রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

অনিকেশ দাশগুপ্ত

                              


সৃজনের এই সংখ্যার কবি অনিকেশ দাশগুপ্ত।জন্ম ১২ ই অক্টোবর ১৯৮৭৷কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর।বর্তমানে মালদা জেলায় সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান শিক্ষক।  পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন ওয়েবম্যাগ ও লিটিল ম্যাগেনিয়মিত লেখালিখি করেন৷ তার 
কয়েকটি কবিতা পড়া যাক 


 


পুরুষরাত্রি


খয়েরি রক্তের কথা,নক্ষত্রের মিহিন গোলাপ...

কুঁকড়ে ওঠা গাঁজাখোর পিঠ-পল্লীপ্রান্তে কুমকুম জল

এরপরও বিকেল ফুরোয় না - 

অগ্নিকুণ্ড ঘিরে চঞ্চু নেমে আসে, খুবলে নেয় ফিনকি অগ্নি

নরম ডিমের পরিমিত হলুদ পুঁছে দালানে ফিরে আসে যুবতী

ঐখানে ভরসন্ধ্যে,পোষা স্তনের গল্প বলে 

তিনসত্যি ডোমবন আর রহস্য ছেঁকে নেয় আমাদের

পরিপুষ্ট আঁচে মাংস,আদ্যাশক্তি, কস্তুরী রস গড়িয়ে নামে

ধূ ধূ নিশীথে অর্ধস্ফুট সুড়ঙ্গে ঘুমজড়ানো মৃগয়া

উজাগর ঝকঝকে শাটার, শূলে উঠে, খিলখিল হাসে

ছায়াদের কেউ ধরতে নামে না

ধারাগৃহে সিঁদুরফোটা রাত ফুরোয় না...











আঁকশিঘর



লোহার পাতে জড়িয়ে থাকা সরীসৃপ

গিঁট খুলে খুলে যে সিঁড়িঘর মন্ত্রতাপ জানে

কেরোসিন বাতির আগে - পরে যে সবুজ কিম্বা লাল

এক কামরার সেই ঘরগুলোয় বিষম লুকোচুরি আর

খিলানের তিন কব্জা এঁটে চুরি দেখা চোখ

ভরপুর ফলের পতন শব্দে হাহাকার ঘুম

কাহার নিয়ে গেছে তাদের ঝকঝকে প্রিয় পালকি

ত্রিশঙ্কু উপত্যকায় – যেখানে হাপর টেনে ক্ষয়াটে মাছ

ওড়ে,চামড়ার অনেক গভীরে গড়ে আঁকশিঘর...













বাষ্পীয় মৃত্যুর অনুকরণ



১। 


হাইড্রাঞ্জিয়ার ওপারে তফাৎ রেখে সাদা নৌকা পাড়ি দিচ্ছে

গাঢ় জলের দেশে, যেখানে মানুষকে ঘিরে মানুষেরা বড় হয়

সাঁকোর ওপর টলছে ক্রিমসন গোল আলো আর ভেতর ভেতর

ক্রমাগত বেড়ে উঠেছে বিষম দৌত্য 

চূড়ান্ত চুম্বনগুলি যখন এঁকে দিচ্ছিলে প্রবাসী প্রেমিকার ওষ্ঠে

ব্রদেল থেকে প্রেমের ক্কাথ হাতে ঘূর্ণিপথ দিয়ে জ্যোৎস্নার উষ্ণ

উদ্গিরণ দেখে ফেলেছিল পথকুকুরের দল

নৈসর্গিক হাওয়ায় পুরনো বাস্তু আরও স্পষ্ট করে রেখেছে

ম্যাজেন্টা কাঁচ,যার ওইপারে ,হ্যাঁ ,বিস্তর আত্মহন্তারক 

বনৌষধী নিয়ে বৃহৎ এস্টেটে নিছক পদরোপণ করেছে 

ক্যাফের ঘনিষ্ঠ টেরেসে উত্তাপ বিনিময়ের শেষরাতে

দলিল দস্তাবেজগুলি ভ’রে উঠেছিল তেমনই পিছল সম্মোহে...
















২|


তারপর কটিবন্ধ কখন যেন প্রতীক হয়ে ওঠে

রৌদ্রের নীচে চেকার্ড টেবিলে পরওয়ারদিগার রেখে গেছে

তাঁর অলংকৃত মঞ্জুষা... চিনে নাও

মায়াবন থেকে অভ্র ছেঁচে তোলা উজ্জ্বল তুষার

বৃন্ততটে ঝরে পড়ে 

জাহাজের শেষ কার্নিভ্যালের মতন

যুক্ত ভ্রুয়ের পর ওই আহ্লাদিত চক্ষু 

ফেনিল মদ ঢেলে দেয় কলিচুন ও মাটির নানান স্তরে

কফিনে ফিরে আসে ময়নাতদন্তের তর্জমা...














রেল গল্প

১.

লাল ঝকঝকে পতাকার মিথ ছিল

রুমাল নড়ে ওঠে অন্যান্য টেরেসে

যেন বিপজ্জনক কথা শোনার এই সময়

সাধু থেকে ঈশ্বর সরিয়ে দিতে 

এক পরম পবিত্র

অর্গল খুলে নিতে হয়

খুনের আগে ও পরে ত্রস্ত ছুরি

উপেক্ষা করতে হয়

ধর্মাবতার, যূপকাষ্ঠে এই স্নেহপ্রবণ মাথা –

তেলচিটে সিঁদুর আর আগুনের ফ্ল্যাশ ।

বিষণ্ণ হলুদ পেঁচা প্রত্যেক বিকেলে

সময় বুঝতে পারে 

সকালের সূর্য কোথাও ছিল না তখন 

ট্রামগাড়িতে পুতুল মেনে নেওয়া

গল্প গড়িয়ে যায়...

  



২.

আর হলুদ পেঁচার সমবেদনায়

নোনা হাওয়া বুঝে নেয় এই উপকূল শহর

ঘোর-লাগা সাঁতারে একে অপরের নিঃশ্বাস ছুঁয়ে 

গম্বুজ রশ্মি পড়ে চোখ - চোখের খানিক নীচে

ধাতব শব্দ অনুসরণের উদ্দেশ্যে এই বৈদ্যুতিক চোঙ

ড্রেসিং রুমের আলোয় বাজিমাত থাকবে

আলোড়িত হ্যারিকেন হাতে কেবিনের দোতলা

থেকে নোঙর দানের কথা বলে উঠবে কেউ...


 



৩.

সিঁদুর আলোয় রেলের ট্র্যাকগুলি এগোয় পিছোয়

লোহার গন্ধে লাফিয়ে ওঠে কেবিন

আমাদের শূন্যতা থেকেই লাল পতাকার ড্রাফ্ট...

হাতের পেছনে অনেক মুখ ঢেকে একের পর এক

মেইল ট্রেন ধাতব গড়িমসি নিয়ে চলে ।

গাঢ় ব্রিজের মানচিত্র - যারা জানলা দেখছে

তাদের জন্য - সিঁড়ি থেকে টেলিফোন ঘর অবধি

রেলিঙের চারপাশে তিনরকম সাবধানতায় 

আমাদের চলাচল...



একঘন্টার অপেক্ষা


উজ্জ্বল কোট গায়ে তুমি এই বিভেদকে অস্বীকার করতে পারো

যখন প্রিয় বস্তুদের রং দুলে উঠছে সান্ধ্য আলোয় 

আর আকাশ থেকে খসে পড়ছে খয়েরি খয়েরি পাথর

তোমার হাতের মুঠোয় তখন যেকোন প্রিয় বর্ণহীন  হাত...

এটুকুই তো রং

                            যা আঘাতের মতন তোমায় সতর্ক করবে

এটুকুই সেই চিহ্ন  -  যা সিংহের মতন,

                     তোমার ওই চওড়া কাঁধে ভাগ বসাতে চাইবে !

আবার ক্লান্ত হয়ে পড়বে একটা কালো কাচের গাড়ি 

আর ততোধিক কালো উজ্জ্বল স্যুট তোমায় মূল্যায়িত করবে...


ছিদ্রাল বাড়িটির বিষয়ে হতবাক হ’তে হ’তে 

আধপোড়া একটা পিয়ানো  জায়গা করে নিচ্ছে তখন 

আধডোবা একটা হাত, অনুতপ্ত হয়ে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে

এবং এই কালো কাচের গাড়িতেও ... কারো ফেরার কথা ছিল না...











বিচারকক্ষ


ঘরভর্তি লোক তীব্র উচ্ছ্বাসে তাকিয়ে ফেলছে

ঘোড়ার প্রতীয়মান অংশগুলিতে ...

মুখে নানারকম ধ্বনিসহ বাজি রাখছে ওরা

ঘোড়ার উচ্ছ্বাস বিষয়ে

ঘোড়ার ফুঁসে ওঠা নাসায়

টর্চ জ্বেলে বাতাসের ধার পরীক্ষা করছে কেউ কেউ

সূর্যের তীক্ষ্ণতা নিয়ে ওদের কোনও বক্তব্য নেই

সূর্যের নীচে শিহরিত হ’তে হ’তে ওরা

ঘোড়ার স্বীকারোক্তি নিয়ে অনুতপ্ত হচ্ছে ...



















উৎসর্গ


মায়াজন্ম ছেড়ে লাল পাথুরে রাস্তায় বিস্তর দিন

তামাটে যুবতীরা অভ্যর্থনায় ভরিয়ে তোলে গ্রীষ্মসকাল

তুলট ফল মুখে গুঁজে রেখে গেছে কেউ

বিজাতীয় শিশির ওষ্ঠে গেঁজে ওঠে 

করপুটে তুলে ধরি লুন্ঠিত পদ্মবীজ, কৃষ্ণ নক্ষত্র

এসব তোমার উদ্দেশ্যে,হে মৃদু ত্বকের দেশ !

রাণীর গরিমায় তোমরা প্রভাতফেরি দেখে 

রণক্লান্ত পাঞ্জা রাখো এ ক্লীবতায়

সর্পিল চলনে আরও মুগ্ধ ,আরও অগাধ প্রশস্তি

তোমার সম্মুখে - গির্জাঘর ছেড়ে এ মায়াজন্ম 

চিত্রকর ফুটিয়ে তোলে হলুদ রঙের অতিব্যবহারে

 যেন এক নিঃসীম খোলা জানলা 

রাখা আছে তোমার পাশে

যেন এক বিস্তৃত শোভাযাত্রা সেজে উঠছে 

তোমারই উদ্দেশ্যে ...


রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সিন্ধু সোম

                   


এই সংখ্যার গদ্যকার সিন্ধু সোমIতিনি মূলত গল্প লিখে থাকেন। প্রথম দশকের দ্বিতীইয়ার্ধের লেখক বলা যায়। আসুন তার গল্প পড়া যাকI

মাছি


মাউলা বাউরির নাকের শির বরাবর মাছিটা বসেছিল। মাঝে মধ্যে ডানা তার কিয়ৎ ফাঁক হয়ে এলে মাউলার মাথা ভোঁ ভোঁ করে এই উইড়ল, এহ্ এইট্টা উইড়ল রেএএ—মাছি নির্বিকার। মাছির ডানার কাঁপন থির থিরায়ে দেয় তার বসার রড গ্যালান। লক আপের গোটা দেয়াল দেখে মাউলার মনে হয় ই দিয়ালগ্যালান আঁট হয় নাই ভালো। আরো অইল্প কইষথ! লয়? ঝিমাপাঁচন গরমে আর চাম ফুলানো মারের দাগের গাঁটে গাঁটে ঘামের সঙ্গে জ্বলনের অবকাশে, ঘুমে উয়ার চোখের পাতা ভার হয়ে আসে এবং সেই ঘোরে বিড়বিড় করে সে বুঝি বা মাছিটার কাছেই না-খুশ মনের ভাব ছড়ায়। লক আপের থেকে তার ঘরের পরিসর ছোট, ছাদও নিচু…এ অবস্থায় গরাদ তার বড় ফাঁকা ফাঁকা ঠেকলে ধাচুক ধুচুকিয়া নিন্দ সেই ঘরের ফাঁকগ্যালান ভরে দিতে থাকে ও তাতে করে চারপাশে ন্যাতামারা ম্যাদামারা ভিজাপন চারিয়ে গিয়ে তার চোখের পাতা বেঁকে বেঁকে স্যাঁতসেতে হয়ে আসে। এ খালি তার বাইরে থেকে আসে নাকি ভিতরের ভুড়ভুড়ি কাটা খালির পুখর থেকে উথলে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় মাউলা তার হদিস পায় না। মাছির ডানা ঝপটের আওয়াজে উ চমকে চোখ খুলে দেখে মাছি উড়ে নাই। নির্বিকার, তবে ডানা সে বসে বসেই নাড়ে। সে আওয়াজ মাউলার পাওয়ার কথা না, কিন্তু ঘর এত খালি খালি বলেই সম্ভবত আওয়াজ তার পাল্লা ছাড়িয়ে কান ধরে ঝুলাঝুলি করে। এসময় লক-আপের গরাদ ডাণ্ডার উল্টা দিকে হুই উঁচা ঘুলঘুলানি দে হুড়াইমুড়াই বাতাস ঢুকে। এক পোঁচ পেচ্ছাব দিয়ে দিয়াল যেন ধুয়ে দেয় কেউ। মাউলা অল্প নাক কুঁচকায়। অল্প। তার কাঁচাপাকা চুলে আধবোজা ঢেউয়ের কাঁটায় কাঁটায় কালো রক্তের বাদবাকি নোনাজল কেটে যেতে থাকে। বাকি আদ্ধেকের সাদা জালিজুলি পটের মাঝে কালসিটে দাগ গজের দানায় দানায় জলের ভারী রঙ ছড়িয়ে দিলে মাউলার চাম চিড়িক চিড়িক নখরা ছাড়ে, চুলবুলায়। এ গজ কে বাঁধছে মাউলা জানে না। বাঁধার সময় চোখ তার অল্প লাইগে গেইছিল না পুরা তাও সে ঠাওর করতে পারে না।


