রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৯

শ্রীলেখা মুখার্জ্জী

মুক্তগদ্য

একলা আকাশ /
-----------------------------
জানি ,অভ্যেসগুলো ছড়িয়ে আছে ভাবনার ভাঁজে ভাঁজে। বহুদিন ধরে হেঁটে চলা পাশাপাশি দিন ,আজ একাকীত্ব ছায়ার আলোআঁধারি তে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। অভ্যেসের রোঁয়াগুলো ঝেড়ে ফেলে দিতে গিয়ে গুমরে উঠছে নোনা ঢেউ স্রোত। এতদিনের ভালোবাসা বাসি কি ছুঃঁমন্তরে অতীত হতে পারে ? 
বৃষ্টির রাত , বারান্দার চেনা কোণ ,গা ঘেঁষাঘেঁষি দুটো চেয়ারে গুলাম আলি ‘চুপকে চুপকে রাতদিন’ ভুলে যাবো বললেই তো আর ভোলা যায় না… যে কোনো বাহানায় কান্নারঙের তোড়ে ভাসে। আর জানলায় উঁকি দেওয়া পাহাড়ের খাঁজে ডুবে যাওয়া সূর্য্যের আলোলিপির স্বাদ নিতে নিতে রবিবারের বিকেল… কফি মগে আয়েশী চুমুক , ঠোঁট থেকে মুছে যায় নি এখনও !!

তবুও আমি চেষ্টা করছি মেঘলা ছুঁয়ে ভালো থাকার। এখন থেকে হয়তো  আমার অ-সুখের মাস ! তবুও আমি বাঁচবো ডুবসাঁতারের কৌশল হস্তগত করে। আমি গড়ে নেবো আমার আকাশ ,অপরাজিতার নীল ঢেলে। ঝড়ে উড়ে যাওয়া খড়কুটো দিয়ে এবার বুনবো কেবল আমার একলা বাসা । আমার নিভৃতি নিরিবিলির স্বাদে পরিপূর্ণ একটি ভালোর বাসা----

শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

সম্পাদকীয়


বেশ কয়েক মাস বিরতির পর আবার ফিরে এসেছে সৃজন ৷ ফ্রেবুয়ারি মাসে "সৃজন " প্রকাশ হয়েছিল | কেটে গেছে ৩ মাস ৷ ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে আমার সৃজন পত্রিকার" নস্টালজিয়া কলকাতা "সংখ্যা ৷ মুদ্রিত সংখ্যা ও ব্লগ দুটো একসাথে চালাতে আমি অক্ষম ছিলাম ৷ সত্যিই এর ক্ষমাপ্রার্থী Iগ্রীষ্মের গুমোট এখনও কাটেনি ৷তবুও " সৃজন " হাজির বর্ষা সংখ্যা নিয়ে ।


ইদানিং ভাবনা চিন্তার অবসর হয় না ৷কিছু লিখতে ,পড়তে ইচ্ছা করে না ৷ তাই ১৫ দিন ধরে ভাবছি সম্পাদকীয় কী লিখব ! মস্তিষ্কের উর্বরতা কমে গেছে ৷ নতুন কোন ভাবনাই আসে না ৷  মস্তিষ্ক বার্ধক্যজনিত রোগগ্রস্থ l সত্যি বলতে কী খুব কষ্ট হয় ৷ না লিখতে পারার কষ্ট ৷  কবিতা আমার ঈশ্বর ছিল ৷ সেও ছেড়ে চলে গেছে আমার জীবন থেকে ৷ ইদানিং ঘুমের মধ্যে দুস্বপ্ন দেখি ৷ হারাবার । আমার কলম চুরী হয়ে গেছে ! কে যে নিল ... খুঁজে পাই না ৷ খাতার সব পাতা শেষ ...

পাহাড় ,সমুদ্র যেখানেই যাই অস্বস্তি লাগে I
কবিতার সামনে এনে দাঁড় করায় ৷কিছু তো করবার নেই ৷ কলম , খাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ৷ জানি না কবে শেষ হবে নির্বাসন ৷ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শৃঙ্খল ভেঙে চুড়ে একাকার ৷ 


কিন্তু তবুও সৃজন থেমে থাকবে না ৷ এগিয়ে নিয়ে চলবে গুণী ,সৎ পাঠক ও লেখক সাধারণ ৷ 'আমার সৃজন ' আবার মুদ্রিত আকারে আসতে চলেছে ৷ এই সংখ্যার বিষয় "নারী "৷ সবাই ভালোবাসায় থাকুন , সৃজনে থাকুন ৷ 

পারমিতা চক্রবর্ত্তী
সম্পাদিকা 

তাপস কপাট






মেঘশ্রী ব্যানার্জী







১) অবসর

বারমাস্যার খোপে খোপে 
যত্ন করে সাজিয়ে নিয়েছি ব্যস্ততা
কখনও তার নাম দিয়েছি পরিস্থিতি, কখনও বা কাজ।
তোমার মুখের ছবি আজও ভেসে বেড়ায় অবসরে -
ব্যস্ত মুহূর্তগুলো বেঁচে একখন্ড নিরুপদ্রব নিশ্চিন্ত 
অবসর ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টাই বুঝি আলেয়া। 



২) অবিরাম

ঢেউ অবিরাম, আবার সময়ও
ঢেউ অল্প থেমে আসা-যাওয়ার মাঝে 
মেপে দেয় প্রশ্বাসের সময়...
সময় থামে না, থামতে দেয় না। 
প্রতি পলে বয়স বাড়ে তার,
বুঝে নেয় প্রতি মুহূর্তের হিসাব!
নিত্য সমস্যার যাতায়াত হোক ঢেউয়ের মত, 
সময়ের মত নয়।



৩) ঢেউ

সাগরপাড়ে আছড়ে পড়ে ঢেউ প্রবল উচ্ছ্বাসে, 
ঢেউ কি জানে সে কেবল ডাকহরকরা?
শান্ত নীলকান্ত বুকের ঝিনুক-বার্তা বয়ে আনা -
আর নগর-সভ্যতার মালিন্য মুছে নিয়ে যাওয়া জলধিগর্ভে - এই তার যাপন।
উচ্ছাসের স্থায়িত্ব কাচ-ভাঙা শব্দের মতই ক্ষণিকের।
শুভ্র জলকণার ফেনিল মেঘ হয়ে লাফিয়ে ওঠার পরেরটুকুই মিলিয়ে যাওয়া এক লহমায়।

স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক








বাঘের খোঁজে বান্ধবগড়ে


এই গরমে কেউ জঙ্গলে যায় ? মানে জুন মাসের গরমে লোকে পাহাড়ে যেতে  পারে, সমুদ্রে যেতে পারে, নদীর ধারেও যেতে পারে, কিন্তু তাই বলে জঙ্গলে ! পাগল না মাথা খারাপ !
জুনের শুরুতে আমাদের মধ্যপ্রদেশ যাবার খবরটা শুনে নানাজনের প্রায় এরকমই প্রতিক্রিয়া ছিল । তা আমরাও আমাদের সিদ্ধান্তে অনড়। মধ্যপ্রদেশেই যাব, তাও আবার এই জুন মাসেই। কারণ ? কারণ আর কিছুই না, দেশের বিভিন্ন জঙ্গল ঘুরে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে যে জঙ্গলে এসে জানোয়ার দেখতে হলে কিন্তু ভরা গরমেই আসতে হবে। যত বেশী গরম পড়বে তত জলের সোর্স কমবে। আর জলের সোর্স কমলে তবে না ভিভিআইপি জানোয়াররা জলাশয়ের আশেপাশে দর্শন দেবেন। তাই হিংস্র জন্তু জানোয়ার, বা সোজা বাংলায় বললে বাঘ দেখতে গেলে এই গরমেই যেতে হবে। হুঁ হুঁ বাবা, কষ্ট না করলে তো কেষ্ট মিলবে না। 
যাই হোক তল্পিতল্পা গুছিয়ে একদিন দুপুরে উঠে পড়লাম শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে।


