শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

সম্পাদকীয়


সারা বিশ্ব আজ ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার৷প্রতিদিন সংবাদমাধ্যম যে সংখ্যাতত্ত্ব দিচ্ছে তাতে আশঙ্কা বেড়েই  চলেছে আমাদের Iসারা বিশ্ব এক মারণ ব্যাধির স্বীকার ৷ সংক্রমণ আমাদের জীবনকে চার দেওয়ালের  মধ্যে বন্দী  করেছে I আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি যখন সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে ৷ বৈশাখ মাস আমাদের কাছে উৎসবের মাস । রবীন্দ্রনাথ ,নজরুলের জন্মমাস ৷এনারা আমাদের জীবনের কঠিন সময়কে সহজ করে তুলেছেন ৷
" তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম ঘুচায়ে "
সত্যি আমারা সবাই যেন নির্মল থাকতে পারি ।আমাদের ভাবনাগুলো যেন সর্বদা হাওয়ায় উড়ে বেড়াতে পারে ৷ বন্দীদশায় কাছে এনে দিয়েছে সম্পর্কগুলোকে ৷ স্বামী -স্ত্রী ,বাবা - মা , কন্যা - পুত্র ,ভাই - বোন সম্পর্কগুলোকে যেন এক ছাদের তলায় এনে দাঁড় করিয়েছে ৷সংক্রমণ না হলে বোঝা হত না কত কথা ! কত যন্ত্রণাকে উপশম দিয়েছে ৷ এই যুদ্ধ কালীন পরিস্থিতিতে একদল মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে চলেআর কাছে হাসপাতাল ,থানা , রাস্তায় ।কুর্নিশ তাদের ৷ সারা বিশ্ব অবশেষে একটি বিষয়ে সমবেত হতে পেরেছে ৷ দেরীতে  হলেও আমরা বুঝেছি সারা পৃথিবীকে সকলের বাসযোগ্য করে তুলতে হবে ৷ কীট ,পতঙ্গ , পশু ,মানুষ সবাই আমরা একসাথে চলতে পারি ৷ 

আমাদের জীবনে দূষণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত I এই সংক্রমণের জেরে দূষণের মাত্রা কমে গেছে Iপৃথিবী যেন আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে ৷ ব্যস্ততম পৃথিবী শান্ত হয়ে গেছে পূর্বের মত Iকিন্তু সময় এগিয়ে চলছে ৷আর এই সময়ের ভূমিকায় অন্যতম মাধ্যম হয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ৷ বিশ্বের এই কঠিন সময়ে মনকে আরাম দেওয়ার জন্য সৃজন চলে এসেছে আপনাদের পিছুপিছু ৷জোর করে লিখিয়ে নিচ্ছে কবি ,লেখকদের দিয়ে ...

এ সময়ের তোড়ে বয়ে চলে 
আগামীকাল
দূরত্ব নয় 
আমরা বরং মিলে মিশে থাকি 

কোয়ারিন্টিন জীবনে আমিটুকু 
যেন দিয়ে যেতে পারি 
বিশৃঙ্খল দিনলিপি লেখা থাকে সময়ের কুলুঙ্গীতে ...

আমাদের এই সংখ্যাতে আছে উপন্যাস ,গদ্য ,কবিতা ,গল্প ,অণুগল্প ইত্যাদি ৷ লিখেছেন মলয় রায়চৌধুরী ,স্বপন রায় ,তুষ্টি ভট্টাচার্য ,যুগান্তর মিত্র ,জয়তী রায় তথা লেখকেরা ৷সবাই সৃজনে থাকুন ,ভালোবাসায় থাকুন ।আমরা সবাই সংক্রমণ মুক্ত পৃথিবীতে একসাথে হাঁটব ৷ 

সম্পাদক
পারমিতা চক্রবর্তী 

সিলভিয়া ঘোষ

অভ্যাস বদল
--------------------

 সিলিং ফ্যানের গুলোর গায়ে লেগে আছে   কত জন্মের ধুলো, মাকড়সার জাল বিস্তার  করেছে দেওয়ালে টাঙানো পুরস্কার প্রাপ্ত ফটোগুলির গায়ে।
        তবে আগেও কি  সব এমনই ঝাঁ চকচকে ছিল ?না তা কখনই নয়, কিন্তু যে জিনিসটা ছিল তা খুঁজে  বেড়ায় অনন্য রায়।
   ইলেভেনে পড়া যে মেয়ে বেলা ৯ টার আগে ঘুম থেকে ওঠেনা,  সেই  কি না আজ সকাল  থেকে রান্না ঘরে ! অন্তরা  রান্না করে এনে দিচ্ছে  বাবা ,দাদা কে! মায়ের হাতে সকালের খাবার  খেতেই  যে ছেলেটা আজীবন অভ্যস্ত, সে মুখটা হা করেই বলে ওঠে,  'অনু  একদম  দূরে  সরে যা, কেমন গা গুলিয়ে উঠছে,  আমি খেতে পারব না'!  কথা শেষ হতেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টুডেন্ট অন্তর।
           আপাত দৃষ্টিতে যিনি উদাসীন, শান্ত, বেখেয়ালী মানুষ, মিনিটে মিনিটে  চা চাওয়া যার বাতিক, তিনি কেবল ঘরময় ছড়িয়ে  ছিটিয়ে থাকা শাড়ি,  ব্লাউজ , নাইটি,  চুরিদারে হাত বুলাচ্ছেন  আর নাকের কাছে সব ধরে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন  যা  একসময় অভ্যেস ছিল অনন্যার। তার স্ত্রীর।
        বারো বছর বিছানায় পড়ে থাকা একটা প্রাণ যার সঙ্গী ছিল চব্বিশ ঘণ্টার , ঐ ফ্রেমে বাঁধানো মানুষ টা, যে কি না এক আধদিন বিছানা নোংড়া হলে বলে উঠত 'আর কতদিন এভাবে জ্বালাবেন,  এবার মুক্তি দিন'..তারও দুচোখের গোড়া দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। মনে মনে বলেন ভগবান আর কথা নিষ্ঠুর হবে তুমি! মা হয়ে  লক্ষ্মীহীন ছেলের সংসারে জঞ্জালের মতোন পড়ে আছি অথচ আমার ঘরের লক্ষ্মী কে তুমি এভাবে কাছে টেনে নিলে! আমার মুক্তি আর কবে দেবে...!
ঠাকুর ঘরের লাল সাদা গরদের শাড়ীটা থেকে এখনও ধূপ ধূনোর গন্ধ বের হয়। মাঝে মাঝে  অরণ্য বাবু সকলের দৃষ্টিগোচরে তার ঘ্রাণ নিয়ে থাকেন। টের পান যেন পাশেই স্ত্রী অনন্যা রয়েছেন।

শাশ্বতী সান্যাল



কিছু নষ্ট মানুষের রোদ


অনেকটা পথ হেঁটে কজন মানুষ
তাদের নারীর কাছে ফিরতে চেয়েছিল
রেশন ভিক্ষার কাছে,
রুটি আর শরাবের কাছে,
ধুলোমাখা, প্রায় আদুল, কিছুটা অনুন্নত
কোনো এক স্বদেশের কাছে

ভোরের সূর্যের সঙ্গে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠেছে
তাদের কর্তিত মুণ্ড। ওই দেখ
ক্ষুধিত ও একা মানুষের রক্তে
পুবআকাশ লাল হয়ে এল...

দশাশ্বমেধের ঘোড়া,এই দেশ, সাময়িক গতিরুদ্ধ করে
দেখেছে একঝলক, সূর্যের গায়ে
কিছু নষ্ট মানুষের রোদ লেগে আছে...























যেকোনো মৃত্যুর পর

শ্মশানবন্ধুর গল্প প্রাসঙ্গিক নয় আর। সমস্ত শহরে
শোকের বরাদ্দে আছে কাচেঢাকা শববাহী গাড়ি
বাতাস লজ্জিত, ছদ্ম-সামাজিক, ভারী,
যেকোনো মৃত্যুর পর আমাদের দেশে
সে বড় নিঃশব্দে আসে, কুণ্ঠিত  গ্রামীণ স্বজন
যেভাবে বিকেলে আসে, গঙ্গা লেখা চিঠি হাতে নিয়ে

প্রেতযোনি পুরুষের মতো তুমি ইদানীং আমার ছবিতে
জোড়া শিং এঁকে রাখছ। মুদ্রাদোষে আমিও মাংসাশী
নিজেকেই ছিঁড়ে খাব, অন্ধকারে,
যেন অন্য লোক...

খই বাতাসার অপচয় আর প্রাসঙ্গিক নয়,
স্মৃতিগন্ধী এ সরক। ধূপ নিভে গেলে
শোকের বরাদ্দে থাকে শুধুমাত্র কুসুম-স্তবক...









মলয় রায়চৌধুরী

                 
লয়ের ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ আর ঠাকুরমা অপূর্বময়ী



                               বাবা, মা ও দাদার সঙ্গে মলয়
ছোটোলোকের জীবন  ( ধারাবাহিক )

         
আমি আজও আমার প্রথম বইটা লেখার চেষ্টায় বাংলা ভাষাকে আক্রমণ করে চলেছি ।
         ইমলিতলায় ছিলুম বামুনবাড়ির মহাদলিত কিশোর ।দেখি খুল্লমখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি  তুলে আনতে পারি উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত ।


 ক্লাস টেন-এ পড়ার সময়ে ক্লাসটিচার অধিকারী স্যারের সঙ্গে ; সিঁড়ির দ্বিতীয় সারিতে বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় মলয়

