রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

 

                                 

   












শ্রাবণের ধারার মত
(পঞ্চম পর্ব)


তাজপুরের রিসোর্টটি বেশ সাজানো গোছানো।ঊশ্রী এখনো বেহুশের মতো ঘুমোচ্ছে।ওর কপালে আলতো করে হাত রাখল দেবপ্রিয়া।ঘুমোক আরেকটু।এই ছোট্ট প্রাণটায় আঘাত তো কিছু কম নয়।ভোরের আলতো আলোর মায়ায় মন যেন জুড়িয়ে যেতে লাগল।অথচ গোধূলি মাসি বুকের ভেতর আস্ত সূর্য বসিয়ে দিয়েছে।সবাইকে আঘাত দিয়েছে দেবপ্রিয়া?বরুণ চিরকাল তার অন্ধ ভক্ত ছিল।তার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক।আকারে প্রকারে ইঙ্গিতে সরাসরি সব রকম ভাবে মুগ্ধতা জানিয়েছে।আর তারপরেও ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে।আর অনুজ সে তো থেকেও ছিলনা।ঊশ্রীর পাঁচ বছরের জন্মদিনেই অনুজকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল দেবপ্রিয়া।অনুজ কথাটা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি মন দিয়ে কিছু পেপারস্ দেখছিল।দেবপ্রিয়া বহুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরে ফিরেছে ঊশ্রীর কাছে।খানিকপর অনুজ ধীর পায়ে বেডরুমে এসে বলে,'ঠিক আছে আজকের রাতটা থাকছি,আগামীকাল চলে যাব।তুমি উকিলের সাথে নিশ্চই কথা বলেছো।মিউচুয়াল ডিভোর্স ফাইল করো আমি সই করে দেবো।'এতটা নির্বিকার হতে পারে কোনো মানুষ!দেবপ্রিয়া ভাবতে পারেনা।অনুজ পরদিন চলে গিয়েছে।আর কখনো বাড়িতে ফেরেনি।কোর্টে এসে সই করেছে চলে গেছে।একবার কোনো খবর জানতে চায়নি ঊশ্রীর বা মায়ের।ডিভোর্সের পর বরুণ এগিয়ে আসার রাস্তা খুঁজেছে সব রকম ভাবে।মাত্র একদিন দেবপ্রিয়া দুর্বল হয়েছিল।সেও তো মানুষ সবাই কি সেটা ভুলে গিয়েছে।ঊশ্রী ভাইরাল ফিবারে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল সে সময়, এদিকে দুটো বড়ো হাউসের লেখা জমা দিতেই হবে।রাত জেগে জেগে মাইগ্রেনের পেন বেড়েছে।ঠিক তার মধ‍্যেই ওর মা দিপালীর সিঁড়ি থেকে পড়ে বাঁ দিকের ফিমার ভেঙে গেল।অসহায় দেবপ্রিয়ার পাশে বরুণ এসে দাঁড়াল ত্রাতার মত।লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ডাক্তার, নার্সিংহোম, ওষুধ বাড়ির দায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল।ক্লান্ত ধ্বস্ত দেবপ্রিয়া।

-এভাবে একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছ যে?কী হয়েছে কাঁদছ নাকি তুমি?প্রিয়া?

-নাহ্ আমার কাঁদবার অধিকার নেই বরুণ।একজন মানুষ সারাজীবন বাইরের টানে ঘরের দিকে ফিরেও চাইল না।আমার ভালোবাসা, ইচ্ছে,জীবন সব একা গহীন রাতের তারা হয়ে জেগে রইল।কোণঠাসা হতে হতে ছেড়ে যাবার কথা উচ্চারণ করলাম কী করলাম না,সব শেষ হয়ে গেল।আমার হাত শূন‍্য হয়ে গেল।তবু আমায় কাঁদতে নেই।মেয়ে আর মা এই তো সম্বল।দুজনাই অসুস্থ অথচ আমায় কাঁদতে নেই।

-এমন ভাবে বলছো কেন প্রিয়া?

-কারণ আছে বরুণ,আজ তথাকথিত পড়াশোনা জানা সংস্কৃতি মনস্ক এক মানুষ আমায় বলেছেন,'তোমার মনটা খুব স্ট্রং দেবপ্রিয়া,অন‍্য কোনো মেয়ে হলে কেঁদেকেটে শেষ হয়ে যেত।ভালো ভালো।যে ভাবে লিখে যাচ্ছো মনটা পাথর না হলে এ পরিস্হিতিতে লিখতে পারতে না।অবশ‍্য হ‍্যাঁ রবীন্দ্রনাথ পারতেন।' ভাবতে পারছ আমি কতটা নির্দয়?

কথাটুকু শেষ করতে পারেনা ফুলেফুলে ওঠে।ভীষণ আবেগ পথ খোঁজে বাইরে বেরিয়ে আসার।বরুণ এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে।আঙুল দিয়ে মোলায়েম ভাবে মাসাজ দিতে থাকে।

-মানুষ আঘাত কাকে করে জানো?যাকে সে ঈর্ষা করে,তার মতো হতে চায় কিন্তু তার সাধ‍্যে কুলায় না।আর তুমি!তোমার মেধা ঈর্ষণীয় তোমার রূপ লোভনীয়।অথচ তোমাকে কেউ ছুঁতেও পারে না।তো তোমাকে আঘাত করবে না?

বরুণের আঙুলের ছোঁয়া ধীরে ধীরে নেমে আসছে ঘাড় বেয়ে।বহুদিন পর সুখে জারিত হচ্ছে দেবপ্রিয়া।পদ্মকুঁড়িতে মৃদু সুখ কাঁটা।ডুবছে জাগছে।বরুণ দীর্ঘদিনের অপেক্ষা প্রবল আশ্লেষে পূর্ণ করতে লাগল।ভেসে গেল একটা রাত।ছাদের গন্ধরাজ ফুলগাছটা সাক্ষী কী ভীষণ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছিল দেবপ্রিয়া।


-চলে যাও বরুণ প্লিজ।এসব আমি চাইনি।ছিঃ ছিঃ।

-কেন প্রিয়া?আমি তো কাওকে বঞ্চনা করছি না।তোমার কাছেও কিছু চাইছিনা।তোমার পাশে থাকতে চাই।তোমার সঙ্গ চাই।তোমার মনন,মেধা আমার বেঁচে থাকাটা সুন্দর করে।প্লিজ প্রিয়া।

-নাহ্ বরুণ!জোনাক আমার পিসতুতো বোন কেবল নয়,ও আমাকে ভীষণ মান‍্য করে আমি কিছুতেই ওকে ছোট করতে পারবো না।প্লিজ বরুণ।আর এগোনোর চেষ্টা করো না।

এসব ভাবতে ভাবতে কেঁপে উঠল দেবপ্রিয়া এরপরেও বরুণ কতবড়ো সর্বনাশে মেতে উঠেছিল।এরপরেও গোধূলিমাসির মনে হয় সেই সবাইকে আঘাত দিয়েছে।এই কি জীবনের পরিহাস!









শ্যামলী আচার্য

                                  


মৃত্যু অথবা  
 (পঞ্চম পর্ব)

চা অ্যান্ড টা--  বাঙালির রিল্যাক্স স্টেশন। বাঘাযতীন আই ব্লকে আনকোরা নতুন একটি টী-বুটিক। চায়ের সঙ্গে টা রয়েছে, আর রয়েছে অপূর্ব অন্দরসজ্জা। ঢুকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুটি ঘর। মুখোমুখি আর বৈঠকী। মুখোমুখিতে এসে বসে দুজন। রাণা আর দীপু। ওরা আসার মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পৌঁছয় কিরণমালা। 

