রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

                        




গতকাল যাহা গোলারুটি আজ তাহাই প্যানকেক 


একটা আলসে দুপুর, ঝিমঝিমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলা। একটা ছোট্ট শালিক কাকভেজা হয়ে বসে আছে পাতার আড়ালে...এসব দেখতে দেখতে কখন যে  লাঞ্চটাইম চলে এল টেরই পাইনি।কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে বিড়ালের মত ঘুরঘুর করছি,আচমকা চোখ পড়ল কৌটোঘরের তৃতীয় তাকে।এখানে আটা ময়দা ব্যাসন ওটস চালগুঁড়ো এসব রাখা থাকে। দেখা মাত্রই মাথায় কিলবিল করে উঠল খাদ্যপোকারা।

     


একটা বড় ডিপ বাটি নিলাম।সেখানে চারচামচ করে ব্যাসন ওটসগুঁড়ো আর আটা, দু'চামচ করে ময়দা কর্ণফ্লাওয়ার এক পিঞ্চ বেকিং সোডা স্বাদমতো নুন দু'চামচ চিনিগুঁড়ো নিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে নিলাম, এরপর  একটা ডিম একটা কলা অল্প দুধ দিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে মাঝারি ঘনত্বের ব্যাটার তৈরি করে নিয়ে একটা ননস্টিক প্যানে দু'ফোঁটা অলিভ অয়েল ব্রাশ করে তৈরি করে রাখা মিশ্রণ কিছুটা ঢেলে গোল করে ঘুরিয়ে নিয়ে একটা ঢাকনা দিয়ে পাঁচ মিনিট গ্যাসের আঁচ কমিয়ে রাখলাম।এরপর ঢাকা খুলে অপর দিক উল্টে দিয়ে আবার দু'মিনিট।  


মা খুব ভালো গোলারুটি করত। ঝাল হোক বা মিষ্টি মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মা নিজেই।আজ যাকে আমরা প্যানকেক বলি বহুবছর ধরেই বাংলার রান্নাঘরে সে ই ছিল গোলারুটি। 


এর সাথে সাইড ডিশ হিসেবে খেলাম  খাকড়ি গুড়।এখন আপনারা বলবেন এটা কি বস্তু? এর খায় নাকি মাথায় দেয়?আমি বলব এটা দারুণ লোভনীয় পদ।যারা বাড়িতে ঘি তৈরি করেন তারা জানবেবই ঘি ছেঁকে নেবার পর ছিবড়ে অংশটা পড়ে থাকে, অনেকেই গরম ভাতে বা মুড়ি দিয়ে ওটা খান,আমি খাকড়িটার সাথে একটু গুড় মিশিয়ে একটা প্যানে একদম লো স্টিমে ক্রমশ নেড়ে তৈরি করেছি খাকড়িগুড়।


গোলারুটি বলুন বা প্যানকেন, খাকড়ির সাথে জমে গেল বৃষ্টিধোঁয়া একাকী লাঞ্চ।.

            


জয়তী রায় (মুনিয়া)

                                         


                                                                    



অশান্তি 😌 থেকে শান্তি😊

💕💕💕💕💕💕💕💕💕

  মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল অশান্তি। এ এক ভয়ঙ্কর রোগ। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে এই রোগের শিকার। মহামারীর চাইতে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। অশান্তিতে যে ভুগছে, সে সবসময় চাইবে অপরজন তার অসুবিধাটা বুঝুক। চুপ করে থাকলেও তার শরীর হতে বিচ্ছুরিত হয় অশান্তির আলো, যা পরিবার বন্ধু এবং সমাজ করে তোলে অন্ধকার। 

💕💕💕💕

অশান্তির সমস্ত কারণের পিছনে বাস্তব সম্মত কিছু ভিত্তি থাকে। কোনো কিছু অকারণ হয় না। সেই কারণ বলতে না পারা বা বুঝতে না পারার সঙ্গে লড়াইতে ক্লান্ত মানুষ, সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য, নিজের এক কাল্পনিক দুনিয়া তৈরি করে, সেটা ঠাকুরঘর হতে পারে, গানের ঘর হতে পারে, লেখার টেবিল অথবা পরকীয়া। ধীরে ধীরে সেই কাল্পনিক দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে পড়ে, আর মুক্ত হতেই চায় না, এমন ও দেখা গেছে, সেই দুনিয়ায় কিছু মানুষজনের দেখা পায় সে। অর্থাৎ, মনের স্থিতি তখন নষ্ট হতে চলেছে। 

আর, দীর্ঘস্থায়ী মন খারাপ শরীরের মধ্যে সৃষ্টি করে না না রোগের। ক্যান্সার সহ  সুগার প্রেসার বহু রোগের কারণ অশান্তি থেকে উৎপন্ন নেগেটিভ এনার্জি।  নষ্ট করতে থাকে কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা আনন্দ। অকারণ কান্না পায়, দুনিয়া ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে আসে।

😊😊😊😊😊😊

আগেই বলেছি, অশান্তি অমূলক নয়। থাকে কিছু তো ঘটনা থাকে। প্রথম কারণ আমি বলব , কথা। শব্দ ব্রহ্ম। কথার শক্তি প্রচন্ড। শব্দবাণ রক্তাক্ত করে দিতে পারে মানুষকে। পরিবারের একটি কথা, ফেসবুকের একটি পোস্ট ... বদলে দিতে পারে আগামী কিছু ঘণ্টা। কথার আঘাত সামলে ওঠা খুব মুশকিল। বিশেষত, কুৎসা রটনা শুনলে মন খারাপ হয়। কুৎসা মেনে নেওয়া খুব মুশকিল। ফলে, কেউ কাজ ছেড়ে দেয়, কেউ আত্মহত্যা করে। তাহলে কথা একটা কারণ। এবার, দিনের শুরু থেকে রাতের ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত শুধু মাত্র ভালো কথা শুনব এটা হতে পারে না। মনে রাখতেই হবে, বাজে কথা ভেসে আসবেই। স্বামী সন্তান ভার্চুয়াল জগৎ... টুক করে খারাপ কথা এসে নাড়িয়ে দেবে মনের স্থিতি। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ভালো কথা তোষামোদি কথা মন উৎফুল্ল করছে, কুৎসা মন খারাপ করছে। দুটো অভিঘাত আসছে বাইরে থেকে। এবার আমার করণীয় কী? সুতরাং, সকালে উঠে সবচেয়ে আগে আয়না থেরাপি করে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে: আমি শক্তিশালী একজন মানুষ। আজ যে কথাই আসুক, আমার সুবিধা অনুযায়ী তাকে গ্রহণ অথবা বর্জন করব। সারাদিন দেখতে হবে অপরের মুখ তাই আয়নায় আগে নিজেকে দেখি, নিজেকে তৈরি করি তারপর দেখব অপরে কি বলে! কুৎসার আয়ু বেশিদিন থাকে না। বিচলিত হলে বরং কুৎসার রটনাকে ইন্ধন দেওয়া হবে। 

এই থেরাপি খুব কাজে দেয়। টানা কয়েকদিন করলে তফাৎ বোঝা যায়। 

 *****

অশান্তির আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল অবদমন। চেপে রাখা। অনেক কিছু আমরা চেপে রাখতে বাধ্য হই, যৌনতা থেকে জীবনের অসফল কিছু মুহূর্ত চেপে রাখি সযত্নে। এই চেপে রাখার ফলে ভিতরে ভিতরে বাড়তে থাকে অশান্তি। এই চেপে রাখা কিন্তু ঘুন পোকার মত। তিলে তিলে শেষ করে দেবে। নাহ্, বাইরের কাউকে বলতে না পারলে, নিজেকে বলা যাক। নিজেকে বন্ধু করে তুলতে হলে, 5 মিনিট সময় দিতেই হবে। এবং, জিজ্ঞেস করতে হবে কোথায় হচ্ছে গন্ডগোল। আজকাল এটা ট্রেন্ড, নিজেকে ব্যস্ত প্রমাণ করা। কেবল বলে যাবে, এক ফোঁটা সময় নেই অথচ অনর্থক চ্যাট করার সময় আছে। কি হবে নিজেকে  5 মিনিট দিলে? চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটবে। পরিণত হবে। 5 মিনিট শারীরিক ব্যায়াম যেমন শক্ত করে শরীর, তেমনি মনের ব্যায়াম পুষ্টি জোগায়, পরিণত করে,  ঘটনাটার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে চিন্তা শক্তির উন্নতি ঘটিয়ে দেখা যাবে, চেপে রাখা ঘটনা নিজের সঙ্গে বিশ্লেষণ করে ঘটনাকে কিভাবে মোকাবিলা করা যাবে, তার একটা উপায় বার হয়। না হলে, অনর্থক উত্তেজিত মন ক্লান্ত অবসাদ আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। এই সময় একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারলে আরো ভালো।

*******

আপোষ অথবা কম্প্রোমাইজ , অশান্তি সৃষ্টির বড় কারণ। আপোষ করে চলতে হবেই, নাহলে সংসারে থাকা মুশকিল। কিন্তু, একটা সীমার পরে মন আর নিতে পারে না, তখন শরীরও বিদ্রোহ করে। আপোষ করে চলতে ভালো লাগে না, কথায় কথায় মন চায় , মুক্ত বিহঙ্গের মত বেরিয়ে পড়তে। যদিও, বিহঙ্গ ও মুক্ত নয়, তাকেও আপোষ করতে হয়, সুতরাং, ব্যাপারটাকে ইতিবাচক নজর দিয়ে দেখতে হবে। ওই যে চিন্তা শক্তির উন্নতি ঘটিয়ে চলার প্রক্রিয়া, সেই শক্তিমান চিন্তা শক্তি সাহায্য করবে, আপোষ করেও কি করে নিজেকে সুন্দর এবং ভালো রাখা যায়, সেটা করতে। মনে রাখতে হবে, অশান্তি হল ধোঁয়া, আর স্ট্রেস হল আগুন। 

শুরু থেকে অশান্তির উৎস খুঁজে বার করে তার উপর কাজ না করলে ধীরে ধীরে সেটাই পরিণত হবে মারণ দায়ী স্ট্রেস এ। 

*******

অশান্তি থেকে আসে অবসাদ। মনের নিজেরও কিন্তু ইমিউন পাওয়ার আছে , আছে অরা অর্থাৎ প্রচুর পজিটিভ এনার্জি নিয়েই আমরা জন্মায়। প্রবল অবসাদের আক্রমণে ক্ষয় হতে থাকে এনার্জি। মন দিশেহারা হয়ে পড়ে, ডিসিশন নিতে ভুল করে ফলে আবার অবসাদ আসে। এইখানে বলব, দুই ভুরুর মাঝখানে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষণ টিপে রাখুন। এটা একটা মারাত্মক থেরাপি। যেখানে যখন ইচ্ছে করে নেওয়া যায়। অবসাদে খুব কাজে দেয় ওম মন্ত্র কানে শোনা অথবা মুখে উচ্চারণ করা, দিনে দশবার। অবসাদের সূচনা হলেই এই থেরাপি প্রয়োগ করুন। ভয়ঙ্কর কিছু হলে কিন্তু তখন ডাক্তার আর ওষুধ।

******

আলোচনা শেষ করার আগে বলি, অন্যের উপর সুখ নির্ভর করে না কিন্তু দুঃখ নির্ভর করে। জীবনের নব্বই ভাগ অমুকের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি, বাইরের প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে অশান্তির বীজ, এইখানে থেরাপি হ'ল, বাইরে নিয়ে যখন চলতেই হবে, তখন মন আর বাইরের মাঝখানে একটা পাঁচিল তৈরি হোক। প্রতিদিন ধ্যান করলে, প্রতিদিন একটু একটু করে আত্মশক্তির উন্নতি করলে, বাইরে থেকে ধেয়ে আসা ঝড় বৃষ্টি খুব বেশি ভেঙ্গে ফেলতে পারে না , মনের দুর্গ। প্রতি রাতে না হোক, কিছুদিন অন্তর অন্তর এক জায়গায় নিজের জন্য কিছু পজিটিভ বার্তা লিখে রাখি। যে সময়টা গালে হাত রেখে চিন্তা করছি, অথবা অমুকের সঙ্গে চ্যাট করে হা হুতাশ  করছি, সেই সময় নিজেকে দিয়ে, নিজেকেই শোনাই, আমি অমৃতপুত্র। কেউ আমার কিছু করতে পারবে না। 


 💕💕💕💕💕💕

সামনে আসছে বিশ্বশান্তি দিবস। গোটা বিশ্ব হল আমার মন। তাকে প্রতিদিন যত্ন করুন। নিজের চারিদিকের প্রতিরক্ষা গড়ে তুলুন। অশান্তির ঝড় থেমে গিয়ে পাবেন সুন্দর নির্মল জীবন।

শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                       


মেটামরফসিস 





অবশেষে এক আশ্চর্য ছায়াসম্ভব আলো আমায় নিষ্কৃতি দেয়- বেতস সুষুম্না ভিজে উঠছে স্নানজলে, শৈবলিনী চোখ বুজে সদ্যোজাত তাপে স্বস্তি খুঁজছিলেন অথবা আঁকতে চাইছিলেন। একাই যে পথ পেরিয়ে এলেন এতোদিন, যার শুরু ছিলো যৌথতার প্রতিশ্রুতি দিয়েই, এমনও বলা যায় যৌথতার নিমিত্তেই মন্ত্র দিয়ে গেঁথে যে জীবন নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিলো, শুধু কি তার একারই দায় ছিলো তাকে ধারণের? বহমান রাখার ? এমনকী হয়তো শেষ সমাগত, এই শ্বাসেরও? প্রশ্ন আসে না আর। পথ দীর্ঘ হলে তার ক্লান্তি পথিককে গন্তব্য প্রসঙ্গে উদাসীনতা দেয়, যে কোনো দীর্ঘতর দৈর্ঘ্যের এইই সাফল্য। 




খুব সহজ ছিলো না। অনভিজ্ঞ ষোড়শী ছিলেন। সতেরোতে মা, উনিশে দ্বিতীয় সন্তান, তেইশে কাশের রঙে প্রায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এও এক রহস্য। যে মেয়েটি লাল রঙ ভালোবেসে বড় হলো, আমিষ গন্ধ ছাড়াও যে ভাত মাখা যায়, বিশ্বাস করতে শিখলো না, তার নর্ম সহচর পঞ্চভূতে বিলীনের সঙ্গে সঙ্গে সেই রঙ সেই অন্নঘ্রাণই তার কাছে নিষিদ্ধ, কী করে যে এই ফতোয়া দেওয়া যায়...কই জায়া বিয়োগে তো এমনটি হয় না, এমনকী প্রভু-ভৃত্য পরম্পরাতেও নয়, তাহলে এই অদ্ভুত নীতি শুধুমাত্র এক ব্যতিক্রমে কেন? শৈবলিনী এভাবে ভাবেননি, তার সন্তানেরা ভেবেছিলো। ধ্রুপদী সুন্দর মা'কে বোধ হওয়া ইস্তক শুধুই শুভ্রতায় দেখতে দেখতে তাদের ক্ষোভ এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিলো বিস্তীর্ণ বাগান আলো করে থাকা জুইঁ আর কুন্দ ঝাড়ের একটি ফুলকেও রোদ্দুর ওঠার পরে গাছে দেখা যেতো না। ঋজু ব্যক্তিত্ব অভেদ্য প্রাচীর হয়ে তার সঙ্গে তার সন্তানদের অনাবিলে বাধা হয়ে থেকেছে বরাবর। মা'কে তারা তাদের হাস্য পরিহাসের অংশে পায়নি কখনো। ভাবতে ভাবতে শৈবলিনী ভিজে ওঠেন ভিতরঘরে। তিনি অপরাধী কি? বিশাল এক জীর্ণ অট্টালিকা, অকালপ্রয়াত স্বামীর অপরিকল্পিত সামান্য সঞ্চয় দিয়ে দুই সন্তানকে যে নারীর একা হাতে 'মানুষ' করে তুলতে হয়েছিলো সত্তরের দশকে, চৈতন্যে পুঁতে দিতে হয়েছিলো অর্থের সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো সম্পর্ক থাকে না, থাকে আত্মাভিমানের- এই দর্শন, শুধু সেইই জানে নিরেট গাম্ভীর্য কোনো বর্ম বা মুখোশের মতো আত্মরক্ষার অধিক প্রত্যাঘাতের নাম। এ বাসরে ছিদ্রের অধিকার তিনি দেবতাদের দেননি ফলত দানবেরা অনুপ্রবেশের পথ পায়নি। 