এইসময় গরাদের গায়ে ঘা লাগে। হট্ ঘটাং। কে রে? হ! কনস্টেবল! মাউলা একপ্রস্থ তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। ই সময়ে তাকাবার জরুরত বোধ হয় না তার। রাজ্যের বিরক্তি তার মজ্জার ভিতরে ফের সেই খালি পুখরের ভুড়ভুড়ি তুললে সে টের পায় এতে শুধু বিরক্তি নাই, ডরের খাদ আছে। মাংস ছিঁড়লে ভিতরের লাল সুতা যি রকম গুটায়ে গুটায়ে আসে, সেই সুতা মাউলার লাল চোখের শিরায় শিরায় জড়াতে থাকে। এই সময় একটা ঢেকুর উঠলে, আ মর গা, বাসলিচোদা ঢেকুররে! খালি পেট সেই ঢেকুরের বুকে পিঠে শুধু সকালের তাড়ি ছাড়া আর কিছু যে মাখায় পাঠায় নাই তা নাকে না পেলেও বুকে টের পায় মাউলা। জালের ফাঁক দিয়ে এই যে হঠাৎ হঠাৎ শব্দ ছুঁড়ে মাউলার জালি জালি পানা আরো কুচিয়ে ঘোলা করা যার কাজ, সি কনস্টেবলের নাম হল যেয়ে পান্নালাল। জালের ফালা ফালা জড়িয়ে আসার মধ্যেও মাউলার চোখের ভিতরের পর্দায় ছ্যাঁকা দে যায় কনস্টেবলের সন্দেহ। তা সে তার মনে যখন ঢুকে পড়েছে ভুল পথে উড়েই হোক বা বাড়ি ফেরার বাসনাতেই হোক, সন্দেহের যে ছাড়ান‌ নাই তা নিয়ে সন্দেহ নাই। 


পান্নালাল একটু দাঁড়ায় কী যেন ভেবে! মাউলা বাউরির দিকে তার সেই বাতিকগ্রস্ত ভুরু তুলে খানিক আগে পিছে করতে সে নিজেও বেশুমার সুখ পায়। মাছি নির্বিকার। একটু ওপর নিচে সরে। কিন্তু ওড়ে না। মাউলা বাউরিকে আজ সকালে ভরা বাজার থেকে খদ্দেরের আশায় পড়ে থাকা জিয়ন্ত কাতোলের মতো প্রায় রাঙা হাতে, অথবা যে হাতে বন্দুক থাকার কথা, অথচ ছিল না, এমনভাবে তুলে এনেছেন বড়বাবু, যে ছোটবাবু, সেই মুহূর্তে, অতিরিক্ত উত্তেজনায় পান্নালালকে দুবার 'আপনি' বলে ফেলেছিলেন। তা বললেও ক্ষতি নাই, পান্নালাল মাটির দিকে তাকায়ে লজ্জাগোকুল হয়ে ভাবে, মাথায় তার রূপার বহর কেশ দুইটা বেশিই হবে ছোটবাবুর থেকে। বাচ্চা আদমি। তবে হাঁ! সাচ্চা অফিসার আছে। মেজবাবু সে বখোত থানায় ছিলেন না। কোলিয়ারির দিকে একটা কিছু ঝামেলা হয়েছে তা সামলাতে গেছিলেন। অর্থাৎ বহুৎ বড় রকমের মামলা না। রকম বড় হলে অফিসারও বড় দরকার পড়ে। পান্নালাল এসব জানে। তাদের কথা বাদ দিগে যা। তারা হল গে বাতিল মাল না বাতিল মাল! তবে মাউলা বাউরির উপর নজরটা বড়বাবুর কমদিন না! বেশ কয়বার রাস্তাটাস্তা আটকিয়ে ছোটবাবুর মাথা ফাটিয়ে বড়বাবুর নেকনজরের আনাচে কানাচে উঁকি দিতে পেরেছে লোকটা। তা পুলিশের নজর যখন উঁকি তো দিতেই হত! বড় ধ্যাঁটা লোক! স্বীকার করে নাই এখনও কিছু। তবে কোর্টে কেস উঠলেই ফেঁসে যাবে, জানে পান্নালাল, বিশেষত আজ দুপুরের পর… বড়বাবু উঠিয়ে এনে ছোটবাবুর হাতে ছাড়ে। ছোটবাবু জেরা করার আগেই কষে ডাণ্ডা দিইছিল! লোকটা একটা শব্দ পর্যন্ত করে নাই! মড়া যেন! তবে তাড়ির গন্ধ ছিল ঘোর। সকাল সকাল…সাধে কি বলে ছোটলোক!  ব্যবস্থা সব্বোই হঞ গেছে। বড়বাবুর শখের খাতিরে একটু অতিরিক্ত ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল, মিটে গেছে। ওনার চোখা মাথার চোখা বিশ্বাস বন্দুকটা মাউলা স্মাগল করে এনেছে বাইরে থেকে। রেয়ার মাল। এসব চোরচোটঠা ছোট লোক! এদের অসাধ্য কিছু আছে! পান্নালালের নাচতে থাকা ভুরু শরীরের মধ্যভাগে একটা থিরথিরি কাঁপন ধরিয়ে দিলে পান্নালাল গরাদের সামনে একটা টুল টেনে বসে পড়ে। মাছিটা নির্বিকার। দুপা মুখের সামনে তুলে ঘষে, চোখ ঘুরায়…


খুন কইরলি ক্যানে রে মাউলা? এ হে হে! ইবার বিরাবার কী হবেক? ফাঁসিও হইঞ্জাইতে পারে রে!

হে! খুন কইরতি যাবো ক্যানে! আমার তো আর খাইঞদাইঞ কাজ লাই! উ হারামিক আমি মারি নাই বাবু! আমি আপনার লিজের জিনিষ লিথে গেইছিলম বাজার!

হঁ? ই বাবা! কী বলিস? বলিস কী রে তুইঁ? তাইলে মাইরলেক ট কে? গোটা বাজার বইলছে মাউলা মাইরিছে! সবাই মিছা বইলছে বল!

বইলছে তো মিছা! আরে সুনো! মাইঞ্ছ কি না মাইঞ্ছ আমি মারি নাই হরকে, বাস। আমি মাইরলে বহুত ধীরে মাইরথম, আমাকে উ যেইরকম মাইরছে...লাশে যেইপারা ঘাড়ে চাপে…...সেই পারা মাইরথম শুয়ারের ছাকে! এত সহজে মইরথ নাই…...আগে চইথে লাইরথ…...ফিরকে বইসে বইসে চইলথ…...ফির গোঙ্গাইথ! তারপরে থির মাইরে আইসথ...উয়ার পর...দ্যখ রে শালা…...লাশ দেইখিছিস? তুর লাশে কারবার! জীয়ন্ত লাশ দ্যাখ...তোর বাবু আমাক কাঁইন্ধে ক্যামন চাইপে ছিল দ্যাখ...এই দ্যাখ পায়ের ছাপগ্যালা...আমার মরা শরীল টথে গাঁইথি গেইছে...এ চামড়া এখন ঢোল বাজাবার কামকে লাগে ক্যনে…...ডুমদুম ঢোল...গাঁইধাছে দেইখছিস লাই? গন্ধ পাছিস লাই? দেখ মাছি কত? আমি শুধু ঝাইড়ি ফেলাইন্দিঞ্চি খাইল্ভরাক...গোদির ছা...আমিই কী আর জীয়ন্ত আছি? তুদের সব মাছির কপাল ক্যনে...অমন হাজার চোখ…...

মাউলা বিড়বিড় করতে থাকলে পান্নালালের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে...চোখ অমন লালাইলো কখন ইয়ার? অমন নিথর ট্যারা! একি জীয়ন্তের চোখ…

  

অ্যাঁ? ও মাউলা! কী বইলিস? শালার বেটা গুদমারানির মুখ দেখ! হরবাবুকে ই অইঞ্চলের দশজনায় সেলাম ঠুকথ, তা জানিস? আর তুইঁ, খ্যাংরাচোদা…

দশজনায় ঠুকথ তো ঠুকথ! আমি উয়ার পোষা খচ্চর বাইঞ্চোত যে আমার উপর উ কড়া চালাইবেক আর আমি পাছা দুলাইঁ নাচ দেখাব! ইড়িচুইমড়ি দিইঁ লাইগি ছিল শালা…...

হঁ! তোদের পিছে তো সবায়োই লাইগছে!

আরে নারে দাদা! খ্যামটা লাচো না যাও…... ইখান টথে কী? হুরররর হ্যাট হ্যাট…...নাই নাইদবি হারামি তোর নাদা এখন সরাইতে লাইরলম...লাশটকে জুইড়াথে দে...