একটা গোটা দিন ট্রেনে করে চলার পর অবশেষে পরেরদিন দুপুরে কাটনি স্টেশনে নেমে নির্দিষ্ট গাড়ীতে করে রওনা দিলাম বান্ধবগড়ের জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। প্রায় দুঘণ্টা যাত্রাপথের আদ্ধেক রাস্তা পেরিয়ে যাবার পরেই চারপাশে জঙ্গলের রাস্তা শুরু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম, কিছুটা মাঠ আর তারপরেই আবার গাছের সারি। যদিও আসল জঙ্গল থেকে এখনো অনেকটাই দূরে আমরা তবু চারপাশে গাছের আধিক্য অমন কাঠফাটা  রোদেও চোখকে আরাম দেয়। জঙ্গলের বেশ কাছাকাছি এসে গেলে শুরু হয় লাল ধুলো। কিছুটা অংশে তো ধুলোর জন্য তো প্রায় রাস্তাই দেখা যায় না। একদম ফাঁকা এই রাস্তাটা। এতক্ষণ তবু মাঝে মধ্যে মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল। এদিকটায় তাও নেই। যাই হোক অবশেষে বান্ধবগড়ে প্রবেশ করা গেল। ছোট্ট একটা টাউন, গুটিকয়েক টিমটিম করা দোকান, মনিহারি থেকে ওষুধপত্র বা হ্যান্ডলুম কিংবা স্থানীয় হস্তশিল্প সবকিছুরই দোকান রয়েছে। একটি গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, অল্প কিছু পাকা বাড়ী আর তারপরেই শুরু হচ্ছে হোটেল আর জাঙ্গল রিসর্টের লাইন। এখানে প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেশী হাঁটাহাঁটি করতে বারণ করে। পুরো জায়গাটাই তো জঙ্গলে ঘেরা। আমাদের বুকিং ছিল সরকারী ফরেস্ট লজেই। কেন না আগে থেকেই জানা ছিল এটাই একমাত্র জঙ্গলের প্রায় ভেতরে। বাকি সব হোটেল জঙ্গল থেকে একটু দূরে।

“হোয়াইট টাইগার ফরেস্ট লজ” এর মেন গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা বিরাট বড় সাদা বাঘের ছবি দেখে অত গরমে আর ক্লান্তিতেও মনটা খুশী হয়ে গেল। ঢুকেই অফিসঘরে বসে খানিক বিশ্রাম করে নিলাম সকলে। অফিসঘরের লাগোয়া একটা বিরাট ডাইনিং হল রয়েছে দেখেই খিদে পেয়ে গেল ভীষণরকম। সেই কোন সকালে ট্রেনে ব্রেকফাস্ট করেছি। ম্যানেজার ভারী অতিথিপরায়ন মানুষ। আমাদের নানা ব্যাপারে নিজেই জানালেন আর এও বললেন, ‘একদম ঠিক সময়ে এসেছেন আপনারা। এই সময় ভিড় থাকে না একদম। খুব কম লোকে এত গরমে আসে। কিন্তু যারা  আসে তারা সত্যি জঙ্গলপ্রেমী বলেই আসে। বাঘ পাবেনই, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
রুম পেয়েই সবাই মিলে দৌড় লাগালাম চান করতে। পেটে তখন তিন চারটে ছুঁচো একসঙ্গে লাফাচ্ছে।

অফিস থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠে একটা বারান্দায় পড়তে হয়। খোলা আকাশের নিচে প্রচুর গাছগাছালিতে ঘেরা মাচার মতো টানা বারান্দা চলে গেছে বিভিন্ন ঘরের সামনে। লজের পাঁচিলের ওধারেই জঙ্গল। কিংবা বলা যায় জঙ্গলের কিছুটা অংশ এই লজের মধ্যেই চলে এসেছে। গাছগুলোয় ভর্তি পাখি, আর কয়েকটা ঘরের টিনের চালের ওপর হনুমানের দল আমাদের যেভাবে বন্য অভ্যর্থনা জানালো তাতে প্রথমটা একটু ঘাবড়েই গেছিলাম। হোটেলের কর্মচারী অবশ্য বললো হাতে খাবার জিনিস না থাকলে ওরা কিছু করবে না। এখানে ওরা হামেশাই আসে। সবুজ রেলিংওয়ালা লম্বা বারান্দা ধরে হেঁটে হেঁটে ডানদিক বাঁদিক ঘুরে অবশেষে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছলাম।
বেশ বড় ঘরে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে সেটা হল  উল্টোদিকের দেয়াল জুড়ে একটা বিরাট কাঁচের জানলা। জানলা না বলে কাঁচের দেয়াল বলাই ভাল। আর জানলার ওপাশেই এক টুকরো জঙ্গল। যদিও পরে জেনেছিলাম ওটা হোটেলের বাউন্ডারি ওয়ালের মধ্যেই, তবু তাতে ওই জঙ্গলের অনুভূতিটা যায় না। আর এটা আরো বেশী করে বুঝলাম রাতে খেয়ে ফেরার সময়।
দুপুরে সাদা ভাতের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় আমিষ ও নিরামিষ খাবার ছিল। সঙ্গে রায়তা। সেটা গরমের কারণেই। রাতে মিলল রুটি/ভাত, কষা আলুরদম, পনির বাটার মসালা আর আমিষে চিকেন কষা। সঙ্গে পায়েস, যাকে ওরা ক্ষীর বলে। তবে বাঙালী পায়েসের মতো অত মিষ্টি নয়। এলাহি খাওয়াদাওয়া সেরে যখন বারান্দা ধরে হেঁটে আসছি তখন টিমটিমে আলোয় আসেপাশের গাছগুলোকে দেখে কেমন একটা গা ছমছম করে উঠলো। সঙ্গে দূর থেকে ভেসে এলো কোন এক অজানা জন্তুর ডাক। মনে হলো এক ছুটে ঘরে চলে যাই। সারাদিন অত গরম থাকা সত্বেও রাতে জঙ্গলের ভেতরে কিন্তু কেমন একটা হাল্কা শিরশিরে হাওয়া দেয়। এখানে রাতের খাওয়াদাওয়া সারা হয় খুব তাড়াতাড়ি। কেননা ভোরে সাফারি যাবার জন্য উঠতে হয় বোর্ডারদের। আমরাও তাই প্রায় কলকাতার “ভর সন্ধ্যেবেলায় ”, মানে ন’টার সময় ডিনার সেরে গুটিগুটি ঘরের দিকে এগোলাম। পরেরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সাফারি শুরু।   