         ঘোঁচু ছিলুম স্বমেহন বলুন ম্যাস্টারবেশান বলুন আমাকে শুরু করতে হয়েছিল কলেজে ঢুকে আসলে জানতুমই না একদিন পাটনার গান্ধি ময়দানে বসে রুমালে চিনেবাদাম রেখে আমি সুবর্ণ তরুণ আর বারীন খাচ্ছিলুম সুবর্ণ তরুণকে বলল এই তুই বড়োগুলো খেয়ে নিচ্ছিস জবাবে তরুণ বলল কি করব বল চিন্তায় আছি আজকাল দিনে তিন বার হাত মেরে ফেলছি আমি জানতে চাইলে হাত মারা আবার কি ব্যাপার সুবর্ণ বললে শালা হাত মারা জানিস না নুনুর খোসার তলায় যে নোংরা থাকে তা পরিষ্কার করিস না বারীন বলল বাঞ্চোৎ মেয়ে ফাঁসিয়ে বেড়াচ্ছিস হাত না মারলে খোসার তলার নোংরা যদি কোনো মেয়ের লাবিয়া মাইনরায় ঢুকে যায় তার লাইফ হেল হয়ে যাবে বললুম আরে শালা চুতিয়া কাহিঁকা হাত মারা কী জিনিস সেটাই বলবি তো তাহলে খোসার তলাকার নোংরা পরিষ্কার করব সুবর্ণ বলল নুনুতে সাবান লাগিয়ে ডান হাতটা এইভাবে নিবি আর নুনুকে সাবান মাখাতে থাকবি ব্যাস ফণফণিয়ে বেরিয়ে পড়বে তোর লিকুইড ডায়মণ্ড কি লজ্জা কি লজ্জা নাইটফল নিয়েই ছিলুম মজায়  নিজেই পায়জামা পরের দিন সকালে কেচে ফেলতে হতো নয়তো ধোপাটা “ই কাহেকা দাগ লগলই” বলে টিটকিরি মারবে তাই কলেজে ঢুকে চেককাটা গাঢ় রঙের লুঙ্গি পরা শুরু করেছি যাক শুরু হয়ে গেল আমার ম্যাস্টারবেশানের কালখণ্ড সমস্যা হল যে বুড়ো বয়সে প্রস্টেটের জন্যে ইউরোলজিস্টকে দেখাতে গেলে ডাক্তার জিগ্যেস করলে আর ম্যাস্টারবেশান করেন না বললুম না কেন দরকার হয় না বউ আছে তো বউয়ের মেনোপজ হয়ে গেছে ডাক্তার বললে আপনাদের লোকে ভুল বুঝিয়েছে ম্যাস্টারবেশান পঞ্চাশ বছরের পর আবার শুরু করতে হয় যাতে প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড মরে না যায় আপনি ভাবলেন বউয়ের সঙ্গে শুলেই কাজ হয়ে গেল তা ঠিক নয় শোয়াটা মনের ব্যাপার দেহের ব্যাপার হল ম্যাস্টারবেশান যাকগে আপনি তো যে বয়সে পৌঁছেচেন আর ম্যাস্টারবেশান করে লাভ হবে না কেননা প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড অলরেডি মরে গিয়ে ফুলতে আরম্ভ করেছে শুধু ওষুধ খেয়ে ওর ফোলা থামিয়ে রাখতে হবে বছরে একবার সোনাগ্রাফি আর পেচ্ছাপের রিপোর্ট আনবেন তাহলেই হবে মনে রাখবেন ম্যাস্টারবেশনে প্রমোদকর লাগে না।
         সেক্স ? চিরকাল দিনের আলোয়  চোখ খুলে রেখে আমার ভালো লাগে  রাতের অন্ধকারে নয় রাতে হলে জোরালো আলো চাই । হাড়কাটা হোক, সোনাগাছি হোক, কালীঘাট হোক, খিদিরপুর হোক, পার্কস্ট্রিটের সন্ধ্যা হোক, ফ্রিস্কুল স্ট্রিট হোক, সব দিনে কিংবা আলোয় । খাটে নয়, চোটে ।
         যখন প্রথম পর্ণোগ্রাফিক ফিল্ম  দেখলুম তখন ভাবলুম যে কেন এদের ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট ফিকশান বলা হয় না ।
         বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না বাংলা পাল্প ফিকশন হল ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন ।
         সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না  আমাকে বোঝার চেষ্টা করা হেঁয়ালি তাই আমার লেখালিখিকে বুঝুন ।
         আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না বুঝলেন তো আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয় গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্যে নয় তা পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্যে আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না  আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি-লেখকরা ভিড় করুক একজনকেও চাই না সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো যখনই মরি না কেন যুবাবস্হায় মারা যাবো মাঝে পনেরো বছর মরে গিয়ে যাচাই করে নিয়েছিলুম আমি লেখালিখি বেছে নিইনি লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে লেখকদের একেবারে তলায় নেমে গিয়ে ধাঙড় হতে হয় জানি পরের জন্মে ঘুর্ণিঝড় হয়ে জন্মাবো ।
         কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর কপি কৈলাস পর্বতে তুলে রেখে এসেছি দেখলুম আগেই কেউ মনুস্মৃতি রেখে গেছে  ।
         প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল  তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি  কিন্তু সার্কাসে যে লোকটা সিংহদের আগুনের ভেতর দিয়ে লাফাতে বাধ্য করত তাকে আমি ছোটোবেলায় মাফ করতে পারিনি আমার সবক’টা দুঃস্বপ্ন চোখ খুলে কেননা ঘুমে সবচেয়ে রসালো স্বপ্নগুলো দেখি ভোরের পুকুরে মৌরলা-ঝাঁকের মতন সুন্দুরীদের দল আমার উচ্চাকাঙ্খা ছিল একটা বিশাল বেশ্যালয় কিনি আর চোরাকারবারের মালিক হয়ে লুকিয়ে বেড়াই কিন্তু যখন ভারতীয় বাস্তবে পচতে থাকি তখন মগজে লেখা আসেনা মনে হয় সেসময়ে কেউ একজন আমাকে একটা শ্মশান বা গোরস্তান উপহার দিক হোমো স্যাপিয়েন মানুষের প্রথম যে করোটি পাওয়া গিয়েছিল তা যে আমার  লেখালিখিই তার প্রমাণ।
         দেশটা দিনকেদিন চুতিয়ায় ভরে উঠেছে গুয়ের সমুদ্রে ডানে পড়ি বা বাঁয়ে । একজন কমিউনিস্ট নেতাকে জিগ্যেস করেছিলুম, দেশভাগের সময়ে তো ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ধর্ম বাঁচাবার জন্য, তা এখানে এসে নাস্তিক হয়ে গেলেন যে ? ঢাকাতেই নাস্তিক থাকতে পারতেন, এই ধর্ম হোক বা সেই ধর্ম, নাস্তিকের আবার ধর্ম হারাবার ভয় আছে নাকি । শুনে, তাঁর চটি হয়ে উঠলো স্পোর্টস শু ।
         আমার দু’রকম চোখ নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় হাঁটতে আমার ভালো লাগে আমি তখন তাকিয়ে থাকি কিন্তু দেখি না অন্য সময়ে তাকাই আর দেখি পৃথিবীর কতো-কতো শহর গ্রাম গঞ্জের পথে-পথে এই ভাবেই চকরলস কেটেছি ।
        আমাকে নিয়ে ঠাকুমা অপূর্বময়ীর অতিকথায় বলা আছে যে আমি দু’বছর বয়সে ‘কুজঝটিকা’ স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলুম কিন্তু  কনভেন্ট ইশকুলে ভর্তি হবার পর আর পারতুম না বলে রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি হলে বাংলার মাস্টারমশায় এক্ষুনি নাম মনে পড়ছে না ও হ্যাঁ কর্মকারবাবু তবে  ওই ইশকুলে টিচারদের পদবি বা নামে বাবু যোগ করতে হতো ব্রাহ্মধর্মের ফিকে-রেশ হিসেবে বলেছিলেন “শব্দটা অরুন্ধুতী নয় রে অরুন্ধতী তুই কি ঘটি ” সহপাঠী তরুণ শূরকে জিগ্যেস করি ঘটি কী রে  গাণ্ডু ঘটি জানিস না পাটনাইয়া বওড়াহা ভঁয়সালোটন কোথাকার বাঙালের বিপরীত সমাস বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বসমাস নীলাংশুবাবুর ক্লাসে জানতে পারবি উনি চাটগাঁর সত্যিই জীবনকে মরচে-পড়া থেকে বাঁচাতে হলে জিভে পালিশ দিয়ে রাখতে হবে ভালোবাসা এক রকমের কল্পনার অসুখ আর আমার ঠাকুমার নাম জানেন তো “অপূর্বময়ী” তাঁর শাশুড়ির নাম “মাতঙ্গিনী”। ঠাকুমার ছোটো বেয়ানের নাম বিবসনা । এমন অসাধারণ নামগুলোকে লোপাট করে দিয়েছে কসমোপলিটান আধুনিকতা ।
         তিন বছর বয়সে মহাদলিতদের পাড়া ইমলিতলার গলিতে লেত্তি দিয়ে লাট্টু ঘোরাতে শিখে যাই  হাতের তালুতে কেয়া চকরলস কাটিস হ্যায় বাঙালিয়া গিল্লি-ডাণ্ডা বা ড্যাংগুলি খেলার চেষ্টা করতে গিয়ে কপালে আলু নিয়ে ফিরি  তিন বছর বয়সেই কনভেন্টে ভর্তি হবার জন্য নটিবয় শু কিনতে গিয়ে জানতে পারি যে আমার বাঁ পায়ের চেয়ে ডান পা বড়ো পায়ের কড়ে আঙুলের পাশের আঙুল ছোটো জানতে পারি যে আঁস্তাকুড়ের দিকে একবার তাকালেই যেমন টের পাওয়া যায় তা বাতিল জঞ্জালের জমঘট  তেমনিই অনেক লোকের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারি যে তার জীবনের গর্তে আছে শুধুই টাকাকড়ি শুধুই শুধুই ইমলিতলায় বসবাস না করলে ইমলিতলাকে জানতে পারা অসম্ভব ইমলিতলার নানা রঙের নানা কাপড়ের নানা পোশাকের তাপ্পি মারা ক্যাঁদরায় আমি মোড়া সমস্যা হল যে আমি আবার খোলের ভেতরে ঢুকে যেতে পারি না আর তো গুটিপোকা নই বদলে গেছি তবু আজও সুন্দরীদের দিকে তাকালে মন দুঃখে ভরে ওঠে । 

স্ত্রী সলিলার সঙ্গে মলয় । বিয়ের পরের দিন, ১৯৬৮ সালে

বাংলা অ্যাকাডেমিতে মলয় । দাদা, বউদি, স্ত্রী, নাসের হোসেন প্রমুখের সঙ্গে

(ক্রমশঃ) 


তৈমুর খান

ব্যাখ্যা
______________

মৃত্যুকে দেখতে দেখতে রাস্তা ফুরিয়ে আসছে আমাদের
হলুদ পাখিদের ঠোঁটে ঝুলে আছে বিকেলের রোদ
চৈতন্য ঘেরা বাড়িতে কারা বসবাস করে?
রেলিং এর ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় বোধ

রাস্তায় ধর্ষণ চিৎকার করে
পুলিশ ছুটে যায়
মর্গের উদ্বোধনে নতুন যুবতী
চকচকে অস্ত্রগুলি হাসে

মানুষ যদিও মানুষের ব্যাখ্যা করে
আর মৃত্যুরও ব্যাখ্যা হয়
ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে বেলা পড়ে আসে
হলুদ পাখিরা উড়ে যায় কোন্ অন্ধকার বনে!

                🐦
আমার মৃতদেহ
_____________________________

ঝাঁক ঝাঁক পিঁপড়েরা আমার রক্তমাংস খুঁটে নিয়ে যাচ্ছে
আমি বাধা দিচ্ছি না
আমার তর্জনী আর কলম ধরতে পারছে না
আমার বোধের শব্দ ও অক্ষরগুলি ঝরে পড়ছে
কে লিখবে তাদের?

সময়ের কবরের নিচে শুয়ে আছি
কে খুঁড়বে সময়?

উপর দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে
বিস্ফোরক বোঝাই গাড়িও
ন্যাংটো মানুষের দল
আর রাতের সঙ্গম

আমার পাথরচোখ দেখতে দেখতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে

  🐦 
নিজের ছায়ায় 

 এখনো চলার পথ কত বাকি আছে?
 নিবেদন ফুরিয়ে গেছে
 এখন একাকী নিজের ছায়ায় নিজে
স্মৃতির আমলকি গাছের বাতাসে 
জিরিয়ে নিতে থাকি

 দূরের শাদা ডানা হাঁস উড়ে গেলে
 আমার 'দেখা' ক্রিয়াটিও শূন্যে দোল খায়
 কোথাও ঘর নেই যদিও থাকার জায়গা আছে
 যদিও চায়ের কাপে এখনো উষ্ণতা
 এখনো গ্রামবাংলায় পৌষ মাস আসে
 পিতৃ-পুরুষের লন্ঠনটি এখনো দেওয়ালে ঝোলে
 কেউ আর জ্বালায় না ওকে 
 মৃত বাউলের মতো সে শুধু  অতীত জ্বরে জ্বলে

 ভাঙা আয়নার কাছে  দাঁড়াই
 ইচ্ছে করে না নিজেকে দেখি
 আয়ুরেখা দিগন্তের সীমানায় কাঁপে
 ইচ্ছে করে না আর কুয়াশাকে বলি সরে যেতে!