পান্নালাল এল সরে। মহা হারামি এই লোক! পান্নালাল কি আর জানে না? সেই পান্নালালে জানা কিছু, কিছু ছড়ানো ছিটানো খই মুখে তোলা কাক হয়ে মাউলা খুঁটে আনে বাউরিপাড়ার পিছুডাক। মাউলারা আদতে, যদি সত্যিই ধরতে হয়, এখানকার লোক না। উয়ারা লোক হল যেঞে কুঁড়াখাড়ার। সে গাঁ ছিল গাঁ যার ফসলে কভি পোকার ডাঁট পড়ে না। বাউরিরা মরা জীবজন্তু ফেলাথ সেই তখন থেকেই। সেইসব মরদেহ যনখানে ঢিপ হয়ে থাকে সেইখানে হয় যেঞে গেদে মাছি, লয়? সেই মাছি বাউরি পাড়ায় ভিনভিন। তা বাদে গাঁও ছিল ভালোই। জমিনদার দয়া করে গাঁয়ের বাইরে বইসথে দিইঞ্ছিল—বইলথ নাকি গাঁয়ের লোক! দাদু বইলথ উয়ার দিদাকে, "ওসব ঝুটা বাত রে টেঁপি! উগেলান কান নাই দিবি! আমরা ইখানে থাকি তখন যখন জিনাসিনি বসতি দেয় নাই।" কেউ তার কথা শুনথ, কারোর কান ভারি। মাউলার দাদুর, শুধু দাদুর ক্যানে তার বংশের মান্যি গণ্যি ছিল বাউরিদের মাঝে। এখনও তার আন নাই। তা বাদে দাদু সেই একবার খাব পেল জিনাসিনির। ঘোড়ার উপরে চারহাতে চার অস্তর, মা আমার লাল পাড় হলুদ শাড়ি পইরেছিল গোওও! মাউলার দিদা তাকে শুনাত সে খাবের কথা। জিনাসিনির মুখে অবিকল দাদুর বড় মার মুখখানা বসানো! জিনাসিনি বলে, “ওরে ছিনু বাউরিরে! শুনো ছিনু, শুনো! এই গাঁ ছেইড়ে চইলি যাও উত্তরে। ইখানে নাই থাকো বাপ! ইখানের মাটি ধইসে যাবে, সব্বো পাপ ধসে যাবে!” তো সে গাঁ কোলিয়ারির নাগালে যাওয়ার আগেই মাউলার দাদু সেই গাঁ ছেড়ে পেটখোরাকি জুটাতে ধিকির ধিকির এগিয়ে এসে কাজ নিয়েছিল জেমারির পাথরভাঙা কলে। সেই কলে মাউলাই কি কাজ করে নাই! ই বাবা! মস্ত বড় জালি বিজালি ঘের ঘুরে আর ঘটঘুটুইরা আওয়াজে তার কাকেও ইয়া কৈরে ফেলায়। সেই কলের তলা ছাইনে মাউলারা পাথরকে পাথর গিটি কে গিটি মাথায় বইথ। দাদুকে মাউলা দেখে নাই, তবে দিদাকে দেইখিছে হে…একমাথা শনপুড়ানি চুল ছিল বুড়ির। মাউলাকে কোলে নে গল্প নাই কৈরথ দাদুর? তা দাদু এইদিকে এসে ধরেছিল জমিনদারের জামাইকে। নিরসা কোলিয়ারির মালিক তখন পদ্মডির এই ভুঁইয়ারা। এইসব গাঁ গঞ্জ তখন ছিল ভুঁইয়ার জায়গা। ইয়ার পর দেশ ট নাকি স্বাধীন হইঞ্চিল বলে শুনা যায়? তা শুনা যায় যখন, হবেক যাইঞ! জমিদারদের জায়গা জমিন নাকি কাইড়ি লিঞ্ছিল সরকার। পলিটিকে টিকে থাকায় জামাইয়ের কোলিয়ারি গেইলেও জায়গা জমিন যায় নাই উয়ার শ্বশুরের মতো। কোলিয়ারি টো নামেই গেল, দু নম্বরি কয়লার ব্যবসা ফুইলি উইঠতে লাগল। দাদু অসৎ পথে যায় নাই। তখন কখান আর গাঁ! আমলাডিহি, দুর্গাডিহি, জিতপুর, কেশিয়া, বড়মুড়ি, কানগোই----আর হেইদিকে হরিশাডি টাবাডি, গৌরাণ্ডি, রুপনারাণপুর---আর একটু এগালেই আহ্লাডি, কালিপাথর, জিমারি, বনবিড্ডি--ফাঁকায় ফাঁকায় গাঁ তখন। বেশিরভাগই সাঁওতাল গা। সবই জামাইয়ের জমিন। খাইজনা লিথে আইস্থ রামেশ্বর তেওয়ারি ইদিকে। লায়েব উ তখন। আর হেইদিককার ফসলা জমি দেইখথ মহাবীর মুখার্জী।  পাথরভাঙা কলও ছিল জামায়েরোই। তা দাদু যেঞে ধইরলেক মুখার্জী সাহেবকে। তারই সুপারিশে দাদুদের জায়গা মিললেক এইখানে, এই এখন যনখানটথে মাউলারা থাকে, তখন এইদিক গেলানে গেদে জঙ্গল, উল্টাদিকে এখন যনখানে বিহার রোড, তখন উয়ারই কাছকে বাউরিরা বসল আইসে। তখনও বিহার রোডকে বিহার রোড, এই জায়গাটই হয় নাই! গাঁয়ে কয় ঘর বাউন, আর সরাকে গাঁ ভত্তি। সাঁওতালরা তখন ইদিকে নাই, অলগ গাঁয়ে অলগ থাকে উয়ারা। পিঠাকেয়ারীর নিচ টথে। উদিকে ধীবরদেরও বসতি। বড় লড়াইয়ে, দুর্গাডিহির ফসলা জমিনে যখন রেল কারখানা হইল, তখন সাঁওতাল কি আর কম মইরিছে? বাপ রে বাপ! পুখর দিঘি বুজায়ে দিয়ে লাশ পড়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি! তা সেই সব ঝঞ্ঝাট এড়ায়েঁ বাউরিরা বসল এসে কাঁচা সড়কের ডান পাশে। রেলের লাইন এখন যনখানে, উপর উপর, তা পেরিয়ে উধারে। তারপরে এই রোড হল বিহার রোড। গাঁয়ে ঢুকার রাস্তার উপরে বাউরি পাড়া হওয়ায় গাঁয়ের বাউনরা তখন ধরল যায়ে জামাইকে। জামাই তখন হই গেইছে পুরা কংরেসি। তার ঠাঁট বাঁট অলগ! বাউনরা বলল, গাঁয়ের রাস্তার উপর উয়ারা থাইকবেক, তাইলে আমরা ঘরকে ঢুইকব কেমনে? উয়াদের তো আর ছুঁয়া যায় না! রোজ দুবেলা বাউরির ছায়া মাড়াইতে হইলে নরকের ঠাঁই হবেক নাই বাপ, তুমি ভরোসা! রইক্ষা করো! তা জামাইকে জামাই, লোক ভালো! জামাই উয়াদের তুলে এনে ঠাঁই দেয় ইদিককার জঙ্গলে। শাল, পলাশ, নাগকেশর, অর্জুন, খেজুর! ছিল কি   কম নাকি? সে জঙ্গলও বাউরিরা পরিষ্কার করে। আবাদি বসায়। তা বাদে কেবল কলোনি হওয়ার পর বিহার রোড হইঙ্গেল পিছনের রাস্তা। বাউরি পাড়ার উপর দে নতুন বড় রাস্তা হল। বাউরিরা জায়গা দিল। বড় রাস্তা হবে, ক্ষতি নাই। বাউরি পাড়াকে ডানে বামে ভাগ করে হইল কালচে রক্ত শুকানো চিকনা মিহি পিচের নতুন রাস্তা। বাউরিরা মাটিও ফেলালো। তখন পয়সা দিথ পাঁচ পয়সা ভারা। তা সে রাস্তা দে বড় বড় লরি গেল, আবাদি বড় হইল, বিরাট হইল। আবাদির রাস্তার নিচে বাউরির ঘামের দাগ শুকায় আইল বহুদিন। বিহার রোডের দিক থেইকে উয়াদের তুলে দিয়া বামুং্যালা দাঁত পিষে এখনও। বাউরিরা ঘুইরে ফির আইসি গেল বড় রাস্তার আশটথে পাশটথে। হালে শুরু হইঞ্ছে বড় বড় ফেলাট! বাপ রে উঁচা! মাউলার মাথা ঘুরায়! সে উঠে না! তা বলে ভাইব না উ কিছু নাই জানে! উয়ার বউ কিন্তু উঠথ রোজ! ফেলাটে কাজ কইরথ দুই ঘর। আরো ইদিক উদিকেও কইরথ! রেলপারের খাল পিরায়ে মেহিজামের দিকে। তাথেও কিছু রোজগার হইয় তখন। পিছলা সরকারের আমলে টাকা দিছিল কিছু। ঘরবাড়ি মাটির গাঁথনি করে ইঁট দিছিল তাইতে উয়ারা। তা বাদে কেমন রঙ ট কইরেছিল মাউলা! মাউলাকে মাউলা। উয়ার বাপ পর্যন্ত দেইখে বইলেছিল, “এমন আসমানি ঘর মাউলা! অবাক কইরলি বাপ! এমন ট বাপের জইন্মে নাই দেখি!” তা বাপ না দেখুক মাউলার বউ কয়লা দে তার উপরে দুইখান পাখি দিছিল আঁইকে। তা সে বাপ মারা যাওয়ার পর পরোই। সেইখানে বাপের রূহ লহু জমাট বাঁধা মনে লেয় মাউলার। পাখির ডানায় ডানায় কেমন আদর! মাছির পারা লয়, বাপের ছায়া বেবাক! তা সেও হতে চইলল কত বচ্ছর! তারপর একদিন হর আইল পাড়ায়। হর হইল যাঞে জামাইয়ের নাতি। সঙে আইল ছিপকা বাউরি। সে আজকাল হরর সঙ্গেই ঘুরে। কয়লা করে। পয়সা হওয়ার পর বাউরি পাড়া ছাইড়িছে কয়েক সন আগে। বাউরিরা ঘিরে আইল চারদিকে। হর মানেই পয়সা ট আর তাড়ি ট। তবে কি এলেকশান আইল নাকি! এলেকশান ছাড়া হর বড় একটা আসে না। কিন্তু এলেকশান ছাড়াও হর আইল। বড় রাস্তার উল্টা দিকে যে বাউরি পাড়া তার গা   লাগানিয়া এক বড় বট। গোড়া বাঁধা। তাথে বইসলে হরর ঘেমো মুখের চর্বির তাল টথে এক ট মাছি ইদিক উদিক ভনভনায়, হর বিরক্ত হঞে হাত লাড়ে। মাছি নির্বিকার। মাছি নাই যায়। বাউরিপাড়ার আনাচে কানাচে তদ্দিনে ফের মাছির ডানার শব্দ চলে অবিরাম। দেয়ালে বসে চোদে, তার ডিম ফাটে, তার বছর বছর হু হু করে বাচ্চা হয়। এ গাঁয়েও মড়ি ফেলানোর কাজ করে বাউরিরা। তাথে মাছি হয়। উপরি রোজগারও হয়। বাউরি পাড়ার পাড় ঘেঁইষে বড় আবাদির হাই ডেরেন! সমস্ত আবাদির মইলা জল যায় ক্যানে। সিখানে বাউরির ছায়েরা হাগে, ছোঁচায়, ছায়ের বাপেরাও হাগে, ছোঁচায় কখনও কখনও! নেশার ঘোরে তার মধ্যেই উল্টায় গেইছিল সেদিন বিধু বাউরি! তা সিখানেও মাছি হয়। বট গাছের তলায় গামছা পেতে বসলে হরর মুখ অবিকল জামাইয়ের পারা লাগে মাউলার। “বসেন বসেন হরদাদা! জামাই কেমন আছেন গোও?” অনাদি বাউরির নতুন দুধ পড়া মুখে নিজের বাপের নাম জামাই শুনলে হরর বিরক্তি আরো বাড়ে। চারপাশ বড্ড গুমোটিয়া! ঝড় উইঠবেক মইনে লেয়! অনাদির মুখের দুধ তার সদ্য বিয়ানো বউয়েরও হতে পারে ভেবে হর আপন মনে টেনে টেনে হাসে, খানিক আরাম পায়। তবে জবাব দেয় না। বোতলে ভরা জল খায় ঢকঢক করে। উয়ার সিল্কের পাঞ্জাবী টর গায় ধীর ধীর ছড়াইঞ্জাওয়া জল দেইখতে দেইখতে মাউলা মন উচাটন। লাহ্‌! খারাপ কিছুই হবেক। ডর হয়তো লাইগথ  নাই! ডরাবার কুনও কারণও ছেল নাই! কিন্তু কাল রেইতে উয়ার সপনকে আইসিছিল নহরদা। নহর বাউরি ছিল উয়ার বন্ধু লক। নক্সাল ভাইবে গলায় দা মাইরে বাউরিপাড়ার ডেরেন টথে ফেলায় রাইখি দিঞ্ছিল কেউ। তা লকে বলে হরই ফেলাইঞ্ছিল। হর তখন পাঁড় কংরেসি। সেই হর সিপিয়েমের জামানায় হইঙ্গেল প্রোমোটার। কয়লা কইরে আর কয়লা কইরে পয়সা কইরে লিইঞ্ছিল গেদে। কাল নহর বাউরি কাটা গলা লিয়ে মাউলার শিরের জানলায় আইসে বসে। আদ্ধেকের বেশি কাটা গলায় পিচের রাস্তার পারা শুকনা লহু। তবে লাল নাই। এক ফোঁটা লাল নাই! কাঁপা কাঁপা হাথে জানলার শিক ট ধইরে নহর ফ্যাঁসর কোঁ ফ্যাঁসর শব্দ মারে। যেন কত কিছু বলবার বাকি  ছিল, হইল নাই! হইছে নাই! সেই চাপ চাপ অন্ধকার রক্ত ভাইলথে ভাইলথে মাউলার মনে লেয় বাউরির কি লাল লহু নাই? সে কি অমনই কালো? আগল খুলে মাউলা বাইরে বিরায় আইলে নহর আগে আগে চইলথে শুরু করে এবং থামে যাঞে সেই ঢালাই রাস্তার হাই ডেরেনের পাশ টথে। ইখানকেই নহরের লাশ পইড়েছিল। সেই ডেরেইনে নাইমে নহরের লাশ খালি ঘুরে ঘুরনপাক, একবার ইদিক, একবার উদিক! একবার ইদিক, হেইও একবার উইদিক! দেইখেই মাউলার মনে লিইঞ্ছিল কিছু এক ট হবেক আগুড়ি । ই ছমতা উয়ার বংশের, লয়! হঁ! উয়ার দাদুর ছিল, তার দাদুর ছিল! আর আজ দেখ! ঠিকোই মিলি গেইঞ্ছে! এই জমির উপরে হরর নজর কিছু আজকের লয়! ইয়ার আগেও আকারে ইঙ্গিতে উ বাউরিদের উঠে যেইতে বইলিছে। পারে নাই। এখন বাবুদের জামানা। উয়ারা ফ্ল্যাট চান, বস্তির কারণে উয়াদের ঘরে নাকি গেইদে মাছি! তা সে না পারার কারণেই কিনা জানে না মাউলা, এক দঙ্গল বাউরি মিয়াছিলা হাপুসি গেইলে বাউরিরা অল্প লড়েচইড়ে! বাউরিরা কি বুঝে না? বাউরি সব বুঝে। কিন্তু তার লহু কালা! মাউলার বাপ বৈলথ, বাউরির মিয়া হারাইলে আর খুঁইজথে যাইও না। থানাতে তো যাইওই না। নতুন সংসার কর। আরো মিয়া আনো! মিয়া বাউরির চিরকাইলেই যায়, উ লিয়ে মাথা ট গরম কৈরিছ, কি মইরিছ। যার ঘরে আগুলবার দিয়াল লজ্-ঝইরা, তার ঘরের মিয়াছিলা শুধু পেয়দায় লয়, সারাজীবনই ল্যাংটা, উ লিয়ে ভাইবো না। জিনাসিনি দেইখবেন!" মাছি ট লাগাতার হরক জ্বালিন্দিতে থাইকলে ফির এ কথা টই মইনে লেয় মাউলার! ছোট ছোট কাঁচপাকা  চুলের রাশ জীবন মরণ এক ঠাঁই কইরে খুইজলাথে খুইজলাথে একবার অনাদির দিকে ভাইলে মাউলা। তার বুক দুরু দুরু করে। সে বা হর, কেউ কুনও কথা না বলায় শেষতক ইতস্তত কইরথে কইরথে ছিপকা জানায়েই ফেলে, বাউরিদের এই জায়গা ট ছাইড়ি দিতে হবেক। চিন্তার কুনও কারণ নাই। বেঘর উয়াদেরকে হইথে দিছে নাই কেউ! এই রাস্তার ধারের জমিনের বদল উইধারকে, কিছু জমিন তাদের দিবেক হর। সাফ কথা! আবাদি কইরে লাও ক্যানে! এই ট গাঁইয়ের মুখ। ইখানটথে ফেলাট হবে ভদ্দরলোকদের! 