মাটি যে কতদূর ভারী ঠেকলে কেউ স্বেচ্ছায় জলজ হতে চায় শৈবলিনী সেদিন টের পেয়েছিলেন যেদিন তার বাইশ বছরের ছেলে ইণ্ডিয়ান নেভির  নিয়োগপত্র হাতে মায়ের অনুমতি নিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। শৈবলিনী বন্দরের থেকে বেশী বাতিঘর হতে চাওয়ায় সে বাধা পায়নি কোনো। তিনি জানেন, সামান্য বিরোধ প্রত্যাশিত ছিলো মায়ের তরফ থেকে স্বয়মের, অপত্য হলেও সে পুরুষ, যাদের দৃষ্টি বুঝতে তার এক পল মাত্র লাগে। কিন্তু শৈবলিনী বিশ্বাস করেন বিচ্ছেদ তুল্য মায়াবিস্তার কোনো বন্ধনই নির্মাণ করতে পারে না, সুতরাং অবিচল ছিলেন। 



 গত বছর শ্রী'কে সম্প্রদান করেছেন। সেই শূন্যতায় পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই স্বয়ম তাকে জানিয়ে গেলো ঘোর অরণ্যেও প্রতিটি বৃক্ষের একাকী থাকাই বিধি। এখন তার দিলরুবায় অসীম নৈশব্দ্য। অবশ্য এই দেওয়ালেরা প্রগলভতার অভিজ্ঞতা পেলোই বা কখন? বড় শান্ত মেয়ে ছিলো তার শ্রী। মায়ের কাঠিন্য তার নরমে আঁচড়ের অবসর পায়নি কোনোদিন। কথা সে প্রায় বলতোই না। তার আনন্দ অভিমান যে কোনো তরঙ্গের সামান্য সরণ তাকে রেওয়াজে বসাত। সেই সুরই সম্ভবত তাকে নীলাদ্রীর কাছেও পৌঁছে দিলো, ভাবছিলেন শৈবলিনী। যতটুকু তিনি তাকে দেখেছেন, শ্রী যতই অনিন্দ্যসুন্দরী হোক, "রূপে তোমায় ভোলাবো না" এই স্বীকারোক্তির জায়গা অন্তত নীলাদ্রী নন, এইটুকু বুঝেছেন তাই আশ্বস্ত বোধ করছেন। রিপুজয়ের কথা যারা বলে থাকে তারা সম্ভবত প্রথম ইন্দ্রিয়টিকে নিরীহ জ্ঞানে রাখে। অথচ যাবতীয় ভ্রম ও ভ্রমভঙ্গের দায়ভাগ যদি কিছুকে দেওয়া যায় তবে তা 'চোখ'ই। শৈবলিনীর ব্যক্তিগত বিচারে গান্ধারীর অপরাধ অনেক বেশী ধৃতরাষ্ট্রের সাপেক্ষে। জন্মান্ধের অজুহাত যদিও বা গ্রহণীয় কিন্তু সক্ষমের ভাণজনিত বিকার কোনোভাবেই নয়।




বেলা গড়াচ্ছে। স্বয়ম আর শ্রী থাকার সময় বহুসময় তার উনুনের আঁচে কাটতো। রন্ধনশিল্পে বিক্রমপুরের মেয়ের নৈপুণ্যের খ্যাতি মূলত লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হেতু পাড়ায় সুবিদিত ছিল। অবশ্য সে এক এমন সময়ের কথা যখন কোনো সংসারের সব ক'টি তৈজস দিনান্তে নিজের আস্তানাতেই থেকে গেছে, এ'ঘটনাকে বিরল মানা হতো। প্রতিবেশীরা শুধু একটি তথ্য জানতো না, একটা সময়ের পর হাজার চেষ্টাতেও শৈবলিনী তার হেঁসেলে আমিষ রাঁধতে পারেননি। এই একটি বিষয়ে ভাই-বোন দুজনেই অসম্ভব জেদে তাকে হারিয়ে দিয়েছে বারবার এবং প্রতিবার। সামান্য বোধের বয়সে পৌঁছে যেদিন থেকে তারা বুঝতে শিখেছে কী এমন অসুস্থ তাদের মা রোজই এমন হয়ে পড়ে যে তাদের রান্না সেরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে নিজের জন্য একটা পাত্রে সিদ্ধ ফুটিয়ে নিতে হয় সারাদিনের নামে, তারা সেই সমস্ত কিছুর স্বাদকে অস্বীকার করতে চেয়েছে যাতে মায়ের অধিকার নেই। ফলে শৈবলিনীকেও হার মানতে হয়েছে। আঁশহীন অজস্র প্রণালীতে সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতে হয়েছে। 'ঘাটতি' - সঠিক শব্দ হলো কি? শৈবলিনীর অহং জাগল। কখনো 'ভালোবাসি' শব্দ উচ্চারণ করেনি তার কাছে তার সন্তানেরা। হাজারো প্রাপ্তিতে উচ্ছল হয়নি। সহস্র অপ্রাপ্তিতেও অভিযোগ আনেনি। অথচ তাদের সংবেদন এতো সূক্ষ্ম যে কীভাবে কবে হয়ে উঠলো তিনি কর্তব্যের ভারে ঠাহরই করে উঠতে পারলেন না। পিতৃহীন সন্তানদের সব মা'ই কি পৃথা?



ভাবতে ভাবতে উঠছিলেন, প্রায়োবেশনে স্পৃহা নেই প্রমাণে পুরনো একাহারী অভ্যাসে ফিরতে। সিংদুয়ারের কড়া তাকে বিচলিত করল। প্রাচীন আবলুশ, লোহার ভারী শিকল, নির্জন ছিঁড়তে যথেষ্ট সক্ষম। হতেই পারে আত্মীয় পরিজন অথবা ফেরিওয়ালা কিন্তু নৈঋতে কাকের কর্কশ তাকে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য দিয়ে গেলো। এমনটি যেন হওয়ার কথা ছিলো না। আয়ুর প্রথমার্দ্ধে সামর্থ্য, দ্বিতীয়ার্দ্ধে প্রয়োজন তাকে পরিচারকহীন করেছে। সুতরাং কিছু সময় লাগলো জানতে সদর সংবাদ।


-- " একী ! শিয়া তুমি? চিঠি দাওনি তো আজ আসবে... কী হয়েছে? "


বরাবরের ধীর মেয়ে তার বরফ এখনো


--" ভিতরে আসি? "



হাজারো ঝঞ্ঝাতেও যে নন্দিনীকে তিনি অভিভাবকহীন চারণের অনুমতি দেননি বহু শঙ্কায়, অনেক দ্বিধায়, সে আজ আটপৌরেতে তার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখের দীঘল বলে ঘুম হয়নি বিগত বেশ কিছু প্রহর, অবিন্যস্ত চুল হাতপ্যাঁচে ঘাড়ের উপর ফেলা। সঙ্গে সামান্য হাতব্যাগটিও অনুপস্থিত। তার বুক বসে যেতে লাগলো চোরাবালির গতিতে।



স্নান সেরে শ্রী ঘুমোতে চাইলে শৈবলিনী জিজ্ঞাসার চৌহদ্দিও পেরোননি। কুম্ভক তার নিয়ন্ত্রণে। ঘুমোক, যতক্ষণ সম্ভব। যে কোনো বিপর্যয়ে এইই বিশল্যকরণি শরীর মনের ভারসাম্য রাখতে। সন্ধ্যায় শ্রী জানিয়েছিলো অতি সংক্ষেপে। মধুপুরের চ্যাটার্জি ফ্যাক্টরি আর সংলগ্ন বাগান ঘেরা বাংলোটি গত রাতে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছে। বোমা, গুলি কিছুই বাদ থাকেনি। বিশ্বস্ত এক সূত্র সামান্য আগে খবর পেয়ে তাদের কাছে লুকিয়ে রাখায় নীলাদ্রি ও শ্রীয়ের প্রাণ দুটি রক্ষা পেয়েছে মাত্র। বাকি সর্বস্ব নিতান্তই ভগ্নস্তূপ এখন। ভোর রাতের প্রথম ট্রেনে শ্রীকে তুলে দিয়ে নীলাদ্রি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গেছেন অনির্দিষ্ট কাল সময় চেয়ে নিয়ে। বেনারসের আদি বাড়ি অথবা আসানসোলে দাদার কাছে যাবেন, এমন শিরদাঁড়া তার নয়। সুতরাং, তিনি কোথায়, শ্রী জানে না।



কিছু রাত কুরুক্ষেত্রের, কিছু জোনাকির, আর কিছু সংজ্ঞাহীনতার। শৈবলিনী জানতেন না ঠিক কোন স্তরে সে রাতকে ফেলা যেতে পারত। শৈশবে শ্রী'র জ্বর হলে যেভাবে রাতপাহারা দিতেন শিয়রে, ফিরে গেলেন সেই সময়ে। হঠাৎ শিয়ার ঘুমন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে জন্মদাত্রীর অভিজ্ঞ স্নায়ু তাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করল। এই প্রবল অন্ধকারের ভিতরে কি কোনো তীব্র আলোর সংকেত লুকিয়ে যা তিনি অনুমান করছেন? ডাক্তার এসেছিল। ধারণা অভ্রান্ত, আনন্দে জানিয়ে ফিরে গিয়েছিল।  




শৈবলিনী ঠিক তিনদিন আগের মতো, আজও সেই সময় একই ভাবে দাঁড়িয়ে। শুধু সেদিন যে 'নিষ্কৃতি' শব্দোচ্চারণ করেছিলেন, তাকে প্রত্যাহার করছেন আজ সজ্ঞানে। যার লগ্নে সংগ্রাম, এত সহজে কি তার মুক্তি আসে? অনির্ধারিত অজ্ঞাতবাসে যাওয়া নীলাদ্রির আগামীকে গর্ভে ধারণ করে শ্রী এসেছে তার কাছে। তার যাবতীয় ছায়া আজ আলোময়। আজ সত্যিই তিনি সিংহের প্রয়োজন বোধ করলেন, রাশি থেকে খুবলে হৃদয়ে প্রতিস্থাপন নিমিত্তে। সন্তান সংকটাপন্ন হলে কোন গর্ভধারিণী অবিকল সিংহবাহিনী নয় আর তিনি তো শৈবলিনী, গায়ত্রীজল সবিতাকে অর্পণ করে বীজস্বার্থে মহাতেজা রূপ পরিগ্রহ করলেন।

চিত্র - অন্তর্জাল

সুবীর সরকার

                        


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া


৯.
চর কালপানি দিয়ে মন্থর লয়ে ছুটতে শুরু করে মজনু শাহের ঘোড়াটি।বাদামি কেশর।নিভৃত আর মায়াময় চক্ষুদ্বয়।মজনু তার এই ঘোড়াটি কিনেছিল ছত্রশালের হাটে।বিবি ফুলজান ঘোড়াটির নাম রেখেছে সুমি।এই ঘোড়া নিয়ে,ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ধান পাট তামাক নিয়ে এক হাট থেকে আরো আরো দূরে কাছের হাটগুলোতে ঘুরে বেড়ায় মজনু।মজনু শাহ।ভালো বাঁশি বাজাতে পারে বলে লোকমুখে তার নাম মজনু মাস্টার।ধুবুরি শহরের এক কবি মজনু আর তার ঘোড়াটিকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিল।সেই থেকে গঞ্জ হাটে মজনুর বেশ কদর।খাতিরদারি।
মাঝে মাঝে মজনু মনের সুখে ফাঁকা রাস্তায় সুমিকে  ছোটাতে ছোটাতে গলা ছেড়ে গান ধরে_
"আরে চলে রে মোর ঘোড়ার গাড়ি রে
কাদো পন্থ দিয়া
আরে নওদারি নাইওরি গুলা
দেখি থাকে চায়া রে"
আমরা দেখি মস্ত এক আবছায়ার ভিতর লীন হয়ে যাচ্ছে মজনু শাহের ঘোড়াটি।
১০.
শুকনো চরের বালু শরীর জুড়ে লেগে থাকা মরিচ বেচা পাইকার, রেডিও বাজাতে বাজাতে কিংবা বলা ভালো রেডিওতে গোয়ালপাড়ার গান শুনতে শুনতে এই প্রাক সন্ধ্যেতে কোন এক হাট থেকে ফিরতে ফিরতে বারবার কেন জানি আনমনা হয়েই পড়ছিল!
এই কুড়ি পঁচিশ মাইল পরিধি জুড়ে তার পরিচিতি মরিচ বেচা পাইকার।আবার পাইকারের রেডিও প্রীতির কারণে সম্প্রতি অনেকেই তাকে "রেডিও বাজা পাইকার" বলেও ডাকতে শুরু করেছে।প্রায় তিন কুড়ি বছর ধরে তার কাজ মরিচের পাইকারি।তার বাবা,বাবার বাবা সকলেই ছিল মরিচের পাইকার।সেই কবে যে সে তার আসল নাম নিজেই ভুলে গেছে তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই!আচ্ছা,এই সব বিস্মরণ কি তাকে আনমনা করে দিয়েছে!
এইসব ভাবতে ভাবতে পাইকার তার অন্যমনস্কতা আর রেডিও সমেত গঙ্গাধরের ফেরিঘাটে এসে পৌঁছান।আর শুরু হয় ঘাটোয়ালের সাথে কিঞ্চিৎ হাসিমস্করা।তখন রেডিওতে বেজে উঠেছে আব্দুল জব্বারের গান_
"চাষার মুখত আর
 নাইরে সেই গান"
 

রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বীথি চট্টোপাধ্যায়

               



বড়দিন 


জীবন থাকলে পেরেকও থাকবে;ক্ষমা করে ভালবেসে

আর কতদিন কাটাব এভাবে মিথ্যে মিথ্যে হেসে?  

খাবার চাইতে হাত বাড়াচ্ছে রোগা অভুক্ত শিশু

চার্চে দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে পেরেক বিদ্ধ যিশু।

তারাভরা রাতে বরফ পড়ছে কত ক্রিসমাস ট্রিতে

কেউ কি কোথাও কষ্ট পাচ্ছে পেরেকে অথবা শীতে? 

#

সান্তাক্লজের গাড়ি  যদি থামে দুঃখের ফুটপাতে

যেখানে মানুষ চট পেতে শোয় হিম-কুয়াশার রাতে।

#

এবার একটু হাসি ফুটে থাক যিশুর করুণ মুখে,

মার্কিন সেনা খাবার বিলোক,ইথিওপিয়ায় ঢুকে।

পথের কুকুর মায়াভরা চোখে সামনে দাঁড়ালে এসে

তাকে কোলে তুলে বিস্কুট দিক শাহরুক হেসে  .... 