“অত্যাধুনিক চায়ের দোকান, কী বলিস?” দীপুর কথায় হেসে ফেলে অর্ণব। এই বুটিকের তরুণ কর্ণধার। 
“তা বলতে পারেন দাদা। তবে কিরণদি এই প্রথম এল। ফেসবুকে রেগুলার ছবি দেখে, কমেন্ট করে, ভাবিনি বিদেশ থেকে এসে আমার এখানে পায়ের ধুলো দেবে।” 
“অর্ণব, তুই কি কি সার্ভ করবি দেখ, আমরা কাজের কথা সেরে ফেলি চটপট।” কিরণের কথায় একগাল হেসে অর্ণব বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। 
ইরাবতী সান্যালের মৃতদেহ পড়েছিল বাথরুমের দরজার বাইরে। অন্তত প্রত্যক্ষদর্শী মালতী তেমনই বলেছে সকলকে। সকালে আটটা নাগাদ ঘরের দরজা খুলে সে ভেতরে ঢোকে। বাথরুমের দরজায় মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন ইরাবতী। মালতী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে আর অনমিত্রকে ফোন করে। ডাক্তার এসে জানান প্রায় শেষরাতে মৃত্যু হয়েছে। তখন কিংশুক রায় কলকাতার বাইরে। তাঁকে খবর দিয়ে আনা হয়। আর বাড়িতে মানুষ বলতে ওই অনমিত্র। ইরাবতীর ভাই। পুলিশি ঝামেলা সন্তর্পণে এড়ানো হয়। কেউই পোস্টমর্টেমের নামে কাটাছেঁড়া করতে চাননি।  
“আচ্ছা, এই মালতী, যে আপনার মা’কে শেষবার দেখেছিল, সে এখন কোথায়?”   
কিরণমালা বলে, “সে নাকি সেইদিনই কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। এমনকি মায়ের দেওয়া কোনও জিনিস সে নিয়ে যায়নি। আমি কলকাতায় ফিরে অবধি তাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি, তার ফোন সুইচড অফ। মালতী আমাদের বাড়ির অনেক পুরনো লোক। তার চলে যাওয়াতেই আমার সন্দেহ বেড়েছে... তোমরা জানো, আগামী রবিবার, ঠিক সাতদিন পরে মায়ের স্মরণসভা। আমি খুব চেয়েছিলাম মালতীদি অন্তত সেইসময় আসুক। কিন্তু, আমি তো তার বাড়ি চিনি না, ফোনও বন্ধ...। যতদূর জানি তার বাড়ি ডায়মন্ডহারবারে, উস্থিতে।”  
“মালতীর ছবি থাকলে দিন। আর, অবশ্যই ফোন নম্বর। তিনজন সম্পর্কে একটু ডিটেলে দরকার। মালতী, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, অনমিত্র সান্যাল তো বটেই...।” 
রাণার কথায় কিরণমালা একবার তাকায় দেওয়ালের দিকে। সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত সিনেমার পোস্টার দিয়ে একটা চমৎকার কোলাজ টাঙানো রয়েছে দেওয়ালে। সেদিকে তাকিয়ে বলে, “ভালো করে দেখো, সবটাই কেমন মিলেমিশে একাকার করে দেওয়া হয়েছে। টোটালিটিতে কোলাজটা অপূর্ব, আবার ছবিগুলো আলাদাভাবেও...”, বলতে বলতে যেন সম্বিত ফিরে আসে কিরণমালার, “সহেলি নন্দী বাবার এখনকার পিএ। আগের পিএ ছিলেন রাজীব বর্মণ। তিনি মারা গেছেন। এর বেশি আমি এদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না। এখন আমাদের ডাক্তার বিতান রায়চৌধুরী, ওনার বাবা বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরী আসলে আমাদের এই পরিবারের ডাক্তার ছিলেন একসময়। ডাক্তারজেঠুকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি। ডাক্তারজেঠু কিন্তু আমার বাবার কাকার বন্ধু, কিন্তু তাঁকে দাদু না বলে জেঠু বলতাম। উনি খুব আসতেন, আমিও গিয়েছি ওঁদের বাড়িতে। ওনার বয়স হয়েছে অনেক। শুনেছি ডিমেনশিয়া ধরা পড়েছে। বিতানদাই এখন আমাদের বাড়ির ডাক্তার। ল্যান্সডাউনে বাড়িতে পুরনো চেম্বারে বসেন, আর নিজের আলাদা চেম্বার আছে বালিগঞ্জে। আমি বিতানদার পার্সোনাল নম্বর দিচ্ছি।” 
বিতান রায়চৌধুরীর নাম খুঁজে নম্বর বের করে দেয় কিরণমালা।    
“আর আপনার মামা, অনমিত্র...” 
কিরণমালা ঢোঁক গেলে। স্পষ্টই একটা অস্বস্তি। 
“আমার মা ইরাবতী সান্যালরা তিন ভাই-বোন। আমার মা বড়। তার পরে অনমিত্র আর অনিন্দিতা যমজ। অনিন্দিতা অর্থাৎ আমার মাসির বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে। ডাকসাইটে সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তা’ই ছিলেন।” 
“ছিলেন মানে?” কিরণমালাকে বাধা দিয়ে জিগ্যেস করে রাণা।
“ছিলেন, কারণ অকালবৈধব্য তাঁকে অনেক সমস্যায় ফেলে। একই সঙ্গে আমার মায়ের বাবার পক্ষে সওদাগরি অফিসের সামান্য বেতনের চাকরি সম্বল করে তিন ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করা কঠিন ছিল। যদিও আমার মায়ের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা খুবই গুণী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের ছিল বইয়ের নেশা। মেহগনি কাঠের দুটি আলমারি আর ট্রাঙ্কে ছিল প্রচুর বই। সাধ করে একটা পড়ার টেবিল পর্যন্ত বানিয়েছিলেন। আর একটি ইজিচেয়ার। কালক্রমে সেই টেবিল আমার মায়ের সম্পত্তি। শুনেছি দাদু কবিরাজি চর্চা করতেন। প্রচুর মানুষের উপকার করতেন এরা দু’জন। নিজেরা না খেয়ে অন্যকে খাবার খাইয়ে দিতেন। সংসারে একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না। মা তাঁদের ওই গুণটি পান। মায়ের বাবা-মা একটি বছর উনিশের বিধবা মেয়ে, একটি অপোগণ্ড ছেলে এবং একটি কলেজে পড়া বাইশ বছরের মেয়েকে পৃথিবীতে ফেলে রেখে অকালে অতি অবিবেচকের মতো মারা যান। তখনও আমার মায়ের ঠাকুর্দা বেঁচে। তিনি কি ভেবে, সেই একটি ছোট্ট বাড়ি, ঠাকুর্দার নিজের নামে, সেটি উইল করে দিয়েছিলেন আমার মায়ের নামে। কেউ জানত না। মা একদিন ট্রাঙ্কের ভেতর সেটি খুঁজে পান। মায়ের ডেস্কে সেই উইল আমি নিজে দেখেছি। ঠাকুর্দার একটা খাতা ছিল... অনেক কবিরাজি ওষুধ লেখা ছিল তাতে... সেটাও মা খুব যত্ন করে রেখেছিলেন।   
“মায়ের ঘাড়ে সংসারের চাপ এসে পড়ে। মা পড়তে পড়তেই চাকরির চেষ্টা করেন। নানানরকম কাজের অভিজ্ঞতা হয়। কখনও স্কুলের পার্ট-টাইম চাকরি, কখনও ছোট অফিসে রিসেপশনিস্ট, সেলস-গার্লের কাজও নাকি করেছেন। এতরকম জীবন দেখছেন বলেই বোধহয় অত সাবলীলভাবে সেসব লিখতে পারতেন মা।” 
দীপু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। সাহিত্যিক ইরাবতী সান্যালের এই অতীত জীবন কেউ জানেন কী? একটু উসখুস করে সে কিরণমালাকে প্রশ্নটা করেই ফেলে। 
কিরণমালা একটু হাসে। করুণ হাসি। “মায়ের অতীত জানি শুধু আমি। মা বাইরের কাউকে বলত না। মা অতীত ভাঙিয়ে খেতে চাইত না।”   
“কিংশুক রায়ের সঙ্গে বিয়েটা তাহলে...”
রাণার প্রশ্ন শুনে কিরণমালা বলে, “সেই কথাতেই আসছি। আমার মাসি অনিন্দিতা নিজের দুর্ভাগ্য মেনে নিতে পারেনি। পাশের পাড়ার একটি বাউণ্ডুলে ছেলের সঙ্গে সে ঘর ছাড়ে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। আর কোনও খোঁজ রাখেনি কেউ। আমার মামা বেশিদূর পড়েনি। কোনওক্রমে ঘষেমেজে পাস গ্র্যাজুয়েট। মাথার ওপরে কেউ নেই। এই সময়ে একটি কোম্পানিতে মা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন আমার বাবা কিংশুক রায়ের কাকা কল্যাণ রায়। এই কোম্পানির গোড়াপত্তন তিনিই করেন। চাকরি পাওয়ার প্রায় বছরতিনেক পরে এই বাড়িতে মায়ের বিয়ে। যদিও সেটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেকেই এই বিয়ে মেনে নেয়নি। একেবারে পিতৃ-মাতৃহীন একটি মেয়ে, তার বিধবা বোন পালিয়েছে, ভাই অকালকুষ্মাণ্ড... তবুও একেই কেন? তবে ডাক্তার জেঠু মা’কে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তিনি এই বিয়ে সমর্থন করেন। কল্যাণ রায় আর তাঁরই ছেলেবেলার বন্ধু ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরীর চেষ্টায় এই বিয়ে হয়। অদ্ভূত ব্যাপার হল, মায়ের বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যে কল্যাণ রায় আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে স্পষ্ট লিখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কিন্তু জেঠু বলতেন, কল্যাণের মৃত্যুর জন্য দায়ী সিস্টেম। সেটা ঠিক আজও আমি বুঝতে পারিনি।”             
“কিন্তু একটা বিষয় এখনও পরিষ্কার নয়। ইরাবতী সান্যালকে মেরে কার কী লাভ হতে পারে?”
“লাভ প্রত্যেকের। ইরাবতী সান্যালের নামে কোম্পানির শেয়ার, কল্যাণ রায় মা’কে বিয়ের সময় কোম্পানির কিছুটা অংশের ভাগ লিখে দিয়ে যান। এই বাড়ির অর্ধেক মালিকানা মায়ের। আমার মামা যে বাড়িতে থাকেন, সেটিও তাঁর নামে নয়। জানিনা, মা’কে চাপ দিয়ে মামা নিজের নামে বাড়ি লিখিয়ে নিয়েছেন কিনা। তবে মায়ের একটি অপ্রকাশিত আত্মকথা রয়েছে। সেটাতে মারাত্মক সব তথ্য লিখেছেন মা। সে তথ্য নাকি অনেকের জীবন উল্টেপাল্টে দিতে পারে। তার আভাস আমি পেয়েছি।”     
“আত্মকথা, আই মীন, নিজের জীবনের কথা?”   
“হ্যাঁ। আমি যতদূর জানি, সেটি ‘ভাষা আঙিনা’ পত্রিকার জন্য রেডি করছিলেন, শেষ পর্যন্ত মা জমা দিয়েছিলেন কিনা আমি জানি না। খুবই বিতর্কিত সব তথ্য রয়েছে। মা বলেছিলেন, ওই আত্মজীবনী প্রকাশিত হলে অনেকের খুব অসুবিধে হতে পারে...”     
“কার অসুবিধে? কিংশুক রায়ের?”
কিরণমালা চুপ করে থাকে। বলে, “আমি জানি না।” 
“আচ্ছা বেশ,” রাণা প্রশ্ন ঘুরিয়ে নেয়, “আপনার মামাকে তো দেখলাম। আপনার মাসি, যিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন, তিনি এখন কোথায়?”
কিরণমালা ঘড়ির দিকে তাকায় একবার। “তিনি বেঁচে নেই বলেই জানি। অন্তত মা আমাকে তাই বলেছিলেন। তাঁর কোনও ছেলে-মেয়ে ছিল কী-না... নাঃ, মা তাঁর কথা কখনও বলতেন না... কিন্তু মামা যে ফ্যাকটরিতে কাজ করতেন, সেটা বন্ধ হয়ে যাবার পর মা’ই বাবাকে বলে কিছু কাজ জোগাড় করে দেন। মামা প্রায়ই আসতেন। টাকা-পয়সা চাইতেন। কীরকম যেন হিংসে করতেন সকলকে... ভালো লাগত না। আমার বিয়ের পর ও-ই তো সব... যাক গে, আমাকে এবার উঠতে হবে। এবার তোমাদের হাতে বাকি কাজের ভার রইল,” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় কিরণমালা।   
“ইরাবতী সান্যাল বহরমপুরে থেকে চাকরি করেছেন বহুদিন। সেই সময়কার কথা জানেন কিছু?”
“নাঃ। মা কখনও অতীতের কথা চট করে বলতে চাইতেন না।” 
“ইরাবতী সান্যালের উইলটা দেখেছেন আপনি?”
কিরণমালা পিছন ফিরে তাকায়। “যতদূর জানি, মায়ের উইল অনুযায়ী মায়ের সব বইয়ের কপিরাইট আমার। আর মায়ের সেই বাড়িটি, যেটিতে এখন আমার মামা-মামী থাকেন, সেটিও আমার নামে ট্রান্সফার করেছেন...ডেস্কের ওই তালাটা তো নতুন। ভাঙলে হয়ত দেখা যাবে গয়নাগাঁটি কিছুই নেই...। এসে অবধি লেখার পাণ্ডুলিপিটাও খুঁজে পাইনি। মায়ের কম্পিউটারে যা রয়েছে, সব বছরখানেক আগের লেখা। সাম্প্রতিক লেখা কিচ্ছু নেই...।”   
“আপনি ব্যাংকের লকারে গিয়েছিলেন?”
“গিয়েছিলাম। লকারে খুব সামান্য কিছু রয়েছে। মায়ের গয়নার প্রতি মোহ ছিল না। শুধু একটা হিরের আংটি মায়ের ডেস্কে থাকত। আর একটা পুরনো ডিজাইনের কানপাশা, কঙ্কন আর বিছেহার। ওগুলো মা কেন জানি না ওই ডেস্কেই রাখতেন।” 
“ওই গয়নাগুলো কার দেওয়া কিছু জানতেন?” 
“বিয়েতে ডাক্তারজেঠু দেন।”   
( ক্রমশঃ)

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                



মৃত্যু অথবা  ( পর্ব ৪)



