মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

সম্পাদকীয়


বহুদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়াতেই উড়ে গেল ঝরা পাতা I এখনও মনে হয় 
এইতো সেদিন বইয়ের ব্যাগ ফেলে এক ছুট্টে মাঠে যাওয়া ৷ কখনও ঝালমুড়ি কিংবা ফুচকা , আইসক্রিমের ঘণ্টা অপেক্ষায় ৷ 


হারিয়ে গেছে মেঘলা বিকেল ! হাতে হাত রাখা I এক নিঃশ্বাসে দুটো অস্তিত্ব অনুভব করা ৷ সন্ধ্যে নামলে তারারা বিবাগী হয় , ,ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা কান দিয়ে নামে ৷ সাইকেল জমা থাকে ইষ্টিশানে ৷

জানো নীল "পুতুলের ঘরটা মা আজ তছনছ করে দিয়েছে ৷ " 

"ভেবো না... আমাদের ঘর ভাঙবে ..."

সময় বয়ে যায় ক্যালেন্ডারের ভিতর এক কিংবা শূন্যে ৷ সেই কথা গুলোকে আজ পাকাচুল , চোখের কোণে একরাশ কালির মধ্যে খুঁজে পেলাম ৷ 


বড় ক্লান্ত লাগে নীল আজকাল ৷ এক আকাশে রোজ মেঘের আনাগোনা কিন্তু নীলের দেখা নেই ৷ কপালের সন্ন্যাসের নীচে দিঘি জল ৷ তালগাছের পাশে সুপারী ...

ওই দিঘির পাড়ে একটুও নীল আছে ! আমার পুতুলের ঘর ... এখনও সাইকেল ইষ্টিশানে আছে ৷

এই তো সেদিন " সৃজন " প্রকাশ হলো দেখতে দেখতে ৭ মাস অতিক্রান্ত ৷ ভালো মন্দ মিলিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ৷ "সৃজন " ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র । কিছু গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশ হয়েছে ইতিমধ্যে পরবর্তীতে আর কিছু অপেক্ষায় ৷ চারিদিকে উন্মুক্ত সাহিত্যের প্রাঙ্গণে " সৃজন" আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র ৷ তার পুরো কৃতিত্ব " সৃজন" লেখক ও কবিবৃন্দের ৷ শেষে বলি " আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে " সুহৃদ পাঠক আরো স্পর্শ চাই আপনাদের ৷ ভালোবাসায় থাকুন ৷ সৃজনে থাকুন |

সম্পাদিকা 

পারমিতা চক্রবর্ত্তী 

"সৃজন"


চিত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অন্তর্জাল

গৌতম দত্ত



কাছে এলে দূরে যাওয়া যায় –


কাছে এলে দূরে যাওয়া যায় –
দূরে গেলে কাছে।
সব রঙ মিশে গেলে নেই-রঙ আর !
সাদা বালিয়াড়ি বড় মিহি।

পরাগ ফোটে ছড়ায় ওড়ে
সব রাগ ও-
কতো রূপ কতো বর্ণ কত গন্ধ।
সময়ের সীমানায় সব যায় মিলেমিশে।
পড়ে থাকে শুধু মন।
একান্ত আপন শুধু-
ফুলে ফুলে জমা করা মধু’র মতন
অপেক্ষায় –
একরাশ আশা—আর
একবুক ভালোবাসায়।
প্রজাপতি আসে সকালবেলায়।
ফুল-মন নিয়ে উড়ে যায়
নতুন আশায়।


#####

বড় রুক্ষ হ’য়ে গেছে চারিপাশ।

বড় রুক্ষ হ’য়ে গেছে চারিপাশ।
ফনিমনসা’র কাঁটা, আলো করে আছে –
সারাটা শহর। তাও ছিল ভালো,
ভাদ্রে’র রাতে যদি ফুল দেখা যেত !
সব কিছু শেষ নাকি ?
অগষ্ট্‌ ছ’য় কিম্বা আট-এর মতো ?
শিমা—সাকি তবু পোড়াতে পারেনি –
মন- স্বপ্ন- আশা- আলো।

এখন যে ভাইরাল জ্বরে সব পুড়ে যায়।
হে মহান,
হে অনির্বান শক্তি,
সব কিছু নিয়ে নাও তুমি-।
শুধু একটুকু ভালোবাসা রেখে দিও প্লিজ্‌
বুভুক্ষু হৃদয়ে আমার !

একটুকু। এ্যাটমের মতো !
আবার গড়ে দেবো এক পৃথিবী আকাশ, নদী, পাহাড় আর
নতুন মানুষ-
যারা শুধু ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু
বুঝবেই না।

পিয়ালী বসু ঘোষ



সাঁঝবিহান --পর্ব ৫

মনের মধ্যে অস্থির একটা চঞ্চলতা সতীশের ।একবার শাল্মলীকে লিখবে বলে কাগজ কলম হাতে নেয় আর একবার তা রেখে ঘরময় হেঁটে বেড়ায় ।কি বলবে মেয়েটাকে ? বলবে সাঁঝ ও তার পরিবারকে  ঘিরে ওর অবচেতনে একটা অস্থিরতা তৈরী হয়েছে ?নানা ,কিকরে বলবে এসব ও?

কতো কি ভাবনা ভীড় করে আসে ।কিন্তু লিখে উঠতে পারেনা ।শুধু লেখে -"তোর সাথে আমার অনেক গল্প আছে শাল্মলী ।আজ জঙ্গলের পথে ফেরার সময় ইচ্ছে করে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম জানিস ।ভেবেছিলাম কোনো গন্তব্যেই ফিরবনা নির্ভুল ঠিকানা চিনে ।"

কিন্তু কি এক সংস্কার অবশ চেতনা কে তাড়া করে বেড়ায় ।অজানা কে জানতে এসে এই অসহায় পরিবারটির কষ্টকর জীবনযাত্রা ওর জানা জগৎটাকে ওর থেকে দূরের করে দিয়েছে ।এতে ওর আক্ষেপ নেই যদিও কোনোও, শুধু এই বদলে যাওয়া জীবনে শৈশব থেকে জমিয়ে রাখা স্বপ্নটার বদল হয়ে গেছে ।একথা এবার ওকে বলার সময় এসেছে ।কিন্তু ও জানেনা এই সত্যের মুখোমুখি করাবে কি করে শাল্মলী কে ।

