রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০

জয়ীতা ব্যানার্জী

                               



এই সংখ্যার কবি জয়ীতা ব্যানার্জী।নিবাস - বাঁকুড়া। ২০১৬ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও ব্লগে লেখেন। একক কোনও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। 



আতিথেয়তা ও শীতকাল
― জয়ীতা ব্যানার্জী



সেসব লোডশেডিং, আধখাওয়া চাঁদের কাছে
হাঁটুমুড়ে বসে থাকা। তারাদের উপকথা বেয়ে 
তখনও নামত নীল। মাকড়শার জালে আটকে 
শেষ হতে হতে ফের জ্বলে ওঠা। কাওকে না বলে

এমনি বেহায়া সিঁড়ি থেমে যেত। চিলেকোঠা একা
লোডশেডিং সেসব, রঙিন ছায়ার সমারোহ



আমাকে উঠোনে ফেলে উঠে গেছে ও বাড়ির সিঁড়ি
কলতলা বাঁয়ে রেখে চুপিচুপি সরেছে বয়স
আমার পায়ের থেকে বটগাছ দুহাত দূরেই- 
এখন অনেক বড়। ঝুরি বেয়ে ওঠে নামে স্মৃতি

কোথা থেকে জল আসে, পিছুটান ধুয়ে ধুয়ে শেষে 
পিছল শ্যাওলা আর একমুঠো ঘাস রেখে যায়



ঠিকানা লিখতে বসি। সহজ যদিও চিঠি লেখা
প্রতিবার ভুল হয়, খাম থেকে চোখ তুলে আনি
লাল ধুলো মনে পড়ে, বালিহাস, দুচারটে নামও
অনায়াসে বলে দিই। অথচ বাড়ির মেঠোপথ

ঠিকানা লিখতে বসে সদর দরজা ঢেকে যায়
নামের আখর খুঁজি, নেমপ্লেট ভেঙে পড়ে থাকে



কিছুটা রোদের মতো, একা একা জ্বলে আর নেভে
রাখতে শেখেনি তবু, পরিয়েছ স্মৃতির আগল
একটি মোটেই তালা ! বাঁধবে কীকরে ফিরে আসা
উঠোনের কাছাকছি শীত এলে বেশ বোঝা যায়

একদিন এখানেও ভোরের আজান শোনা যেত 
তুলসী মঞ্চের পাশে পরিপাটি আমপাতা, ঘট



আঁচল পেতেছে ঘাটে সোহাগী শিশির বোনা আলো
সাদা কালো ঘুম ভেঙে তুমি ফেরো ভোরের উঠোনে
নদী পেয়ে বর্তে গেছে, ভুলে থাকা জনপদ ভাবে
জল পেয়ে জল ভাবে বয়ে চলা কতটা সহজ

সফর রেখেছ হাতে। পরিযায়ী শীতের কাছেই
সে সফর শেষ হলে, ওইচোখে পালক চিনিয়ো



জানালা নিয়ম করে রঙিন শিশিতে রোদ ভরে
মেলে দেয় সারি সারি উপশম। প্রবীণ ব্যথারা
তখনও আলগা পায়ে রাত্রিদোষ জড়িয়ে রেখেছে
আপাত বিস্মৃত জ্বর। গরম জলের স্বাদ জিভে

তিক্ততাই সমঝোতা যতক্ষণে জেনেছে আত্মীয়
কোলের আতিথ্য ফেলে সোহাগী বিড়াল চলে গেছে



পিছল পাথর আর পাতায় মেশানো যত জল
নীল হয়ে আছে মেঘ। অথচ তেমন বর্ষা কই
মাঠের হরিণ দেখে শিকারী ডেরায় ফিরে আসে
নামতে নামতে রাত হরিণ-ও ঘুমোতে গিয়ে দেখে

উল্টানো চাঁদের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সাথে 
শিকারীর মরদেহ। এমনি হেলায় পড়ে আছে