  
গরম যতই প্রবল হোক জুন মাসের ভোরেও জঙ্গলে হালকা একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকে। দু’দিন থাকবো আমরা। সেই দু’দিনের তিন বেলাই সাফারি বুক করা রয়েছে। বান্ধবগড়ের জঙ্গলকে তিনটে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, টালা, মগধি ও খিটৌলি। এর মধ্যে আবার সাব জোন আছে। প্রত্যেক জিপসিকে নির্দিষ্ট সাবজোন দিয়ে দেওয়া হয়। তার বাইরে তারা যেতে পারে না। প্রথম দিনে আমরা টালা জোনের টিকিট কেটেছিলাম। টালা হলো জঙ্গলের মূল অংশ। যদিও কোর এরিয়ায় সাধারণ পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, তবু বাঘের সাইটিং-এর জন্য টালা জোন বিখ্যাত। হুডখোলা জিপসি করে জঙ্গলের রাস্তায় যেতে যেতে হরিণ, বুনো শুয়োর, বনবিড়াল, ময়ূর, নানারকম পাখি দেখে ফেললাম কিন্তু তেনার আর দেখা নেই। পায়ের ছাপ দেখা গেল অনেক জায়গায়। সেই ছাপ ফলো করে গিয়েও কিছু মিললো না। এখানে এসে একটা জিনিস জানলাম যে বাঘকে হিন্দীতে কিন্তু বাঘই বলে। আমরা অনেকেই জানি বাঘ হলো শের। কিন্তু গাইড ভদ্রলোক জানালেন শের হলো সিংহ আর বাঘ হলো বাঘ।
জানোয়ারের খোঁজে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম সেটা আগে বলি। চলতে চলতে এক জায়গায় পৌঁছে কেমন যেন অন্যরকম লাগল। এত খালি খালি কেন ? অনেকটা জায়গা জুড়ে কেমন যেন শুকনো বর্ণহীন বনভূমি, আর অস্বাভাবিক নিঝুম একটা ভাব। এতক্ষণ পাখির ডাক, বাঁদরের আওয়াজ কানে আসছিল। এখানে সেসব কিছুই নেই। চমকে তাকিয়ে দেখলাম পরপর সারি দিয়ে গাছেদের মৃতদেহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু কাণ্ডটাই রয়েছে কালো হয়ে, ওপরের অংশ পুরোটাই জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছে। গাইড বললেন প্রতিবছর ফরেস্ট ফায়ারে জঙ্গলের একটা অংশ এভাবে পুড়ে যায়। গরম আর শুকনো হাওয়ায় নাকি আপনিই জঙ্গলে আগুন ধরে যায়, আর তারপর তা ছড়িয়ে যায় মাইলের পর মাইল জুড়ে। ওদের কাছে বোধহয় খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, আমার কিন্তু ভয়ঙ্কর লাগলো দেখতে। প্রকৃতি এমন নিষ্ঠুর কেন ? এত এত পূর্ণবয়স্ক প্রাণকে এভাবে অকারণে নষ্ট করে কেন ? কেমন যেন একটা মৃতনগরী হয়ে রয়েছে জায়গাটা। একটাও আওয়াজ নেই। গাইড বললেন এদিকে কোন জানোয়ারও পারতপক্ষে আসে না। প্রায় এক দেড় কিলোমিটার জায়গা জুড়ে চললো পোড়া গাছেদের সেই অসহনীয় দৃশ্য। শেষে গিয়ে এক জায়গায় গাইড দেখালেন রাস্তা কাটা রয়েছে। বেশ কিছুটা জ্বালাবার পর যখন আগুনের তেজ একটু কমে তখন এভাবে রাস্তার মধ্যে পরিখা কেটে আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তবে আরও একটা অদ্ভুত কথা বললেন তিনি। বোধহয় আমাদের মুখ দেখে বুঝেছিলেন এত পোড়া গাছ দেখে আমাদের মনের অবস্থা কি, বললেন, ‘ফরেস্ট ফায়ার কিন্তু একদিকে জঙ্গলের ভাল করে। আগুন লাগলে পুরনো শুকনো গাছ মরে গিয়ে জঙ্গল নতুন হয়। কোন বছর যদি আগুন না লাগে তাহলে জঙ্গলের সবুজ ভাব কমে যায়।’ সত্যি ! কি অদ্ভুত নিয়ম পৃথিবীর, আগুনে পুড়ে সবকিছু শুদ্ধ হয়, এমন কি নতুন প্রাণের জন্মও হয়।
সাড়ে পাঁচটায় শুরু করে মাঝে দশ মিনিটের ব্রেক নিয়ে সাড়ে আটটা অবধি ঘুরেও বড়মিঞার দেখা পাওয়া গেল না। সবাই যখন হতাশ হয়ে পড়েছি, ক্যামেরা আর দুরবীনগুলো যখন হলুদ কালো খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত তখন একটা কাণ্ড ঘটলো। জঙ্গলের রাস্তা খুব এবড়োখেবড়ো, সাধারণ গাড়ী সেখানে চলতে পারবে না। জিপসিতে বসে যেভাবে আমরা আন্দোলিত হচ্ছিলাম তাতে নিজেদের টিনের ভেতর ঝাঁকিয়ে দেওয়া মুড়ির মত মনে হচ্ছিল। অনেক খাল বিল পেরিয়ে, গাছের ডালের ওপর নাচতে নাচতে যাবার পর একটা জায়গা এলো যেরকম জায়গা আমি সেদিন সকাল থেকে আর দেখিনি। একটা খোলা চত্ত্বর, তিনদিকে তিনটে রাস্তা গিয়ছে। ডানদিকে দূরে একটা ন্যাড়া টিলা, সেখানে ছোট বড় পাথরে ভর্তি। আর বাঁদিক ঘেঁষে গাছের সারি গিয়েছে। গাছের সারির পিছনে দেখা যাচ্ছে একটা খাদের ওপারে একটা গুহার মুখ। আকাশ তখন একটু মেঘলা। সকাল থেকে একটানা আগুন ঝরিয়ে আমাদের যেন কিছুক্ষণের জন্য ওয়াক ওভার দিয়েছেন সূর্যদেব। একটা অদ্ভুত ডাক শোনা যাচ্ছিল এদিক থেকে, সেই শুনেই ড্রাইভার এদিকে এসেছে। ডাকটা আসছে ডানদিকের টিলার ওপর থেকে। ডাকটা কোন চেনা পশুর নয়। অনেকটা মানুষের বাচ্চা যেভাবে প্রথম মুখ দিয়ে অর্থহীন আওয়াজে ডাকে সেরকম। এক নাগাড়ে সেটা হয়ে চলেছে। আর কোন আওয়াজ নেই কোথাও। গাছের পাতাও যেন থেমে গেছে। কেমন একটা বুক খালি করা ডাকটা যেন। আমাদের জিপসিটা থেমে গেল একপাশে। গাইড কোন কথা বলছে না, ইশারায় আমাদের চুপ করে থাকতে বলে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে। হঠাৎ একটা বার্কিং ডিয়ারের ডাক চারদিকের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিল যেন। আমাদের গাইড এবার মুখ খুললেন। বললেন এই ডাকটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন উনি। ‘এতক্ষণ যে ডাকটা শুনছিলেন ওটা বাঘের ছানার ডাক। কিছুদিন আগে এখানে তিনটে বাচ্চা দিয়েছে বাঘিনী। এখানে মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা একা রয়ে গেছে। সেটাই মাকে ডাকছে। ওর ডাকে ওর মা আসবেই। বাচ্চাকে ছেড়ে খুব দূরে যায় না। এটাও কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। এখন বার্কিং ডিয়ার ডাকছে মানে ছানার ডাক শুনে মা এদিকেই আসছে।’ আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর কোন ডাক শোনা গেল না। আমাদের জিপসিটা একটু এগিয়ে গেল যেদিক থেকে বার্কিং ডিয়ারের ডাকটা এসেছিল। একটা গোল চক্কর ঘুরে এসে যখন হতাশ আমরা আগের জায়গাটায় আবার ফিরে এলাম তখন সেখানে আর একটা জিপসি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের গাইড বললো বার্কিং ডিয়ারের ডাকটা পাশে চলে গেছে। তার মানে এই রাস্তায় বাঘ আসবে না। দুই ড্রাইভারে কি যেন ঠিক করে নিয়ে যে রাস্তা দিয়ে আগে আমরা এসেছিলাম সেদিকে রওনা দিল। বেশ কিছুটা ঘুরে একটা ঝোপ জঙ্গল মতো জায়গায় আমরা এসে পড়লাম। বোঝা গেল এটা ওই টিলাটার পিছনের দিক। এখান থেকে টিলাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। একগাদা ঝোপে ঢেকে রয়েছে জায়গাটা। টিলার সামনের দিকটা যেমন ন্যাড়া এদিকটায় আবার তেমনি জঙ্গল। আবার বার্কিং ডিয়ারের ডাকটা শোনা গেল। এবার আর একটু কাছ থেকে। সঙ্গে বাঁদরের ডাকো। এদিকে আবার সেই বাচ্চাটা দুবার ডেকে উঠলো। গাইড বলে দিয়েছিল বলেই কিনা জানি না এবার কেমন যেন মনে হলো স্পষ্ট শুনলাম ডাকটার সঙ্গে আমাদের ‘মা” ডাকের খুব মিল আছে। এবার গাইডের নির্দেশ অনুযায়ী দূরে এক জায়গায় চোখ রাখতেই বুঝলাম ঝোপগুলো দুলছে। সেখান দিয়েই আবির্ভূত হলেন তিনি। চকচকে হলুদ কালোর চলমান গোলা নিঃশব্দে ঝোপের পাশ দিয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে টিলার ওপরে উঠে একটা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাচ্চার ডাকে সাড়া দিতে এক মায়ের ব্যস্ততা দেখলাম।
সেদিন সময় শেষ হয়েই এসেছিল, তাই ফেরার পথে পা বাড়ালাম আমরা। সেদিন বিকেলে মগধি জোনে ও পরেরদিন টালাতে আবার এসেও আর তেনাদের দেখা পাওয়া যায়নি। তবে তাতে জঙ্গল দেখার মজা কিছুমাত্র কমে যায়নি। প্রচণ্ড দাবদাহ সহ্য করে আড়াই দিন কাটিয়ে যখন ফেরার ট্রেনে উঠলাম তখন আমাদের মন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। প্রকৃতি যে এই চরম গ্রীষ্মের নির্মম রোদে আমাদের জন্য এতরকম চমক সাজিয়ে রেখেছে তা সত্যিই আমরা ভাবতে পারিনি। আবার কোন এক গ্রীষ্মে চলে আসবো ওদের সঙ্গে দেখা করতে। তখন হয়তো এই ছানাটাই একটা বড়সড় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হয়ে দর্শন দেবে আমাদের।
 