কিরণমালা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগে দীপুর। 

“উফ! পুরো সিনেমা!” 
“ভুল করছিস দীপু,” রাণার দুটো ভুরু সেই যে কুঁচকে আছে, সে বলে, “তুই শুনিসনি, ট্রুথ ইজ স্ট্রঙ্গার অ্যাণ্ড ডেফিনিটলি স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন... সত্য ঘটনা গল্পকেও হার মানায়... কিন্তু বড় দ্রুত কাজ করতে হবে, আর তার চেয়েও মারাত্মক, কিংশুক রায়ের বাড়িতে না ঢুকলে ইরাবতীর থাকা-খাওয়া-বসার জায়গাগুলো দেখা মুশকিল।” 
রবিবারের সকালে বাংলা-ইংরেজি অনেকগুলো কাগজ উড়ছিল সোফার ওপর। রাণা একমুহূর্ত তাকায় সেদিকে। 
“পেয়েছি” বলেই মোবাইলে নম্বর খুঁজে ডায়াল করতে থাকে রাণা।   
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ‘কালকণ্ঠ’ থেকে বলছি, ইরাবতী সান্যালের ওপর একটা কভার স্টোরি হচ্ছে আমাদের। অ্যাকচুয়ালি ওনার পুরনো ইন্টারভিউ আছে আমাদের কাছে, স্মৃতিচারণে বহু বিদগ্ধ মানুষ কথাও বলেছেন, কিন্তু আমাদের একটা অনলাইন পোর্টালে আমরা ভিডিও ক্লিপ আপলোড করি। সেখানে আমরা ওনার বসার ঘর, মানে স্পেশালি ওনার লেখার জায়গা, বইপত্র একটু ভিডিও করে দেখাতে চাইছি। যদি পারমিশন দেন... আজই দুপুরের দিকে... না না, একদমই বেশি লোকের ব্যাপার নেই, আমি একাই যাব, বড়জোর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট, ওই একজন ক্যামেরায় থাকলে আলো-টালোগুলো একটু দেখে নিতে হয় আর-কি... না না, আপত্তি থাকলে আমি একাই আসছি... আমাদের কাজটা শেষ করতে হবে চটপট, বুঝতেই পারছেন...। আমাদেরও তাড়া আছে...।”  
ফোন রেখে জোরে একটা শ্বাস ছাড়ে রাণা। 
“ইয়েস! ডান।” 
দীপু তাকায়, “খেয়ে বেরোবি তো?”
“অবশ্যই। আর তুইও যাচ্ছিস। জানি রবিবার দুপুরে ল্যাদ খাওয়া ছাড়া তোর কোনও কাজ থাকে না। শুধু বড় ক্যামেরাটা বের করে গলায় ঝোলা। আর হ্যাঁ... পুলিস বন্ধুটির সঙ্গে কথা বলে নিই একটু।”  
অরিন্দমকে ফোনে যোগাযোগ করতে বেশ সময় লাগল। তার মধ্যেই দু’জনে সাংবাদিক হিসেবে কিংশুক রায়ের বাড়িতে ঢোকার জন্য রেডি। ঠিক হল, ইরাবতীর বাড়ির ছবি তুলে সোজা যাবে অরিন্দমের কাছে। সে ততক্ষণে লোকাল থানায় কথা বলে রাখবে। কোনওভাবে রাণার ইনভেস্টিগেশন নিয়ে শুরুতেই জানাজানি হয়ে গেলে পুরো কেস যাবে ভেস্তিয়ে। 
বাড়ি নয়। প্রাসাদ বলাই ভালো। বিশাল গেটে চারজন সিকিওরিটি। নাম-ঠিকানা লিখে পরিচয়পত্র দেখিয়ে, ফোনের কল রেকর্ডে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই ভেতরে ঢোকা গেল। বিরাট লন এবং সাজানো বাগান পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। 
“আপনারাই ছবি তুলতে এসেছেন? নমস্কার। ভেতরে আসুন। আমি অনমিত্র সান্যাল।”
“আপনি কি এই বাড়িতেই... মানে আপনি কি কিংশুকবাবুর আত্মীয়?” 
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ইরাবতী ছিলেন আমার দিদি। আমিও এই বাড়িতে থাকি। বৌ-ছেলে-মেয়ে বারাসতে। ওদেরকে দেখেশুনে আসতে হয়। আসলে কিংশুকবাবুর ব্যবসার খুব সামান্য অংশের দায়িত্ব আমার ওপরে, আর দিদির দেখাশোনা মূলত আমিই করতাম।”  
“দেখাশোনা মানে?” বাইরের সুসজ্জিত ঘর ছাড়িয়ে ততক্ষণে দোতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন তিনজন, রাণা প্রশ্ন করতে করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে নজর করছে চারিদিক। কিরণমালাকে জানায়নি ওরা আসছে। সে কি এই বাড়িতেই রয়েছে আপাতত?   
“দিদির একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকে, দিদির একার পক্ষে নিজের লেখালেখি সামলে সংসারের চারদিক লক্ষ্য রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক ছোটবেলা থেকেই দিদি খাটাখাটনি করছে। একটা সময় কলকাতার বাইরে বহরমপুরে বহুদিন একা থেকে চাকরি করেছে। সংসার টেনেছে। সেইসময় অসুস্থও হয়ে পড়েছে ও...”
“কী অসুখ?” 
অনমিত্র এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে বলে, “সে তো ঠিক মনে নেই। আমি অতশত... আসলে আমি তখন কারখানায় কাজ পেয়েছি। যেতেও পারিনি। একাই থাকত দিদি বহরমপুরে। খুব ভুগেছে।” 
“তাহলে সেই সময় ইরাবতীকে দেখাশোনা করতেন কে?”  
 “কল্যাণ রায়। এই কোম্পানির হর্তাকর্তা সব উনিই ছিলেন। আর ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরী। উনি এই কোম্পানির মালিকের বন্ধু ছিলেন। ওই সময় কোম্পানি অনেক দায়িত্ব নিয়েছিল দিদির...”   

রানা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে চারপাশ। 
“আমার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পরে কিংশুকবাবুর সঙ্গে এসে কথা বলি কাজের ব্যাপারে... এটা দিদির স্টাডি রুম। এখানেই অধিকাংশ সময় থাকতেন। পাশে বেডরুম। অ্যাটাচড বাথ। বহুদিন এমন হয়েছে লিখতে লিখতে ওখানেই গিয়ে শুয়েছেন। শেষের দিকে বছরখানেক ওটাই রুটিন হয়ে গিয়েছিল। যেদিন দিদি চলে যান, ওই বাথরুমেই তো... সকালের আগে কেউ কিচ্ছু টের পাইনি আমরা...”।   
“আচ্ছা, কিংশুকবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলা যায়?” 
“সেটা দেখছি। ওনার পিএ-র সঙ্গে কথা বলতে হবে। আজ হবে না।” 
“উনি যেদিন মারা যান, তার দিনকয়েকের মধ্যে ওনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিলেন?”
“কেন বলুন তো?” চোখ সরু করে জিগ্যেস করে অনমিত্র।
“না, আসলে সাহিত্যিকের ডকুমেন্টেশন, যদি কোনও প্রকাশক, লেখক এসে থাকেন...”
“সেরকম কেউ আসেননি। দিদি বাড়িতে কাউকে ডাকত না।” 
অনমিত্রর কথা শুনতে শুনতে দোতলার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে যে বিরাট ঘরটির দরজায় দাঁড়াল ওরা, সেই ঘরটির মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত বইয়ের র‍্যাক। পুরনোদিনের লোহার শিক দেওয়া জানলা, মেঝে থেকেই জানলা শুরু। জানলার কাঠের কপাটে খড়খড়ি। তাঁতের পাড়বসানো উজ্জ্বল হলুদ রঙের পর্দায় আলো ঠিকরে পড়ছে। পর্দার বাইরে অসংখ্য সবুজ পাতার আবছায়া। বাগানের বড় গাছেদের মমতামাখানো ঘর। বই, আলো-বাতাস আর তাজা প্রকৃতি... লেখার জন্য আদর্শ। একটা জানালার দিকে মেহগনি কাঠের পড়ার টেবিল। সেখানে কম্পিউটার। আর রয়েছে একটি বড় ছবি। এই ঘর যাঁর তিনি এখন সেই ছবির ফ্রেমে বন্দি। রাণার ইশারায় দীপু ক্যামেরা অন করে এগিয়ে যায় পড়ার টেবিলের দিকে।  
“এই এত বড় লাইব্রেরি কি ইরাবতী দেবীর?” 
“না। এই লাইব্রেরি দিদির খুড়শ্বশুর কল্যাণ রায়ের। ওই যে, ওনার ছবি।” অনমিত্র দেখায় একটি বইয়ের র‍্যাকের পাশে একজন বছর চল্লিশের পুরুষ। সপ্রতিভ, তীক্ষ্ণ চেহারা। পাশের র‍্যাকে আরও কিছু ছবি। একটি ইরাবতী আর কিংশুকের অল্পবয়সের। সম্ভবত নতুন বিয়ের পরে তোলা। আরেকটিতে চারজন দাঁড়ানো। কল্যাণ কিংশুক আর ইরাবতী ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তিটি সম্পর্কে রাণা জিজ্ঞাসা করে অনমিত্রকে।
“উনি ডাক্তারবাবু। বিশ্বেশ্বরবাবু। কল্যাণবাবুর বাল্যবন্ধু। এই লাইব্রেরি আর বেডরুম সব কল্যাণ রায়ের।”   
“কল্যাণবাবু বিয়ে করেননি?”
“না। ওনার হাতেই এই কোম্পানি শুরু। বাপ-মা মরা ভাইপোকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেন। তিনিই দিদির সঙ্গে নিজের ভাইপোর বিয়ে দেন।” 
“এই ঘরে ফ্ল্যাশ দরকার হবে না।” দুজনেই পরিচিত কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায় পিছনদিকে। 
দরজায় কিরণমালা দাঁড়ানো। সে একের পর এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরে। অনমিত্র একটু যেন বিরক্ত। “তুমি আবার আসতে গেলে কেন? ওঁরা ছবি তুলবেন, চলে যাবেন...”  
“ওঁরা আমার খুব পরিচিত। দোতলার ঘর থেকে ওঁদের আসতে দেখলাম... তা-ই।”  
রাণার চোখ ততক্ষণে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে চারপাশের যাবতীয় জিনিস। ভীষণ পরিপাটি, ঝকঝকে পরিষ্কার। যেন সব গুছিয়ে রেখে কেউ বেরিয়েছেন ঘর থেকে, আবার এসে বসবেন জানলার পাশের চেয়ারে। 
“ইরাবতী দেবী ডায়েরি লিখতেন? বা, এমনি হাতের লেখা কিছু পাওয়া যাবে? মানে, বুঝতেই পারছেন, একজন লেখকের হ্যাণ্ডরাইটিঙের ওপর দিয়ে ক্যামেরা প্যান করে গেলে... সেটার আলাদা ইমপ্যাক্ট...” 
অনমিত্র একটু অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“মায়ের ডায়েরি ছিল ছিল না। কিন্তু একটা বড় খাতা ছিল। বাঁধানো। রুলটানা কাগজ আর ওপরে কালচে নীল রঙের শক্ত বাঁধাই। সোনার জলে নাম লেখা ছিল ‘ইরাবতী’, আমি ছেলেবেলায় দেখেছি। মা বলছে, ওটা নাকি মায়ের ঠাকুমা মা’কে দিয়েছিলেন। আমি শুনেছি, তিনিও লেখালেখি করতেন। মা ওই খাতায় মায়ের ছোটবেলার কথা লিখতেন। আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন।”    
কিরণমালার কথায় রাণা উত্তেজিত হয়ে ওঠে, “আরেব্বাস! এটা আমার স্টোরিতে বাড়তি অ্যাট্রাকশান। খুব ভালো হত যদি সেই বাঁধানো খাতা ক্যামেরায় রাখা যেত...”   
কিরণমালা অনমিত্রের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, “মামা, আমার মনে হয়, ওঁদের এই সব জিনিস তুমি দেখাতে পারবে... তুমিই সব দেখে রাখতে...” 
অনমিত্র ঝাঁজিয়ে ওঠে, “সারাদিন তোমাদের বাড়ির ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে... লেখাপড়ার অত খুঁটিনাটি জিনিসের খোঁজ আমি রাখিনি...”।  
“তাহলে মায়ের ডেস্কের চাবিটা দাও। ওটা খুলে খাতাটা পাওয়া যেতে পারে।”  
“ডেস্ক!” আকাশ থেকে পড়ে অনমিত্র, “ডেস্কের আবার তালা দেওয়া থাকত নাকি? আমি এসব জানতামই না... তবে দিদি একবার কোন চাবি হারিয়েছে বলছিল... আমি মিস্তিরি ডাকলাম... সেটাই?” 
“সে আবার কি! মা অত বড় টেবিলটায় বসে লিখত, পড়ত, দাদুর ওই টেবিলটা তো মায়ের প্রাণ!” বলতে বলতেই বিরাট জানালার সামনে মেহগনি টেবিলের সামনে চলে যায় কিরণমালা। ডেস্কই বটে। এবং তাতে তালা দেওয়া। নতুন ঝকঝকে তালাটা দেখেই কিরণমালা চেঁচিয়ে ওঠে, “এই তালাটা কবে এল? মায়ের তো এই তালা ছিল না।”   
অনমিত্র বিরক্তমুখে এগিয়ে আসে। কিরণমালা হঠাৎ বলে, “ইস! ওঁরা কতক্ষণ এসেছেন, একটু জলও দেওয়া হয়নি। মামা, প্লিজ একটু চা-কফির ব্যবস্থা করো। তোমাকে বলা হয়নি, এই ক্যামেরা গলায় ভদ্রলোক আমার কলেজের জুনিয়র। আমি দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছি।” 
কিরণমালার গলায় কর্তৃত্ব আর অনুরোধ মিশিয়ে এমন একটা স্বর ছিল, অনমিত্র দোনামোনা করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ‘কলেজের জুনিয়র’ কথাটা ওনার বিশ্বাস হয়েছে বলে মনে হল না। 
অনমিত্র বেরিয়ে যেতেই ছুটে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয় কিরণমালা। ডেকে দেখায় দুজনকে, “এই ডেস্কটা দেখ তোমরা, এই তালা ভাঙা হয়েছে, আমি শিওর।” 
মেহগনি কাঠের গাঢ় কালচে রঙে স্পষ্ট আঁচড়ের দাগ। ধারালো ধাতব বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। পুরনো নয়, একেবারে টাটকা নতুন দাগ।  
“চাবিটা হয়ত সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল।” 
রাণার প্রশ্নে কিরণমালা বলে ওঠে, “এই তালার কোনওদিনই চাবি ছিল না। আমি ইচ্ছে করেই চাবির কথা তুললাম... এখানে একটা কম্বিনেশন লক ছিল, তার সিক্রেট নম্বর জানত মা, আর ... আর জানতাম আমি।” 
“কিন্তু কী ছিল এই ডেস্কে? আপনি জানেন?” 
“না, কিন্তু আমি আন্দাজ করতে পারি। এই ডেস্কে আমার ঠাকুর্দার একটা উইল ছিল। সেই উইল আমি নিজে দেখিনি, গল্প শুনেছি। ঠাকুর্দা আর ঠাকুমার হাতে লেখা খাতা ছিল। ওগুলো মায়ের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কল্যাণ রায়, মানে আমার বাবার কাকার একটা ডায়েরি ছিল। আর... আমার মায়ের উইলও ছিল। মা উইল করেছিলেন, আমাকে বলে গেছেন। আর আমি যদ্দূর জানি মায়ের কিছু গয়নাও এখানেই থাকত। বিয়েতে পাওয়া কিছু আশ্চর্য গয়না মা কেন জানি না ব্যাংকের লকারে না রেখে এখানেই রাখতেন...” কথা শেষ না করেই দরজার দিকে তাকায় কিরণমালা, “আমি পরশু দেশে এসেছি। এই ঘরে যতবার আমি ঢুকেছি, ততবার কেউ না কেউ কোনও না কোনও ছুতোয় আমার সঙ্গে আসছে, কিছুতেই এখানে আমাকে একা থাকতে দিচ্ছে না ওরা।” 
“ওরা কারা?” 
“আমার মামা, যাকে দেখলেন, আর নতুন একজন কাজের লোক এসেছে, আমার বিয়ের পর রাখা হয়েছে, সে এসে কেবল এটাসেটা জিগ্যেস করছে... আর... আর একজন কিংশুক রায়ের নতুন পিএ। তিনবেলা আসছে, যাচ্ছে, পাহারাদারি করছে। আমাকে দেখেই কেঁদে ভাসাচ্ছে, যেন মায়ের মৃত্যুতে ও অনাথ হয়ে গেল...”  
“আপনি চটপট এদের ফোন নম্বর পাঠাবেন আমায়। আর এদের সম্বন্ধে যা জানেন...”   
বলতে বলতেই ভেজানো দরজা খোলার শব্দ হয় আর দীপু চেঁচিয়ে বলে, “উঁহুহু কিরণদি, ওই পোজে দাঁড়িও না, অ্যাঙ্গেলটা ঠিক লাগছে না...” কিরণমালা ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ইরাবতী সান্যালের ছবিটা দু’হাত দিয়ে তুলে নেয় বুকের কাছে, “এবার?” 
রাণা আড়চোখে দেখে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে অনমিত্র ঢুকছে ঘরে। পিছনে একজন বয়স্ক লোক, তার হাতে খাবার বোঝাই ট্রে।       
কিরণমালা বলে ওঠে, “দীপু, তোমাদের ছবি তোলা কতক্ষণে শেষ হবে? আমি একবার যাদবপুরে যাব। আমার এক জুনিয়র বন্ধু অর্ণব একটা টী-বুটিক খুলেছে। চা অ্যাণ্ড টা। যেতে বলেছে একবার। আজকেই ঘুরে আসি...” কথা বলতে বলতেই খাবার সাজানো হয় প্লেটে আর কিরণমালা বলে, “মায়ের মৃতদেহ কোথায় পড়েছিল দেখবে না তোমরা?”     
  .......................................................................................................................................