          🐦     

 যদি ছুঁতে পারো

 আমি দৈর্ঘে নেই ,প্রস্থে নেই, শূন্য অবতলে কোথাও নেই
 অথচ আমার ভাষা ব্যাপ্ত চরাচরে শব্দ ও স্বপ্নের তালিকায়
 বাঁচা ও মরার নির্বাহী ক্রিয়ায় ছলকে ওঠে গন্ধে ধূপে

 তুমি এসে ছুঁয়ে যাও যদি ছুঁতে পারো
 যদি  এ নিঃসঙ্গতার বেড়া থেকে আমাকে বের করে দাও!
 ইহজাগতিক পথে  জয়ঘোষণার কাছে কারা কারা গেল ?

 আমি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাব ওই তো জবা গাছ,
 কত জবা ফুল ফুটে আছে সবাই ডাকছে আমাকে 
 তুমি ছোঁও , একটিবার অন্তত ছুঁয়ে যাও!


তৈমুর খান 

ধনীশ এম কে পিDhaneesh Mkp







ভজন দত্ত

জানো দেবাশিস,
মাঠের সাইডলাইনে বসে আছি। ঘরকে যদি প্যাভিলিয়ন ভাবো,তবে ধরে নাও প্যাভিলিয়নেই বসে আছি প্যাড পরে। টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে খেলা। এত ফার্স্ট বোলিং হচ্ছে যে,পৃথিবীর বাঘা বাঘা সব  ব্যাটসম্যানরা ঘায়েল। ধরো,এক একটা ব্যাটসম্যানের নাম এক-একটা দেশের নামে। তারা যখন সব অসহায়, একের পর এক প্রতিদিন উইকেটে পতনের শব্দে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে ,স্কোর দেখছি না নির্বাচনী ফলাফল দেখছি, সব যখন ঘেঁটে ট, তখন মনের অবস্থা বুঝতেই পারছো! যেকোনো সময়,কারোর না কারো ডাক পড়তেই পারে। আমি প্যাড পরেই আছি। মাঝে মাঝে চার দেওয়ালের ভেতর রিচার্ডসের মতো ব্যাট ঘোরাচ্ছি, ওয়ার্ম আপ করছি, এক্ষুনি নামতে হলো বলে!নিজেকে তৈরি রাখছি। জানি আউটের কপাল! তায় আবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই আউট হতে হবে যে খেলায়, সেই খেলায় নামার আগে তাই পিছনে তাকিয়ে দেখি বারবার। ওদের ভবিষ্যৎ ভেবে আকুল হই,বাজারে ভিড় বাড়িয়ে ইমিউনাউজেশন বাড়ানোর জন্য  প্রাণিজ প্রোটিন নাহোক, সাধারণ ডালভাত শাকসবজির আয়োজন করার চিন্তা করি। মোবাইলে খোঁজ নেয় দূরের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা, 'মাঠে নামিনি এখনো' বলি ওদের। বলি,'ভালো আছি, ঘরে আছি'।
তারপর,মোবাইলের নেট অন করলেই হড়হড় করে জল ঢুকে। এখানে ওখানে উইকেট পতনের খবর,খেলার নিয়ম না মেনে বিশৃঙ্খলার খবর আসে।আইনের রক্ষকদের সভয়ে পলায়নের দৃশ্য দেখি, আর আসে এতএত লাইভ ও ভিডিও। বিশ্বাস করো,মানুষের যে এতএত প্রতিভা লুকিয়ে ছিলো জানতাম না এই লকডাউনে না পড়লে!কজনই বা দেখে সেসব!আমার সেসবের কিছুই দেখা হয় না,কত কত লেখা দেখি তার ভেতরে ঢোকা হয় না, আমি লাইক দিয়ে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব,নিজের বেঁচে থাকা প্রবলভাবে জাহির করি।
ঘরের বইগুলো এর আগে কোনোদিন সময় পায়নি,আমাকে এভাবে দেখতে!ওর সব জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,ওদের গায়ে জমে আছে এত এত ধুলো না জীবাণু কেজানে!
খুব ইচ্ছে করে, ওদের স্যানিটাইজ না করি,একটু পরিষ্কার করে গুছিয়ে সুন্দরম করে তুলি।সত্যি বলছি,করা হয়না।একেকটা বই খুলে পাতার পর পাতা উল্টে যাই শুধু  পড়া হয়না। সেই কবে থেকে প্যাড পরে বসে আছি, কখন যে ডাক আসে কেজানে! 
জানো,দেবাশিস খুব পড়তে ইচ্ছে করে কিন্তু বেহায়া মন কিছুতেই সায় দেয় না। সে এসে আমার দুচোখের পাতায় দুদণ্ড বসে না। আমার  পড়া হয় না। এই প্যাড,হেলমেট,গ্লাভস, ব্যাট যদি একবার  নামিয়ে রাখতে পারতাম তবে হয়তো....


তানিয়া চক্রবর্তী

ভগবানের হারেম 


মাংসের দোকানে তাকিয়ে থাকা
জুলজুল চোখের কুকুর
তুমি কী জানো তোমার স্বজাতির 
উল্কি আঁকা হয় দামি চামড়ায়?
শীর্ণ বাবার ছেঁড়া গামছা ধরা শিশু
তুমি কী কখনো জানবে
তোমার ছবি দেখে সুখি চোখে
আমোদের জল আসে?
জেনেই বা তোমার কী লাভ!
একদিনের জ্যাকপট তোমাকে 
খুনি হতে শেখাবে হয়ত ;
তুমি বিসর্জনের বাজনাতে 
উন্মাদের মতো নাচবে
কপালে সিঁদুর দিয়ে সিটি মারবে
কারণ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটা
            সাধ্যাতীত স্বপ্নাতীত---
মায়ের গায়ে ঐ লোকটার মারের আওয়াজ
তুমি ড্রাম পিটিয়ে মিলিয়ে দিতে চাইবে,
এরপর এক অসহ্য বর্ষায় 
কুকুর ও তুমি লাশ হয়ে পড়ে থাকবে ভাগাড়ে
পশু হয়ে কেন তুমি জন্মেছিলে বস্তির ছেলে?
হয়ত এরকম নাচ দেখে ভগবানবাবু ঘুমোতে যান
তোমরা তার হারেমের নর্তকী সব 
দুঃস্বপ্নে হাত বুলিয়ে নেচেছ তফাতে!
এ জন্ম কোথায় হবে, জানবে না কেউ !
তবু এটুকুই সত্যি জীবনের মায়া
তবু এটুকুই সত্যি শহরের আলো
যেখানে আলো কালোর সঙ্গে মিশে
বাড়িয়ে দিচ্ছে মজা---
বস্তিবাসী ভাগাড়মুখী ছেলে, তুমি মরবে বলেই
রাতের শামিয়ানা ডিস্কো হয়ে জ্বলে ,
নিয়ন আলোর ফুটো হয়ে বেরিয়ে আসে
            লালচে রং এর মদ,
আর ফিনকি দিয়ে বৃষ্টি নামে রাস্তায় ---

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


ফ্রাঙ্কেনস্টাইন !

“আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক
আমি চাইনা হতে নব বঙ্গে নবযুগের চালক”
আমি যে বিষয়টি নিয়ে শব্দ সাজাবো তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মান্তর’ কবিতার এই প্রথম দুটি পঙক্তি সুপ্রযুক্ত এমন কথা না বললেও, কোথাওনা কোথাও এই পঙক্তি দুটির ভাবগত প্রাসঙ্গিকতা খুজতে চেষ্টা করেছি । মারণ বিজ্ঞানের ধ্বংশকামী অনুশীলন ও আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বংসমুখী শক্তির বিরুদ্ধে মানব মনের অনন্ত মুক্তির সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ধ্বংসকামী শক্তি কখনোই কাম্য ছিলনা তাঁর কাছে ।
একথা সত্য, জীব ও জড় জগতের তাবৎ সৃষ্টিই তার নিজের মধ্যে নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করে চলে। কিন্তু তা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সূত্র মেনে । সেই সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের সৃষ্টিও ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর হতে পারে মানব ইতিহাসে তার অজস্র নজির রয়েছে । বিজ্ঞানী ওপেনহিমার কি জানতেননা তাঁর আবিষ্কৃত এটম বোমা হিরোশিমা, নাগাসাকি শহর দুটিকে ধ্বংস করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করবে, মানব সমাজের কি বিপর্যয় ঘটাবে ! তবুও অপেনহিমার ভগবৎ গীতার উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে সদম্ভে বলেছিলান “মনে হচ্ছে আমিই মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা” ।
আধুনিক বিজ্ঞান নাকি মানুষের প্রতিরূপ ‘ক্লোন’ সৃষ্টি করতে সক্ষম । ১৯৬০এর দশক থেকে এরকম প্রয়াস শুরু হয়েছিল । নোবেল জয়ী জসুয়া লিডারবার্গ প্রথম ১৯৬৬তে তাঁর একটি লেখায় ‘ক্লোন’ সৃষ্টির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন । জন্ম – মৃত্যুর চিরন্তন সূত্রকে অস্বীকার করে মানুষের প্রতিরূপ সৃষ্টি হলে  কি ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক চলে । অবশেষে ২০০১এ রাষ্ট্রসঙ্ঘ সব ধরণের মানব প্রতিরূপ বা ‘হিউম্যান ক্লোনিং’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানায় তার সদস্য দেশগুলির কাছে । অস্ট্রেলিয়া , কানাডা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি , বৃটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানান প্রদেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে । আর মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতো ‘খোদার ওপর খোদকারি’র এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে ফতোয়াই জারি করেছিল । জন্ম-মৃত্যুর জাগতিক সূত্রকে জীবন সৃষ্টির প্রয়াস কি বিপর্যয়কর হতে পারে এমনকি তার স্রষ্টার কাছেও তা আজ থেকে দুশ’ বছর আগেই জেনেছিলাম মেরি শেলীর উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ । হ্যাঁ বাংলা উচ্চারণ এটাই হওয়া উচিত (Frankenstein) ।
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ -- এই নামটা প্রায় দুশ’ বছর যাবত প্রায় প্রবাদের মত এক ভয়ংকর কল্প-বস্তু হয়ে আছে যে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনি । আমরা প্রবাদের মত বলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ সৃষ্টি করেছ, সে তোমাকেও রেয়াত করবেনা’ । আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে ভয়াল ভয়ংকর ধ্বংসকামী এক বিকট মূর্তি । না , সেই বিকট মূর্তি কিন্তু ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নয় , তার সৃষ্টিকর্তার নাম ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন । সেই নামেই মেরি শেলী তাঁর এই সাড়া জাগানো উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন অর মডার্ন প্রমিথিউস’ । বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে মানুষের প্রতিরূপ - সেই ভয়াল সৃষ্টির জনক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন কে কেন লেখিকা গ্রীক পুরানের বীর নায়ক প্রমিথিউস এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন জানিনা । গ্রীক পুরানের কাহিনি , প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে । মানব অস্তিত্বের অগ্রদূত হিসাবেই প্রমিথিউস পূজ্য । দেবলোক থেকে আগুন চুরি করার জন্য প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েছিলেন সম্রাট জিউ,একটা প্রস্তরখন্ডের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন তার দেহাংশ, শকুনের ভক্ষ্য রূপে । গ্রীকবীর হারকিউলিস অমরত্ব অর্জন করা প্রমিথিউসকে মুক্ত করেছিলেন । লেখিকা মেরি শেলি তাঁর উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিনকে আধুনিক প্রমিথিউস মনে করেছিলেন, হয়তোবা রীতিবিরুদ্ধ বা নিষিদ্ধ বিজ্ঞান সাধনার জন্য, যেমন নরলোকে নিষিদ্ধ আগুন প্রমিথিউস চুরি করেছিলেন দেবলোক থেকে যার দন্ডও তিনি ভোগ করেছিলেন । প্রমিথিউস অমরত্ব অর্জন করেছিলেন আর মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ নামটি প্রায় দুশ বছর ধরে অমর হয়ে আছে প্রবাদের মত, হয়তো থাকবেও আরো অনেকদিন ।
মেরি শেলি তার এই প্রবাদ প্রতীম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে - যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর , শেষ করেছিলেন ২১ বছর বয়সে, অর্থাৎ তিনবছর লেগেছিল উপন্যাসটি লিখতে । লর্ড বায়রন, পি বি শেলী, জন কীটস’এর সমসাময়িক মেরি শেলী ইংরাজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের লেখিকা । আমাদের দেশে তখন গদ্য সাহিত্যের জন্মই হয়নি । সবেমাত্র শ্রীরামপুর মিশনারীরা রামরামবসু প্রমুখদের দিয়ে কিছু পন্ডিতি বাংলা লেখা শুরু করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ কৌমুদি’ ইত্যাদি সংবাদপত্র । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ছদ্মনামে লন্ডন থেকে । ১৮২৩এ ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ২য় সংস্করণ থেকে লেখিকা মেরি শেলীর নাম জানা যায় । উপন্যাসটিকে বলা হয় একাধারে গথিক উপন্যাস এবং বিজ্ঞান কাহিনি বা সায়ান্স ফিকশন’, আবার রোমাঞ্চ কাহিনি বা ‘হরর স্টোরি’ ও বটে । বস্তুত মেরি শেলীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ বিশ্বের প্রথম সার্থক সায়ান্স ফিকশন রূপেই খ্যাত । এরপরে যুগে যুগে অনেক রোমাঞ্চ কাহিনি লেখা হয়েছে  সেগুলির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে- কিন্তু কোনটাই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর মত প্রবাদ-প্রতীম হয়ে ওঠেনি ।
উপন্যাসটি আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা । উত্তর মেরু অভিযানকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ওয়ালটন তার বোন মার্গারেটকে চিঠিতে তার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, এভাবেই শুরু হয়েছে কাহিনি । ক্যাপ্টেন ওয়ালটন ছিলেন এক ব্যর্থ লেখক , বাসনা ছিল উত্তর মেরু অভিযানের মধ্যদিয়ে জানবেন বিজ্ঞানের রহস্য আর তা দিয়ে তিনিও বিখ্যাত হয়ে যাবেন ।
ওয়ালটনের জাহাজের কর্মীরা এক অতিকায় মানবকে একটি কুকুরকে নির্দয় ভাবে হত্যা করতে দেখেন , কয়েক ঘন্টা পরে তারা এক বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায় লোককে উদ্ধার করে , তিনিই বিজ্ঞানী ভিকটর ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ঐ অতিমানবের সৃষ্টিকর্তা । সুস্থ হবার পর ভিক্টর তার কাহিনী বলতে থাকেন । বলেন কিভাবে বিজ্ঞানের উচ্চাশা ও রীতিবিরুদ্ধ চর্চা যার ফলশ্রুতি এক অতিমানবের সৃষ্টি এবং সে তার জীবনে কি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল, সেই রোমাঞ্চকর কথা ।
প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের প্রথাগত বিজ্ঞানসম্মত সূত্রগুলি বোধয় ভিক্টরকে ক্লান্ত করেছিল । ভিক্টর আয়ত্ত করেছিলেন মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করার বিদ্যা । ল্যাবরেটরিতে মৃত মানুষের ও পশুর দেহাবশেষ দিয়ে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । ভিক্টর চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি হবে সুন্দর , কিন্তু হ’ল ৮ফুট দৈর্ঘের , হলুদবর্ণ চোখের এক ভয়াল সৃষ্টি । ভিক্টর তার নিজের সৃষ্টিকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন । সৃষ্টি করলেন বটে কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কায়দা তার আয়ত্তে ছিলনা । সে সৃষ্টির পরমুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আতঙ্কিত ভিক্টরকে প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে চলে , ভিক্টর গৃহত্যাগ করেন । মাস চারেক পরে ফিসে এসে দেখেন তার ছোটভাই উইলিয়াম খুণ হয়েছেন। উইলিয়ামের গলার লকেটটি পাওয়া যায় তার দিদিমা জাষ্টিনের পকেটে , দিদিমার ফাঁসি হয় । ভিক্টর ঘটনাস্থলে তার সৃষ্ট অতমানবটিকে দেখতে পান এবং নিশ্চিত হন যে সেইই প্রতিশোধ স্পৃহায় এই হত্যা ঘটিয়েছে, উইলিয়ামের লকেটটি তার দিদিমার পকেটে চালান করে তাঁরও মৃত্যুর কারণ হয়েছে । ভিকটর বিবাহ করেন তাঁর প্রেমিক এলিজাবেথকে , সেইদিনই এলিজাবের খুন হয়ে যান, ভিকটরের সেই ভয়াল সৃষ্টির হাতে । নির্মম প্রতিশোধ স্পৃহায় ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি একে একে হত্যা করে তার সৃষ্টি কর্তার ভাই , উইলিয়াম, বন্ধু ক্লেভারেল, ও প্রেমিকা এলিজাবেথকে ।
ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে অবশেষে দাবী করে ভিকটর যেন তার মতই তার এক প্রেমিকা সঙ্গি সৃষ্টি করে দেন , কেননা তারও জৈবিক সুখের অধিকার আছে । তাহলে সে তার সঙ্গিকে নিয়ে জনমানব হীন কোন স্থানে চলে যাবে । পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভিক্টর সম্মত হয় । কাজটা করার জন্য চলে যায় ইংল্যান্ডে । সেখানেও হাজির হয় দানবটি , সে ভিক্টরের প্রতিমুহুর্তের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলে । ভিক্টর সেই দানবের প্রেমিকা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন । কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভিক্টর উপলব্ধি করেন তাঁর এই দ্বিতীয় সৃষ্টি আরো কি ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্ট করতে পারে । যদি তারা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হন তবে হয়তোবা এক ভয়াল ভয়ঙ্কর অতিমানবের জাতি সৃষ্টি হয়ে যাবে যা সমগ্র মানব সভ্যতারই সংকট ডেকে আনবে । ভিক্টর তার অসমাপ্ত সৃষ্টিটি ধ্বংস করে দেন । ভিক্টর পালিয়ে যান । কিন্তু যাবেন কোথায় ? তারই সৃষ্ট দানব প্রতি মুহুর্তে তার পিছু পিছু থাকছে । অবশেষে ক্যাপ্টেন ওয়ালটন আন্টারটিকায় বিধ্বস্ত , মৃতপ্রায়  ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনকে উদ্ধার করেন । উপন্যাসের শেষটা বড় করুণ – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের মৃত্যু হয়েছে । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন ভিকটরের সৃষ্ট সেই দানব তার সৃষ্টিকর্তার মৃত দেহের সামনে শোকার্ত অনুতপ্ত । নিজেই নিজেকে ধ্বংশ করতে উদ্যত, কারণ সে বুঝেছিল তার সৃষ্টিকর্তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অস্তিত্বও অর্থহীন । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন আন্টার্টিকার বরফের স্তুপের মধ্যে বিলিন হয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে ।
একটি সমাজ ছাড়া সৃষ্টি - দুশ’ বছর ধরে তাবৎ বিশ্বের মানুষের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে । চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ের মধ্যদিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে । রোমাঞ্চকর কাহিনি বা হরর ফিকশন বিশ্বসাহিত্যে কম নেই । ব্রাম স্ট্রোকারের ‘ড্রাকুলা’ , কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ বাস্কার ভিল’ , ভ্যাম্পায়ার’ হিচককের ‘সাইকো’ এই রকম অজস্র রোমহর্ষক চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি, কিন্তু তার কোনটাই ফ্রাঙ্কেনস্টিনের মত এমন স্থায়ী প্রভাব ফেলেনি । মজার কথা কাহিনির নাট্যায়ন বা চলচ্চিত্রায়ন দেখে যতটা আতঙ্কিত হই উপন্যাসটি পড়লে ততটা হইনা । কারণ চলচ্চিত্রে নানা ডালপালা যুক্ত হয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে আতঙ্কের দৃশ্যায়ন করা হয় । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রবাদ প্রতীম হয়ে যাওয়ার সেটাই মুখ্য কারণ ।
আমাদের জানা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ কি আদৌ ‘ধ্বংশকামী’ অতিমানবীয় সৃষ্টি ছিল ? উত্তর হ্যাঁ এবং নাও বটে । সে তো তার চারপাশের সমাজ সংসারকে ধ্বংশ করতে চায়নি । সেও এই সমাজেই বাস করতে চেয়েছিল । এমনকি সে বলেছিল তার সৃষ্টিকর্তাকে তারই মত এক সঙ্গিকে সৃষ্টি করতে যাকে নিয়ে সে মানব বহির্ভূত কোন স্থানে চলে যাবে । একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তার ছিল, তা ছিল তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি – তাকে সকলে ভয় পাবে তার অতিমানবীয় ভয়াল ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে – এমন সমাজ ছাড়া সৃষ্টির জন্য । তার জিজ্ঞাসা ছিল ভিক্টর যদি তাকে সৃষ্টিই করলেন তাহলে সে জাগতিক সুখ থেকে বঞ্চিত হল কেন ?
কাহিনি থেকে জেনে যাই, ভয়াল অতিমানবটির স্রষ্টা ভিক্টর ছেলেবেলা থেকেই রীতি বিরুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় আকৃষ্ট ছিল, অশ্রদ্ধা ছিল প্রচলিত মূল্যবোধগুলির প্রতি । তার সমাজ ছাড়া সৃষ্টিটিরও তাই সমাজের প্রতি, তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একটা প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিয়েছিল তার সৃষ্টির পরমুহুর্ত থেকেই । তবুও সে তার সৃষ্টিকর্তার মৃতদেহের সামনে এসে শোকানুতপ্ত হয়েছিল এবং নিজেকেই ধ্বংশ করেছিল ।  এই মনস্তাত্বিক প্রশ্নে কোন কোন সমালোচক উপন্যাসটির লেখিকা মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার  প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন  । লেখিকা মেরি শেলী তার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাঁর মাকে হারান, তার চার বছর বয়সে পিতা গডউইন পুণর্বিবাহ করেন । সতেরো বছর বয়সে মেরি তার পিতৃবন্ধু বিবাহিত পার্শি শেলীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন । পরের দুবছর তাদের জীবনে নানান বিপর্যয় , ঋণগ্রস্ততা, শিশু সন্তানের মৃত্যু ইত্যাদির পর পার্শিকে বিবাহ করেন , তা্র ব্যক্তিজীবনে কিছুটা স্থিরতা আসে । লেখা শুরু করেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’,  কিন্তু ছদ্মনামে । ১৯২৩এ স্বনামে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগে ১৮২২এ মেরির স্বামী পার্শি শেলির মৃত্যু হয় জলে ডুবে ।
এই অভূতপূর্ব সৃষ্টিতে মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার ছায়াপাত ঘটেছে কিনা তা আমার আলোচ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি, দুশ’বছর আগে, কি অসামান্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে মেরি শেলী তার প্রবাদপ্রতীম উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বকে বিজ্ঞানের অপব্যবহার সম্পর্কে সাবধান বার্তা দিয়েছিলেন । এই অনুষঙ্গেই এটম বোমার আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী ওপেন হিমারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম, কোথাও যেন ধ্বংশকামী ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ আর ওপেন হিমারের দম্ভোক্তি একাকার হয়ে যায় ।  ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ নিশ্চিত ভাবেই দুশ’ বছর আগের এক সাবধান বার্তা, যে প্রাকৃতিক ও জীবজতের দ্বান্দ্বিক সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের যে অনুশীলন তা অপবিজ্ঞান এবং সেই অপবিজ্ঞান সৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হীন কোন কিছুই মানব সভ্যতার পক্ষে শুভ হতে পারেনা, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনা । তাহলে কে সেই ভয়াল দানব ? আমাদের জানা মেরি শেলীর কল্প-চরিত্র অতিমানবটি  নাকি তার উপন্যাসের নায়ক ব্যর্থ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন ?