ভুলবার মন্ত্র বল, দ্যাখো অনুরোধ করছি না
যতটা পেরেছ নিজে, ছিটেফোঁটা তার, বাকিটুকু
নেই বলে ধরে নেব কোনওদিন ছিল না আসলে
অথবা অতিথিসম। এসেছ খেয়ালে, চলে গেছ

আমিও লিখেছি কিছু আতিথেয়তা ও শীতকাল
প্রেমের আক্ষেপে নয়, ভালোবেসে অবজ্ঞা শেখাও



মায়া ফেলে গেছে ভোর। উঠেছ যখন ক্ষীণ আলো
সুতোর মতন যেন মেঝের চাদরে ছায়া আঁকে
কুড়িয়ে নিয়েছে খই। একপাশে নিকোনো উঠোন
শেষযাত্রার মতন বিসমিল্লাহ বেজেছে তার
 
প্রতিটি শ্বাসের সাথে। মায়াময় ফেরেনি তবুও
শুধু ছায়া সরে এসে প্রশ্রয়ের সদর পেরোয়


১০

সেদিনও নবান্ন ছিল। দুধসাদা আতপের ঘ্রাণ
নিকোনো উঠোন আর আলপনা মাটির সরায়
ধূসর শীতের সাথে বোঝাপড়া সয়েছে। রয়েছে
ধানের আলোর কোলে মাথা রেখে জমিয়েছে জল

মলমাস শেষ হল ? ফিকে হয়ে এসেছে হলুদ
আরবার রং দিয়ো। রং ছাড়া অপেক্ষা বাঁচে না



রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

অনিন্দ্য পাল

                                                 





 সৃজন এই সংখ্যার কবি অনিন্দ্য পাল। 


সাপের খোলস // অনিন্দ্য পাল 
=====================
মুখোসের উপর মুখোস চড়িয়ে 
লুকিয়ে পড়েছি সবাই 
গভীর 
ঘুরন্ত অন্ধকারে!

অন্ধকার কি শব্দহীন? 
না, খিদের শব্দ এখানে 
হিস-হিস...

অন্ধকার কি শর্তহীন ?
তাহলে তার পোষাক নেই কেন 
লজ্জাস্থানে!

অন্ধকার কি লোভহীন ? 
তবে এত মালা কেন গলায় 
সর্বাঙ্গে! 

আসলে আমরা সবাই বিবর্তনের শিকার 
সাপের ছেড়ে ফেলা খোলসের মত পড়ে থাকি 
চুপচাপ, 
ফাঁপা শরীরের খিদে এঁকে রাখি 
বেওয়ারিস খোলসের 
ভিতরপিঠে... 
================================ 
আঁকা মানুষ।  // অনিন্দ্য পাল 
===========
শেষ হয়ে যাওয়া সময়টুকু পেরিয়ে এসেছি সবে 
সব নাম-বেনাম বেরিয়ে গেছে শেষ নিঃশ্বাস হয়ে 
আমার "আমি"র মুখে বারবার এঁকে রাখা সব মুখোশ 
খরার আদরে ফাটাফুটি দোঁয়াশের মত চেয়ে আছে 
আকাশের দিকে, 
ধরো সেখানে ভেসে আছে একটাই মেঘ 
অথবা অভিশাপ 
বৃষ্টি হলে ,ধুয়ে যাবে রঙের পরত 
না হলে , ধূসর গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিশে যাবে 
আঁকা পরিচয় 
স্তরে স্তরে গড়ে তোলা বল্মীক জীবন 

এখন দেখছো এই সব শব যা চেয়ে দেখ 
আকাশের দেওয়ালে ফুটে আছে নাম 
আঁকা মানুষ ...
==================================
 বসন্তের শেষে //অনিন্দ্য পাল 
======!!!!=====
আজ বসন্ত চলে গেছে এই খানিকটা আগে 
চৌকাঠে ডানপা বাড়িয়ে দিয়েছে গ্রীষ্ম 
শীতকাল চলে গেছে বলে কষ্ট হচ্ছে না আর 
সিলিং-এ পাখাটা ঘুরছে, নামছে বাতাস আবার 