সৌমী আচার্য্য

                                            



শ্রাবণের ধারার মতো



পর্ব-৪

মাদিকেরীর বুকের ভেতর পাহারের কোলে ছোট্ট জনপদ কাদাগাদাল।কফি বাগানের মাঝেমাঝে পাহাড়ের ঢালে ছোটছোট ছিমছাম বাড়িঘর।সহজ সরল মানুষজন।সকলেই প্রায় কর্ণাটকের আদিবাসিন্দা।মহেশ এখানে মানিয়ে নিয়েছে খুব ভালো ভাবে।গ্রামের সকলেই তাকে বিশেষ ভালোবাসে।সদ‍্য গড়ে ওঠা রিসর্ট,হোমস্টে,হোটেল সবকিছুর উপর তার কড়া নজরদারি।কোনভাবেই অঞ্চলের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে দেবেনা।নেচার মাদার এনজিওর কর্মী হিসেবে বছর তিনেক হল এখানেই রয়েছে।ধীরে ধীরে নিজের আধিপত‍্য বিস্তার করে চলেছে।যে ছোট্ট বাড়িটার একতলায় মহেশ থাকে তারপাশেই কুভান আলভার বাগানবাড়ি।সেখানেই আজ বিকেলে নিমন্ত্রণ।এমনিতে এসব নিমন্ত্রণ এড়িয়ে থাকতেই স্বচ্ছন্দ সে তবে কুভানকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।প্রভাবশালী বলেই নয় বছর সত্তরের মানুষটা জ্ঞানের ভাণ্ডার।বিশেষ স্নেহ করেন তাকে।সন্ধ‍্যে সাতটা নাগাদ ওর বাড়িতে গিয়ে উপস্হিত হতেই দেখল গোটা বাগানটা সাদা মলমল কাপড়ে মুড়ে হালকা বেগুনি অর্কিডে সাজানো হয়েছে।মহেশ হাতে করে বই নিয়ে এসেছে।কালেকশান অফ্ ও হেনরি।কুভান স্মিতমুখে বইটা বুকে চেপে ধরলেন।

-এরচেয়ে বড়ো কিছু নেই রয়।তুমি ভেতরে এসো একজন তোমার সাথে আলাপ করতে আগ্রহী।

ঘরের ভেতর খুব লো ভল্যুউমে সারেঙ্গী বাজছে।মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরটায়।কুভান কাওকে চাপা গলায় ডাকলেন।সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল হলদে জমির উপর ছোট ছোট লাল বুটিদার শাড়ি,লাল ব্লাউজ আর সাদা ফুলের মালায়,মুক্তোর সেটে এক নারী। মহেশ খানিক মুগ্ধ না হয়ে পারলনা।শুভেচ্ছা বিনিময় ও নাম জানার পর ধীরে ধীরে ত্রিচি, মহেশ গল্পে মেতে উঠল।বাগানের মাঝখানে রাখা ছোট্ট গোল টেবিলে কথোপকথন এগিয়ে চলল।সাথে কন্টিনেন্টাল খাবারের সমাহার।

-আপনাদের রাজ‍্যের দার্জিলিং আমার সবচে প্রিয়।একাধিক বার গিয়েছি কর্মসূত্রে।

-হ‍্যাঁ দার্জিলিং অসামাণ‍্য তবে পারলে একবার পুরুলিয়া,বাঁকুড়া ঘুরে আসবেন।ভালো লাগবে।

-আমার ইচ্ছে আছে।বিশেষ করে লাল কাঁকুড়ে মাটির জৌলুস দেখাটাই উদ্দেশ‍্য।আপনার নানা রকম কাজকর্মের প্রশংসা শুনতে পাই মিস্টার রয়।তাই আমি সরাসরি একটি প্রস্তাব আপনাকে দিতে চাই।

-কী বিষয়ে?

-কুভান একটি ইকো রিসোর্ট চাইছেন দুবরা এলিফ‍্যান্ট ক‍্যাম্পের কাছাকাছি।আপনি আমাদের উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যোগ দিন।আপনার সাজেশান অনুযায়ী আমরা রিসোর্টটিকে সাজাতে চাই।

মহেশ ত্রিচির চোখে চোখ রেখে বুঝতে চাইল কী উদ্দেশ্য এই নারীর।ঠিক তখন সামাণ‍্য ঝুঁকে হাত ধরে বলল,'মহেশ আমরা সত‍্যিই চাইছি দুবরা ইন্টারন‍্যাশানাল পরিচিতি পাক।'মহেশ উঠে দাঁড়াল।গভীর খাঁজের অমোঘ আকর্ষণ সহজেই এড়িয়ে বলল,'ম‍্যাডাম ত্রিচি,আমরা চাইছি দুবরা ক‍্যাম্পে হাতিদের সুরক্ষা আরো বাড়ুক।দর্শকের চাপ কী করে কমানো যায় সেটাই আমাদের লক্ষ‍্য।আচ্ছা চলি ভালো লাগল আলাপ হয়ে।ভালো থাকবেন।'চলে যাওয়া মহেশের পায়ের রেখায় চোখ রেখে কুটিল হাসল ত্রিচি।দূর থেকে মহেশের কুভানের সাথে করমর্দন দেখে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।টেক্সট করল,'ইউ আর রাইট হিয়ার হি ইজ!অনুজ।'


--------------------------------------------------------------

চন্দ্রনাথ আদিত‍্যর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বাঁকা হাসিল।দই চিঁড়া কলা ভালো করিয়া মাখিয়া বৃহৎ একখানি গ্রাস মুখ পুড়িয়া চকাম চকাম আওয়াজ বজায় রাখিতে রাখিতেই কথা বলিতে শুরু করিল।

-তুমি বাপু স্ত্রী লোককে কিঞ্চিৎ অধিক গুরুত্ব দিয়া থাক।আমার শ‍্যালিকার সহিত সারাদিনে যে পরিমাণ বাক‍্যব‍্যয় করিয়া থাক তাহা দৃষ্টিকটূ।

আদিত‍্যনাথ হতভম্ব হইয়া কহিল,'এ কী রূপ দোষারোপ।তোমার শ‍্যালিকাটিই বরং পায়ে পায়ে ঘুরিয়া বেড়ায়।সোহাগের কথা শুনিতে চাহিয়া ব‍্যতিব‍্যস্ত করিয়া তোলে আর তুমি কিনা চন্দ্র আমাকে দুষছ!'