গতকাল সতীশ চলে আসার পর গ্রামের হোমরাচোমড়াদের নিয়ে কলমির বাড়ীতে চড়াও হয়েছিলো গোমস্তা ।শাসিয়ে গেছে কলমিকে সতীশ যেন ওখানে আর না আসে ।বলেছিল যদি সতীশকে কলমির বাড়ির আশেপাশেও দেখে তবে ওর লাশ নাকি কাকে শকুনে খাবে এমন ব্যবস্থা করবে ।আর যদি সে সাঁঝকে বিয়ে করে তবে আলাদা কথা ।কিন্তু ও মেয়েকে বিয়ে করে আর কি হবে এই বলে তারা নিজেদেরই মধ্যে মস্করা করে ।আর এতেও যদি কাজ না হয় তবে সাঁঝের যা হয়েছিলো সেটা ওর ছোট দুই মেয়ের সাথেও হতে পারে । কলমি জ্বলে ওঠে এই প্রথম ।মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে বলে 'হারামির বাচ্ছারা' ।এরপর ফজিরাম কে সাথে নিয়ে থানায় যায় নালিশ জানাতে ।

ফজিরামই এসে জানালো সব ।বলল ছোট দারোগাবাবুও নাকি খুব হেনস্থা করেছে ।জিগ্গেস করেছে সতীশবাবু কি মা ও মেয়ে দুজনকেই........!এ পর্যন্ত বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ফজিরাম । আরও বলল কলমি নাকি লজ্জাতেই আসতে পারেনি ওর কাছে ।সে নাকি বলছে বারবার" আমার মেয়েটার চিকিৎসা করতে এসে এ কি বিপদে পড়তে হলো বাবুকে ফজি দাদা! "
এরপর  কুয়োতলিতে জল তুলতে তুলতেই ফজিরাম বলে,
---বাবু যে কোনোদিন হয়তো আপনার নামে ওয়ারেন্ট বেরোবে ।সতীশ ঘেন্নায় তেতো হয়ে যাওয়া মুখের থুথুটা ফেলে জিগ্গেস করে
 --কিসের ওয়ারেন্ট ?
----দারোগাবাবুর ইচ্ছাই ওয়ারেন্ট ।
---আচ্ছা
---আসলে ওরা আপনাকে এই দেশ ছাড়া করতে চায় বদনাম দিয়ে।
---আচ্ছা
---তবে তুমি চিন্তা করোনা বাবু, আমি গ্রামের লোকেদের জানিয়েছি
সবাই তো আর ওই জানোয়ার দের মতো নয় ।তোমাকে জবরদস্তি করলে আমরাও দেখে নেবো ।
সতীশ ঘেন্নার মধ্যেও ওই  অশিক্ষিত সরকারী উর্দিধারিদের বুদ্ধির বহরের কথা ভেবে হাসে  ।ফজিরামকে বলেনা কিছুই ।এই মানুষগুলোর কাছে ওর অনেক ঋণ । তাছাড়া শহুরে শিক্ষিত মানুষ যা করেনা এরা তাদের জীবন দিয়ে হলেও সেটা করে ।আত্মীয় শব্দটার প্রকৃত সত্ত্ববহনকারী হলো এরাই ।ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ।খানিক আগের তেতো ভাবটা কেটে গিয়ে ওর মনটা কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে ওদের প্রতি ।

পারমিতা চক্রবর্ত্তী

প্রাচীন যুগে রূপকথা 
_____________________


সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যুগে যুগে বদলাচ্ছে তা আমরা আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারি I আজকের দিনে সবাই যেখানে স্লিম ফিগার’-এর দিকে ঝুঁকছে, সেখানে অতীত হাতড়ালে আমরা দেখতে পাই চীনে ট্যাং বা তাং রাজবংশের শাসনকালে ব্যাপারটা ছিল ঠিক উল্টো। তখন স্থূলকায়, গোলগাল মুখ, লম্বা গাল এবং প্রশস্ত কপালের মেয়েদেরই সুন্দর বলে বিবেচনা করা হত। সুন্দর বা সুন্দরী কাকে বলব, মানে সৌন্দর্যের ভিত্তিটা কি ? বাহ্যিক সৌন্দর্য বলতে আমরা বুঝি ত্বক , চুল , দাঁত , নখ ইত্যাদি , ইত্যাদি ৷

চুল সৌন্দর্যের বড় একটি বিষয় ৷ মধ্যযুগের বিভিন্ন চিত্রকর্মে মহিলাদের যেসব ছবি আমরা দেখি, তার সঙ্গে আমাদের বর্তমান সমাজের মেয়েদের সাজসজ্জার বেশ বড় একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে তখনকার সময়ে নিজের কপালকে স্বাভাবিকের চেয়ে আরো বড় এবং কিছুটা বাঁকানো রূপে দেখানোই ছিল সৌন্দর্যের পরিচায়ক। সেজন্য তাদের অনেকেই সামনের দিকের কিছু চুল কাটা কিংবা তুলে ফেলার মতো কাজটি করত। পরবর্তীকালে চুলবাঁধাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নানা কলাকৌশল ৷ পুরানো এক প্রবাদবাক্য আছে মেয়েদের কেশেতেই বেশ । বিভিন্ন ধরণের খোপা তাতে ফুলের ব্যবহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে বারবার ৷


বড় নখ নারীদের প্রাচুর্যের প্রতীক ৷ নেইল আর্ট যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে ৷ এককালে চীনের লোকদের হাতের নখ বড় রাখার চল ছিল। কিং রাজবংশের সময়কালে তাদের নারী-পুরুষদের হাতের নখ কখনো কখনো ৮-১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা দেখা যেত। কোনো কোনো নারীকে নখ ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সোনার তৈরি নেইল-গার্ড ব্যবহার করতেও দেখা গিয়েছে। নখ বড় রাখার বিচিত্র এ চর্চা দেখা যেত মূলত ধনী সমাজের মাঝেই। তারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাতে নখের পরিচর্যা করত ৷ তারা এটা বোঝানোর চেষ্টা করত যে, এত টাকা-পয়সা তাদের আছে যে নিজ হাতে কাজ না করলেও দাস-দাসীদের দ্বারা দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন হবে ৷ দাস-দাসী দিয়েই জামা-কাপড় পরা ও খাওয়া-দাওয়ার কাজটা সেরে নিত তারা।