বসন্ত চলে গেছে বলে কোকিল ডাকলোনা আর 
অথচ 
কোকিলের ছানাপোনা সব এখনো কাকের বাসায় 
কোকিল কি ভুলে যেতে পারে সন্তানের কথা 
কোকিল কি ভুলে যেতে পারে সেই সব পথ 

আগামী বসন্তে আসতে হবে আবার 
বোকাসোকা কাকের মাতৃস্নেহ লুঠ করতে 
কোকিল ভোলেনা কাকের অপত্যপ্রেম 

তবে কাক ভুলে যায় বারবার বিগত বঞ্চনার ইতিহাস। 
========================= 
অনুরোধ // অনিন্দ্য পাল 
========
আমাকে ফেলে দিও না কাঁটাঝোপে 
ঘুলঘুলি থেকে পড়ে যাওয়া চড়ুই বাসার মত ,
বরং দিও এক সানগ্লাস সূর্যবাঁধ 
গুমটি মনের ফোস্কাতে দিও কিংশুক চুমু 

দহনরাগ জুড়াবো যখন অন্ধকার ঠাসা কোণে 
আলোকে দিওনা ঠিকানা লুকানোর 
কোন নদীজলে দিয়েছি ডুব 
মিশে গেছি কোণ বনে ...

অহল্যাঘুম ভাঙিও না আমার 
জীবনঘড়িতে দিওনা ঘুম ভাঙাবার চাবি 
আটকে দিওনা মোলায়েম শীতের বাতাস 
এ ভাবেই বাঁচি আমি এটুকুই আমার দাবী, 

সময় ফুরিয়ে এলে চলে যাবো ঠিক 
যেমন যেতে হয় হরিণকে মৃগনাভি ছেড়ে 
নাহলে প্রত্নবীজ হয়ে থেকে যাব হাজার বছর, 
যদি আসো তারও পরে, কালের সেচখাল পেরিয়ে 
ছুঁয়ে দেখো প্রথম বেরোনো কচিপাতা দুটো 

চারাগাছে পাবে নরম ভালোবাসা, 
                                            কাঁটার প্রেম এড়িয়ে। 
====================================
ভালোবাসার বাড়ি // অনিন্দ্য পাল 
===============
মোমের শিখার মত লাজুক আগুন
ছড়িয়ে দিয়েছ বুকের গভীরে 
সেখানে অনশনরত একগুঁয়ে ম্যাগমারা তখন 
একে অন্যের ইচ্ছা পানে ব্যস্ত, 
তবু তোমার এই পেলব দহন সয়ে নিতে পারি 
বেতাল জীবনের মত,
আরও পারি মৃত সভ্যতার শৌচাগার হতে 
অথবা অন্ধ দাবানল হয়ে গিলে নিতে পারি 
সবুজ কলমি লতা, 
অথবা যদি তুমি বলো, পুষ্পহীন করে দিতে পারি 
রাধার কুঞ্জবাগান,
শেষ লহমায় ছিনিয়ে আনতে পারি অ্যানুবিস হয়ে 
রতিমগ্ন প্রেমিকযুগল,

কিন্তু এত সব করেও কী পাওয়া যায়, পাওয়া গেছে 
কখনও কোনকালে বেহুলার প্রেম? 
তাই আর আদেশ নয়, নয় কোনো আইন জারি 
এস,লালরডোডেনড্রনের মত ঝরে পড়ি পাথরপাহাড়ে 
ফুলের শব দিয়ে বানাই ভালোবাসার বাড়ি। 
==================≠=========== 
ভালোবাসার বনসাই // অনিন্দ্য পাল 
=========
সেই প্রথম দিন, প্রথম দেখা 
একঝাঁক পায়রা এবং তুমি 
হাতে সোনালী শস্যদানা 
বানভাসি উপত্যকা আমি 