-আহা চটো কেন?আসলে অমরকন্ঠক হইতে আসিয়া ইস্তক তুমি ব‍্যাকুল হইয়া রহিয়াছো।বিশেষ করিয়া স্ত্রীরত্নটির জন‍্য বোধকরি মন উচাটন হইয়াছে।তাহাই স্বাভাবিক।তুমি বরং কয়দিন বাড়ি হইতে ঘুরিয়া আইস।আমি আবার দিন পাঁচের ভিতর জয়পুর যাত্রা করিব ব‍্যবসাটিকে আরো ঢালিয়া সাজাইতে পারিলে তোমার কর্জটিও চুকাইতে পারি।

আদিত‍্য শেষের বাক‍্যগুলি শুনিয়া যারপরনাই অসন্তুষ্ট হইল কিন্তু চন্দ্রনাথকে কঠিন কথা শোনানোর হিম্মত তাহার কোনদিন হয় নাই।বরং খানিক চুপ করিয়া থাকিবার পর তাহার মনে হইতে লাগিল,চন্দ্রনাথকে সে হয়ত না বুঝিয়া কখনো আঘাত করিয়াছে তাই সহসা কর্জ শোধ করিবার প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িল।বসারঘরটিতে চন্দ্রনাথের ফলার খাইবার আওয়াজ ব‍্যতীত অন‍্যকোন শব্দ নাই।আদিত‍্য অনেক সময় চুপ করিয়া থাকিল।তারপর কথা বলিয়া উঠিল।

-চন্দ্র তোমার আপত্তি না থাকিলে আমি জয়পুর যাত্রায় তোমার সঙ্গী হতে চাই।

ডানহাতের কনুই পর্যন্ত মিষ্টি রস গড়াইয়া যাওয়ায় সেই রস জিভ দিয়া চাটিয়ে লইবার কাজটির অবসরে এক ঝলক আদিত‍্যকে দেখিয়া চন্দ্রনাথ বলিল,'সে তো আমার পরম সৌভাগ‍্য।তবে কিনা মহিলা মহল তোমাকে ছাড়িতে রাজি হইবে কিনা সেটি বিচার্য।তোমার যত্ন আত্তি করিয়া তাহারা সবিশেষ সুখ লাভ করেন কিনা।'আদিত‍্য বুঝিল গতরাতে চন্দ্রর স্ত্রী রুক্মীনি তাহার খাদ‍্যের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করিবার কারণেই চন্দ্র তাহার সহিত মশকরা করিতেছে।তবু সে বিবেচনা করিল,রাগ করিয়া ফল কী,বরং গৃহে প্রত‍্যাবর্তন করিয়া সকলের সহিত সাক্ষাৎ করা ভালো হইবে।সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,'চলি চন্দ্র জয়পুর যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করিয়া খবর পাঠাইও।'চন্দ্রনাথ উদাসীন মুখ বলিল,'গৃহে যাইতেছ যাও সোহাগবালার খপ্পরে নিজেকে বাঁধিয়া ফেলিও না।অতি কষ্টে মুক্তি পাইয়াছ,ভুলিও না।'সোহাগবালার নামটি চন্দ্রর মুখে শুনিয়া আদিত‍্যর বুকটা মোচড় দিয়া উঠিল।

রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                            



মৃত্যু অথবা  ( পর্ব ৩)



ঘড়ির কাঁটায় ন’টা সাতাশ বাজতেই রাণা একবার তাকায় দীপুর দিকে। সময়ের ব্যাপারে ও অসম্ভব খুঁতখুঁতে। দীপু জানে কিরণমালা ঠিক সাড়ে ন’টায় আসবে বলেছিল। দীপু সবেমাত্র বাঙালির টাইম ম্যানেজমেন্ট, মেয়েদের সাজতে সময় লাগে, এইসব নিয়ে দু’চার কথা বলবে ভাবছিল, ঠিক সেই সময় রাণার মোবাইল বেজে ওঠে।   
“আমি অপেক্ষা করছি। ভেতরে আসুন।” ফোনে কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় যে মহিলা, তার সঙ্গে কলেজের সেই যুবতীর মিল শুধু কাঠামোয়। বাইরের চেহারা রীতিমতো বদলেছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অর্থের জৌলুস। এতটা ঝলমলে আর ফ্যাশনেবল কিরণমালা কোনওকালেই ছিল না। তার সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে সপ্রতিভতা। 
কিরণমালা ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়ায়। “অনেকদিন পরে দেখা হল। কিন্তু আমার বেশি সময় নেই হাতে। খুব চটপট কাজের কথাগুলো বলতে চাই।” রাণার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতেই দীপুর দিকে তাকায় কিরণমালা। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
রাণা পরিচয় করায়, “ও আমার বন্ধু। একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে। আমার ক্লাসমেট। দীপন মিত্র। মনে আছে কীনা জানি নয়া। আপনি ওকে কলেজে দেখে থাকতে পারেন। আপনি বসুন। দীপুর সামনে কথা বলতে আপত্তি থাকলে...”  
“না না। আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমারও চেনা চেনা লাগছে ওনাকে... এনি ওয়ে...”
“বসুন প্লিজ।” 
কিরণমালা বসে। আঁচল গুছিয়ে নিয়ে একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। মাথা নিচু। 
“আমার মায়ের খুনের তদন্ত করতে হবে। সেইজন্যেই আসা।”  
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও দীপু এতটা চমকে যেত না। কিন্তু রানা একদম স্থির। নিস্পৃহ। 
“আপনার মা, মানে...”
“আমার মা। ইরাবতী সান্যাল। লেখালেখি করতেন, অনেকেই তাঁকে চেনেন।” 
“কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমরা কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি দূর থেকে। কিন্তু কখনও কোনও অবস্থাতেই আপনি নিজের বাবা-মায়ের পরিচয় কাউকে দেননি। এটা পার্সোনাল প্রশ্ন, তবু... উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ব্যাপার।”   
রাণার কথায় মৃদু হাসল কিরণমালা। 
“আজ অনেক কথা বলব বলেই এসেছি। আগে বলি, তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত আমার সেই অর্থে কোনও নিজস্ব পরিচয় ছিল না। মানে, আমি জানতাম না, কে আমার বাবা-মা। আমি কিংশুক রায় আর ইরাবতী সান্যালের দত্তক নেওয়া সন্তান। আমার ঠিকানা ছিল বেসরকারি একটি অনাথ আশ্রম। যেদিন একটা জমকালো বিরাট বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল, সেদিন থেকে এই দুটি মানুষকে আমায় ‘বাবা-মা’ বলতে শেখানো হয়েছে। আর খুব ছেলেবেলার ঘটনা হলেও সেই দিনটা আমার এখনও মনে আছে। জ্ঞান হবার অনেক পরের ঘটনা তো...
“আমার ঠিকানা বদলে গেল। ফুটপাথ থেকে রাজপ্রাসাদ। অনেক আদবকায়দা শিখলাম। আর বহু কিছু পেতে শিখলাম। না চাইতেই পাওয়া। প্রচুর খেলনা, অগুনতি জামাকাপড়, টেবিল উপচোনো খাবার। এককথায় প্রাচুর্য। কিন্তু আমার ভেতরে একটা গরিব মন থেকে গেল। সবকিছু পেতে পেতেও পাওয়ার অভ্যেস হল না। কেবল মনে হত, এগুলো আমার নয়, আমার প্রাপ্য নয়। আমি এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। কেউ যেন একটা রঙিন সিনেমা দেখাচ্ছে, হঠাৎ সুইচ অফ করে ঘর অন্ধকার করে দেবে। আমার খুব ভয় করত। আমি কেমন গুটিয়ে থাকতাম। সহজ হতে পারতাম না। প্রথম এই অসুবিধে বুঝেছিলেন ইরাবতী সান্যাল। আমার মা।”  
রাণা আর দীপু দুজনেই লক্ষ্য করে ‘মা’ শব্দটা বলতে বলতে চোখ উপচে আসছে কিরণমালার। সে সামলে নেয় চট করে। বলতে থাকে, “অনেক জন্ম তপস্যা করলে অমন মা পাওয়া যায়। তিনি আমার বায়োলজিক্যাল মাদার নন ঠিকই, কিন্তু...। মা প্রচুর পড়তেন, রাত জেগে লিখতেন। কিন্তু আমাকে এতটুকুও অবহেলা করেননি কোনওদিন। নিজে যখন যা করেছেন, আমাকে পাশে বসিয়ে নিতেন। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে কোলের কাছে রেখে লিখেছেন, বাঁহাতটা আমার মাথার ওপর, ডান হাতে কলম চলছে। অনেক বড় হয়েও আমি এমনটাই দেখেছি। আর শিখিয়েছেন, ‘নিজের পরিচয়ে বাঁচবে। অন্য কারও পরিচয়ে নয়। প্রতিটি মেয়ের নিজস্ব পরিচয় তৈরি হওয়া দরকার। সে কার মেয়ে, কার বৌ, কার মা, এটা তার পরিচয় নয়। বী ইওরসেলফ। মা নিজেই বারণ করেছিলেন আমি যেন কোথাও আমার বাবা-মায়ের পরিচয় ব্যবহার না করি। আমি মায়ের সব কথা শুনতাম। এই কথাটাও শুনেছি।”  
কিরণমালা কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এই সুযোগে রাণা জিগ্যেস করে, “আর কিংশুক রায়? আপনার বাবা?” 
“বাবা? সত্যি কথা বলতে কি, বাবারা কেমন হন আমি জানি না। ছেলেবেলা থেকে মায়ের বই পড়ার নেশা দেখে আমারও বন্ধু হয়েছিল বই। আমাদের বাড়িতে একটা বিরাট লাইব্রেরি আছে। আবার বাবার কাকার। আমাদের কোম্পানির কর্ণধার কল্যাণ রায়ের। আমি সেখানে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম। বন্ধু ছিল না তেমন। থাকলেও তাদের কাছে বাবাকে নিয়ে গল্প হত না। আর কিংশুক রায় বরাবর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের কেরিয়ার, নিজের বিজনেস নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। যতটুকু শুনেছি, মূলত মায়ের চাপেই তিনি আমাকে অ্যাডপ্ট করেন। স্নেহ-মমতা নিয়ে তাঁর শো-অফ ছিল না। আমাকে তিনি কোনওদিন খুব কাছে টেনে নেননি। আমিও দূরত্ব বজায় রেখেছি। মা’কেও দেখেছি একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রাখতেন। আমার আর মায়ের কিছু কমন জগত থাকলেও কিংশুক রায় আমাদের দুজনের কাছেই দূরের গ্রহের জীব।”  
কথা বলতে বলতেই একবার ঘড়ি দেখে কিরণমালা।  
“আমি কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর তদন্ত করতে এসেছি। আমি নিশ্চিত, আমার মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।”    
রাণা বলে, “কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন? মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক। বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। সকালে কাজের মেয়ে দেখতে পায়। তখন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। সবটাই আইনের চোখে অত্যন্ত স্বাভাবিক।” 
কিরণমালা একদৃষ্টে তাকায় রাণার দিকে, ধীরে ধীরে বলে, “আইন আমিও জানি। সেইজন্য আইনের দ্বারস্থ হইনি। জানি, লাভ নেই। আইন থাকলে আইনের ফাঁকও থাকে। খুব সুন্দর নিটোল করে সাজানো একটা খুনের প্ল্যান। মাঝরাতে বাথরুমে হার্ট অ্যাটাকের চেয়ে সহজ সরল স্বাভাবিক মৃত্যু আর হয় না। কিন্তু সত্যিই মাঝরাতে কী হয়েছিল মায়ের? হার্ট অ্যাটাক, না অন্য কিছু? পোস্ট মর্টেম তো হয়নি। কী করে জানা গেল মা’কে কেউ কিছু খাইয়েছিল কীনা। আমাকে জানতেই হবে। মা আমাকে বলে গিয়েছিলেন... মায়ের কিছু একটা মনে হয়েছিল... ইন ফ্যাক্ট মায়ের সঙ্গে আমার বণ্ডিং ভীষণ স্ট্রং ছিল। আমি জানতাম আমি চলে যাবার পরে মা খুব একা হয়ে পড়েছেন।”   
“আপনাকে মা বলেছিলেন... মানে? ইরাবতী সান্যালের মনে হয়েছিল তাঁকে খুন করা হতে পারে?” 
মাথা নিচু করে কিরণমালা।
“মা আমাকে আভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি হঠাৎ মরে গেলে একটু খোঁজ নিস কিরণ। আমি শুনে রেগে যেতাম। তখন মা হেসে বলতেন, এত তাড়াতাড়ি মরব না, জানি অনেক পাপ করেছি, সব কর্মফল মিটিয়ে যেতে হবে না? আমি বকলে বলতেন, ভয় নেই রে, অনেক লেখা বাকি। সব লিখে রেখে যাব। তবু...। আমি জানি মায়ের হার্টে বেশ সমস্যা ছিল... সেইজন্যেই কি ওই রাস্তা দিয়ে... আমি জানি না রাণা, প্লিজ আপনি আমাকে হেল্প করুন। এই রহস্য উদ্ধার করতে না পারলে আমার মা’র কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব...।”  
রাণা একবার তাকায় দীপুর দিকে। “আমি কেসটা নিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করব আপনার সন্দেহ যাতে মিথ্যে হয়, সেটা প্রমাণ করতে। শুধু আমার একটাই প্রশ্ন, কাকে সন্দেহ করেন আপনি?” 
কিরণমালা গম্ভীর হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ায় সে। রাণার দিকে তাকিয়ে বলে, “সিস্টেম, সিস্টেমকে সন্দেহ করি আমি,” বলতে বলতেই ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একগোছা নোট বের করে এনেছে কিরণমালা। সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বলে, “এতে পাঁচ হাজার আছে। অ্যাডভান্স পেমেন্ট। আমি কলকাতায় আপাতত কয়েক সপ্তাহ থাকব। তার মধ্যে...। জানি, কাজটা কঠিন। কিন্তু পেশাদার গোয়েন্দার পক্ষে সব সম্ভব। তোমরা ভুলে যেও না, আমি মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়েছি। আমি জানি, পারলে তুমিই পারবে। আসি। যে কোনও দরকারে ফোন কোরো।”    
রাণা আর দীপুকে সেভাবে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় কিরণমালা। শেষ বাক্যে কিরণমালার হঠাৎ ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে সম্বোধন পরিবর্তনও কান এড়ায় না দুজনের। কিরণমালা কি তাদের সঙ্গে ফর্ম্যাল সম্পর্ক ছেড়ে বন্ধুত্বের সহজ পথে আসতে চাইছে? 
ফ্যানের হাওয়ায় টাকার গোছা থেকে নোটগুলো উড়ে পড়ে এদিক-সেদিক। দীপু কুড়িয়ে তুলতে তুলতেই শোনে রাণা অস্ফুটে উচ্চারণ করছে, “সিস্টেম।”  
....................................................................................................................................