তা অনাদি শুধায়, “ক্যানে? এমনি ছাড়ব ক্যানে? দুর্গামন্দিরের কাছকে যে ফেলাট হইঞ্ছে, যাদের জায়গা তেনারা এক ঘর কইরে ফেলাট পাইঞ্ছেন। আমাদিগে দিন ফেলাট! আর তাবাদে উধারের মাটি ফোঁপরা, পোঁদের খোঁদলের পারা গত্ত...কয়লা উঠাইঁ উঠাইঁ আর কিছু বাকি নাই!” ছিপকা অপ্রস্তুত হয়! এতটা সে ভাবে নাই। হর শক্ত চোয়াল দেখে মাউলারও চোয়াল বাঁধে। ছিপকা সামহাইলতে যেঞে বলে, “ই ট কি কুনও কথা হইল অনাদি? তুদের গুষ্ঠি হইল রাবণ গুষ্টি! অ্যাদ্দিন ছিলম, আমি জানি না! ছা বউ লিয়ে যয় ঘর বাউরি আছে না, ফেলাট দিতে গেইলে গোটা টয় ছাইড়ি দিথে হবে, লয়!” “ছোটলোক কি সাধে বলে!”- প্রায় জিভের ওপর কথাটা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকলেও ছিপকা জোর সামলে নেয়! এই মধ্যস্থতা হরর বুকে আঁটোসাটো হয়ে বসলে সে বিব্রত বোধ করে। এতক্ষণে সে বলে, “দিতে হলে মানে? দেওয়ার কথা কখন হল?” মাউলার মইনে লেয় সেই গমগমে স্বরে ছিপকার মুখ খইসে এই পইড়লেক ডেরেনে। মাউলার বুকের ভিতরটা বাপদাদুদের জমানো পরতে আবার ছ্যাঁতছ্যাতাইঁ উঠে। মনের মাঝে দাদুর না দেখা চেহারা ঠাওরাবার বেশুমার কোসিস কৈরথে কৈরথে উ ঠ্যাকা ট দেয় লজ্-ঝইরা ঘর-জমিনে। শুধু অনাদি মিনমিন কইরে বলে, “সরাকরা তক্ক ফেলাট পেলেক…” কথা তার শেষ হয় না। তবে ইবার মাউলার আওয়াজ ঘন হয়। দু একটা হাওয়ার জোর ঝাপটে বটের শুকনা পাতা উড়াউড়ি শুরু করেছে। মাছিটা হরর চারপাশে তখনও উড়ে। মাউলা বলে, “ফেলাট দেওয়ার কথা হইছে নাই অনাদি। হইলেও লিথম নাই আমরা! ছিনু বাউরি এ আবাদির পেতিষ্ঠা কইরেছিলেন বাপ, মনে রাখ! এ জমিন বাউরির হকের জমিন। এ জমিন রাখা আমাদের দায়! জমিন আমরা ছাইড়ব না!” বাদানুবাদ বাড়ে। বাউরিরা একে একে ঘিরে আসে মাউলার পিছে পিছে। মাউলা ঠাঁই দাঁড়ায় থাকে আপন জমিনে। হিলে না এত টুকু। হিলানো তাকে যায়ও না! দেড় ঘণ্টা ব্যর্থ চেষ্টার পর হরর মুখের লাল নাইমে আসে ছিইপকার মুখেও। সে জানে বাউরি ঠাইঞ্ছে যখন, লাখ টাকা দিলেও আর জমিন পাওয়া যাবেক নাই! “কাজ ট ঠিক হইল নাই খুড়া, ভগবান আছেন, ঠিক দেইখবেন!” বলার সঙে সঙ বিপিন বলে, “আরে যা! যা! বাইঞ্চোত কুত্তার বাচ্চা, আবার ভয় দেখাছে!” ঠিক এই সময় ঝড় ট উঠে! প্রচণ্ড জোরে সে হাওয়া আছাড় খাঞে ধুলোয় মাউলা আর হরর মুখের মধ্যিখান ঢেকে দেওয়ার মিনিট কয় পর হরর গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়।


হর চইলি গেল। আইল যেঞে গরমকাল। উরি বাপোঃ! শালা ইখানকার শুখা হাওয়া নাকের কাঁচা ফাটায়ে রক্ত তুলে। সেই রক্তের কালো ঢেলা আঙুল দিয়ে টাইনে তুললে তাথেও মাছি বসে। গরমকে গরমে বাউরি পাড়ার ঘুপচি গ্যালান পেকে উঠে! ছোট ছোট পা চলা ঘরফাঁকানি গলিগ্যালার মুখে মুখে ভাপ ছাড়ে। টালির ছোট ঘর তো ভাঁটা হে বেবাক! তখন বাউড়ি পাড়ার ঢল নামে গাঁয়ের ঢালাই রাস্তার উপর! তখন বাউরিরা কেউ হাইড্রেইনে হাগে না। ড্রেনের পাশ ঘেঁষে কুয়ার পাশ ঘেঁষে থরে থরে লোক শুয়ে থাকে সারারাত। বদনে অইল্প হাওয়া খেলে! আহ্‌! কী আরাম! সকালে কুয়ায় স্নান সেরে তারা কাজে যায়। বিকালে এসে স্নান করে বসে পড়ে রাস্তার উপর। ঢালাই যেন সিন্দুর কুড়ান যায়! তার উপর বইসে মেয়েরা চুল আঁচড়ায়, উকুন বাছে, পাকা চুল বাছে, সারাদিনের গল্প করে। ছেলেরা তাস বিছায়, তাড়ি টানে। এখন গাঁয়ে শহরের লোক বাইড়িছে। এই ঢালাইয়ের উপর দে লোকজন যায় না আর। ওই দিকে, দুর্গা মন্দিরের দিক ট দিঞেই লোক যায় বেশি। ওদিকে বাজার! লোকজন এদিক মাড়ায় না বইলে ই রাস্তা টই উয়াদের উঠান। মাগনা এমন উঠানের জায়গা উয়াদের আর কে দিবেক? ছা গেলান ইদিক থেকে উদিক দৌড়ে। উদিক থেকে ইদিকে দৌড়ে। নাকে পোঁটা মুখ পিরাইঁ থুনিতে দুলে। কেউ কেউ কাঁইদতে কাঁইদতে হাই ড্রেনের উপরেই মুইতে দেয়। ধমকও খায় কারো কাছকে! হবেক কেউ মাসি পিসি! সবাই তো লতায় পাতায়! তবে সারা রাত রাস্তায় শোয় শুধু মদ্দ। ছা গেলানও! বউবিটিরা যে যার ঘরে যায়। আর তখন ঘরে যায় যে মদ্দ সে লাজে আর টিটকিরিতে কয়দিন খুব একটা মুখ দেখাতে পারে না। হর যেইদিন চলে যায়, তার কয়দিন পরে সেই কেউ না যাওয়া সরু ঢালাই রাস্তা যনখানে বড়রাস্তায় যেঞে পইড়িছে  সেই মুখ টথে একটা বড় কয়লা বোঝাই ডাম্পার গোঁত মাইরে ঢুইকি পড়ে। রাত তখন গহিন! ঢুইকে আগুড়ির লাইট পোস্টে গুঁতা মাইরে বিকট এক ট আওয়াজ করে দাঁড়াইঞ্জায়। ডেরাইভার, খালাসিকে খুঁইজে পাওয়া নাই যায়। কী কৈরে ডাম্পার ঢুইকল এতথ দূর কিছুই বুইঝতে লারে পুলিশ! তা খাতায় কলমে উয়াদের পুলিশ খুঁজে পায় নাই আজ তক্ক! আর বাউরিদের এগারো জন সাফ! তিনটা ছায়ের ছ্যাতরানো বাকি সেই ঢালাই বেয়ে মাটিতে মিইশে যাওয়ার কসিস কইরতে থাকে। গোটা সিমিন্ট লহু আর লহু। সেই আরশি গিলা টলটৈলা লালে মাউলা নিজের মুখের ছবি দেখতে পায়। লাশ গেলানের আশেপাশে বহুৎ মাছি উড়ে। এই লহু সহজে কালো হয় না। মাউলার আদেশে বাউরিরা ছা বউ মেয়ে লিয়ে বড় রাস্তা আটকায় দেয়। তা ভিড় কে ভিড়! গেইদে লোক। লাশ উঠাতে আইসে পুলিশের পাগ্যালান আঁইটে যায় সেই রক্তে। পুলিশ ভয় পায়। পুলিশ মারে লাঠি, আর বাউরি মারে ঢিল। তা কৈরথেই ছোটবাবুর মাথা ট যায় ভট কৈরে ফাইটে।  আশপাশকে গাঁয়ের আত্মীয় স্বজন লিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো লোক থানা ট ঘিরে চাক বান্ধে। বিজেপির তিওয়ারিরা চোঙ্গা ফুঁকে। তাদের আওয়াজে বাউরিও গলা মিশায়। মাইক থেইকে হাত তিনেক দূরে উয়ারা সুধানিধির মাকে দাঁড় করায় গর্জায়। মাউলার চোখ জ্বলে। আর কী হাতাতলি! চটোপট চটোপট! শ্যাষে বিজেপি সরকার মাথা পিছু দশহাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেক। বাউরিরা খুশি। অমল তিওয়ারি মাউলাকে ডাইকি বলে, তোদের কাজটা করে দিলাম মাউলা…...তৃণমূল কি করল? দেখ! গতবার অত ওদের হয়ে চেঁচালি তো? এইবার পদ্মফুল কিন্তু!” মাউলা মাথা নাড়ে। মোট টাকা থেকে বাউরিরা পাইলেক হাজার পঁচিশ। বাদবাকির হিসাব মাউলা কিছু বুঝে না। 