তুমি, আমি এভাবে গড়ায়নি আর দিন 
ক্যালেন্ডার নতুন হয়েছে বারবার 
ঘুমের মধ্যে তুমি লেডি আলাদিন
অর্ধেক দিন বেচে আমার রোজগার 

আমি দানা খুঁজি কবুতর জীবন 
চাঁদপ্রেমে উড়ে গেছ সমুদ্রশহর 
কুয়াশা বাষ্পে চুমুক দেয় তৃষ্ণা সৌরদিন 
পেয়ালায় ঢেলেছি স্মৃতি, রাত্রি উজাগর 
ইতিহাস অতীত কখনো ডাকেনি পিছনে 
তলানিতে ঘোলাটে সুখ, বসত করে মনে 


আমার বাগান জুড়ে আগাছা গুল্ম ঘাস 
তোমার দোলনাটবে বনসাই ভালোবাসার চাষ ...

================================
একফোঁটা সুখের জন্য // অনিন্দ্য পাল 
================
মুষ্টিবদ্ধ সুখ খুঁজে ছিলাম মরিচীকার মত 
বেলেমাটি লেপা মেটে দাওয়ায় 
সেখানে বসত ছিল হলুদ ঝরাপাতার...

নীলচে শিরায় উপভোগ শ্লথগতি 
আপেলশামুক বাসা বাঁধে স্পন্দনঘরে
দু-একফোঁটা সুখেই ভিজবো, ভেবেছিলাম 
মেঘের আদর ভেসে চলে গেল, হঠাৎ মরুঝড়ে 

এত বড় আকাশ এত বৃষ্টি ঝরে 
আমাকে ভেজাবে কে, আমার একলা ঘরে 
ভালোবাসা ফুটে আছে দেখি রাতের জ্যোৎস্নাতলায় 
একফোঁটা সুখ তোমার গন্ধ নিয়ে 
আমাকে উদাস করে ...
============================= 
আবার প্লাবন আসুক, ব-দ্বীপে // অনিন্দ্য পাল 
==≠=================
তোমার আধচেরা ব-দ্বীপে এখন 
অস্তরাগের বিষণ্ণ প্রতিলিপি 
তবে কি এবার দিন ফুরিয়ে এল? 

ঋতুহীন খনিগহ্বর চাঁদ গেলে গোগ্রাসে...

জোনাকিরা এখনও ছড়ায়নি দেহগত আলো 
তুমি কি নিতান্তই অমাবস্যা চেয়েছ, বীতকাম 
প্রতিরাত ভোরে, 

প্লাবন আসবে কবে তোমার ব-দ্বীপে আবার?
আলুনি উর্বরতা আর সুখ দেয়না, শান্তি দেয় 
স্নেহ আর উৎসবে কেটে যায় রাত, অচঞ্চল 
কঠিন বাঁধে কি আটকেছো মোহনার নোনাজল? 

তবু আমি আশাদীপ জ্বেলে রাখি প্রাণপনে 
তোমার পলিপল্বল উঠোনে 
আবার যদি ফিরে আসে সেই সব প্লাবিত উচ্ছ্বাস
থেকে যাবো তবে, এই দ্বীপে,আনাচে-কানাচে 
অথবা বিশুষ্ক হও যদি লবণ বালিয়াড়ি 

ফুরিয়ে যাবো তবে, একান্ত একা আনমনে... 
==============================
বন্ধুকে / অনিন্দ্য পাল 
=========
যে ভাবে হারিয়েছিল তোমার উত্তরকাল 
আজ সেই আলুথালু পথে 
যেতে হবে ঐন্দ্রজালিক পদক্ষেপে, 