সঞ্জীব কুমার


आरज़ू
>>>>>

খিলখিলিয়ে উঠলো মেয়েটা - "শোনো,  বয়স হয়েছে তোমার, পাগলামী কোর না...."

" কি? বয়স নিয়ে খোঁটা? অপমান! অপমান! ধরণী দ্বিধা হও....না থাক দ্বিধা হয়ে কাজ নেই....তবে এই অপমানের জবাব আমি দেবোই এবং সেটা এক্ষুণি।" - বলেই ছেলেটা থুরী লোকটা থুরী বুড়োটা জ্যাকেট খুলে ফেললো - তারপর জামা - তারপর গেঞ্জি -  অতঃপর খালি গা। 

চমৎকার দেখাচ্ছে লোকটাকে! একমাথা কাঁচাপাকা চুল - পাঁচদিনের বেড়ে ওঠা সুগার অ্যান্ড পেপার দাড়ি - গোঁফ, গায়ে সামান্য মেদ, জিন্স থেকে ঝুলতে থাকা রোদচশমা, পায়ে ডিঙ্গো, মুখে সিগারেট। শুধু গলায় একটা গীটার ঝুলিয়ে দিলেই....!

" অ্যাই কি করছো? পাগল হলে নাকি? এই ঠান্ডায়......." 

" ঠান্ডা? কোথায় ঠান্ডা? তুমি টের পাচ্ছো না আমার রক্তের স্রোত ছুঁয়ে বসে আছো তুমি?আমার দৃষ্টির উষ্ণতার আঁচ পাচ্ছো না তুমি? বলো - টের পাচ্ছো না, আমার উজার হয়ে যাওয়া জীবনে তোমার উপস্হিতির উষ্ণতা? টের পাচ্ছো না এই রাত ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে  উঠছে? পাচ্ছো না - না? কি করে পাবে? তুমি যে আবার ভয় পেয়েছো - নিজেকে হারানোর ভয় - আমায় হারানোর ভয়।  
 
শোনো!  তুমি বরং আরো একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াও! কিছুক্ষণ আগে বলছিলে না - আমার বয়স হয়েছে - আমি বুড়ো হয়েছি - তাহলে যাওয়ার আগে দেখিয়েই যাই বুড়ো হাড়ের ভেল্কিটা! তফাৎ যাও!"

লোকটার চোখমুখ কেমন যেন বদলে গেছে! গলার স্বরে কিছুক্ষণ আগের ঠাট্টা আর নেই - লোকটা যেন আদেশ করতে শুরু করেছে এবার। এ কি পাগলামী? এমনিতেই শীতের পাহাড়ী পথ শুনশান - একটা গাড়িটাড়ীরও দেখা নেই - তারমধ্যে ঠাট্টা তামাশা করতে করতে এই বিপত্তি। মেয়েটা ভয়ে পেয়ে এবার সত্যিই একটু সরে এলো - তবে পাহাড়ের দিকে নয় - খাদের দিকটাতে!

লোকটা চেঁচিয়ে আর একবার আদেশ দিলো " ব্যাস! থামো! আর এক পা'ও পিছিও না! ঐ পাথরটার ওপর বোসো! দেখতে পাচ্ছো আমায়?" 

মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ - চতুর্দশীর আলো - চারপাশে বরফে বরফে সাদা হয়ে যাওয়া পাহাড় রাজি - কেন দেখা যাবে না? বেশ দেখা যাচ্ছে ঐ মূর্তিমান বিভীষিকা!   

পাথরটার ওপর বসলো মেয়েটা! পায়ের ওপর পা তুলে! উদ্ধত সেই বসার ভঙ্গী যেন ব'লে দিচ্ছিল " বেশ বসলাম! এবার দেখাও হে পুরুষ - তুমি কেমন রোডোডেনড্রন হয়ে উঠতে পারো, দেখি!" 

" অলরাইট্! রেডী?" লোকটা হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো - মাথার নীচে গুঁজে দিল দুহাত - পায়ের ওপর পা - ডিঙ্গোতে তাল ঠুকতে ঠুকতে গলা ছাড়লো -
    
ये रातें.... ये मौसम.....नदी का किनारा
ये चंचल हवा......
कहा दो दिलों ने की मिल कर
कभी हम ना होंगे जुदा.......
 
গাইতে গাইতে উল্টে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে  এগোচ্ছে লোকটা - নিষ্পলক চোখে উঁকি দিচ্ছে এক বন্য দৃষ্টি..... নিশ্বাস গভীর.... মেয়েটা আবার হেসে উঠলো .... ক্রমে হাসি ফিকে হয়ে আসছে....এগিয়ে আসছে শরীরটা.....

सितारों की मेहफिल ने कर के इशारा
कहा अब तो सारा जहाँ है तुम्हारा.........

ঠিক এমন সময়ে ওপরের রাস্তা থেকে কর্কশ ব্রেক কষার শব্দ! বেশ কিছুটা পিছলে গিয়ে গাড়ীটা কোনরকমে থামাতে পেরেছে চালক! নেশা ছুটে গেছে - ঘুম উড়ে গেছে তার - হেডলাইটের আলোয় সে দেখছে পাহাড় থেকে ধীরে ধীরে শরীরের অর্ধেকটা নেমে আসছে - আর রাস্তাটাকে মাঝখান থেকে চিরে বাকি অর্ধেক শরীর নিয়ে ময়ালটা প্রায় পৌঁছে গেছে পাথরে বসে থাকা মেয়েটার পায়ের কাছে......

কাটা জিভটা বেরিয়ে আসছে ক্ষণেক্ষণে আর মেয়েটার পা চেটে জিভটা ঢুকে যাচ্ছে মুখের ভেতর - হেডলাইটের আলো পাত্তা না দিয়ে এবার ময়ালটা ক্রমশ উঠে দাঁড়াচ্ছে - মেয়েটা তখনো হাসছে - অলৌকিক অর্কেস্ট্রায় গান বাজছে পাহাড় জুড়ে - সাপটা তার প্রকান্ড শরীর নিয়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়েছে - ওর মুখ মেয়েটার মুখের সামনে - একদম সামনে - সুরের তরঙ্গে একটু একটু একটু দুলছে প্রকান্ড ময়াল- নিষ্পলক দৃষ্টিতে - মেয়েটার চোখে চোখ রেখে।

তবে.......

প্রতিবারের মতো এবারেও মেয়েটা সাপটার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সুযোগ পাবে না - ঠিক তার আগেই প্রচন্ড শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসবে - গুলিবিদ্ধ শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটা প্রচন্ড আক্রোশে আর একবার তাকাবে মানুষগুলোর দিকে - তারপর শেষবারের মতো প্রকান্ড মৃত শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডানা মেলে উড়ে যাবে - তবে এবার সে উড়ে যাবে সেই পৃথিবীর দিকে যেখানে কোনও মানুষ থাকে না - যেখানে আলো নেভে না কোনদিন। 
___________ 