স্বদেশ  / বীথি চট্টোপাধ্যায় 


স্বাধীনতা কীসে আর দেশ বলে কাকে?

শুধু কি সীমানা দিয়ে মাপা যায় তাকে?


এই মাটি, এই জল, এ সংবিধান

দেশ মানে সেইখানে কবুল এ-প্রাণ।


স্বাধীনতা মানে খুব বেশি কিছু নয়,

নিজের হৃদয় খুঁড়ে আনা পরিচয়। 


রক্তবিন্দু দিয়ে যাকে গড়া যায়

দেশ মানে মানুষের মুক্তির উপায়।


কতখানি দিতে পারে কেউ ভালোবেসে?

অনেকেই ঘরে আর ফিরলনা শেষে। 


মৃত্যুর মুখে দেওয়া বাঁচার শ্লোগান

দেশ মানে সেইখানে কবুল এ-প্রাণ।


জয়হিন্দ

সম্পাদকীয়

             


বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির রেশ কাটিয়ে ফুটে উঠেছে ছোট ছোট কাশফুল ৷কাশফুল মানেই শরৎ । আকাশে উড়ে বেড়ায় পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ।ভেসে বেড়ায় ভালোবাসার ধূলিকণা । শরৎ আসা মানেই সৃজন শারদ সংখ্যা প্রকাশ করতে হবে ৷ এই সংখ্যায় যুক্ত হয়েছেন অনেক নবীন , প্রবীণ লেখকবৃন্দ। সবার সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিতে সেজে উঠেছে "সৃজন" শারদ সংখ্যা। 

সকলের লেখা নিজে বসেছি প্রকাশ করার জন্য। প্রচছদ সহকারে একে একে সেজেছে প্রতিটি পাতা। সব শেষে সম্পাদকীয় লেখার পালা৷ কিন্তু বেশ কিছুদিন হল কিছু ভাবতেই পারছি না । কী লিখব সম্পাদকীয়! এত গুণী মানুষের সৃষ্টিতে সেজেছে এ সংখ্যা তার কাছে নিজেকে তুচছ মনে হয়৷আগে ভাবতাম কবিতায় আমি বেশ স্বচছন্দ‍্য ।কিন্তু কালের নিয়মে তাতেও পড়েছে ভাটা । এক সময় কত ভাবনা পাখা মেলে উড়ত। কত স্বপ্ন উঠোনে রোদ পোয়াত। ছোট ছোট ইচ্ছেরা চিনেবাদাম খেতে বেড়ত বিকেলবেলায় ৷ সবই ইতিহাস। সময়ের টানাটানিতে শব্দরা নিঃস্ব। কোথা থেকে শুরু আর কোথায় গিয়ে শেষ তার কোন সীমারেখা ছিল না। কী যে লিখব ভাবতে বসলে হাহুতাস করে ভাবনারা ।

বাসাবদল
বেশ কিছু সময় ফেলে এসেছি 
নিঙড়ানো স্মৃতিগুলোকে সরিয়ে রেখেছি কৌটোয় 
বিস্কুটের মত মিইয়ে গেছে সেগুলো

যেখানে বসে তোমার কথা ভাবতাম
যাবতীয় সংলাপ  তুলে রাখতাম
সেই চেয়ারটা আর নেই জানো 

তুমি  ওই নারকোল গাছের মাথার থেকে আমাকে দেখতে
আমাকে জড়িয়ে ধরতে সোহাগে
বাকিটা ব্যক্তিগত

সেই বাসাটা আজ ছেড়ে আসতে হল
আমি অনেক চেষ্টা করেছি সময়গুলোকে কাঁধে করে আনতে 
কিন্তু পারলাম কই

হয়ত বলবে হারানো মানেই নতুন প্রত্যয়
কিন্তু আমার কাছে হারানো মানেই ক্ষয়
ঋতুযোগে তা বেড়ে চলে 

এখন যেখানে আছি দু হাত দূরত্বে নারকোল গাছের মাথা
তোমার নিঃশ্বাসের কাছাকাছি
আজ আর দূরে থেকো না

এসো ক্ষয় তোমাকে নিবিড় করে পাই
বহুদিন পর ঘুমোতে যাচ্ছি

ঘুম আসে না। চোখ বুজে শুয়ে থাকি৷ চোখ খুললেই অস্বস্তি শুরু হয়৷

মেঘের ইনসুইং হলে 
একটা অবযব ফুটে ওঠে
লম্বা ,সুদর্শন ,কামরাঙা ঠোঁট 
আপনারা বলবেন 
" এই সেলফিশ ন্যাকামিগুলোর কি দরকার?"

আসলে নিজের প্রতি টায়ার্ড  হতে হতে 
কেমন যেন একটা ফাও মনে হয় 
উদ্বৃত্ত 

সত্যি বলতে কী যতবার ইউটার্ন নিয়েছি
একটা হ্যাংলামি পেয়ে বসেছে
কাছে যাবার, নিবিষ্ট হওয়ার
মে বি  ইট ইস রঙ
আসলে" ক্ষয় নেই জাগরণের"
ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে কিছু অপশান চোখে আসে
" মৃত্যুর পর এই অ্যাকাউন্টিটিকে কী করতে চান ?"

মুহূর্তে গলায়  একদল দুষ্কৃতী ছুরি মারে 
সিওর ইট ইস কল ট্রমা
 
 জীবনে ন্যাকামির প্রয়োজন আছে
তাকে মান্যতা দিতে গিয়ে দেখা
ক্ষতচিহ্ন জানে তাকে ক্ষমা করতে কতটা ক্লান্তি লাগে 

আর বুঝলাম সব থেকে বড় ন্যাকামি ছিল জীবনে
" তুমি"

তাকে রাইট অফ...




স্বপ্নের মধ্যে আঁশ ঘোরাফেরা করে
চকচক অথচ পিচ্ছল
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আসে পেঁয়াজের খোসার মত

ইদানিং তোমাকে দেখিনা সেখানে 
তারাখসা রাতের মত বিক্ষিপ্ত
তুমি 

সেই সব রাতের গল্পগুলো ধীরে ধীরে
তারা হয়ে যায়
মিটমিট করে আঁশের মধ্যে

না আজ আর অন্য কথা নয় । পুজো এসে গেছে৷ আমরা এখন সবাই ভালোবাসার গন্ধ গায়ে মেখে ঘুরি।এই সংখ্যায় যারা লিখেছেন তাদের সবার পক্ষ থেকে শারদীয়ার শুভেচছা।

প্রসঙ্গত আপনাদের জানিয়ে রাখি সৃপ্রকাশন নিবেদিন যৌনতা সংখ্যা খুব শীঘ্রই প্রকাশ পাচ্ছে। " সৃজন" "শারদীয়া" সংখ্যা সেজে উঠেছে অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্যে৷ এই সংখ্যায় নতুন কবিদের কবিতায় ভরে উঠেছে।।"সৃজন" পরবর্তী সংখ্যার নাম " শীত " সংখ্যা । এই পরিস্থিতিতে আমরা উৎসব উপভোগ করব ঘরে বসে কবিতা,গল্পে ,উপন্যাসে। সবাই খুব ভালো থাকুন, সৃজনে থাকুন, আনন্দে থাকুন৷ আমাদের লেখা পাঠান। সৃজন এখন থেকে সাপ্তাহিক ভাবেও কবিতা, ধারাবাহিক গল্প, ভ্রমণ প্রকাশ করতে চলেছে৷ সৃজনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা কিন্তু একই আছে তাও ইমেইল আইডিটা আরও একবার  বলে রাখি। srijanblog10@gmail.com ইমেলে আপনি আপনার অপ্রকাশিত লেখা টা পাঠান আমরা আমরা খুব যত্নসহকারে আপনার লেখা প্রকাশ করব। সবাই খুব ভালো থাকুন আরো একবার বলি৷ শুভরাত্রি৷


পারমিতা চক্রবর্ত্তী

সম্পাদক

চিত্রঋণ - মলয় দত্ত

কৌশিক সেন

                 



অলিভ পাতার দেশ

এই সখ্যতা তোমায় দেবো বলে সামুদ্রিক প্রজাপতির পাখনায়
ক্রশ এঁকে দিয়েছিলাম একদিন। তিরতিরে কর্মমুখরতায় 
ছড়িয়ে দিয়েছিলাম শান্তি আর ক্ষমার সুবাস। প্রজাপতির দল
যেদিন পাড় হয়ে গেল নিকশিয়ার আকাশ, আমি ভূমধ্যসাগরের
পাড়ে পাড়ে বুনে দিয়েছিলাম ঈশ্বরের বীজ।

তোমার মতো বন্ধু পাবোনা এই ভূমণ্ডলে, জানি। তোমার কাছে 
পৌঁছে দেবো বলে নীলনয়না মৎস্যকন্যার হাতে রেখে এসেছিলাম
অলিভ গাছের নরম প্রশাখা। এই স্বর্গীয় সখ্যতা তোমায় দেবো বলে
এক এক করে সমাধান করে গেছি সিড়িভাঙা গণিত। সদর দরজা
সাজিয়ে রেখেছি বেগুনী অর্কিডে।

দেখবে, তোমাকে ভাই বলে ডাকবো একদিন। তোমার বোন
সারা সকাল উপবাস করে আমারও কপালে এঁকে দেবে
চুয়া-চন্দন তিলক, কোনো এক কার্ত্তিক দ্বিতীয়ার অমৃতযোগে।
এনে দেবে জন্মদিনের উপহার। সেইদিন হলুদ প্রজাপতিরা
ফিরে আসবে আমাদের ঘর আলো করে...

মীনাবাজার

নাভির উর্বরতায় একটা রক্তগোলাপের চারা, 
কয়েকটি মৃত আরকিয়প্টেরিক্স আর 
এল ডোরাডোর স্বপ্ন দেখেছিলাম।  
সওদা করে ফেরবার পথে 
শুনতে পেয়েছিলাম 
ভ্রমরের গুঞ্জন।

এখন গমগম করে 
গভীর খাদের কিনারায়।  
গোলাপি আভা ছড়িয়ে পরে কাচের চুড়ির শব্দে।
কাউকে বলা হয়নি এখনও, এই নিভৃতে
জীবাশ্ম গেঁথে গেঁথে খুঁজে পাই
অনন্ত কামনার মিসিং লিঙ্ক!


সাহিত্য উৎসব

আমরা চা খেতে খেতে আলোচনা করবো, কীভাবে অমুক লেখকের
সাম্প্রতিক উপন্যাস থেকে খসে পরছে দেয়ালের পলেস্তারা,
ভাঙা দালানের কোটরে বাসা বেঁধেছে সুন্দরী চন্দ্রবোড়া
আর কার্নিশ বেয়ে কোন প্রবাহে নেমে আসছে
পাকুড়ের মজবুত শেকড়গুলি।

গরম শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে আমরা আলোচনা করবো,
হটকেক কাব্যগ্রন্থ থেকে উঠে আসা উদ্ভিন্নযৌবনা নারিটি
ঠিক কাকে কাকে কল করে রাতের আমন্ত্রন জানিয়েছে।

দরবেশে ঠোট ঠেকিয়ে আলোচনা করে যাবো
মুক্তগদ্যে ধূসর মন্বন্তরের কাহিনী,
ক্ষুধার্ত শকুনের স্থির ধৈর্যের কথা।

তারপর, আঙুল চাটতে চাটতে সেরে নেবো কাকজ্যোৎস্নার বেচাকেনা   
আর গৃহযুদ্ধে নিহত কবিদের জন্য নীরবতা রেখে যাবো
এক পক্ষকাল!




শর্মিলা ঘোষ

                




বাতিল ঈশ্বর//শর্মিলা ঘোষ

একমুঠো নীল আকাশ হাতে ধরে শরতের গান গাইছি  মহা সমারোহে,
শয়তানের চোখ থেকে  বাঁচতে একতারা নিয়ে মেতে উঠছি মিঠে বাউল সুরে,বেলোয়ারি চুড়ির শব্দও ছন্দে বাঁধা স্বরলিপি;


ধানখেত  থেকে ঊষর শুষ্ক মরুতেও ফোটে বেনজির রক্ত পলাশ 
ধ্রুবতারা নেমে আসে স্টেশনে ব্রীজে গরিবের জলন্ত উনুনে
বিজ্ঞাপনের ক্রাইসিস ছিল ব্যাক্তিগত সরীসৃপ জীবনে
আঠালো পথ চলতে চলতেই লাভামুখে  আটকে পড়ে কাঠের শরীর;

অনেক অনেক পথ হাঁটা হলো যন্ত্রণার  রুটম্যাপ ধরে
সৃজনী সমাজ জুড়ে শারদীয়া  যাপন , তাতে প্রেম লেখা  হলুদ অক্ষরে
গিলোটিন  নেমে আসছে ,বাতিল  ঈশ্বর,  শুকনো পাতায় লেখা  হচ্ছে ক্ষুধিত পাষাণ।


 



অন্তর চক্রবর্তী

                   




অষ্টমীর পদ্য

––———————



অষ্টমীদিন ঘিরে বয়ে আসে ফাগুনের আঁচ

আঁজলার কূলে কূলে অবিচল মরমী মানত 


যত রঙ শিউলির, তত রঙ পলাশ-ছোঁয়াচ

'একবার দাও ঠাঁই প্রিয়মনে, সোহাগী বসত' 


দুরুদুরু অপলকে ঘন হয় প্রতীক্ষাঘোর

রোদ পড়ে আসে আর ভিড় ঠেলে একাকীর সুর 


বাঁধভাঙা দখিনায় আসবে কি মিঠে উত্তর?

কিশোর চাতকমন পড়ে থাকে বেহাগবিধুর 


আন্ধার চেয়ে চেয়ে গোধূলিবেলাটি কেটে যায়

অষ্টমীসাঁঝ জুড়ে ফিরে আসে শ্রাবণের বাঁক 


সন্ধিপুজোর উলু ভেসে চলে অশ্রুছায়ায়

বোধন যতটা দূর, তত দূর ভাসানের শাঁখ...



( বিশেষ ধন্যবাদ : অর্ঘ্যদীপ ঘোষ )

মিনাক্ষী ঘোষ

                     




 ভান

যে মেয়েটি

মালসায় আগুন আর নাভিমূলে

শ্বেতপদ্ম রেখে ভেবেছিল একদিন

মৃত্যু আর অমরত্বের মাঝখানে

সেতু নির্মাণ করা যায় অনায়াসেই!

শুন্যতার অতল খাদে

মনটাকে অনায়াস গড়িয়ে দিয়ে

প্রথাসিদ্ধ নিয়ম জলে আচমন সেরেছিল

এক কমন্ডলু বিবমিষায়!