মধ্যযুগে এবং রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপের নারীদের সাজসজ্জা শুধু মাথার চুল তুলে কপাল বড় করার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। চোখের পাতার লোমকে তখন অতিরিক্ত যৌনাবেদনময়তার প্রতীক হিসেবে দেখা হত। তাই অনেক নারীই তাদের সেই লোমগুলো একেবারে তুলে ফেলতেন। এছাড়াও প্রাচীন গ্রিসে জোড়া লাগা ভ্রু ছিল নারীদের পবিত্রতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতীক। এটা না থাকলে অনেকেই চোখের সুরমা ব্যবহার করে সেই ঘাটতিটা পূরণ করত।

জাপানি নারীদের প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস একেবারেই ছিল না ৷ আমাদের মাঝে গড়ে ওঠে সেই ছোটবেলা থেকে দাঁতের সুরক্ষা রক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাঁতকে ঝকঝকে সাদা দেখানোও নিয়মিত এই ব্রাশ করার অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে জাপানি নারীদের মাঝে প্রচলিত সৌন্দর্য চেতনা ছিল এর ঠিক উল্টো। হাজার বছর ধরে জাপানি নারীরা তাদের দাঁতকে কালো রঙে রাঙিয়ে নিত। উনিশ শতক পর্যন্তও তাদের মাঝে এ চর্চা দেখা গেছে। সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বিয়ের অঙ্গীকার রক্ষার একটা প্রতীকী রূপও ছিল কালো দাঁত।

আবার প্রাচীন ধনী রোমান সম্প্রদায়, আরো ভালো করে বলতে গেলে ধনী রোমান নারীরা তাদের দাঁতকে ঝকঝকে সাদা করার জন্য বেছে নিয়েছিল মানবমূত্রকে। সেই মূত্র দিয়ে ধুয়েই দাঁত পরিষ্কারের কাজটি তারা করত। তবে যেনতেন মানুষের মূত্রের উপর ভরসা করতে পারত না তারা। দাঁত পরিষ্কারের জন্য তারা শুধুমাত্র পর্তুগিজদের মূত্রই ব্যবহার করত। এজন্য জাহাজ ভর্তি করে জার পূর্ণ পর্তুগিজ মূত্র আসত রোমান নারীদের জন্য। মূত্রে থাকা অ্যামোনিয়া জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করত। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্য যে, আঠারো শতক পর্যন্ত মাউথওয়াশ হিসেবে মূত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

আঠারো শতকে এসে ইউরোপীয় নারীদের সৌন্দর্য চর্চায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। আগেকার সময়ের হালকা সাজসজ্জার বদলে তখন তারা বেশ ভারি সাজসজ্জার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এরই একটা অংশ ছিল বিভিন্ন ধরনের বিউটি প্যাঁচ। চাঁদ, তারা, বর্গ, বৃত্ত ইত্যাদি নানা আকৃতির বিউটি প্যাঁচ পাওয়া যেত তখন। ছোট ছোট সেই ফেব্রিকগুলো মুখের বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হতো। আর একেক জায়গায় লাগানোর অর্থ ছিল একেক রকম। যেমন- যদি কোনো নারী এমন বিউটি প্যাঁচ তার ডান গালে পরত তবে তার অর্থ হত যে, সে বিবাহিতা।


প্রাচীনকালের চীনের রূপচর্চায় ঢু মারলে দেখা যাবে তৎকালীন নারীরা তাদের ভ্রুকে কালো, নীল কিংবা সবুজ গ্রিজ দিয়ে রাঙাতে খুব পছন্দ করত। সেই সঙ্গে তখনকার ফ্যাশন অনুযায়ী ভ্রুকে দিত নানা আকৃতি। হান রাজবংশের সময়ে কোনো দিক নির্দেশ করা ভ্রুর স্টাইল বেশ জনপ্রিয় ছিল। আবার এককালে দুঃখের ভ্রুনামক একপ্রকার স্টাইল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই স্টাইল অনুসারে কারো ভ্রুকে মাঝখানের জায়গায় বাঁকিয়ে কিছুটা উপরের দিকে তুলে দেওয়া হত।

প্রাচীনকালের নারীরা ভিন্ন উপায়ে নিজেদের রঙিন রাখার চেষ্টা করত ৷ তবে সর্বতোভাবে রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সজীব মন ৷ তার পরিচর্যাই হল রূপচর্চার আসল চাবিকাঠি ৷ রূপ নিয়ে পুরুষ কিংবা নারীর উন্মাদনা চিরকালই ছিল বেশী ৷ তাই সেই রূপকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই । 


