বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৯

সম্পাদকীয়



"There is no friend as loyal as a book"

বই হল প্রকৃত বন্ধু ৷আমাদের জীবনে এমন অনেক বন্ধু থাকে  যারা কোন না কোন সময় আমাদের ছেড়ে চলে যায় কিন্তু বই হল এমন বন্ধু যা কোনদিনই আমাদের সাথে থেকে চলে যায় না । বর্তমান সময় যখন মানুষের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে তখন এমন একটা সংখ্যা করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি ৷ বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বইয়ের পরিবর্তে ভিডিও গেম ,টিভি প্রভৃতিতে সময় কাটায় ৷বই পড়ার মনষ্কতাই কমে যাচ্ছে আজকের সময়ে ৷
কিভাবে বাড়ানো যাবে এই উদ্যোগ তা জানা নেই ৷

অনেকেই বলে থাকেন তেমন লেখক কিংবা কবি  তৈরী হচ্ছে না যার বা যাদের বই পড়ে আমাদের পড়ার রসনা তৃপ্তি লাভ হতে পারে  ৷ আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি  আমাদের পরিশ্রম বিমুখ করে তুলেছে ৷ ব্যক্তি আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী নই ৷ তার জলন্ত উদাহরণ হল " কলিকাতা লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র " এই লাইব্রেরীতে প্রায় ৮০ হাজারের মত বই আছে ৷আছে বহুকালের পুরানো পুঁথি এবং তথ্য ৷ যা দিয়ে দেশ বিদেশ থেকে গবেষণা করতে আসছেন গবেষকরা  ৷ বই এখনো আমাদের পথ দেখায় ৷উৎকৃষ্ট মানের বই আজও হচ্ছে ৷
 " আমার সৃজন " দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটির নাম তাই " বই সংখ্যা " রাখা হয়েছে ৷


পূর্ণিমার রাত ৷ আলগা বাতাসে  উড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে সুপারী গাছের খোলা বুক বেয়ে  ৷ চারিদিক তখন নিস্তব্ধ ৷জোনাকীর ঝিঁঝিঁ আওয়াজে হেসে ওঠে নীরবতা ।রূপোলী আলোয় ম্লান দেখায়  ঠাকুরদালানের সামিয়ানা  ৷ ঠাকুরদালানের চারিদিকে
  পড়ে থাকে কাচের টুকরো  ৷ পিছনের কাছারি বাড়ির পাশ থেকে তখনও ভেসে আসছে গানের আওয়াজ ৷ লাল অালতা মাখা পায়ের ছাপ সারা উঠোন জুড়ে ...

আপনাদের ভালোবাসায় এই পত্রিকা এগিয়ে চলেছে খুব দ্রুত ৷ " আমার সৃজন" শব্দ স্পর্শ সাহিত্যের সাড়া উঠোন জুড়ে ৷আসন্ন বইমেলা ও লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় সবাইকে স্বাগত ৷সবাই বই কিনুন ও বই পড়ুন ৷ সৃজনে থাকুন সবাই ৷আমাদের বই সংখ্যাটিতে  কলম ধরেছেন অনেক গুণী মানুষ
সম্পাদিকা
পারমিতা চক্রবর্ত্তী

পবিত্র পাত্র


কবিতা ১: বেঁচে থাকা কুড়িও না

বেঁচে থাকা কুড়িও না,সখ্যতা দাবি করো।
হিম সংকুল পরাগগর্ভ হাতড়াও।
হেঁটে যাও মহীখাত-
আলোড়ন মুছে মুছে,চন্দনের আসনে। 
সাড়া,যারা মাখেনি;তারা অজেয়।

বেঁচে থাকা কুড়িও না,সখ্যতা দাবি করো। 
বিপ্লব লিখে রাখো রক্তের কুঁড়িতে।
শোনো,ঘুমন্ত আসবাব-
জড়তা জড়ো করো না আর,হেঁটে যাও,
তরঙ্গ,যারা সইলো না;তারা সভ্য নয়। 

বেঁচে থাকা কুড়িও না,সখ্যতা দাবি করো। 
কান পেতে শোনো নিঝুম কোলাহল।
নাভীচর মাড়িয়ে যাও-
আরো কিছুটা গেলে,হয়তো বিশ্রামের ঘর,
স্তব্ধতা,যারা শিখলো না;তারা আগ্নেয়।

কবিতা ২: ক্ষমা,চেয়ে দেখো

ক্ষমা চেয়ে দেখো,
জানালা কেমন কুয়াশার।
কুহেলিকা যেন সাগরসেনার মোহবাষ্পের মতো শুয়ে আছে অক্ষর আহুতিতে। 
যুগ যাপনের অমোঘ তাগিদ যেন,সংঘাতের বর্জগুনন। 
চেয়ে দেখো ক্ষমা,শেষ স্ফুটনাঙ্ক কেমন,ধুলোর কুটিরে মিলিয়ে যায়।  
এই যে সন্ধান,পালকের মতো তীক্ষ্ণ নেশা,
বলে যায় উড়ে যাও,উড়ে যাও। 
তারা কি জানে না,আত্মা কিভাবে কবিতা হয়ে যায়,অনুভূতিরা সইতে শিখে নেয়। 
এ যেন এক অনন্ত অভিষঙ্গ-
তাই কুয়াশা যদি জানালার হতে পারে,অপরাধ কেন ক্ষমার নয়? 

কবিতা ৩: যারা নদী হতে ভালোবাসে

যারা নদী হতে ভালোবাসে
তাদেন ভেতর সভ্যতা বাস করে- 
নিপুন মৃত্যুও তাদের প্রত্নবীজ ভাবে। 
তাদের স্রোতে গড়িয়ে যায়,নীড় ছাড়া চোখ,হয়তো বা গোটা শরীর। 
আসলে তারা দেহজ চড়ুই-
নদী যাদের ছুঁতে পারেনি-



পৌলমী পুরকাইত

#শূন্যতা
বিরান ধানজমির মাঝে এক লম্বা কাঁটাতারের বেড়া।
মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে পুরো জমি ধানি জমি জুড়ে।
সে হাওয়া দিক থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে।
সে হাওয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটা কোনে।
সে হাওয়া শুধু চলছে না আমাদের মনে!
আমাদের প্রতিটা বাড়ির প্রতিটা কোণ থেকে কোণে  সে ধাক্বা খেয়ে ফিরে আসছেএই বিরান ধানজমির গায়ে।
আছড়ে পড়ছে একবুক শূণ্যতা নিয়ে।
আজ আমাদের একে অপরের থেকে বহুদূরে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত বাস।
ওই কাঁটাতারের গায়ে আটকে রয়েছে আমাদের মনুষ্যত্ব, বর্ণ আর  ধর্মের শক্ত গিঁট।
কে খুলবে!? দমকা হাওয়া চাই একখানা।
প্রতিদিন মনুষ্যত্ব মাথা কুটে মরছে ওই বিরান ভূমির গায়ে।
          ----------------------////////---------------------
২০.১.২০১৯
পৌলমী

#নিখোঁজ
সারারাত প্রতীক্ষায় আছি কখন তুমি আসবে?
ঠিক ভোর বেলায় সেই তুমি একবার এসেই আবার চলে গেলে।
নাহ্ আর আসবে না!
কে আছো পাশে, চারিদিক খুঁজলাম কাউকেই তো দেখলাম না!
কে মনে করাবে আমাকে তোমার কথা!
সবাইকে জিজ্ঞসা করি এক এক করে,
তাকে দেখেছো কেউ?
কেউ বলতে পারে না, ঠৌঁট উল্টে চলে যায় সব।
কেন!কারুর কাছে কোন উত্তর নেই কেন!?
পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, ঘরের জিনিষপত্র একটানে বাইরে ফেলে দিলাম রাগে।
ডাক্তার বদ্যি, বাবার থান, মন্দিরের দুয়ারে হত্যে, মসজিদের জলপড়া সবই  তো করলাম, কিছুই কাজে লাগলো না, সব ব্যর্থ হলো।
আদাড়ে বাদাড়ে-- বাড়ির কাছের জঙ্গলে তাও পাগলের মত ঘুরে ঘুরে খুঁজলাম...পেলাম না।
একবার ভাবলাম, যাই অ্যালবাট্রেসের ডানায় ভর করে খানিক উড়ে আসি, খুঁজে আসি পৃথিবীর অপর প্রান্তটা!
কত রকম করে ভাবছি তাকে কোথায় পাই,কোথায় হারালো সে নিজেকে!
কেউ জানো, পারবে দিতে কেউ সন্ধান!?
আমার কিছু অমূল্য স্মৃতি হারিয়েছে...ফেরত চাই।
        --------------------------///////-------------------
২০.১.২০১৯
পৌলমী


