রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

             





 গরমবাহার কুড়িতমপর্ব



গুড়জ্বাল আর তিলের নাড়ু মুড়ির মোয়া


আজ খুব শীত, উত্তুরে হাওয়ার গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে।  মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা যখন এরকম অঘ্রানের রাতে আমার আম্মা একটা শাল মুড়ি দিয়ে বিছানায় বসে মহাভারত মুখস্থ করতে করতে তন্দ্রাঘোরে ,মা সেসময়  উনুনে কাঠ ঢুকিয়ে তিল ভাজত কাঠখোলায়, ফটফট করে শব্দ হত,সুন্দর হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত ঘরময়, মা জ্বাল দিত আখের গুড় তারপর সেই গুড়ে চিট এলে একতার দুইতার মেপে অর্ধেকটা মুড়ির পাক আর বাকি অর্ধেকে সাদাতিল।এরপর দু'টো পাত্র আর সর্ষেরতেলের শিশি বিছানায় রেখে দিয়ে  আম্মাকে বলত,"ওকেই পুরোটা খাইয়ে দেবেন না মা, কিছুটা টুলুর বাড়ি পাঠাব"। 




আম্মা মোয়া আর নাড়ু গড়ে নিয়ে আমার দু'হাত ভরে চারটে দিয়ে বলত,"লুকাইয়া ফ্যাল"। কাঁথার নীচে আমার পাদু’টো গরম করার জন্য শীতের এই সন্ধেগুলোতে আমার আম্মাই রসুনসর্ষেরতেল ফুটিয়ে গরম গরম মাখিয়ে দিত পায়ে হাতে পিঠে বুকে। ঠান্ডা লাগার ধাঁচ বলে যত্ন করতে করতে বলতো," ক্যাডায় কয় রূপসীরে লইয়া যাইব একদিন, আমি দিমুনা যাইতে"।আজ আম্মা নেই। আমার যত্ন উধাও হয়ে গেছে অ্যালোভেরা জেল আর সানস্ক্রিনের মোড়কে। কিন্তু কেন জানি না  গুড়জ্বালটা সুইগিজোমাটোতে আজও অর্ডার করতে পারি না। তারাদের দেশ থেকে আমার  মা আর আম্মা মোয়া - নাড়ু হয়ে ফুটে থাকে রাতের নক্ষত্রে...



মীনাক্ষী ঘোষ

                            


কোল্হাপুর ডায়েরী ৫


রাতে নিজের বাংলোয় সকলকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়ির সামনে ড্রপ করে বৌদি বিদায় নিলেন।
মন্দিরের কাছাকাছি জায়গাটা দিয়ে যাবার সময়  মিমি  কোল্হাপুর শহরের পুরনো রূপটা যেন দেখতে পেল। মিমিদের ফ্ল্যাট যেখানে সেটা কোল্হাপুরের পশ এরিয়া। সেখানে কসমোপলিটান ভাবটাই বেশী। কিন্তু মহাদ্বার রোডের এদিকটায়  এলে কোল্হাপুরের আসল চেহারাটা প্রতিভাত হয়।পুরনো শহরের মতোই সরু সরু পথঘাট। পুরনো কেল্লার ভগ্নাবশেষ কেল্লার তোরণের মতো প্রবেশ ফটক মারাঠা ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।আর কোল্হাপুরকে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে পঞ্চগঙ্গা নদী।
এই মহাদ্বার রোডেই বিখ্যাত চপ্পল গলি। ভারত বিখ্যাত কোলাপুরী চপ্পলের উৎপত্তিস্থল।   কোল্হাপুরি চপ্পল (ইংরেজি: Kolhapuri chappal) হল ভারতের মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে প্রচলিত ও পরম্পরাগত হস্তশিল্পজাত একপ্রকার চামড়ার জুতো। স্থানীয়ভাবে উদ্ভিজ্জ বা প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে এই জুতোর চামড়া পাকা করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে কোলহাপুরি চপ্পল পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্ক নিয়ন্ত্রক জেনারেলের কাছ থেকে ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ইতিহাস প্রাচীন এই শহরটার মূল সুরটি যেন ক্রমশ একটু একটু করে ধরা দিচ্ছে মিমির কাছে।
কোল্হাপুরে  মারাঠা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বেশী। মারাঠা হলো মূলত ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। স্বয়ং শিবাজী মহারাজ ছিলেন মারাঠা কুলতিলক। ক্ষত্রিয়রা স্বভাবত
যুদ্ধপরায়ণ।কোল্হাপুরে এখনো মারাঠা গৃহে তলোয়ার দেখা যায়। এরা এমনিতে খুব নির্ঝঞ্ঝাট ও নির্বিবাদী। অকারণ কলহে এরা  পটু নয়। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে ওরা তলোয়ার বের করতে দ্বিধা করেনা।
দু'বছর পুণে থাকার সুবাদে মিমি  মারাঠি ভাষাটা একটু একটু বুঝতে পারে। কোল্হাপুরে মারাঠি বলার ধরণটা
একটু ভিন্ন। একটু গ্রাম্য টান থাকলেও আন্তরিকতার ভাবটা সুস্পষ্ট।
আজ সূর্য একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে অফিস থেকে। আজ প্রথম দিন। জয়েনিংয়ের যাবতীয় ফর্মালিটিজ মিটিয়ে অন্যান্য কলিগদের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে রওনা
হ য়ে পড়েছে। আজ অফিসেই সবার সাথে লাঞ্চ সেরেছে। আগামীকাল থেকে আশীষ এসে লাঞ্চ বক্স নিয়ে যাবে।
সূর্যর কাছে দারুণ একটা মজার কথা  শুনলো মিমি। সূর্যর প্ল্যান্টটা কাগাল পরগণায়। বাড়ি থেকে সড়কপথে দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটার।  মহারাষ্ট্রের শেষ সীমানা ওইটাই। সূর্য যেহেতু প্ল্যান্ট হেড, প্রোডাকশন ও মেইনটেনান্সের দায়িত্বভার ওর ওপরেই। ওর কেবিনটাও তাই শপ ফ্লোরের ভেতরেই। লাঞ্চের পরে কেবিন সংলগ্ন ওয়াশরুমে যেতেই মোবাইলে টিংটং করে মেসেজ বেজে উঠলো। ' ওয়েলকাম টু কর্নাটক'।বাহ  এতো ভারী মজার ব্যাপার। কেবিন মহারাষ্ট্রে আর ওয়াশরুম কর্নাটকে!এ যেন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বর্গচ্ছেদ। যদিও এখানে কাঁটাতার অদৃশ্য তবু এই ভাগাভাগিতে বেশ মজাই লাগলো।
সন্ধ্যার একটু পরেই মিমি সপরিবারে রওনা দিলো মিঃ বোসের বাড়ীর উদ্দেশে।
ক্রমশঃ


ছবিঃ কোলাপুরী চপ্পল
 

সুবীর সরকার

                             


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৬.
গঙ্গাধর আর গদাধর নদীর পারে পারে কত কত হাট।বড় হাট মাঝারি হাট জৌলুস হারানো কিংবা জাকজমকের হাট।এই সব হাট ঘিরে ভূমিলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকা।মানুষের জীবন ঘিরে এত এত হাটের কুহক।
সে আলমগঞ্জের হাট বলো, প্রতাপগঞ্জের হাট হোক,পাগলাহাট বা কাছারিহাট যাই হোক না কেন;
সব হাট ছাপিয়ে ভেসে উঠতে থাকে গৌরীপুরের হাট।গোলকগঞ্জের হাট।এই আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই একবার হলেও ঢুকে পড়ে গৌরীপুর আর 
গোলকগঞ্জের হাটের কেন্দ্রে।
আমরা দেখে ফেলি গৌরীপুরের হাটে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরিদের।তাদের মুখের লালায় জিভের শরীরে লেগে থাকে গৌরীপুরের খিলি পান।গোলকগঞ্জের মজা গুয়া।হাটের প্রান্তে প্রান্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তাদের গান_
"নদীত ফোটে 
নদীয়া হোলা"

২৭.
"একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না"

মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে।কিন্তু তখন
নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না।কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে।তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে।তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি।আর ভাঙা জলের সোতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে।
এভাবেই জীবনের পর জীবন বাঁচে এই সব হাটপরিধী জুড়ে জুড়ে।আখ্যানের পর আখ্যানের পরিসরে তীব্র এক গঞ্জহাটের কোরাস!

(সমাপ্ত)

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

                           


গরম বাহার। ঊনিশতম পর্ব।আজ নিম্নচাপ, শীত জমিয়ে পড়ার আগে এটা একটা ট্রেলার বলা যায়, এই মরসুমে টুকটাক আন্দোলন তো হয়েই যেতে পারে, তেল কড়াই ধনেপাতা লংকা ফুলকপি বাঁধাকপি... উঁহু আর কী চাই।


"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা"...সুপর্ণা এল কম্বলের তলায় পা ঢুকিয়ে বসল। নরম ঠান্ডা দু'গাল বেয়ে তখন বৃষ্টি।  জমিয়ে শীত। কি রান্না করব ভাবতে ভাবতেই... 


আজ যাকে পকোড়া বলে,আমরা সেকেলে বাঙালিরা একেই আবদার করে বড়া বলি। আজ রইল গরমাগরম ফুলকপির বড়া আর বাঁধাকপির বড়া



মীনাক্ষী ঘোষ

           



কোল্হাপুর ডায়েরী ৪

অ‍্যাপার্টমেন্টের নীচেই একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্তোঁরা আছে সেখান থেকে লাঞ্চের অ‍্যারেঞ্জমেন্ট হোলো।
আগামিকাল সূর্যের জয়েনিং ডেট।
বিকেল চারটে বাজে। দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানের কারণে সূর্যাস্ত হয় দেরীতে। লাঞ্চের পরে সবাই যখন নিজের নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছে মিমি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো লিভিংরুম লাগোয়া বর্গাকৃতি ছোট্ট খোলা ছাদটার রেলিং ঘেঁষে। এখানে সবাই এই ধরণের সংলগ্ন খোলা ছাদকে টেরেস বলে।  ব্যালকনিকে
বলে গ্যালারি।
তিনতলার টেরেস থেকে নীচে ব্যস্ত সড়কের ছবি প্রতীয়মান। মিমি তার দৃষ্টি ভাসিয়ে দিলো সুদূরে। দূরে চক্রাকারে বেষ্টিত পাহাড়ের  অস্পষ্ট রেখা দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। আপাতশান্ত কোলাহলবিহীন এই শহরটির প্রতি এক অজানা ভালবাসা বুকের ভেতর জারিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে।
সম্বিৎ ফিরলো কলিংবেলের আওয়াজে। এইসময় আবার কে এলো? দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ও পাশে স্মিতহাস্যে মধ্যবয়সিনী  ভদ্রমহিলা। চকিতে মিমির মনে পড়লো সূর্য বলেছিলো বটে ওর নতূন অফিসের বস কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর মিঃ বোস আসতে পারেন।  ওর মাথা থেকে কথাটা একেবারেই বেরিয়ে গেছিলো।ইশশ ছি ছি। ওর অপ্রস্তূত মখ দেখে ভদ্রলোক হাতযোড় করে নিজের পরিচয় দিলেন। কোনরকমে অপ্রস্তুত ভাব সরিয়ে মিমি ওঁদের ভেতরে আসতে অনুরোধ জানালো। এই কোম্পানিতে সূর্য ছাড়া উনি আর একমাত্র বাঙালি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই অপরিচয়ের দূরত্ব কমে অন্তঙ্গতার সুরটি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠলো। মিসেস বোস ক্রমশ হয়ে উঠলেন মিমির কাছে 'বৌদি'। স্নেহশীলা এই মানুষটি মিমিকে প্রথম থেকেই  নিজের ছোট বোনের মতো করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মিমিও তাকে নিজের বড়দিদি  ভেবেই ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো ধীরে ধীরে।
নানান আলাপচারিতায় মিমি জানতে পারলো কোল্হাপুরের মহালক্ষ্মীদেবীর মন্দিরের কথা।মিমির উৎসূক মন জানতে পারলো আরো অজানা কিছু তথ্য।করবীর তালুকার অন্তর্ভুক্ত কোল্হাপুরকে করবীর তীর্থ ও বলা হয়।
বৌদি প্রস্তাব দিলেন পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে এগেলে উনি মিমিকে নিয়ে মহালক্ষ্মী মন্দির দর্শন করাতে যাবেন। নতুন জায়গায় মাতা অম্বাবাঈয়ের কাছে পুজো দিয়ে শুভারম্ভ করা ভালো।
পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে গেলে মিমি স্নান করে
রেডি হয়ে রইলো। ছেলেমেয়ের ব্রেকফাষ্ট  টেবিলে ঢাকা দিয়ে বৌদি আসা মাত্র  বেরিয়ে পড়লো দেবী সন্দর্শনে।। বাড়ি থেকে খুব বেশী দূর নয় মন্দির। বৌদির সাথে গাড়ী ছিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল মন্দিরের কাছে। মন্দিরের প্রবেশপথ মোট চারটি। পশ্চিমদিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে মিমি আর বৌদি প্রবেশ করলো মন্দিরে।
মিমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলো মন্দিরের কারুকাজ।
পঞ্চগঙ্গা নদীটি কোল্হাপুরকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।আর এর তীরেই রয়েছে বিখ্যাত দেবী মহালক্ষ্মীর মন্দির।প্রায় ছয়হাজার বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কালো গ্রানাইট পাথরে গুহার আদলে নির্মিত। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধনে এই মন্দিরটির শৈল্পিক গুরুত্ব ও অপরিসীম।
মূল মন্দিরটির শীর্ষদেশে পাঁচটি চূড়া। চূড়াগুলিতে যথাক্রমে পাঁচটি বড় ও ছোট সোনার কলস স্থাপিত।। এত সকালেও দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাগম যথেষ্ট।
,  হরি পুরাণের  কাহিনী অনুসারে তপস্বী ভৃগু বৈকুন্ঠে পদার্পণ করে কলহবশত বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করলে বিষ্ণুপত্নী কুপিতা হন। বিষ্ণুবক্ষেই যে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান!স্বামীর অপমানে ক্রোধান্বিতা দেবী এত অপমানের পরেও শ্রী বিষ্ণুকে প্রসন্ন ও সহাস্য বদনে মহর্ষি ভৃগুর প্রতি ক্ষমার্হ নয়নে দৃষ্টিপাত করতে দেখে  বিষ্ণুধাম পরিত্যাগ করে মর্ত্যে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।মর্ত্যে দেবী যে স্থানটিকে নির্বাচন করেন সেটি হোলো এই কোল্হাপুর। স্বয়ং বিষ্ণু ও দেবীর সাথে বৈকুণ্ঠ  পরিত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রে বসবাসের সূচনা করেন।দেবীর অগণিত ভক্তের আকুল আবেদনে মাতা চিরকালের মতো এখানেই আপন অধিষ্ঠান স্থাপনা করেন।তদবধি তিনি সমস্ত রকম দৈব রোষ থেকে এই স্থানের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে পূজিতা। এমনকি প্রলয়কালে যখন সমগ্র ধরিত্রী জলরাশিতে নিমজ্জিত তখনো শ্রী বিষ্ণু ও মাতা লক্ষ্মী ভক্তদের পরিত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ গমনের ইচ্ছা পরিহার করেন। কোল্হাপুরে তাই বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর চিরকালীন অধিষ্ঠান। লোকশ্রুতি, কোল্হাপুরে কেউ কখনো অন্নাভাবে অভুক্ত থাকেনা।
অন্য মতানুসারে দেবাদিদেব মহাদেবের বরে অপ্রতিরোধ্য কোলাসুরকে দেবী যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করতে উদ্যত হলে অসুর মিনতি করেন তার মৃত্যুর পর এই স্থানটিকে যেন তাঁর নাম অনুসারে নামাঙ্কিত করা হয়।
তার নামানুসারে স্থানটির নাম হয় কোল্হাপুর।
দেবীকে মাতা ভবানী  উমা বা পার্বতী পক্ষান্তরে অম্বা মাতা রূপে পূজা করা হয়।
এই মন্দিরটি সপ্তম শতাব্দীতে চালুক্যবংশীয় রাজা কর্ণদেব নির্মাণ করান। সামনে দক্ষিণভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে  একটি বৃহৎ দীপাধার। গুহার আদলে তৈরী মন্দিরটির প্রবেশাভিমুখে বাঁদিকে দেবীর চরণ চিহ্ণ যা শ্রীযন্ত্র নামে খ্যাত সেখানে প্রণাম করে মূল মূর্তির অভিমুখে যাত্রা। প্রবেশপথটি অত্যন্ত অপরিসর। সিংহদরজা পেরিয়ে মাতৃসন্দর্শনের স্থানটি অপেক্ষাকৃত পরিসরযুক্ত।
কালো পাথরে তৈরী মাতৃমূর্তিটি নাতিবৃহৎ। দৈর্ঘ্যে তিনফুট। নানানরকম দুর্মূল্য রত্নালঙ্কার ভূষিতা মূর্তির ওজন চল্লিশ কিলোগ্রাম।মূর্তির পিছনে  কালো পাথরে রচিত সিংহমূর্তি দেবীর বাহন। মূর্তির মস্তকোপরিভাগে শেষনাগ ছত্ররূপে বিরাজমান।
মাতৃমূর্তি চতুর্ভূজা।  দেবীর নিম্ন দক্ষিণহস্তে একটি ফল- মতুলিঙ্গ।দক্ষিণ উপরিভাগে একটি বৃহদাকার গর্ধভের মস্তক ভূমি নিবদ্ধ দৃষ্টি।বাম উপরিহস্তে একটি বর্ম ধৃত এটিকে খেতক বলা হ য়। ও বাম নিম্নহস্তে একটি পানপাত্র। দেবীমূর্তি পশ্চিমমুখী। বৎসরের তিনদিন পশ্চিম দেয়ালের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে অস্তগামী সূর্যের  বিদায়রশ্মি দেবীর মুখে  আলো প্রদান করে দেবীকে প্রনিপাত জানায়।
মুগ্ধ হয়ে মিমি মন্দিরের অনুপম ভাস্কর্য দেখছিলো। এই পাথরের গায়ে গায়ে কত অজানা কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তার কথা আর কে বলবে! নির্বাক অথচ বাঙ্ময় যেন প্রতিটি গাত্র শৈলী।
শুধু দেবীমূর্তি নয় এই অদেখা ভাস্করদের  অনুপম কারুনৈপুণ্যের প্রতি প্রণাম জানিয়ে মিমি মন্দির থেকে বেরিয়ে এল।
ক্রমশঃ