সেদিন ছিদামের গুমটিতে দুপুর থেকেই ছিল মাউলা। আহা! অমন তাড়ি হয় বড় কম! খাঁটি রস! নেশা চইড়ছিল যেন দমকে দম! গুষ্ঠির তাড়ি টেইনে লগবগ কইরথে কইরথে মদনের কাঁধে ভর দে ঘরে ফিরার পর প্রথমে মাউলা যখন ছিলার বউয়ের কাছ থেকে খবর পায়, তখন শব্দ গ্যালা উয়ার কানে ঢুকে নাই। ধীরে ধীরে মাথার ভিতরের হলকা সেই শব্দ জুইড়তে থাকলে শরীরের গরম মাউলার মাথায় চইড়ি যায় ফট করে! সেই গরমেই সে বেটার পা ভারি বউয়ের গালে সমানে থাপ্পড় কষিয়ে যেতে থাকে। থামতে হয়তো সে চাইছিলই, কিন্তু মাথার ভিতরে বিছার অবিরত পাশ ফিরা আর খলবলি উয়ার হাথ যেন অলগ কৈরি দেইছে আপন মাথা থেইকে! দম উয়ার আটকায় আইসে, কিন্তু হাথ থামে না। তা কইরথে বেটার বউয়ের চিৎকারে অনাদি, বিপিন ইয়ারা ছুইটে আসে! মাউলাকে দুই জনে মিলে চাইপে ধইরলে মাউলা আবছা সংসার নিয়ে ষাঁড়ের মতো কুঁথাতে থাকে। ততক্ষণে একের পর এক থাপ্পড় খেইতে খেইতে পা ভারি বউ হুমড়ি খেয়ে উঠানে পইড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। মাউলা খেয়াল করে তার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে একট মোটা অন্ধকারের স্রোত বিরায় আইসছে। যত বখোত যায় মাউলার উদ্ধত পেশিবহুল কালো শরীর ধীরে ধীরে নিজের ছড়ানো ছাল নিজের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে থাকে। অনেকক্ষণ চুপ করে দাওয়ায় বসে থাকলে মাউলার নিজের শরীর খুঁড়ে রক্তের রঙ দেখতে সাধ জাগে! বাপ আর দাদুর রক্তের রঙও দেখতে হইথ, কিন্তু উপায় নাই। কোলিয়ারির বুকের আগুন নিভে না। রাত বিরেতে রাস্তার পাশে মাইলকে মাইল ধিকি ধিকি আগুন দেখা যায়। সে আগুনে মাটি শুধু লাল হয়, আকাশে তার ছাপ পড়ে না! বাপের চিতায় আকাশেও ছাপ পইড়িছিল। দাদুর চিতাতেও লিচ্চয় পইড়িছিল, মাউলার চিতাতে পড়ে না কেন? তার বুকের চিতা কোলিয়ারির বুকের পারা মাইলকে মাইল ধইরে ধু ধু করে! সে আগ বুঝে কেউ! এই যে ঘরে এতগ্যালা লোক! সব ফালতু! “সর! সর!” বলে আকস্মিক মাউলার চিৎকারে ঘর ভর্তি লোক চমকে উঠে! বিপিনের বউ মাউলার বেটার বউকে তুলে বিছানায় শুয়ায় জল দিছিল, হাওয়া দিছিল। তার হাত থেকে ভিজা ন্যাতা কাইড়ে লেয় মাউলা। মাথা তার আবার গরম হছে! কীসের উপর এই জ্বলন, কাদের উপর জ্বলন মাউলা বুঝতে পারে না! তবে গেদে জ্বলন! সেই জ্বলন তার পেট থেকে বুকের আনাচ কানাচ হাতড়িয়ে গলা জ্বালিয়ে বমির পারা হড় হড় করে অবাধ চিৎকার হয়ে বেরোতে শুরু করলে সে টলতে টলতে রাস্তার দিকে এগোয়! “সর সর”! “ও খুড়া! কোথায় যাছো গো?” “ও খুড়া!” অনাদি দৌড়ে আইসে হাত থ ধরে। মাউলা এক ঝটকায় হাত ছাড়ায় লিয়ে দৌড়থে থাকে! এই বাউরিপাড়ার ইতিহাসে কেউ হারিয়ে যাওয়া মেয়েছেলে খুঁজতে বিরায় নাই। মাউলা উন্মাদের পারা এই বাউরিপাড়াকে, লিজের বাপকে, দাদুকে  পিছনে ফেলায় ছুটথে থাকে! পিচের রাস্তা ছাইড়ে টাঁইড়ে। গাছের শিকড়ে লাইগে নখ তার ফেইটে যায়। মাউলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ফের উঠে, ফের পড়ে, ফের উঠে! মাউলা দৌড় থামায় না। এই ছিঁড়া পা আরো ছিঁড়থে থাকা গাছ ট্র গাছালি টর শিকড়ের মইধ্যে উয়ার কালো লহু মাখাতে মাখাতে উ কথ দূর যাবেক, সি ট উয়ার মনেই লেয় না…


তখন স্টেশন পারের লম্বা দেয়ালে ঘষটে ঘষটে থাকা বড় গাছের ঝুরিগেলানের সমস্বরে ডাকতে থাকার সময়। টেশন পারের ই জায়গাটা আগে খোঁজার দরকার। খারাপ জায়গা বলতে এটাই। এর আগে পিছে বাস চলে, লোক চলে। আলো আছে। শুধু এইটুকু শুনশান আন্ধার পেরিয়ে মাউলার বউকে রোজ কাজে যেতে হয়। আকাশে সবে চাঁদ উঠেছে। মাউলা বাউরির ভিজা ন্যাতা বান্ধা ঘোলাটে মাথা সেই চাঁদ একবার ছোঁয়, একবার নেমে যায়। মাউলা দৌড়ে। মাউলা আছাড়ি পিছাড়ি যায় আউলান আলুইড়া টালুইড়া জমিনের বুক চিরে। সেই মাথার উপরে ভিজা চুঁইয়ে মাথার ভিতরে গেলে ফোঁস করে আওয়াজ হয় আর সেই ধুঁয়া মাওয়ার চোখ বেয়ে ছড়ায় পইড়থে থাকে টাঁইড়ে টাঁইড়ে...রেল লাইনের পাতে…সোজা তখন ক্রমে ঢইলে যেতে থাকে বড় বড় ঝুপ্সি ছায়াগ্যালানের দিকে...বিছা লড়ে…...বিছা কাটে...মাউলা ছটফট কইরে গতি বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে...হছে নাই...খ্যাপাচোদা শরীর টাল দেয় খালি...বড় একটা তাল গাছের গুড়ি ধরে মাউলা জীয়ন্ত কাতলের পারা দম লিথে থাকে...মাউলা দম লিথে থাকে…এই সময় রেল পাড়ের খালের ধারে চার পা ওয়ালা একটা বড় জানোয়ার...হেঁড়োল লয়…বাঘোই হবেক...তার পিঠে চার হাতের জিনাসিনি মুরোতি গোওও...লাল পাড় হলুদ শাড়ি... মুখ ট আন্ধারে ঢাকা...ই সময় হঠাৎ জানোয়ার ট ইদিকে ফিরলে মাউলা চৈমখে উঠে…...না-মালুমেই কখন তার রক্তাক্ত বুকে ও পায়ে গতি ফিরে...মুখ ট একদম, একদম আদুরি বসানো গোওওও...…মাউলা সেই রেলপাড়ের খালের কাছাকাছি…আদুরিইইইইই অঅঅঅঅ আদুরিইইই…মাউলা ডাকে…কুনও আওয়াজ নাই…আদুরিইইইইই অ আদুরিইইইইইইইই…কুনও ফিরা আওয়াজ নাই…...বেবাক ঝিঁঝিঁর ডাক শ্যাওড়ার কাঁটা গলে শেয়ালকাঁটার ঘনঝাড়ে জালের পর জাল ঘনিয়ে তোলে…আদুরিইইইইই…স্বর আপনি খাদে নেমে যেতে থাকলে মাউলা বোঝে গলা তার টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে…মাথা তার টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে…বুক তার…নেশার অতল থেকে আঁটুরে হাঁকুপাঁকু বেরোনোর চেষ্টায় কলজেটা তার জিভের ডগা অবধি ভার হয়ে চেপে বসতে থাকে যেন…এইসময়ে চাঁদের ঘাম তার চোখে চিকচিক করে, নাকে চিকচিক করে, খালি রোমশ বুকের আনাচে কানাচে চিকচিক করে। মুখের দু পাশের পেশি বেবাক হালকা বোধ হওয়ায় মাওলার মুখ বন্ধ হতে চায় না… সে জীয়ন্ত লাশের খোলা মুখের চারপাশে মাছি আসে…মুখ থেইকে লাল গড়ায় তার দাড়ি, বুক, পেট একাকার…ঘামে আর লালে তখন ফারাক নাই… খাল পাড়ের নরম কাদায় হুড়মুড়ায়ে পা তার গেঁথে যেতে চায়…ছিঁড়া পায়ে ঠণ্ডক লাগে…আরাম লাগে… সে কাদার তাল উপড়িয়ে পা তুলে আনে…সেই বিছা ভিতরে সাপ হঞ ফোঁসফুঁইসায়ে ছোবল দিলে মাথার শিরায় শিরায় বিষের জ্বলন তাকে খালপাড়ের জঙ্গলের আরো গভীরে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ও সে একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনতে পায়… যেন বহুদূর… যেন রূহের আওয়াজ…সেই ছিলা রূহ তাকে কিছু একটা বলতে চায়… মাওলা কান পাতে… পা তার মাটিতে এক হাত বসে যায়… খালের উঁচু পাড়ের ওপরে রেললাইন… মাউলা পাড়ে নাই চড়ে… ধীরে ধীরে মিহি রূহের কথা পরত পরত জমে রেলের আওয়াজে মোটা হয়ে উঠে… খালের জল চিকন কাঁপে…ঘোলা চোখ চিকন কাঁপে…নরম মাটিতে পা আরো গেঁথে যাওয়ার আগেই ঝড়ের 

বেগে পেরিয়ে যেতে থাকে একটা রেলগাড়ি...এই সময় হাতখানেক বইসে যাওয়া পাঁকের তলায় পায়ে তার কিছু একটা শক্ত মাল ঠেকলে মাউলা বসে ও সিখানে হাত ট ঢুকায়...মাউলার চোখ থেকে জড়তা গড়িয়ে গড়িয়ে হাতে নেমে এলে জিনিসটা ফের ঠাওর কইরথে উয়াকে গেদে কসরত কইরথে হয়… শেষমেষ বিরায় পাঁক এঁটো জিনিষ ট...সাদা বাঁটয়ালা এক ট হাড়গিলা ট্যারাবাঁকা বন্দুক...জিনিসটা হাথে ধইরথেই কী আইশ্চইর্য, বিছার কাটুনি, সাপের ছোবল শান্ত...বেবাক শান্ত…চাঁদের আলো সেই কাদা চুঁয়ায় ভিতরের বাঁটে দুধের গরম ভরে আনলে মাউলার বন্দুকটা মুছে কোমরের গামছায় জড়িয়ে নেয়...


পরদিন ভোরে মাউলাকে খালপাড়ের কাদা থেকে তুলে নিয়ে আসে বিপিন আর বিধু। অনাদির কথায় উয়ারা পিছে পিছে গেইছিল। ভোর রাতের দিকে মাউলার চিৎকার ঠাণ্ডা হয়ে এলে উয়ারা মাউলাকে তুলে আনে। কালো পাঁকে লতপত মাউলা বাউরির লহুর কালো রঙ তখন বিরায়ে আইসিছে চামের বাইরে। মাউলার বেটার বউয়ের পেট খালাস হয়ে যায়। মাউলার বউও আর ফিরে না। বাউরি পাড়া দুদিন একটু থিতিয়ে থাকে। সে নেহাত মাউলার পরিবার বলেই। তারপর আবার যেমনকে তেমন। কারোর কিছুই থেমে থাকে না। শুধু মাউলার বেটা লক্ষ্য করে বাপের কোমরের গামছায় একটা কিছু সারাক্ষণ জড়ানো থাকে। মাউলা বন্দুকটা কাছে কাছেই রাখে। ওর উপরেই মা জিনাসিনি দেখা দিইঞ্ছিল বাপ! উ তো আর যে সে জিনিস লয়! মায়ের দেন, গায়ে রাখলে গা বড় ঠাণ্ডা থাকে। নাইলে সেই বিছা। রোববারের সকাল আজ। তাড়ির ঠেকে সকাল সকাল সাত আট চোঙা তাড়ি টানে মাউলা। তারপর কিছু জিনিস লিথে নিরাপদর মুদির দোকানে যায়। হরকে সে দেখে নাই। দেখার উয়ার গরজও ছিল না। ঠিক এই সময় তার কোমরের গামছার ওপরে একটা মাছি এসে বসে…মাউলা ঝপট দিলে তার হাওয়ার বেগ নিজের উরু পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারে না। মাছি নির্বিকার। তার গায়ে হাওয়া লাগে না। কিসের একটা ঝোঁকে বা সকালে খাওয়া তাড়ির নেশাতেই হবে, মাউলা গামছাটা ধরে জোর ঝাইড়লে গামছা উয়ার কোমর থেকে খুলে যায় এবং বন্দুকটা বাজারের ঢালাই রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ে।


অবাক কাইণ্ড হে! একের পর একের পর এক, গুলি বিরাইঞ্জায় আপুনিই! বিশ্বাস করেন, চোদনা যে ঐ পথেই যাছিল আমি দেখিই নাই উয়ার গায়ে গুলি লাগার আগে তক্‌খ!


মাউলা আপুনি বলে। পান্নালাল সুযোগ ট বুইঝে এই ফাঁকে আরেকটু এগায় আসে...

বটে! বন্দুক কুড়াইঁ পেলি কুথায় না রেলপাড়ের খাইলে, সে বন্দুক লিইঙ্গেলি কুথায় না রোববারের বাজারে, মাছি আইসে বইসলেক কুথায় না মাজার গামছায়, আবার পইড়ি যেয়ে সে বন্দুক কিনা আপুনি চইলতেই থাইকল? সকালে ক হাঁড়ি খাইঞ্ছিলি বাপ? হঁ? আমি খাই নাই, বুইঝলি! তুর ঐ তাড়িখোর বাউরি ছা গ্যালাকে বুঝাবিগা! তা সত্যি বল মাউলা! এত সোন্দর বন্দুক পালি কুথায়?

জিনাসিনির দেন লয়! 

আবার? আরে হাতির দাঁতের বাট বটে হারামি! নৌটঙ্কি কম জানো না, লয়? এমন দেখাইছে, যেন জানথই না! কত টাকায় বাগালি? বড়বাবুর বড় পছন্দ হৈঞ্ছে। বাড়ি লিয়ে গেল, ছেলে বউকে দেখাবে বইলে...


বড়বাবু সব ব্যবস্থা করেছেন! অন্য সাধারণ একটা বন্দুকে মাওলার হাতের ছাপ থেকে শুরু করে গুলি বদলানো পর্যন্ত সব! রিপোর্ট তৈরি! এমনিতেই মহা ঝামেলাবাজ এই ছোটলোকদের কেস নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না! বেরোতে পারবে না! কিন্তু বন্দুকটা একটা অদ্ভুত মোহ তৈরি করেছে বড়বাবুর মনে! আহা! এত সুন্দর বন্দুক! মীনাকে দেখাতেই হবে। ওর ভাইয়ের আবার পুরোন জিনিষ জমানোর শখ! ও নিশ্চয় বলতে পারবে দেখে। ছেলেটাও এমন জিনিষ জীবনে দেখে নি!