সিলভিয়া ঘোষ




গুচ্ছ অণুগল্প



(১)  ড্রয়িং খাতায় আঁকা নতুন ছবিটা দেখানোর জন্যে ডান  হাতে করে অধীর আগ্রহে  অপেক্ষা করছে পাঁচ বছরের  ছোট্ট সালমা, বন্ধু সুনেত্রার জন্যে।  বাঁ হাতটা টনটন করছে।  ব্লাড চলছে যে।  বড় হয়ে সেও বন্ধুর  মতোন  হবে।  হাসি খুশিতে ভরা থ্যালাসেমিয়া ডাঃ সুনেত্রার দেওয়া ড্রয়িং খাতায় সেই ছবিটাই এঁকেছে সে। 

(২)  মেয়ে কে  পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে শিখিয়ে দিয়েছেন যশবিন্দর।  সেই কথা অনুযায়ী  পরিণতি   ঐ 
ইজি রিভলভিং চেয়ারটাতে বসে থাকা বৃদ্ধের পা ছুঁতে-ই  সম্বিত ফিরে পেলেন  ডাঃ চক্রবর্তী। তার হাতে তৈরী 
 প্রথম টেস্ট টিউব বেবী যশবিন্দরের মুখের আদলটা হুবহু কেটে বসিয়ে দিয়েছেন  ভগবান তার  মেয়ে পরিণতির শরীরে।  জীবনে প্রথম টেস্টটিউব বেবীর অাত্মজার  মুখোমুখি  তিনি।

(৩) ভিড় লাইন ঠেলে এর ওর সাথে মতানৈক্য করতে করতে  গ্রামের সরকারি  ডাক্তারখানার ভাঙা  টেবিলের  সামনে  যে মহিলা  এগিয়ে  এলেন অর্থোপেডিক্স সার্জেন ডাঃ সব্যসাচী ঘটকের সামনে তাকে চিনতে এতটুকু ভুল করলেন না ডাক্তার বাবু। কুড়ি বছর  আগে এই  টেবিলেই  প্রসূতি নীলোফারের ক্রিটিক্যাল  ডেলিভারি কেস যে তাকেই সামাল দিতে হয়েছিল প্রতিকূল পরিবেশে। মুখ তুলে চোখের ইশারায়  জিগ্যেস করলেন কি দরকার? নীলোফার একটা কার্ড রেখে বললেন মৃণালের বিয়েতে আপনাকে  আসতেই হবে ডাক্তার বাবু। তার আগে মৃণাল আর তার হবু স্বামী রাজার একটা রক্ত পরীক্ষা করাতে চাই  আপনার হাসপাতালে। 'মৃণাল' নামটা যে ডাঃ ঘটকেরই দেওয়া, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট এক প্রতিবাদী চরিত্র। ডাক্তার বাবুর চোখে জল

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পথের ওপর পথ
------------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়




         পথের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে কত কত মানুষ। সকলের পথ তো এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন পথে তাদের হেঁটে চলা। আমার সামনে কত কত মানুষ। আমার পিছনেও অনেক। আমরা কি সবাই তাহলে এক পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি। কখনোই নয়। আমার পথ সে তো আমারই। আমারই রঙে রঙিন হয়ে আছে সে। আমারই শব্দ দিয়ে সাজানো তার শরীর। আমার জন্যেই কথা বলে ওঠে আমার পথ। 

          আজকের কথা তো নয়। সেই কোন সকালে পথে পা রেখেছি। এখন অনেকটাই বেলা হল। এখনও পথ আমাকে তার বুকের ওপর ধরে রেখেছে। আমাকে পথ একটু একটু করে চিনিয়ে দেয় তার শরীর। আসলে আমি তো পথ চলি না। সবাই যখন দেখে আমি পথ হাঁটছি, আমি নিজেও যখন আমাকে পথের ওপর সচল দেখি তখন সকলের মতো আমারও মনে হয় আমি পথ হাঁটছি। কিন্তু এই চলা তো পথচলা নয়। পথের শরীরকে একটু একটু করে চেনার চেষ্টা। পথের বর্ণমালাকে আপন হৃদয়ে ধারণ করার অভিযান। 

          বর্ণমালা চেনার পর্ব শেষ হলে আমি শব্দ চিনি। কত কত শব্দ। মনে হয় তারা আমার খুব চেনা। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও যেন তাদের দেখেছি বলে মনে হয়। তাদের শরীরের গন্ধও যেন আমার কত চেনা। মনে পড়ে, এ তো পথের শব্দ। কত সময় ধরে সে আমাকে একটু একটু করে সবকিছু চিনিয়েছে। এত সহজে কি তাদের ভুলে যাওয়া যায়? সাহসে ভর করে আমি একটার পর একটা শব্দ সাজাই। অশক্ত বাক্যগুলোর গায়ে দেখতে পাই হিম পড়েছে। অদ্ভুত ভাবে তারা কাঁপে। বুঝতে পারি আমার পা টলছে। এগিয়ে আসে পথ। হাতে ধরে বাক্য ঠিক করে দেয়। আমার খাতা জুড়ে শুধু সংশোধন। আমি বুকে জোর পাই। এক একটি সঠিক বাক্যের উত্তাপ আমাকে হিমশীতল গহ্বর থেকে উঠিয়ে আনে। 