 

সুবীর সরকার

                 


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৬.
গঙ্গাধর আর গদাধর নদীর পারে পারে কত কত হাট।বড় হাট মাঝারি হাট জৌলুস হারানো কিংবা জাকজমকের হাট।এই সব হাট ঘিরে ভূমিলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকা।মানুষের জীবন ঘিরে এত এত হাটের কুহক।
সে আলমগঞ্জের হাট বলো, প্রতাপগঞ্জের হাট হোক,পাগলাহাট বা কাছারিহাট যাই হোক না কেন;
সব হাট ছাপিয়ে ভেসে উঠতে থাকে গৌরীপুরের হাট।গোলকগঞ্জের হাট।এই আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই একবার হলেও ঢুকে পড়ে গৌরীপুর আর 
গোলকগঞ্জের হাটের কেন্দ্রে।
আমরা দেখে ফেলি গৌরীপুরের হাটে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরিদের।তাদের মুখের লালায় জিভের শরীরে লেগে থাকে গৌরীপুরের খিলি পান।গোলকগঞ্জের মজা গুয়া।হাটের প্রান্তে প্রান্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তাদের গান_
"নদীত ফোটে 
নদীয়া হোলা"

২৭.
"একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না"

মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে।কিন্তু তখন
নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না।কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে।তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে।তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি।আর ভাঙা জলের সোতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে।
এভাবেই জীবনের পর জীবন বাঁচে এই সব হাটপরিধী জুড়ে জুড়ে।আখ্যানের পর আখ্যানের পরিসরে তীব্র এক গঞ্জহাটের কোরাস!
   



রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৪.

এই পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে ভবতারণ বাবুর।পেছনে পড়ে থাকবে একটা চার কুড়ি পঁচাশি দিনের মস্ত জীবন।তার বন্ধ চোখের ভেতর এখন হেমন্তের মাঠের ছায়া।অগ্রহায়ণের খড় বিচালির ঘ্রাণ। বেঁচে থাকতে থাকতে একটা আস্ত জীবন কিভাবে ফুরিয়ে যায়!সরকারবাবুর জোত জুড়ে সেই কবেকার একুশ মহিষের ভইসা গাড়ি।
গাড়ির নিচে কালি পড়া লন্ঠন দোলে। পরনকথার গল্প ভেসে যায় আঞ্চলিক নদীতে।
জমে ওঠে হেমন্তের গানবাড়ি_
"দোলার জল থই থই
আছে মাগুর সিঙ্গী কই"
এই নদী টদি বাথান টাথান খেত খামার মানুষজন বাড়ি টাড়ি ঘিরে জমে ওঠা মানুষের জীবনযাপন থেকে দীর্ঘ হাই তোলে মানুষের জীবন।
যে জীবন ঘিরে থাকে মরণ।
মৃত্যুর স্বাদ তো নিতেই হয় মানুষ কে।
ভবতারণ বাবু তার মস্ত এক জীবন থেকে চলে যাচ্ছেন।তিনি তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রম জটিলতার ফাঁকে ফাঁকে মাঠে মাঠে ছড়িয়ে থাকা গান শুনতে শুনতে নুতন এক লোকপৃথিবীর দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
মরণের ভেতরের বিষাদ থেকে তখন ভেসে আসে গান_
"পানিয়া মরা যাবার না দেয়
কেমন করিয়া যাং"
ভবতারণ বাবু চলে যাচ্ছেন।
সঙ্গ থেকে সঙ্গহীনতার দিকে।
আলো আর অন্ধকারের কুহক থেকে নিঃসঙ্গতার উপর ঝুঁকে পড়ে ভবতারণ বাবুর আস্ত আয়ুষ্কাল।
এই যাওয়া রাজকীয়।
এই প্রস্থান মহামহিম হয়ে জেগে থাকে।নুতন নুতন গল্প দিয়ে ভরিয়ে তোলা লম্বা আখ্যানের মতন।
এই চলে যাওয়া চিরকালীন শুন্যতার জন্ম দিতে থাকে।আর সেই জন্ম মরণের ভিতর শিস দেয় হেমন্তের পাখিরা।
২৫.
ছত্রশালের সিথানে কালডোবার হাটে অঘ্রাণ সন্ধ্যায়
ভরা সভায় গান গাইতে শুরু করেন আলাউদ্দিন গিদাল। মানে সেই আখ্যান থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসা আলাউদ্দিন এম এল এ।সঙ্গে দোতরায় সঙ্গত করছে আব্দুল জব্বার।আলাউদ্দিন গান ধরেন আর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দোতরায় ঝড় তোলেন জব্বার।জমায়েতে মানুষ ঢুকে পড়ে।জমায়েত থেকে বেরিয়ে যায় মানুষ।এই যাতায়াতের
মাঝখানে,মানুষের প্রবেশ প্রস্থানের ভেতর খুব নিবিড়তা নিয়ে কেবল জেগে থাকে গান।মাটির গান।মাটিতে বসবাস করা মানুষের জীবনযাপনের গান।আমরা শুনি গান উড়ে বেড়াচ্ছে,ঘুরে বেড়াচ্ছে_
"বাইরা খোলান তোর ঝিকি রে মিকি
ঘরে জ্বলে ঘিয়ের পঞ্চবাতি
সোনার চান রে"
গানের পর গান চলে।গানের ফাঁকে কত গল্প করেন আলাউদ্দিন সাব।কত কত কিসসা শোনান।
রাজার হাতি পার করানোর সেই রাজড়াঙার ঘাটের কথা বলেন।একাব্বর ঘাটোয়াল আর তার "শিমুল খুটার" সেই মস্ত বাহারি নৌকোর গল্প বলেন।
এভাবেই মানুষের ঘন হয়ে আসাটা বেশ টের পাওয়া যায়।জমায়েতে উড়ে বেড়াতে থাকে বিড়ির আগুন,হুকা টানবার শব্দ, কোলার ছাওয়ার ডুকুরি
ডুকুরি কান্দন।রাত বাড়তে থাকে।গ্রামদেশে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে।গঙ্গাধরের বাতাসে শীত প্রগাঢ় হয়।আলাউদ্দিন এম এল এ আর গীদাল জব্বার খুব খুব ডুবে যেতে থাকেন গানেরই ভেতর_
"হস্তীর সনে মাহুতের পিরিতি
হস্তী ছাড়া মাহুত চলে কেমনে"

মীনাক্ষী ঘোষ

                     



কোল্হাপুর ডায়েরী ৩

সূর্য ওর কোম্পানির এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে জানিয়ে রেখেছিল ওদের পৌঁছবার কথা।  সেই রাতটার মতো কোম্পানির তরফ থেকে কোল্হাপুরের একটি নামী
হোটেলে দুটো রুম অ‍্যলটেড ছিলো যাতে এতটা জার্নি
করে এসে রাতটুকু  নিশ্চিন্ত আয়াসে বিশ্রাম নিতে পারে।
হোটেলের লবিতে এইচ আর ডিপার্টমেন্টের একজন প্রতিনিধি  উপস্থিত ছিলেন। সব ব্যবস্থাপনা মিটিয়ে রুমে আসতে আসতে সন্ধ্যার তিমির তখন ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসছে।
রুমে ঢুকে খানিকটা ফ্রেশ হতে না হতেই কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে রুম সার্ভিস হাজির। এতটা জার্নিতে খিদেও পেয়েছিল একটু।  ছেলে এবং মেয়ে ওদের চেঞ্জ নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। আর সূর্য চেঞ্জ করে সুখশয্যায় গা এলিয়ে দিতেই নিদ্রাদেবীর করতলগত।
নতুন জায়গায় আসার আবেগে আর উত্তেজনায় মিমির ভেতরে তখন সহস্র অশ্বক্ষুরের শব্দ।
সূর্য অকাতরে ঘুমোচ্ছে। দরজাটা আলতো করে টেনে মিমি এলো পাশের ঘরে। পুত্র এবং কন্যা দুজনেই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসেছে দাবাখেলার সরঞ্জাম নিয়ে। ওদের ব্যাকপ্যাকের সর্বক্ষণের সঙ্গী এই চেসবোর্ড। পাসটাইম হবিও বটে! খুব যখন ছোট সূর্য ই শিখিয়েছিল। এখন ফাঁক পেলেই দুই ভাইবোন খেলতে বসে পড়ে এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।
মিমি পায়ে পায়ে এগোলো ওদের ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটার দিকে। কি নিরিবিলি শান্ত নির্জন পরিবেশ!।গার্ডেন ফেসিং ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে মিমি নতুন শহরের গন্ধটাকে বুকের ভেতর ভরে নেবার চেষ্টা করছিলো।
খানিকক্ষণ পরে রুমে ডিনার ও সার্ভ করে গেল। সূর্য ততক্ষণে একটা ন্যাপ নিয়ে এই ঘরে এসে বসেছে। ওদের খেলার মাঝখানে ছোটখাটো ফুটনোট ও দিয়ে চলেছে। প্রায় সবটাই মেয়ের পক্ষে আর তাই ছেলে আরো সিরিয়াস ভঙ্গীতে  পরের মুভটা নিয়ে  যৎপরোনাস্তি দার্শনিক হয়ে পড়ছে। ছেলের অবস্থা দেখে মিমির হাসি পেয়ে গেল।
ছেলেকে বললো-' তোর বাবার খালি  পার্শিয়ালিটি।  এবার
রাখ দেখি। চল্ নতুন জায়গার খাবারগুলো টেষ্ট করে দেখি। সূর্য হার্ডকোর ননভেজ। মেনুতালিকায় কোল্হাপুরী
শুখা মটন  জিরা রাইস আর ভাকরি। জিরা রাইসের সাথে রসনা পরিচিতি থাকলেও বাকি দুটো নিতান্ত ই এযাবৎ
অনাস্বাদিত।
কোল্হাপুরের লোকেরা সাধারণত একটু মশলাদার খাবার পছন্দ করে। কোল্হাপুরী মাটন তার অন্যতম। এটা বানাবার বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে। স্বাদেগন্ধে অতুলনীয় এই পদটির রন্ধনপ্রণালী পরে মিমি আয়ত্ত্ব করেছে।কোল্হাপুরী মাটনের সাথে আরো দুটো পদ পরিবেশিত হয়।
এই দুটি যথাক্রমে তাম্বড়া রসা আর পান্ডরা রসা।
রসা অর্থ হলো রস। কোল্হাপুরী রান্নায় শুকনো নারকেলের প্রচলন খুব বেশী। প্রায় সব রান্নাতেই শুকনো নারকেলের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়।
তাম্বড়া রসাটি তাম্রবর্ণের বা রক্তাভ। লাল লঙ্কা এর প্রধান উপকরণ। পান্ডড়া শব্দটির মারাঠি অর্থ হোলো সাদা।  এর বর্ণটিও তাই সাদা। এই রসটি বানাবার মূল উপকরণ হোলো প্রধানত তিল পোষ্তদানা আর শুকনো নারকেল গুঁড়ো। এগুলি একত্রে পিষে  তরল চাটনির মতো তৈরী করা হয়। অ‍্যাপেটাইজার বা খিদেবর্ধক হিসেবে এটি ভালো কাজ করে।  আর তাম্বড়া রসা হোলো মাংসের গ্রেভি বা জলীয় অংশ। শুকনো মাংসের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও  এখানে বাটারমিল্ক বা ছাঁস পরিবেশন করা হয় হজমকারক হিসাবে। এটি মিমির খুব পছন্দের পানীয় একটি।দই দিয়ে ঘোলের মতন বানিয়ে তার মধ্যে পুদিনা পাতাও ভাজা জিরেগুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে পরিবেশন করা হ য়। অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত ও পুষ্টিবর্ধক পানীয় হিসাবে এটি খুব জনপ্রিয় ও বটে। ভাকরি হলো যবের রুটি। এটিও অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত।।  এই হোটেলের প্রতিটি খাবারের স্বাদ নিতে নিতে কোল্হাপুরী রন্ধনপ্রণালীর  এক অনন্যতা অনুভব করছিলো মিমি যা পরবর্তীতে তাকে কোল্হাপুরী মশলার স্বকীয়তা সম্পর্কে উৎসাহী ও কৌতূহলী করে তোলে।
সবশেষে ছিলো এক বিশেষ ধরণের লঙ্কার আচার যাকে ওরা থেচা বলে। মিমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেও সূর্য বা ছেলেমেয়েরা কেউই আর মখে তুলতে পারলোনা। ওরা কেউই তেমন ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়।
ডিনারের পাট চুকিয়ে ছেলেমেয়েকে গুডনাইট জানিয়ে
নিজেদের ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখের পাতা জুড়ে নেমে এলো নিবিড় ঘুম।রাস্তার ধকল নতুন জায়গায় আসবার উত্তেজনা সর্বোপরি ভোজনের পারিপাট্য মিমিকে আর জেগে থাকার অবকাশ দিলোনা। রাতবালিশের নিবিড় কোমল স্নেহস্পর্শে তলিয়ে যেতে লাগলো নিশ্চিন্দিপুরীর স্বপ্নরাজ্যে।
সকালে ঘুম ভাঙলো সূর্যের ডাকে। সামনের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ন টা বাজে।পাশের বেডসাইড টেবিলে মর্নিং টি আর বিস্কিট রাখা। ওকে চোখ মেলতে দেখেই সূর্য বললো-
'মিমি আমাদের  প্যাকার্স অ‍্যান্ড মুভার্সের গাড়ি এসে গেছে। কোম্পানির লোক ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে আসবাবপত্র ঠিকঠাক অ‍্যারেঞ্জ করার জন্য।তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাষ্ট করে নাও। আমরা ফ্ল্যাটে যাবো।
সূর্য ই পাশের রুম থেকে ছেলেমেয়েকে ডেকে তুললো।ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে রেডি হয়ে আবার নতুন ঠিকানায়।
হোটেলের বেশ কাছেই নির্ধারিত ফ্ল্যাটটি। একেবারে তিনরাস্তার মোড়ে। একেবারে উল্টোদিকে বিবেকানন্দ কলেজ। কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামী বিবেকানন্দের একটি আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত।
ফ্ল্যাটে ঢুকে মিমির মনটা  আনন্দে ভরে গেল। তিনটে বেডরুম ড্রইং ডাইনিং কিচেন মিলিয়ে অনেকটাই স্পেশাস। সবচেয়ে বড় কথা বেডরুমগুলো সবকটাই রাস্তার অভিমুখী। মিমিরা পৌঁছতে পৌঁছতে কোম্পানির  লোকজন  ততক্ষণে ফার্নিচার মোটামুটি সেট করে ফেলেছে।কিচেনে ঢুকে দেখলো  অল্পবয়েসী একটি ছেলে বাসনপত্র সব বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে। নাম জানালো আশীষ। কোম্পানির পিওন।  সূর্যর অফিসে লাঞ্চ পৌঁছোবার দায়িত্ব  ওর তার সাথে ফাঁকে ফাঁকে ঘর গেরস্থালির কাজে সাহায্য করার জন্য ওকে নিয়োগ করা হয়েছে। মিমির অবশ্য এই ব্যাপারটা একেবারেই না পসন্দ। অফিসের বেয়ারাকে দিয়ে ঘরের কাজ করাবার একেবারেই পক্ষপাতী নয় সে। কথায় কথায় জানলো ছেলেটি কোল্হাপুরের শিবাজী ইউনিভার্সিটি থেকে মারাঠি ভাষায় এম এ পাশ করেছে!ছেলেটি ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
নম্র ভদ্র বিনয়ী ছেলেটি সহজেই সকলের মন জয় করে নিল।
ক্রমশঃ




রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

                              



লোটেঝুরঝুর 



গরম বাহার। আঠেরতম পর্ব।অনেকদিন পর আজ ফিরে এলাম।নিয়ে এসেছি বাঙালির একটি মাছের প্রিপারেশন। অনেকেই এই মাছটা খেতে পছন্দ করেন না আবার আমার মত কেউ কেউ আছেন যারা বিরিয়ানির থেকে বেশি ভালবাসেন এই মাছ।হ্যাঁ আমি বলছি লোটে মাছের কথা।কৌলিন্যে এ মাছ জায়গা করে নিতে পারেনি কোন আনুষ্ঠানিক ভোজের মেনুতে।কিন্তু তা বলে এর গুণাবলি কম নয় কিন্তু।ইংরেজিতে নাম blue bay sea fish কেউ বলেন Bombay duck.প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এই মাছ হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম এবং আয়রন থাকার জন্য পেশির সমস্যা কমাতে হেল্প করে


আজ আমি এই মাছ যেভাবে রান্না করব তাতে মাত্র এক চামচ তেল ব্যবহার হবে।কারণ মাছের গুণাগুণ তখনই বজায় থাকবে যদি রান্না খুব কম তেলে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বানানো যায়


প্রথমেই মাছগুলো ধুয়ে একটা স্টেনারে রেখে জল ঝরিয়ে নিতে হবে।এই স্টেপটা জরুরি। জল ঝরানো মাছের মধ্যে একে একে মিহি করে কুচোনো পেঁয়াজ, রসুনবাটা, কাঁচালঙ্কাবাটা, টমেটোকুচি, নুন সামান্য এক চামচ তেল, ভাজা জিরের গুঁড়ো, পাতিলেবুর রস, কয়েকদানা চিনি আর অল্প একটু গরমমশলার গুঁড়ো দিয়ে, বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেখে নিতে হবে।এভাবে ম্যারিনেট করে অন্তত দু'ঘন্টা রেখে দিতে হবে চাপা দিয়ে।এরপর গ্যাসে একটা ননস্টিক প্যান গরম করে তাতে কয়েক ফোঁটা তেল ব্রাশ করে নিয়ে ম্যারিনেট করা লোটেমাছ দিয়ে  মিনিট পাঁচেক বেশি আঁচে রান্না করার পর গ্যাসের তাপ কমিয়ে চাপাঢাকা দিয়ে রাখতে হবে অন্তত আধ ঘন্টা। এর ফাঁকে ফাঁকে দু'বার ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে আবার ঢাকা।কিছুক্ষণ পর থেকেই দেখা যাবে প্রচুর জল বেরিয়েছে মাছ থেকে।সেই জল টানতে টানতে শুকিয়ে আসবে আর প্যানের গা ছেড়ে বেরোতে শুরু হবে।একসময় নাড়তে নাড়তে কচুবাটার মত পাক হয়ে এলে বুঝতে হবে রান্না রেডি  

তেল মশলা দিয়ে খুব রিচ করেই সাধারণত আমরা এই মাছ রান্না করে থাকি কিন্তু তাতে পুষ্টিগুণ কিছুই থাকে না।ঠিক এই তেলছাড়া এভাবে করে নিলে সুস্বাদুও হবে সাথে স্বাস্থ্যসেবাও৷


    


মিনাক্ষী ঘোষ

               


দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে কেটে গেল একটা সপ্তাহ। এরমধ্যে এল পিজি ট্রান্সফার ও ব্যাঙ্কের আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম মেটাতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ছেলের টুয়েলভ ফাইনাল হয়ে গেছে।মেয়ের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ও নেওয়া হোলো। কোল্হাপুরে খুব নামকরা একটা কনভেন্ট রয়েছে মেয়েকে সেখানে গিয়ে অ‍্যাডমিশন করাতে হবে।  তার একটা চিন্তাও মাথায় আছে বৈকি! মিমি জানে একটা উপায় ঠিক হবেই।যত সমস্যাই আসুকনা কেন মিমির স্থির বিশ্বাস তার থেকে সে বের হয়ে আসতে পারবেই। এ বিশ্বাসটুকুকে ভর করেই অনেক দুরূহ বাধা সে অতিক্রম করেছে এখনো পর্যন্ত।
প্যাকার্স অ‍্যান্ড মুভার্সের দায়িত্বে মালপত্র  ন্যস্ত করে রবিবার মিমিরা রওনা হোলো নতুন শহরের উদ্দেশে।
সূর্য ই ড্রাইভ করছিলো। মিমি পাশে বসে  সমস্ত যাত্রাপথের ছবিটা কেবল বুকের ভেতর এঁকে রাখার চেষ্টা করে গেছে।
পুণে থেকে কোল্হাপুরের দূরত্ব প্রায় দুশো পঁচিশ কিলোমিটার। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার ধার ঘেঁষে এই  উপত্যকা শহরটি হোলো কোল্হাপুর।  মারাঠি ভাষায় 'কোল্হা'' শব্দের অর্থ হোলো উপত্যকা। কোল্হাপুরের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হোলো উপত্যকার শহর বা 'সিটি অব ভ্যালিজ'।
 মূলত ব্যাঙ্গালোর পুণে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই পুরোটা পথ চলা। এই দু' বছরে মিমি পুণের বাইরে কোথাও যায়নি। পুণে থেকে সাতারা পর্যন্তযেতে পথে দুটি ঘাট সেকশন পেরোলো ওরা। পাহাড়ী রাস্তা। খুব শার্প  চড়াই উৎরাই যদিও নয় তবুও চুলের কাঁটার মতো পাকদন্ডী পথ পেরোবার  সময় বুকের ভেতর শিরশির করে উঠছিল। এরপর কতবার এ পথে মিমি যাতায়াত করেছে তবু প্রতিবার ই বুকের ভেতরটা পাহাড় পেরোতে ধুকপুক করতে থাকে। নীচে অতলস্পর্শী খাদ। যদিও রাস্তা বেশ চওড়া তবু মূহুর্তের অসতর্কতায় খাদের গভীরে তলিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সূর্য ড্রাইভিংটা যথেষ্ট ভাল করে। পাহাড়ি রাস্তাতেও নিয়মকানুন মেনেই ফার্ষ্ট গীয়ারে আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠছিলো। একপাশে ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা পাহাড় অন্যদিকে খাদ। বেশ অনেকটা রাস্তাই সাতারা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের আওতায় পড়ে।  যদিও প্রচুর গাড়ি চলাচল করছিলো পাহাড়ি পথ বেয়ে মিমির মন কিন্তু ওই নিবিড় অরণ্যানীর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। এই পাহাড়ী পথেই শিবাজীর মারাঠা সৈন্যদল মোঘলশত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। 
তবু বশ্যতা স্বীকার করেনি।  এসব ভাবতে ভাবতে মিমি কখন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছিলো চমক ভাঙলো
সূর্যর ডাকে। সূর্যর গাড়ি ততক্ষণে সমতলের মাটি ছুঁয়েছে।
- 'মিমি সামনে একটা চায়ের দোকান আছে চলো একটু
দাঁড়িয়ে চা খাই।'
টানা দু ঘন্টা ড্রাইভ করে সূর্য একটু ক্লান্ত। আরো ঘন্টা
তিনেক ড্রাইভ করতে হবে। চা খেয়ে একটু ফ্রেশ হ য়ে নেওয়া এই আর কি! কাছের দোকানটায় একজন ভদ্রমহিলা চা  বিক্রি করছিলেন।
- 'কাকু দৌ কাপ চায়ে'
মারাঠীতে  কাকিমাকে কাকু বলা হ য়। সম্বোধনটির মধ্যে অপরিচয়ের আধিক্যের চাইতে অন্তরঙ্গতার আবেদনটুকু
অনেক বেশী। মিমি মারাঠি ভাল বলতে না পারলেও বুঝতে পারে একটু একটু। কাকুর কাছে শুনে বুঝলো বাকি রাস্তাটা মোটামুটি সমতল  আর ঘন্টা দেড়েক পথ পেরোলে কারাড শহর। এটিও বেশ বর্ধিষ্ণু একটি শহর।
কারাড থেকে কোল্হাপুর আরো ঘন্টা খানেকের পথ।
 কাকুর কাছে গরম গরম বড়া পাও পাওয়া গেল। পাঁউরটির ফাঁকে আলুর বড়া। এটা এখানকার খুব জনপ্রিয় খাদ্য। ছেলেমেয়ের ও খুব প্রিয়।
এরপর টানা ড্রাইভ। দেখতে দেখতে কারাড পেরিয়ে গেল। এরপর এলো ইচলকরঞ্জি। এখানে বেশ কয়েকটি টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে টেক্সটাইল হাব তৈরী করা হয়েছে।
ছোট্ট ছোট্ট টিলার ওপর বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর।
পথে কয়েকটি টোল পড়লো। মহারাষ্ট্র গভর্ণমেন্ট রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পে খানিকদূর পরপর এই টোল ট্যাক্স ধার্য করেছেন। রাস্তা যেমন চওড়া তেমন মসৃণ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রকল্পিত সোনালি চতুর্ভূজ সড়ক যোজনা বা গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল 
ন্যাশনাল হাইওয়ের অন্তর্গত এই মহাসড়কটি।
কোল্হাপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্যদেব  ততক্ষণে পশ্চিম দিগন্তের পথযাত্রী।
কোল্হাপুর প্রবেশের আগে মিমি দেখলো অদূরে বিরাট আকৃতির গণেশ মূর্তি। পরে জেনেছে এটি চিন্ময় গনেশ নামে খ্যাত।বিঘ্নহর্তা সমস্ত রকম আসন্ন বিপদের  হাত থেকে শহরটিকে রক্ষা করবার জন্য প্রবেশপথের নিকটে দন্ডায়মান।
ব্যাঙ্গালোর পুণে হাইওয়ে সোজা চলে গেছে ব্যাঙ্গালোরের দিকে। আরেকটা রাস্তা বাঁদিক ঘেঁষে নেমে গিয়েছে কোল্হাপুরের দিকে। সেই পথ ধরে মিমিদের গাড়ি এবার প্রবেশ করলো কোল্হাপুরের তোরণদ্বারে। সুন্দর একটি ফটকের ভেতর দিয়ে কোল্হাপুর শহরের  প্রবেশপথ।উল্টোদিকের রাস্তাটা চলে গেছে গান্ধীনগরের দিকে। মূলত সেটি বস্ত্রবিপণীর জন্য বিখ্যাত।
কোল্হাপুর শহরে ঢুকতেই মিমির চোখে পড়লো একেবারে কেন্দ্রস্থলে অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ়া এক নারীমূর্তি।হাতে সুউচ্চ উন্মুক্ত তরোয়াল। পরণে মারাঠি কায়দায় পরিহিত ন' ওয়াড়ি শাড়ি। মহারাণী তারাবাইয়ের মূর্তি এটি।
মহারাণী  তারাবাই ছিলেন  অসীম সাহসিকতার প্রতিমূর্তি।তিনি বিখ্যাত মারাঠা জেনারেল হাম্বিতরাও মোহিতের  কন্যা,মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী পুত্র রাজারাম ভোঁসলের  পত্নী এবং  শিবাজী দ্বিতীয়ের মাতা।তিনি স্বামী রাজারামের সম্পর্কিত ভগ্নী ও ছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় মহারাণী তারাবাই ছিলেন অতুলনীয়া।অশ্বচালনায় ও যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুচতুর।
১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী রাজারামের মৃত্যুর পরে তিনি  তাঁর নাবালক  শিশুপুত্র শিবাজী দ্বিতীয়কে উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন ও আওরেঙ্গজেবের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন।এবং মোগলবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ১৭০৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মোগল বাহিনীকে শর্তাধীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে মুঘল শাসক সেটা প্রত্যাখ্যান করেন।১৭০৭ পর্যন্ত তারাবাই তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে মোগল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তারাবাইয়ের নেতৃত্বে মারাঠা অঞ্চল বিপন্মুক্ত হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছিলেন ১৭০০ -১৭০৭পর্যন্ত মহারাণী তারাবাইয়ের অসীম সাহসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা মারাঠা জাতিকে ভয়াবহ সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।এবং এই সময়ের মধ্যে মহারাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনীর নির্দেশক রূপে বিধবা রাণী তারাবাই মোহিত ভিন্ন সেইসময় সঙ্কটকালীন উপদেষ্টা হিসাবে আর কোন মন্ত্রী ছিলোনা।
ক্রমশঃ