--------------------

"সৃজন" নিবেদন 

পারমিতা চক্রবর্ত্তী

শাপলা সপর্যিতা


পর্ব
প্রথম গানের শিক্ষক। শ্রী স্বপন কুমার সরকার।মেঝো ভাইয়া উদীচীতে যায় গান করতে।সাথে আমারও উদীচীতে যাওয়া। সকাল সকাল ক্লাস। প্রতি শুক্রবার ক্লাস।আর তাই প্রতি ভোর বেলা দিনের শুরু আমার সারগামে। উদীচীর খুব প্রিয় দুজন শিক্ষক ছিলেন।একজন সোবহান স্যার। রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেন। আর অন্যজন স্বপন সরকার। তিনি আমাদের সারগাম করাতেন। কিন্তু মূলত ছিলেন গণসঙ্গীতের শিল্পী।নজরুল সঙ্গীতও করতেন।আর যতীন সরকার পড়াতেন কার্ল মার্কস, বস্তুবাদ, ডারউইনের তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম থেকেই আমার প্রথম পছন্দ রবীন্দ্র সংগীত। ধ্রুব পরিষদে ভর্তি হলাম রবীন্দ্র আর শাস্ত্রীয় সংগীতে। পরীক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্র যা হোক কোনোমতে উতরে যাব। কিন্তু শাস্ত্রীয়? ঘরে আনা হলো ওস্তাদ।মেঝোভাইয়ার পছন্দ মতো গানের ওস্তাদ আমার, শ্রী স্বপন সরকার।প্রথমদিনই মাথায় হাত রেখে বললেন কন্ঠটা ভালো তোমার। যত্ন করো। ঠিকঠাক রেওয়াজ করো। সরস্বতীর মন ভোলাতে হবে।ভালো করবে তুমি।তারপর - রোজ ভোরবেলা গলা সাধা একটা নিয়ম হয়ে গেল। ওটা হলো আমার জন্য একটা বিরক্তিকর কাজ। গান গাইতে ভালোলাগে কিন্তু প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই গলা সাধতে বসা। উফ। তার মাঝে আমি চাই আমার প্রাণের ঠাকুরের প্রিয় প্রিয় সব গানগুলো তুলতে তিনি আমাকে নজরুলের গানের বিষয়ে উৎসাহী করতে সবরকমের প্রচেষ্টায় নিবেদিত।তার বদৌলতে বেশ কিছু নজরুল সঙ্গীত আমার তোলা হয়ে গেল। নজরুলের সেই সব গান....মনে পড়ে সে কোনো বিদায় সন্ধ্যা বেলা, তুলসী তলায় যবে সন্ধ্যা বেলায়... এসব গানের কথা এখনো মনে পড়ে। ধীরে ধীরে আমার নজরুলের গানের প্রতি আগ্রহ জন্মালো। একসময় বেশ নজরুল সংগীত শুনতেও শুরু করলাম আগ্রহ করে।তখন খুব শুনতাম অনুপ জালোটা, অনুরাধা পাড়ডোয়াল, ফিরোজা বেগম। সপ্তাহে তিনদিন ওস্তাদের কাছে নিয়ম করে হারমোনিয়াম তবলায় সুর সাধা গান শেখা জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ালো। আর কোন উপায়ে আমার গানের প্রথম ওস্তাদকে বিতাড়িত করা আমার সম্ভব হলোনা।গান শেখালেন দীর্ঘদিন।গানের শিক্ষকের সাথে সম্পর্কটা এতটাই নিবিড় হয়ে পড়লো আমাদের পরিবারের সাথে যে তার বিয়ে বাবা হওয়া আর দুইবাড়ি আসা যাওয়াও চলতে থাকে বেশ। খুব সুন্দরী ছিল বৌদিও। ওস্তাদের ছেলে সন্তান দু তিন বছরে কি অদ্ভুত তবলা বাজাতো.......। আমাদের বাসায় এলে আমার বায়া তবলা দিয়ে সামনে বসিয়ে দিতেন স্যার। আর কি অসম্ভব সুন্দর বোলে বোলে তালে তালে হাত চালাতো সেই অবুঝ শিশু আজও মনে হলে মুগ্ধ হই।সময়ও গড়ালো অনেক। বছর বছর। যুগ যুগ।জানিনা আজ কোথায় তারা কেমন আছেন সবাই।একসময় আমি গাই না গাই একটা গানের যন্ত্র আর হারমোনিয়াম তবলা থাকতো আমার সাথে সাথে। কোথা থেকে কোথায় যাই জানিনা আজ বহুদিন হারমোনিয়াম তবলা গানের সুর ছাড়া আমি। দিনান্তে গান শুনবার অবসরটুকুও থাকেনা বেশিরভাগই। তবু জীবন চলছে ঠিকই। তবু কোনো এক বিষণ্ন দুপুরে কোথাও এক দারুণ দুঃসহ তৃষ্ণায় জেগে উঠি। ভেসে আসে রক্তে কাঁপন তোলা আমার স্যারের গণসঙ্গীতের সুর
নোঙ্গর তোলো তোলো/সময় যে হলো হলো/নোঙ্গর তোলো তোলো
সাথে ভেসে ওঠে দেবীর মুখ।হায় দেবী ওস্তাদের কথা রাখিনি আমি।সরস্বতীর মন ভুলাতে আমি পারিনি নাকি ভুলাইনি সেটা আজও এক বিষ্ময়.........(চলবে)




রিয়া চক্রবর্তী


কথা রাখার কথা ছিলো


কথা ছিলো ঝরে পড়া পাতাদের জড়ো করার
মতোই, ইচ্ছেদের  সাথে নিয়ে অসহ্য জীবন ঠেলে
উঠে দাঁড়াবো আরেকবার।
ভালোবাসার বন্ধ্যা জমিতে
দুজনে মিলে ফুল ফোটাবো।

কথা ছিলো দীর্ঘ শীতের রাত পার করে, 
আবার বসন্ত হেসে উঠবে,
আমাদের দুজনের ঠোঁটের ছোঁয়ায়।
চাঁদও হিংসে করবে আমাদের ভালোবাসা দেখে।

কথা ছিলো দূরে বহুদূরে, 
তারাদের সাথে নিয়ে, 
ইচ্ছে নদী দুকুল ছাপিয়ে বইবে।
 স্বপ্নেরা বেরিয়ে আসবে মৃত্যু উপত্যকা ছেড়ে। 
বিশ্বাসের পানসি বেয়ে তুমি আমি,
সীমাহীন  ভেসে বেড়াবো।

কথা ছিলো, কথা থাকে,
মানুষ বদলে যায়, মুখোশ পাল্টায়।
তারারাও থাকে, চাঁদও থাকে, নদীও থাকে,
থাকেনা শুধু বিশ্বাস ভালোবাসায়।
প্রেমের খেলায় স্বপ্নের পানসি 
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
শীত ঘুম শেষ করে 
বসন্ত জেগে ওঠে না।।



রাহুল গাঙ্গুলী





ঝরা স্পর্শের বৃত্তক পেরিয়ে
---------------------------------------------------------

(১ - স্কাইলাইট)
.........................................................
যে পথে যেতে চাই না
বারবার আগ্নেয়গিরি নিভে যায়
বিকেল ভেজা খাম     
কিছু এলোমেলো _____ কিছু গোছানো
পোড়া সলতের স্তন চিরে
লোহিত সময় ঝরে


(২ - ঈগল্ নখের আঁচড়)
.........................................................
ছিড়ে ফেললে অচেনা নেভিব্লু গাউন
সাদা পাতার পুরোটা জুড়ে গ্যালাক্সি
ছায়ারও গোপন গর্তে দেখে চতুর্দশীর চাঁদ
মুখোমুখি ঘন আঘাত
নাভি ও ঠোঁটের শালুক বিয়োগে