          আমি পথকে ধরতে পারি। একটু একটু করে বাক্যজালে বেঁধে ফেলি পথের শরীর। এখন পথ তো আমার হাতের মুঠোয়। আমি দেখতে পাই পথ নিজেও অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। আসলে আমার গতিপথ দেখেই তার এই স্থিরতা। আমি আমার সাদা ক্যানভাসে বাক্য সাজাই। একটার পর একটা বাক্য। তৈরি করে ফেলি পথের শরীর। 

          আমার পথ সে তো আমারই কথা। আমারই প্রিয় রঙে রঙিন হয়ে আছে সে। আমার কষ্ট কষ্ট কথার মালায় ফুল হয়ে ফুটে আছে সে। কখনও দুপুরের ভীষণ উত্তাপে সে উজ্জ্বল। আমাকেই সে চেনা দেয় আমার মতো করে। 

          কত না মানুষ হেঁটে গেছে পথ ধরে। তাদের মতো করে তারা তাদের পথকে সাজিয়েছে। হয়ত সে রঙকে আমি চিনি। কিন্তু তার ইতিহাস আমার অজানা। আমার অপ্রয়োজনীয় রঙেই সে গড়ে তুলেছে তার পথের আল্পনা। কখনও কোথাও দেখি আমার প্রয়োজনীয় রঙের ছিটেফোঁটা লেগে আছে তার পথের চোখে মুখে। কিন্তু তা দিয়ে তো চেনা যায় না সমগ্রকে।

          আমার আগের মানুষ তার নিজের মতো করে চিনে নিয়েছে তার পথকে। এক পা , এক পা করে রেখা এঁকে গেছে তার পথে পথে। সে রেখার যা অর্থ হয় তা শুধু খুঁজে পাওয়া যায় তারই অভিধানে। সে বিমূর্ত রেখার একমাত্র সমর্থক শুধু সে নিজেই। তার মতো করে সেই রেখার সমীকরণ সঠিক। এই রেখায় সে এতটাই বিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে, চোখের সামনেও সে ওই একই রেখার মিছিল দেখে। দেখতে চায় অন্যের পথেও। সফলতার যে রেখাচিত্র সে সারাজীবন ধরে এঁকেছে সেটাই সে মনে করে সর্বজনগ্রাহ্য রেখাচিত্র। 

          প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব পথের সপক্ষে চিৎকার করে। আমার পথ নিয়ে শুধু আমিই ব্যস্ত থাকি না। কি দরকার আমার অন্যের পথের মূল্যায়নে। প্রতিটি পথ তার নিজের ঘাম, রক্তবিন্দু দিয়ে তৈরি। আমার পথে তোমার পথের সমীকরণ কিছুতেই খাটবে না। আবার এটাও তো সত্যি, আমার পথের ওপর কিভাবেই বা মেনে নি অন্যের পথের শরীর। 

          সেই কবে প্রথম যখন পথের ওপর এসে দাঁড়াই তখন কে-ই বা আমায় চিনত! পথ আমাকে নিয়েছিল তো। একটু একটু তাকে চিনেছি। কত কাছ থেকে গভীরভাবে তাকে দেখেছি। ভালোবেসে ফেলাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যকে অস্বীকার করা -------
" আমি ঠিক পথে হাঁটছিলাম / আর সে ভুল পথে / কিন্তু সে-ও ভাবছিল / সে-ই ঠিক পথে হাঁটছে / আর আমি ভুল পথে ; / কেউ একজন মনে হয় / আমাদের দুজনকে দেখেই / ফিক্ ফিক্ করে হাসছিল । "

          একসময় কত মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলেছে  -------- আমার পথ নাকি ভুল। আমি খুব হেসেছি। পথ কি ভুল হয় কোনোদিন? না, পথ ভুল হয় না। যে পথের জন্য যে যোগ্যতা লাগে ------ এটা তো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। যে পথের জন্য যে কৃচ্ছ্রসাধন ------ মাথায় রাখতে হবে সে কথাও। আমরা যদি সেই সাধনপথে যেতে অপারক হই, পথ আমাকে কেন সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেবে? এ তো ভুল পথের দৃষ্টান্ত নয়। এ আমারই অক্ষমতা। পথের মতো হয়ে আমি পথে হেঁটে যেতে পারি নি। এমনও তো হয়েছে পথ বদলে এসেছে আকাঙ্ক্ষািত সাফল্য। এই সাফল্যও ওই পথের ইতিবাচক দিক নয়। আসলে ওই পথ যা চেয়েছে আমার মধ্যে তা-ই ছিল। আজকের সফলতা সে পথেই।