কিন্তু বন্দুক নিয়ে যাওয়ার কথায় মাউলার লাল চোখ আবার ঘোলাটে বিড়বিড় করতে থাকে, “বন্দুক ট যে আপুনি চলে, ফেলাই দিলে আপুনি পোয়াতি, লাশমারা বন্দুক আমাকে মাইরিছে দেখ, দেখ অল্প, হরর লাশ ট, চোয়ালোই ছিল না, ল্যাওড়াও টও না, লাশের সব ঝইরি যায়, দেখ ক্যানে, আমার ল্যাওড়া আছে? দেখ, হেদ্দেখ………”, বিড়বিড় সে করে বটে, কিন্তু আদতে বন্দুকের ছবিটুকুন মাথার কুলুঙ্গির ভিতরে থাকায় তার শরীর মাথা এখন অসম্ভব ঠাণ্ডা...শুধু মাছির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে…...নিজের লুঙ্গি তুলে ধরতে থাকে তার অন্যমনস্ক হাত, খানিকটা যেন দেখানোর জন্যেই…...মাউলা তখনও বিড়বিড় করে চলেছে...


সেই লাশের পারা ঠাণ্ডা বিচি পান্নালালের গলায় জড়িয়ে যেতে থাকলে প্রচণ্ড ভয়ে লাফিয়ে সরে আসে ও! প্রাণপণে হাঁফাতে থাকে…...


ঠিক এই সময়ে মাউলার নাক বরাবর বসে থাকা মাছিটা উড়ে যায়…

রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

                                        


এই সংখ্যার গদ্যকার মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়৷জন্ম হাওড়া জেলায় । পড়াশোনা বাণিজ্য নিয়ে হলেও শৈশব থেকেই সাহিত্য প্রীতি ।  সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল রবিবাসর, কথাসাহিত্য, গল্পপাঠ, পুরুলিয়া দর্পণ, ভবিষ্যত সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং অবাণিজ্যিক পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে একটি অণুগল্পের একক সংকলন শপিজেন বাংলা থেকে । তাছাড়াও বহু যৌথ সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গল্প ও অণুগল্প । আসুন পড়া যাক তার একটি গল্প।



অন্তর্ধান

দূরে ঢালাই কারখানায় যখন ঢং ঢং করে বারোটা বাজলো, ঠিক সেই মুহূর্তে সুবর্ণ তার কাজ শেষ করে হাতটা ঝাড়লো । খুব নোংরা হয়ে হয়ে গেছে হাতদুটো । কিছুটা সময় নিয়ে প্রথমে হাতটা হাল্কা হাতে ঝেড়ে, তারপর পাশে জলের বালতিটার দিকে তাকালো । যাহ্‌, বড্ড ভুল হয়ে গেছে । তাড়াহুড়ো করে জলের বালতি আনতে ভুলে গেছে । এই তার মস্ত দোষ । কিছুতেই নিঁখুত হয় না তার কাজ । কিছু না কিছু ঘাটতি থেকেই যায় । যাকগে, আজকের কাজে এটা কোন ভুল হিসেবে ধরা যায় না । তবু মনটা খুঁতখুঁত করছে সুবর্ণর ।

তবে মনের মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব টের পাচ্ছে । ইচ্ছে করছে এখানে চিৎ হয়ে শুয়ে ছোটবেলার মতো চেঁচিয়ে কোন কবিতা বলতে । সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে ভেবে নিজেকে নিরস্ত করে সুবর্ণ । তবে এটা ঠিক, আর উঠতে-বসতে তাকে জ্ঞান শুনতে হবে না, মনে হবে না সে ছোট হয়ে যাচ্ছে কারো কাছে । শুধুই কী মনে হওয়া ? ভাবে সুবর্ণ । না কক্ষনো নয় । তাকে ডেলিবারেটলি ছোট করা হতো । চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হতো সে কতটা ছোট, কতটা নীচ মনের অধিকারী । শুধু কী তাই ? তার সঙ্গে যেভাবে কথা বলা হতো, তাতে পরিস্কার বুঝিয়ে দেওয়া হতো সে আসলে কতটা ব্যর্থ মানুষ । আর তারপর রিয়াক্ট করলে ?  শুনতে হতো, “তুমি অসুস্থ । তোমার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন ।” চেষ্টা চলেছে প্রচুর সুবর্ণকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার । তবে সুবর্ণকে বাগে আনা এত সহজ নয় । 

এই তো দিন দশেক আগের কথা । সেদিন সে আর . . . আচ্ছা, প্রথম থেকে শুরু করব নাকি দশদিন আগের কথাটা বলে নিয়ে আরও পুরনো ঘটনায় যাব ? 

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে সুবর্ণ কে আর তাকে কার কাছেই বা জ্ঞান শুনতে হয় আর কার কাছেই বা ছোট হতে হয় । তাহলে একটু নিজের মতো করে বলি । দেখুন তো আপনাদের বুঝতে সুবিধা হয় কিনা ।  

সেদিন সুবর্ণদের বাড়িতে খুব খুশির দিন । দীর্ঘ সাত বছর পর সুবর্ণর মায়ের কোল আলো করে এই প্রথম নতুন অতিথি ওই বাড়িটায় আসতে চলেছে । সব ঠিকঠাকই ছিল । কিন্তু সুবর্ণর মা নার্সিং হোমের সামনে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কীভাবে যেন পা জড়িয়ে পড়ে গেলেন । আশপাশ থেকে হইহই করে উঠল মানুষজন । শুধু সুবর্ণর বাবা বলে উঠলেন, ‘ক্যালাস একটা । কিছুই পারে না ।’ মায়ের গর্ভে সেদিন সুবর্ণ কেঁপে উঠেছিল । 

এই বিপত্তি সত্ত্বেও সুবর্ণর জন্মে কোন সমস্যা হয়নি । আর শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়নি সুবর্ণ । বাড়ির লোক থেকে ডাক্তার সবাই স্বস্তির শ্বাস নিয়েছিল ।

সেই সুবর্ণ এখন অ্যাডাল্ট । বিয়ে হয়েছে বছর দুই । আনন্দীর সঙ্গে । স্মার্ট, আধুনিকমনস্ক মেয়ে আনন্দী । চাকরি করে একটা সরকারী স্কুলে । তার সঙ্গে একটা এনজিওর সঙ্গে যুক্ত । একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছে তারা । সুবর্ণর ইচ্ছাতেই ওরা বাবা-মাকে ছেড়ে এসে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে । কিন্তু আনন্দী চেয়েছিল সুবর্ণর বাবা-মা আর তারা একসঙ্গে সুবর্ণদের নিজেদের বাড়ি টালাতে থাকবে । 

বিয়ের পর থেকে সুবর্ণর মাকে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হতো আনন্দীর । সব বিষয়ে ভয়, জড়তা, আড়ষ্টতা । আর সুবর্ণর বাবা প্রতি মুহূর্তে ওই মহিলার ওপর যেন মারমুখী হয়ে আছেন । সুবর্ণকে কিছু বলতে গেলে সে বলত, ‘বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামাতে যেও না ।’

‘কিন্তু তুমি ? তুমি তো মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারো ।’

‘কেন ? কিসের জন্য ? মা-কে তুমি চেনো না । মায়ের সবকিছুকে গুবলেট করে দেওয়া স্বভাব । তাই বাবা ওভাবে রেগে যায় । ঠিক করে । আমার নিজেরও বিরক্ত লাগে ।’

অবাক লেগেছিল আনন্দীর । খুব খারাপ লেগেছিল সুবর্ণর কথা । কিন্তু নতুন জীবনের শুরু, চোখে স্বপ্নের মায়াকাজল, এই খারাপ লাগাকে স্থায়ী করতে পারেনি ।

আনন্দী আস্তে-আস্তে কেষ্টপুরে তাদের নিজস্ব দু-কামরার ফ্ল্যাটে নিজেদের জগৎ গড়ে তুলছিল । কিন্তু বাধ সাধল সেদিনের সেই ঘটনাটা । পার্টি ছিল সুবর্ণদের অফিসের । আনন্দী স্বীয়-স্বভাবের গুণে খুব অল্প সময়ে সবাইকে আপন করে নিতে পারে । আর অন্যেরাও বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাকে কাছে টেনে নেয় ।

সেদিন সুবর্ণদের অফিস পিকনিক ছিল । খুব জমজমাট হাসিখুশি পরিবেশ । আলাপ হয়েছিল অনেকের সঙ্গে । তার মধ্যে সুমনদা একজন । প্রাণখোলা মানুষটার সঙ্গে আনন্দীর অনেক কথা হয়েছিল । সুমনদাকে বেশ ফ্যামিলিয়ার মনে হয়েছিল আনন্দীর । তার বাড়িতে কে আছে, ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে, কী পছন্দ . . . একেবারেই ঘরোয়া আলোচনা । কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢুকেই সুবর্ণর আচমকা চিৎকারে চমকে যায় আনন্দী ।

‘এত কী কথা সুমনদার সঙ্গে ? পিকনিকে তো আরও অনেকেরই মিসেস গিয়েছিলেন । কই, তারা তো কেউ সুমনদার সঙ্গে গল্প করতে বসে যায়নি ?’

‘সেরকম কোন কথা নয় । এই ছোটবেলার কথা, বাড়িতে কে কে আছে এইসব জানতে চাইছিলেন ।’ থতমত খেয়ে বলে আনন্দী ।

‘ও, আচ্ছা ! সেরকম কোন স্পেশাল কথা হয়নি বলে আফশোষ হচ্ছে বুঝি ?’

‘ছিঃ ! কী বলতে চাইছ তুমি ?’

‘যা বলতে চাইছি সেটা ঠিক বুঝেছ । আর ন্যাকামি করতে হবে না ।’

স্তব্ধ হয়ে যায় আনন্দী । এ কোন সুবর্ণকে দেখছে ! বিয়ে ছমাস হলেও আগে এই মানুষটার সঙ্গে গত দেড় বছর মেলামেশা করেছে । কখনো তো এই ধরণের কথা শোনেনি ।

  হঠাৎ মনে পড়ে যায় আনন্দীর । তখন তারা চুটিয়ে প্রেম করছে । সিসিডিতে কফি খাচ্ছে । উল্টোদিক থেকে একটা ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল তাকে । আনন্দী বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল । কিন্তু সুবর্ণ দুম করে উঠে বলে উঠেছিল, ‘স্যরি ভাই, ম্যাডাম বুকড্‌ । চোখটা এবার সরিয়ে নিন ।’

তখন খুব জোরে হেসে উঠেছিল আনন্দী । কিন্তু আজ ? খুব খারাপ লাগছে সুবর্ণর কথাগুলো । কেমন অচেনা মনে হচ্ছে এতদিনের চেনা মানুষটাকে । একসঙ্গে চলার ছন্দে সেদিন প্রথম তাল কেটেছিল ।

এর মাসখানেক পরের কথা । আনন্দী হাসতে-হাসতে হাতে একটা কাগজ নিয়ে ঘরে সুবর্ণর কাছে আসে ।

‘এই, এটা দ্যাখো, একটা দারুণ খবর ।’ আনন্দী কাগজটা সুবর্ণর হাতে দেয় ।

‘ও আচ্ছা ! এখন মাস্টারনীর  সমাজসেবীর তকমা না পেলে চলছে না ?’ চিবিয়ে-চিবিয়ে বলে সুবর্ণ ।

‘মানে ! কী যা তা বলছ ? এটা আমার অ্যাচিভমেন্ট । এই কাজটা বিয়ের আগে থেকে করছি । আজ তার স্বীকৃতি পাচ্ছি । শুধু তাই নয়, এই পুরস্কারের সঙ্গে যে টাকাটা পাব তাতে ওই অসহায় বাচ্চাগুলোর ঠিক করে থাকা, ন্যুনতম খাওয়া, কিছুটা পড়ার খরচ উঠে যাবে । এটা কম কথা নাকি ?’