(৩ - ইলানকলি ফুলগুলোকে)
.........................................................
বুনো স্ফটিকে ঘামছে রাত
রাত খুঁড়লে রাত
খিড়কি আগলানো মাদক মরফিন
কেউ বোঝে নি শব্দরূপের কেচ্ছা
তালাবন্ধ সবুজের বিদ্যুৎ তামাটে প্রশ্ন ওঠায়
হিম-চুম্বকে পদ্মযতি গর্ভাশয়ের চাষ


(৪ - কৃষ্ণাভ বরফিলা)
..........................................................
এইমাত্র উড়ে গেলো বেলুন
উড়ছে ঋ-কথা
তোমার নাম পরিচয়
আমার লোভ
ছুয়ে যাচ্ছে অস্পৃশ্য পারদ
ওভারহেড তারে শূন্য প্রবাহ চলছেই


(৫ - লিথিয়াম বেলুনওয়ালা)
..............................................................
চিনতাম।তোমায়।তোমাকে।ঘুঙুরে ঘুণপোকা
ভালো হতো।না।চিনি না।কেন।মগজে বসছে আসর
আঙুর ফল টক্ বা চিরতা মিস্টি।৭সমুন্দরে
নেশা লাগছে।পাইটের বোতল।ভাঙলেই জন্ম
হোক সেসব সবিস্তৃত।মোহনার জ্যা ভাঙুক
মিথেন প্রশ্নরা মেঝে কাটে।হারাকিরি শুনেছি কেবল


(৬ - সিলিকনিক মেঘযতির স্যিলুউট)
...................................................................
বাটার্ টোস্ট।তুলাযন্ত্র।ঘনক বিসর্গ-র ঠিকুজি
মানতে পারো।দালির আত্মহনন্ শনি বলয়ে
মাল্টি অরবিট্।বলে ফেলছি।ঠাপ কেবল ঠাপ
নারকেল কোরক্ ক্রমশঃ কার্বন বহুসত্ত্বার বিকেল
ঘামছি।যেন ধূনুচীর গন্ধে কিছু স্যাঁতসেঁতে মাপ
জারজ্ বুলেট বাবা ডাকছে।সাড়া দেওয়া অসাড়
মা-কে বলেছি আঁতুড় সামলাও।বিসর্জিতা গুহামুখ


(৭ - নির্দিষ্ট পতনরেখার অধঃক্ষেপ)
................................................................
তোমাকে নিয়মরক্ষার ধর্ষনের সময়
যাযা দেখি।প্রস্টিটিউশনের শুদ্ধতায় একলব্য কাপে

যেমন : রাগ হলে ঘুড়ি।বা অভিমন্যুর প্ল্যানচেট

তুমি বলো রোজ দেখছো।সেলুনের চুল কাটা

আমার কতোটা সেভিং ক্রিম : তোমার সিম্ফনিতে

ধর্ষনেরও কিছু গিগা-খাম্বাজ গ্রাফ আছে

তুমি সাড়া দিলে।তবেই : জড় ও প্রাণের খোজে
চূড়ান্ত হত্যার প্যারাবোলা।অঙ্কে কেন 0। ফেল _____