সুবীর সরকার

                                  


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২২.
যাতায়াতের রাস্তায় কত রকমের মানুষের সঙ্গেই যে দেখা হয়!অন্তহীন কথা হয়।গল্প হয়।সেই গল্প জুড়ে পুরোন কোন ধনীবাড়ির খোলানে ঘুরে বেড়ানো হাঁস মুরগী কইতরের দল যেমন থাকে তেমন থাকে পাকঘর,পুরোন খড়ম আর ঢেঁকি পাড়ের শব্দ।
গঙ্গাধরের পারের চর গুলি থেকে ধান নিয়ে যান জামালউদ্দিন ভাই।তার জোড়া মহিষের "ভইসা গাড়ি"।সন্ধ্যের শেয়াল দৌড়ে বেড়ায়।একটা মেটাফিজিকাল ডার্কনেস জড়ানো পৃথিবীতে গান বাজে,গান ঘুরে বেড়ায়_
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
আর জামালউদ্দিন ভাইয়ের "ভইসা গাড়ি"_র নিচে দুলতে থাকে ভুসো কালি মাখা লন্ঠন।
আমি কূপি আর লন্ঠন হারানো হাটগুলোর কথা ভাবতে থাকি।
তখন ঘোড়া জোতদারের টাড়িতে চুপচাপ মস্ত এক ছায়াশরীরের মত এগিয়ে আসতে থাকেন মহি গিদাল।রাত ঘন হতে থাকে। নিশি পংখী উড়াল দেয় গঙ্গাধর পেরিয়ে বুঝি নদী গদাধরের দিকে।
মহি গীদাল তার দোতরার কান মোচড়ান আর গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন_
"ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
আমি গল্পের শরীরে হাত রাখি।
এভাবে গঙ্গাধরের পারে পারে জীবনের পর জীবন বেশ গুছিয়ে রাখা থাকে,হেমন্ত মাঠে শুয়ে থাকা পাকা ধানের আটির মত!
২৩.
তখন মরা দুপুরের  প্রাক শীতের নরম রোদে ভিজতে ভিজতে এমএলএর হাট থেকে হাতি হারানো জোতদারের জোতের দিকে হেঁটে যেতে থাকে ইজাজ মাস্টার। পাটের শনের মতন তার দীর্ঘ পাকনা চুল দোল খেতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়।চার কুড়ির এক জীবনে বাঁচতে বাঁচতে ইজাজ মাস্টার দূরাগত বাতাসের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে।তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মস্ত এক স্মৃতির খামার।
ইজাজ মাস্টার আসলে বাইচ খেলার দক্ষ বাইচার।
বাইচ খেলায় ইজাজের নাও কখনো হারে না।এই পঞ্চাশ সত্তর গ্রাম গঞ্জে সবাই তাকে ইজাজ মাস্টার বলেই ডাকে।জানে।চেনে।
ইজাজ তখন হাতি হারানো নরকান্ত জোতদারের
আখ্যানগুলির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে।ইজাজ তখন ১৫/১৬।রূপসীর জমিদারের চড়ক মেলায় ইজাজ তার নানার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।নানাই তাকে প্রথম জোতদারকে চেনায়।দীর্ঘ মেদহীন পেশীবহুল সেই জোতদারের রাজকীয় ছবি সুরত আজও ইজাজের
স্মৃতিতে জীবন্ত হয়েই রয়ে গেছে।
তারপর সেই বড় বন্যার বছর "লক্ষীমালা" নামের সেই জোতদারের হাতিটি হারিয়ে গেলে সেই জোতদার "হাতি হারানো জোতদারের" কিংবদন্তিতে
ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে যান।
এখন ইজাজ মাস্টার তার বেটার ঘরের বেটি, বেটির ঘরের বেটাকে সেই জোতদারের গল্প শোনান।
আর জোতদারটাড়ি জুড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে বাইচের গানের কলি_
"ওরে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
গঙ্গাধরের  কাছাড়ে
ওরে মাস্টার বেটার নাও ফাইনালে"


রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                    


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২০.
নদী গঙ্গাধরের ভাটিতে চন্দ্রকান্ত দেউনিয়ার জোত জুড়ে এই হেমন্তে হেউতি ধান কাটার মরসুম।ধান নিয়ে গো_মহিষের গাড়ি চলেছে কৃষকের ঘরে। এ দৃশ্যে উৎসব জড়িয়ে থাকে।জীবনের মায়া জড়িয়ে থাকে।বগা বগির দল উড়ে যাচ্ছে রতিয়াদহর দিকে,বালাজানের দিকে, বিষখোয়ার দিকে,আগমনীর দিকে,গোলকগঞ্জের দিকে,আগমনী পেরিয়ে রূপসীর দিকে।মাঠ মাঠ ধানের মাঝখান থেকে মেয়ে বউদের সমবেত গান ভেসে আসে_
"আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই
দুয়রত করিলেক হায় ম্যাও"
ধান কাটতে কাটতে কণ্ঠে গান আসে,শরীরে পুলক জাগে।আর শরীরের পেশিতে জেগে উঠতে থাকে নাচের মুদ্রা।বাদ্য থাকে না।বাজনা থাকে না।কিন্তু নাচ থাকে।নাচের সাথে জড়িয়ে থাকে গান।চিরকালের সব গান,যা জীবন নিংড়ে উঠে আসা_
"ধর তো দ্যাওরা ছাওয়াটাক
মুই বিলাইওক সাজা দেও"
জীবন বয়ে চলে এভাবেই।দুর দুরান্তরে ছড়িয়ে পড়া বগা_বগি একসময় ফিরে আসতে থাকে।হেমন্তের ধানের মাঠে তাদের ডানার শান্ত ছায়া বিছিয়ে পড়তে থাকে।
২১.
জীবনের গল্প কখনো শেষ হয় না।হাটপর্ব ফুরোয় না কখনো!আসলে হাট হারানো একটা জীবনের কথা ভাবতেই পারে না মানুষ।গঙ্গাধর নদীর উজান ভাটি জুড়ে কত কত মানুষের জমায়েত।আসা যাওয়া।জমায়েতের ভেতর সারি সারি সাজানো সব গল্পেরা।
এক গল্প শেষ না হতেই নুতন গল্পের শুরু হয়ে যায়।
গল্পে গল্পে মানুষ বাঁচে।মানুষকে আসলে বেঁচে থাকতে হয়।জন্ম জন্ম জুড়েই।
আমরা আবার দেখি হেমন্তের ম্যাজিক জমে থাকা মাঠে আবার বাওকুমটা বাতাস।বগা_বগির হাহাকার মিশে থাকা কান্নার সুর।
আর মাঠের সিথানে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা আবহমান কালের জোড়া মহিষ।ময়কান্ত ব্যাপারী।
আর গুয়া পানের মৌতাতে গান গাইতে থাকেন ফুলেশ্বরী আবো_
"ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ছাড়িয়া কাটে ওরে নাড়া
সেই মতন মানুষের দেহা
পবন গেইলে ওরে মরা জীবন রে"

মীনাক্ষী ঘোষ

                                       




কোল্হাপুর ডায়েরী


কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলতেই সূর্যর
সহর্ষ চিৎকার- 
-"মিমি' এখানকার পাততাড়ি এবার গোটাও। একসপ্তাহের মধ্যে কোল্হাপুর শিফ্ট করবো আমরা।"
মিমির হাঁ-মুখটা বুজতে  বোধকরি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো আর সেই হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হেসে চলেছে সূর্য।
-"মানেটা কি? বলা নেই কওয়া নেই 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে'!
ধুসস কি ব্যাপার খোলসা করে বলোই না!"
বছর দুয়েক হোলো মিমি সূর্য  ওদের দুই পুত্রকন্যা সহ
পুণেতে এসেছে।অবশ্যই সূর্যের কর্মসূত্রে। এর আগে দীর্ঘ
আঠারো বছরের বিবাহিত জীবন কেটেছে বাংলার বূকেই।
সূর্য পেশায় মেটালার্জিষ্ট।পশ্চিমবঙ্গের একটা বিখ্যাত অ‍্যালুমিনিয়াম কোম্পানির  একটি ইউনিটের সর্বোচ্চ আধিকারিক ছিল সূর্য। বছর তিনেক আগে সেই বেসরকারি কোম্পানিটি অন্য আরেকটি কোম্পানি
টেক ওভার করে।কয়েকমাস যাবার পরে  ভারপ্রাপ্ত নতুন আধিকারিকরা এই ইউনিটটি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সূর্যকে বদলির প্রস্তাব দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশের চম্পা জেলায় অন্য একটি ইউনিটের প্রধান হিসেবে।
ওদের ছেলের তখন ক্লাস টেন। সামনে আই সি এস ই পরীক্ষা।মেয়ে ছোট ক্লাস ফাইভ। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ওদের কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলোনা।মিমি আর সূর্য ই ওদের পড়ানোর দায়িত্বটা পালন করতো।
বদলি হলে সূর্যকে একাই  যেতে হবে - এই টানাপোড়েনে যখন তারা  ভীষণভাবেই দ্বিধাগ্রস্ত তখন ই পুণেতে কর্মরত মিমির ছোটভাই সূর্যকে পুণে চলে আসার প্রস্তাব দেয়।
সর্য দোনোমোনো করেছিলো। কিন্তূ মিমির প্রবল উৎসাহ আর আগ্রহে শেষমেষ বাংলার পাট চূকিয়ে একরকম হারা উদ্দেশে অনিশ্চিতকে বরণ করে নেবার একটা দুঃসাহসিক
সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তারা। 
বদলির সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় এবং ইউনিটটি বন্ধ হবার কারণে ছেলের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের মুভ করার কোনো উপায় ই ছিলনা। আরো একটা কারণ ছিল। মিমির অ‍্যালায়ানস ফ্রাঁসেজে ফ্রেঞ্চ ক্লাসে সিক্স্থ লেভেল কমপ্লিট করার মাস দুয়েক বাকি ছিল। সব চুকিয়ে
পুণে আসতে বছরের মাঝামাঝি।
তারপর থেকেতো জীবনটা বল্গাছাড়া ঘোড়ার মত ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়েই চলেছে। তার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মিমি দিশেহারা। পুণেতে কনসালট্যান্ট হিসেবে একটা কোম্পানিতে জয়েন করার তিনমাসের মধ্যে সূর্য বদলি হলো দিল্লী। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পুণেতে শুরু হলো মিমির চরৈবতি পর্ব। এই দু বছরে সূর্য কখনো দিল্লী কখনো গোয়া  কখনো পুণে এভাবে চাকরির সাযুজ্য বজায় রেখেছে। আর মিমি পুণেতে থেকে গেছে ছেলে মেয়ের জন্য। সবে কাল ই ছেলের টুয়েলভের পরীক্ষা শেষ হ য়েছে।
এরমধ্যে সূর্য চাকরির সন্ধান চালিয়ে গেছে নিয়মিত। যেখানে একজায়গায় পরিবারসহ থিতু হতে পারে। আসলে সূর্য বরাবর ই ঘরকুনো বড় বেশী পরিবার ঘেঁষা।
ঘরে ঢুক ধপ্ করে সোফায় বসেই  মিমিকে বললো- 
'তোমায় বলিনি মিমি। কিছুদিন আগে কোল্হাপুরের একটি বড় কোম্পানির মালিক আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন ওদের ফ্যাক্টরিতে  জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেবার  জন্য। সবটাই টেলিফোনিক ইনটটারভিউয়ের মাধ্যমে। অবশেষে সবকিছু ফাইনালাইজ
করে আজ ওরা ‍অ‍্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে।' কোম্পানি রেন্টেড ফ্ল্যাট আর নিজস্ব ব্যবহারের গাড়ি ও দেবে  সেই কোম্পানি। সাত দিনের মধ্যে জয়েন করতে
হবে। অতএব,' চলো মুসাফির বাঁধো গাঠরি।'
মিমির মাথায় এখন আর কিছুই ঢুকছেনা। ওর মনের ভেতর স্লাইড শো হয়ে তখন ভেসে চলেছে একটা অদেখা শহরের স্বপ্নে আঁকা কিছু ছবি। আবার নতুন জায়গা নতুন মানুষ আবার আরেক অনিশ্চিতের হাতছানি  যা মিমিকে সারা জীবন অস্থির করে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরের দিকে। সূর্য যখন কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেছে মিমি অভয়দাত্রী হয়ে সাহস জুগিয়েছে। টালমাটাল সময়গুলোকে শক্ত হাতে ধরে ঢেউ সামলেছে একের পরে এক।
কোল্হাপুর  সম্পর্কে মিমির জ্ঞান ছিলো ওই কোল্হাপুরী চপ্পল অবধিই। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে কোল্হাপুরী সেন্টার নামে জুতোর দোকানটা কোল্হাপুর নামটা সম্পর্কে অবহিত করেছিলো। ব্যস ওই পর্যন্ত ই। আর কোন কৌতূহল বা ধারণা কিছুই ছিলনা। এমনকি  এখনো পর্যন্ত মিমির ধারণা নেই পুণে থেকে কোল্হাপুর কতটা দূর! 
 সূর্যর গলার আওয়াজে ছেলেমেয়েও পায়ে পায়ে বসার ঘরে। সবটাই শুনেছে তারা কিন্ত বিমিশ্র অনুভূতি তাদের দুজনের গলায়। ছেলে খুব খুশী। এমনিতেও ও এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যাবে বাইরে। কিন্তু মেয়ে--!!!
এখানে দু'বছরে এখানকার স্কুল ও পরিবেশে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে গেছে সে। নতুন ভাষা মারাঠীকেও বেশ ভালোরকম করায়ত্ত্ব করেছে সে এই দুই বছরেই। এখানে নামী কনভেন্টে ভর্তি হবার সুযোগই শুধু সে পায়নি এখানকার স্কুলেও ভালো ছাত্রী হিসেবে স্কুলের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ফার্ষ্ট অথবা সেকেন্ড হয়েছে প্রতিটা পরীক্ষায়।
আবার নতুন স্কুলে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষা মেয়েটাকে ভীতচকিত করে তূলেছে।কিন্তু মেয়ে অসম্ভব বাবা ন্যাওটা। বাবা আবার একসাথে থাকবে এই আশ্বাসটুকু ভরসা করে তাই সেই ভীতিটুকু হজম করেছে চুপ করে বাবার কোলে বসেই।
রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মিমি ডেষ্কটপ খুলে কোল্হাপুর শহরটার ইতিবৃত্ত পড়লো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
পুণে থেকে দুশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পশ্চিম মহারাষ্ট্রের একটা ছোট্ট সুন্দর শহর হলো কোল্হাপুর। মূলত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সংযোগবিন্দু এই  উপত্যকা শহরটি স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের  অধীনে ছত্রপতি শাহু মহারাজের স্বায়ত্ত্বশাসিত রাজ্য ছিল।স্বাধীনতার পরে এটি একটি জেলা হিসেবে পরিগনিত।সহ্যাদ্রি পর্বতমালার পূর্বদিকে অবস্থিত এই ছোট শহরটি কেবলমাত্র নান্দনিক সৌন্দর্যেই সমৃদ্ধ নয়।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকেও এর তাৎপর্য অপরিসীম।
ইতিহাস প্রাচীন এই শহরটি রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল একসময়।মহারাণী তারাবাঈ কোল্হাপুর, কাগাল ও ইচলকরঞ্জি এই তিনটি পরগণা নিয়ে কোল্হাপুর রাজ্যটির পত্তন করেন।পরে উত্তরাধিকার সূত্রে ছত্রপতি শাহু মহারাজের হাতে এর শাসনভার অর্পিত হয়।
সূর্য উঠেছিল বাথরুমে যাবে বলে। মিমিকে  ডেস্কটপের উপর ঝুঁকে বসে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিলো। রাত ও হয়েছে অনেক। কথা না বাড়িয়ে মিমি শুয়ে পড়ার আয়োজন করলো। যেটুকু পড়লো  তাতে যাবার আকর্ষণ আরো প্রবল। বাকিটা গিয়েই নাহয় এক্সপ্লোর করা যাবে। 