অমরত্ব পাবে ভেবে

 অবিনাশী পাথরজন্মকে

আগুনে পোড়াতে চেয়ে বারবার

পদ্মের মৃণালে  ঢেকেছিল তার সমস্ত ক্ষত

বল্কল অথবা লজ্জাবস্ত্র

কোনটিই আজ আর গ্রহণযোগ্য নয় তার

 সেতুহীন অমরত্ব পেতে গেলে

মৃত্যুর আগুনে স্নাত হতে হয়।


মাভৈঃ



নিকষকালো গুহায় দাঁড়িয়ে থেকেও

বুকের ভেতর সহস্র সূর্যকে পুষে রাখি

 যত ই ঝঞ্ঝা ভাঙুক শাখা সম্বল

অন্য কোথাও নীড় খুঁজে নেবে পাখি

 

অন্ধকারের প্রাচীরগাত্রে ক্ষয়

জানি,জানি তাও নিশ্চিত হবে কোনদিন

ততোদিন চোখে জোনাকি জ্বালিয়ে রাখি

ভাদ্রের নদী যদিই উজানে বয়


ফাটলের গায়ে ক্ষীণ যে স্রোতস্বিনী

এতদিন ছিল একলাই নিরিবিলি

জোয়ার প্লাবনে বাঁধ ভাঙে উচ্ছ্বাস

পাথর ভাঙতে প্রয়োজনে রঙ তুলি


নাগপাশে আরো যতই কঠিনে বাঁধো

কান পেতে থাকো,শুনতে আর্তনাদ

হাজার আলোর ঝাড়বাতি তবু জ্বেলে রাখি

ধরেছি মুদ্রাতে আনন্দ বিষাদ যুগপৎ ।


কথা দিলাম


বর্ষার আগে

জমিতে নিড়েন দিতে হবে বলে

তুমি ঠা ঠা রোদ্দুর টুকু উড়ানিতে বেঁধে

মাঠে নেমেছিলে!


বর্ষা নামার আগে

ভাবী ফসলের আগমন

সুনিশ্চিত করা চাই!

জৈষ্ঠ্যের তীব্র পরাক্রম তোমায় ক্লান্ত করলেও

হতোদ্যম করেনি তাই

জানিনা,কতটা প্রদাহ তুমি

সয়েছিলে এই অবকাশে

শাখাহীন গাছের আড়ালে

এতটুকু বিশ্রাম চেয়েছিলে বুঝি!

তাই কি আভাসে

অনাহুত অতিথির মতো

মেঘ হয়ে উড়ে আসি

তোমার আকাশে

যদি এতটুকু ছায়া দিতে পারি

এই খরতপ্ত জীবন প্রদোষে

সেকথা অজানা থাক

আমার চিবুক জুড়ে ছড়ানো বিষাদ

আজ বাঁধভাঙা বৃষ্টি হয়ে

সোহাগ ছড়াক

পরিতৃপ্ত ঘুম নেমে আসা

তোমার নিবিড় দু'চোখে

একে যদি সামিয়ানা বলো

আমৃত্যু তাই হবো আমি


কথাদিলাম।

নদীজন্ম



আকাশের রূপোলী সিঁথিতে চলকে ওঠা আলো

নাকি আরণ্যক বিষাদ

কোনটা জন্ম দিয়েছিল হিরণ্যগর্ভ মেঘের 

সেকথা বুঝতে বুঝতে

কেটে গেল আরো এক নদীজন্ম

নুড়িপাথরের ঠোকাঠুকি,আর

গাছগাছালির ফিসফিসানি

সূর্যাস্তের সবুজকে যে গভীরতা দিয়েছিল 

সেকথা কেবলমাত্র  যুবতী নদী জানে

অবধারিত সমুদ্রস্নানে 

যদি আর না ই যেতে হয়

সম্পর্কের কাটাকুটি খেলা তবে

তার শেষ জন্মশোধ 

আর কোনো দায় নেই তার বহতা হবার

নিজের সাথে বোঝাপড়া সাঙ্গ হলে

মেনে নেওয়া

চিরস্থায়ী একলার বসবাস 

শ্যাওলায়,পাথুরে গুহায়


তবু

সহস্র প্রাচীন সেই 

কোটর জমানো জলে

ফাটলের চোরাপথে

 ক্ষণজন্মা মেঘেরাও

মাঝেমাঝে

বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে

চিরায়ুষ্মতী হবার নেশায়।


বিভাগীয় সম্পাদক

        




আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই দেবীপক্ষের শুরু। দাঁতাল অতিমারীর রেশ কাটিয়ে ফের মহোৎসবের দিন গুনছে উল্লাসপ্রিয় বাঙালি। অসুখের গভীর আঁচড় হোক বা প্রকৃতির ভয়ঙ্কর খামখেয়াল, টালমাটাল দৈনন্দিন বা চূড়ান্ত ঘুণ-লাগা রাজনৈতিক আবহ, এ সবকিছু উপেক্ষায় রেখে ধ্রুবের মতোই দাঁড়িয়ে মিলনপরবের বর্ণাঢ্য হাতছানি। শিউলি-কাশের দুধশাদা স্পন্দনে, আদ্যাশক্তির আগমনী দখিনায় ভরে উঠেছে পল্লী থেকে নগরী। অবশ্যম্ভাবী বিজয়াটি বুকে নিয়েও ক্ষণিকের উদ্বেল মানসমেলা ও পার্বণী ছলাৎছলে ভেসে যাব আমরা সক্কলে... 


সেই সন্ধিসুরেই অমরা হয়ে উঠুক বিশ্বচরাচর। তানে তানে মোক্ষমন্ত্র হোক বাংলা কবিতাও...


চিত্র - ঋজু 

তৃষ্ণা বসাক

             




খিদে

 
পাশের ঘর থেকে গরম ভাতের গন্ধে
খিদেটা চাগিয়ে ওঠে,
আসলে আমার রক্তের মধ্যে এখন প্রচুর ফসফরাস,
চুলে জড়ানো ঝিনুক প্রবালের মালা,
কাঁদলে এখুনি মুক্তো ঝরবে,
কিন্তু আমি কাঁদব না, আমার খিদে পেয়েছে।
#
আমাদের বাস  বড় রাস্তা দিয়ে ছুটছে,
দুপাশ থেকে উঠে আসছে জাগুয়ার আর ব্রহ্মকমল,
হলুদ সাপের মতো সরু একটা নদীর চুল
এলোমেলো করে দিচ্ছে সাহসী সারস,
পাশের ঘর থেকে গরম ভাতের গন্ধে
খিদেটা চাগিয়ে ওঠে,
আসলে আমার রক্তের মধ্যে এখন
প্রচুর ফসফরাস,
তিনতলার বারান্দা থেকে দোল খেয়ে,
দোতলার ছাদে নেমে
চুলে ঝিনুক প্রবালের মালা জড়িয়ে
দুহাতে সমুদ্রের অন্ধ ফেনা নিয়ে
আমি ঠিক পৌঁছে যাব জন্মের শহরে।
চিত্র - পারমিতা মণ্ডল 
 

জয়া চৌধুরী

                       






Fernando Denis ফেরনান্দো দেনিস (কলম্বিয়া)-

কবি পরিচিতি- ১৯৬৮ সালে কলম্বিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সিয়েনাগায় জন্ম গ্রহণ করেন এই কবি। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে সমসময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। এতাবৎ প্রকাশিত সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ La criatura invisible en los crepúsculos de William Turner বা বিকেলের আলোয় উইলিয়াম টার্নারের অদৃশ্য ভূত ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটির প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের সাহিত্য জগতে আলোড়ন পড়ে যায়। বিংশ শতকের সে দেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কীর্তি হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে এটি। এই বইটি লেখার সময় ব্রিটিশ চিত্রকর উইলিয়াম টার্নারের আঁকা কিছু গোধূলির ছবি থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে প্রকাশিত LOS MOSAICOS DE BABILONIAবা ব্যাবিলনের মোজাইক কারুকাজ  y সেই সালেই LOS CINCO SENTIDOS DEL VIENTO  বা ঝড়ের পাঁচ অনুভূতি, ২০০৪ সালে Ven a estas arenas amarillas বা এই হলুদ বালুকায় আপনারা আসুন, একই সালে El vino rojo de las sílabas পদাংশের রক্তলাল ওয়াইন ইত্যাদি তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির স্বনতার সঙ্গে বহিঃ প্রকৃতির রূপের মেলবন্ধন ধরা পড়ে। সমসময়ের অন্যান্য বিখ্যাত কবি রোমুলো গাইয়েগো পুরষ্কার বিজেতা উইলিয়াম ওসপিনা বা খোসে রামোন রিপোলি ম খোসে লুইস রিভাস ইত্যাদিরা স্বীকার করেন বর্তমান লাতিন আমেরিকার কন্ঠ বিধৃত হয় তাঁর কবিতায়। ভারতে সাহিত্য অকাদেমী ইতোমধ্যেই তাঁকে সে কলম্বিয়ার শ্রেষ্ঠ কবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০০৯ সালে তাঁর লেখা ১১৩ টি কবিতা সম্বলিত Geometry of Water” বা জলের জ্যামিতি বইটি অনূদিত হয়েছে ভারতে সাহিত্য অকাদেমীর মাধ্যমে ।  বর্তমান কবিতাগুলি তাঁর সাম্প্রতিকতম  LA MUJER QUE SUEÑA EN LAS MURALLAS বা দেওয়ালে তন্দ্রারত মেয়েটি থেকে নেওয়া। 



La mujer del fuego আগুনে মেয়ে/ ফের্নান্দো দেনিস ( কলম্বিয়া) 


১০

আমি নিজস্ব গোলকধাঁধায় বন্দিনী, গোপন যত

প্রলাপ যা আমার যাত্রীর ট্রাংকে সযত্নে বয়ে চলি,

আমার ত্বকের বর্তুলতায় , আমার মধুভান্ডে,

আমার আঙুলের কুসুমগুলিতে যারা বড় খারাপ ভাবে হয়েছে ক্ষতবিক্ষত

নীরবতা, গোধূলিতে তার চড়চড় করে ফাটা;

এক গভীর প্রভার কাছে বন্দিনী,

তার জেলকুঠুরীতে যন্ত্রণা সয়ে যাই। 


গ্রহের অনপনেয় সূর্যাস্তের নিচে সময়

ঘোরে আমার সাথে,

আমিও ছিলাম রাজকুমারী আরিয়াদনা- এক ইন্দ্রজালের ভেতরে বাস করি বদ্ধ

এবং নিজে রূপকথাও বটে; 

ষাঁড় মুখো কোন রাক্ষস আমায় তাকিয়ে দেখে না,

আমার ভেতর আরো বেশি সুন্দর কিছু করে বসবাস…,

তবে একইসাথে বড় ভয়ানকও বটে।  


১১

ঝড়ের চারপাশ ঘিরে থাকা রহস্যময়ী লতাদের ভেতরে থাকে

আমার সঙ্গীতের রূপ,

আমার শ্রবণের আগুনে থাকা ল্যুট গিটারের রূপ,

তার অনন্ত একাকীত্ব এবং জনশ্রুতির পাথরকুচিরা, তার চিত্তভ্রংশ।


তার মথিত করা স্মৃতির অবয়ব থেকে সেরে উঠি-

তার অহং, তার আনন্দ,

তার ছলনাময়ী কোমলতা যা স্ফটিকের যন্ত্রণায় 

স্বতন্ত্র বাস করে ,

সে আলোর প্রলেপ তেজীয়ান পরিবেশ রেখে যেতে যেতে

বিদীর্ণ হয় হিমঋতুর বরফপ্রদাহে,

ঝঞ্ঝাবাত্যা ভেদ করতে করতে, তামার অজানা মহাদেশ 

খাঁড়ির প্রবেশ দ্বারে মারা যাবে যারা, পবিত্র মৃত্তিকায়,

রক্তিম গতিরুদ্ধ উপত্যকায় যাদের প্রান্তরেখায়

প্রমিথিউসের স্বপ্ন থামে নি এখনও ,

দেহভস্ম এখনো যেখানে হয় না জয়ী।


প্রমত্ত, উদ্যমী, কমনীয়তার দিকে চেয়ে বুজে ফেলি চোখ,

নিখুঁত, অচেনা সুখে এবং অপ্রশমনীয়

সৌন্দর্যের শক্তিতে আমায় যে পরাভূত করে

এবং নীলার মত অগ্নিশিখা আমায় সময়কালকে প্রজ্জ্বলিত করে ঝড়ের আড়ালে। 


যুগান্তর মিত্র

                    




 জলপরি


চিঠিভর্তি প্লাস্টিকের প্যাকেটে ইটের টুকরো বেঁধে জলে ফেলে দেয় তুষার। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নভেম্বরের এইসময় এদিকে লোকজন প্রায় আসেই না। পুকুরের কালো জলে ডুবে গেল চিঠিগুলো। অপলক জলের বুদবুদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। 

শান্তাদিদি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এক দমে যদি নীচ পর্যন্ত চলে যেতে পারিস, তাহলে জলকন্যার দেখা পাবি। 

তুষার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ডুব দিয়েছিল পুকুরে। কিছুটা গিয়েই হাঁসফাঁস অবস্থা। জলের ওপরে উঠে এসে দেখেছিল শান্তিদিদি হাসছে। তার ঝলমলে দাঁত থেকে সূর্যের আলো ছিটকে ছিটকে পড়ছিল জলের মধ্যে। 

পারলি না তো! জানতাম পারবি না। একবারে হয় না। 

একবারে হয় না মানে? চেষ্টা করলে হবে বলছ? 

হবে না কেন শুনি? রোজ প্র্যাকটিস করবি। ঠিক পারবি। শান্তাদিদির দিকে তাকিয়ে তুষার দেখেছিল, তার মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল সূর্যের আলোয়। সেও একদিন ঠিক জলকন্যার দেখা পাবে, এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল তখনই। 

তুষার অনেক গল্প শুনেছে ঠাকুমার মুখে। জলের গভীরে থাকে এক পাতালপুরি। সেখানে এক জলকন্যা চুল এলো করে ঘুমিয়ে থাকে সোনার পালঙ্কে। তার মাথায় আর পায়ে থাকে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। সেই কাঠিদুটো অদলবদল করে দিলেই ঘুম ভাঙে। অপরূপ সুন্দরী জলকন্যাকে দেখার খুব শখ তুষারের। কাউকে একথা বলতে পারেনি কোনওদিন। পুকুরে স্নান করতে আসার সময় শান্তাদিদিকে কথাটা বলেছিল সেদিনই। শান্তা অবশ্য সাঁতার জানে না। তুষারের মুখে পুকুরে স্নানের কথা শুনে দেখতে এসেছিল। পাড়েই দাঁড়িয়েছিল সারাক্ষণ। 

শান্তাদিদিদের বাড়ি কলকাতায়। তুষারদের ঠিক পাশের বাড়িটাই ওর মাসির বাড়ি। মাসিকে শান্তাদিদি ছোটমা বলে ডাকত। শহুরে পরিবেশে থাকে বলে তুষারদের থেকে তার চলনবলন আলাদা। আগে তুষার, নীরূপ, বিমল, আবেশরা অবাক হয়ে শান্তাকে দেখত। তাদের থেকে কয়েক বছরের বড় দিদি। ঝকঝকে দাঁতে কেমন সুন্দর করে হাসে! গালে একটা টোল পড়ে। সারা শরীর যেন মোম দিয়ে তৈরি। শহরের মেয়েদের এইরকমই কোমল হয় শরীর! সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তুষাররা। 

গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে এসে কয়েকদিন এখানে থাকত শান্তা। অন্য সময় এলেও দু-একদিন বাদেই ফিরে যেত। তুষার সেই কদিন আঠার মতো লেগে থাকত শান্তাদিদির সঙ্গে। ওরা আসত সাদা একটা অ্যাম্বাসেডরে। তুষার শুনেছে গাড়িটা শান্তাদিদিদের। তাদের পাড়ায় তখন কারও বাড়িতেই গাড়ি ছিল না। দু-একজনের শুধু স্কুটার ছিল। ওর বাবারও ছিল সেইরকমই আকাশি রঙের একটা স্কুটার। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা ছিল ভেসপা। বাবার স্কুটারটা নিয়ে তুষারের চাপা গর্বও ছিল। 

এক রবিবার সকাল সাড়ে নটা নাগাদ গাড়িটা যখন এসে থেমেছিল, জানালা দিয়ে দেখেই তুষার বুঝে গিয়েছিল শান্তাদিদিরা এসেছে। দৌড়ে চলে গিয়েছিল সেখানে। শান্তাদিদির মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়া মুক্তো গড়াগড়ি খাচ্ছিল সবুজ ঘাসের জমিতে। তুষারকে দেখে হাসিমুখে শান্তা বলেছিল, দুপুরে আসিস। অনেক গল্প করব। কালই ভোরে ফিরে যাব তো। বাবার অফিস আছে। আসিস কিন্তু! 