#সুঘ্রাণ
এই যে এতদিন পর যে তুমি অমন করে তাকালে!
আমার বুকের ভেতর যেন লক্ষ কোটি প্রজাপতি পাখনা মেললো...
রাতের আঁধার নেমে এলে তুমি যখন সাঁঝবাতিটা এক ফুঁয়ে নিভিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠলে,"এই, একটু কাছে এসো না!"
আমার বুকে তখন সারা পৃথিবীর মাদল একসাথে বাজলো; দ্রিমি-দ্রিমি দ্রিমি-দ্রিমি দ্রিমি-দ্রিমি দ্রিম দ্রিম...
এরপর আলতো করে জড়িয়ে, তুমি যখন বিছানার চাদর আর বালিশে লেপ্টে যাওয়া মেহেদী রং এর চাঁদটার মায়াবী আলো দেখালে...
তখন, আমার নিঃশ্বাসের প্রতিটা শব্দ যেন আমার নিজের কানেই বড়ো বেমানান হয়ে বাজছিলো!
অপেক্ষায় আছি...
কাছে এসো, ঝড় তোলো, সেই প্রথম রাতের ঝড় তোলা আলিঙ্গন আর চুম্বনের মতো;
উড়ে যাক সব বাধা খড়কুটোর মতো।
ভালোবাসা পাখনা মেলুক ওই দিগন্তে...
লক্ষকোটি জোনাক জ্বলুক আমাদের ওই চাঁদছোঁয়া জোছনার গায়ে।
চলো আজ এক আকাশ ভালোবাসি ওই দৃষ্টি সুখের সুঘ্রানে।
         ----------------------//////-------------------


মেঘশ্রী ব্যানার্জী

ছোটগল্প

লাল-সাদা



আজ ভীষণ খুশি ইভান, এইলি আর ডাফিল্ড। একরাশ হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে মম আর ড্যাডাকে গুডনাইট জানিয়ে এইমাত্র শুতে গেছে। রোঁয়া ওঠা কম্বলটায় বাড়ন্ত তিন বাচ্চার আর কুলায় না। তাও গুটিসুটি মেরে যুদ্ধ করতে করতে, একে অন্যের ওম নিতে নিতে একসময়ে ঠিক ঘুময়ে পড়ে ওরা। মার্থা বাকি খাবার গুছিয়ে তুলে রাখছে। ডেরিক লক্ষ্য করে মার্থার বসে যাওয়া গালের কালো খসখসে চামড়ায় কুঞ্চন। দুহাত কঙ্কালসার। তবু আজ মুখে তৃপ্তি।

ডাউনটাউনে এক অপরিসর ভাড়ার কামরা আর নামমাত্র ডাইনিং-কাম-কিচেনে গুঁতোগুঁতি জীবন। কাঠের দেওয়ালের ফাঁকফোকর গুলো অহরহ শীতের জানান দিয়ে যায়। তাতে সাঁটা কাগজগুলো জানান দেয় দারিদ্রের। তবু তো মাথার উপর ছাদ!

বছর দুয়েক আগেও অবস্থা এমন ছিল না। অভাব ছিল। কিন্তু খেয়ে-পরে বাঁচার দুশ্চিন্তা ছিল না। তার উপর ইভানের আগমন বার্তায় আনন্দে ভরপুর কাটছিল জীবন। হঠাৎ একদিন চুরির অপবাদে ডেরিকের স্টোরের চাকরিটা দুম করে চলে যায়। জেলও খাটতে হয় ন’মাস! দুর্বিপাক পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে মার্থাকে। জিসাসের ভরসায় দুই ছেলেমেয়েকে রেখে সন্তানসম্ভবা মার্থা হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়ায়। যুতসই কাজ না পেয়ে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তার ধারে, স্টোরের সামনে বসে থাকে কিছু ভিক্ষের আশায়!

একসময় ছাড়া পায় ডেরিক। জন্তুর মত মার খেয়েও অপরাধ স্বীকার করেনি সে। আসল চোর ততদিনে ধরা পড়েছে। বাড়ি ফিরে একদৃষ্টে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলে নিতেও ভুলে যায় যেন! ক্ষতচিহ্নে হাত বোলাতে বোলাতে একটা বদল টের পায় মার্থা। টের পায় চামড়ার দাগড়া দাগড়া দাগের শিকড় আরও অনেক, অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

ডেরিক সকালে কাজের চেষ্টায় বেরোয়। কখনো সফল, কখনো নয়। ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত বা ভোর রাত। তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা। খ্রিস্টমাস ইভ। আজ ডিনারটা একসাথেই করার বায়না করেছিল ছেলেমেয়েগুলো। মার্থাও কি তাই চায় নি? নিশ্চয়ই চেয়েছে। কিন্তু বাবার কাছে স্পেশাল দিনে স্পেশাল খাবারের ফরমাইস করবে ইভান আর এইলি - এই তার ভয়! ডাফিল্ড তাদের জীর্ণদশার সাথে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে। না দিতে পারার যন্ত্রণায় ডেরিকের চোয়াল শক্ত হতে,  চোখ নিষ্ঠুর হতে দেখেছে মার্থা!

গত সপ্তাহে শুকনো ব্রেড ছাড়া কিচ্ছু জোটেনি। আজও অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত বাচ্চাগুলো ম্লান মুখে শুকনো পাঁউরুটির দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই ড্যাডা সান্তাক্লজের পোষাক পরে ঝোলা ভরা কেক, অ্যাপল পাই, পাপ্পা জন’স পিৎজা আরও রকমারি খাবার, উপহার নিয়ে হাজির হয়েছে। তারপর সে কি উল্লাস! জিসাসকে থ্যাঙ্কস জানিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করে সবাই মিলে। ডাফিল্ডের চোখেমুখেও আজ অকাল-পরিণত ভাব সরে যেন জেল্লা দিচ্ছে শৈশব। বাচ্চাগুলোর আনন্দে একবার জিসাসকে একবার ডেরিককে সজল নীরব চোখে ধন্যবাদ জানায় মার্থা। ডেরিকের মুখের রেখা আজ নরম, পরিতৃপ্ত! চোখ নিস্পৃহ।

গোছগাছ সেরে ডেরিকের গা ঘেঁষে বসে মার্থে। গুডনাইট কিস দিয়ে এক স্বপ্নময় রাতের ইশারা করে যায়। পেটের খিদে মিটতেই আজ অনেকদিন পর শরীর তার খিদের কথা জানান দিয়েছে। ডেরিক ওষ্ঠপ্রান্তে সম্মতি সূচক হালকা হাসি ঝুলিয়ে সান্তাক্লজের ঝোলা নাড়াচাড়া শুরু করে। আর দাঁড়ায় না মার্থা।

অন্যমনস্ক ডেরিক ঝোলার ভিতর থেকে বার করে একটা বিয়ারের বোতল। সাথে একটা পেটমোটা পার্স। ক্রেডিট কার্ডসের আধিক্য থাকলেও তাতে ডলারের পরিমাণও নেহাত কম নয়। ত্বরিত গতিতে হাতড়ে চলে প্রতিটি পকেট। চোখের নিস্পৃহতা বদলে যেতে থাকে চকচকে লোভে। ড: হ্যারল্ড গার্বার -  ড্রাইভিং লাইসেন্সের উপরের নামটা বিশেষ দাগ কাটেনা ডেরিকের মনে। টেবিলে উল্টে রাখে। উল্টোপিঠে জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকানো ফটোটাতে চোখ আটকায় এবার। লাললাল গোলগাল তিনটি বাচ্চার খুশি খুশি ছবি। ডেরিক অপলকে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। ওরা এখনো ওদের ড্যাডার পথ চেয়ে বসে। হ্যারল্ডকে বরফ সাদা ফুটপাতের উপর লাল রক্তে ভাসিয়ে আজ ডেরিক নিজের পরিবারের জন্য খুশি এনেছে ঝোলা ভরে!