না কোনো প্রশ্ন নয়, কৌতুহলের ওষ্ঠে রাখ 
ধৈর্যের বাটখারা 
তোমার শত্রু নয় কেউ, তুমিও নও বন্ধু সবার 
ভঙ্গুর পলিথিনে মুড়ে পুরসভার ডাস্টবিনে ফেল
ষড়যন্ত্র আর মিথ্যার মাসকারা

এ অভিশাপ এনেছ কিষ্কিন্ধ্যা থেকে 
বৈরিতা বিদূষক হয়ে শুয়ে আছে তোমার হারেমে 
মনসার সুড়ঙ্গ ভুলে তুমি তুলে নিয়েছ ধনুক
দেবতার লড়াইয়ে বলি হতে হয়, রাবন আর রামে 

সুগ্রীবের ছলনায় বধেছ সহোদর
এখন বদলেছে সব, আগের মত নেই কালের নগর 
তবু তোমাকে বলছি আমি বন্ধু হই তোমার 

তুমিও শত্রু নও, কেউ বন্ধু নয় তোমার! 
====================================
অদ্ভুত কথা // অনিন্দ্য পাল 
=========
ধরবো বলে ছুটেছিলাম একবগ্গা 
সময়ের পিছনে 
নীল লন্ঠন জ্বেলে এগিয়ে ধরেছিল 
অবসৃত আদিম আত্মীয়রা 
আত্মার আলোয় যেটুকু ছিল পূর্ণিমা 
ব্রহ্মাণ্ডের গাছেরা তাও নিয়েছিল শুষে 

তবুও গোড়ালির আঘাতে ভেঙে ফেলে 
সভ্যতার মাইলফলক 
পেরিয়ে এসেছি প্রজন্ম পারের পঞ্চভূতে 
এখানে এখন সমুদ্র সমতল 
গুল্মজাতীয়রা ছেঁটে দেয় বট-অশ্বত্থের ডানা 
হৃৎপিণ্ডের আবহবিকারে জন্মনেয় 
লঘু আর গুরু 
এখানে সবাই স্বাধীন, অথচ প্রশ্ন করতে মানা,

মেরুদণ্ড বন্ধক রেখে সিংহাসনে রাখা হয় চুমু 
উচ্চরক্তচাপে ভোগে তরুন সময় 
খোলাবাজার থেকে কিনে নেয় বোতলের লোভ 

কফিনে ঘুমিয়ে থাকে মরেও বেঁচে থাকা 
বাস্তু ঘুঘু ... 

রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০

মৌমিতা মিত্র

                                    




এই সংখ্যার কবি মৌমিতা মিত্র।জন্ম ১৯৯৫ । কলেজ জীবনে কবিতার হাত ধরেছেন।একটা সমস্যার মুখোমুখি ছেলেবেলা থেকেই হতে হতো — তা হল সকলের সাথে মিশতে না পারা। অনেক কথা থাকতো যা হয়তো বলার প্রয়োজন মনে করতেন কিন্তু বলা হয়ে উঠতো না। অনেকটা নিজের জগতে গুটিয়ে থাকা এই কবি কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজের না বলা কথাগুলোকে তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি কবিতায় নিজেকে জানতে চেয়েছেন সবসময়। 

সন্ধে নামলে

সন্ধের নিস্তব্ধতায় এক অচেনা সন্ধ‍্যার নিঃশব্দ চলাচল;
পোশাক বদলে মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা!
কত মানুষ ঘর চিনে ফিরে আসে নি।
একাকী ঘরের দরজাগুলোয় আঁচড়ের দাগ
যেন হিংস্রতায় গিলে নেবে সকলকে
আর আমরাও নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পা গুটিয়ে
বসে যাবো বিশাল হা মুখের ভেতর; চোখ বুজে।