‘যাও, যাও । বেশি জ্ঞান দিতে এসো না ।’

সরে এসেছিল আনন্দী । কিন্তু বাধাটা এভাবে আসবে ভাবেনি । যেদিন তার পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠান, সেদিন বিকালে তৈরি হতে গিয়ে আলমারির চাবি কোথাও পায় না । তন্নতন্ন করে সারা ফ্ল্যাট খুঁজে ফেলে । কিন্তু না, কোথাও পায়নি চাবি । সুবর্ণকে ফোন করে । বারবার শোনে ফোন স্যুইচড অফ । কান্না পেয়ে যায় আনন্দীর । এই কাজ সুবর্ণ ছাড়া কেউ হতে পারে না । কেন এমন হয়ে গেল সুবর্ণ ! সেদিন সামনের ফ্ল্যাটের মাসিমার শাড়ি পরে গিয়ে কোনরকমে মান বাঁচায় আনন্দী । 

সুবর্ণর আচরণে ক্রমশ হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে আনন্দী । শ্বশুরমশাইকে সুবর্ণর কথা জানালে তিনি অক্লেশে বলে দেন, ‘অ্যাডজাস্ট করে চলতে শেখায়নি তোমার মা বাবা ? স্বামীর ত্রুটি না খুঁজে স্বামীর মনোমত হয়ে চলার চেষ্টা করো ।’

আনন্দী আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার চেষ্টা করে । সুবর্ণ যাতে রাগ না করে, তার সঙ্গে দূর্ব্যবহার না করে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করত । আচমকাই এলো ওদের দুজনের জীবনে খুশির খবর । ওরা দুজনেই একেবারে খুশিয়াল হয়ে উঠল । মা হতে চলেছে আনন্দী । সুবর্ণ অস্থির হয়ে উঠল, কী ভাবে আনন্দীর সেবাযত্ন করবে । ডাক্তার, ওষুধ তো বটেই, নিজে হাতে রান্না করেও আনন্দীকে খাওয়াত । একদিন একটা ছোট্ট পুতুল এনে হাজির করল সুবর্ণ । আনন্দী তো খুব খুশি । কী দারুণ দেখতে পুতুলটাকে ! চোখদুটো পিটপিট করছে, একরাশ কোঁচকানো চুল, গাল থেকে গোলাপি আভা বেরোচ্ছে । পুতুলটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে আনন্দী বলে, ‘এইরকম একটা তার মেয়েই চাই ।’ সেদিন সুবর্ণর চোখদুটো খেয়াল করে উঠতে পারেনি । পারলে হয়তো . . .

নাহ্‌, পারেনি আনন্দী মা হতে । আচ্ছা আনন্দী পারেনি, নাকি তাকে মা হওয়ার পরিপূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করা হলো । আর সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে । সেদিন মনে না হলেও আজ আনন্দী নিশ্চিত । কিন্তু সে মুক্তিও চায় না । ভাবে সুবর্ণ ঠিক বুঝবে তাকে আগের দিনগুলোর মতো । নিজেকে ঠিক সংশোধন করে নেবে ।  আবার তারা সুন্দর করে তাদের জীবন কাটাতে পারবে । 

বাথরুমেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আনন্দী । অ্যামবুলেন্সে সারাটা রাস্তা তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল সুবর্ণ । বুঝিয়েছিল, আবার সে মা হতে পারবে । তাদের জীবন একটা পুচকে আলো করে রাখবে । ওই পুতুলটার মতোই তাদের একটা মেয়ে হবে ।

শোক একটু হলেও সামলে উঠছিল আনন্দী । সুস্থ হয়ে নার্সিংহোম থেকে ফেরার দিন তিনেক পরে সুবর্ণ গভীর আদরের মাঝে যে কথাটা বলে উঠেছিল তাতে চমকে উঠেছিল আনন্দী ।

‘আমাদের মাঝে কেউ আসুক আমি চাই না । সে নিজের সন্তান হলেও …’ 

কথাটার শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি আনন্দী । দৌড়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়েছিল । বাইরে সুবর্ণর চিৎকার আর গালিগালাজে ঘরের ভিতর বাকি রাতটা ঠকঠক করে কেঁপেছিল । ভোররাতে সুবর্ণ যখন কেঁদেকেটে ক্ষমা চেয়েছিল তখন আনন্দীর মন আবার দুর্বল হয়ে পড়তে চাইছিল তার ভালবাসার মানুষটার ওপর ।  

ইদানীংকালে সুবর্ণ তার আদরকে অত্যাচারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে । কিন্তু আনন্দী সবটুকু সহ্য করছে নিজের ভিতর আর একটা প্রাণের উপস্থিতি পাওয়ার জন্য । তার আশা অলীক জেনেও বুক বাঁধছে । 

সেদিনের রাতের পর সুবর্ণর মধ্যে অনেকটা বদল লক্ষ্য করেছিল আনন্দী । তাদের জীবনের দিনগুলোর একঘেয়েমি কাটাতে আনন্দী একপ্রকার জোর করে সুবর্ণকে নিয়ে এসেছিল ওদেরই দেশের বাড়িতে । সুবর্ণদের দেশের বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকে । বহুদিনের বিশ্বস্ত লোক বেণীকাকা বাড়ির দেখাশোনা করে । 

প্রথম দুটোদিন খুব ভাল কেটেছিল ওদের । কিন্তু গতকাল রাতে যা ঘটল তাতে শেষপর্যন্ত আনন্দী সব কিছু ধরে রাখতে পারবে কিনা সেই ব্যাপারে নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে । গতকাল রাতে চূড়ান্ত আদরের মধ্যে সুবর্ণ সজোরে তার গলা টিপে ধরে । ভীষণরকম ধ্বস্তাধ্বস্তির পর নিজেকে ছাড়াতে পারে আনন্দী । 


# # #


কাজ মিটিয়ে সুবর্ণ ঘরে এসে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে । খুব হাল্কা লাগছে তার নিজেকে । তার সঙ্গে একটা ছটফটানিও কাজ করছে তার মধ্যে । গুনগুন করে গানের এক কলি গেয়ে নেয় । তারপর বিছানা থেকে উঠে ঢকঢক করে বেশ অনেকটা জল খেয়ে নেয় । এবার সোফায় বসে কুশনটা বুকে টেনে নেয় । কাল রাত থেকে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত যা যা ঘটেছে আরও একবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে করতে চায় সুবর্ণ । কিন্তু কেন ?

কাল রাতে চূড়ান্ত আদরের পর আনন্দী একটু-একটু করে একেবারে নেতিয়ে পড়ল । মনে হয় গলায় চাপটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল । এখন সেরকমটাই মনে হচ্ছে সুবর্ণর । ভাল করে বুকের ওপর মাথা রেখেছিল, নাকের নিচে হাত রেখে পরীক্ষা করেছিল । যা অনেক আগে করতে চেয়েছিল আজ প্রস্তুতি ছাড়াই সেই কাজ করে ফেলেছে সে । তবে তার জন্য কোন আফশোষ নেই তার । অনেকগুলো দিন হয়ে গেল আনন্দীকে একেবারেই সহ্য হতো না তার ।

কাল রাতেই মাটি খুঁড়ে ফেলেছিল । আনন্দীকে নিয়ে যেতে পারেনি । কেননা ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে । আজ রাতে কাজটা সম্পূর্ণ করে ফেলেছে সে । কিন্তু জল না দিলে মাটিটা ঠিক মতো বসবে না তো । নাহ্‌, আজ রাতেও আর বিশ্রাম হলো না । ভাবে সুবর্ণ । 

 জলের বালতি নিয়ে পিছনের বাগানে আবার যায় সুবর্ণ । জলটা ঢালার আগে কী মনে হতে মাটিটা দুহাতে আবার খোঁড়ে । আসলে সুবর্ণর নিজের ওপর কনফিডেন্স চিরকাল কম । 

এটা কী হচ্ছে ! সুবর্ণ টের পায় তার হাতটা কেউ টানছে মাটির ভিতর থেকে । জলের বালতিটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সুবর্ণ । 

রাতের অন্ধকার চিরে শুধুই একটা ভয়াল আর্তনাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

দুদিন পর খবরের কাগজে একটা ছোট খবর বেরোয় । 

দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসে স্বামী-স্ত্রীর রহস্যজনক অন্তর্ধান…

রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শুভদীপ নায়ক

                                      


"সৃজন " এই সপ্তাহের কবি শুভদীপ নায়ক৷ জন্ম কলকাতায় ১৯৮৯ সালে ।শৈশবস্থা কেটেছে উত্তর কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে । স্কুলশিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বিজ্ঞান ও বাস্তুবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া করেন । অধুনা তিনি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত । শৈশবস্থা থেকেই সাহিত্যের বইপত্র পড়া, লেখালিখি ও ছবি আঁকার চর্চা করেন । সাহিত্যে কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন  একুশ শতকের প্রথম দশকের একেবারে সূচনা পর্বে, ২০১০ সালে । নিজেও যুক্ত থেকেছেন একাধিক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে । সাহিত্যে মূলত কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের রচয়িতা৷ প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থ হল: নির্বাক মুহূর্তগুলো (২০১৬), আত্মহত্যার স্নানঘর (২০১৭)

       


স্মরণ, তোমাকে





পেলাম না পণ্যের স্বীকৃতি, ভার পড়ে রইল দূরে, চোখের মণিতে ।

সারাদেহ ভরে গেল কালির হরফে, বৈচিত্রে । কোথায় রয়েছ তুমি !  

পালক ফুটেছে তোমার কবিতার শরীরে, একদিন মনের ভিতরে 

জমে ছিল ভয়, ছাই থেকে পুনরায় আগুন খোঁজার ঝুঁকি, সেসব

পাখির ঠোঁটের মতো বয়ে বয়ে বেড়িয়েছি এতকাল, দারুব্রহ্ম, মীন, 

প্রেমঘটিত যুদ্ধ এবং নিত্য পুজোর প্রাক্কালে হয়েছিল তৃষ্ণা নিবারণ ।

একটি রঙিন সুতোর জট থেকে খুলে পড়ে ছায়া, উৎসবের দিনে

অহেতুক আঁধারে ভরে আছে শহরের যেসব গলি, জীবিত থাকলে

সেখানে দাঁড়িয়েই তোমাকে বলা যেত : সমস্ত সদর বন্ধ, নিজ নিজ

ইতিহাস লেখার ছলে প্রতিটি মানুষ বসন্ত হয়ে বাঁচে দূরের টিলায় ।





মনে নেই, ভুলভ্রান্তি আর কিছু ছিল কিনা পুরনো বাড়ির চৌকাঠে ।

যদি থাকে, নিয়ে যেও । ভুল থেকে কত ধারণা গড়ে ওঠে, সংস্কার

পাল্টে যায়, ভ্রান্তির ছাপ নিয়ে বেরিয়ে আসি সম্পর্ক থেকে, কিছুতেই

কাটে না পুরনো সংস্কার, ভয় । এইভাবে শতছিন্ন মানুষও একদিন

অন্যের সংস্পর্শে আসে, সশব্দে, আশঙ্কায় । ভাঙা পড়ে বাড়ি,

ঘর ছোট হয়ে আসে, আক্ষেপ বাড়তে থাকে, বয়স পেরিয়ে যায় দূরে ।

সর্বত্রই ভাঙা পড়লে বোঝা যায় এতদিন সবটা দাঁড়িয়েছিল শূন্য এক

জমির ওপরে, আসন্ন বিপদে, হয়তো পাহাড়ের ঢালে, মরা মৃত্তিকায়, 

কিংবা ডুবন্ত চোরাবালি ঘিরে । যে পায়ে চিরকাল বেড় থাকার কথা, 

সেই পায়ে লেগে আছে কাদা, সেই পায়ে নোনাবালি, ঢেউ, উচ্চারণ ।

এখন শুধুই প্রতীক্ষা, বিশেষণ আর সর্বনামে, যে বাতাসে উড়ে গেছে

গা থেকে খসে পড়া সামান্য পালক, সেই বাতাস জানতে চাইছে

অতীতের সম্বন্ধগুলোর চেয়ে তুমি কতটা পৃথক ? কতটা গোপন ? 














আয়নার স্বভাব ছিল তোমাকে উন্মোচিতা হতে দ্যাখা, কখনো আঁধার রাতে

আয়নার শরীরে ফুটে উঠতে তুমি, বিবর্ণ মুখের ছবি দেখতে । যে মুখে সহস্র

শীতকাল খসে গেছে, তুমি সন্ধান পাওনি, তুমি বিপন্ন হয়ে বেড়িয়েছ পাহাড়ে, 

ঘাস জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখেছ চারপাশে শৈলশিরার বিস্তৃত রজনী ।

মনে আছে, এই আয়নার সামনেই ব্লাউজের হুক বেঁধে দিয়ে বলেছিলাম, আজ

বহুদিন পর তোমাকে ঘিরে নেমেছে সৌজন্যের মেঘ, আঁকা হয়েছে বাড়তি দূরত্ব, 

যে লেখায় তুমি নিখোঁজ বহুকাল, সে লেখায় ফিরেছ আজ স্বভাবদোষে, কটুযত্নে ।

এখন আর ব্লাউজের হাতায় নেই সুতো দিয়ে বোনা ফুলের কাজ, পরিবর্তে

সরু লেস, অঙ্গের সমাহার । আঙুলের প্রান্তে এখন অসহায় নখ, ঠোঁটও হারিয়েছে

চিকণ চুমুর স্বাদ, আয়নার স্বভাব ছিল তোমাকে কালো টিপ আর সিঁদুরে দেখা ।






এই জন্মের যেটুকু আছে তার সবটা রেখে গেলাম, প্রয়োজন মতো খরচ করে ফেলো ।

যূথবদ্ধ মথের পাখনা, সাহসে কুড়ানো ফুল, ভাঙা তৈজসপত্র, হিসেব লেখার ঐ বাতিল

খাতাটা, জংধরা তালা, পরিত্যক্ত জুতোর চামড়া, সবেতেই পাবে আমাকে । এককথায় 

আমি ছিলাম ব্যবহারকারীর ভূমিকায়, তাই ছাপ রেখেছি স্মৃতিতে, আমাকে ঠকাতে গিয়ে

করুণা এসেছে মনে, আমাকে ভুলতে অবজ্ঞার সাহায্য নিতে হয়েছে । তবুও একদিন হঠাৎ

মনে হয়েছে, নতুন করে কিছু পাওয়ার ছিল পুরনো অভ্যাসগুলোর থেকে । তাই, বৃষ্টিতে

সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে এলোচুলে ভিজে ছাতা হাতে ধরে এসেছ এখানে, বহুদিন পর জঙ্গলে ঘেরা

এই সমাধিক্ষেত্রে । তোমারও প্রশ্ন ছিল, কেন মানুষ স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কে যেতে রাজি নয় ? 