(ক্রমশঃ)

সৌমী আচার্য্য

                                




শ্রাবণের ধারার মতো


পর্ব-৩

বিন্দুবালা কিছুতেই স্বস্তি লাভ করিতে পারিতেছে না। যাহা ঘটিতেছে তাহার জন্যে কাহাকেও দোষারোপ করিবার উপায় নাই অথচ মনের ভিতর অভিমান ফেনাইয়া উঠিতেছে। সোহাগ নিজ হাতে ডাল বাটিয়া গয়না বড়ি বানাইয়া রান্না করিয়া দ্বিপ্রহরে সৌম‍্যাদিত‍্য খাইতে বসিলে তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে, বিন্দু সেইক্ষণে মাছের মুড়ার ঝোল সবে আগাইয়া দিয়াছে।

-মাছ খাইবার পূর্বে একবার দেখুন তো ইহা খাইবার যোগ‍্য হইয়াছে কিনা।

বিন্দু অবাক হইয়া দেখিল তাহার স্বামী পরম মমতায় গয়না বড়ির আলু ঝোল খাইয়া ঢেকুর তুলিয়া বলিল, 'আজ আর কিছু খাইতে ইচ্ছে করিবে না। বিন্দু মাছের মাথা আজ খাইব না।' বিন্দু ঘাড় নাড়িয়া উঠিয়া যায় তবে বুঝিতে পারেনা ইহা কী করিয়া সম্ভব। মাছের মাথা যাহার না খাইলে একটি দিনও চলে না সে কিনা বড়ির ঝোল চাটিয়া খাইয়া উঠিয়া যাইতেছে! একখানি গরম বাতাস সহসা ঘরময় দৌরাত্ম্য করিয়া বাহির হইয়া গেল। সোহাগের নিকট গিয়া বিন্দু চুপ করিয়া দাঁড়াইল।

-তুই ছোটো জাদু জানিস ভাই। আমার সোয়ামির মাছের মাথা খাওয়া ঘুচিল।

-জাদু জানি কিনা জানিনে। তবে তোমার সোয়ামিটির মাছের মাথার চাইতে অন‍্যকিছুর মাথা খাইতে সাধ জাগিয়াছে কিনা খোঁজ রাখিও। 

কথাটি বলিয়া দীর্ঘ বিনুনিটি দুলাইয়া নরম পায়ে হাঁটিয়া চলিয়া গেল। বিন্দু এসব দুর্বোধ‍্য কথা বিশেষ বোঝেনা। খাইতে বসিয়া অখাদ‍্য গয়না বড়ির ঝোল খাইয়া তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। ঘরে আসিয়া সৌম‍্যাদিত‍্যের দিকে তাকাইয়া কহিল, 'এ তোমার ভারি অন‍্যায়, অখাদ‍্য খাইয়া নিজের শরীরকে কষ্ট দিবার কোনো কারণ বুঝিনে।' 

-সব কারণ বুঝিবার মতো বুদ্ধি ঈশ্বর যদি তোমায় না দিয়া থাকেন তাহাতে তোমার কিছু করিবার নাই।

-সব সময় ঠাট্টা ভালো লাগেনা বাপু!

সৌম‍্যাদিত‍্য হাসিয়া কোলবালিশটিকে জড়াইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। বিন্দুর মনে অস্বস্তি বাড়িয়া চলিল। স্বামীর পাশটিতে বসিয়া বাম হাতখানি পিঠের উপর রাখিতেই টের পাইল, সে ঘুমাইয়াছে। চোখের কোণ দুইটিতে জল আসিয়া সব ঝাপসা করিয়া দিতেছে। সোহাগের প্রতি এই বিশেষ পক্ষপাতিত্ব কী স্নেহ না অন‍্যকিছু ইহা জানিবার কোনো উপায় কি নাই!

--------------------------------------------------------------
গোধূলি মাসির কথায় হতবাক হয়ে গেল দেবপ্রিয়া।ফোনের ভিতর দিয়ে গালে যেন সপাটে চড় পড়ল।

-মরুণকিশোরকে মনে পড়ছে কেন তোর? ওর ভিতরে আর কি কিছু বাকি আছে নিঃড়ে নেবার মত? 

দেবপ্রিয়া খানিকক্ষণ চুপ করে যায়। এত রোষ নিয়ে কথা বলছে কেন মাসি? কোনদিন তো এমন ভাবে কথা বলেনা।

-তুই যতদিন ওর কথা তুলিসনি আমার তোকে বলার মত কিছু ছিল না। কিন্তু একটা আত্মভোলা খ‍্যাপাকে আবারো খুঁচিয়ে তুই যন্ত্রণা দিবি সেটা আমি হতে দিতে পারিনা।

-মাসি আমি কখনো কাউকে যন্ত্রণা দিতে পারি? সে ক্ষমতা আমার কোনদিন ছিল?

-হাসালি প্রিয়া, তুই যন্ত্রণা ছাড়া আর কাউকে কিছু দিয়েছিস? মরুণকিশোর, অনুজ, তোর মা এমনকি বরুণকে পর্যন্ত তুই যন্ত্রণা দিয়েছিস। আমার তো ভয় হয় তুই নিজের মেয়েটাকে ছাড়বি তো!

কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে দেবপ্রিয়ার। এত রাগ, ঘৃণা তার প্রতি গোধূলি মাসির? ফোনটা রাখার আগে আশ্চর্য নরম গলায় বলল, 'কিছু মনে করিস না প্রিয়া, মরুণকিশোরের নাম তোর মুখে শুনতেই বড্ড রেগে গিয়ে এসব বললাম। ওর বিয়ে হয়েছে। ভালো আছে দুটিতে। তুই আর ওর ঠিকানা খুঁজিস না মা। আমি সামনের মাসে পারলে একবার যাব তোর কাছে। আদর করে আসব একটু। বড্ড কঠিন কথা বলে ফেললাম না রে মা?' 

মায়ের ঘরে ঢুকে ঊশ্রীর ভুরু কুঁচকে গেল। দেবপ্রিয়া রাইটিং টেবিলে মাথা নীচু করে বসে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর।

-মা!

ছোট্ট ডাকটায় মুহূর্তে সচেতন দেবপ্রিয়া।নিজেকে কুড়িয়ে নেয় অতীত থেকে। চোখটা আলতো হাতে মুছে বলে, 'বেড়াতে যাবি মুনিয়া?'


রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                 





 মৃত্যু অথবা  (পর্ব ২)


কিরণমালার ফোন ধরেই লাউডস্পিকারে দিয়ে দিল রাণা। দীপু সামনে রয়েছে। ওর সামনে আবার আড়াল কীসের? বরং ও সবটাই শুনুক। আলোচনা করতে সুবিধে হবে।  
মহিলাকণ্ঠ ভেসে আসে, “হ্যালো, এটা কি রাণা সেনগুপ্তর নম্বর?”
“হ্যাঁ বলছি।” 
“নমস্কার। আমাকে চিনবেন কি না জানি না। আমার নাম কিরণমালা রায়। আমি সায়েন্স কলেজের দু’হাজার চোদ্দ সালের পাস আউট। আমার সাবজেক্ট ছিল সাইকোলজি।” 
কিরণমালার শান্ত সৌজন্যের মধ্যে ‘আপনি’ সম্বোধন কান এড়াল না দুজনের। রাণাও অবশ্য ভীষণ সংযত গলাতেই কথা বলছিল।   
“বুঝেছি। আপনাকে বেশ মনে আছে। আমাদের চেয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। বলুন, বিশেষ কোনও প্রয়োজন?” 
“হুম, প্রয়োজন তো বটেই। এবং প্রয়োজনটা বিশেষ এবং ব্যক্তিগত। কাজেই বুঝতেই পারছেন সব কথা ফোনে বলা যাবে না।”  
“সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু, আপনি ... মানে আমাকে হঠাৎ খুঁজে ...এভাবে ফোন করছেন...” রাণার গলায় স্পষ্ট প্রশ্নচিহ্ন।   
“আমি যতদূর খবর পেলাম আপনি বেশ কিছুদিন হল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করছেন। অপরিচিত এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। আমারই এক ক্লাসমেট আপনার সন্ধান দেয়। আপনাকে আমার মনে আছে। আমার মনে হল, প্রোফেশনালি কাজ দিলে আপনাকেই ভরসা করা যায়। আফটার অল, আপনি খুব সামান্য হলেও চেনেন আমাকে।” কিরণমালার কথা শুনে রাণা দীপুর দিকে তাকায় একবার। 
“আপনি কি এখন কলকাতায়?”
“আমি কয়েকদিন হল এসেছি। কিছুদিন থাকার ইচ্ছে আছে। এর মধ্যেই একটা কাজ মিটিয়ে দিতে চাইছি, সেটা আপনাকে সাক্ষাতে বলব।” 
“বেশ, অবশ্যই আসুন। আমি আপনার এই নম্বরে আমার ঠিকানা পাঠাচ্ছি। গুগল ম্যাপ ধরে চলে আসা খুব সহজ। শুধু একটাই কথা...”  
রাণাকে থামিয়ে কিরণমালা জবাব দেয়, “আমি জানি, আপনি কাজটা সম্পর্কে জানতে চাইছেন... টেলিফোনে শুধু একটিই কথা বলছি, আমি একটি খুনের তদন্ত করাতে চাই। এর বেশি জানতে চাইবেন না।”   
রাণা থমকে যায় এক মুহূর্ত। তারপর সপ্রতিভ গলায় বলে, “আপনি কবে কখন দেখা করতে আসবেন?”
“কালই সকালে। ঠিক সাড়ে ন’টা। আই হোপ আপনার প্রবলেম নেই কোনও।”
“নট অ্যাট অল। আসুন।” 
“আমি পৌঁছে যাব।”  
কিছু বোঝার আগেই ফোন কেটে দেয় কিরণমালা।  
রাণা মোবাইলটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে কুশনের ওপরে। ভুরুদুটো কুঁচকে গেছে, চোখে অস্থিরতা। 
দীপু বলে, “কেসটা কী হতে পারে বল তো?”
“আন্দাজ করছি, শিওর নই। কিন্তু... একটাই মুশকিল...”
রাণার কথায় অস্থিরতা। 
দীপু জিগ্যেস করে,“কী মুশকিল?” 
“একরাত্তিরের মধ্যে আমাকে খুঁজে নিতে হবে কিরণমালা কেন আসতে চায় আমার কাছে। সময়টা বড্ড কম। ওর সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিয়ে রাখতে পারলে ভালো হত। অ্যাট লিস্ট কোথায় আছে, কী করছে...।”   
“কিন্তু রাণা, এত তাড়া কীসের? ওকে আগে আসতে দে। ও নিজেই এসে বলবে নাহয়...।” 
রাণা উঠে পড়ে। পায়চারি করতে করতে বলে, “তুই একটু তলিয়ে ভাব দীপু, এতদিন পরে তাকে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর খুঁজতে হচ্ছে কেন? তার যা সোশ্যাল স্ট্যাটাস সে পুলিশের বড়কর্তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে... তার ওপর খুন। খুন হলে পুলিশ জানবে না? না কি পুলিশ জেনে ফেললে খুনি পালিয়ে যাবে বলে সে ভয় পাচ্ছে? খুনি কি আরও প্রভাবশালী কেউ? খুন হলই বা কোথায়?...” পায়চারি করতে করতে মাথার চুলগুলো খামচে ধরে রাণা।    
দীপু বলে, “আমি যতটুকু বুঝলাম, জট পাকিয়ে যাচ্ছে একটাই কারণে। ক্লায়েন্টের নাম কিরণমালা রায়। আর সে চিরকাল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। কিন্তু তুই কী ভাবছিস রাণা?”  
দীপুর কথায় হুঁশ ফেরে। 
“সেরকম কিছু ভাবছি না। আমাদের ডিএসপি সাহেবের কথা মনে পড়ছে।” 
“কে? অরিন্দম? ও তো এখন বারাসতে পোস্টেড।” 
“আরে, যেখানেই পোস্টেড হোক, ক্লাসমেট তো রে বাবা। এই ঝামেলায় ওকে একবার লাগতে পারে।” 
“কিন্তু রাণা, কে কোথায় খুন হল, তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কিরণমালা আগে কাল আসুক। আর তাছাড়া, তোর এই শখের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে অরিন্দম খুব গাল দেয়, মনে নেই?”
“তা’ দিকগে। বন্ধুরা অমন বলেই থাকে। ভালোবাসে বলেই গাল দেয়। দেখ ভাই, রাজনীতি করতে গিয়ে কেরিয়ার ডুবিয়েছি। হাবিজাবি চাকরিবাকরি করে ওই ডালভাতের জীবন আমার পোষাবে না। আমার এই কাজই ভালো। থানাগুলো মোটামুটি চিনে নিয়েছে। জানে, আমি লোকটা চোর-ছ্যাচোড় নই। টুকটাক কেস সলভ করলে পুলিশেরও লাভ। আমারও মগজের ব্যায়াম। নির্মেদ নির্ভার মস্তিষ্কে হাওয়া খেলে...”  
রাণার কথা শুনতে শুনতে মন খারাপ হয় দীপুর। রাণা ছিল ব্যাচের ব্রাইট বয়। সত্যিই অনেক বেশি সময় দিয়ে ফেলেছিল ছাত্র-রাজনীতিতে। নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারেনি। যথারীতি রেজাল্ট হল একদম সাদামাটা। নম্বরের ফাঁদে অনেক বড় কেরিয়ারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। নেহাত কিছু পৈতৃক ধনসম্পত্তির ভরসা আছে। নিজের বাড়িতে একা মানুষের খাওয়া-পরার সংস্থানটুকু রয়েছে। বাকি সময়টা, এখন ওর নিজের ভাষায়, ‘মগজের ব্যায়াম’ করে। পুরোপুরি পেশাদার গোয়েন্দা না হলেও প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে বেশ কিছু কেস সামলেছে।  
“দীপু, আমি একটু কাজে বসি। তুই শুধু দেখিস কেউ ডিস্টার্ব না করে। আর হ্যাঁ... কিরণমালা রায়ের মা ইরাবতী সান্যাল আর বাবা কিংশুক রায়ের সব ডিটেল চাই চটপট। যেখানে যত ইন্টারভিউ আছে, নিউজ ক্লিপিংস আছে... সব খুঁজে জড়ো করি। দুজনেই সমাজের উঁচুতলার মানুষ, কিছু বেসিক ইনফো তো থাকবেই...।”   
দীপু উঠে পড়ে। মানিকতলায় রাণার আনঅফিসিয়াল অফিসঘরের চৌহদ্দির ঠিক ওপরের তলাতেই ওদের একত্রে বসবাস। দুই ব্যাচেলরের ভাগাভাগি জীবন। দীপুর নিশ্চিন্ত ব্যাংকের চাকরি রাণার পেশাদার গোয়েন্দা জীবনে কোনও অসুবিধে করেনি। বরং রাণার পৈতৃক বাড়ির একটা অংশে দীপু পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকায় এক অর্থে দুজনেরই সুবিধে। দীপু সুদূর মফঃস্বল থেকে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে চাকরি করতে আসার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত, রাণা তার পিতৃমাতৃহীন নিস্তরঙ্গ একলা জগতে একটা বন্ধুর সাহচর্য পেয়ে তৃপ্ত। দীপু তাকে প্রচুর সাহায্যও করে। ঠিক এই মুহূর্তে যেমন দীপু টেবিলের কম্পিউটার অন করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পাশে রতনের চায়ের দোকানে হাঁক দিয়ে এলে ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা চলে আসবে রাণার পাশে। রাতের খাবার চলে আসবে হোম ডেলিভারি মারফত সময়মতো। দীপু চুপচাপ এবার নিজের ঘরে। হয় সিনেমা কিংবা ওটিটিতে জমিয়ে সিরিজ। নয় গল্পের বই। রাণা ডাকলে তবেই আবার একসঙ্গে বসা। তার আগে রাণাকে কোনও ভাবে বিরক্ত করা যাবে না।    
রাতে চোখ বোজার আগে অবধি নিচের ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছে দীপু। 
ভাগ্যিস কাল রোববার।     
.......................................................................................................................................
( ক্রমশঃ)

সৌমী আচার্য্য

                     





শ্রাবণের ধারার মতো


পর্ব ২


এই অবধি পড়ে ঊশ্রী ভীষণ মন খারাপ করে মাকে বলল,'মা তুমি কি ওদের আলাদা করে দেবে?'দেবপ্রিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,'সে তো ওদের উপর নির্ভর করছে রে।ওদেরকেই বুঝতে হবে কি ওরা চায়?'

-ইস‍্যুটা তো খুবই সাধারণ।

-সেটা তোমার মনে হচ্ছে,ওদের নয়।

-কিন্তু মা...

-উহু আর নয়।আমার লেখাকে প্রভাবিত করবে না।তুমি এবার নিজের কাজে যাও।

বৃষ্টি ঝরে পড়ছে অবিরাম।ঊশ্রী মায়ের চোখে কিছু খুঁজতে চেয়ে একবার তাকাল।দেবপ্রিয়া ততক্ষণে মন ডুবিয়ে দিয়েছে সোহাগে।

ঊশ্রী পা ফেলে এগিয়ে আসে বারান্দায়।বাবার কথা ভাবতে চায় কিন্তু অস্পষ্ট ছবিটাতে আলো ফেলতে পারেনা।'নিরাকার অবয়ব নিয়ে ঘর করা যায়না'বহুবার মা একথা বলেছে,নিজেকেই হয়তো।তবু শুনেছে সে।ছোটোবেলায় যতদিন ওর দিদা বেঁচে ছিলেন জিজ্ঞাসা করেছে,'এর মানে কি দিদামা!'

-ওরে বাবা ঊশ্রী এত কঠিন কথা তুই পুরোটা বললি কি করে হ‍্যাঁ?আমি তো মনে রাখতেই পারতাম না।

-আহ্!তুমি অন‍্য কথা বলছো কেন?

দিপালী নাতনীর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে কেবলি কথা নিয়ে খেলতে খেলতে ওর মনটা সরিয়ে দিত অন‍্য দিকে।বড় হবার সাথে সাথে ঊশ্রী দেবপ্রিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ক্রমশ।মায়েতে মেয়েতে খোলা বারান্দা আবিষ্কার করেছে নিজেদের মধ‍্যে।বাবাকে নিয়ে আগ্রহ দেখালে দেবপ্রিয়া স্পষ্ট করে বলেছে,'অনুজ সত‍্য গোপন করত।যে সত‍্য আমার জানা দরকার ছিল।সম্পর্কের শুরু থেকেই এই লুকোচুরি আমি বুঝতাম।'

-তাহলে বিয়ে করলে কেন?

-কি জানিস মুনিয়া!মানুষ কি চায় সেটা বোধহয় সে নিজেই জানেনা।অনুজের গ্রেসফুল ব‍্যক্তিত্ব আদর করার ধরণ সব এত পছন্দ ছিল যে অনেক কিছু উপেক্ষা করে গিয়েছি।যখন একসাথে থাকতে এলাম তখন সব বদলে গেল।দমবন্ধ লাগতে শুরু করল।চলে এলাম।

ঊশ্রী মায়ের চোখে কখনো কোনো আক্ষেপ দেখেনি।কেন!মা কি বাবাকে ভালোবাসত না।একটা মানুষের জন‍্য মায়ের মনে কেন কোনো উত্তাপ নেই?

