আচানক ঘুম ভেঙে গেলে
পাখিরা নেমে পড়ছে শীতঋতুর ভেতর

ঘরে ঘরে দাম্পত্যের সুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে অবোধ স্বপ্ন
বিবাহের মালাবদল, দধিমঙ্গল এসব ফেলে
বেরিয়ে আসছে বর-বৌ এর ক্লান্ত শরীর

শাবকের অজান্তেই ওড়ার সময় পেরিয়ে গেছে 
গাছ থেকে ফুল,ফুল থেকে মালা
একগাছি সুতো উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে

পরস্পরের প্রতিরূপ হয়ে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে- মা,বাবা আর একটি গাছ

তৃতীয় বিশ্ব
---------------

রাতগুলো একে অপরকে ধাওয়া করে।

এখানে একটি বন্দর
দূরে কোথাও সমুদ্রের শব্দ-নিঃশব্দ মিলিয়ে
তোমাকে ভালোবাসি আমি
আমার চুম্বন তোমার ঠোঁট পেরিয়ে যেদিকে গেছে 
ঐখান থেকে আকাশ অনেক উঁচু,আরও উঁচু থেকে তার তারাগুলো
বন্দর আর আমার বুকে ঝরে পড়ে
পুরনো নোঙরগুলোর মতো 
আঁধারে সামুদ্রিক পাখিরদের জলক্রীড়া

আমি এক অন্ধ
অন্ধের আলাদা ঘরানা 
ভিন্ন এস্রাজ ভিন্ন দিলরুবা।



স্কেচ
-------

নিজেকে আদর করলে
নয়নতারার মতো লাগে দাম্পত্য 
অনুপ্রস্থ তারে ঝোলা সংসার 
টপটপ ঝরে পড়া রঙ,
যাবতীয় আলতা, 
সিঁদুরের দায়ভার, 
মাসিকের সময় 
বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে কান্নার বাদ্যকর
মাটির অন্তরে অন্তরে বিষ ঝাড়ে
যেনো তাঁর রাগ
আমরা কেন কবিতা লিখি
কেন লিখে রাখি নিজের ফণা তোলা
চশমার মনমরা পাওয়ার