বাইরে ঝোড়ো হাওয়া। সাথে অনর্গল তুষারপাতে দরজার সিকি ভাগ সেই কখন ঢাকা পড়ে গেছে! কিচেনের জানলার নড়বড়ে সার্সি ঝড়ের দাপটে ঝনঝন করে ওঠে। ঘোর কাটে ডেরিকের। নোনতা অনুতাপ মুছে ফেলে চটপট বাকি থাকা কেক, খাবারদাবার, আধখোলা গিফটের প্যাকেট ঝোলায় ভরতে থাকে। গায়ে আরও একবার চাপিয়ে নেয় সান্তাক্লজের পোষাক। দেড়ফুট ঝুরো বরফে পা গেঁথে গেঁথে এগিয়ে চলে ডেরিক। পিছনে বল্গাহরিণের ক্ষুরের সাথে ছাপ ফেলে যায় একজোড়া সমান্তরাল রেখা।

শ্রীলেখা মুখার্জ্জী


লক্ষ্মীমন্ত /
—————————————
হেমন্তসূর্যের গড়িমসি ভোরে আমি জনলা ঘেঁসে দাঁড়াই। তখনও হাল্কা ঘুমের স্বপ্নসুখে আমার শহর। পাহাড়ের ওপর কুয়াশা আস্তরণের ভাঁজে ভাঁজে নাছোড়বান্দা রাত লেগে থাকে। শুধু আমি স্বপ্নের সন্ধানে জানলার শার্সি খুলে শিশিরের শব্দ শুনি। বন্ধ চোখের পাতায় আজকাল স্বপ্নরা আসে না। 
স্মৃতিরা ঘুমের চৌকাঠে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে গপ্পো জোড়ে। মেয়েবেলার ছাদে আকাশপ্রদীপের আলো এসে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন হেঁটে যায় একলা ছায়াপথ ধরে  নির্লিপ্ত ভঙ্গীমায়। বুকের ভেতর শূন্যতার খনিতে হীরক কুচির মতো মাঝেমাঝে ঝিলিক মারে অতীত। 
যেন পূর্বজন্মের আমি দীপান্বিতা লক্ষ্মী পূজোর আল্পনা দিই উঠোন জুড়ে। জলচৌকি তে লক্ষ্মীর পা আঁকি। জেঠিমা বলেন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদেয় হলেও সবার অলক্ষ্যে তিনি কিন্তু আমারই আঁচলধরা…
দূরে কোথাও বেড়ালের কান্নায় স্মৃতিরা ঝাপসা হয়ে আসে। ভেসে আসা আজানের একাকীত্ব আঁকড়ে মনে পড়ে যায় আজ দীপাবলী। অলক্ষ্মীকে আঁচলে বেঁধে প্রদীপের সলতে পাকাতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আমি যে লক্ষ্মীমন্ত…

সুদীপ্ত বিশ্বাস

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

*****----*******
ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো নাচবো ভাই
তাধিন তাধিন...

পোড়া বিড়ি দেব ছুঁড়ে ফেলে।
ফেলে দেব তামাকের শিশি
ছেড়ে দেব সব ছাইপাঁশ
তেতো জল, বিলিতি বা দিশি।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো গাইবো ভাই
গলা ছেড়ে যা আসবে মনে

বাতাসকে বলে দেব আমি কত সুখি 
আকাশকে বলে দেব আমি কত সুখি 
পাহাড়কে বলে দেব আমি কত সুখি 
তারাদের বলে দেব আমি কত সুখি। 

ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তাহলে তো  ভাই
হয়ে যাব ফুল, পাখি, নদী।
ভালবাসা ফিরে পাই যদি -
নরম পালক নিয়ে
রামধনু রঙ মেখে এসে
বয়ে যাব তির-তির,
 পাহাড়ের দেশে।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো বাঁচবো ভাই
সমস্ত জীবন।

প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা শরৎ বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা বছর বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা দশক বেঁচে বেঁচে
তবুও তো ভরবে না মন।
বলে যাব, 'বড় ছোট এ জীবন।'

ভালবাসা যদি ফিরে পাই,
তাহলে কিচ্ছু না--
স্রেফ বাঁচতে চাই।


★******★********★*******★

নদী ও প্রেমিক 


পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে
অনেক না বলা কথা আছে নীল খামে।

ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী
শুনবে নদীর গান , কান পাতো যদি।

ও নদী কোথায় যাও? ছল ছল তানে?
দাও নদী দাও বলে জীবনের মানে।

ঘন্টার ঠুন ঠুন, আজানের সুর
নদী জলে মিশে যায় সোনা রোদ্দুর।

ছোট ছোট ঢেউ তুলে নেচে নেচে যায়
সব মেয়ে তাই বুঝি নদী হতে চায়?

ও নদী চলেছ বয়ে, নদী তুমি কার?
প্রেমিকটা প্রাণপণ কাটছে সাঁতার।

সাঁতরে সাঁতরে আরো  কতদূর যাবে?
কতটা গভীরে গেলে তবে তল পাবে?

নদীটা যেই না গিয়ে সাগরেতে মেশে,  
প্রেমিক ঘুমিয়ে পড়ে  সঙ্গম  শেষে...

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়





কথার উষ্ণতাহীন শীতার্ত মানুষেরা
-------------------------------------






          চোখের সামনে কথাগুলো কেমন যেন ভেঙে ভেঙে যায়। কথার শরীরে লেগে থাকে গুঁড়ো গুঁড়ো আস্তরণ। অথচ এই তো সেদিনও কথার নিপাট ভালো মানুষের শরীর জুড়ে ছিল বসন্তের আয়োজন। দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে গজগামিনীর মতো এগিয়ে এসেছিল দখিনা বাতাস। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল কথার যাবতীয় সবুজ রঙ। কিন্তু কোথায় আজ সেই সবুজের সহজতা। জায়গায় জায়গায় সবুজের মনভূমিতে কালচে ছোপ। এ কি আমার সেই চির চেনা সবুজের গন্ধ বাতাস? না, তা তো নয়। পাঁচমাথার ডানদিকে সোজা গিয়ে বাঁক ঘুরতেই দেখি আয়োজন। কথার আয়োজন। মেরুদণ্ড কোথায়? বিশ্বাসের গ্রন্থি ভেঙে ভেঙে সবুজ আজ ধুলোকণা। আকর্ষকে পাথেয় করে সে আজ অবলম্বনের ভরসায়। 

          কথার ভার কোথায়? কথা তো আজ যেকোনো কথা। সব কথার রঙই আজ এক। দু'পা হাঁটতেই তোমার কথার শরীর আমার কথায় মিশে যায়। কোনো প্রতিবাদ নেই। বিনা আয়োজনেই তারা একে অপরের সফর সঙ্গী। সময় সুযোগ বুঝে কথারা এক এক  জায়গায় ঝাঁক বেঁধে থাকে। 

          অসহায়ের পাশে কোথায় কথা? কথারা উড়ে গেছে সেই কোন ভোরে। অনেকেই তাদের দেখেছে মাচায়। অনেক অনেক উঁচুতে মাচা। সেখান থেকে তো কিছুই প্রায় দেখা যায় না। দেখতেও কি আছে? আসলে কথারা একদিন দল বেঁধে উঠে গিয়েছিল মাচায়। বোজা ছিল তাদের চোখ। এই শর্তেই তো তারা পেয়েছিল সিঁড়ি। তাই ফিরে আসার পথ তারা জানে না। অবশ্য সে ইচ্ছাও তাদের নেই। 