যুগান্তর মিত্র


কাটা ঘুড়ি
যুগান্তর মিত্র
একটা ঘুড়ি এসে লাট খেয়ে পড়ল ছাদে। আমার ছেলে বুচাই ঘুড়িটা দৌড়ে তুলে নিল হাতে। এক টুকরো সুতো ঝুলছে ঘুড়ির সঙ্গে। বুচাই বলল, বাবা, আমাদের ছাদে ঘুড়ি পড়েছে। এটা এখন আমাদের ঘুড়ি।
আমি নিজেও দেখেছি ঘুড়িটাকে নেমে আসতে। তবু ও ভাবছে ঘুড়িটার লাট খেয়ে পড়া ওর আবিষ্কার। আমি হাসিমুখেই ওর আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিলাম।
হুহ্‌, আমাদের ছাদ! হোটেলের ছাদকে আমাদের ছাদ বলিস না তো! মিলি হিসহিস করে উঠল। কথাটা ঠিকই বলেছে। এটা আমাদের ছাদ নয়। হোটেলেরই ছাদ। তবু ছোট্ট ছেলেটার কথার পৃষ্ঠে মিলির ছুঁড়ে-দেওয়া কথায় আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমরা বেড়াতে এসেছি দিঘায়। নিউ দিঘায় ‘সমুদ্রনীড়’ নামের একটা মাঝারিয়ানার হোটেলে এসে উঠেছি। আগেই বুক করা ছিল। সকালে এসে সমুদ্রের ধারে চলে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ কাটিয়ে ফিরেছি দুপুরে। হোটেলের নীচতলায় রেস্টুরেন্ট। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে এসে একটু গড়িয়ে নিলাম। দুপুরে ঘুমোনো মিলির অভ্যেস। বুচাইকেও ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও এপাশ-ওপাশ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সবার আগে মিলির ঘুম ভেঙেছে। আর আমাকে ডেকে তুলে দিয়েছে।
ইস দেখো, আজকের বিকেলটাই মাটি হয়ে গেল। আকাশ কেমন কালো হয়ে গেছে!
সে তো হবেই। বর্ষার সময় এসেছি। এইসময় সমুদ্রের রূপ অসাধারণ হয়। চলো চলো, বেরিয়ে পড়ি।
না না। বুচাইয়ের ঠান্ডা লেগে যাবে।
রেন কোট আছে তো। চলো। দেখবে এইসময় সমুদ্র দেখতে দারুণ লাগে!
যেতে হলে তুমি যাও। আমি আর বুচাই যাব না। ওর ঠান্ডা লেগে গেলে তোমার আর কি? জ্বরজারি হলে সারারাত জ্বালাবে। তুমি তো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোবে।
বুচাইয়ের জ্বরটর হলে আমি ঘুমোই ওভাবে, কথাটা ঠিক নয়। তবে মিলি একটুও ঘুমোয় না, সারারাত জেগে থাকে। আমার নামে যা বলল মিলি, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। বেড়াতে এসে এই নিয়ে কিছু বললেই কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। বেড়ানোটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই চুপ করে গেলাম। বেরোলামও না আর। অথচ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মেঘ উধাও। আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। মিলি বলল, বেরোনোর মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। এখন না, সন্ধের পরেই বেরোব। একবারে ডিনার সেরে ফিরব। এসব ব্যাপারে মিলির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ওর ইচ্ছেতেই ছাদে উঠে এসেছি আমরা।
ছাদ থেকে দূরের সমুদ্র দেখছিলাম। সমুদ্রজলের মুহুর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ কানে আসছে। হু হু করে সামুদ্রিক হাওয়া এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে ছাদ। কিছুক্ষণ পরেই একটা ঘুড়ি লাট খেয়ে ছাদে এসে পড়ল। ওটা যখন ভাসতে ভাসতে আসছে, তখনই আমার চোখে পড়েছিল। দূরের ঘোলাটে সমুদ্রের থেকে চোখ সরিয়ে আমি এদিক-ওদিক দেখছিলাম। কত হোটেল হয়ে গেছে। বিশ বছর আগে যখন প্রথম আসি, তখন এত হোটেল ছিল না নিউ দিঘায়। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। এরপরেও একবার এসেছিলাম। তখনও এত হোটেল বা গেস্ট হাউস ছিল না। এখন একেবারে জমজমাট। এসব দেখতে গিয়েই কাটা ঘুড়িটা চোখে পড়েছিল। এটা যে আমাদের কাছাকাছিই পড়বে ভাবিনি। হাওয়ায় ভেসে যাবে ভেবেছিলাম।
ও বাবা। হোটেলটা তো আমাদের। ছাদও আমাদের। তাই না বাবা?
আমি হেসে মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদেরই। বুচাইয়ের কথায় আমার বেশ মজা লাগছিল। ছয় বছরের ছেলে। এর মধ্যেই যুক্তি দিতে শিখে গেছে। আমাদের হোটেল হলে ছাদও আমাদের হওয়ারই কথা। তার মানে ঘুড়িটাও আমাদের, এমন একটা যুক্তি খুঁজে নিয়েছে ও। মিলি ততক্ষণে ছাদের অন্যপ্রান্তে চলে গেছে।
আমাদের ঘুড়ি যখন, তাহলে রেখে দে। বাড়ি নিয়ে যাবি। দূর থেকে মিলির কথা ভেসে এল। ঘুড়ির মতোই লাট খেতে খেতে কথাটা এসে পড়ল বুচাই আর আমার কাছে। বুচাই চুপ করে গেল। মিলির ঘুড়ি নিয়ে যাবার কথাটা যে রাগ করে বলা, ও বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষণ থমকে থাকার পরে ধীরে ধীরে বুচাই ঘুড়িটার কাছে গেল। ঝুঁকে পড়ে তুলে নিল হাতে। আমি চুপ করে দেখে যাচ্ছিলাম ছেলের কাণ্ড। একটু এগিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, তিন-চারটে ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে হোটেলের পেছনদিকের একচিলতে মাঠে। ওরা কাটা ঘুড়ি লক্ষ্য করে এসে বুঝে গেছে, এই ছাদের ওপরেই পড়েছে। ছেলেগুলো চিৎকার করে কিছু-একটা বলল ওকে। বুচাই ওদের দেখতে পেয়ে দু-হাতে ঘুড়িটা তুলে ধরল। অনেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর ভঙ্গিতে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল ঘুড়িটা। দেখলাম, পাক খেতে খেতে খানিকটা ওপরে উঠে নামতে শুরু দিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ধরে ফেললাম ছেলেকে। এখনই ঝুঁকে পড়ে দেখবে জানি। ঠিক তাই হল।
আমরা দুজনে দেখছিলাম ঘুড়ির গতিবিধি। কিছুটা নেমে সোঁ করে গোঁত্তা খেল ঘুড়িটা। যেন স্বাধীনভাবে উড়তে চাইছে। সুতোর টানে উড়বে না আর। কিন্তু ঘুড়ির স্বাধীনতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, যেমন আমাদের কারও স্বাধীনতাই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নীচের ইলেকট্রিক তারে আটকে গেল ঘুড়িটা।
জানো মাম্মাম, আমাদের ঘুড়িটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তারে আটকে গেল। উড়ন্ত পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দ বুচাইয়ের গলায়। তবে ‘আমাদের’ শব্দটা জুড়ে দিতে ভোলেনি দেখলাম।
আমাদের ঘুড়ি আবার কী? মিলি আবার বিরক্ত। আমাদের ঘুড়ি যখন, উড়িয়ে দিলি কেন? জাপটে ধরে রাখতে পারলি না বাপ-ছেলে মিলে? যত্তসব!
আহ্‌, ওভাবে বলছ কেন? আমরা বলি না আমাদের অফিস, আমাদের বাজার! সেইরকমই বলেছে ও। বুচাইয়ের মনখারাপে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করি আমি।
চুপ করো। আমাদের ছাদ! আমাদের ঘুড়ি! আমাদের আছেটা কি শুনি? না আছে বাড়ি, না আছে নিজের কিছু। মিলি আবার হিসহিস করে সাপের চেরা জিভে কথা ভাসাল।
মিলির রাগ যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। এইসময় ও দিঘায় আসতে চাইছিল না। বলেছিল, বর্ষায় বেড়াতে গিয়ে কী লাভ? হয়তো হোটেলেই কাটাতে হবে। অন্য সময় চলো। আমিই জোর করেছিলাম। আসলে এইসময় চারদিন ছুটি ম্যানেজ করা সহজ। এখন অফিসে কাজের চাপ কম। তাছাড়া এইসময় আসার আরও একটা কারণ হল, বিষ্ণুদা হোটেল বুক করেছিল আসবে বলে। কিন্তু শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেড়ানো ক্যানসেল করেছে। এদিকে হোটেলওলা টাকা ফেরত দেবে না। সাতদিনের আগে নাকি ক্যানসেল হয় না। তখনই আমাকে জিজ্ঞাসা করল যেতে রাজি কিনা। বসকে বলাতে ছুটিও মঞ্জুর হয়ে গেল। চলে এলাম এখানে। আমি শ্যামল দত্ত। হোটেলে আমার নাম বিপ্রদাস দত্ত। টাইটেল একই আছে, শুধু নামটাই বদলে গেছে। দত্তদার ছেলে আট বছরের। আমার ছেলের ছয়। ভাগ্যিস হোটেলের ম্যানেজার দত্তবাবু বলে সম্বোধন করছিলেন। বিপ্রদাসবাবু বলে ডাকলে আমি হয়তো ম্যানেজ করে নিতাম, কিন্তু বুচাই নিশ্চিতভাবেই গুবলেট করে দিত সব।
আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। সেলস ওরিয়েন্টেড অফিস। তবে আমার কাজ অবশ্য ইন-হাউস, সেলসে নয়। অনেক অফিসের মতোই আমাদের অফিসে ক্যান্টিন ছিল না। টিফিন টাইমে বাইরে গিয়ে খেতে হত। কিংবা রামাশ্রয়কে বললে খাবার এনে দিত। সল্ট লেকের চার নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে অফিস। এখানকার খাবারদাবারের দাম বড্ড বেশি। খাবার আনিয়ে নিলে অনেক খরচ পড়ে যায়। তাই নিজেই চলে যেতাম টিফিন খেতে। মুড়িমাখা বা একটু হেঁটে গিয়ে সস্তার হোটেলের কচুরি খেয়ে নিতাম। এইরকমই একদিন খেতে গিয়ে আলাপ হল মিলির সঙ্গে। আমাদের পাশের অফিসেই ও চাকরি করত। ওরটাও বেসরকারি। সেই আলাপ থেকে প্রেম। তারপর একসময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আমি তখন সেই অফিস ছেড়ে অন্য একটা অফিসে জয়েন করেছি। বেতন অনেকটাই বেশি। আমার এখনকার অফিসেও ক্যান্টিন নেই, তবে মিলি টিফিন করে দেয়, তাই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হয় না।
ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি আমি। মামাবাড়িতে মানুষ। মানুষ কতটা হয়েছি জানি না, তবে জীবনযন্ত্রণা বুঝেছি অনেক। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরই মামা-মামি নিজের পথ দেখতে বলে দিলেন। আমিও চাকরির চেষ্টা করতে করতে পেয়ে গেলাম একটা। তারপর থেকেই ভাড়াবাড়িতে থাকি। মিলির বাড়ি থেকে আমার বৃত্তান্ত শুনে রাজি হয়ে গিয়েছিল। শাশুড়ি নেই, ননদ নেই। এমন ঝাড়া হাত-পা সংসারে মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি করেননি ওঁরা। মিলির সামনের দাঁত উঁচু। পড়াশোনাও খুব বেশি করেনি। ঘরে বসে থাকলে মন অন্যদিকে চলে যেতে পারে, তাই একটা প্রাইভেট ফার্মে টেবিল ঝাড়ামোছা করা, চা করে দেওয়ার কাজে ঢুকে পড়েছিল। ফলে আমার মতো জামাই ওদের প্রত্যাশার থেকে একটু বেশিই।
বিয়ের দু-বছর পরেই আমি বলেছিলাম, এবার একটা ইস্যু নিয়ে নিই মিলি। কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। এত তাড়া কিসের? আরও বছর তিনেক চাকরি করলে আমি হয়তো একটা ভালো পজিশন পেতে পারি। মিলি জোর দিয়ে বলেছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তেমন সম্ভাবনা প্রায় নেইই। কেননা মিলি এগারো ক্লাশে উঠে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। মিনিমাম গ্রাজুয়েট না-হলে প্রোমোশন পাওয়ার চান্স নেই। মিলি তবু কিছুতেই মানতে চাইল না। একসময় ওকে রাজি করানো গেল। ছেলে হওয়ার পরে অবশ্য আর চাকরিতে জয়েন করল না ও। বলল, কাজের লোক রেখে ছেলে মানুষ করা যাবে না। তাছাড়া কাজের লোক রাখার খরচ যেমন আছে, ঝক্কিও কম নেই। ডানকুনির ভাড়াবাড়িতে কাজের লোকের ওপর ঐটুকু ছেলেকে রেখে অফিস করার ভরসাও ছিল না। আমিও চাইছিলাম মিলি আর চাকরি না-করুক। একভাবে ঠিক চলে যাবে আমাদের। কিন্তু ছেলেই যদি মানুষ না-হয়, তাহলে চাকরি, সংসার এসবের মানে কী? মিলিরই যুক্তি ছিল এসব।
সংসার আমাদের মোটামুটি চলে যায়। স্কুলেও ভর্তি হয়েছে ছেলে। ওর পিছনে খরচা কম নয়। সবমিলিয়ে বেড়ানোর সুযোগ আমাদের কপালে নেই সেভাবে। মিলি বলেছিল, বাচ্চাকাচ্চা নেওয়ার আগে একটু ঘুরেটুরে নিই। পরে আর হবে কিনা কে জানে! আমি তখন ওর কথা শুনিনি। পরে অনুভব করেছি, মিলি ঠিকই বুঝেছিল। আমাদের আর বেড়ানোই হল না! এইজন্যই মিলি বলেছিল, একটা বেড়ানোর সুযোগ পেলাম। তাও বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে কী হবে বলো? মেঘ দেখে তাই মিলির রাগ হওয়াটা স্বাভাবিকই।
সন্ধ্যায় সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে এলাম। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই বলে মিলির মেজাজ বেশ ফুরফুরে। ফুচকা খেলাম, মাছভাজা খেলাম, সমুদ্রের ধারে বসে থাকলাম। হাত ধরাধরি করে হাঁটলামও কিছুটা। বুচাইয়ের মুখে এমনিতেই খই ফোটে সারাক্ষণ। সমুদ্রের কালো জলে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়া দেখে ওর মুখেও ফেনার মতো কথা ভেসে উঠছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, সেই যে মেঘ এসে ভয় দেখিয়ে উড়ে গেল, আর আমাদের দেখা দেয়নি। আমি বহু আগে একবার বর্ষার সমুদ্র দেখেছিলাম। ভয়ংকর সুন্দর সেই রূপ। কালো মেঘের ছায়া পড়ে সমুদ্রের জলও কালো। উত্তাল সমুদ্রের কালচে জলের মধ্যে সাদা সাদা ফেনা। প্রবল জলের শব্দ। অসাধারণ সেই দৃশ্য। এতদিন আগে দেখা, তবু চোখ বুজলেই আমি সেই দৃশ্য দেখতে পাই। এবার আর সমুদ্রের সেই রূপ দেখার সুযোগ হল না। তবু আমার মনখারাপ হয়নি, কেননা আমার প্রত্যাশা মিটলে মিলি আর ছেলের মন ভেঙে যেত।
দুদিনের জন্য ঘর বুক করা ছিল। একবার শঙ্করপুর আর মন্দারমণি ছুঁয়ে এলাম অটোয় চেপে। পরদিন ফেরার পালা। বাসের সিট বুক করে নিয়েছি আগেই। একটায় বাস ছাড়বে। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে আসার পরে বুচাই ঘুমিয়ে পড়ল দ্রুত। আসলে সমুদ্রের ধার দিয়ে অনেকটা পথ আমরা হেঁটেছি। খুব আনন্দ করেছে বুচাই। এতেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমাদের রুম চারতলায়। মাথার ওপরে শুধু ছাদ। এই ছাদটা যেন আমাদেরই।
ছেলে ঘুমোচ্ছে। ও একবার ঘুমোলে আর ওঠে না। সকাল পর্যন্ত একটানা ঘুমোয়। মিলি বলল, চলো ছাদে ঘুরে আসি কিছুক্ষণ। কাল তো চলেই যাব।
সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার হাতে নিয়ে আমি মিলির সঙ্গে ছাদে চলে গেলাম। দূরে আলোর বিন্দু দেখতে পেলাম সমুদ্রের জলরাশির ওপর। মাছ ধরার ট্রলার। মিলি সেদিকে না-দেখে পেছন দিকে চলে গেল। আমাকে ডাকতে আমিও সেদিকে গেলাম। আঙুল তুলে দেখাল নীচের তারের দিকে।
ঐ দেখো ঘুড়িটা ঝুলছে।
দেখলাম কাটা ঘুড়ি হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে।
একদম আমাদের মতো, তাই না? আটকে গেলাম পুরোপুরি! মিলি দার্শনিকের মতো বলল।
যখন প্রেম করতাম, প্রায়ই অফিসের পরে বাবুঘাটে চলে যেতাম। কিংবা মিলেনিয়াম পার্কে। কখনও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। বিয়ের পরেও বার কয়েক গেছি। পরের দিকে আর যেতাম না। সারা সপ্তাহ অফিস করে ছুটির দিন বেরোতে ইচ্ছে করত না আর। বুচাই জন্মানোর পর বেরোনোর প্রশ্নই রইল না আর। একবার মাত্র ওকে নিয়ে আমরা চিড়িয়াখানায় যেতে পেরেছিলাম। ওর তখন বছর তিনেক বয়স।
আমরা চুপ করে দেখে যাচ্ছিলাম কাটা ঘুড়ির ওড়াওড়ি। মনে মনে দুজনেই কথা বলে যাচ্ছিলাম অজস্র। আমি যেমন প্রেমপর্বের কথা ভেবে গেছি, মামাবাড়ির অনাদরের কথাও। মিলি নিশ্চয়ই তেমনই ফেলে-আসা দিনে মশগুল ছিল। একসময় মিলিই বলল, চলো নীচে নামি। বুচাই একা আছে ঘরে।
পরদিন চেক-আউট করে বেরিয়ে আসব আমরা। খাতায় সইসাবুদ করছি আমি। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে হঠাৎ মিলি বলল, একটু দাঁড়াও। আমি একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
এখন ছাদে? এই রোদে?
হ্যাঁ, যাব আর আসব। ঘুড়িটা একবার দেখে আসি প্লিজ।
আমি আর বুচাই মিলির জন্য গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। অনেকক্ষণ।