ক্রমশঃ


                  




      
    
             
                          



ছবি ১ঃ কোল্হাপুর লোগো
ছবি ২,৩ ঃ মহারাণী তারাবাঈ
ছবি ৪ঃচিন্ময় গনেশ
ছবি৫ঃ কোল্হাপুর প্রবেশপথের মূল ফটক

রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                     


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়



১৮.
কবেকার কোন এক হেমন্তের হাটে হেমকান্ত দেখে ফেলেছিলেন সেই জোড়া কৈতর। আর হাটে ঢুকে পড়া মেয়েরা তাদের শরীরে নাচ নিয়ে শুরু করেছিল গান_
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
নাচের পর নাচ গানের পর গান চলে,চলতেই থাকে
হেমন্ত জুড়ে।মাঠে মাঠে সোনার ধান।
মানুষের ঘরবাড়ি থেকে দৈনন্দিন কথা বার্তা ভেসে।
হিমে ভেজে খোলানের নিঃসঙ্গ আখা।
দূরে কোথাও আগুন জ্বলে ওঠে।
আগুন ঘিরে মানুষের ছায়া আবছায়া।
আল ও আলি দিয়ে দৌড়ে পালায় হেমন্তের ছাইবর্ন শৃগাল।
রহস্যময় মনে হয়,মনে হতে থাকে দূরে কাছের গ্রামদেশ।
মস্ত চাঁদ ওঠে। জোড়াদিঘির জলে চাঁদ আর সুপুরি গাছের ছায়া।
কোথাও পুঁথি পড়া হয়।
আর গান জেগে ওঠে_
"বাপরে বাপ কি জাড়
মাওরে মাও কি জাড়
জাড়ত কাপে দেখং এল্যা
দিন দুখির সংসার"
এভাবে জীবন সেজে ওঠে।জীবন প্রবাহিত হয়।
জন্ম আর মরণের ঘোর জাগিয়ে রেখে
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হেমকান্ত।
আর হেমন্তের মাঠে খেতে হাহাকারের মতন ছুটে
যায় গান_
ওরে মানুষের দেহা
পবন গেইলে হবে মরা"
১৯.
হেউতি ধান,পাখির পালক,শেষ হেমন্তের নদী,ধান নিয়ে ঘরে ফেরা কৃষক,নির্জন কলাগাছের পাতা_এই সব দৃশ্যের মায়া আর ম্যাজিক কেমন নিরিবিলি করে দেয়।
এই সব আসলে চিরকালীন,আবহমান।
যেভাবে জীবনের পর জীবন মানুষ বাঁচে,মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
পুরোন মানুষ হারিয়ে যায় এই মর পৃথিবী থেকে।
নুতন মানুষ বেঁচে থাকাটাকে ছুঁয়ে থাকে।
জন্ম জন্ম জুড়ে এ এক ধারাবাহিক পক্রিয়া।
ছয় নদী আর নয় ফরেস্ট জুড়ে জুড়ে গল্প নির্মিত কিংবা বিনির্মিত হতে থাকে।শিমুল গাছের শরীরে নখের আচড় রেখে আসে চিতাবাঘ।
হাতির পাল নেমে আসে উত্তরের ধানবনে।
নদীর শিথানে খুব নির্জন হয়ে বসে থাকে সেই আবহমান কালের বগা বগি।
এই জীবন তো আদতে এক ফাঁদ।
আমরা সবাই "ফান্দে পড়িয়া কান্দি"!
আর কার্তিকের কুয়াশায় ভেসে আসে গান_
"চাষার মুখত আর
নাইরে সেই গান"।
জীবনের অদ্ভুত এক মায়া আছে।দূরাগত হাওয়ায় বুঝি জীবনেরই ঘ্রাণ ভেসে আসে!কত কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।গল্প হয়।মানুষের জীবন জুড়ে না ফুরোন কত গল্প।রতিকান্ত পাইকারের গল্পে কখন বুঝি মিশে যেতে থাকে হাতি জোতদারের হলুদ খামারবাড়ি।আমি নদী পেরিয়ে,চরের পর চর পেরিয়ে হেঁটে যেতে থাকি এরাজ ধনীর জোতে।এইসব আসা যাওয়ার মাঝখানে ছায়া ফেলে জোনাকির আলো। কোথাও দোতরা বেজে ওঠে।দেহতত্ত্বের গান উঠে আসে আর ঘুরে বেড়াতে থাকে টাড়ি বাড়ি নদী উপত্যকা জুড়ে।
এভাবেই জীবন কিভাবে বুঝি উদযাপন হয়ে ওঠে!


রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১

জিনাত রেহেনা ইসলাম

                       





স্বাধীনতা  দিবসে মনে  খুশির জোয়ার এনে দিল মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ,ছয়ঘড়ির (মন্ডলপাড়া গ্রাম)  মহিলা কৃষক মৌসুমি বিশ্বাস। মুর্শিদাবাদের একমাত্র মহিলা কৃষিবোন,যে নিজের হাতে চাষ থেকে শুরু করে মাথায় করে বাজার পর্যন্ত নিজের উৎপাদনকে সন্তানের মত নিয়ে যায়,জেলা  পেরিয়ে  দেশজুড়ে  ছড়িয়ে পড়তে চলেছে তার ধানের বীজ নিয়ে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। কালই ওর ভিডিও বার্তা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরের জন্য  চলে গেছে। তারপরের স্তরে সেটা পাঠানো হবে রাষ্ট্রসংঘে। মৌসুমিকে এই বিশ্বের দরবারে যারা নিয়ে হাজির করছে তারা আর কেউ নয়, ন্যাশানাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন।


আট বছর ধরে কলা,পেঁয়াজ সহ  ধানের বীজের উপর  মাঠে বসে গবেষনা চালিয়েছে মৌসুমি। সাফল্যের স্বীকৃতি মিলেছে ধানে। প্রথমে নলাক আর আই আর -৩৬ ক্রস করে।  তারপরেও চার  বার ক্রস চালিয়ে  আনে নতুন ভ্যারাইটি।  নাম এম যামিনী। সেটি সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বছর তিনেক আগে গান্ধীনগরের এক তরুণ কৃষিবিজ্ঞানী সহ এক প্রোজেক্ট কো অর্ডিনেটর। গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা জায়গায় ফলন ফলায় এই বীজ। চাষীরা  বিঘাপ্রতি ৬/৭ কুইন্টাল বেশি ফলনের  রিপোর্ট দেয়। সেচ কম,রোগ কম,আবার ফলনও বেশি। এরপর মৌসুমির ডাক পড়ে দিল্লি ও গুজরাটে যাওয়ার। লকডাউন বাধ সাধলে ভিডিওতেই প্রেরণ করা হয় মৌসুমির ধানের বীজ নিয়ে  সাফল্য ও কাজের বার্তা। 


 ন্যাশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন (এনআইএফ) -  ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের (ডিএসটি) একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। গ্রাসরুট প্রযুক্তিগত  সৃজনশীল উদ্ভাবকদের স্পেস দেওয়া মিশন এই সংস্থার। এবারে  কৃষক মৌসুমী বিশ্বাসের এতদিনের সংগ্রাম ও গবেষণায়  নতুন পালক সংযুক্ত হওয়ার  অপেক্ষা।


জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                       





বেঁচে থাকা একটা সাধনা 

&&&&&&&&&&&&&&&&

     

      দিনের শেষে আমরা কি চাই? 

বাড়ি গাড়ি অর্থ না কি একটু শান্তি?

এক একসময় মনে হয়, সমস্ত কিছুর বিনিময়ে যদি শান্তি পাওয়া যেত! যদি, বালিশে মাথা দেওয়া মাত্র ঘুম এসে যেত! 

কখনো কখনো মনে হয়, চারিদিক অন্ধকার, সন্তান স্বামী অথবা অসুস্থ পরিজন নিয়ে পেরে ওঠা যায় না, একদিক সামলে উঠলে অন্যদিক ঝামেলায় পড়ে, সেজেগুজে ছবি তুলে আরো কত কী করে দেখাতে তো চাই, ভালো আছি, কিন্তু নকল হাসির বন্ধ দরজা ভেদ করে আলো আর ঢোকে না কিছুতেই। জীবনের শুরুতে যে পথ মনে হয়েছিল সহজ সরল, চলতে চলতে দেখতে পাই কত কাঁটা, ছোট ছোট কাঁটা কিন্তু ধারালো, আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ সমস্যা, কিন্তু আঘাত তীব্র, কর্কশ, ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় সাজানো জীবন, বলা যায় না, সহন করা যায় না, অভিনয় করে যেতে হয় তবু, সাজানো সুখের অভিনয়!

************ 


কেন হয় এমন? ত্রুটি করা হয় নি কোনো কাজেই, আকুল হয়ে ভাবতে থাকে মন, কোথায় হয়েছিল সমস্যা, কোথায় ছিল ঠিক সময়ে ঠিক কাজ না করার ভুল, নিজেকে দোষারোপ করতে করতে, অপরের থেকে দোষারোপ শুনতে শুনতে ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়ে দিতে, প্রাণ না থাকলে, থাকবে না ঝামেলা! 

এইভাবে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। পরিসংখ্যান বলছে-- গোটা পৃথিবী জুড়ে গড় আত্মহত্যার সংখ্যা যেখানে ৮ লাখ , সেখানে শুধু ভারতেই প্রায় ১ লাখের উপর। ভারতে জন সংখ্যা বেশি হলেও, জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রেকর্ড বলছে-- ভারতীয়রা আত্মহত্যা করছে বেশি, সমস্ত রকম শ্রেণীর মানুষ আছে সেখানে, উচ্চবিত্ত, সেলিব্রেটি, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে। সবচেয়ে বেশি, তামিলনাড়ু, কেরালা,পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, সুইসাইড করার বয়স গড়ে পনেরো থেকে চুয়াল্লিশ এর মধ্যে। মনের ডাক্তার বলে-- মানসিক চাপ ও হতাশার মোকাবিলা করার শক্তি যখন হারিয়ে যায়, মানুষ তখন জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে আয়ু কমিয়ে দেওয়ার 

পরিকল্পনা করতে থাকে, একসময় সফল হয়। 

***********

রামতনু বাবু আত্মহত্যা করেন কারণ,ছেলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য, শীলা সহ্য করতে পারেনি, শ্বশুরবাড়ির কথার আঘাত, এমন আরো কত...! যৌনতা সম্পর্কিত সমস্যা, রোগে জর্জর হয়ে যাওয়া, প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু, প্রিয় পোষ্যের মৃত্যু, সামাজিক খ্যাতি পড়ে যাওয়া-- তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই-- আশি পার্সেন্ট শিক্ষিত লোক বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। 

************

শিক্ষিত লোক  উদাহরণ দেওয়ার পিছনে কারণ হল, আত্মহত্যাই সমাধানের পথ, এমন যারা ভাবতে বাধ্য হন, শিক্ষা তাদের কী কাজে লাগল!

অনেকেই তর্ক করবেন, যুক্তি দেবেন, সুশান্ত সিং রাজ্পুতের মর্মান্তিক ঘটনাকে অনেকেই বলেছেন, খাদের কিনারায় এসে গেলে আর উপায় থাকে না, সুইসাইড অনিবার্য। আমিও তর্ক করেই উত্তর দেব, সুইসাইড করতে যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা, যেটা ছোট থেকে শেখানো উচিৎ, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজন সেই কৌশল শেখে না, তবে কি শেখে? কি করে সেরা হয়ে উঠতে হয়, কি করে সমাজের মাথা হয়ে উঠতে হয়, কি করে নিজের প্রিয় বন্ধুকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে হয়, মায়ের টেলিফোন কথোপকথন, বাবার মদ্যপান বিজনেস মিটিং-- সমস্ত সময় আলোচনা-- চারপাশ জুড়ে আছে কেবল খারাপ মানুষ! সকলে বিশ্বাসঘাতক, সকলে ফালতু, সকলে স্বার্থপর। 

এইরকম অবিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা সন্তান, একদিন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা, বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার মত পুষ্টি কি করে পাবে মানুষ? 

**********

মনের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় কখন? যখন আর উপায় থাকে না। শরীরের ডাক্তারের কাছেও তো যেতেই হয় শেষপর্যন্ত, কেন যেতে হয়? শরীরের যত্ন নেওয়া হয় না ঠিক মত, নিয়মিত চেকআপ যাওয়া হয় নি, হঠাৎ ধরা পড়ল ভিতরে ভিতরে বড়  একটা অসুখ বাসা বাঁধছে, তখন আর কোনো উপায় থাকে না। 

মনের চেক আপ করে নিয়মিত করা জরুরি বলে কেউ মনেই করে না। যেহেতু, মনের জীর্ণ দশা চোখে দেখা যায় না, অথবা, তাত্ক্ষণিকভাবে  খুশিতে থেকে, বেড়িয়ে এসে কেনাকাটা করে, ব্যাঙ্কে সম্পত্তির হিসাব মিলিয়ে খ্যাতির লিস্টি মিলিয়ে সুখী ভাবতে চাওয়ার মধ্যে থাকে মস্ত ফাঁকি। পরিসংখ্যান বলছে-- মোট আত্মহত্যার বেশির ভাগ পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে শেষ করে দেয়। আর এই মুহুর্তে অতিমারি একটা বিরাট কারণ। 

বোঝা যাচ্ছে, মনের জমিতে ফাটল ধরছে ক্রমাগত, সেই ফাটল মেরামত করতে হবে, ছোট  থেকেই গড়ে তুলতে হবে সুস্থ মন। সতর্ক থাকতে হবে, কোথাও টোল খেলো কি না! মানুষ ছাড়া জীবন কিসের? মানুষকে অবিশ্বাস করে ঠকে যাচ্ছেন না কি মানুষকে সব বিলিয়ে দিয়ে আশা করে আছেন? বাঁচতে হবে নিজের শর্তে, মানুষ পাশে থাকলে ভালো আর না থাকলে? আরো ভালো। প্রয়োজন নেই। নিজের শর্তে বাঁচতে হবে। সাফল্য নিতে পারব, পার্টি দেব আর ব্যর্থতা মানতে পারব  না? তখন গলায় দড়ি দেব? 