যুগান্তর মিত্র


দৌড়
________



বিমল মাস্টার হুমকিই দিয়ে গেলো আসলে। আবার সন্ধ্যার পরে আসব জানিয়ে বলল, যা ঠিক করার এর মধ্যেই ঠিক কর, এসে যদি শুনি উল্টা কথা তাহলে আমারেও ভাবতে হবে কিছু। এই ভাবা মানে যে কি সেটা জানে না তাপস। তবে এটুকু বোঝে পারলে খুনটুনও করাতে পারে বিমল মাস্টার। কেননা মাস্টারের হাতে ক্ষমতা আর লোকলস্কর কম নেই।
দুপুরের খাওয়ার পর ভাতঘুম দেওয়া একটা অভ্যেস হয়ে গেছে তাপসের। আজ তাড়াতাড়িই খেলো মতির হোটেলে। এখানে মাসকাবারি খায়। তাপসকে ঢুকতে দেখেই মতি বলল, কী গো তপা মাস্টার, আজ এত সকাল সকাল কেন? দূরে কোনো অপারেশন আছে নাকি?
মুচকি হাসে তাপস। তারপর ধীরে ধীরে মতির দিকে এগিয়ে যায়। মতির সামনে কাঠের একটা বাক্স। এটাই ওর ক্যাশবাক্স। তার উপর কাগজ আর কলম। কলমটা আবার একটা সুতো দিয়ে বাঁধা আছে বাক্সের গায়ে। তাপস গিয়ে মতির পাশের টুলে বসে। এখনও তেমন লোকজন আসেনি। তবু প্রায় ফিসফিস করে বলে, না রে মতি। তোরে তো কইছিই আমি এইসব কাজ ছাড়লাম। আর করুম না।
~ তা কইছ ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস যায় না। শুনি একবার এই লাইনে ঢুকলে আর ছাড়া যায় না।
~ সে হয় কোনো দলে থাকলে। আমার তো দলবল নাই। আমি একাই। গত মাসখানেক কোনো কাজ করি নাই। তোরে তো সবই কই। আর কেউ জানে না আমার কামকাজের হদিশ।
~ জানে না কবা না মাস্টার, এইসব খবর হাওয়ায় উড়ে। অনেকেই হয়তো জানে, তয় স্বীকার করে না। আসলে তুমি হইলা গিয়া চালাকের চালাক। তোমারে ধরতে পারে নাই কেউ, তাই হলফ কইর‍্যা কইতে পারে না আর কি। আমি নেহায়েত দেইখ্যা ফেলছিলাম। তাই
~ সেই দেখার মূল্যও তো তুই পাইছস। পাস নাই ?
~ তা পাইছি। আমিও দেওয়া কতাখান রাখছি সেইটা কও?
তপা চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না। মতিই আবার কথা বলে, কামকাজ না করলি পয়সা পাও কই খাওনের? মতি আসলে বুঝে নিতে চায় মাসকাবারি বাকির টাকাটা সে ঠিকমতো পাবে কিনা।
~ টাকা জোগায় ভূতে। হা হা হা তুই কি ভাবস আমার পয়সা নাই? কিছু টাকা তো জমাইছি রে পাগলা।
~ তুমি ওস্তাদ যে সে মাল না। তোমার ঘটে বেজায় বুদ্ধি।
তপা এর কোনো জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, হিসাবটা করতে কইছিলাম। করছস?
~ না হয় নাই। এত তাড়া কিসের? এ তো দু'মিনিটের কাজ মাস্টার, ধরুম আর শ্যাষ।
~ কইর‍্যা ফেল। আজই মিটাইয়া দিমু।
~ কও কী? রাতে কি খাবা না ?
~ না না। বিকালেই চইল্যা যামু আমার সুমুন্দির বাড়ি। তোরে কইছিলাম কাইল। তর মনে নাই।
সাধারণত বেলা তিনটের আগে খায় না তাপস। আজ একেবারে একটার মধ্যে খেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। গায়ের আকাশি রঙের ফতুয়াটা খুলে দেওয়ালের গায়ে পোঁতা পেরেকে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঢ্যালঢ্যালে পায়জামা পরেই চৌকির উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। কিন্তু ঘুমাতে পারল না। লাইনে নতুন নামা বামনাকে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে যাবে ভেবে রেখেছে। ছেলেটা ওকে গুরু বলে মানে। বলেছে, গুরু কিছু জ্ঞান দাও মাইরি। একটু করেকম্মে খাই। তোমার পায়ের ধুলো মাথায় দাও ওস্তাদ।
তা কিছু জ্ঞান দিয়েছে বইকি ! কীভাবে নানা কিসিমের তালা খুলতে হয়, লকার ভাঙতে হয়, ধরা পড়লে কীভাবে চমকে দিয়ে পালাতে হয় সব শিখিয়ে দিয়েছে। এবার যন্ত্রপাতিগুলোও দিয়ে দেবে ওকে। কী আর হবে এসব নিয়ে তপা মাস্টারের?
তাপস ঠিক করেই নিয়েছে এই জীবন আর না। এবার সৎপথে বাঁচতে হবে। তাহেরপুরে থাকে পরিমল। সেও আগে পকেটমারি করত টুকটাক। ধরা পড়ে বেদম মার খেয়েছে একবার। থানার বড়বাবু ছিল ভালো মানুষ। দিন তিনেক লক-আপে রেখে তাকে ছেড়ে দেন। তার আগে কাগজে সইসাবুদ করিয়ে নিয়েছেন  আর কোনোদিন এই পথে যাবে না। শুধু কি তাই ? বড়বাবু কোথা থেকে বেশকিছু টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন ছোটোখাটো ব্যবসা করার জন্য। পরি কথা রেখেছে। এখন একটা চায়ের দোকান দিয়েছে স্টেশন বাজারে। অবশ্য বড়বাবুর উদ্যোগ ছিল এর পেছনে। সেই পরিকে দেখেই তপার সৎভাবে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছে।
পরি বাংলাদেশে কাপড়ের দোকানে চুরি করে পালিয়ে এসেছিল বর্ডার পেরিয়ে। নানা জায়গা ঘুরে এসে পড়ল মদনপুরে। সেখানে ছোটোখাটো চুরিটুরি করে চলত। সেই সূত্রেই আলাপ পরির সঙ্গে। তখন থেকেই দুজন দুজনকে সুমুন্দি হিসাবে পরিচয় দেয়। পরিমলকে তাপস পরি ডাকে। আর তাপস পরির ডাকে হয়ে গেলো তপা মাস্টার। তাপসের এই ডাকটা পছন্দ বলে কাউকে নিজের পরিচয় দেয় তপা মাস্টার বলেই। পরি শেষে ট্রেনে বা বাজারে পকেটমারিতে ঢুকে গেল। আর নিজের উদ্ভাবনীশক্তি দিয়ে দোকানের বন্ধ তালা খুলে টাকাপয়সা লুঠের দিক বেছে নিল তাপস। তবে যোগাযোগটা থেকেই গেল।
একদিন সুমুন্দিকে গিয়ে নিজের মনের কথা বলল তাপস। বুঝলি পরি, তোর তো দোকান ভালোই চলে দেখি। তা আমারেও একটা জায়গা দেখি দে দিনি। আমিও এট্টা ব্যবসা ফাঁদি।
~ কও কি মাস্টার ? তোমার ইনকাম কি কম নিকি? ব্যবসা করবার মন চায় ক্যান হঠাৎ?
~ না রে পরি। ছোট্টুটা মরি যাওনের পর থিকাই ভাবতাছি আর এ পথে যামু না।
~ কও কি? ছোট্টু মরি গেছে?
~ হ ভাই। মাইর‍্যা ফালাইছে পিটাইয়া।
~ অ্যাঁ ! কেডায় মারল?
তাপস সবিস্তারে জানায় ছোট্টুর গণপিটুনির কাহিনী। প্রথম প্রথম বাজারের দোকানের গেট বা সাটারের তালা কৌশলে ভেঙে তারপর যা টাকাপয়সা পেত সব লুঠ করত তাপস। ছোট্টু ছিল বাপ-মা খেদানো এক ছেলে। পথে পথে ঘুরে বেড়াত আর নানা দোকানের ফাইফরমাশ খাটত। ওকে দেখেই মাথায় খেলে গেল আইডিয়া। দোকানের টাকাপয়সার হদিশ দিতে পারবে ছেলেটা। একদিন পাকড়াও করে অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে লোভ দেখিয়ে নিজের দলে টেনে নিল তাপস। দল বলতে সে একাই। এসব ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। এক থেকে এবার দুজন হল। মাসখানেক আগে এক সোনার দোনাকে চুরি করতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। কীভাবে যেন টের পেয়ে গেলো কোনো অফিস বা এটিএমের সিকিউরিটি। সে ঘটনা আঁচ করেই চিৎকার করে উঠল আর বাঁশি বাজাল। বাঁশির শব্দে আশেপাশের কিছু লোকজন ছুটে এলো। সিকিউরিটি তাপসকে জাপটে ধরে ফেলেছিল। তাপস তাড়াতাড়ি জামার বোতাম পটাপট খুলে প্যান্টের পকেট থেকে ধুলো মুঠোয় নিয়ে ছুঁড়ে মারল সিকিউরিটির চোখে। তারপর জোর ঝটকায় ছিটকে পড়ল মাটিতে। উঠেই দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সিকিউরিটির হাতে থেকে গেলো তার জামা। ওদিকে তালা ভেঙে ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল ছোট্টু।সে বাইরের এত কাণ্ড বোধহয় টেরই পায়নি। দৌড়তে দৌড়তে হইহই চিৎকারে বুঝে গেল ছোট্টু ধরা পড়ে গেছে।
পরদিন একটু বেলায় ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে, মুখে দাঁড়িগোঁফ লাগিয়ে এলাকায় এসে ছোট্টুর অবস্থা বুঝতে চেয়েছিল। শুনল মারের চোটে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। তারপর পুলিশ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় ছেলেটা। নিজের উপরই খুব রাগ হল তাপসের। যাকে জোর করে টেনে আনল এই পথে, তাকে বাঁচাতে পারল না! এই ঘটনার পর আর-একবার অবশ্য একটা বড় মুদি দোকানের তালা ভেঙেছিলে তাপস। সেটা ছিল বড়সড় অপারেশন।  কিন্তু সেটাই শেষ। আর ও পথ মাড়ায়নি।