          শীতার্ত মানুষের বুক আজ কথার উষ্ণতাহীন। তাই কথা আজ আর আরোগ্য আনে না। কথার মেঘে নেই কোনো বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। কথাহীন ঠাণ্ডা প্রদেশের ফুটপাতের বাসিন্দা আমরা। অথচ চারপাশে কথার ফোয়ারা ছোটে। কিন্তু সেই কথাদের ধরবে কে? সেই কোন কালে তারা তো সব বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের ধরার মতো অত বড় হাত তো আমাদের নেই। যাদুকাঠির অনেক নিচে আমাদের চলাফেরা। আমরা তো পরিবর্তন জানি না। পরিবর্তনের কেনই বা প্রয়োজন সে ব্যাপারেও আমরা বিশেষ জ্ঞাত নই। আমরা তো জানি ধারাবাহিক ভাবে পথ হেঁটে চলা। কোথাও থামা নেই। নেই পিছন ফিরে মূল্যায়নের কোনোরকম প্রস্তুতি। পথ পেরোলেই তো বদলে যায় চারপাশ। তার সাথে আমিও তো বদলে বদলে যাই। তাহলে কেন এই পরিবর্তনের আয়োজন? 

          আজন্ম যেসব কথার হাত ধরে হয়েছে আমাদের দিনরাত তাদের আজ আর চিনতে পারি না। বুঝতে পারি পরিবর্তনের কথায় আজ আর আমাদের কোনো অধিকার নেই। সহজ কথায় সহজ প্রবেশের সময় আজ অন্তর্হিত। 

          ফুটপাতের শীতার্ত মানুষ তাকিয়ে দেখে অনেক দূরে মাচা। কথা হয়। কানে আসে শুধুমাত্র কিছু বিমূর্ত শব্দধ্বনি। ওরা কারা কথা বলে? ওদের কথায় কেন চোরা স্রোতের টান? কানের কাছে কে যেন বলে যায় অনুবাদকের নাম। কিন্তু আমি তো তাকে চিনি না। আর তাছাড়া সে আমাকে কেনই বা বলে দেবে ওইসব বিমূর্ত শব্দধ্বনির অর্থ। তারা আরও বলে খাতার কথা। নাম জিজ্ঞাসা করলে আমি সেটাই ঠিক করে বলতে পারি না। আসলে আমার তো কোনো নাম নেই। নাম কে রাখে তাই তো জানি না। কোনো দিন তো খাতা দেখি নি, তাই নামের প্রয়োজন পড়ে নি। 

          আমাকে কে ডাকবে? আমার তো নামই নেই। ভাষাও তো বুঝি না। খোলা আকাশের নিচে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। পারি না কিন্তু তবুও মনে হয় আমি সোজা হয়েই আছি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি আরও কত কত মানুষ। সকলের চোখেই একটা নিরাসক্তের ছাপ। যেন আর কেউ কিছু পাবে না। নতুন করে আর যেন কিছুই শুরু করা যাবে না। শুধুই দীর্ঘশ্বাস। চোখের সামনে মৃত্যুর ছায়া। আলোর দেশের ঠিকানা সবাই যেন ভুলে গেছে ------- " দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে / জন্মাতে দেখেছি। "



(গদ্যে ব্যবহৃত কবিতাটি কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা )

রীনা রায়





"সিদ্ধান্ত"
*******
কেন জানিনা, আজ আর কান্না আসছেনা। চোখের জল শুকিয়ে গেছে বোধহয়।
বহুতল এপার্টমেন্টের তেরো তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টা আজ নিয়েই নিলো ঋতজা।
নিচের দিকে চোখ যেতে দেখলো আজও একঝাঁক উজ্জ্বল প্রজাপতির মত  বাচ্চাগুলো হুটোপাটি করতে করতে স্কুল বাসে উঠছে।
ওই যে গাঙ্গুলিদা বৌদিকে রোজকার মত স্কুটিতে বসিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতে গেলো।
সৌরভ বাজারের ব্যাগ হাতে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছে। এসেই অফিস ছুটবে। মাসিমার এই এক বাতিক, প্রতিদিন টাটকা সবজি আনা চাই।
পুজোর সময় এদের সবার সাথে হইহই করে দিন কেটে যায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঋতজা।
সবকিছু কালকেও একই নিয়মে চলবে। সবার জীবন ছন্দ মেনেই চলবে, শুধু ঋতজার জীবন আজকের পর থেকে বদলে যাবে।
" ইউথ্যানাশিয়া"..শব্দটা মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছেনা।
এই একটা শব্দ ওর জীবনটাকে সম্পূর্ন পাল্টে দেবে।
ও জানেনা ও কি করে স্পন্দনকে ছাড়া বাঁচবে। কিন্তু দীর্ঘ সাতমাস কোমায় থাকা মানুষটা কোনোদিন যে সুস্থ হয়ে উঠবে সে আশাও তো নেই। ঘাড় থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্যারালাইসিস হয়ে গেছে।
এই অবস্থাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে কোয়াড্রিপ্লেজিক !
এখন তো শরীরের বেশিরভাগ অর্গানই কাজ করছেনা। শুধু বাইরে থেকে যন্ত্রের সাহায্যে ওকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে সবাই বলা সত্বেও কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না ঋতজা।
একটা ছোট্ট একসিডেন্ট এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে ও বোঝেনি।
অফিসের কাজে সিমলা গেছিলো স্পন্দন। ফেরার পথে ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করতে শুরু করে। একপাল ভেড়া যাচ্ছিলো, পাস কাটাতে গিয়ে গাড়ি ধাক্কা লাগে পাহাড়ের গায়ে। কতটা ইনজুরি তখন বোঝা যায়নি।
মাত্রই তিন বছরের বিবাহিত জীবন হলেও স্পন্দন ওর জীবনে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মত। এত এত স্মৃতি ... ওর জীবনের সবটাই তো স্পন্দন! স্পন্দন ছাড়া ওর অস্তিত্ব শুন্য।
দ্বিধাগ্রস্ত মন বারবার বলেছে, হসপিটালের বেডে কোমায় থাকলেও মানুষটা তো আছে, দুবেলা তাকে দেখতে তো পাচ্ছে ছুঁতে পারছে।
সে না থাকলে এই বিশাল শূন্যতা কিভাবে বইবে ও?
মনে মনে আউড়ায় ,পরজন্ম বলে সত্যি কিছু আছে কি না আমার জানা নেই। তবু আমি বারবার তোমাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই ।
....
আজ স্পন্দনের লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হবে।
বহুতলের তেরো তলায় একমুঠো ঘুমের ওষুধকে সঙ্গী করে ঋতজা চিরনিদ্রায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
"আমি আসছি স্পন্দন! তোমাকে ছাড়া আমি যে অসম্পূর্ন।পরজন্মে বিশ্বাস করিনা আমি। কিন্তু আজ ভীষণভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে জানো! পরজন্মে আবার আমাদের দেখা হবে .... "
ঘুমের ওষুধগুলো জলে গুলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো ঋতজা।
ফোনটা বাজছে... কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো ঋতজা....
"মিসেস বাসু, আহুজা হসপিটাল থেকে বলছি। আপনি কোথায়? স্পন্দন বাবু তো রেসপন্স করছেন। এ যাত্রা বোধহয় আপনার প্রার্থনা ভগবান শুনেছেন।আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন..."