তুষার বিকেলের দিকে যেতই ওই বাড়িতে। তার প্রিয় শান্তাদিদি এসেছে, না-গিয়ে থাকা যায়! দুপুরে যেতে বলাতে খুব আনন্দ পেয়েছিল। অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে ভেবে খুশি উপচে পড়েছিল তখন। তুষার খুব আশ্চর্য হয়ে ভাবত, শান্তাদিদির ভাইটা কোনওদিন ওদের গল্পে যোগ দেয় না কেন? দূরে দূরে থাকে। দিদিকে ও যেন ঠিক সহ্য করতে পারে না। 

পড়াশুনা, স্কুল, এসব কথা বলতে বলতেই আচমকা শান্তা বলে উঠেছিল, তুই রামায়ণ পড়েছিস তাতাই? 

দু-দিকে মাথা নাড়িয়েছিল তুষার। না গো। পড়া হয়নি। তবে গল্পটা জানি। 

সব গল্প জানিস? সবার? শান্তা কে জানিস? 

হ্যাঁ, রামের দিদি। অনেকটা ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিয়েছিল তুষার। 

আর কিছু জানিস? 

অবাক হয়েছিল তুষার। আর কিছু মানে? রামের দিদি হয় শান্তা। এর বেশি আর জানে না সে। তার মুখে ফুটে উঠেছিল না-জানার গ্লানি। 

তুষারের ঠাকুমা বলত, ‘শান্তারে নিয়া মহামুনি কিছু ল্যাখে নাই। মাইয়াটার কী হইল, কোথায় গেল, তার কোনও হদিশ দেয় নাই ব্যাটা।’ ওর ঠাকুমা এভাবেই বলত। বাল্মিকী মুনির প্রতি ভীষণ রাগ ছিল ঠাকুমার। কিন্তু কেন যে রাগ, তা বুঝতে পারেনি তুষার। এইসব ভাবনার মধ্যেই শান্তা বলে উঠেছিল, শান্তা এক উপেক্ষিতা নারী, জানিস! বাল্মিকীর রামায়ণে তেমন গুরুত্ব পায়নি। 

একটু বলো না শান্তাদিদি, কেন উপেক্ষিতা? 

শান্তাকে ওর মাসি-মেসো দত্তক নিয়েছিলেন। ভাব একবার, নিজের মেয়ে, তাকেও মানুষ করার ইচ্ছে হয়নি দশরথের! আসলে কী জানিস, মেয়ে সন্তান তো! তাই তার জন্মে বাবা-মা খুশি হতে পারেননি। মহান রাজা দশরথ মেয়েকে তুলে দিলেন বউয়ের বড় বোনের কোলে। ঠিক আমার মতো! 

‘আমার মতো’ কথাটাতে খটকা লেগেছিল তুষারের। কিন্তু অন্য একটা প্রশ্নে সেই খটকা তখনকার মতো চাপা পড়ে গিয়েছিল। ‘শান্তার মা কিছু বলেনি মেয়েকে দিয়ে দেওয়ার সময়?’ 

না রে। কৈকেয়ী হয়তো কিছুই বলতে পারেননি। তখন মেয়েরা কিছুই বলতে পারত না, তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছু ছিল না। এখনও অনেকে পারে না। 

তুষারের কেমন যেন গুলিয়ে যায়। এখনও মেয়েরা কিছু বলতে পারে না? তার বাবা তো মায়ের সব কথা মেনে চলে! না-মানলে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে। বরং বাবার কোনও কথাই মা শুনতে চায় না, মানতে চায় না। গুলিয়ে যাওয়া মাথায় ভেসে ওঠে আগের কথাটা, তোমার মতো বলছিলে কেন শান্তাদিদি? তোমার সঙ্গে রামায়ণের শান্তার মিল কোথায়? 

দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল শান্তার বুক থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, আমার ছোটমা আমার আসল মা। আর যাকে তুই আমার মা-বাবা বলে জানিস, ওরা আমার মেসো-মাসি। এক বছর তিন মাস বয়সে আমাকে দত্তক নিয়েছিল। তখন আমার ভাই সদ্য জন্মেছে। সেই থেকে আমি ওদের কাছেই থাকি। ওদেরকেই বাবা-মা ডাকি। ওরাই তো আমার প্রকৃত বাবা-মা, তাই না? এমনকি শান্তা নামটাও আমার নতুন বাবা-মায়ের দেওয়া। মেসো আর ছোটমা আমাকে বুড়ি বলে ডাকত। 

অবিশ্বাসের চোখে শান্তার দিকে তাকিয়েছিল তুষার। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। সেইসময় শান্তা বলে উঠেছিল, শোন তাতাই, এসব কথা আর কাউকে বলিস না যেন! তুই শুধু জানলি, আর কাউকে বলিস না প্লিজ। 

না না, কাউকেই বলব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তুষার মনে মনেও প্রতিজ্ঞা করে, এমন কথা কাউকে সে জানাবে না। তার শান্তাদিদির গোপন যন্ত্রণার কথা সে একাই জানবে। এই একা জানার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ অনুভব করেছিল সে। 

তুমি তাহলে বাবাকে মেসো বলো কেন? 

মেসোই তো আমাকে এই বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। আগে জানতাম না। যখন জানলাম কে আমার আসল বাবা, তখনও বাবা ডাকতে ইচ্ছে করেনি। ছোটবেলা থেকেই মেসো ডাকি। সেই ডাকটাই রেখে দিলাম। আমি অবশ্য কমই কথা বলি মেসোর সাথে। ইচ্ছেই করে না! 

আর তোমার ছোটমা? 

ছোটবেলায় মাসিই ডাকতাম। এখানে এলে খুব কাঁদত, জানিস? আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, আমাকে মাসি ডাকিস না মা, ছোটমা বলে ডাকবি। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, মনে আছে। তখন আমার মা বলল, ঠিক আছে শান্তা, ও যখন চাইছে, তুই ওকে ছোটমা বলেই ডাকিস। তখন থেকেই ছোটমা ডাকি। 

খাটে শুয়ে কথা বলছিল শান্তা। তুষার বসেছিল তার পাশেই। হঠাৎই উপুড় হয়ে শুয়ে বলেছিল, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে না তাতাই। 

শুধু মাথাতেই নয়, মাথা থেকে সারা পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তুষার। কখন যে শান্তাদিদি ঘুমিয়ে পড়েছিল, টের পায়নি সে। যখন বুঝতে পারল, তখন ঘুমন্ত শান্তাকে রেখে চুপচাপ চলে গিয়েছিল নিজেদের বাড়িতে। সেবার মাত্রই দু-দিন ছিল। তারপর পুজোর ছুটিতে এসেছিল কয়েকদিনের জন্য। সেইসময় শান্তাদিদির সঙ্গে কতকিছু নিয়েই যে গল্প করেছে প্রত্যেকটা দিন, ভাবলে এখনও ভালো লাগে তার। 

একদিন শান্তা জিজ্ঞাসা করেছিল, হ্যাঁ রে তাতাই, তোর গার্ল ফ্রেন্ড আছে? 

তুষারের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। তার সত্যিই কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই। কিন্তু শান্তাদিদি এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে সে ভাবতেই পারেনি। শুধু বলেছিল, না না। আমার কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই গো। 

ওমা, লজ্জা পেলি নাকি? গার্ল ফ্রেন্ড থাকা অন্যায় নাকি রে? তুই এখন ইলেভেনে পড়িস। গার্ল ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। আমার তো বয় ফ্রেন্ড আছে। 

তাই? আমার কিন্তু সত্যিই কোনও গার্ল ফ্রেন্ড নেই। 

একদিকে বেঁচে গেছিস। আমি খুব চিন্তায় আছি রে! 

কেন গো শান্তাদিদি? 

রফিক আসলে মুসলিম কিনা, তাই বাবা মেনে নেবে না। সাফ বলে দিয়েছে। 

কোন বাবা? 

বোকার মতো কথা বলিস না তো! কোন বাবা আবার? আমার বাবা একটাই। ইনি আমার মেসো। বাবার জায়গা কোনওদিনই দিতে পারব না। এমনভাবে ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল তুষার। আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, তুমি রাগ করলে শান্তাদিদি? বিশ্বাস করো, আমি সেরকম কিছু ভেবে বলিনি। প্রমিস করছি, আর কোনওদিন বলব না। 

খিলখিল করে হেসে উঠেছিল শান্তা। তড়াক করে উঠে বসে তুষারের গালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, তুই খুব ভালো ছেলে রে তাতাই। খুব সরল। 

একথায় লজ্জা পাওয়ার কথা নয়। তবু তুষার লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে নিয়েছিল। শান্তা তখন তুষারের মাথাটা টেনে নিয়ে তার বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিল। কী নরম বুকটা, হাতের থেকেও নরম, ফোলা ফোলা বুকে মাথা ডুবিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু শান্তাদিদি কিছুক্ষণ পরেই মাথাটা দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এখন বাড়ি যা। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তোর বাড়িতে চিন্তা করবে না? সেদিন আসার সময় আর-একটা কথাও বলেছিল শান্তাদিদি, তুই আমার থেকে অনেকটাই ছোট রে তাতাই। না-হলে রফিকের বদলে তোকেই বিয়ে করতাম। কথাটা বলে আর দাঁড়ায়নি। তুষারের আগেই নেমে এসেছিল একতলায়। 

(২) 

বেশ কয়েক বছর আর শান্তাদিদির দেখা পায়নি তুষার। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গিয়েছিল। রবিবার সকালে পড়ার বই সামনে রেখে বসে থাকত সে। মন পড়ে থাকত জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। তার চোখ দেখতে চাইত সাদা রঙের গাড়িটা, তার কান উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইত সেই পরিচিত গাড়িটার চাকার ঘর্ষণ। থাকতে না-পেরে একদিন গিয়ে ধরল শান্তার ছোটমাকে। অনেকদিন শান্তাদিদি আসছে না কেন গো কাকিমা? 

ছোটমা চুপ করে চলে গিয়েছিলেন রান্নাঘরে, কোনও জবাব না-দিয়ে। কাকু পাশের ঘর থেকে ধীরপায়ে এসে বলেছিলেন, তোর শান্তাদিদির খুব পড়ার চাপ তো, তাই এখন আসতে পারছে না। পরীক্ষা হয়ে গেলেই আসবে, কেমন? 

হতাশ তুষার ফিরে এসেছিল ঘরে। তারপর কেটে গেছে অনেকদিন। এতদিনে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা! তাও আসছে না? আবার কি খোঁজ নেবে? কিন্তু কাকু-কাকিমার থমথমে মুখ দেখে আর জিজ্ঞাসা করতে পারেনি কোনওদিন। একদিন সে জানতে পারল শান্তার এখানে না-আসার আসল কারণ। পাড়ার অনেকেই ততদিনে জেনে গেছে। 

তখন থেকেই তুষার প্রতি রবিবার পড়তে বসে একটা করে চিঠি লিখত, শান্তাদিদিকে সে তার মনের কথা বলত। কখন যেন সেই চিঠি লেখাও থেমে গেল। একসময় শান্তাদিদি পাতালকন্যার মতো জলের অতলে হারিয়ে গেল। শুধু তার বুদবুদ মাঝে মাঝে তুষারের বুকের মধ্যে গুবগুব শব্দ তুলত। 

আপনাকে একবার ম্যাডামের ঘরে যেতে হবে স্যার।  

ম্যাডামের ঘরে! কেন? 

পেপারসে উনিই সাইন করেন। আর আপনাদের কোম্পানির চেকটাও উনিই দেবেন। 

ও। আপনাদের ল্যানের সমস্যাটা মিটে গেছে। আর আপডেটেড ভার্সনের সফটওয়্যার লোড করে দিয়েছি। মিস্টার বাসু সব দেখে নিয়েছেন। কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তুষার। 

হ্যাঁ স্যার, জানি। বাসু স্যার ম্যাডামকে রিপোর্ট করেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন, ম্যাডামের ঘরে। 

যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছিল, তাকে এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল কিনা জানে না তুষার। মেয়েটিকে অনুসরণ করে এগোতে থাকে সে। চ্যাটার্জি ইনফোটেকের কর্মী হিসাবে তুষার এখানে এসেছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তুষার ভৌমিক কোম্পানির হয়ে ক্লায়েন্ট মিট করে। তাদের কোম্পানির সঙ্গে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চুক্তি করেছে, তাদের সফটওয়্যারের কোনও সমস্যা হলে চুক্তি অনুসারে কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার পাঠায়। এই কোম্পানিতে তুষার একেবারেই নতুন। তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার জন্য আগের কোম্পানির থেকে বেশি পে-স্কেলে এখানে জয়েন করার সুযোগ পেয়েছে। একে একে নানা ক্লায়েন্ট মিট করছে সে। এই এনজিওতে প্রথম এল তুষার। কাচের দরজা ঠেলে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, ওনাকে এনেছি ম্যাডাম। 

চেয়ার ঘুরিয়ে ম্যাডাম তাকাতেই তুষারের ভেরতটা দুলে উঠেছিল। শান্তাদিদি! বয়স বাড়লেও চিনতে অসুবিধা হয়নি তার। 

আসুন মিস্টার রয়। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। শান্তাদিদির চোখেমুখে তাকে দেখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই বলে অবাক হয় তুষার। দ্রুত ঘরে ঢোকে সে। ইশারায় বসতে বলায় চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকে ম্যাডামের দিকে। ম্যাডাম তখন ড্রয়ার খুলে কিছু কাগজপত্র বের করছেন। তুষারকেও যে কিছু কাগজে সইসাবুদ করাতে হবে, সেদিকে খেয়াল নেই তার। 

ম্যাডাম চোখ তুলতেই তুষার বলে ওঠে, আমি তাতাই শান্তাদিদি। চিনতে পারছ না? 

তাতাই? শান্তাদিদি? কী বলছেন মিস্টার রয়, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! আপনি কি কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন? 