সন্ধের অন্ধকারে কালো হতে থাকা গাছের পাতাগুলোয়
পিতৃসুলভ অস্থিরতা; নিষেধাজ্ঞা আর সতর্কবার্তা―
হাওয়ার বেগ বদল কিংবা দিক বদল হয়েছিল
একবার; দূরে কোথাও; তাপমাত্রার তারতম্যে
তারপর থেকেই আকাশে বরাবরের মতো কালচে নীল

অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় রাতজাগা পাখি আর হারানো শিশুদের গান
ঘরের সুচিন্তিত উষ্ণতায় ওরা আমন্ত্রিত নয় কারণ
তুমি আর আমি সময়কে নাকি বন্দি করেছি


*****************************



অপেক্ষার রঙ



মেঘরঙা পাখি আর
কাশফুলের প্রেমের
পরিণতিহীনতার স্পন্দনে
নদীতীর মুখর।

জীর্ণ গাছের গল্পে 
অপেক্ষার রঙ বদলে বদলে যায়।


*****************************



ঝরা পাতার গল্প


ভাতের দাগ মুছে গেছে অনেকদিন।
ফুটপাতে এখন শুধু 
ঝরাপাতার গল্প।
তারা পরিচয় খুঁজে পায়নি কোথাও
তারা গাছের পাশে বেঁচে আছে।


*****************************



চশমা




একটা চশমা উল্টো করে রাখা।

একটা ছায়া বড়ো হতে হতে
কাঁচদুটো চোখ হয়ে গেল।

সমীকরণ সহজ দেখে সেদিন সবাই
হাত তুলেছিল; দ্রুত সংখ‍্যা বসিয়ে
অনেক প্রকার সমাধানও উঠে এসেছিল।

বাগানের বালতিতে জমা জলে
মুখ দেখতে দেখতে গড়িয়ে যাচ্ছি ---
দেখে সে পেছন থেকে চুল টেনে ধরে।
কুসংস্কারের মতো। রোজ।

অনেক সরলরেখা ভেঙেচুড়ে, বাঁকিয়ে
নাম লিখে দিয়েছে ওরা সবাই ----
সকালগুলো বেঁধে দেবে বলে।

তারপরেও শ‍্যাওলা ধরা জলে মুখ ভাসে।
সবুজ হয়ে আসে জলের আকাশ।

চশমাটা উল্টো হয়ে পাশে থেকে যায়।


*****************************



ঘর





ছেলেটি নতুন জামা পেলে কাঁদতো।
মেয়েটি কোনোদিন জানতে চায়নি
বাড়ির নাম কেন কুয়াশা।

ডালভাত গড়িয়ে যেতে যেতে
থালার একপাশে একটা মাছি।
তারা ঘর বাঁধবে নৌকার
আলোছায়া আশ্রয়ে।

গল্পটা এগোতে থাকে।
সব কথা পাড় হয়ে যায় নদী;
মাছিগুলো এখন শহরের সেই দীর্ঘ পথে,
ছড়িয়ে ছিটিয়ে।


*****************************


আপোসের পথে




কিছু কিছু বিকেল আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।

ভাঙা ভাঙা কথা, দূরের হলুদ আলো, 
মাটির ভাঁড়, এলোমেলো আমি ---
সব ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পথ।

দিন-শেষের আলোয়
অচেনা রাস্তার কাছে এসে দাঁড়াই
নতুন গলিপথের সন্ধানে।

ভুলগুলোর সাথে আপোস করতে পা বাড়াই।


*****************************


ঘুণ ধরা গন্ধে




শেষ সারির মৃতদের একজন
চোখ খুলে সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিল
তারপর থেকেই আকাশের রং লাল
সোনালি ফল হাতে দুটো শরীর
পাশাপশি এলেই হিংস্র ডালপালা
চেঁচে নিতে থাকে সমস্ত শাঁস
বাইরের ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস আর
বন্ধ ঘরের সোঁদা ঘুণ ধরা গন্ধে
নতুন পৃথিবী একে একে হাত পা তৈরি করছে
ভূমিষ্ঠ শিশু গতকালের চির ধরা টুকরোগুলো
সঠিক শূন‍্যস্থানে বসিয়ে
গল্পকথা বুনবে আর ক'দিন পরেই
রাত্রিকালীন বৈদ‍্যুতিক তারাগুলো
গলে গলে নিভে এলে
দেবদূতের পুরোনো কেল্লার 
শেষ জানলা বন্ধ হয়ে যাবে নিঃশব্দে