তুষ্টি ভট্টাচার্য




                   পেট গুড়গুড়

    সকাল থেকে খিক খিক খুক খুক হাসিতে পেটটা গুড়গুড় করছে। সিঁড়ির কোণে, বাথরুমে গিয়ে গিয়ে এগারো বার হেসে এলাম লুকিয়ে লুকিয়েছাদে উঠে কুঁড়িগুলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে বারোতম হাসিটা হেসেই ফেললাম! ওমা, আর যায় কোথা – প্রশ্ন উড়ে এলো , “ কি হল হাসছ কেন ?” কী কেলো ! ধরা পড়েই গেলাম শেষ পর্যন্তগম্ভীর মুখে নেমে ভাবতে বসলাম, এত গুড়গুড়ে হাসির কী কী কারণ থাকতে পারে আমারঘণ্টা দুয়েক ভেবেটেবে কারণগুলোকে লিপিবদ্ধ করে ফেললাম এই ভাবে –
১) চাদ্দিকে লোকজন বেতাল রেটে কেস খাচ্ছে অথবা খাওয়াচ্ছে ,
২) আমি একসাথে গণ্ডা চারেককে মুরগী করতে পেরেছি ,
৩) কবিতা টবিতা আর আসছে না ,
৪) সারাদিন এফবিতে সময় কাটাতে পারছি ,
৫) আমার এক চরম শত্রু, যে কিনা আমার ভয়ে এফবি ছেড়ে পালিয়েছে, তারই উক্তি এটা – আমার সামনের দাঁতগুলো বড় বড় কিনা, তাই ওমনি হাসি হাসি মুখ দেখাচ্ছে,
৬) শেষ হাসিটা আমিই হাসব ভেবে আগে থেকেই আহ্লাদিত হচ্ছি ।
না , আমি পাগল-ছাগল বা বোকাসোকা নই মোটেই । দিব্যি জ্ঞান টনটন করছে । যাই হোক , এখনও হাসির বা পেট গুড়গুড়ের নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাইনিপেটের গুড়গুড় ও হাসি চলছেই ...
    শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের পরামর্শে সাইকিয়াটিস্টের কাছে গেলাম একবার। যাওয়ার সময়ে মনে মনে নিজেকে সমানে উৎসাহ দিয়ে গেলাম, ব্রেভো, ওয়েলডান, ইত্যাদি বলতে বলতে। নিজেকে খুব আধুনিক মনের মানুষ মনে করছিলাম তখন। কেননা, এই যে যাচ্ছি, আমার একবারও সংকোচ হল না, মনে এলো না – ইসস আমি কি পাগল নাকি! কারণ, আমি আধুনিক মনস্ক মানুষ, আমার মনে যদি কোনো সংশয় আসে, আমি সেই মনের জট ছাড়াতে মনের ডাক্তারের কাছে যেতে পিছপা হই না। আমি সত্যিই অত্যাধুনিক হয়ে উঠছি, বুঝতে পারছিলাম নিজেই! যাই হোক, ডাক পড়লে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। খুব মিষ্টি করে হেসে ডাক্তারবাবু বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন – আপনার সমস্যাটা কী? আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ, কখন এই প্রশ্ন আসবে। এবার গড়গড় করে আমার গুড়গুড়ের কথা বলে ফেললাম। ভেবেছিলাম, উনি বোধহয় অবাক হবেন। তো দেখলাম, ওনার মুখের একটি রেখাও কাঁপল না। আমাকে দেওয়ালে টানানো একটা বোর্ড দেখিয়ে বললেন, সবুজ আলোটা দেখতে পাচ্ছেন? আমি তো থ! কোথাও কোনো সবুজ আলো নেই এ ঘরে। আর আমি রঙ-কানাও নই, তাহলে! শেষমেশ বলেই ফেললাম – নাহ, এই ঘরে কোনো সবুজ আলো নেই। এবার উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কী কী দেখতে পাচ্ছেন ওই বোর্ডে ?” আমি আবারো খুঁটিয়ে দেখলাম। দেখলাম – একটা নিরীহ বোর্ডে একটা সাধারণ হলুদ বাল্বের নীচে আরও কয়েকটা অতি নিরীহ কাগজ বোর্ড-পিনে গেঁথে ঝুলছে। বুঝতে পারছিলাম না ডাক্তার কী চায়। বোর্ড, বাল্ব না কাগজ! আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে যাওয়ার ভাণ করে, সপাটে গড়গড় করে যা দেখলাম তাই বলে দিলাম।
      ডাক্তার দেখলাম গম্ভীর মুখ করে খসখস করে প্রেশকিপশান লিখতে লাগলেন। আমি ভেতরে ভেতরে আরও ঘামতে লাগলাম। এরপর মুখ তুলে উনি আমায় বললেন, আপনার একটা বিরাট গোলমাল হচ্ছে কোথাও। আমি তুতলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কো...থাথায়?  তো তিনি একটা খুব শক্ত রোগের নাম বললেন। আমি ওরকম সিনড্রোমের নাম আগে কোথাও শুনিনি। যা থাকে কপালে, এই ভেবে বলেই ফেললাম, ডাক্তার বাবু – আমি কি আর বাঁচবো না! প্লীজ আমায় বাঁচান!! আমি কিছুতেই ডিপ্রেশানের ওষুধ খাবো না, কিছুতেই ইলেক্ট্রিক শক খাবো নাআআআআআআ...। এবার বোধহয় ডাক্তারবাবু ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন, ডোন্ট ওরি, আপনাকে এসব কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু সপ্তাহে একবার আমার চেম্বারে আসবেন, এসে আমার সাথে একটু গল্পটল্প করে যাবেন। আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম – ব্যাস এতেই হবে! একমুখ হাসি নিয়ে তিনি ঘাড় নাড়লেন। আমিও ওনার ফিজ দিয়ে চলে এলাম। পরের সপ্তাহে এলে, উনি আবার সেই বোর্ড আর সবুজ আলোর খেলায় মাতলেন। এবারও যথারীতি আমি সবুজ আলো দেখতে পেলাম না। তার পরের সপ্তাহেও তাই, তার পরেও তাই।
       হঠাৎ রাতে শুয়ে আমার মাথায় এলো, আরে এভাবে ডাক্তার ব্যাটা আমায় উল্লু বানাচ্ছে না তো! শুধুশুধু আমার কিছু পয়সা খসিয়ে দিল! ঠিক আছে আবার গেলে আমি বলে দেবো – হ্যাঁ আমি সবুজ আলো দেখতে পাচ্ছি। ব্যাস যেমন ভাবা তেমনই কাজগটগট করে চেম্বারে ঢুকে প্রশ্নের অপেক্ষায় বসে রইলামঅবশেষে প্রশ্ন এলো – সবুজ আলো দেখতে পাচ্ছেন? আমি উত্তর নিয়েই বসে ছিলাম, ফটাস করে ছিটকে বেরোল উত্তর – হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি আবার বললাম – হ্যাঁএইবার উনি বললেন, আর আসতে হবে না আপনাকে। আপনার রোগ সেরে গেছেঠিক একমাস পরে এসে আমায় রিপোর্ট করবেন, এর মধ্যে আপনার পেট গুড়গুড় আর করেছে কিনা। আমার ঠিক বিশ্বাস হল না, তবুও ভাবলাম দেখাই যাক না, কী হয় একমাসে ! একমাসের মধ্যে যখনই পেট গুড়গুড়ের কথা মনে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের সবুজ আলোর প্রশ্নটাও মাথায় ধাক্কা মেরেছেফলে পেট আর মাথার ভীষণ ঠোকাঠুকিতে গুড়গুড় আর সবুজ আলো দুটোই ভ্যানিশ! নাহ আমার আর পেট গুড়গুড় করে না, আর সবুজ আলো দেখার জন্য ডাক্তারের কাছে ফিজ গুনতেও যেতে হয় না
        এই তো এখন আমি দিব্যি সুস্থ । আমি আর আমার সত্যি-গুড়গুড় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করি না । মিথ্যে কোনো সবুজ আলোও আর তাড়া করে না। পেট আছে, খিদেওযেমন আলো আছে তার স্বমহিমায় । শুধু ওই পেট গুড়গুড় ভীষণ ভাবে মিথ্যে হয়ে গেছেআর যে মিথ্যে সবুজ আলোর ভয়ে আমি ঠিক হয়ে গেলাম, সেই সবুজ আলো মাথার কোনো লুকনো ঘরে দপদপ করে জ্বলছে আজও 


মলয় রায়চৌধুরী

‘ওয়ান শট’ : একটি অসাধারণ ছোটোগল্পের বই - লেখক অবনী ধর

         অধিকাংশ পাঠক অবনী ধরের নাম শোনেননি, অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি অসাধারণ ছোটোগল্পের বই দিয়ে গেছেন ।
           ১৯৬৮ সালের সন্ধ্যা । হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জড়ো হয়েছেন জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য । টেবিলে উঠে পড়লেন অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন এই গানটা, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সবাই, এমনকি হাংরি আন্দোলনের কয়েকজন ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । যে সাংবাদিকরা খবর কভার করতে এসেছিলেন তাঁরাও গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা । পরের দিন দি স্টেটসম্যান যে সংবাদ দিয়েছিল তাতে ভাসা-ভাসা উল্লেখ ছিল । সেই সপ্তাহের ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।
        ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য ।
         অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান সট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকার ।

         গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:
জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,
হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ
শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।
উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ ।