অবিকল সেই মুখ, কানের নীচে কালচে লাল রঙের তিল, সেইরকম মিষ্টি কণ্ঠস্বর! তবে চামড়ার জৌলুস কিছুটা কমেছে বোঝা যায়। সে কি বয়সের জন্য! আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি শান্তাদিদি! মনে মনে ভাবে সে। 

আমার নাম পারভিন সুলতানা। আপনি হয়তো কারও সঙ্গে আমার মিল পেয়েছেন। এইরকম হয় মিস্টার রয়। কথাগুলো বলেই হাত বাড়িয়ে দেন ম্যাডাম। আপনার পেপার্স দিন। আর চেকটা রেডি করে রেখেছি, নিয়ে যাবেন। আমি আজ একটু ব্যস্ত আছি। আমাকে এখনই উঠতে হবে। কিছু মনে করবেন না। 

যন্ত্রের মতো কাগজগুলো এগিয়ে দেয় তুষার। সইসাবুদ শেষে চেক ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়ান। 

আসুন মিস্টার রয়। আজ আমাকে অন্য একটা কাজে বেরোতে হবে। অন্য একদিন আপনার সঙ্গে অনেক কথা হবে। আপনার শান্তাদিদির ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে খুব। মুচকি হেসে বলেন পারভিন। 

পরবর্তী ক্লায়েন্টের ঠিকানায় বাইক ছোটায় তুষার। মাঝরাস্তায় বুকপকেটে ফোন ভাইব্রেট করতেই বের করে দেখে অফিসের নম্বর। কথা বলে তুষার অবাক হয়, পারভিন সুলতানার প্রতিষ্ঠান চাইছে না সে আর এখানে মিট করুক। অন্য কাউকে পাঠাতে বলেছেন নাকি ম্যাডাম স্বয়ং। তার চাকরি জীবনে এই প্রথম এমন একটা অভিজ্ঞতা হল। বরং আগের কোম্পানিতেও ক্লায়েন্টরা তাকেই চাইত বেশি করে। এই কোম্পানিতেও কয়েকজন ক্লায়েন্ট তাকে খাতির করে খুব। তাহলে কি ম্যাডামকে শান্তাদিদি ভেবে বসায় রেগে গেলেন! কীভাবে অফিসে এই ব্যাপারটা ফেস করবে ভাবতে ভাবতে বাইক চালাতে থাকে তুষার। 

(৩) 

হ্যালো, আমি কি মিস্টার রয়ের সঙ্গে কথা বলছি? অচেনা নম্বরে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ বেজে ওঠে ফোনের ওপারে। রাত তখন সাড়ে নটা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ বাদে একপাক ক্লাবে ঘুরে আসে প্রতিদিন। ক্লাবে যাওয়ার পথেই ফোনটা বেজে উঠেছিল। 

হ্যাঁ বলছি। গম্ভীর কণ্ঠ তুষারের। মিস্টার রয় নামে ক্লায়েন্টরা ছাড়া আর কেউ তাকে ডাকে না। অফিসেও তুষার বলেই ডাকে বয়স্ক মালিক। অন্যরা কেউ তুষার, কেউ-বা তুষারদা। তাকে সরাসরি কোনও ক্লায়েন্ট সাধারণত ফোন করে না। অফিস মারফত কাজের কথা জানতে পারে। তাই খানিকটা বিরক্ত হয় সে। 

আমি শান্তাদিদি বলছি তাতাই! 

ম্যাডামের মুখটাই ভেসে ওঠে প্রথমে। শান্তাদিদি! মানে সেই পারভিন সুলতানা? তাই তো? 

হ্যাঁ তাতাই, তুই ঠিক চিনেছিলি। আমি ধরা দিতে চাইনি ওখানে। রফিকের কথা বলেছিলাম তোকে, মনে আছে নিশ্চয়ই। ওর সঙ্গে বিয়েটা টেকেনি রে তাতাই। হয়তো দোষ আমারই। তখন থেকেই আমি পারভিন সুলতানা। এই এনজিওতে আছি বছর ছয়েক আছি। আমি চাইনি আমার অতীত উঠে আসুক। পুরনো জীবন আমি ভুলে যেতে চাই। এভাবেই ভালো আছি। 

তুমি কেন আমাকে তোমাদের ওখানে যেতে বারণ করেছ? অভিমান ঝরে পড়ে তুষারের গলা থেকে। 

বললাম তো, আমার অতীত ঢেকে রাখতে চাই। নীচু কণ্ঠে জানায় শান্তা। 

তুমি বারণ করলে আমি সেসব কথা কাউকে বলতাম না! কিন্তু তার বদলে আমার অফিসে… 

এতে তোর চাকরির কোনও ক্ষতি হবে না তাতাই। আমি সেরকম ভাবেই কথা বলেছি। তোর নামে খারাপ কথা বলিনি। শুধু বলেছি, এত অল্পবয়সী কাউকে চাই না আমরা। আমাদের এনজিওর পক্ষে বয়স্ক মানুষই ভালো হবে। আরও কিছু কথা বলার পরে তুষার বলেছিল, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই শান্তাদিদি। তোমার ঠিকানা দাও। 

আজ থাক তাতাই। কিছুদিন পরে আমি জানাব। কথাটা বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল শান্তাদিদি। তারপর থেকে যখনই সেই নম্বরে ফোন করেছে, শুনেছে সুইচড্‌ অফ। নিজেও আর কোনওদিন ফোন করেনি শান্তা নামের জলপরি। 

মাস দুয়েক পরে ওদিকেই এক ক্লায়েন্টের কাজ সেরে ফেরার পথে মরিয়া হয়ে বাইক থামিয়ে দিয়েছিল তুষার, তরতর করে উঠে গিয়েছিল দোতলায়। ম্যাডামের খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পারভিন সুলতানা প্রায় দেড় মাস আগে লেকের জলে ডুবে মারা গেছেন। পুলিশ জানিয়েছে আত্মহত্যা। বিধ্বস্ত তুষার ফিরে এসেছিল সেদিন। 

তারপর থেকে প্রতি রবিবার সারা দুপুর বিছানায় আধশোয়া হয়ে শান্তাদিদিকে চিঠি লিখত তুষার। অফিস ব্যাগের একটা কোণে জমা হত সেগুলো। জমতে জমতে অনেক হয়ে গেছে। এবার নতুন কোম্পানিতে জয়েন করবে সে। এই ব্যাগটা ফেরত দিতে হবে। তাই সে সমস্ত চিঠি বের করে পুকুরধারে এসে বসে। আজ রবিবার। আজও সে চিঠি লিখেছে। হয়তো শেষ চিঠি। 

চিঠিগুলো জলের নীচে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে। আকাশভরা তারার মেলা। অর্ধচন্দ্রের আলো এসে পড়ছে পুকুরের জলে। তুষার সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সে নিশ্চিত, একসময় চিঠিগুলো পুকুরের তলদেশে পৌঁছে যাবে। সেখানে শান্তাদিদি জলকন্যা হয়ে শুয়ে আছে, তার চিঠির অপেক্ষায়।  

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                      


ইচ্ছে  

আমিঃ
একটা জানলা, কাচে জমা হয়েছে কুয়াশা আর জলবিন্দু কিছু। বিকেল না সকাল রোদ দেখে বোঝা যাচ্ছে না তেমন। এপারে বসে আছি দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। এমনিই। কোনো কাজ নেই, ব্যস্ততা নেই, নিত্যকার কাজকর্ম নেই, মানুষের মৃদু সাড়া আছে। আর উদাস বসে থাকা আছে। মস্ত বড় একটা ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখেও উঠব না। গায়ে কিছু জড়ালে ভাল লাগত, ভেবেও উঠব না চাদর আনতে। ধীরে ধীরে হাজার হাজার তারার মালায় জড়িয়ে যাবে পাহাড়। চিকমিক করবে ওরা আকাশ থেকে, জানলার কাচের ওপার থেকে। কেউ একজন শুধুই বসে বসে দেখতে থাকবে, দেখতেই থাকবে...

#
ভোরঃ

ক্রমশ অন্ধকার ফিকে হয়ে এসে লালের ছটা লাগবে জানলায়। একটা জ্বলজ্বলে বল সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসে বলবে--এবার উঠে পড় সোনা মেয়ে। ভোর হল। তোমার চা তেষ্টা পায় না? তাকিয়ে দেখব জানলার জলবিন্দুগুলো ঝরে পড়ছে দ্রুত। ওদের কোথায় যেন যাওয়ার আছে। আমি বরং আরেকটু বসি...
#
কুয়াশাঃ
কেন বসে থাকতে চাও অযথা? তোমার কোনো কাজ নেই বুঝি? এই দ্যাখ! আমরা গা ঘামালেই আকাশের ঘাম ঝরে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। আমরা বসে থাকলেও অন্য ভঙ্গিতে বসি। তখন জমাট বেঁধে যায় আমাদের ত্বক। সাদা কেন শুদ্ধতার বাহক জান? আমরা জমায়েত হই বলেই। তোমার এই বসে থাকা তো অনর্থক। সময় নষ্ট! 
জানলার কাচে কান চেপে ধরে শুনে ফেলি এসব। আমার কি একবারও এই জানলার ধার ছেড়ে ওই পাহাড়ের রাস্তায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না? ওই যে চাঁদোয়ার মতো লেক পড়ে আছে, যার গায়ে আকাশ বারবার ঘুমে ঢলে পড়ছে...যেতে ইচ্ছে করছে না ওই লেকের ধারে? আর ওই যে হিমশৈল চূড়া, মনে হচ্ছে না কি ওখানে উঠে গোড়ালি ডুবিয়ে দাঁড়াই কিছুক্ষণ?  যতক্ষণ না অসাড় হয়ে আসবে পা আর একপায়ে লাফাতে লাফাতে আমি গড়িয়ে পড়ব বরফের মসৃণ গা বেয়ে... ঠিক যেন স্লিপ বেয়ে নেমে আসছি, আর তারপর আবার চূড়ায় উঠে গড়ান দেব! ইচ্ছে করে না আমার? 
#
পাহাড়ঃ 

এই বসে থাকার মধ্যে একটা সুতো গুটোনোর শব্দ লুকিয়ে আছে। ঠিক যখনই আমি উঠে পড়ব, গুটনো সুতোর বাণ্ডিলটা আর কেউ খুঁজে পাবে না। চারিদিকে মানুষের শব্দ, তীব্র যানজট আর মরিয়া ব্যস্ততা। কাচের জানলাটা ঢাকা পড়ে যাবে ভারি পর্দায়। যার ওপারে ধুলোর মলাটে ঢাকা পড়ে থাকবে সেই পাহাড়। তার চেয়ে এই বসে থাকা অনেক আরামের।

সুবীর সরকার

                    


শিরোনামহীন


১.
শালি ধানের চিড়ার লোভে এই গঞ্জদেশে এসেছি
বিন্নি ধানের খই ছড়িয়ে পাখিদের ডেকে আনছি
আলপথ আর ঝাড় ঝোপে পড়ে থাকছে এন্টি এজিং
                                                            ক্রিম
২.
পুরোন ছবিতে সেই কবেকার রোদ ও হাওয়া
মানুষের ঘুম কমে গেলে 
মানুষের কান্না শুকিয়ে গেলে
পাখি আর বেড়ালের খুব খিদে পায়
মাঠে মাঠে নেমে আসে আস্ত একটা টাউন
                                                      ক্লাব
৩.
নারীর চোখে ছায়া ঘনিয়ে এলে
আঙুল থেকে আংটি খসে গেলে
হাত থেকে হাতঘড়ি খুলে গেলে
পরিচালক মন দিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু 
                                                        করেন
 
সমস্ত রাত জুড়ে নৌকোডুবির গল্প।
গল্পে পাশ ফেরা নদীর হাহাকার।
কপালে চুল উড়ে এলে
অনেকেই তুলি দিয়ে আঁকতে শুরু করেন
                                                          ভুরু










 

সৌমিত্র চক্রবর্তী

                           




ঝুম্পা তোদের দুর্গাপুজোয়

ঝুম্পা তোদের বাড়ির দেওয়াল 
নক্সীপুকুর গাছ
সেখানে সবুজ ঘাসবনে চরে 
হারানো সকাল স্বপ্ন
হাসিরা কখন ছেড়ে চলে গেল 
ফের ফিরে এল শরতে 
ঝুম্পা তোদের গোলবারান্দা 
জুড়ে শোয় রোদ্দুর
ঝাঁকে ঝাঁকে আসে কিচিরমিচির 
সোনালি ধানের সুখ
শারদ সকাল দুপুর সন্ধ্যে 
ধুনুচি নাচের ধূম
ঝুম্পা এবার খুঁজে নিস তুই 
ভীড়ের মধ্যে মুখ
তোদের দুর্গা দালানে এবার 
শতভীষা ঝিকমিক।।

*****

খর্ব বৃত্ত অধুরা গল্প

স্বর্ণলতা লাগিয়েছিলেম রূপোলী টবে
ব্যালকনিতে ঝুলতো লতার কথকতা
সরু চোখের প্রতিবেশী গলতো রাগে
আমার ছাতি তখন বেড়ে পঁয়তাল্লিশ।

স্বর্ণলতা স্বর্ণখনির ব্যাকুল আবেগ
ধিন কেটে ধিন তা কেটে তাক রঙ উচ্ছ্বাস
গোলাপী ঠোঁট গভীর চোখে ধ্বংস আবেশ
অলিন্দ আর নিলয় জুড়ে রাগ মালকোষ।

শুদ্ধস্বর সকাল হলেই সুরেলা আজান
মাঝ কার্তিক মাঠকর্মী হিম ছড়িয়ে
বরফ ছোঁয়া রাত ফুরোলেই চমকে দেখি
গল্প শেষের আগেই উধাও স্বর্ণলতা।

*****

একনায়কের ঝুন্ড

জেগে থাকা আর ঘুমোনোর গল্প শুনলেই
আমার হিটলারের সূক্ষ্ম বুদ্ধির কথা মনে পড়ে যায়,
কি অনায়াসেই না কমেডিয়ান মার্কা ভদ্রলোক
কয়েকটা দেশের সব জেগে থাকা মানুষদের
ঝেড়ে পুছে সাফ করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন!

অবশ্য হিটলার এটা শিখেছিলেন
মহামহোপাধ্যায় বীর নেপোলিয়নের কাছে,
নেপোলিয়ন আবার ক্রেয়নের কাছে
আর এভাবেই দেশ কালের কাঁটাতার আর
নোম্যানসল্যান্ডের উঁচানো
তরোয়াল কিম্বা কালাসনিকভের ভয়াল
সবুজ চোখ টপকে 
চলতি সব পার্লামেন্টেরিয়ান
আইন কে কাচকলা দেখিয়ে উত্তরাধিকার
সূত্রে ঢুকে পড়ে রাজকীয় আগুনখেকো দর্শন।

মাঝেমধ্যে দু একটা পাগল বিড়বিড় করে
কথকিঞ্চিৎ বিড়ম্বনায়
সুইমিংপুলের মউ মউ মৌতাতে
মজে থাকা জল ঘুলিয়ে ফেললে
নিরো জেগে ওঠে ঝুরঝুরে পুরনো কবরের
তলা থেকে হাতের গুপ্তি থুক্কু বীণা নিয়ে
হতভাগা পাগলগুলোর আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড হয় -
নাম্বার ওয়ান, ব্রুনো, 
টু লোরকা, 
থ্রি মোলায়েজ 
ডট ডট ডট...

একচোখোমি মাতাল হয়ে গেলে
বড্ড অসহ্য লাগে, আরেবাবা
শুধু অ্যানিমিয়া কেসের মত রক্তকণা কাউন্ট
করে গেলি! এমন ঝক্কাস ক্ল্যাসিক দর্শনের 
কদর করতেই শিখলি না!

তেজালো কবিদের বাপের ভাগ্য এখনো
সকাল হলেই চা, খবরের কাগজ
আর ধারালো পেন পেয়ে যাচ্ছেন;
ঘুম পাড়ানোর লিস্ট কখন যে জেগে ওঠে,
কে জানে!