এইরকমই এক মধ্যরাতে দোকান লুঠ করে পালানোর সময় দেখে ফেলে মতি। তারই ছোট্ট হোটেলের কাছের দোকান ছিল সেটা। এই প্রথম নিজের এলাকার দোকানের সাটারের তালা ভেঙেছিল তপা। মতিকে সে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। মতিও কথা রেখেছে। কোনোদিন মুখ খোলেনি কোথাও। মতির গল্প পরি আগেও শুনেছে।
সব শুনে আফসোস করল পরি। তারপর নানা কথার ফাঁকে জানাল স্টেশনের পাশেই একটা জায়গা ঠিক করে দিতে পারে সে। তবে অনেক টাকা দিতি হবে পার্টি অফিসে।
~ কত টাকা?
~ তা পেরায় ধরো হাজার কুড়ি টাকা।
~ সে দেওয়া যাবে'খন। তুই কথা ক' ইউনিয়ানের লগে।
~ পাট্টির লগে কালই কতা কয়ে নেবো। তাপ্পর ধরো গিয়া দোকান দিতি হবে। জিনিসপত্র কিনতি হবে। ম্যালা টাকার মামলা। এত টাকা তুমি পাবা কোতায়?
~ সে সব ব্যবস্থা হইব রে পাগলা। ঠাকুরের ইচ্ছায় কিছু টাকা জমাইতে পারছি। তুই জায়গাটা দেখ।
পরি জায়গা দেখল। ঘুগনি পাউরুটি ডিম সেদ্ধর দোকান করতে যা যা লাগে তারও ব্যবস্থা করল। একজন সাহায্যকারীও ঠিক করে দিল। সব পাকাপাকিও হয়ে গেলো একদম। এমনকি আপাতত তার বাড়ির বারান্দা ঘিরে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিল পরি। ঠিক হল মাস দুয়েকের মধ্যে দোকান চালু হলে অন্য জায়গায় ভাড়াতে যাবে তপা। পরির পোয়াতি বউ। ক'মাস পরে নতুন একজন আসবে সংসারে। বারান্দাটা তার লাগবে।
আগামীকাল থেকেই সেই দোকান খুলতে চায় তাপস। তাই আজই তার মতির দোকানে শেষ খাওয়া। এর মধ্যে দু-তিনদিন ঘুরেও এসেছে তপা। আজ বিকেলে তাহেরপুরে পাকাপাকি চলে যাবে সে। দোকানের রঙ করা হয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। ডিম, পাউরুটি সব জোগাড় করে রেখেছে পরি। ঘুগনিটা রান্না করতে হবে ভোরে। মটর ভেজাতে হবে। দোকানে একটু পুজো দিতে হবে। অন্যান্য দিকও দেখে নিতে হবে।
চৌকির তলা থেকে একটা চামড়ার বাক্স টেনে বের করল তপা মাস্টার। হাত দিয়ে উপরের ময়লা মুছে খুলল বাক্সটা। কয়েকটা বিভিন্ন মাপের পেরেক, দুটো স্ক্রু ডাইভার, সরু মোটা তার, ভাঙা ব্লেড, স্টিলের একটা ছোটো হাতুড়ি, আর-একটা কাঠের হাতল লাগানো বড় হাতুড়ি, টুকরো দড়ি, কামারশালা থেকে বানানো লোহার বাঁকানো পাত ইত্যাদি নানা যন্ত্রপাতিতে একটা একটা করে পরম মমতায় হাত বোলায় তপা। এমন সময় বাইরে থেকে কার জোরালো গলা ভেসে আসে।
~ তপা মাস্টার আছো নাকি ?
তাড়াতাড়ি বাক্সটা বন্ধ করে আবার চৌকির নীচে চালান করে দেয়। তার ঘরে আসার মতো লোক তো কেউ নেই ! এক মতি আসে। তাও কালেভদ্রে। কখনো খুব ইচ্ছে করলে বাংলার বোতল কিনে আনে। সেইসময় মতিকে বলে আসে রুটি তরকা বা মাংস পাঠিয়ে দিতে। এছাড়া তো কেউ আসে না এখানে ! চুপ করে বোঝার চেষ্টা করে কে এলো। একটু আগেই মতি বলছিল কেউ কেউ নাকি জানে তার কাজের কথা। সত্যি হতেও পারে। পুলিশের লোক নয়তো? ভাবতে ভাবতেই আবার ডাক, কই হে তপা? সাড়া দিস না ক্যান?
ঘাড় বাড়িয়ে দেখে বিমল মাস্টার। পঞ্চায়েতের মেম্বার আবার এলাকার প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার। তাই সবাই তাকে বিমল মাস্টার নামে ডাকে। তা সে এই দুপুরবেলা এসে হাজির কেন? বিপদের আঁচ পায় তপা। চোখ সরু করে দেখে। এর মধ্যেই বিমল ঘরে ঢুকে পড়ে।
~ একটা জরুরি দরকারে এলাম বুঝলি। তোকেই আমার খুব দরকার।
~ আমারে দরকার আপনার ? কী ব্যাপার বলেন তো মাস্টারবাবু?
বিমল যে দরকারের কথা বলে তাতে মাথাটা ঘুরে যায় এতদিন এই লাইনে থাকা তপারও। বিমল প্রাইমারি স্কুল কমিটির সেক্রেটারি। একটু আগে ব্যাঙ্ক থেকে সরকারি অনুদান হিসাবে দু লাখ টাকা তুলে এনেছে হেড মাস্টার। তাকে আর কমিটির প্রেসিডেন্টকে সাক্ষী রেখে  টাকাটা আলমারির লকারে রেখেছে। স্কুলের নতুন বিল্ডিং হচ্ছে। কালই বিল্ডার্সকে কিছু টাকা দেবার কথা। আর বাকি টাকা স্কুলের আলাদা ফান্ডে রাখা হবে। সে নাকি অন্য এক ব্যাঙ্ক। তা তপাকে আজ রাতেই আলমারি ভেঙে সেই টাকা লুঠ করে এনে দিতে হবে বিমলের হাতে। বিনিময়ে সে পাবে কুড়ি হাজার টাকা।
~ কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কাছে ক্যান মাস্টারবাবু?
~ তুই পারবি বলেই। আমি সব জানি রে তপা। মতির থেকে পাক্কা খবর নিয়েই এসেছি।
শুনে থমকে যায় তপা। তার মানে কেউ কেউ জানে বলে মতি যে ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা ঠিক। ও কথা রাখেনি। অনেককেই হয়তো জানিয়েছে। মনে মনে মতিকে হারামজাদা বলে স্পষ্ট করে জানায়, আমি এইসব কাজ ছাড়ছি চিরকালের জইন্য। আপনে অন্য কাউরে ধরেন মাস্টার।
~ আচ্ছা ! খুব তেল বেড়েছে দেখছি। তোর খবর থানায় জানালে কী হবে জানিস? আমারে চিনিস নাই তপা। আমি হলাম বিমল মাস্টার। সবাই আমারে ডরায়।
ঝপ করে বিমল মাস্টারের পায়ে পড়ে তপা। আমারে বাঁচান মাস্টারবাবু। আমি সত্যি কইর‍্যা কইতাছিএই কাজ ছাড়ছি। আমি অখন ভালো কাম কইর‍্যা বাঁচতে চাই।
বিমল কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। বলে দিয়েছে সন্ধ্যার পরে আবার আসবে। তপা সব দিকই চিন্তা করে দেখেছে। একবার ভেবেছিল কাজটা করে দিলে খারাপ হয় না। কুড়ি হাজার টাকা কম না ! টাকাটা পেলে ব্যবসাটা আরও ভালোভাবে করতে পারবে। তাছাড়া পরি তার জন্য এত করল, ওর জন্য একটা জামাপ্যান্টের পিস, ওর বউয়ের জন্য ভালো শাড়িও কিনতে পারবে।
চৌকিতে শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে অবশেষে ঠিক করে, নাহ্‍ একবার যখন করবে না ঠিক করেছে, আর করবেই না এই কাজ। একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ভেসে বেড়ায় তার চোখে। একটা ঘর, বউ, সংসার তার সেই স্বপ্নে হানা দেয় বারবার। কিন্তু বিমল মাস্টারের হাত থেকে আপাতত বাঁচতে হবে।
চৌকির নীচ থেকে বাক্সটা আবার বের করে। তারপর ঝোলানো ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে বাক্সটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তালাট দুটো কড়া একসাথে করে ঝুলিয়ে দেয়। চাবি ঝোলে তালার সঙ্গেই। দিনের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এবার পালাতেই হবে।
পিছু ফিরে একবার তার এতদিনের আস্তানা দেখে নেয়। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে পলাশডাঙার দিকে। কিছুটা যাওয়ার পর ধু ধু মাঠ পায়। সেই মাঠ ধরে দৌড় শুরু করে। অন্ধকারে বারবার হোঁচট খায়। উঠে আবার দৌড়োয়। কতক্ষণ এই দৌড় চলে সে নিজেই জানে না। একটা বড় রাস্তা পার করে দেখে রেললাইন। তার পাশ বরাবর জলাজঙ্গল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা স্টেশন দেখতে পায়। স্টেশনের নামটা আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার জানতেই ইচ্ছে করে না কোন স্টেশন। বাক্সটা মাথায় দিয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চে শুয়ে পড়ে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল দৌড়ে দৌড়ে। তাড়াতাড়ি ঘুমও এসে পড়ে।
"তপা, আজ রাতেই কাজটা করা চাই। কুড়ি হাজার টাকা নগদ ।" বিমল মাস্টারের গলা শুনে ধড়ফড় করে উঠে দেখে কেউ কোত্থাও নেই। দুঃস্বপ্ন দেখেছে। বাক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। স্টেশনের নামটা ভালো করে দেখে। এটা হল্ট স্টেশন। অনেক দূরে চলে এসেছে সে। কিন্তু বিমল মাস্টারকে বিশ্বাস নেই। যদি ধরা পড়ে যায়। অন্ধকার চিরে আবার দৌড় শুরু করে তপা মাস্টার। আর কতক্ষণ দৌড়োলে সে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছবে নিজেও জানে না। দৌড় চলতেই থাকে 