         ১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত  থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ।
         প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্নচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য।
         আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।
         ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেকন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল  সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।
         পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প -- সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্‌হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো ।
         ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না ।
         বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন আলোচককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে যে, উপন্যাস আর্ট ফর্মটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ছোটোগল্প আর্টফর্মটিকে সম্পূর্ণ দেশজ করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সনেট-তের্জারিমা-ভিলানেলকে এতদ্দেশীয় করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী ইত্যাদি ।  এই যে একটি ভিন্ন ভাষসাহিত্যের সংরূপকে আরেকটি ভাষাসাহিত্যে এনে সংস্হাপন, এর জন্য দ্বিভাষী দক্ষতা এবং সংরূপটি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই যথেষ্ট নয় । যিনি এই কাজটিতে লিপ্ত, তাঁর গ্রাহীক্ষমতা, বহনক্ষমতা ও প্রতিস্হাপন ক্ষমতা থাকা দরকার। অমন ক্ষমতা গড়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে । আর এই জ্ঞান আহরণ তখনই সম্ভব যখন আ্হরণকারীর লেখক-প্রতিস্বের নির্মাণ ঘটে জ্ঞানটির পরিমণ্ডলে ।
         অনির্মিত লেখক-একককে ব্র্যাণ্ডার ম্যাথিউজ প্রণীত ছোটোগল্পের সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা যাক । ‘দি ফিলজফি অফ দি শর্ট স্টোরি’ বইতে ম্যাথিউজ বলেছেন, “যাহা কেবলমাত্র গল্প এবং পরিসরে ক্ষুদ্র, তাহাই ছোটোগল্প নহে । ভাবের ঐক্য ছোটোগল্পের পক্ষে অপরিহার্য এবং এইখানেই উপন্যাসের সহিত ইআর পপধান প্রভেদ । ছোটোগল্পে ভাবের ঐকভ আছে, উপন্যাসে নাই ।  ক্ল্যাসিকাল ফরাসি নাটকের তিনটি ঐক্যই ফরাসি নাটকে আছে ; ইহা একটি ক্ষেত্রে, একটি দিনে, বিশেষ একটি ঘটনা দেখায় । ছোটোগল্পে একটিমাত্র চরিত্র, ঘটনা বা ভাব থাকে, অথবা একটিমাত্র পরিস্হিতির পটভূমিকায় কতকগুলো ভাবের সমাবেশ ঘটে।” এখন, অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কাছে ‘ভাবের ঐক্য’, ‘ভাবের সমাবেশ’ ‘ক্লসিকাল ফরাসি নাটক’ ইত্যাদি ভাবকল্পগুলো দুর্ভেদ্য থেকে যাবে, এবং ব্যাখ্যার পরও বিমূর্ততা কাটবে না ।
         ‘অ্যান ইনট্রোডাকশান টু দি স্টাডি অফ লিটারেচার’ বইতে দেয়া ডাবলু. এইচ. হাডসন-এর তৈরি অনুশাসনের প্রেক্ষিতেও ব্যাপারটা বিচার করা যেতে পারে । হাডসন বলেছেন, “ছোটোগল্পে শিল্পকলার মূল্য নির্ধারণের জন্য ‘একক উদ্দেশ্য ও ভাবের ঐক্য’ বজায় আছে কিনা তা দেখা উচিত।” এখানেও প্রশ্ন উঠবে ‘শিল্পকলা’, তার ‘মূল্য নির্ধারণ’ এবং ‘একক উদ্দেশ্য’ ভাবকল্পগুলো নিয়ে । বস্তুত যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার সরবরাহ করা সংজ্ঞায় খাপ খায়নি বলে পূর্ণচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখা ‘মধুমতী’ রচনাটিকে সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হয়নি । সার্থক ছোটোগল্পের তকমা দেয়া হল ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দেনাপাওনা’ রচনাটিকে । ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে গভীরভাবে বুঝতে না পারলে ‘সার্থক’ ছোটোগল্প লেখা সম্ভব ছিল না । সার্থকতা নামের মানদন্ডটি ওই চিন্তনতন্ত্রের ফসল । বর্তমান কালখণ্ডে ওই চিন্তনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ।
        ওপরের কথাগুলো এইজন্য বলতে হল যে অবনী ধর, যাঁর চোদ্দটি গদ্য নিয়ে ‘ওয়ান সট’ বইটি  প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি ছোটোগল্প-লেখক বা গল্পকার হওয়া-হওয়ি অবস্হান থেকে সেগুলো লেখেননি, এবং তাঁর লেখক-প্রতিস্বটি ছিল অনির্মিত । ১৯৬৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত, এই কালখণ্ডে তিনি এও চোদ্দটি গদ্যই লিখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের পর তিনি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল, অশোকনগরে, কিন্তু তখনও তিনি লেখালিখি আরম্ভ করেননি, যদিও তিনি নিজের জীবনের এই ঘটনাগুলো শোনাতে ভালোবাসতেন । তাঁর কথনভঙ্গিমা ও জীবননাট্যের ঘটনা থেকে স্পষ্ট ছিল যে কথাবস্তুর পরিসরটি সেই সময়ের সাহিত্যিক ডিসকোর্স এবং কাউন্টার-ডিসকোর্স থেকে একেবারে আলাদা, এমনকী হাংরি আন্দোলনের গল্পকার-ঔপন্যাসিক থেকেও আলাদা । ১৯৯৪ সালে কলকাতায় ফিরে জানতে পারি যে অবনী ধরের রচনাগুলো নিয়ে বই বের করার উৎসাহ কোনও হাংরি আন্দোলনকারী দেখাননি । আমি শর্মী পাণ্ডেকে অনুরোধ করি যে অবনী ধরের গদ্যগুলো নিয়ে একটা সংগ্রহ ওদের শিলালিপী প্রকাশনী থেকে বের করতে । শর্মী আর ওর স্বামী শুভঙ্কর দাশ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায় আর আমাকে একটা ভূমিকা লিখে দিতে বলে । এই সময়ে অবনী ধরের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটে আর ওনার জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলি । অবনী ধর বইটার নাম রেখেছিলেন ‘ওয়ান শট’, কিন্তু প্রচ্ছদ আঁকার সময়ে তা ‘ওয়ান সট’ হয়ে যায় ।
         অবনী ধর জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালে, তখনকার পূর্ববঙ্গের মাদারিপুর জেলার কালাকিনি থানার পাঙাশিয়া গ্রামে. তাঁর মামার বাড়িতে । মারা যান ২০০৭ সালে, অশোকনগরে । তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র ধর ( ১৯০৫ ) ওই জেলার মাইচপাড়া গ্রামের নিবাসী ছিলেন, সাত ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট ; বঙ্কিমচন্দ্র ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন, কিন্তু কখনও কোনও চাকরি বা ব্যবসা করেননি ; স্বাদেশী আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে কয়েকমাসের জেল হয়েছিল তাঁর । বঙ্কিমচন্দ্র তখনকার দিনের ম্যাট্রিক পাশ ছিলেন, অর্থাৎ যে চিন্তনতন্ত্রের কথা একটু আগে বলেছি, তার মননবিশ্বে অবনী ধরের প্রতিস্বনির্মাণের সুযোগটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, বিশেষ করে অবনী ধর যখন তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ।