কীভাবে আগেকার দূরত্ব মুছে দিয়ে নতুন করে ফিরে আসা যায় ? আমিও বই পড়তে পড়তে

ভেবেছি পৃষ্ঠা-শেষের জীবন কীভাবে ডুবতে পারে অদ্বিতীয় কোমল আভায় ! এসো বিস্তৃতি হয়ে, 

দরজা খোলাই আছে, যেখানে যা ফেলে গেছ আমি তার কিছুই রাখিনি সরিয়ে । আছে ধূপদানি, 

কর্কশ রেডিও, জ্বলন্ত বৃত্তের মধ্যে দিয়ে আর যা কিছু পালিয়ে গেছে, তা সঞ্চয়ের জন্য ছিল না ।















 ৫



মায়ার মতো মানুষের সবকিছুরই ইন্দ্রপতন ঘটে । চোখের কাজল 

যে বয়সে যা পায়নি, কাজল হারানো চোখ তাই-ই খোঁজে সারাজীবন ।

অবলুপ্ত সৌন্দর্যকে ভালবাসবার সময় দেখেছি, সুন্দর নিজেকে

খেয়ালহীনতায় হারিয়েছে, বাঁধা পড়েছে । হঠাৎ সেই বন্ধন ভেঙে দেখি

আসন্ন বাঁকের মুখে পথ গেছে ঘুরে, যেন লজ্জা ভেঙে এই প্রথম

কোনও ফিঙে পাখি বসেছে আমার বাড়ির জানলায় । ভূলুণ্ঠিত আলো, 

বনাঞ্চল, ঢালু ঘাসের জমি, এতদিন যা কিছু সংগ্রহে ছিল সমস্ত কবিতায়, 

কোনও এক মানুষের শতপ্রশ্ন চাহনিতে সেসব বিক্রি হয়ে গেল । 

এই আনাদায় গোধূলিবেলায়, বিস্মৃতিপ্রান্তে, পাহাড়ের পথে, যেখানে

ভাঙা মানুষ, ভ্রান্ত মানুষ, মিছিলের শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে

নির্দ্বিধায় বিস্তার করে নিজেকে, স্বেচ্ছায় হারানো চাবির স্বপ্নে, 

ত্রাস ও হিংসার বিনিময়ে, সেইসব মুখবায়বকে ভাসিয়ে দিয়ে এসে

পুনরায় বসেছি, দৃশ্যের মধ্যে ভুল করে ঝরে গেছে বহু ফুল, খবর রাখিনি ।






নিজেকে পুনরাবিষ্কারে দক্ষ নই, তাই অলিখিত প্রতিশ্রুতির দলিল রেখে যাই ।

আরও একটি পরিকল্পিত চিঠি লিখে, নতুন করে বাড়ির পুজোয় তোমাকে 

আসতে বলি । যারা আমার ভিতরে চিরকাল অন্ধকারে তাঁবু ফেলেছিল, 

যারা প্রজ্জ্বলিত চাঁদকে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে নিতম্বকম্বল দিয়ে ঢেকে 

অকস্মাৎ ছিন্ন করে বানিয়ে তুলেছিল দারিদ্রহীন হ্রদ, তারা সব ফিরে গেছে

একে একে । শুধু পরিধিনাশক কিছু ছায়া এগিয়ে চলেছে, আমাকে ছোঁবে

তোমারই অনুপস্থিতিতে । তাই, নৃশংস অন্ধকার কাঁদে : পরার্থপর সুরের অভাবে

গানগুলো ঝরে যায় রাতে । দূরে বিস্তীর্ণ গাছের সারি, স্থিরজল ঠেলে ঠেলে 

অনেক দেরিতে ফেরে আশাহীন নৌকো, মাছ নিয়ে, টাঙানো লণ্ঠন নিয়ে,

তার কিছু কথা ছিল, ছেঁড়া জাল ও বৈঠার সামান্য কাহিনি, আগুনের পাশে, বৃষ্টিতে । 











অরণ্য পুড়ছে, এর চেয়ে নিদারুণ অখণ্ড অস্বস্তি আর কী হতে পারে ! 

যদিও প্রেরণা পুড়তে পারে, পুড়ে যেতে পারে নিঃশব্দে বেঁচে থাকা ক্ষমা, 

অনেক দূরের তারা, সেও পোড়ে প্রেমে, ক্ষুধায়, বোধিসত্ত্ব স্নেহের জারণে ।

এই মাঘ-ফাল্গুন মাসে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বীরভূমে, শাড়ির ওপরে

জড়ানো সুতোর কাজ করা একটা শাল, তুমি বাজার থেকে রিক্সা নিয়ে 

ফিরবে বলে দাঁড়িয়েছিলে । আমি পথভ্রান্ত বেমানান, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ,

পরিচিত লেখার খাতাটা নিয়ে সন্ধের আড্ডার দিকে যাচ্ছি । মা হারা মাতাল

যেমন রাত্রে ফেরে না বাড়ি, জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যেমন জলপতনের শব্দ, 

ফুটে থাকা ফুল যেমন অনাদৃত সৌন্দর্য নিয়ে পোড়ে, তেমনই পুড়েছি আমি ! 

ঐ সমুদ্রটিলার নুন, ঐ রেললাইনের ভঙ্গুর পাথর, বন্ধ টিকিটঘর, রঙতামাশা, 

সবই সীমার মধ্যে ছিল, আমি দেখিনি । শাড়ির পাড় চওড়া ছিল কিনা, শালের

আসল রঙ সবুজাভ নীল না কি স্পর্শকাতর মেরুন, দেখিনি রত্মমালা থেকে

ছিঁড়ে পড়া মাণিক্য হারিয়ে গিয়েছিল কিনা, শুধু পতনমুখী আলোয় দেখেছি

তোমার অরুন্ধতী মুখ । লেখা ছিল, 'যাও সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ো সব ব্যাথা নিয়ে !'






একদিন বাইরে তাকিয়ে দেখি ঊষাকাল ভাঙছে । যাদের সূর্যাস্ত অবধি যাওয়ার কথা

তারা জমায়েত হয়েছে ফেরিঘাটে । ওখানেই বিচরণ আমার, ওখানেই আজন্ম অস্তিত্বটুকু

দায়দাস হয়ে বেঁচে । ঐ অনন্ত, ঐ আতিথ্য থেকে বহুকাল হল সরে এসেছি । সম্পর্কে

কেন আমি সবটা তার মতো করে ভাববো ! সেখানেও অংশ আছে আমার, আছে জমি, 

এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু শিশুগাছ, কাঁটার জঙ্গল, উঁইয়ের ঢিবি । আমারও

রয়েছে খাগের কলম, কালির দোয়াত, রঙের গভীরে ডুবন্ত তুলি, আমি তাই নিয়ে লিখব ।

একদিন অনুপম আঘাত থেকে বেরিয়ে এসে দেখি জন্ম নিচ্ছে প্রেম, বাকি সব মরে আছে

বীজের আশায়, জলের ফাঁকে, ক্ষতির অন্নে । আমিই শুধু ক্রান্তিহীন, জয়ের মাস্তুলে, ঝাউবনে, 

ভাঙা হাড় বেছে বেছে এসেছি ভূর্জতটে, রাতের সাগরে । ব্যবহৃত খামের উল্টোপিঠে যেটুকু

শূন্যস্থান আছে, সেখানেই লিখে ফেলি অঙ্গীকার, কবিতা হয়তো । স্থান ফুরায়, এখনো

অনেক লেখা অনিয়ত, অপ্রকাশিত থেকে যায় । বৈকুণ্ঠকে কোথায় রেখেছে সে,— কোন ঠিকানায়!

অপরাহ্নে জাল বোনা দেখি, দুপুরে তাঁতের মেশিন চালাই, বাড়ির উঠোনে যারা আলপনা দিত, 

তারা আজ নেই কোনও দূরের সীমানায় । টেবিলে ন্যস্ত থাকে খাতা, জীবনের হিসাব, অনাদায়ী ঋণ, 

নিমন্ত্রণের ত্রুটি, শিমুলের মৃত্যুর বেশ কিছু খতিয়ান, এবং অনেক বছর পর এই আমি ! 











বসতি ফুলের ডালি, আমি তাকে গ্রাম ভেবে ভুল করি ।

এসেছি কলকাতা থেকে, বইপত্র হাতে, ব্যাগভর্তি মন,

জামাকাপড়ে জড়ানো, আছে তাঁবু, লোহার পেরেক, 

সম্পর্ক গাঁথার জন্য হাতুড়ি । যেহেতু পাহাড়ে এখন আর

বরফ পড়ে না, তাই ধাপ কেটে ঝুমচাষ শুরু করেছে লোকে ।

তিনদিকে সবুজ পাহাড়, বাদামি মাটির ঢাল পাথরে জড়ানো, 

তাই গোপনে নদির স্রোত বয়ে চলে এখানে । যৎসামান্য বাড়ি, 

দোকানবাজার, খাদ্য ও বিশ্রামাগার । আমি স্থান পেয়ে যাই, 

আমি মৃত্যুর খুব কাছে, দারুণ অসুখে সব লিখে ফেলি,—

আলো জ্বালি, সন্তাপ মুছে ফেলি । তবুও রহস্য থাকে, 

পড়ে থাকে ভাঙা শব্দ, পথ হারানো অক্ষর, বিচ্ছেদমুখী চিহ্ন !

আত্মীয়েরা পক্ষ নেয় তোমার, আমার সমর্থনে এগিয়ে আসে

মরশূন্য লাইব্রেরি । কথা ওঠে, অন্ত্যমিল থেকে সরে যায় ক্রিয়াপদ ।

স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি বাজারে ফলের দোকান, রেলিং টানা 

মদের দোকানে পর্যটকদের ভিড়, যানবাহনের খোঁজে 

অনেকেই চলেছে খানিকটা নিচে, বুকস্টোরে । আছে সামগ্রী,—

অন্যায় ও অপব্যবহারের । লোহার কয়েদ ছিল এখানেই, 

একদা যা ছিল বন্দি, এখন সেটাই হয়েছে ভ্রমণের উপযোগী,

জংশন আর অববাহিকায় খোলা আছে চায়ের আস্তানা, 

বিদেশিরা বসে আছে সেখানে, শুধু সবুজ বনানীই হয়ে আছে অনিশ্চিত ! 



১০



তামার অচেনা রঙ, তবু সেটা আমাকে টানে, দ্বিপ্রহরে, ধূসর কম্বলে ।

তুমি তো ছিলে না সেই ভুলবোঝাবুঝির পরে, ছিল সে, কাঙাল হৃদয়ে, 

অজ্ঞাত অভিসারে । যে সূত্রে পরিচয়, সেই সূত্রে এতকাল বাঁধা ছিল দূরে, 

পীড়িত ছিল স্বপ্নে, আহত ছিল গানে । অভ্যাস খুলে ছড়ানো ছিল,

বালিশে ঘুমন্ত রাত, তার পাশে কবিতার বই, অন্য ঘরে, বিভেদদেওয়ালে ।

এ ঘর শূন্য দেখে ভরা এক সন্ধেতে এল ঝড়, বাসনা নিভেই ছিল এতদিন, 

স্ফুলিঙ্গ জ্বলেনি, দণ্ডী কাটেনি, সবুজ পানের গায়ে এতকাল লাগেনি চুনাদাগ ।

তবু হাহাকারের মতো  শস্যখেতে জন্ম নিল অচেনা গম, আত্মহত্যার আগে, 

গ্লানির আগে, মানুষের এই পরাভব, তঞ্চকতা, জেদ, দুপায়ে ঘিয়ের আগুন, 

একান্নবর্তী রক্ত, সবটুকু বোনা হল । বুনে নিল সে, বুঝতেই পারিনি— বৃশ্চিকের মতো

তার লতামূলে, চোরাটানে, প্রাণহননের শিকড়ে এতকাল লুকিয়ে ছিল সূচবেঁধা সন্ধান ।