মানস চক্রবর্ত্তী

সেকেলে দাদু দুদু উচ্ছন্নের কথা 
-------------------------------------------


ভালোদাদুই পোথম আমার বুক ধরেছিলো 
যাঃ
সত্যি বোলছি মাইরি মাক্কালী
ধোরবে বলে ধরেছিল !
হুঁ তো । প্রায় প্রায় ধোরতো । ছুতোয় নাতায় । বাঃ মুনিয়া তোর ফরকটা তো বেশ বোলে টেনে নিতো তারপর একহাত পিঠে আরেক হাত বুকে ।
তুই কষ্ট পেতি মনে মনে?
মেয়েদের সহজে কষ্ট পেতে নেই
অবশ্য ভালোদাদু আমারো নুংকু নিয়ে যাতা করতো । সবার মধ্যে পেন্টুলের সামনে হাত দিয়ে চিৎকার করতো নন্দোর চিটকেনাটা ইয়াআ বড়ো
এ বাবা , তোর লজ্জা কোরতো ? তখন তুই কত বড়ো ?
এইট টেইটে পড়ি
তার মানে তো ঘাস গজিয়ে গ্যাছে
তা তো হবেই
একদিন নাআআ ভালোদাদু আমার বুকে মুক দিয়ে বলে দিদিভাই এট্টু মিনু খাই। আমি তো হাত ছাড়িয়ে দে  দৌড়। ক'দিন পরে বাড়িতে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে কী জোরে জোরে মা কে ডেকে বলছে কী , বৌমা তোমার মুনিয়া ডাগর হয়েচে গো আমায় দুদু খেতে দেয় নাকো আর ।
তখোন কাকীমা মুক ঝামটা দিতো না !
ধুস মা তো মুকে আঁচল চাপা দিয়ে রান্না ঘরে খিলখিল কোরে হাসতো । আরে বিন্দু পিসি কম করেচে আমার সনগে । ঘাটে পীঠে সাবান দিতে দিতে বগোলের তলা দিয়ে বুকে হাত দিতো , আমি যদি বলি উঁউউ , সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিতো । আর সকলে কী হাসি । ভাগ্গি মেয়েদের ঘাটে চান কোত্তুম । আমায় বিন্দুপিসি পীঠে সাবান ঘষতে বোলতো , আর আমার হাত টেনে নিতো নিজের বুকে , বোলতো টেপ টেপ , কাউকে খপোরদার বোলবিনি কিন্তু ।
ও মা তাইইই ! বিন্দু পিসিদের বাড়িতে একবার , ওই যেবার রত্নাপিসির ছেলের পৈতে হলো , বিন্দুপিসি ছাড়া সবাই তো চোলে গেলো বর্ধমানে , মাকে বোলে গেলো , নন্দ যেন রাত্তিরে থাকে , বিন্দুর একা একা ভয় করবে । এট্টা পুরুষ মানুষ থাকা দরকার । বিন্দুপিসি ফাস্ট ইয়ারে পোড়তো । আমি খেয়েদেয়ে ছোটঠাকুমার বাড়ি শুতে গেলুম । বিন্দুপিসি সব্বোস্য এঁটে বসে আছে । আমি যেতে যেন তার ধরে প্রাণ এলো । খেলোদেলো । আমি বোল্লুম তুমি শুগে যাও । একটু টিভি দেখে এ ঘরে শোবোখন । বিন্দু পিসি আঁৎকে উঠে বলে , ও নন্দ আমি মরে যাব --- লোক্কী সোনা আমার কাছে শো । আমি ঘুমুতে পার্বো না রে , খুটখাট আওয়াজ হোলে হাটফেল করে মরে যাবো । তকোন কী আর করি । অগত্যা ওর ঘরে শুলুম ।
হ্যাঁতোও ও খুব ভীতু ।
শুদু ভীতু ! আমি ঘুমিয়ে পড়েচি । হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল । আমার পেন্টুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে ।
সে কীঈঈঈ ! এ বাবা ! তার পর ?
আমাকে জাগতে দেখে তাড়াতাড়ি হাত বার করে নিয়েচে । কিন্তু ততক্ষণে তো যা হবার তা হয়ে গেছে । শালা কাউকে বোলতে পাচ্চি না । মাক্কালী এই পোথম তোকে বোল্লুম । আর কেউ জানে না । তারপরেও তিনদিন রাতে শুতে গিয়েচি কিন্তু আর টাচ করেনি । করলে নাআআ--- 
নন্দো মনে আছে সুবল স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া ! 
মনে থাকবে না ! রেচনের চ্যাপ্টার আসতেই ব্যস আর যেন তোরা মুক তুল্তে পারতি না , মাধবী তো ফিক ফিক করে হেসেই যেতো 
আর হরমোণ --- ওফ যেন কী না কি --- স্যারের পড়া শুনে ভেতরে ধন্ধ হলো , নিশ্চয় স্যর কিছু চেপে যাচ্ছে ; ভাবলুম গাছের ভেতরও হরমোণ আর আমার ভেতরও হরমোণ ।
লজ্জায় লজ্জায় পড়াই হলো না , জিগ্গেস করা হলো না , পরে পড়তে গিয়ে দেখি ---- ভোঁ ভাঁ । ছেলে মে একসঙ্গে না হলে ভালো ছিলো ।
জননটা আলাদা পড়িয়েছিলো মনে নেই ? আমাদের মে'দের সকলেরটায় হাত দিয়েছিলো স্যার । তোদের ?
ধুস , আমাদের সম্পূর্ন ফুলের পরাগ মিলন বুঝিয়ে বোলেছিলো , গাছের মতো মানুষেরও স্পার্ম আর ওভাম মিলিত হয়ে বাচ্ছা হয় ।
বোঝো ঠ্যালা আর আমাদের মানুষের প্রাইমারি অর্গান তার বোঁটা অব্দি ধরে ধরে বোঝালো , আর কেবল বলে লজ্জা করলে লাইপ সাইন্স পড়া হবেনা কো । 
ভেবে দ্যাক এখন হলে জেল জরিমানা হয়ে যেতো ।
ভালোদাদু , বিন্দুপিসি সুবোল স্যর সব জেলের ঘানি টানচে !



মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়


অপরাধবোধ


ছোট্ট সানাকে স্কুল দিতে যাবার সময়ই আজ তপতী ভেবে নিয়েছিল কিছুতেই স্কুলের পাশের গলির দিকে তাকাবে না । একটা উটকো সমস্যা শুরু হয়েছে দিন পনেরো হলোতবে তার আগেও হতে পারে । কিন্তু তপতী নোটিশ করেছে পনেরো দিন আগে । সানাকে স্কুলের গেটের ভিতর ছেড়ে দিয়ে মনটাকে শক্ত করে ফেরার পথ ধরে তপতী । কিন্তু শেষমুহূর্তে নিজের অজান্তেই পিছন দিকে তাকিয়ে ফেলে তপতী । আর ঠিক চোখাচোখি হয়ে যায় বয়স্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ।
পরেরদিন গিয়ে দেখে যথারীতি ওই মহিলা দাঁড়িয়ে আছে আর তার দিকে একদৃষ্টে দেখছে ।  দেখেও না দেখার ভান করে সানাকে গেটের ভিতর ছেড়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরে । আজ মহিলাটি তার সামনে রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়ায় ।
বলে,সুমনাপিসিকে মনে আছে ? তোমাদের বাড়িতে থাকত একটা সময় ।
তপতী ভাল করে দেখে মহিলাটিকেহ্যাঁ, ইনি সুমনাপিসিই । বয়সের ছাপ পড়লেও চেনা যায় ।
কি গো বুড়িমা, চিনতে পারছ না ?
আর তো কোন সংশয়ের জায়গা নেই । বুড়িমা বলেই সুমনাপিসি তাকে ডাকত । আর সুমনাপিসিকে সে তো কোনদিন ভুলতে পারবে না । ভোলা সম্ভব না ।তার দশ বছরের জন্মদিনে দিদার থেকে সোনার রিং উপহার পেয়েছিল । কিন্তু তার পরের দিন মা দুষ্টুমি করার জন্য বেশ বকাবকি করে সেই রাগে কান থেকে রিং খুলে জানলা দিয়ে বাড়ির পাশের হাই ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল । কিন্তু একটা রিং খুলে ফেলে দেওয়ার সময়েই সুমনাপিসি ঘরে চলে আসে । দেখেই ছুটে আসে । বলে, এটা কী করলে বুড়িমা ! বৌদি জানলে খুব রাগ করবে ।
পরে মায়ের আদরে রাগ ভাল হয়ে গেলে সে রিং ফেলে দেবার কথা ভুলেও গিয়েছিল । গোলমাল বাঁধলো পরেরদিন স্কুল যাবার সময় মা যখন চুল বাঁধতে গিয়ে একটা কানে রিং দেখতে পেলো না । তাকে জিজ্ঞাসা করলে ভয়ে সত্যি কথাটা মাকে বলতে পারেনি তপতী ।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে সুমনা পিসিকে দেখতে পায়নি । পিসি কোথায় জানতে চাইলে মা বলে দিয়েছিল, পিসি আর এ বাড়িতে থাকবে না । 
পরে বাবা মায়ের আলোচনায় বুঝতে পেরেছিল কানের রিং না পাওয়ার জন্য মা পিসিকে দায়ী করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে ।
আজ সেই সুমনাপিসি সামনে দাঁড়িয়ে । কী করবে সে ? সে তার পুরোনো অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে, নাকি চিনতেই অস্বীকার করবে মানুষটাকে ।
বেশ কিছুটা সময় মুখোমুখী দাঁড়িয়ে থাকার পরে সুমনাপিসি নিজে থেকেই বলে, আমিই বোধহয় চিনতে ভুল করেছি । কিছু মনে করো না । তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলাম ।
সুমনাপিসি চলে যাবার পর তপতী মনে প্রশ্ন জাগে  এতদিন পর সুমনাপিসি কেন এলো তার কাছে ? কী করে খোঁজ পেলো তার ? তাহলে কী কোনো প্রয়োজনে  . . .
চোখটা ভিজে যায় তপতীর । ভাবে, সেদিনের অপরাধ না আজকের অপরাধ, কোনটা বেশী ?