**********

জীবন একটা যুদ্ধ তো বটেই, ওঠা  পড়া  থাকবে, অপমান থাকবে, তবে শেষপর্যন্ত দেখতে হবে, হেরে যাই তো ঠিক আছে, আগের থেকে হার মানলে চলবে না। 

  মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, অমুক ওই করেছে, তমুক তাই করেছে, এগুলি না ভেবে দেখতে হবে আমি কি করেছি, সেটাই প্রয়োজন, সেটাই জরুরি। বাকি আর সব তুচ্ছ। 

   বেঁচে থাকা একটা সাধনা, প্রাণ আছে তো সমস্ত কিছু আছে। প্রাণের সাধনা করতে হবে প্রতিদিন। 

   চেষ্টা করি আসুন, সাধনা সফল হোক।

পিয়াংকী

                      





গরম বাহার, নামেই যার উত্তাপ তার কাছে গেলে ছ্যাঁকা খেতে হবে এ আর এমন কী কথা! 

আসলে আমি বলতে চাইছি আপনি ছ্যাঁকা খান সমস্যা নেই কিন্তু আপনার ওয়েটমেশিন যেন কোনভাবেই পুড়ে না যায়🙂,আর এসব যাতে না হয় তার জন্যই এত আয়োজন।


বলতে চাইছি একটি ওয়েটলস লাঞ্চের কথা। বাটার ভেজ উইথ ক্রিস্পি কর্ণ চিকেন। শুনতে ভজঘট হলেও আদতে বিষয়টি খুবই সহজ এবং সময় রক্ষক।


গাজর বিন ক্যাপসিকাম ব্রকোলি রেড বেলপেপার ইয়ালো বেলপেপার, চাইলে পছন্দমত অন্য ভেজিটেবলও নিতে পারেন।লম্বা শেপে কেটে নিয়ে ৬০-৭০%সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে নিন,মেরেকেটে মিনিট সাতেক সময় লাগবে,এরপর ননস্টিক প্যান গরম করে তাতে সামান্য বাটার। মেল্ট হলে রসুনকুচি। গন্ধ বেরোলে সেদ্ধ সবজি,পরিমাণমত নুন, কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দুধে গোলা কর্ণফ্লাওয়ার দিয়ে একটু সময় টস করলেই তৈরি বাটার ভেজ


এবার পালা ক্রিস্পি চিকেন তৈরির। চিকেনপিসগুলো ফ্রিজের ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে দশ মিনিট, এরপর জল চেপে তুলে নিয়ে গোলমরিচ গুঁড়ো লেবুর রস নুন আমচুর পাউডার সামান্য সর্ষের তেল দিয়ে মেখে আধঘন্টা রেস্টে রেখে দিতে হবে।তারপর প্যানে অলিভ অয়েল ব্রাশ করে পিসগুলো রেখে কম আঁচে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রান্না করতে হবে, অন্তত মিনিট কুড়ি সময় লাগে এই কাজটায়।এরপর অন্য একটি প্যানে অল্প বাটার দিয়ে তারমধ্যে পেঁয়াজ আদা রসুন পেস্ট দিয়ে তিন চার মিনিট রান্না করার পর কাঁচা গন্ধ চলে গেলে  ফার্স্ট স্টেপ রেডি করা চিকেন পিসগুলো দিয়ে, তারমধ্যে একটু টমেটো সস চিলি সস মিশিয়ে দিয়ে রান্না করলেই তৈরি আজকের পদ।

সোনালী চক্রবর্তী

                           


ফাত্রাতুন



"শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্রাতা গুরুরুষ্টে ন কশ্চন:
ইতি কঙ্কালমালিনীতন্ত্রে..."

শেষটুকু উচ্চারণের আগেই প্রায় বিবর্ণ পাতা প্রথমে ঝাপসা আর তারপর- 'তুমি তো নারী, তোমার কবিতায় জলের অধিক কিছু থাকার ছিলোনা'। কে রুষ্ট হলো তার? জন্মইস্তক শিবপূজা করে আসছে প্রায় ভগ্ন, অশ্বত্থঘেরা দেউলঘাটে শ্রী, যে পুণ্যভূমি হালিশহরের গঙ্গাজলমৃত্তিকার ঘ্রাণের মধ্যে মিশে থাকেন মহাসাধকের বেড়া বাঁধার সঙ্গিনী লীলাবতী মহাকালী। লোকে বলে তারই অর্জন চট্টোপাধ্যায় বংশে তার বিবাহ, তিন পুত্রের সর্বকনিষ্ঠটির বধূ হলেও তারই হাতে দেড় শতাধিক বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চলিঙ্গের (বাণেশ্বর, চন্দ্রমৌলীশ্বর, রত্নেশ্বর, রামেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর) নিত্যপূজার দায়িত্ব কমলিনী মারফত এসে পড়া। সেই রাতেও কি আরিদ্রা নক্ষত্র হেসেছিলো? জানা নেই। এই প্রাপ্তির লৌকিক ব্যাখ্যা চন্দ্রস্রোতে ভেসে যায় তার গুরুসম্বন্ধীয় অলৌকিক সৌভাগ্যে। সপ্তমবর্ষীয়া কন্যাটি দীক্ষা পেয়েছিলো স্বয়ং শ্রী সারদা মায়ের সাক্ষাত গৃহীশিষ্য শ্রী লাবণ্যকুমার চক্রবর্তীর থেকে। পরমহংসের নশ্বরতা বিষয়ে যারা চর্চা করে থাকেন তাদের কাছে পরিচিত "যুগজ্যোতি" ও "ঠাকুরের বাউল" সহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা, প্রেমেশ মহারাজের প্রিয়তম কবি এই সাধকের নাম। শৈবলিনীও বিস্মিত ছিলেন বরাবর এত কিছুর পরেও শ্রীয়ের অন্তর্মুখীনতায়, অধ্যাত্মের পারদভারকে স্ফটিকের স্বচ্ছে নীরব জ্বালিয়ে রাখার দক্ষতায়। সন্তানকে পার্থিব প্রাপ্তিতে সন্তৃপ্ত দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার সাধারণ মা তিনি ছিলেন না। ফলত, যোগীচক্ষুর বিচলনের প্রয়োজন পড়েনি। নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন মেয়ে তার শান্তিসূত্রের সমীকরণ নিজেই এঁকে নিচ্ছে বলে। নীলাদ্রীকে দেখে তার নিয়তিতে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল- "বারাণস্যাং তু বিশ্বেশম ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে" । তিনি মেনকা ছিলেন না কিন্তু একথাও তো সত্য পার্বতী শুধুমাত্র কিছু পুরাণমতের নাম। শক্তি ও তার আধার প্রসঙ্গে পুঁথি মানা হলে শেক্সপিয়র কেন নয়? "What's in a name?" 


সেই শ্রী আজ অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কি বাণলিঙ্গ আঘাত পেয়েছেন? সদাশিবের অত্যন্ত উগ্ররূপ এই উপবৃত্তাকার স্বয়ম্ভু লিঙ্গ। রুদ্রজ ব্রাহ্মণেরাও অতি সন্তর্পণে তাঁকে আরাধনা করে থাকেন। কিন্তু তবুও তো শ্রীয়ের গুরুদাদু আছেন। সে জানে শ্রীশ্রীমা নহবতখানায় থাকাকালীন একদিন তাঁর স্বপ্নধ্যানে পিঙ্গলজটা দুলিয়ে বাঘছাল পরা এক শুভ্রকায় শিশু দৌড়াতে দৌড়াতে এসে নালিশ জানিয়েছিলো- "আমায় ফেলে দিয়েছে"। মা তাকে কোলে বসিয়ে আদর করে বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন এই বলে যে "ইচ্ছে করে তো করেনি বাবা, সবই তো তোমার সন্তান, অপরাধ নিতে নেই"। তাহলে? কীসের অপরাধে তাহলে এই শূন্য বাড়িতে অধিকতর শূন্যতা ধারণ করে তার তাকিয়ে থাকা? আজ ষোলোদিন পেরিয়ে গেলো নীলাদ্রি নার্সিংহোমে। স্বধা রোজ ছয় ঘন্টার জন্য বাড়ি ফেরে। মেয়ের মুখ দেখে সে কোনো প্রশ্ন না রেখেই বুঝে যায় অমাবস্যার দেরী নেই। তাহলে কি... তাহলে কি... সে নিজেই হোতা, অধ্বর্যু ও উদ্গাতা এই আকস্মিক 'যজ' ধাতু ', 'ঞ' প্রত্যয়ের অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবের? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যে সূক্ষ্ম চিড় ধীরে মহাখাত হয়ে আলাদা দুটি সভ্যতায় পরিণত করলো তাকে ও নীলাদ্রীকে, সে কি জেন হ্যারিসনের তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা দিলো তবে?

"Collectivity and emotional tension, two elements that tend to turn the simple reaction into a rite"

শীতল লাভার মতো তার অভিমানসমূহ এভাবে বধযোগ্যতা দিলো নীলাদ্রীকে? 



চন্দ্রগর্ভের ক্ষতগুলিকে কলঙ্ক নামে রোম্যান্টিসাইজ করাই প্রথা। সেইহেতু এই প্রশ্ন কখনো ওঠেনা যে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তথা পাণ্ডবশক্তির কেন্দ্রস্থল বলেই দ্যূতসভায় রজস্বলা পাঞ্চালীকে বিবস্ত্র করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো নাকি কেশবসখী হওয়ার দায়ে তাঁর জন্মলগ্ন থেকে বিবাহ- প্রতি পলেই কুরুক্ষেত্র? শুধু কৃষ্ণা তো নন, অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে ঈশ্বরনির্ভরতাই কারণ জীবনব্যাপী দুর্ভাগ্যের। "দুঃখ তাঁর দয়ার দান" উচ্চারণকারী গান্ধারী কি বাসুদেবকে অভিসম্পাত দানে বিরত থাকতে পেরেছিলেন শেষতক? শ্রী তার জীবনের প্রেক্ষিতে এই সূত্রের বহু সম্ভাব্যতা খোঁজার চেষ্টা করেছে এতো বছর ধরে। সে শৈবলিনীর মতো বৈরাগ্যপ্রতিমা নয়, কমলিনীর মতো সিংহতেজাও না। এই দুইজন ব্যক্তিগত আদর্শকে যাপনে পরিণত করতে পেরেছিলেন কারণ ভাগ্য তাঁদের যে মুক্তি দিয়েছিলো তাতে তারা মেধা ও কাঠিন্য মিশিয়ে নিস্তেল স্বাধীনতার অণ্বেষণে নিজেদের ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। অথচ শ্রী? অধ্যাত্মের তীব্র ফল্গু তার মধ্যে প্রবহমান জেনেও তার মা তাকে পাত্রস্থ করেছিলেন অতিরিক্ত দ্রুততায়। যতই শৈবলিনী দাবী করুন নীলাদ্রি সাধারণ পুরুষ নন কিন্তু একমাত্র নিজস্ব মায়াবিশ্বাস ছাড়া এ প্রমাণ তিনি কোথায় দিয়েছিলেন শ্রীকে যে তার জন্য নির্বাচিত জন শর্ব? শ্রী যা পেয়েছে তাতে যদি নীলাদ্রি অনঘও হন তবুও তার রূপ মণিকর্ণিকায় শবের কানে তারকব্রহ্ম নামদায়ী কামারী, কৈলাসে উমার পুরুষ সোম নন। রাগ-রাগিণী সামপ্রিয় নীলাদ্রীর দুর্বলতা অথচ কখনো শ্রীকে শুনতে চাইলেন না তো তিনি। প্রাইমারি থেকে উচ্চবিদ্যালয়- যে শ্রীয়ের দিকে তাকিয়ে হেন প্রাণী নেই অবাক হতোনা গন্ধর্বসম আলোয়, কখনো তাকেই দেখার সময় নীলাদ্রীর চোখে তো মুগ্ধতার অঞ্জন লাগলোনা। কেন? অথচ নীতিজ্ঞান ও চরিত্রে নীলাদ্রীতুল্য পুরুষ দুর্লভ। এক্ষেত্রে তিনি অবিসংবাদী অজাতশত্রু। তাহলে কি অতিশৈশব থেকে ঈশ্বরবোধের যে বেদী নির্মাণ করেছিলেন শৈবলিনী তাইই শ্রীয়ের বোধ ছাপিয়ে শরীরী উপত্যকাকে দেবজ অংশ করে তুলেছিলো যাকে ঘিরে মন্ত্রোচ্চারণ করা যায় কিন্তু অন্তরঙ্গে আনার স্পর্ধা দেখানো যায়না? অগ্নিকে আলিঙ্গন কেই ই বা করেছে কোনদিন? তাহলে কি যে অনীশ্বরকে ভিত্তি করে কমলিনী ও শৈবলিনী সাম্রাজ্যজয়সুলভ সুখলাভ করেছিলেন সেইই শ্রী ও নীলাদ্রীর মধ্যবর্তী আলোকবর্ষ ব্যবধানের মূল রহস্য? 


স্বধা পৃথিবীতে আসার আগে ও পরে, মাত্র একবার, প্রথম ও শেষবারের মতো নীলাদ্রীকে আঘাত করতে চেয়েছিলো শ্রী, যদি রূপকথার মতো গুহামুখ থেকে পাথর সরে গিয়ে জন্ম নেয় নদী না হোক অন্তত কোনো সিল্করুট। সে তখন দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তখনো নিষিদ্ধ না হওয়ায় কে আসবে সে জানত। 

-- "পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা"
যাক, তোমাকে অন্তত এই যুক্তিতে বিয়েতে রাজি করানো গেছিল"

মুহূর্ত কয়েকমাত্র। উত্তর এসেছিল...