শুভ আঢ্য

কাসাহারা ও রবীন্দ্রনাথ


ছায়া ছোটো করে টেবিলের সামনে মরিচদানিতে ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া এখানকার ওয়েটারেরা আর কিছু করে না। এখানকার মেনুকার্ডের বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মাশরুম দেওয়া চাউমিনে বৃষ্টি। কাসাহারার বাইরে কোথাও কোনো আবহাওয়া দপ্তর নেই। এখানে শুধুই কালো কালো ভেড়ার মতো দেখতে শুয়োরেরা টেবিলের তলায় ঘুরঘুর করে। ছায়া ছোটো হয়ে গেলে এখানে খেতে আসা মেয়েদের প্লেটে তা সাজিয়ে দেওয়া হয়। এখানে একটিও চেনাজানা টমেটো নেই। অচেনা টমেটোরা এখানে ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলে। টেবিলটিতে ওয়েটারদের হাতের ছায়াটুকু পড়ে আছে, তাদের ঘরে বিছানায় এলানো শরীর ঘিরে কোনো মেয়ে নেই। অথচ এখানে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন, প্রতিটি মেয়ের স্কার্টের ভেতর একটি করে সাদা পায়রা কখনও লাল হয়ে যায়... এখানে লাল রঙে ছবি আঁকা হয় না যদিও। এখানে মরিচদানি থেকে বৃষ্টি পড়ে না কোনো। শুধুই টেবিলের তলায় শুয়োরেরা একটার পর একটা ডিশ... এখানে কাসাহারায় বাইরে একটির পর আরেকটি মেয়ে অপেক্ষা করছে।






রোদ্দুর কাসাহারাতে পড়ে। সেখানে রাখা মাচার ওপর মাছের ছায়া কি করে পড়ে কেউ জানে না। এখানে মাছরাঙাদের নিয়ে কথা বলতে আসা ছেলেমেয়েরা একে অপরের বুকের কাছে বসে, খাবি খায়। মাছগুলো রোদ্দুরে ভেজে আর ভাবে জলপাইহাটি থেকে এখানে আসার সময় ভিজতে ভিজতে একদিন তারাও ছেলেমেয়েগুলোর মতো বুকের কাছে বসতে পারবে, তাদের সতেজ আর নিস্তেজ স্তনের কথা জানতে পারবে, যদিও মাছরাঙারা কখনও বোতলে ঢুকতে চায় না। তারা রবীন্দ্রকবিতা পড়েনি। তবে জানে, বাবু পারিষদ সাথে ছিপ ফেলেন পুকুরমাঝে। ফাৎনায় মেয়েরা ওঠে, অনেক ঘুমের নীচে তাদের বাড়ি থেকে উঠে এসে রোদ্দুরে আলুথালু দাঁড়ায়। জলপাইহাটি রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে। কবিগুরু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, কাসাহারা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মাছেদের ছায়া আর অ্যাকোরিয়ামের ধারণা। তারা নিজেদের মতো করে জলপাইহাটির জালে জড়িয়ে পড়ছে। জাল মোহ, সেখানে রোদ্দুর পড়ে না। সেখানে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় মাছগুলো মাছরাঙার সাথে কথা বলে, কাসাহারার টেবিলে





অবিরত চলে যাচ্ছে কথোপকথন। সেখানে আলো জ্বলছে না, কাসাহারা পেরিয়ে সবুজ মাঠটির দিকে এগোলে দেখা যায় ক'টি মহিলার স্তনবৃন্তগুলি জোনাকির মতো জ্বলে উঠছে। এঁরা হতে পারেন রামকিঙ্করের সাঁওতাল রমণী বা উৎপল কুমারের নিরক্ষর বেশ্যা। এঁদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখাজোখা আছে কি না তা নিয়ে কাসাহারায় কোনো আলোচনা সভা হয়নি। সেখানকার কফিকাপগুলো এসব মেয়েদের স্পর্শ হয়তো বা পেয়ে থাকবে। এখানে বৃষ্টির সময় অবিরত হয়ে যাচ্ছে কথোপকথন। সবুজ মাঠটির দিকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো ভিজছে। শেষের কবিতায় লাবণ্য যেভাবে কথা বলেছিল, সেই স্তনবৃন্তগুলো সেমতোই উন্মুখ। ফলে, কাসাহারায় কবিতা গোর দেবার কথা রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি। হয়তো উৎপল কুমার বা রামকিঙ্কর এখানে আলো নেভানোর কথা ভেবেছিলেন। এই নিয়ে কাসাহারায় কথোপকথন জারি থাকছে ছেলে ও মেয়েগুলোর মধ্যে।

স্নেহাংশু বিকাশ দাস


নিজস্ব ছায়ার প্রতি 
এক
এই যে এখন সকাল হল, ছায়াগুলো হেঁটে গেল কাঠবেড়ালির দিকে। আমি অতীত জড়িয়ে নিচ্ছি আলোয়, চাদর জড়িয়ে নিচ্ছি – এমনকি অলস হাসির মধ্যে লুকিয়ে রাখছি একটা গোটা বালিচক লোকাল। স্টেশন জুড়ে এখন বিস্মৃতির পদাবলি। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিবর্ণ পাতায়। আমার আতসকাচ নেই, সমুদ্র নেই, এমনকি একটা নির্মেঘ আকাশও নেই। অথচ আমি খোলা খাতাটিকে বুকে জড়িয়ে অনর্গল বলে চলেছি অশ্লীল মৃত্যুর কথা। এখন ভিখিরির মতো হাত পেতে আছি। শুকনো পাতার বিষণ্ণতা ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়। শীতের বিকেলে নরম অভিমান পাশে এসে বসে। দু’হাতের মধ্যে তখন নিজের ছায়া, জলপ্রপাতের শব্দ। এখন জানালার পাশে বিপন্ন পলিমাটি জমা করি অকারণ....