শম্পা রায় বোস

হ্যাপি অ্যানিভার্সারি
---------------------------


না। মেয়েটি হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানে না।/

কিন্তু গো- বাথানে, গোবরের ছড়া দিতে জানে। /জাবনা কাটতেও জানে,,,,,, /

এমন কি গায়ে মুখে হাত বুলিয়ে, /ঐ অবলা গুলো র চোখের ভাষাও পড়তে জানে।/

কিন্তু মেয়েটি হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানে না।/

মেয়েটি সারাদিন বাগানে পাতা ফুল তোলে,
সন্ধ্যায় ঘরে এসে বাচ্চাদের জন্য খাবার বানায়,
হাড়িয়া খেয়ে
মরদের বুকে মাথা রেখে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে,
ঝকঝকে সাদা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চাঁদটা কেমন টুপ করে উঠে পড়ে।

কিন্তু না। এই মেয়েটি ও হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানে না।

আষাঢ়ের কোন সন্ধ্যায়, ভাঙা বাক্সে রাখা বিয়ের ঐ লাল শাড়িটা,,,
সকলের আড়ালে, লুকিয়ে বার করে, /হাত বোলায়, চোখ বন্ধ করে গন্ধ শোঁকে।
বিয়ের রাতের সেই গন্ধটা খোঁজে।
বুকে চেপে ধরে মনে করতে চায় সেই দিনটার কথা,,,,,

কিন্তু সেও হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানে না,,,,,,,,

নেশায় আচ্ছন্ন,, মাতাল স্বামীর গুম করে পিঠে কিল খেয়ে,
দাঁত চেপে দম বন্ধ করা বুকের যন্ত্রণা সহ্য করে,,,,
এক বুক অভিমানে,হাসি মুখে, /মুখের সামনে ভাতের থালা ধরা ,,,
সেই মেয়েটি ও জানে না হ্যাপি অ্যানিভার্সারি র কথা,,,,,

হাড় জিরজিরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাকা অভাবের সংসারে,
এক ঘরভর্তি কিলবিল করা, উপোসী গুলোর জন্য,
 ভাত রাঁধতে রাঁধতে, দূরের কোনও বাঁশির শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠে।
উঠোনে পড়া থাকা পলাশ ফুল খোঁপায় গুঁজে, 
/পারা বের করা আয়নায় মুখ দেখে।
দাঙ্গায় নিখোঁজ স্বামীর মুখটা মনে করে।
সেই মেয়েটিও কিন্তু হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানে না।