মানসী কবিরাজ

                           



মাথুর

১ ।

এবারের  শীত জানি  আগের চেয়েও 

বেশী রাশভারী । 

 এবং

আমার কোনও খড়কুটো নেই অবশেষ 

তবুও

স্বরলিপি না শিখে  বাজাই 

আশাবরী রাগ

ঘন হয় নদীর জ্যামিতি

অথচ তার উদাসীন হাত 


খোলে না

স্নানের কপাট  


২ ।

বলিরেখা গড়িয়ে  নামে 

হলাহল কূট

আমি  ফেনার সাঁতারে  মাখি 

অমৃত-বুদবুদ ।



৪ ।

 ব্যারোমিটারের গায়ে ধুম জ্বর ;


৫ ।

সে বাঁশিটি বাজিয়ে বাজিয়ে 

খোঁজে ,

চন্দ্রাবলী- জল 

আমি  

হারানো নূপুর 

আর 

যমুনার ছল ; 


৬ ।


বৃন্দাবন থেকে 

 কোনও মেঘ , 

মথুরায় যায় না আর


গ্রামাফোনে গান বাজে

বেগম আখতার

নিলয় নন্দী

                   


বিরহ, বৈষয়িক ও নগরবৃত্তান্ত


বিরহ ~

ফিরে যাচ্ছি।
যদিও জানি নড়বড়ে সাঁকো আর স্মৃতিও পেন্ডুলাম
তবু এছাড়া উপায় ছিল না... 

বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার আগে সামলে নেওয়া জরুরী
ঈশানকোণ মেঘের আগেই সেরে নিই পাখিদের ওয়ার্কশপ 
কতটা ডানা ভাসিয়ে রাখতে হবে
কতটুকু ঠোঁট বাড়ালে ঠুকরোবে শাবক 
কীভাবে সামাল দেবে গোপন এয়ারগান 
এখন ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাট বাতুলতা মাত্র 
আয়ু বা আঁচল জল থৈথৈ নিঃশব্দ খেলা...

ডিসেকশন হাউসের দিকে তাকিয়ে আছি
কাঁচি ছুরি কাটাছেঁড়া আর কিছু দোনামোনা বার্ষিকী
যদি ডাকো একবার! 

এখনো ভুবনডাঙা অস্পৃশ্য সংকেত মায়াবালিয়াড়ি


বৈষয়িক ~

এপাশে মিউচুয়াল ফান্ড ওপাশে নেটফ্লিক্স
মধ্যে ঘন শ্রাবণ ধারা...
স্তন, স্তনাগ্র, মগ্ন ধ্যানবিন্দু এবং বিস্তর ফাঁকাজমি
বিষয় প্রেমের মুক্ত অর্থনীতি। দাপট গোধূলি।
যৌবন তল্লাশি সেরে প্রৌঢ় কবি নেমে যায় সংসার পুকুরে 
ঘাম, রক্ত, বাষ্প জমা কান্নাও কিছু কিছু
নিয়তির পশ্চাদ্দেশে সজোরে ফ্রিকিক 
জল ছেঁচে তুলে আনা খিদে বা খনিজ 
লিবিডো প্রবল, এসবই জলাঞ্জলি, চকিত দিগভ্রম
এখন কেবলই গুগল পে, অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস

মৌসুমী বাতাস উড়ে গেছে কবেই পাহাড়ের দিকে...


নগরবৃত্তান্ত ~

ও বিকেলবেলার পার্ক স্ট্রীট
তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছি গোপন অসুখ 
প্রেসক্রিপশন উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায় 
হলুদ ট্যাক্সি থেকে গড়িয়ে পড়ছে মুঠো মুঠো ক্যাপসুল
কপাল জুড়ে গনগনে আঁচ চুমুর প্রলেপ দাও কলেজফেরত প্রেমিকা, খুঁটে খাও প্রেমিকের
অলিখিত শরীর, শহীদ মিনার...
বিপত্নীক ও অবিবাহিতেরা তেলেনাপোতা খুঁজে বেড়ায়
নাগরিক চাঁদ, আগুন বা আঁধার, ডুব দেয় নাহুমের কেক
আমি তো তোমাকেই চিনি খয়েরি সন্ধে ভুল রাস্তা 
বোবা গীটার, এলভিস প্রিসলে, বান্ধবী নেমপ্লেট

ফিরে যেতে হবে জেনেও
শিখে নিচ্ছি সাঁতারের কৌশল ইন্টারভিউ ব্যাকরণ 

যদি কোনদিন অসুখ সেরে যায়... 









পিয়াংকী

                             





টেবিল আর হাইপ্রেসার মেডিসিন 

 

১) 

দুয়ারে জল।টেবিলে বনসাই। 

বেশি জলে একে বাঁচানো যায়? 


জানা নেই!

হয়ত এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা বেলা গড়িয়ে টুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে মেঝেতে 


আমি ভাতের থালা হাতে লিখতে থাকব কবিতা 

ওপাশে টেপরেকর্ডারে বাজবে," ম্যায় হরি চরণন কি দাসী...মলিন বিষয় রস ত্যাগ জাগাকে"


২)

এরপরও বুক ভেঙে বসে আছি থ হয়ে

তোমার তীর্যক দৃষ্টি ফুচকার চুরমুরের মত গুঁড়ো করে দিচ্ছে ভেতরপথ


এতটা নিস্তব্ধ একজন মানুষ তখনই হয় 

যখন সে ওই অন্ধত্ব লালন করার বদলে নিজেকে মেরে ফেলে মাঝরাস্তায়


এসো।বয়ে নিয়ে যাও এই ধ্বংসাবশেষ 


যাকে  সরিয়ে রাখতে  চেয়েছিলে বারবার 

তার ঘরময় সাইলেন্সার


এবার থেকে হাইপ্রেসার মেডিসিন নিও।টেবিলের তলায় রাখা আছে


৩)

ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াও। 

সবুজ দেখো,হলুদ নীল বা গাঢ় লাল।

ওরাও উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে তোমার হাইতোলা মুখের হাঁ


ভেতরে বৃষ্টি। বাইরে বৃক্ষ

এই যে অনবরত বয়ে চলা ব -এর র'ফলা... 


এর পাশের বাড়িতে রোজ মেঘ করে আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়

পিয়াংকী

               





 সাবুটিক্কি

একটি ওয়েট গেইন রেসিপি 


সকালের লেবুমধু খেতে খেতে অ্যালোভেরার গায়ে হাত বোলাচ্ছিলাম গতকাল, সবুজ দেখলে কেমন পাগলামি করতে থাকি আমি। কিন্তু কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়? অগত্যা ব্যালকনি থেকে ঝুপ করে নেমে যাই রান্নাঘরে।আজ পালংশাক করব ছানার বড়া ভেজে সাথে তপসের গ্রেভি...উম্মম্মম্মম্ম ভাবতে থাকি কী দিয়ে গ্রেভি হবে, ভাসুরের এক পছন্দ তো শাশুড়ীর আরেক।ফুলকপি দিয়ে ভেটকিটাও রান্না করে রাখতে হবে। সন্ধেতে একটা পেজের ভার্চুয়াল আড্ডায় সঞ্চালনা আছে।উফফ।এসব সামলে নিয়ে মেয়ের খাতা কারেকশন।আচমকাই মাথায় এল, " এই যা! নিজে কী খাব? ডায়েট চলাকালীন তো দুপুরের এসব রান্না খাব না"


উপোস করেছিলাম নীলষষ্ঠীতে।বড় দানা সাবু  কিনে আনা হয়েছিল, তার কিছুটা এখনো মশলাপাড়া থেকে উঁকি দিচ্ছে। যেই ভাবা সেই কাজ। ভিজিয়ে দিলাম সাবু, যে সময়টুকু সে জলে ভিজিয়ে নিচ্ছে শরীর আমিও সে সময় মিহি করে কুচিয়ে  নিলাম গাজর বিন ব্রকোলি কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ ক্যাপসিকাম


এরই মাঝে বলে রাখি,সাবুদানা হল পাম জাতীয় গাছের মূল থেকে নিষ্কাশিত দুধের মত এক ধরণের জিনিস যার থেকে ময়দার মত গুঁড়ো তৈরি করা হয় আর পরে মেশিনের ক্ষমতায় বর্তমান সাবুদানার রূপ দেয়া হয়,প্রতি ১০০গ্রাম সাবুতে ৮৮.০৭ গ্রাম শর্করা ০.১৯ গ্রাম প্রোটিন  ০.০২ গ্রাম ফ্যাট থাকে, জল থাকে ১১গ্রাম,অর্থাৎ ওজন কমানোর জন্য যারা সাবু খেতে চান তারা ওয়ার্কআউটের আগে খান, অনেকক্ষণ পেট ভর্তি রাখবে আর যারা ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা খুব সহজভাবেই সপ্তাহে অন্তত চারদিন সাবুর বিভিন্ন রান্না খেতে পারেন।প্রচুর শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট থাকে বলে ইন্সট্যান্ট এনার্জি বাড়াতেও কাজ করে সাবু



এবার রান্নায় চলে আসি।সাবু তো ভিজিয়েছিলাম।ওর গায়ে বৃষ্টির শব্দ, আধ ঘন্টা ভেজার পর একটা বড় ছাঁকনীতে সাবুর জল ঝরিয়ে নিয়ে  তাতে সবজীগুলো মিশিয়ে দিলাম,সাথে দিলাম গোলমরিচগুঁড়ো ভাজা জিরের গুঁড়ো গোটা জিরে জোয়ান আর লেবুর রস। আমচুর পাউডার দেয়া যায়,ভীষণ ভালো স্বাদ আসে, কিন্তু ছিল না ওইদিন ঘরে। একটু সময় এভাবে মেখে রাখার পর পরিমাণ মতো নুন আর দেড়-দুই চামচ ব্যাসন মিশিয়ে আঁটোসাটো করে বাঁধলাম সবটা।


 এবার হাতে একটু জল নিলাম, তেলও নেয়া যায়।ওই মেখে রাখা মিশ্রণ থেকে কিছুটা করে নিয়ে হালকা হাতে চ্যাপ্টা করে গড়ে ডাইরেক্ট ফ্রাইংপ্যানে। 

আগে থেকেই প্যানটা গ্যাসে বসিয়ে এক চামচ তেল দিয়ে প্রিহিট করে রেখেছিলাম। টিকিয়া শেপের বড়াগুলোর এক পিঠ কড়া হয়ে এলে খুব সাবধানে উল্টে দিয়ে ঢাকা দিলাম। পাঁচ মিনিট পর ঢাকনা খুলে 

নামিয়ে নিলাম।


এরপর একটা চিমটে বা সাঁড়াশি দিয়ে প্রতিটি টিকিয়া চেপে ধরে সরাসরি আগুনে এপিঠ ওপিঠ করে নিলেই তৈরি সাবুটিক্কি


অনিয়নরিং লেবু আর টমেটোস্লাইস দিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করার আগে টিক্কি নিল সেল্ফি🙂



চুমকি ভট্টাচার্য

              




রাখীবন্ধন



-তোমার জন্যে বেদানা ছাড়িয়ে রাখলাম মা।

ধারালো ছুরি দিয়ে মুসাম্বি টুকরো করতে করতে বলে মিতা।

রান্নাঘরের এক কোণের বেসিনের কলটা খুলে জলের ধারায় পানের গোছ থেকে এক একটা পান নিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে আলতো হাতে ঘসে পরিস্কার করছিলেন অনুপমা দেবী। মিতার কথার উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন,  

-পঞ্জিকায় দেখলাম পড়শু রাখীপূর্ণিমা! আমার গোপালের জন্য সুন্দর একটা রাখি এনে দিতে বোলো তো শুভ্রকে। আর কিছু ফুল, ফল, মিষ্টির কথাও বলতে ভুলো না… তুমি যা ভুলো!


শাশুড়ীমায়ের খোঁচা দেওয়া কথাটা কানে নেয় না মিতা। রাখিপূর্ণিমার কথা শুনেই ভাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মায়ের সংগে যোগাযোগের মাধ্যমও শুধুই ফোন। মনে মনে হিসেব করে কতদিন মায়ের কাছে যায়নি সে। এমনিতেই এবাড়ীর লোকেরা তার বাপেরবাড়ী যাওয়া পছন্দ করে না, তার ওপর আবার এখন কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে চলেছে। শুভ্রর কড়া নির্দেশ মা আর মুন্নীর সুস্থতার কথা ভেবেই সে যেন কোথাও গেলে ভেবেচিন্তে যায়। শুভ্রর এটা ভদ্রভাবে না বলার নামান্তর তা মিতা বোঝে। 


-আচ্ছা মা।

মুন্নীর জন্য মুসাম্বির জুস বানাতে বানাতে শাশুড়ী মায়ের কথায় সায় দেয় মিতা। 

বাইরের ব্যালকনিতে আপনমনেই খেলছে মুন্নী। রান্নাঘর থেকেই মিতা শুনতে পায় দুদিন আগে শেখা রাইম বারবার সুর করে গেয়ে তার অদৃশ্য ছাত্রছাত্রীদের শেখাচ্ছে মুন্নী। মুন্নীর জন্য জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে যায় মিতা। কিন্তু ব্যালকনিতে এসেই দুর্গন্ধে মিতার সারা শরীর পাক দিয়ে ওঠে। নীচের রাস্তায় তাকিয়ে দেখে এই অবেলায় দুজন সাফাইকর্মী ডাস্টবিনের সব নোংরা পরিস্কার করে একটা গাড়িতে তুলছে। মিতার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে ডাস্টবিনের পাশে পড়ে থাকা একটা আধময়লা গদির ওপর। গতকাল থেকেই ডাস্টবিনের পাশে পড়ে আছে গদিটা। পাশের বাড়ির বৃদ্ধা গতকাল মারা গেছেন। 

- ডাস্টবিনের পাশে পড়ে থাকা বিছানার এই গদিটা আবার বৃদ্ধার নয়তো? 

ভয়ে শিউরে ওঠে মিতা!


এই আবাসনে তারা খুব বেশিদিন হয়নি এসেছে। আশেপাশের কারো সঙ্গে তেমন মেলামেশা নেই ওদের, শুধু এক নন্দা কাকিমা ছাড়া। তিনিই শাশুড়ীমাকে পাড়ার যাবতীয় খবরের জোগান দেন। আজ সকালেই নন্দা কাকিমা শাশুড়ীমাকে ফোন করে জানিয়েছেন পাশের বাড়ির বৃদ্ধার মৃত্যু সংবাদ। তবে সাধারণ মৃত্যু নয়, কোভিড কেস। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নাকি জানা গিয়েছিল বৃদ্ধা কোভিড আক্রান্ত। তাই, বাড়ীর লোক আর মৃতদেহ বাড়িতে না এনে সরাসরি নিয়ে গেছে বার্ণিংঘাটে। 


মিতা তাড়াতাড়ি মুন্নীকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গিয়েও বেড়িয়ে আসে

 - ওরা গদিটা আবার ফেলে যাবে না তো?

মিতা কোনোরকমে গায়ের ওড়না দিয়ে নাক ঢেকে সাফাইকর্মীদের বলে, 

-এই যে, তোমরা গদিটা নিয়ে যেও কিন্তু! 