প্রতিটা টোলে একেকটা স্বপ্ন ফেরত চাইছে সময়


*****************************


যুদ্ধভাঙা একটা শহরে




একে অপরের চোখে লুকিয়ে পড়ে নিলে
ভাতের থালার গন্ধ ভুলে যায় উত্তাপ
ত্রুটি আড়াল করতে শক্ত হয়ে ওঠা
বুকের ঠিক মাঝখানটায়
নিথর তখন সব ভাবাবেগ
সদ‍্য যুদ্ধভাঙা শহরে একটিমাত্র স্তব্ধদিবস
আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছি বলে।
কোনো এক ভবিষ‍্যতের বৃদ্ধ
তেল-নুন মাখাতে মাখাতে হিসেব দেয় সংস্কারের
আর তুমি, আমি একটা দাঁড়ি পেরিয়ে এসে
চোখ বুজে থাকার অভিনয়ে নামি।
প্রতিবেশীরা এখনও জানে না
আমাদের মায়ের আয় স্বল্প, বাবার আয়ে
একটাও আঙুল খরচ হয় না
আর আমাদের বুকের মাঝখানে শক্ত একটা কুণ্ডলী
তাই খবর ছড়িয়ে পড়ার আগে
আমরাই চোখ বুজিয়ে দিই
যাতে বোঝানো যায় আমরা কিছু বুঝিনি।


*****************************


সোমবারের বিকেলে

অনেকদিন পর আজ ক‍্যারাম খেলবো
বাবার সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি;
ক‍্যারামবোর্ডের পেছনে দুটো মাকড়শা
ওদের ঘরে চারদিকে হাওয়া;
লাল কালি দিয়ে পাতার ওপর
ভুল সংশোধন করতে করতে
জানলাগুলো আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি জানি ঘুটির আঘাতে
উল্টোদিকের ঘরগুলো ভেঙে যাবে না।
শুধু ওরা জানতে পারবে
দমবন্ধ একটা ঘরের হাওয়াই 
ওদের ছাদখোলা ঘরের চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
ওরা জানতে পারবে আমি ছিলাম এখানে।
একাই ছিলাম আর ওদের লক্ষ্য করছিলাম।
অনেকদিন পর আজ কাউকে ছাড়াই
নীল স্ট্রাইকারে কালো-সাদা রঙ চলকে পরবে
অথবা জার্সির অদলবদল হবে।


*****************************


একটা ঘরের খোঁজে





কথা বলার সংখ‍্যায় গভীরতা বাড়লে
সরে সরে আসে সব রঙপাখিরা
ছোটোঘাসে ফুল হবার আগে হাত ছুঁয়ে করা
যত ভোরের প্রার্থনা সাবেকি গন্ধে মিশে আসে
ছায়ারা পরতে ভুলে গেছে
সংজ্ঞাহীন পরিযায়ী পাখি ভেঙে যেতে যেতে
পথ দেখালে চোখের সামনে সে পথ এগিয়ে নেয়
নাকি উপহারে আসে একটা মৃত্যু?
কথা বলা ফুরিয়ে এলে কথা অনেক হয়
তখন গালিচাপাতা সন্ধেগুলো উত্তাপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে এলে
আমাদের ঘর একইরকম পরিচয়হীন
এক পৃথিবী মেঘে সীমাবদ্ধ এক দৃষ্টি।


*****************************