-- "নির্বাচন করো শ্রী। আমি তোমায় চব্বিশ ঘন্টা দিলাম। তুমি এই সন্তানকে জন্ম দেবে কিনা, দিলে আমায় সারাজীবনের জন্য হারাবে। যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় তোমার কোনো দায়িত্ব কর্তব্যেই ত্রুটি রাখবো না সে তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও। স্বামী কিনা, প্রেমিক তো নই"


পরবর্তী ইতিহাস কোনো পাঁচালী নয়। গর্ভস্থ পুত্রটি হত্যা হয়েছিলো। আর ঠিক সেইদিন থেকে স্বধা দেখেছিলো কীভাবে একই রাতের আকাশের নিচে একই যুদ্ধক্ষেত্রে অন্ধ নৈশব্দ্য নিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে দুই শত্রুশিবির, পরের কোনো সূর্যই যেখানে এমন আসেনা যখন শঙ্খনাদে রণ ঘোষিত হবে। শুধু অস্ত্রেরা নিপুণ থেকে নিপুণতর হতে থাকে, কৌশলেরা নিখুঁত থেকে নিখুঁততর, লক্ষ্যরা তীক্ষ্ থেকে তীক্ষ্তর আর দূরত্ব... অনতিক্রম্য।



স্বধা শুধু ভেবে চলে মাধবের 'শত্রু' সম্বন্ধীয় শ্লোকটি। কী প্রবল পারস্পরিক সংবেদী হলে দুইটি অস্তিত্ব এইভাবে নিজেদের উন্মাদ ক্ষয়কে শক্তিস্তম্ভে প্রতিস্থাপিত করতে পারে? সমর্পণ নয় অথচ প্রত্যাহারও নৈব নৈব চ। যদি এ প্রেম না হয় তাহলে আজ অবধি পৃথিবীতে একটিও কবিতা লেখা হয়নি। 




সুবীর সরকার

                         


     

গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া
সুবীর সরকার

১৭.
ইয়াকুব ব্যাপারীর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হয়ে যায় ঘুঘুডাঙার হাটে।তখন মধ্য দুপুর।ভরা হাটের
গুমগুম শব্দ।ইয়াকুব গরুহাটির পাশে ঝাঁকড়া শিমুল গাছের নিচে ভবেন বৈরাগীর গান শুনছিল।ভবেনের গায়কখ্যাতি তিরিশ চল্লিশ গঞ্জ হাটে কিংবদন্তির মত।গৌরীপুরের লালজি রাজা তার গান.

ভালোবাসে।প্রতিমা বাইদর দলেও একসময় দোতরা
বাজাতো সে।
হাটে হাটে গান গেয়ে গেয়েই জীবন কাটিয়ে দিল ভবেন বৈরাগী।
ইয়াকুব আজ বায়না করেছিল দেহতত্ত্ব মনশিক্ষার
গানের।
আমরা যখন ইয়াকুবকে ভরা হাটের পাশে ঝাঁকড়া শিমুল বৃক্ষের নিচে আবিষ্কার করি,তখন সে ভবেনের
গানে উদ্বেল_
"ওরে টাকা পয়সা ভিটা বাড়ি
জীবন গেইলে সব রইবে পড়ি
সঙ্গের সাথী তোর কেউ তো হবে না"
গান শুনতে শুনতে ইয়াকুবের চোখ ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।
সে কি দূরাগত হাওয়ায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল!
জন্ম কিংবা মরন নিয়ে কোন দার্শনিকতা তাকে আক্রান্ত করেছিল!
সমাধানহীন এই প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে গান কিন্তু বেজেই চলছিল_
"আরে হাতি মার্কা কেরাসিন তেল
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপরে বাপ 
মাওরে মাও
আজি মোর গাও ঝনঝন করে রে"
১৮.
গঙ্গাধরের উজানে মাইল মাইল হাঁটতে হাঁটতে একসময় দাড়িয়েই পড়তে হয় বিমল মালিকে।
সে মুখ ফিরিয়ে পেছনে শীতের নদীকে দেখে।বিমলের কাধে ঢোল।গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
এই ঢোলের জাদুতে অন্তহীন গানবাড়ির মানুষেরা উদ্বেল হয়ে ওঠে। বিমল মালির ঢোল কথা বলে।মানুষের দৈনন্দিন যাপন গানে আর ঢোলে ছড়িয়ে পড়ে দিক ও দিগরের দিকে।
"রাজার বেটির" দলে কত কত বছর জুড়ে বেজে চলেছে বিমল মালির জাদু ঢোল।
গত রাতে বিমল গিয়েছিল সিতানন্দ বুড়ার বাড়ি।
সীতানন্দর সারিন্দা আর বিমলের ঢোল_প্রায় সারারাত চলেছিল তাদের আসর।এমন আসর প্রায়ই বসে তাদের।সঙ্গে "চাওলা" আর "নাসিরউদ্দিন বিড়ি"।
গান চলে।গান থামে।
দুঃখ সুখের কথা হয়।দেশ গ্রামের কথা হয়।
এভাবে মত্ততা জাগে।স্মৃতিকন্দর থেকে ভুস করে জেগে ওঠে গানের কলি_
"বুড়া মাছ মারে রে
গঙ্গাধরের পারে
মাছ মারিতে মাছ মারিতে
বুড়াক নিল চিলে"
অন্যমনস্কতার ঘোর থেকে একসময় বেরিয়ে আসে
বিমল মালি।তারপর সে আবার হাটতে থাকে
গঙ্গাধরের উজানে।
এভাবে কত গল্প জমে ওঠে আমাদের এই চারপাশের পৃথিবীতে।

রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১

উজান উপাধ্যায়

              




ঠাকুমার বুকের ভিতরে ঠাকুরদা একটা ফুলের বাগান করেছিল। সেখানে দুবেলা ঢুকে জল, মাটি, সার আর কীটনাশক দিয়ে মনের মতো কিছু ফুল ফুটিয়ে গেছে। সেসব ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে মতন রঙে সেজেও নিত যখনতখন।

বাবা কিন্তু মায়ের বুকের ভিতরে ফুলের পাশাপাশি কিছু সবজি আর ভেষজ উদ্ভিদও বুনেছিল। বাবা সোজাসুজি নদী থেকে জল আনবার ব্যবস্থা করেছিল। পাখিদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ছিল, পরাগরেণু আদানপ্রদানের। তারপর অন্ধকার হলে পরাগমিলন... বাবার হাতের ফুল, ফল, সবজিরা রঙ পেত মায়ের ইচ্ছে মতো। সে তো আহ্লাদে আটখানা, রঙের টালবাহানা। সে তো ইচ্ছে আর অনিচ্ছে- দুয়েরই রঙ, এ বলে আমায় দ্যাখ। ও বলে আমায় দ্যাখ।

আমিও শুকপাখিকে প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বংশানুসরণের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমিও গিয়েছি, ফুল ফোটাতে। এমনকি চা বাগান, সবজি ও আরও সব কৃষিকাজ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বুনোফুল, জংলী বাহারি গাছ। বুকের ভিতরে পাহাড়েরা জড়ো হয়েছিল‌।

এইবার জলসেচ নেহাতই সহজ।

আমাদের দুঃখ জমে যে শিশির, আমাদের বিষণ্ণতা থেকে যে কুয়াশা, আমাদের অপ্রাপ্তি থেকে জন্ম নিয়েছে যে অখন্ড মেঘ, আমাদের ভালবাসা থেকে যে বৃষ্টি...

তাতেই তো নদী ও দীঘি, খাল বিল ঝরনা ও আরও সব জলাশয়।

আমাদের জলসেচে ব্যস্ত হৃদয়। সেখানেই জটিলতা আসে। যেকোনো সহজ ঠিক যতটা জটিল।

ফুলের রঙ নিয়ে অতঃপর আমাদের গবেষণা শুরু হয়। এ ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে বা মায়ের খুশির মতো রঙ নির্বিবাদে অনায়াসে বেছে নেওয়ার মতো সরল আয়েশে ফুলেদের উত্তরসূরি হতেই পারে না।

এ ফলেরা, এসব উদ্ভিদ বা তাদের পাতারাও গোপন বৈঠকে ঠিক করে, কেমন হবে তাদের রূপ রঙ রস ও গন্ধ।

সে গোপন বৈঠকে পৃথিবীর অসুখের কথা ওঠে, নর ও নারীর যত রূপোলি অসুখ আর শূন্য শূন্য ফাঁকা ভিতরের গান...

এখন যেসব রঙ নিয়ে ওরা সব বাজারে বিক্রি হয়, সে নেহাতই অর্থ-রসায়ন, কৃত্রিম আয়োজন, হাইব্রিড-ক্রোম।
আমাদের পিতা ও পিতামহের সময়, মা ও ঠাকুমার সময়ে ভিতরে ও বাইরে একটাই রঙ হতো ফুলেদের।
এখন যতই ঝলমল করে উঠুক না বিজ্ঞাপিত মুখ, ভিতরে বিবর্ণ সাদাকালো বিরঞ্জিত সুখ...

আমি বা  আমার শুকপাখি ভিতরে রোপণ করি রঙিন অসুখ। তাই বাইরে বেরিয়ে আসে পার্লার চর্চিত মালঞ্চ মুখ।
তাইতো হঠাৎ অনেকক্ষণ খোঁজ না পেলে, ডেকে উঠি- 
কোথায় তুমি? 
সে এক আশ্চর্য উদাসীনতায় উত্তর দেয়-
জাহান্নামে।

আমি তার বুকের ভিতরে পাগলের মতো ঢুকে পড়তে চেষ্টা করি।
আমাদের তো এমনই ঐতিহ্য ছিল, প্রেমিকা জাহান্নামে পৌঁছে গেলে সেখানেও পারিজাতে ভরে উঠবে পুরো তল্লাট।

আমরা তো আলোর ভিতরে মিলনের নহবৎ চাই...
তাইতো মালঞ্চ বাগানে ফুলেরা রঙিন কর্পোরেট রসায়ন মেনে, বুকের ভিতরে শুধু নিঃস্ব ভায়োলিন।

"ফুল ফুটুক না ফুটুক"| বসন্তের চাকরি নাই।

বিরঞ্জিত 
উজান উপাধ্যায়

(ঋণ - সুভাষ মুখোপাধ্যায়)



কবিতা লিখতে লিখতে আমি ঝকঝকে চকমকে এলিট আলোয় ঠাসা শহরের সবচেয়ে নামকরা  ফাইভ স্টার হোটেলের করিডোর থেকে লিফট চেপে একদম ভিতরে সটান পৌঁছে গেছি। এইখানে লবি থেকে একটু ঝুঁকেই,  শহরগুলোকে খুব ছোট্টো দেখায়। ক্যান্ডল ডিনারের  ওপেন এন্ড ওয়াইড টপ ফ্লোরে স্টারস এন্ড সেলেবরা রঙিন ঝলমলে গ্লাসে নেচে নেচে হাসে আর রসেবশে ভাসে। আকাশের তারারা বেশ জড়োসড়ো। এখানে নামার মত সাহস পায় না আর। বৃষ্টি কাচের গায়ে। ভিতরে আসে না।  কবিতা লিখতে লিখতে আমি ক্রমাগত  বদলেছি জামা।   উদাসীন ব্যাগ, অগোছালো চুল,  অবিচল ভুল দেখা বদলেছি রোজ‌। কাগজের খসখসে দাগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মসৃণ মনিটরে ওয়ার্ড বা ডক ফাইল আপলোড করে,  ধেনো মদ ছেড়ে সরিয়েছি সস্তা চোলাই। বিড়ি আর ফ্লেক ছেড়ে এখন কিং সাইজ। সবচেয়ে দামী ব্যান্ড। কবিতারও তেমন ফ্লেভার। ক্যাপুচিনো কফি, সুইডিস কাপ। ইতালির পাথরে টিপটিপ হাঁটা। সাঁওতালি মেয়ে ছেড়ে হাই প্রোফাইল লেডি। মহুলবনীর নেশা ছেড়ে, মহুয়ার গান ছেড়ে সিম্ফনি- প্রিলিউড, মোৎসার্ট বিটোফেন। কবিতা এখন রোজ নাইট গাউন পরে একটু গভীর রাতে দখিনের জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যারিসের ছবিগুলো ভাবে। ওখানে ঘুরতে গিয়ে যেকটা ছবিই তোলা, সবকটা ব্রিলিয়ান্ট। সবকটা মাস্টারপিস। এ শহরে ফুটপাত নিরাপদ নয়। বেশিরাতে বাড়ি ফেরা মেয়েরা 'রাবিশ'। কবিতা লিখতে এসে এগুলো বুঝেছি। এখন পার্টি হোলে, অনুবাদ কবিতাই বেশি পাঠ করি। প্রতিটি কবিতা পড়ে তর্জমা করি। বুঝিয়ে বলতে হয়, কোনটা স্যুররিয়াল, কোনটা এবসার্ড। কবিতা লিখতে এসে স্পষ্ট বুঝেছি, প্যাচানো সিঁড়ির মতো মিস্ট্রির ভাঁজে মৌতাতে বুঁদ করে দিতে হবে ফ্যান্টাসি, ফিকশন। আর যত ডিকশন এবং সেনসর - লুকিয়ে রাখতে হবে চুরুটের ফাঁদে। দুঃখ বানাতে হবে, বিষাদ ঘনাতে হবে। নির্জন সংকেতে বিরহের বাঁশি, ডিজিটাল ফর্মাটে নিও-বানভাসি। কবিতা ঝাউপাতায় আর তত কমফোর্ট নয়। কবিতা মেঘলা দিনে টেকনো-গ্রাফিক্স দিয়ে এখন ঢেউ কেনে, ক্রেডিট কার্ডে আর অনলাইন পে তে। কতজন বুঝবে, কতটা ট্যালেন্ট লাগে এত পথ যেতে। এখন আমাকে ছাড়া ম্যাগাজিন ফ্লপ। এখন আমাকে ছাড়া বইমেলা ঢপ। কবিতা-নায়ক আমি। কবিতা-গায়ক। যেকোনো এঙ্গেল থেকে বর্ণমালাকে দেখো-যেকোনো দিকেই বেঁকে চোখ তুলে রেখো- আমি টপ। আমি টপ। পান্থনিবাসে নেই, ঘামে ভেজা ঘাসে নেই। ইন্টেরিয়র ডেকে ফ্রেঞ্চ ডিজাইনে আঁকা আমার মলাট। কবিতা লিখতে এসে এটুকু বুঝেছি-

জীবনানন্দকে ভালবাসলে তার কবিতাকে ভালবাসা যায় না। এবং ঠিক বিপরীতে জীবননান্দের কবিতাকে ভালবাসলে ওনাকে ভালবাসা যায় না।

দু দুটো মায়াবী চোখে ভেসে নিঃস্ব ভিখারি হবো। আমি কি পাগল নাকি।

রূপবতী নারী আর রূপবান পুরুষকে মুখোমুখি করে আমার তাদের যে কোনও একজনকেই ভালবাসতে পারি।

তা না হলে ওদের পারস্পরিক সঙ্গমে বাধা পড়ে যায়।

একজন পাঠকের কাছ থেকে এমনটা শুনে হাড়েহাড়ে বুঝে গেছি, কবিতার ষোলোআনা চাল।

চিনেগেছি 

জীবন তো মহাকাশ মহাকালে বদলায়,  মৃত্যু উলটোমুখে  মহাকাশ বদলিয়ে গড়ে মহাকাল।

অতএব, রূপ ছেড়ে রূপো, হৃদ ছেড়ে দরদাম। বিক্রি করতে হবে কবিতার বাড়ি। 

আমি পারি। আমি সব পারি। আমি এই পৃথিবীর জাস্ট এক নম্বর-

কবিতা ব্যাপারী।

পিং পং
উজান উপাধ্যায়

ঋণ - অনন্য রায়

( " In Life, the Space becomes Time.  In Death, the Time becomes Space. " )


এই পাথরের নিচে শস্য উড়ে যায়। এই পাথরের নিচে গ্রহণের দিব্যি করে ধান। এই রাত্রে পাত্র ভরে মেঘে।

এই দিনে এই সন্ধ্যায়  এই মঞ্চে হৃদি ভাসমান
পূণ্য শ্লোকে নিঃস্ব অভিমান 
চিৎকার করে ওঠে - 

বলো।

এই জন্মে এই যে হিরন্ময় আলো...