মানস চক্রবর্ত্তী


ত্রাণ 
 আগষ্ট এলেই তুমি তুচ্ছ কোরে দাও 
আর এলিনা ঘাগরা ছুঁড়ে দেয় 
মেঘ তখন ঝাউবন ছেড়ে ঘাটালে 
তুচ্ছগুলো ফেরৎ নিতে গিয়ে 
তুমি দ্যাখো একবুক জলে এলিনাকে
তোমার হাতে তখন 
দেওয়ার মতো বলতে নিজের পড়নের শাড়ি

ঘাটাল এখন তোমাকেই খুঁজছে


পবন বর্মন



আমার ঘর
         
বাতাস ভাঙতে ভাঙতে পথ মাপছি
বাতাসের ছেঁকা খেয়ে
শীরটা নিমিষেই
  স্বপ্ন সাজাচ্ছে
উলঙ্গ মাঠ পড়ে আছে ক্ষেতজুড়ে
সভ্যতার ভিড়ে চিন্তারা
খুব মিলে যায় পাখিদের আযানে
দৃশ্যের চোখে ভাসছে আমগাছ
গাছ দেখে আলগে পড়ছে দৌড়
খানিকটা ছায়ার কলপ ধরা যাক
মাথায় উত্তপ্ত সূর্য , বাতাসে কল
শরীর থেকে ঘাম এনে দিচ্ছে
ঘাম গুলো সুগন্ধের মতো হাসছে
এই তো কালো ধোঁয়ার দাঁত
তারপর লালদিঘি
লালদিঘির উপর আমার ঘর