অর্পিতা বোস

আত্মজ 
_________



_____________

  অনাথাশ্রম থেকে বাড়িতে ফিরে  তিস্তা দেখে ত্রিদিবের ফটোর সামনে তীর্থ চুপ করে একটা চেয়ারে বসে আছে। কোনো কথা না বলে ফ্রেশ হয়ে শোবার ঘরেএসে বসে।ড্রেসিং টেবিলের দুজনের ফটোতে  ত্রিদিবের হাসিটা এখনো যেন জীবন্ত।ফোটো টাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে , আমি কী করবো এখন?আমাকে কার কাছে  রেখে গেলে?  
    এমন সময়ে  আরতী এসে   রাতের খাবার গরম করবে কিনা জানতে চাইলে, তিস্তা  জানায় তার খিদে নেই। তীর্থকে খেতে দিয়ে আরতীকে খেয়ে নিতে বলে।
   নিজেকে বড়ো অসহায়, একাকী লাগে তিস্তার ,তবু বুকের কষ্টটা চোখ বেয়ে নামেনা। হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে তিস্তা দেখে তীর্থ দাঁড়িয়ে, আসব ?
--এসো।
 কি বলবে তিস্তা বুঝতে পারেনা,বুকের ভেতর ঝড় ।তীর্থ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,তুমি  খাবেনা? 
  একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিস্তা বলে,খিদে নেই,তুমি খেয়েছ ?
--আমারও খিদে নেই ।
   ঠিক ত্রিদিবের মতোই বললো তার সন্তান।শুধু কি ত্রিদিবের সন্তান তীর্থ? সে তো তারও সন্তান ।বুকটা মোচড় দেয়,তার আত্মজ অথচ যেন কতদূরের মানুষ।দোষ কার! নাহ্-এসব ভাবার সময় নেই।তীর্থকে বলে,তুমি খেয়ে নাও।কাল তো বেরোবে।
প্যাকিং হয়ে গেছে? 
তীর্থ বলে,প্যাকিংতো তেমন কিছুনা।বেশি কিছুতো আনিনি, তবে বাবাই  সবসময়ই --
   তীর্থের গলাটা ধরে এলো, তিস্তা নিজেকে সামলে বলে, খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
 আরতী--
    হাঁক দিয়ে নিজেই খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে   লাগল তিস্তা। শুধু তীর্থের খাবার বেড়ে দিলে তীর্থ বলে ওঠে,খালি পেটে শুলে তোমার শরীর খারাপ করবে,একটা রুটি খেয়ে নাও।
  চোখটা জ্বালা করে ওঠে তিস্তার,কিন্তু নাহ্ ,দুর্বলতা প্রকাশ করা তিস্তার স্বভাব নয়।তবু এমন করে এই প্রথম তার সন্তান তাকে খেতে অনুরোধ করলো,বুকটা কেমন করে ওঠে। নিশ্চুপে দুজনে খেয়ে ওঠে।খাওয়া শেষ করে তিস্তা শোবার ঘরে এসে বসে,তীর্থের তার জন্য আজ প্রথম অনুভূতির প্রকাশ, তিস্তার ভালো লাগে।ঘুম  আসছেনা দেখে বাইরের বারান্দাতে গিয়ে বসে তিস্তা।
 রাস্তার ওপারে একটা কুকুর আর তার বাচ্চাটা খেলছে।
তিস্তার বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে নার্সিংহোম তার কোলে সদ্যোজাত তীর্থ।বহু চিকিৎসার পরে তার  আত্মজকে স্পর্শ করে তিস্তার সাথে সেদিন ত্রিদিবের চোখেও জল ছিল।কিন্তু সুখের সময় ছিল স্বল্পস্থায়ী।বাড়িতে আসতেই তিস্তার চেনা সংসারটা কেমন চোখের সামনে বদলে যেতে লাগল।একমাত্র বংশধরের সঠিক দেখভাল করতে অনভিজ্ঞ তিস্তার সক্ষমতা নিয়ে সদ্য স্বামীহারা শাশুড়ির সন্দেহ প্রকাশে তিস্তা অবাক হলেও ভাবতো,হয়তো দীর্ঘপ্রতীক্ষার অবসানে নাতির প্রতি স্নেহের কারণে এমন করতেন এবং তীর্থের সাথে সময় কাটালে শোকার্ত একাকী শাশুড়িমার ভালো লাগবে।তিস্তা তাই প্রথমে তীর্থকে তার শাশুড়িমার কাছেই বেশি সময় রাখতো।কিন্তু ধীরেধীরে সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো, এরমাঝেই আবার শারীরিক জটিলতার কারণে তিস্তাকে অপারেশনের জন্য ছোট্ট তীর্থকে তার ঠাকুরমার জিম্মায় রেখে তিস্তা দশদিন নার্সিংহোমে রইলো।সেসময়টা ছোট্ট তীর্থকে দেখার জন্য,তাকে কাছে পাওয়ার জন্য তিস্তার মন ছটফট করতো।স্তনবৃন্ত উপচে তীর্থের আহার বয়ে যেত যখন, অথচ তীর্থ কৌটোর দুধ খাচ্ছে, তখন তিস্তার চোখে অকাল শ্রাবণ নামতো।আকুল হয়ে  দিন গুনতো ছুটির।
বাড়িতে পা দিয়েই তীর্থকে কোলে নিতে চাইলে, শাশুড়িমা বলেন, ঘুমোচ্ছে ,পরে দেখো,ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও।
  ত্রিদিবও তার মাকে সমর্থন করলে ক্লান্ত তিস্তা মনখারাপ করে নিজের ঘরে তীর্থের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করে।
  ছোট্ট তীর্থের কান্নার আওয়াজে তিস্তা তীর্থকে কোলে নিতে শাশুড়িমার ঘরে ছুটে গেলে,শাশুড়িমা ওঠেন, অসুস্থ শরীরে তোমার এসব করতে হবেনা।আমি তো আছি।
  কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিস্তা চোখের জলে নিজের ঘরে ফেরে। 
  ধীরে ধীরে তিস্তা সুস্থ হয়ে উঠলেও তীর্থকে সেভাবে কাছে পায়না।আকুল হয়ে একদিন ত্রিদিবের কাছে তার কষ্টের কথা জানাতেই ,শোনে, বাড়িতেইতো আছে,  এঘর আর ওঘর,আর তোমারও রেস্ট দরকার।তাছাড়া মারও তো তীর্থকে নিয়ে ভালো সময় কাটছে।এসব ভেবোনা।ঘুমিয়ে পড়।
   অভিমানী তিস্তা সেদিন কথা বাড়ায়নি।কি বলবে? কাকে বলবে ?অভিযোগ জানানোর কে আছে তার?
  অসহায় তিস্তা ধীরে ধীরে সংসারে তার অবস্থান বুঝতে পারছিল।তীর্থকে ঘিরে তার ঠাকুরমা একটা বলয় তৈরি করেছেন যেখানে তিস্তার প্রবেশাধিকার নেই।একদিন এই বিষয়ে তিস্তা ও ত্রিদিবের মতানৈক্য চরম পর্যায়ে  ওঠে।ত্রিদিব এই বিষয় ভালো করে  লক্ষ্য করে,তার মায়ের তীর্থের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ, যা স্বাভাবিকতার সীমানা ছাড়িয়েছে।ত্রিদিব এই নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়।চিকিৎসক জানালেন,যে তার মা’র একাকীত্বের সময়ে  তীর্থকে আগলে তিনি নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।
 এটা  একধরনের মানসিক ব্যাধি।এখন তীর্থকে ওনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে গেলে  মানসিক  আঘাতে আঘাতে তিনি  মানসিক  ভারসাম্য  হারাতে পারেন।
   অসহায় দম্পতি  কি করবে ,বয়স্কা মাকে এমন জীবনযাপনে আর বাঁধা না  দেওয়ার  সিদ্ধান্ত নেয়।
  সময় এগিয়ে চলে কালের নিয়মে,তীর্থ বড় হয়ে ঠাকুরমাকে 'মা' আর তিস্তাকে  'মামনি' বলে ডাকে।তিস্তা বিনাl প্রতিবাদে 'মামনি' ডাককেই আপন করে নেয়।শুধু অবাক হয়,তিস্তাকে তীর্থের কাছে দেখলেই শাশুড়িমা ছুটে এসে তীর্থকে নিয়ে চলে যান। তিস্তা দেখে তার সন্তান তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, চাইলেও তীর্থকে সে ইচ্ছেমতো আদর করতে পারেনা।কিন্তু ঐ বয়স্কা মাতৃসমা  মানুষটিকে কেন যেন আঘাত দিতে মন চায়না তিস্তার।সে মনে করে তার সন্তান একদিন ফিরে তারকাছেই আসবে, সেদিন  তীর্থকে প্রাণভরে আদর করবে তিস্তা ।কোথাও একটা নাপাওয়ার  শূন্যতা তিস্তার বুকে জমতে থাকে।
 তীর্থ বড়ো হলে তাকে স্কুলে দিয়ে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে  পড়ানো, সব বিষয়ে সব দায়িত্ব তীর্থের ঠাকুরমা নিজের হাতে তুলে নেন। তিস্তা  অসহায়ভাবে শুধু দেখতে থাকে ।তীর্থ যতো বড়ো হতে লাগল,ততোই তিস্তার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
    তারপর সেই দিন,তিস্তার মনে পড়ে, ছাদে জামাকাপড় তুলতে গিয়ে তিস্তা দেখে ক্লাস এইটে পড়া তীর্থের মুখে সিগারেট। নিজেকে সামলাতে পারেনা সেদিন। তীর্থের ফর্সা গালে তিস্তার পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ চেপে বসেছিল।তীর্থের মুখে অনুতাপের ছায়া না দেখে আশ্চর্য হয়েছিল তিস্তা।নিচে নেমে ত্রিদিব আর শাশুড়িমাকে বলতেই সবাইকে  অবাক করে তীর্থ উগ্রভাবে বলে ওঠে,কে তুমি আমাকে শাসন করার? জন্ম দিলেই 'মা' হওয়া যায়না।যা করেছে আমার মা-
  ঠাকুরমাকে ইঙ্গিত করে বলে,  যদি কিছু বলার থাকে, আমার মা বলবে।
     নিস্তব্ধ ঘরে অভিমানী তিস্তা জলভরা চোখে ত্রিদিবের দিকে তাকালে, ত্রিদিব বলে, গায়ে  হাত তোলাটা ঠিক না।
  স্তম্ভিত তিস্তাকে আরও অবাক করে শাশুড়িমা বলেন,  এই বয়সে অমন একটু আধটু -
কথার শেষটুকু না শুনেই তিস্তা ঘরে চলে যায়। কষ্ট, অভিমান বুকে চেপে বসলেও চোখ বেয়ে নামেনা।
   তিস্তার বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই থেকে তীর্থ আর তিস্তার মাঝে একটা অদৃশ্য পাঁচিল গড়ে ওঠে।তীর্থ তখন থেকে  তিস্তাকে প্রায় এড়িয়ে চলতো।তিস্তার বুক ফেটে যেত,কিন্তু তিস্তার মনেও একবুক অভিমান জমে বরফ  হচ্ছিল। তীর্থ ক্লাস টুয়েলভে উঠার পরেই তীর্থের  ঠাকুরমা  মারা গেলেন, তখন একাকী তীর্থকে কাছে টানার জন্য তিস্তার সবরকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে  দুরত্ব আরও বাড়ে।সময়ের সাথে তীর্থ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ম্যানেজমেন্ট  পড়তে  দিল্লি যয়।
তখনও অভিমানী  তিস্তা ভেবেছিল অন্তত দিল্লি যাওয়ার সময়ে তাকে যাওয়ার কথা বলবে।কিন্তু  সব ভুল ভেঙ্গে তীর্থ আর ত্রিদিব দিল্লি গিয়ে তীর্থকে  সেটল করে ফিরে আসে ত্রিদিব। ছুটিছাটায় তীর্থ কলকাতা খুব কম এসেছে, ত্রিদিব  দিল্লি গিয়ে দেখা করে  এসেছে।
    বাড়িতে একাকী তিস্তার সময় যেন কাটতে চাইতোনা।এমন সময়ে তিস্তা একজনের থেকে এই 'আলোর  দিশা'- নামের অনাথাশ্রমের সন্ধান পায়।এখানে যেন তিস্তা  নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেল, ঐ ছোট ছোট  অনাথ শিশুদের মধ্যে।ত্রিদিবও কোনও আপত্তি করেনি,উল্টে সেও মাঝেমাঝে  তিস্তার সাথে 'আলোর দিশা'তে যেত।এমন করেই দিন কাটছিল,  কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ ত্রিদিবের বুকে ব্যথা, দিশেহারা তিস্তা ডাক্তারকে ফোন করে উঠে ত্রিদিবের বুক ডলতে থাকে কিন্তু সেচেষ্টা ব্যার্থ করে হঠাৎই ত্রিদিবের মাথাটা তিস্তার কাঁধে এলিয়ে পড়ে। ডাক্তার এসে দেখেন সব শেষ।খবর পেয়ে পরদিনই ফ্লাইটে তীর্থ কলকাতা আসে।গতকাল সব কাজ মিটলে রাতে  বসে  ভাবছিল তিস্তা,তীর্থ চলে গেলে,একা একা  এই বাড়িতে সে কিকরে থাকবে? ঠিক করে, তীর্থ চলে গেলে সেও এই বাড়িতে থাকবে না, চলে যাবে যেদিকে দুচোখ যায়।
 কিসের পিছুটান তার?তীর্থর ক্যাম্পাসিং এ ওবেরয় গ্রুপে সিলেক্টেড।তাই  তীর্থের  ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা নেই, তাছাড়া ত্রিদিবের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ও কম নয়।নাহ -তিস্তাকে কারো আর প্রয়োজন নেই।
আজ গিয়েছিল তাই তিস্তা  আলোর দিশা'তে।তিস্তা l ওখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে থাকার জন্য  আগ্রহ প্রকাশ করলে,সাদর অভ্যর্থনা পায়।তাই তিস্তা ঠিক করেছে,তীর্থ চলে গেলে, তার ঠিকানা হবে  'আলোর দিশা।'
   দরজায় নক করার শব্দে তিস্তা তাকিয়ে দেখে সকাল হয়ে গেছে।নিজেকে বারান্দায় চেয়ারে খুঁজে পেয়ে বোঝে , কখন চোখ লেগেছে কাল  রাতে টের পায়নি।দরজা খুলে দেখে তীর্থ, হাতে ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ, আর নীচে  একটা  ট্রলি ব্ব্যাগ।হতবাক তিস্তাকে তীর্থ  বলে, ট্রেটা  ধরে ভেতরে চলো।স্তম্ভিত তিস্তা চায়ের ট্রে নিয়ে খাটে এসে বসে।তীর্থ ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে ঘরে এসে বিছানাতে বসে বলে, নাও গুছিয়ে নাও। দিল্লিতে কিন্তু  ঠান্ডা  পড়ে খুব, শীতের জিনিস বেশি করে নিও।
       তিস্তা অবাক হয়ে তীর্থের দিকে তাকাতেই, তীর্থ ট্রলি ব্যাগ থেকে একটা ডাইরি  বের করে তিস্তার হাতে দেয়। তিস্তার কাঁধে হাত রেখে বলে, বাবাইয়ের ডাইরি, আমাকে পড়তে  দিয়েছিল, মামনি। শেষবার  বাবাই যখন দিল্লি গেল আমাকে  এই ডাইরি টা দিয়েছিল। মা'র আমাকে তোমার থেকে  দুরে নিয়ে যাওয়া, তোমার কষ্ট, সব বাবাই লিখে গেছে ।কিন্তু মা'র থেকে আমাকে  কেড়ে নিয়ে তোমার কাছে  দিলে মা যে আরও অসুস্থ হয়ে যেত,তাই তুমি  এতোটা sacrifice করেছো মামনি!আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি মামনি ,তোমার  কষ্ট, বাবাইয়ের কষ্ট,মা'র সমস্যা,মামনি আমি ডাইরিটা   পড়তে পড়তে অনুভব করছিলাম। এরপর মাঝেই  এমনভাবে বাবাইয়ের এই --
    ধরা গলায় তীর্থর কথাগুলো  মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল তিস্তা।বুঝতে পারছিলনা, সে কি  স্বপ্ন দেখছে কিনা!
  সম্বিত ফেরে  তীর্থের কথায়,   আমি অনেক ভুল বুঝেছি তোমাকে।কতো কষ্ট তুমি  পেয়েছ মামনি, আর না।মামনি আজ এই মুহুর্ত থেকে আর ভুল বোঝাবুঝি নয়,তোমাকে ছাড়া আমি  আর থাকবোনা।কালকের  টিকিট  ক্যানসেল করে   পরশুরাম দুটো এয়ার টিকিট কেটেছি। আমার সাথে তুমি  দিল্লি যাবে। আপাতত এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট  ভাড়া নিয়ে থাকবো দুজনে। তারপর অন্য ব্যবস্থা করে নেবো,ভরসা করতে পারো। 
 তিস্তা তার কাঁধে  তীর্থের ভরসার  হাতে মাথা রাখলো।
---তোমাকে ছেড়ে আর   থাকবোনা,মামনি ।
    তীর্থ জড়িয়ে ধরে  তিস্তাকে।
এতবছরের জমানো কষ্ট তিস্তার চোখ বেয়ে আজ আনন্দাশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে,আজ তার আত্মজ শুধুই তার ,একান্ত নিজস্ব