তুমি ছাড়া তাকে কে ছড়ালো?

এই জন্ম অক্ষয় হোক। মৃত্যুর ভিতরের পথে তোমার অনিন্দিতা চোখে

পাথরেরা পাখি হয়ে গেলো।

এই জন্মঋণ, এই জন্মদিন
উজান উপাধ্যায়


জলে ডোবা কাঠামোগুলোকে খুঁজি‌। এই দেহে জ্বলেছিল আলো। চকমক করে উঠেছিল সংহার ও অপার। 

রঙ সব মিলিয়ে গেছে জলে। সমস্ত উজ্বল ধ্বনি গলে গেছে রাত্রির ভাঙা তলপেটে। 

ঢাকী ফিরে গেছে। পুরোহিত ফিরিয়ে নিয়েছে সব পুঁথি, শাস্ত্র, যজ্ঞের অবশিষ্ট ছাই ও অদাহ্য যা কিছু জিনিস।

ফিরে গেছে আলোর ব্যাপারী। 

এই ব্যাখ্যা আর কতদিন? এইসব ফিরে যাওয়া মৃত্যুর মতো কেন জ্বলে যায়, ভেসে যায়।

এই যে মাটির দেহ, খড় ও বিচুলি দিয়ে গড়ে তোলা নাক কান চোখ...

এই যে নশ্বর প্রতিমাকে মা বলে ডাকা... কেন তাকে চারদিন পর আর খুঁজেও দেখিনা। এই রিসাইকেল, এই যে পুনরুত্থান... এই তত্ত্বে ঢেকে যায় সসীমের জৈব আখ্যান। নিরাসক্ত ? উদাসীন? নাকি তাকে ভুলে থাকা নেহাতই অর্থনীতি! যদি গড়ো, তবে তাকে ছলনায় কেন? রূপ রঙ রস গন্ধ চলে যাক। তবুও সে কাঠামোতে আমার মাতৃঋণ। 

বিসর্জনের পর



সিনেমার ঘরে

সিনেমার ভিতরে পাহাড় দাঁড়িয়ে গেলে পপকর্ন ফিরে যায় ভুট্টা বাগানে। সেখানে যে মেয়েদের বিবাহযোগ্যা করে তুলেছিল ঝর্ণার জল, ধাপে ধাপে আগুন বেগুনি রঙে নেমে এল নদীর মতন।

সিনেমার ভিতরে স্বপ্নের বিছানা পেতে ঘুমিয়েছে আকাশলীনারা। বৈদ্যুতিক তারের মতো ছড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যাদের চুল। 

গাছেদের ভিতরে পাহাড়, মেয়েদের ভিতরে পাহাড়- সিনেমার ভিতরে কুয়াশা। রঙ মেখে নেচে যাচ্ছে হরিণী, ভ্রমর আর নীল শতদল।

জরুরি ঘোষণা নিয়ে আমি যাই অরণ্যের ফাঁকে। আমাকে তোমাকে নিয়ে উড়ে যায় ছায়াচ্ছন্ন ছাই। এইভাবে পাহাড়ের সাথে চুক্তি মাফিক আমাদের যৌথ বয়ানে বেজে মায়াবী হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ রোশনাই।

সিনেমার ভিতরে নিয়ন্ত্রিত অন্ধকারে রঙিন ছেলেরা আগুনমেয়েরা হেঁটে আসে গলিতে গলিতে, বুনোগন্ধ দেশোয়ালি সাজ খুলে যায় জলীয় খোঁপায়- 

এইখানে প্লেব্যাক সাউন্ড, আমরা দুজন একে অপরের বিষাদের স্বাদ নিই- উল্লাসে গেঁথে ফেলি কান্নার মালা- পর্দায় জমে যায় মেঘ। সিনেমার ঘরে জানালা রাখেনি কেউ, ঘুলঘুলি নেই- পায়রা ওড়েনা- মাঝেমধ্যে চোখ জ্বলে ওঠে শিশিরের গায়ে- সিলভার স্ক্রিনে নির্জন মেঘ। 

মৃত্যু শাঁসালো- সিনেমার আলো এইভাবে পাহাড়ের কোলে তোমাকে আমাকে হ্যালুসিনেশনের ছলে কোমায় পাঠালো।




যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে লাগে আমাকে তখন? ঘুমন্ত প্রজাপতি? বৃষ্টিভেজা হরিণীর সলজ্জ দৃষ্টি যেমন? যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে হয় আমার দু ঠোঁট? কৃষক- রমণী তার কোলে নিয়ে মাটির কলস, প্রথম ভোরের আলো মেখে জল ভেঙে নামছে নদীতে? যখন কবিতা লিখি, শাদামেঘ ডানা হয়ে আসে? চা দোকানী ঘুমচোখে রেডিও চালালে, প্রথম যে গান বাজে শহরের আলসেমি ভেঙে? যে করবী প্রতি ভোরে লাল, যে পাখিটি বাঁশির মতন গেয়ে ওঠে সুদূরের বাঁকে! যখন কবিতা লিখি, পারিজাত আলো ফুটে ওঠে? নাকি এক বিষাদের অভিজাত পোশাকেরা আলগোছে সরে, নাকি এক এসরাজে দুঃখেরা এলোচুল মেলে? যখন কবিতা লিখি, দগ্ধ তারার মতো নিঃস্বতা রঙিন ভাস্বর? বৃক্ষের কমনীয় শরীরেরা নারী হয়ে যায়? কেমন আমার গ্রীবা, যে ঘোড়াটা শেষ রাতে ফেলে আসে ঠিকানা-চিরকুট? যখন কবিতা লিখি, সর্ষের ক্ষেত জুড়ে নীলাম্বরী আঁচলের ঢেউ? মালঞ্চ সাঁকো জুড়ে গোলাপের অমেয় কথন? আমার আঙুল বুঝি পলাশের নিখোঁজ আদর? আমার চোখের নিচে আঁধারের মিহি-অনুরাগ? যখন কবিতা লিখি, আমি বুঝি অন্তসত্ত্বা মা? ভিতরে যখন নড়ে নবজাতকের দেহ, সহজ উৎসায়...যখন কবিতা লিখি, জাদুকর দেখায় আমাকে? লাল নীল হলুদের ভাষা জানা কোনও জলপরী? অথবা ঘাতক লাগে? একশো আট খুনে যার হাত? অথবা মেষ পালক, যে চিনেছে মেঘেদের চিঠি? নতুবা কি মনে হয়, পলাতক বিপ্লবী একা, চোরাগলি ধরে খোঁজে নিরাপদ ছায়ার প্রহরা? কেমন দেখতে লাগে, প্রতিটি পঙক্তির আমি পিতা? যার পিঞ্জরে আঁকা লালনের উদাসীন সাড়া? আমাকে কি মনে হয়, নর ও নারীর সংগমসাজে বেজে ওঠা ভিজে একতারা? আমাকে কি মনে হয় অনন্তে উড়ে যাওয়া মৃত্যুর জীবিত ইশারা?

প্রসবকালীন




ব্যস্ত রাস্তায় বাঘ বেরুলে স্কুটার চোখে হরিদ্রাভ ফাঁদ পাতে। বাঘের তখন প্রেমের নরম শোক। গামছা কাঁধে একটা লোক ডোরাকাটা ঠোঁটে, জাপটে ধরলো ঘরফুরনো মেঘ। মেঘ কুড়নোর প্রাচীন শখে আদিম শিকার আয়েশ করে বসে। স্কুটার নামে নদীর দেহে। বাঘের এখন দারুণ জ্বর। বুকের ভিতর প্রেমের ঝড়। একটি মেয়েও এই পাড়াতে নেই। এসব ভেবেই ছয় ঋতু, আঁচল খুলে চুল মেলে। হরেক রঙের পাহাড় নাচ। একটি নোলক একটি পালক স্কুটার বালক আর বাঁশি। অন্ধ একটি বন্য ফুল। ওদের সঙ্গে মিল বিপুল। জানেই না সে আয়না কাকে বলে। এসব রোজই চলে। দুপুর অলস, বিজন রোদ‌। নানান ঋতুর ধারের শোধ। কোথাও কোনও পাওনা বাকি নেই। বাঘ বুঝেছে, প্রেমের মালিক সেই। যেই না বোঝা, হঠাৎ ছুট। এ গল্পটার সবটা ঝুট- শুধু একাই বাঘ ঘুমিয়ে ভাবে। স্কুটার কেন ভয় পেলনা তাকে? ঘুমের ভিতর বৃষ্টি ঝাঁকে ঝাঁকে।

বাঘ স্কুটারের 'ঝুটা' গল্প




কাল রাতে এক মৃত সৈনিক এক কৃষকের বাড়িতে এসেছিল। তার মনে একটা খটকা থেকে গেছে। যুদ্ধের মাঠ আর কৃষকের জমির মধ্যে কে বেশি সূর্যের কাছাকাছি! আকাশের মাঝখানে সবুজ রঙের এক গর্ত দেখতে পেয়ে মৃত সৈনিক ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে তার হাত কৃষকের উঠোনে একটি পিস্তল খুঁজে পেল। 

কৃষকের কলকের ভিতরে জল বেড়ে যাওয়ায় বহুদিন তার আর নেশা হয়না।

এলবেট্রস পাখির জন্য সৈনিকটি গোটা জীবন ধরে রোদ জমিয়েছিল। 

কৃষকটি আজ ভোরেই একটি জাহাজের পাল দেখতে পেল। ওর এক ঘোড়ারোগ। ওই সবুজ গর্তের গন্ধ নাকে এলেই ও সমুদ্রে পাড়ি দেয়।

কৃষকের রমণীটি বেলা বাড়তেই কোমর পর্যন্ত ভিজে চুল ফেলে মৃত সৈনিকটিকে স্নান করাতে এলো।

কিন্তু অবাক হল। সৈনিকটি জানালায় বসে বসে সূর্যের সাথে তাকে নিয়েই গল্প করছে।

আলো আর অন্ধকার চিরকাল কেন এত দূরে। ভালোবাসে বলে?

কৃষকটি তখন মাঝ সমুদ্রে। আশ্চর্য, সেখানে এতটুকু জল নেই। তার বাড়িতে ঢেউ আর ঢেউ।

রমণীকে বলে আসা হয়নি। তার কোমরের ভাঁজে সে অনেকদিন আগেই তার সমস্ত নেশা লুকিয়ে রেখেছে।

রমণী ঝলসে গেল। সূর্য তাকে খেল। মৃত সৈনিক বসে বসে দেখল।

যুদ্ধ ছাড়াই এত প্রেম এখানে। শুধু শুধুই সে প্রাণ দিয়েছিল।

ভালোবাসে বলেই কি সে কৃষকের থেকে এত দূরে? 

দূরে দূরে আরও কত মৃতজন, ভালবাসার গর্ভে বিচ্ছেদের শর্ত পালন করে।

যুদ্ধ ছাড়াই


প্রযত্নে রবীন্দ্রনাথ, একেবারে প্রান্তিক গ্রাম... যেখানেই পিনকোড গেঁথে ভদ্রলোক পা রাখবেন, সেইখানে হুড়মুড় করে ছলকে ওঠে খঞ্জনা অঞ্জনা। কোপাই শ্রাবণী। ওইখানে গেছো? বিকেল গড়ালো? বাউলরা ভালো? আজ শুক্রবার। হাট বসেছে নিশ্চয়ই? পদ্মাপাড় তো নয় জানিই। খোয়াই, সোনাঝুরি। কী পরেছো? নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনী। তোমার হাতে একগুচ্ছ কাশফুল, কখনও দেখিনি। পলাশ পেয়েছো? কৃষ্ণচূড়া লাল? মালঞ্চ কখন যাবে? কাল? দেখা পেলে? লম্বা দোহারা সেই প্রেমিক লোকটার? কথা হলো? বৃষ্টি হচ্ছে বুঝি?  তোমাদের চোখাচোখি মেঘের ভিতর? কেমন লেগেছে ওর? তোমাকে এত কাছে পেয়ে! গীতবিতানের মেয়ে। প্রযত্নে যার নাম। তাকে এত কাছে পেলে, বর্ষা তো আসবেই ধেয়ে।

গীতবিতানের মেয়ে-১
উজান উপাধ্যায়


১০

(১)

স্নানাগারে বন্দী করলাম। অবশিষ্ট আমাকে। বাইরে হালুম হুলুম আপাতত থমকে গেছে। বাইরের আলো আপাতত নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছে। বন্দীশালার নিজস্ব শব্দের অভ্যাসে ফেনা মাখছে  সারাদিনের আহত ফরমান।

(২)

হাসপাতালের চেহারা এখন বিসর্জনের পরের ঘাটের মতো। কাঠামো খানিকটা ডুবে খানিকটা ভেসে আছে জলে। চতুর্দিকে সিরিঞ্জ, মৃত পতঙ্গ, অচেনা লাশ। একেকটি দেবতার একেকটি ছিন্ন অঙ্গ একেকদিকে।

(৩)

এইসব দৃশ্যে আগ্রহ নেই কোনওদিন। এগুলো ছিল, আছে, থাকবে। নানারকম ঝলমলে পোশাক পরিয়ে খামখেয়ালীপনা আর উন্মত্ত ফড়িং নিয়ে চুটিয়ে নেশা করেছি আনন্দের। বেলুন, পটকা, হেভ্ভি দেখতে প্রেমিকা, চূড়ান্ত সঙ্গম, দারুচিনি বনানীর দ্বীপ, শঙ্খচিল, সাতনরী হার, জলপিয়ানো, রাতপরিদের তুমুল উচ্ছলতা...

(৪)
জন্ম মৃত্যু বিষণ্ণতা দুঃখ নিহত গাছ অবসাদগ্রস্ত পাখি আর লুন্ঠিত মায়ের আঁচল...


(৫)

নো ইয়ার....আমার পৃথিবীতে  শুধু হাজার রঙের ফূর্তি...


(৬)

বন্দীশালায় বসে সর্বোচ্চ মুক্তির স্বাদ আসে...খুলে রাখা পৃথিবীর জিভে শুধু গিঁট গিঁট আর গিঁট।

ছিঁড়ে ফেলছি গিলে ফেলা হাইওয়ে আর উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে। 

(৭)

গত সাতশো বছর আমি পোশাক পরিনি। তবুও আমার উল্লাস দেখে কারও সাহস হয়নি আমাকে উলঙ্গ বলার।

(৮)


হাসপাতালের চেয়ে বড় কোনও দেবালয় আজও বানাতে পারেনি মানুষ।

(৯)


আমি ওখানে বসে আরও নয় হাজার বছর লালনের গান করব।

(১০)

আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। আমি মোনালিসা। আমার নাম পিকাসো। 

(১১)

হিম্মত আছে তো..

হাসো।

প্যারাডাইস@হাসপাতাল_দেবালয়.কম
উজান উপাধ্যায়