মাস্ক পড়া দুই সাফাইকর্মী তাদের দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে প্রায় একই সংগে বলে,

-হা দিদি, আমরা গদ্দি লিয়ে যাব।

"দিদি" শব্দটা শুনে মিতার মন যেন কেমন ছ্যাৎ করে ওঠে। সে আনমনে বলে,

-হে ঈশ্বর ওদের রক্ষা কর! শুভ্র যদি আরও দুটো রাখী এনে দিতো…

সোনালী চক্রবর্তী

               


ইগনিস



মৃত জল জ্যান্ত শ্যাওলার উপর কী ভাস্কর্যের জন্ম দেয় যারা দেখতে চায়নি, বর্ষা তাদের ঋতু নয়। আঁচে আলস্য সেঁকে নেওয়া টুকু গন্তব্য হলে শীত সব ঠিকানায় আসনপিঁড়ি খোঁজে না। আর কোনো কোনো দিন প্রকৃতির স্নায়ু মদিরাপ্রবণ হলে পৌষালি শিশির যে মেঘে ডুবে যায়, তাকে ভোর রাতে পালাতে গিয়ে পা থেকে খুলে যাওয়া চাঁদের মোজা মেনে নিতে স্বধার সামান্য সংশয়ও আসে না। সে কোনোদিন 'ফেভারিট সিজন' এই প্যারাগ্রাফ লিখতেই পারেনি। শীতের কোনো কোনো অলীক দিনে বৃষ্টি এলে তাকে তো আর 'সিজন' বলা চলে না অথচ ওটাই তার প্রার্থিত। কেজো মানুষদের কাছে খুবই বিরক্তির এই বাক্সের বাইরের আবহাওয়া। নিতান্ত বাধ্য না হলে এই দিনগুলোকে তারা লেপ্রসি পেশেন্টদের মতোই ট্রিট করে সর্বত্র। ফলত নিখাদ বৃটিশ স্থাপত্যের এই কলেজ আজ প্রায় শূন্য। চোখ খুলেই স্বধার মনে হয়েছিলো আজ তার দিন। অন্তরীক্ষে মোহর গাইছেন - "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ"।



অনুপস্থিত ছাত্র ছাত্রীর তালিকায় তিন বছর ধরে স্বধার নাম একদম প্রথমদিকে থেকেছে কারণ প্রথম বছরের প্রথম সপ্তাহে ছয় জন অধ্যাপকের ইন্ট্রোডাক্টরি ক্লাসের রাউন্ড শেষের পর থেকে অর্ক ছাড়া সে আর কাউকে শুনতে চায়নি। ডিরেক্ট এক্সাম দিয়ে সদ্য জয়েন করা, উদ্ধত, ক্লাসে মূল টেক্সটকে প্রায় ঐচ্ছিক বিষয়ের পর্যায়ে ফেলে দেওয়া, শ্যামবর্ণ, গ্রীসিয়ান স্থাপত্যের অর্ক বাগচী যার তিলফুল নাসা থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচের চৌহদ্দিটাকে কক্ষনো বোতামের শাসনে রাখা হতো না। স্বধার একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সেটাই গৌরচন্দ্রিকা - বোধ আর মেধাকে যারা মগজ থেকে রূহ অবধি একটা টানেল তৈরী করে একাকার করে ফেলতে পারে, তাদের শরীরী ভাষা অমোঘ হয়। অনুমানে সে যে ইঙ্গিত জমা করছিলো এগারো থেকে, ঠিক আঠেরো থেকে অর্ককে তিন বছর নেওয়ার পর তাতে সিলমোহর পড়েছিলো। এগারো - তোলপাড়ের - যা দেখছি যা ঘটছে তার অন্তরালে কোথাও অন্য সত্যেরা অপেক্ষায় - "I too am written" - পূর্ব নির্ধারিত যাবতীয় বহতা - রিনরিনে জাগানিয়ার - এগারো। ভেজা থামে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে সে অতীতচারী হয়ে উঠলো (এই তার ব্যাধি যা সে লালন করে যত্নে) । 


সেই বছর নীলে কাশের বেহায়াপনা ছিলো তাকিয়ে দেখার মতো। ছুটি শুরুর প্রথম দিন। কেন প্রতিটা শরৎ এত খা খা করা হতো তার, সে কারণ খুঁজতো। অজস্র জামা হতো জন্ম ইস্তক, কক্ষনো একটাও পরে প্যান্ডেলে যাওয়ার আবহবিকার তৈরীই হয়নি। দুঃখ তার হয় যে প্রাপ্তির ধারণা জানার পর অপ্রাপ্তি টের পেয়েছে, সুতরাং কোনো বোধই তার আসেনি। তার কাছে নতুন জামার মানে একটাই ছিলো পুরনো গুলো খুব পুরনো, অব্যবহার্য যাতে না হয়ে যায় হস্তান্তরের আগে সেটারই নিশ্চিতকরণ। মহালয়ার সকালে নতুনের মত চেহারায় বাক্সবন্দী হয়ে তারা যে কোন তেপান্তরে যেতো, বেশ খানিকটা বড় হওয়ার আগে সে বোঝেনি। কিন্তু নতুন গুলো যত সুন্দরই হোক, লাল টুকটুকে গাউন বা গোলাপী বার্বি ড্রেস, মেয়াদ এক বছর, মায়া আসতে নেই, এটুকু বুঝে নিয়েছিল। খুব ছোটতে পাপাকে তার বড় নিষ্ঠুর মনে হতো। সে গল্প শুনতো সবার বাবাদের হাত ধরে ঠাকুর দেখার আর তার বাবা ... সে বেলুন ভালোবাসে বলে রাস্তা দিয়ে যে কটা বেলুনওয়ালা তিন চার দিন ধরে যেতো, সবাইকে ডেকে সব কটা বেলুন কিনে দিতে দিতে তাকে দেখতে শেখাতো বেলুনওয়ালাদের ছেঁড়া জামা, চিন্তা করতে বলতো তাদের বাড়িতে যে ছোট্ট ছোট্ট স্বধারা আছে একটাও রঙিন নতুন কাপড়ের রুমালও না পেয়ে, তাদের ইতিবৃত্ত। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিতো বাঁশের জোগাড়ে থেকে শুরু করে ঢাকী, বিপুল শারদীয়া মূলত শ্রেণী বৈষম্যের বিকট উদযাপন। দেবীমুখের গর্জন তেল ততটাই উজ্জ্বল হয় মৃৎশিল্পী যতটা অন্ধকার ধারণ করতে পারে তার উপেক্ষিত যাপনকলায়। ফলে ছুটিতে বাড়ি ফেরার আগে তার অনেক বেশী উন্মাদনা থাকতো এবার কোন বইগুলো তার জন্য উপহার এসেছে ইলাহাবাদ থেকে সেটা জানার।



একইদিনে একই মেটারনিটি হোমে জন্মেছিলো স্বধা আর আয়ান। নিজের ছেলের মুখ দেখার আগে স্বধাকে কোলে নিয়েছিলেন আয়ানের বাবা, ক্রাইসিস ফরসেপ পেরিয়ে যে মেয়ে ডাক্তারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে জন্ম নিলেও মায়ের মুখ দেখতে পায়নি ভেন্টিলেশন ওভারের আগে। তার বাল্যবন্ধু নীলাদ্রির পৌঁছতে আরও তিনদিন লেগেছিলো। জন্মমুহূর্ত থেকে পরবর্তী বাহাত্তর ঘন্টা তিনিই ছিলেন একাধারে স্বধার পিতা ও মাতা। এর পরের কোনো মুহূর্তেই তিনি স্বধাকে নিজেরই অপত্যের বাইরে কিছু মানতে পারেন নি। এমন কোনো উপলক্ষ এরপর আসেনি যেখানে আয়ানের সমান উপহার নীলাদ্রির ঠিকানায় পৌঁছায়নি। স্বধার ভিতর দিয়ে স্বল্পায়ু জুনেইদ খান তার মেয়ের বাবা হওয়ার যাবতীয় উপলব্ধি পেতে চেয়েছিলেন প্রগাঢ় টানে। যখন স্বধা তাকে তার প্রকৃত মর্যাদা দেওয়ার বয়সে পৌঁছেছিলো, তিনি সাড়ে তিন হাত জমিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুধু উপহারগুলো থেকে গেছে। বই ব্যতীত অন্য উপহারকে জুনেইদ ব্লাসফেমি মনে করতেন, এইই রহস্য অজস্র দুষ্প্রাপ্য এডিশনে স্বধার ব্যক্তিগত স্টাডি আলোয় আলো হয়ে থাকার, তার লেখায় কাফনের রঙের আধিক্যেরও বটে। কেন বইকে সে শরীরের অংশ মানে, তারও একই সূত্র হয়তো। নিয়তি হিসাবে সে বই আর বই তাকে সহবাসে রেখে আসছে, নাড়ি ছেঁড়ার ক্ষণ থেকে, জুনেইদ কি জানতেন খুব বেশীদিন তিনি তার মেয়েকে ছুঁয়ে থাকতে পারবেন না? তাই এই আমবিলিক্যাল সাবস্টিটিউট পুঁতে যাওয়া?



সেই এগারোর ছুটির প্রথম দিনে ব্রাউন পেপার ছিঁড়ে স্বধা যে পাঁচটা বই জড়িয়ে ধরেছিলো, তিরিশ বছর পরের স্বধাকে ময়নাতদন্ত করলে হৃদপদ্মে তাদেরই কিছু শব্দকে খোদাই করা পাওয়া যাবে, এ ধ্রুব। সেই পঞ্চকই স্বধার নির্মাণবেদ। তার সমগ্র অস্তিত্বকে ময়ালের শ্বাসে টেনে নিয়ে জাদু আর পরার ইনফিউশনে ফেলে দেওয়ার বাস্তবগ্রন্থি। ছুটি শেষের দিন ফিরে যাওয়ার আগের সন্ধ্যায় প্যাকিং চেক করার সময় তলপেটে যন্ত্রণা করায় সে যখন প্যান্টিতে ডার্ক চকোলেট পেস্ট আবিষ্কার করে, এগারো বছরের মেয়ের পড়া হয়ে গেছে তার মানে, সৌজন্যে - "ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড"। কিছু বছর পর পীতাম্বরপুরায় সত্তরোর্দ্ধ দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার সম্পর্ককে ঘিরে যখন বাঙালীটোলার মুখিয়ারা পুরোদস্তুর গেস্টাপোর ভূমিকায়, চবুতরায় মাথা নিচু করে বসে থেকেছে সে, একান্ত ব্যাক্তিগত এক সহজ সত্যের অনুভবকে সামাজিক তুলায় চাপানোর বাঙালী অশ্লীলতার গ্লানিতে, কারণ তার মাথার ভিতর দিয়ে তখন ভেসে চলেছে ডাজা আর আরিজার জাহাজিয়া নির্বাণ - "লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা"। 


ঘোরে "মিসিং ইউ জুনিপাপা" ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে স্বধা দেখতে পেয়েছিলো অর্ক রাজহাঁস'রঙা শার্টের ভিতর কলোসাল গেট পেরিয়ে হেঁটে আসছেন। প্রাচীন বৃক্ষরাজির সদ্যস্নাত সবুজ চুইঁয়ে হীরের কুচিরা তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। চুল থেকে কপাল গড়িয়ে ঠোঁট - প্রশস্ত কাঁধ - দীর্ঘ বাহু - ভিজে উঠছে। ডানহাতে ট্রাইডেন্টের জায়গায় তিনটে বই। ব্যাস এটুকুই ব্যবধান পোসেডনের সমুদ্র থেকে উঠে আসার সঙ্গে। আঠারোর বুক জানে খরগোশের নরম ঠিক কতটা লাব ডুব নিতে জানে। হোক না তার বাবার নাম নীলাদ্রি চ্যাটার্জি, রিফুর নৈপুণ্যে যতই তার ভিতর বুনে দেওয়া হোক অকাল কাঠিন্য, জলোচ্ছাস তীব্র হলে চর ধ্বসে না যাক, ফাটল তো ধরেই। অশ্বত্থ ঘেরা ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশের স্যাঁতস্যাঁতে কড়িবরগার বিরাট হল... মেহগিনি গ্যালারির একদম শেষ রো'তে উঠে গিয়ে বসে পড়েছিলো। নিজের শ্বাসের শব্দ নিজের কাছেই কখনো কখনো ভয়ের দাবিদার। কিছুটা সময় একা থাকার দরকার ছিলো খুব। দেরী হয়ে গেছে। অর্ক ঢুকছেন হলে। প্রতিধ্বনি হলো -

-- "জানতাম... কেউ আসেনি...               অথচ আজ প্রুফ্রক'কে দেওয়ার         কথা... as far as my capacity       permits... স্বধা, তুমি কী চাইছ?        মানে, চাইছ কি?"

আত্মস্বরও আউটসাইডার হয়, স্বধার জ্ঞান বাড়ল উচ্চারণের পরেই -


-- "শেয়ার করার লোক না থাকলে         চাওয়ার টেনাসিটি বাড়ে বোধহয়"


--- "বেশ... let's begin then..."




 পরের আড়াই ঘন্টা এলিয়টকে "লাভ সংস অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক" এর চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন অর্ক। সেদিন বর্ষণ সম্ভবত তার সঙ্গে ঈর্ষায় নেমেছিলো এবং...হেরেছিল। অর্ক তাকিয়েও দেখেন নি একবার, না ঘড়ি, না বারিধারার গতি। ডায়াস নয়, স্বধার ঠিক সামনের ডেস্কে ডিপ ব্লু ডেনিমে ক্রসলেগড অধ্যাপকটি একবারের জন্যেও রেফারেন্স হাতড়াতে চোখ নামান নি কোনো বইতেও। অর্ক হল ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে স্বধা টের পেয়েছিলো তার জ্বর এসেছে প্রবল।


সে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় অর্ক তার তিনজন কলিগের সঙ্গে স্মোকিং জোনে...

-- "স্বধা, শুনে যাও তো"

হে ঈশ্বর, ক্ষমা আঁকা যায় না? মরণ কি সর্বদাই শ্যামরূপী? কে. ভাস্করনকে মন দিয়ে শোনেনা বলে নীলাদ্রি দুঃখ পান, সেই শাস্তিই কি আজ পাচ্ছে সে? সে এগোনর আগেই অর্ক হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলেন -


-- "ডায়েরিটা রাখো, আমার                   পার্সন্যাল নোট, যখন তোমার             মতো বাচ্চা ছিলাম, এলিয়টকে         এখানে রাখতাম"


লাইটনিং স্পিডে স্বধার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো অসুস্থ শরীরে -

-- " লাগবে না "

অর্ক থমকেছিলেন -

-- " মানে? নেবে না?"

স্বধা তখন অন্য মানুষ -

-- " না। বাচ্চাদের নিজেদের নোট            নিজেদেরই তৈরী করা উচিৎ।             আমিও করছি। গুড প্র্যাক্টিস। "



হা হা করে হেসে উঠেছিলেন অর্ক। নির্জন ইমারতটি অর্ক বাগচীর বিরল সেই হাসিতে বিস্ময়ে আছাড় খাওয়া সূক্ষ্ম চায়না ভাস হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন, তার সহজাত গাম্ভীর্যের থেকেও কয়েক মাত্রা গভীরে-- 



-- " লুটো ইগনিস... লুটো ইগনিস              তুমি স্বধা...
     অন্ধত্ব আরোপ করাই আমার            একমাত্র কর্তব্য এখানে। এত               বেশী বোঝো, এত কিছু জানো,           বেসিক'গুলো না দেখা থাকে কী         করে? আমিও মানুষ। "


স্বধা খড়ের কাঠামো হলে তার দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে অর্কর বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই অগ্নিদেবের উদরপূর্তি হতো খানিক। ঘোর কলিতে তাও হয় না, এ কি কম যাতনার? স্বধার স্ট্যাচুর হাতে ডায়েরিটা ধরিয়ে দিয়ে কথা শেষের পর এক সেকেন্ড দাঁড়ান নি অর্ক। তার পরের সাতদিন কলেজ চত্বরে দুজনের কারোর পা পড়েনি। উত্তাপ যে কতদূর সংক্রামক, স্বধার স্নায়ু টের পেয়েছিল। সাতদিন... প্লাবনের প্রস্তুতি হিসাবে খুব কম সময় ছিলো না ঋষ্যমূকদের কাছে, সম্ভবত মৃগয়াভূমির কাছেও নয়।