শুভশ্রী সাহা





দাঁতাল

বড় একা লাগে এই জঙ্গলে, আলো আঁধারিতে  সবুজের গভীরতায় ময়াল সাপের মত পেঁচিয়ে যায় হাতের রেখার মত চেনা বন ঝোরার ওপারের খসখস শব্দে বুঝি অজগর শিকার ধরেরছে বড়সড় অনেক দূরের ক্যানেস্তারা পেটানোর একটানা আওয়াজ! আজ হাতি বেরিয়েছে এদিকের জঙ্গলে তছনছ করে চলে যাবে খোড়ো বাড়ি আখ ক্ষেত কলা বন চাপড়ামারীর দামাল হাতিটা কাল একজন কে আছড়ে মেরেছে রাস্তায় পড়েছিল মৃতদেহ বেনাম আদিবাসী মরলে কেস দেওয়া মানা বিট অফিসারদের দেশে বাঘ হাতি সংরক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি অতএব তারা মরূক ঋতবান জানে, এই গভীর রাতে এরা চোরা শিকার করতে এসে নিজেরাই শিকার হয়ে ফেরে এদের ধরা মানা আছে তাই বন্য জন্তুকে দিয়ে দাও ভাগ করে খাবে জোরসে চেঁচাচ্ছে আলুওয়ালার কুকুর দুটো, ওদের কপি ক্ষেতে শুয়োর ঢুকেছে নির্ঘাত কুকুর দুটো কম নয় নিমেষের মধ্যে  পেট টি পুরো ফালা ফালা করে দিতে পারে আপন মনে হাসল বিট অফিসার  ---
এদের বন্যতা তুচ্ছ মানুষের বন্যতার কাছে মাত্র মাস আগে কেওন গড়ের জঙ্গলে সে এক পাল কে এল জঙ্গী কে পুড়িয়ে মেরেছিল রাতের অন্ধকারে উপর ওলার নির্দেশে তারপর প্রমোশন নিয়ে একেবারে ডুয়ার্সে সব একদম ঠিক ঠাক আছে এখন কোই বাত নহি! শুধু মাঝে মাঝেই চামড়া পোড়ার গন্ধ পায় সে আজকাল খেতে বসলেই!!!