দুই

চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে আজ। কুয়াশা জমেছে। ধুলো জমেছে। স্মৃতির পাশে এখন বিষণ্ণ কামরাঙা গাছ। গুটিশুটি শুয়ে আছে নিরীহ গিটার। সুর লাগছে না, আবেগ লাগছে না। বারবার সারানো সত্বেও আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি নামছে। পৃথিবীর সব সবুজ আজ ভিজে যাবে। দরজায় এখনই তালা দিয়ে দেব। ঘুম পাচ্ছে। অসহায় আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। গোপন সেই পাচিলের কাছে নতজানু হতে হবে। সারারাত ধরে জলপ্রপাতের শব্দ শুনব। একটা চিঠি লিখতে হবে। অন্ধকারময় এক পোস্টকার্ডে সেই চিঠি লিখব। ব্যর্থতা লিখব। ঘুম লিখব। আয় ঘুম...আয় ঘুম...তোমার আঙুলে ঢুকে পড়ছে কামরাঙা ফুল।

তিন

নদী মানেই একটা শীতল ছায়া। প্রায়শই ঘুমিয়ে থাকে বুকের বাম দিকটায়। রোদে ও পিপাসায় জীবন এলোমেলো হয়। ঘুড়ি ডিঙিয়ে ছুটে যায় ভেজা আকাশের দিকে, পাখিদের দিকে। হয়তো বহুদূরবর্তী কেউ ঠিক লক্ষ্য রাখছে। আগামী রাত্রিগুলোকে বলে দেবে কুর্চির ব্যথাতুর তিলটির কথা। সেই তিল মেঘের ভেতরে খেলে বেড়ায়, শুভেচ্ছা জানায় ঘুমের ভেতরে, গভীর শরীরী শুভেচ্ছা। ছায়ার বুকে, নদীর বুকে শোনা যায় জলের গর্জন। ঝড় আসতে পারে। তুমুল ঝড়। তীব্র হাওয়ায় কেঁপে উঠবে পূর্বজন্মের স্মৃতি। সেই জন্মে একটিও নদীর হৃদয়ে বৃষ্টি নামেনি। ভুল করেও ভিজে যায়নি নদীটির চোখ, চোখের পাতা। অভিশপ্ত সেই জীবনের দিকে বারবার ছুটে যাচ্ছে ছেলেটি, মেয়েটিও। ছুটে যাচ্ছে তাদের জীবনের আজব দোলাচল নিয়ে।

মৌসুমী মৌ





#ডাকপিয়ন

মেঘ, 
 আমার কিছু ভাল্লাগছেনা| বেশ কিছুদিন পর আবার তোকে লিখতে বসলাম | জানিস সারা পৃথিবীর এই অদ্ভুত অসহায়ত্ব আমাকেও আস্তে আস্তে গ্রাস করছে| আমার ব্যালকনি ছোঁয়া দূরত্বে পল্লবী থাকে জুনিয়র ডাক্তার| একাই থাকে| মাঝে মাঝে বন্ধু বা প্রেমিক যাইহোক বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে যায়| ও বাইক থেকে নামলে ছেলেটা হেলমেট খুলে প্রতিদিন ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়ায় আর পল্লবীর তখন সারা মুখ ভীষণ আলো আলো হয়ে যায়| তারপর পিছন ফিরে ছুটতে ছুটতে ফ্ল্যাটে ঢোকে| ওকে হাঁটতে দেখিনা সারাক্ষন দৌড়োচ্ছে|  খুব ব্রাইট চনমনে মিষ্টি মেয়ে| এখন তার আরও একটা পরিচয় ও প্রকৃত সমাজবন্ধু, সাহসী আর সংবেদনশীল| কিন্তু আজ শুনি সেও কয়ারেন্টাইনে| আর প্রকৃতিও দেখ কি অসম্ভব নিশ্চিন্তে আপন খেয়ালে বুঁদ হয়ে রয়েছে| ঠিক তোর মতো| শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্মম| যাকে শাস্তি দিচ্ছি সে মরল কি আধমরা হলো দেখার দরকার নেই | প্রকৃতি, মানুষ, স্বজন প্রয়োজনে সবাই নিষ্ঠুর| 

  যাক সে কথা| জানিস অমিত আমার পরিচিত| আমায় দিদি দিদি করে| চাকরি এখনো পায়নি| এদিকে বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে গত বছর| সেই থেকে হায়ার স্টাডি না করে কোচিং সেন্টারে পড়ায়| কিন্তু দুমাস তার কোনো ইনকাম নেই| কাল পাঁচ মিনিটের জন্য বাজার গেছিলাম দেখা হলো| তখন ওর মুখে সব কথা শুনে আমি বললাম, "আছিতো আমি"| অমিত বলে, দিদি তুমি কত দেবে| ওপরওয়ালা মুখ তুলে না চাইলে এই করোনা সুন্দরীর স্পর্শে সবার মরণ|  আমি যে ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দেব তার উপায় নেই| ভালোবাসার মানুষদের ছোঁয়াও বারণ| শুধু বলি সব ঠিক হয়ে যাবে | পৃথিবী আবার রোগমুক্ত হবে | সব থেকে মজার কথা কি জানিস যেই জিজ্ঞেস করলাম তোমার বান্ধবী আত্রেয়ীর কি খবর? মন কেমন করা হাসি হেসে বলে সব খবর জানতে নেই কষ্ট পাবে| আপাতত আমার এখন প্রথম চিন্তা কুড়ি তারিখে বাবার কেমোর ডেট| বাবাকে কি করে নিয়ে যাবো! তার সাথে টাকা পয়সার জোগাড়| আমি চুপ হয়ে যাই| ওর চিন্তা আমাকে খুব ভাবায়| এতো গুমোট চারপাশ দমবন্ধ লাগে|  এস.বি.আই এর এ.টি.এম এর সামনে এক মুখ দাড়ি, একমাথা উলুঝুলু চুল নিয়ে রোজকার মত আজও সেই পঁচিশ ছাব্বিশের পাগল ছেলেটা বিড় বিড় করে আকাশের সাথে গল্প করে যাচ্ছে| ও জানে এতো ভালো শ্রোতা এ তল্লাটে আর নেই| আমি একটা স্লাইস ব্রেড ওর হাতে দিয়ে চলে আসি |
তোকে কেন যে সব কথা বলি কে জানে! কোন সুদূরে তুই আর কোথায় আমি! আজ সন্ধেতে এখানে হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি হলো| এই প্রথম বৃষ্টির সে শব্দে তুই নেই| অনেক কিছুতেই এখন নেই জানি কিন্তু বৃষ্টি! তাতেও তুই নেই! এমন নির্মোহ বৃষ্টি অনেকদিন পর দেখলাম| অনেকদিন পর তার মাঝে তোকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করলাম| যে নিজেই সমুদ্রের দিকে পা বাড়ায়, বৃষ্টি তাকে ভেজাবে এমন সাধ্য কোথায় ! জমা কথার পাহাড় ধ্বসিয়ে লাভ  কি বল | ভালো থাকিস... 
                                           রিমি












শ্রাবণী সোম যশ


“আগুন্তুক”


আ মোলো এতো ঝড় জলের রাত্রে কে জ্বালাতে এলে বাছা এই বুড়িমানুষকে” ঝন ঝন করে দরজার শিকল টা ধরে কেউ নাড়াচ্ছে মনে হচ্ছেনাকি  ভুল শুনলাম।  সবই বয়সের দোষ! আবার শিকল নাড়ছে। ওহ মা, এবার তো আরো জোরে।  মিনতি হ্যারিকেন  হাতে নিয়ে  কোনোরকমে ঘোমটার আড়ালে মাথা বাঁচিয়ে দরজা খুলতেই খুশিতে গদগদ একেবারে। সামনেই দাঁড়িয়ে ছোট ছেলে
ওহ মাসমু এসেছিসতা একবার মা মা করে ডাকলোই তো হয়। আরও আগেই খুলে দিই। পাগল ছেলে আমার! এহ  হে কাক ভেজা হয়ে গেছিস  বাবা! 
এতো জোরে দরজায় শব্দ করছি শুনতে পাচ্ছনা আর ডাকলেই শুনে ফেলতে!  কি যে বলো তার মধ্যে এই মেঘ ডাকছে এত্ত জোরে। মা  ছেলে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢোকে মিনতি  গামছা এনে তড়িঘড়ি ছেলের ভিজে মাথা মুখ মুছিয়ে দেন। নিজের একখানা কাচা ধুতি সমুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যান ঘর থেকে
- এতো রাত একটু দুধ মুড়ি আর কলা খেয়ে পিত্ত রক্ষা কর সমু কাল সকাল সকাল মোক্ষদা এসে খাবার বানিয়ে দেবে। মাছ ধরাবো দুপুরে খাবি
- দুপুর আবার কোথায় পেলে মা তোমার সমু কাজ  পেয়েছে কালই যেতে হবে। এতদিনে তোমার ভগবান  মুখ তুলে  চাইলো।  বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি পেলাম মা দুঃখ একটাই অনেক দুরের দেশে যেতে হবে। নতুন জায়গা নতুন জীবন তাই তোমায়  প্রণাম করতে এলাম
 ছেলের কথায় আচঁল দিয়ে চোখ  মোছেন মিনতি।
বড়ো খোকাও নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছে ভাইয়ের কাজের খবর পেয়ে বকাঝকা করলেও তোকে স্নেহ করে তো খুবই। ছোট ভাই বলে কথা
- হ্যাঁ মা খুশি তো হবেই, তবে কেউ তো এখনো জানেই না। খবরটা জানামাত্রই  সব্বার  আগে তোমাকে বলতেই ছুটে এলাম

                                পাশের ঘরে কাচা চাদর  বালিশ দিয়ে পরিপাটি বিছানায়  ছেলেকে শুতে দিয়ে নিজের পরিচিত বিছানায় গা এলিয়ে দেন মিনতি। কি জলখাবার করবেন, কি কি মিষ্টি করাবেন, দুটি মাছ ভাত মুখে না দিয়ে কিছুতেই যেতে দেবেন না। এইসব  ভাবনায় দু চোখের পাতা সারা রাত এক করতে পারেন না। বরাবর ভোরে ওঠা মিনতির  ঠিক  ভোররাত্রেই তন্দ্রা এসে যায় হঠাৎ চটকা ভাঙেএকি! বড়ো খোকার গলা না।  হ্যাঁ, তাইতো বড়ো খোকাই তো মা মা করে ডাকছে। দেখো কান্ড রাতে সমু আর এখন এই নিশি পোয়াতেই ভাইয়ের টানে দাদাও এসে হাজির।  ভালোই হবে আজ দুই ছেলেকেই সারাদিন নিজের কাছে আটকে রাখবেন। দুই ভাই একসাথে মায়ের কাছে খেয়েদেয়ে তবেই বেরোবে। কোনো কথাই শুনবেন না।  দরজা খুলতেই আলুথালু বড়ো খোকা মাকে জড়িয়ে ডুকরে ওঠে,
-মা,  সমু এসেছে।  তোমায় একটিবার প্রণাম করতে এসেছে মা
 - হ্যাঁ জানি তো সমু এসেছে  তুই কাঁদছিস কেন খোকা?
- মা আমি পারলাম না। আমি হেরে গেলাম মা। তোমার কাছ থেকে ভাইকে আমি নিয়ে গেছিলাম মা। চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা সমুকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিলো মাগো। কাল রাত্রে দশটার এক্সপ্রেসের সামনে সমু আত্মহত্যা করেছে মা
হতচকিত মা ছুটে যান ঘরে যেখানে সমুকে ঘুমাতে দিয়েছিলেন। টানটান করে কাচা চাদর বালিশ পাতা।  কারোর চিহ্ন নেই সেখানে টলতে টলতে বেরিয়ে দাওয়ায় এসে বসে পড়েন মিনতি চোখে পরে তখনও  কলতলায় সমুর দুধ মুড়ি খাওয়া এঁটো থালা পরে আছে পাশেই কলার  খোসায়  অগুনতি পিঁপড়ে হানা  দিয়েছে। দূর থেকে কানে আসে, বলো হরি হরিবোল বলো হরি হরিবোল”