               ---------------------------------

সোহাগের পিত্রালয়ে ফিরিয়া যাইবার কোন উপায় নাই বলিয়া সে ধীরে ধীরে পরিস্হিতির সহিত মানাইয়া চলিবার রাস্তা খুঁজিতে লাগিল।বড় জা বিন্দুবালার সহিত সময় কাটাইতে লাগিল।বড়ির ডাল বাটা,পিঠে পুলির রকমারি কায়দা আয়ত্ত করিবার অভিপ্রায়ে নিজেকে ডুবাইয়া রাখিল কিন্তু সপ্তাহ পরেই তাহার প্রাণ যায় যায়।দক্ষিণের বারান্দায় আরাম কেদারায় হাত রাখিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

-তুমি ফিরিবে না!আমার প্রেম মিথ‍্যা করিয়াই তোমার আহ্লাদ!ঐ চন্দ্রনাথের সঙ্গ তোমার এত প্রিয়।আজ সাতদিন হইল তুমি ফিরিলে না?

দাসী খুঁজিয়ে খুঁজিয়া আরাম কেদারার পার্শ্বে আলুথালু সোহাগবালাকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া মুখ বাঁকাইয়া গৃহিনীকে সংবাদ দিতে একতলায় নামিয়া আসিল।গৃহকত্রী যমুনাবতী রান্নাঘরে তদারকিতে ব‍্যস্ত।

-মাগো তোমার বৌ যে সোয়ামির দুককে আরাম কেদারা জড়িয়ে ঘুমুচ্চে।আর কত পোচ্ছয় দেবে গো মা?

-বেশি দুঃসাহসের কথা বললে তোর মুকে নুড়ো জ্বেলে দুবো হারামজাদি।দূর হ।মোতির মা একবার এদিক পানে এসো তো বাপু।

মোতির মা এই বাড়িতে দীর্ঘ তিরিশ বৎসর অতিক্রম করিয়াছে।যমুনাবতীর সুখ দুঃখের সঙ্গী।নীরবে আসিয়া দাঁড়াইতেই যমুনাবতী রেকাবিতে সামাণ‍্য সন্দেশ আর ফল দিয়া বলিলেন,'সামনে বসিয়ে খাইয়ে আসবে।আর জটিকে বলবে ওকে আজ সন্ধ‍্যায় যেন সাজিয়ে যায়।'মোতির মা কিছু বলিবার অভিপ্রায়ে তাকাতেই যমুনাবতী গম্ভীর স্বরে বলিয়া ওঠেন,'যাও মোতির মা,বিলম্ব আমার অপছন্দ।'মুখে যাহাই বলুক ছোটোছেলের আচরণ তাহার নিকটেও সুবিধার লাগে না।কি হইলে যে তাহার অন্তর পূর্ণ হইয়া ওঠে কে জানে?অমন সুন্দরী,বিদূষী স্ত্রী ছাড়িয়া জলহস্তীর ন‍্যায় চন্দ্রনাথের সহিত যত্রতত্র ভ্রমণে কি সুখ লাভ করে সে কেবল ঈশ্বরেই জানে।বড়োছেলে সৌম‍্যাদিত‍্য অপেক্ষায় নীরিহ আর তাহার স্ত্রী বিন্দুবালা নেহাতই সাধারণ।উহাদের জীবন ঘটিতে তুলিয়া রাখা জলের ন‍্যায়।গড়াইয়া খাইলেও হয় আবার নষ্ট করিলেও কারো কিছু যায় আসেনা।সোহাগবালা ইহাদের অনেক ঊর্ধ্বে।যমুনাবতী অন্তরে ছোটবৌটিকে স্নেহের অধিক ভালোবাসেন।মায়া দিয়ে গড়া মেয়েটির চোখ।শুধু হাতের বাঁধন আলগা বলিয়াই সব গড়াইয়া যায়।উজাড় করিয়া ভালোবাসিতে জানে ঝগড়া করিতে তার সাধ নাই।অভিমানে ফুলিয়া ওঠে কেবল অধিকার দাবী করিতে বিমুখ।এমন মেয়েকে ভালো না বাসিয়া উপায় কি?মোতির মা আসিয়া দাঁড়াইল।

-মা,ছোটবৌ খেয়েচে।

-বাঁচালে বাপু।তা সে কি করচে?কি হল মুকে কুলুপ আঁটলে যে।সে কি করচে?

-পুকুরঘাটের দিকে গিয়েচে।সাথে রাজ‍্যির জামাকাপড়।

-ওমা,সেকি কতা!শিগগিরই দাসীকে পাটাও।আদরের দুলালী সে অনতথো হবে মোতির মা।যাও যাও।

মোতির মা নিজেই পা চালাইয়া পুকুরঘাটের দিকে আগাইয়ে যাইতেই কাঁঠালতলা হইতে দেখিতে পাইল,সৌম‍্যাদিত‍্য সোহাগের হাত হইতে কাপড় গুলি লইতেছে আর দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া সোহাগ কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।মোতির মা প্রসন্ন মনে ফিরিতে গিয়াও পুনরায় পিছন ফিরিতেই আকাশ কালো করিয়া আসিল।কে জানে কিসের ইঙ্গিত!ঝড় বৃষ্টি পৃথিবী তোলপাড় করিতে আগ্রহী হইয়া উঠিল।

--------------------------------------------------------------
দেবপ্রিয়া লেখা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল।কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে সোহাগকে?নিজেকে কখনো কখনো অচেনা লাগে।এমন বিচ্ছেদ কেন পরিকল্পনায় আসছে?কোন ভাবে কি এই ধূসরতার মধ‍্যে সে নিজেকে মগ্ন করে তুলেছে?অনুজের কথা কোনভাবেই সে মনে রাখতে চায়নি কিন্তু সত‍্যি কি সম্ভব ওকে ভুলে থাকা?এতটা উদাসীন কোন মানুষ কী করে হতে পারে?কোথায় আছে অনুজ?বল্লভপুরের কোনো মাটির ঘরের দোচালায়?নাকি পাহাড়ের কোলে কোথাও টেন্ট করেছে।আদিত‍্যনাথ কি অনুজের ছায়া?নাহ্ কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যায় না।আদিত‍্যকে ভিন্ন শেড দিতে হবে যেভাবেই হোক।মরুনকিশোর কোথায় থাকে খোঁজ নিতে হবে।ওর নামের মানেটা জানা হয়নি।কি খুঁজছিল ও পুরীর মন্দিরে?কে জানে?গোধূলি মাসি ওর খবর দিতে পারবে।কালই একবার ফোন করতে হবে।বুকের বাঁদিকটা বড্ড চাপ ধরে আসে আজকাল।একটা ডাক্তার না দেখালেই নয়।ঊশ্রী এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি বোধহয়।ফিরলেই আগে এইঘরে আসবে,'মা সোহাগের কি হল?ওর বর ফিরলো?মা আদিত‍্য কি গে?'প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে দেবে।একা থাকাটাই এখন অভ‍্যাস।তবু মেয়েটা এলে মনে হয় যেন স্নান সেরে ঠাণ্ডা শরীরে এসে বসল নিশ্চিন্ত হয়ে।দুপুরের এই শেষ রোদের তেজে একটা মায়া গন্ধ আছে।বাড়ির পাশের আমগাছটায় এবারো মুকুলের বৃষ্টি নেমেছে।মা থাকলে ঠিক ঘরের ফুলদানিতে ওরা কেউ না কেউ ঠাঁই পেত।দেবপ্রিয়া জানে মা চলে যাবার আগে ভীষণ ভাবে চেয়েছিল অনুজকে জানানো হোক।কোনভাবেই এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চায়নি সে।বহুকষ্টে যে মোহ ছেড়ে বেরিয়েছে সেখানে আর ফিরতে চায়না।এই সময়টায় গোটাবাড়ি ঘুমিয়ে থাকে।কাজের লোকেরা,ধলিদি সবাই ঘুমায়।কেবল ড্রাইভার ছেলেটা গান শোনে রেষ্টরুমে বসে।অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনটা বাজছে।ল‍্যাণ্ডলাইন।কেউ বোধহয় ধরার নেই।রকিং চেয়ারটায় গুটিসুটি দিয়ে বসল দেবপ্রিয়া।মেয়েটা ফিরছে না কেন?চারটে প্রায় বাজতে চলল অথচ অন‍্যদিন ফিরে যায়।আবার বাজছে ফোনটা।ভুরু কুঁচকে উঠল তবে কি মেয়ের কিছু!তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বেরিয়ে ড্রইং রুমে ছুটল দেবপ্রিয়া।নাহ্ আবার কেটে গেল।কে হতে পারে?কেন ফোন করছে?ঘরে ফিরে মেয়েকে ফোন করল।সচরাচর ফোন করে জানতে চাওয়ার মানসিকতা ওর নয়।মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেই তার আগ্রহ।তবু...

-হ‍্যালো ঊশ্রী!

-হ‍্যাঁ মা বলো।

-ফিরছিস?

-একটু কাফে তে আছি মা,কিছু বলবে?দরকার আছে কিছু?

-না না,দরকার কিছু নেই।সাবধানে ফিরিস।

-আমি আধঘন্টার মধ‍্যে ঢুকে যাব।

-আচ্ছা বেশ।

ফোনটা রেখে দেবার পর অস্বস্তিটা বেড়ে গেল।কে হতে পারে এই সময়?আত্মীয় স্বজন কারো সাথেই তো তেমন যোগাযোগ রাখেনি সে।কিবা হত রেখে?একই উত্তর দিতে আর ভালো লাগতনা।কলিংবেলটা বাজছে।ধলিদি নিশ্চই উঠবে।চুপচাপ অপেক্ষা করে দেবপ্রিয়া।কানে আসে দরজা খোলার আওয়াজ।ফিসফিস শব্দ এবং আবার নিস্তব্ধতা।খুব মৃদু পায়ের আওয়াজ।খানিকপর ধলিদি ডাকে দরজার বাইরে থেকে।

-দিদি,এসেছে।

-কে?

-তোমার পিসতুতো বোনের বর।

-কি?বের করে দাও এখুনি।যাও।স্কাউন্ড্রেলটাকে ঢুকতে দিলে কেন?

কথা শেষ হবার আগেই পর্দা সরিয়ে ঢুকে এল বরুণ দত্ত।মাথার চুল ধুলো ভরা,পোশাক জীর্ণ,ময়লা,চোখ লাল।

-প্রিয়া,নিরুপায় হয়ে এসেছি।একটিবার কথা শোনো।তারপর যা সিদ্ধান্ত হয় নিও।

-তুমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি।যাও বলছি।

-একটু শোনো,তারপর...

-বরুণ আমি পুলিশে ফোন করব।

বরুণের চোখের আকুতি,অসহায়তা মুহূর্তে উবে গেল।এক ভয়ংকর শয়তানিতে হলদে হয়ে উঠল চোখ।গলায় মিথ‍্যে কান্না রেখে তাকাল।

-ঊশ্রীর কিছু ছবি এখনো আমার কাছে আছে।যদিও আমি সেসব তোমায় বলতে চাইনা।তোমার মন চঞ্চল হলে লেখালিখি আবার বন্ধ হয়ে যাবে আগের মতো।তারচে আমায় একটু সময় দাও প্লিজ।

মাথা চেপে ধরে দেবপ্রিয়া।জীবন কিছুতেই যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে না।সামাণ‍্য বিচ‍্যূতি সামাণ‍্য ভুল এত দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলে কি করে?সাড়ে চারটে প্রায় বাজে।মেয়েটা ফেরার আগে এই আপদকে বিদায় করতে হবে।কিন্তু এভাবে কতদিন আর কতদিন।একটা স্হায়ী সমাধান খুব প্রয়োজন।দেওয়ালে টিকিকিটা টিকটিক করে উঠল।

(ক্রমশঃ)