         অবনী ধরের বয়স যখন এক বছর, তখন তাঁর বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে, তাঁর মা লাবণ্য ধর ( ১৯১৫ - ১৯৭৭ ) , আর ঠাকুমাকে নিজেদের ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে, অন্য এক তরুণীর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, এবং বাকি জীবন বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গিনী বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরূপে ভিক্ষা করে চালিয়েছিলেন । যদিও বঙ্কিমচন্দ্র মারা যান ১৯৬২ সালে, তাঁর মৃত্যুর খবর অবনীরা পান ১৯৭২ সালে । ততোদিন তাঁর মা শাঁখা-সিঁদুর পরতেন । অবনী ধরের লেখক-প্রতিস্ব প্রাগুক্ত চিন্তনতন্ত্রের  পরিসরে যদি গড়ে উঠত, তাহলে তিনি এই ট্র্যাজেডির মুহূর্তটি নিয়ে একটি কথাবস্তু তৈরি করতে পারতেন, কেননা ইউরোপীয় সাহিত্যে গ্রিসের সময় থেকে ব্যক্তি-এককের ট্র্যাজেডিটি লেখকত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান ছিল, যা খ্রিস্টের নৃশংস হত্যা ও আত্মবলিদানের প্রতীকি অতিকথার প্রচার-প্রসারের কারণে সাহিত্যের নন্দনক্ষেত্রটিকে দখল করে নিতে পেরেছিল । তাছাড়া বাইবেলোক্ত “আরিজিনাল সিন” বা প্রথম পাপের পতনযন্ত্রণাকে সর্বজনীন নৈতিক-দার্শনিক বনেদে পালটে ফেলার জন্যেও জরুরি ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যের পাতায় পাতায় ব্যক্তি-ট্র্যাজেডির উপস্হিতি ।
         অবনী ধরের জীবনে বহুবার বহুরকম ট্র্যাজেডি সংঘটন দেখা গেছে, কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতার সরাসরি মালিকানা সত্তেও তিনি সংঘটন-মুহূর্ত বা ক্লাইম্যক্স বা হুইপক্র্যাক এনডিং প্রয়োগ করে কথাবস্তুকে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-অনুশাসন ও হেলেনিক মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত করেননি । প্রকৃত প্রস্তাবে কথাবস্তুগুলো গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক সাহিত্য-মূল্যবোধের আওতার বাইরে । প্রসঙ্গত, যে সময়ে অবনী ধর তাঁর প্রথম পর্বের গদ্যগুলো লিখেছিলেন, সেসময়ে মান্যতাপ্রাপ্ত বাংলা ছোটো গল্পকাররা ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুশাসন মোতাবেক, বিষণ্ণতা, পারক্য, প্রেমের বিকার, মৃত্যুপ্রবণতা, নিঃসঙ্গতার বেদনা,শহুরে যৌনতা ইত্যাদির চর্চা করছিলেন ।
         বাবা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁদের একা ফেলে নিরুদ্দেশ হবার কারণে বছর পাঁচেক অন্নকষ্টে ভোগার পর তখনকার বিহারে ( এখন ঝাড়খণ্ড ) মধুপুরনিবাসী অবনীর ‘বুড়োমা’ অর্থাৎ তাঁর ঠাকুর্দার ভাইয়ের স্ত্রী, অবনী ও তাঁর মাকে দেখাসোনার জন্য, ও নিজের বার্ধক্যে দেখভালের জন্য, সেখানে নিয়ে গেলেন । যদিও অবনীর জ্যাঠামশাবরা, প্রথম দুজন ডাক্তার, ততীয়জন উকিল, চতুর্থজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে দেওঘর ও মধুপুরে আশ্রম বসিয়ে তার মোহন্ত ছিলেন, অবনীর পড়াশুনার এবং স্কুলে ভর্তি হবার সুরাহা হলো না । বুড়োমার আশ্রয়ে অবনী ও তাঁর মায়ের অন্ন সমস্যার সমাধান হলেও, শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটল না । স্কুলে ভর্তির জন্য অবনীকে কলকাতার চেতলায় মামারবাড়ি যেতে হলো । প্রবাদবাক্যের মামার বাড়ির আবদারের বদলে অহরহ দুর্ব্যাবহার জোটায়, ১৯৫০ সালের পয়লা অক্টোবর, কাউকে না জানিয়ে, স্কুল থেকে পালিয়ে, অবনী চলে গেলেন মার্চেন্ট নেভিতে, খালাসির কাজ নিয়ে । তখন তাঁর ষোলো বছর বয়স ।
         এই সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো অবনী সংগ্রহ করেন জাহাজে খালাসির কাজ করার সময়ে, বিভিন্ন দেশের বন্দর-শহরে, ইউরোপ তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাঙন কাটিয়ে উঠতে পারেনি । বস্তুত তাঁর খালাসিপর্বের কথাবস্তুগুলো, কথনভঙ্গীর অন্তর্গত আহ্লাদময়তার কারণে, সুখশ্রাব্য ও কৌতূহলোদ্দীপক ছিল, যে গল্পগুলো বাসুদেব দাশগুপ্তকে তিনি শোনাতেন । অনেকে মনে করেন বাসুদেব দাশগুপ্তের গল্পগুলোর উৎস হলো অবনী ধরের অভিজ্ঞতা । লেখালিখি না করেও অবনী ধর তাঁর জীবনযাপনের কারণে নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করতেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে খালাসিটোলায় ঢুঁ মারতেন । বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষের প্ররোচনায় সোনাগাছির যৌনকর্মী বেবি, মীরা এবং দীপ্তির সঙ্গে নৈকট্য গড়ে ফেলেছিলেন ।
         হাংরি আন্দোলনের সময়ে, উৎসাহদানকারী সম্পাদক ও স্তাবকদলের অভাবে, এবং অবনী ধরের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খার অনুপস্হিতিতে, তাঁর বলা কাহিনিগুলো লিখিত পাঠবস্তুর আকার নিতে পারেনি । জরুরি অবস্হার শেষে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটলেও, সম্পাদকরা অবনীর গদ্য সম্পর্কে আগ্রহী হননি, মূলত তাঁর কথনভঙ্গীর ও রচনাকাঠামো বিদ্যায়তনিক সংরূপ বহির্ভূত ছিল বলে । একজন খালাসির গদ্যসন্দর্ভে যে যাযাবরতার নিবাস, যার উপকরণগুলো যাত্রাপথের খুদে অনির্ণেয়তায় তাৎপর্যময়, যার বিন্যাসে ভাসমান পরিভ্রমণের অনুন্মোচিত বাচন, স্নায়ুভাষায় রচিত সেরকম স্বতঃজাত কৃৎপ্রকরণ, স্বীকৃতি পায়নি লিটল ম্যাগাজিন স্তরেও । যেহেতু অবনীর পাঠবস্তু আত্মমগ্নতাকে অতিক্রম করে যায়, এবং তাঁর বাকব্যঞ্জনা বদ্ধসমাপ্তির কাঠামোটাকেই উপহাস করে, প্রধাগত আলোচকদের দৃষ্টিও তিনি আকর্ষণ করতে পারেননি ।
         অবনীর ও তাঁর আত্মীয় পরিজনের পরিবারে নিরুদ্দিষ্ট, সাধু, সন্ন্যাসী, মোহন্ত, ভিখারি-বৈষ্ণব, বাউল ইত্যাদির পূর্বেতিহাস থাকার কারণে অবনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মা চিন্তিত ছিলেন । বয়ঃসন্ধি অতিক্রান্ত সন্ধিক্ষণে তাঁর ছেলে হয়তো কোনও বন্দরশহর থেকে বিদেশিনী বিয়ে করে বা না-করে সঙ্গে এনে একদিন হাজির হবেন, এমন দুশ্চিন্তাও লাবণ্য ধরের ছিল । ছেলের চরিত্রে অভিজ্ঞতাজনিত পার্থক্যও তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন । তিনি অবনীকে বললেন জাহাজের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসতে । খালাসির চাকরি ছেড়ে ১৯৫৫ সালে ফিরে এলেন অবনী ।  বুড়োমা মারা যেতে তাঁর মা মধুপুরে একা হয়ে পড়েছিলেন । অবনী দেশে ফিরে চেতলার একটা বস্তিঘরে, মামার বাড়ির কাছে, বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে মধুপুর থেকে নিয়ে এলেন । ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩, এই আট বছর টাকা রোজগারের জন্য নানা রকম জীবিকার অভিজ্ঞতা হলো অবনীর --- ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়ি চালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লা ফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করলেন । ১৯৬২ সালে অবনীর মা পাত্রী নির্বাচন করে সাধনার সঙ্গে তাঁর বি্য়ে দেন ।
         অবনী তাঁর সংসার ইতিমধ্যে চেতলা থেকে নতুন গড়ে-ওঠা উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কলোনি অশোকনগরে তুলে নিয়ে যান । তখন সেখানে স্হানীয় স্বায়ত্বশাসনের পরিকাঠামো বিশেষ ছিল না । তিনি নবতর অভিজ্ঞতার সামনে পড়লেন অশোকনগরে । তিনি এও দেখলেন যে, যাঁদের মাঝে তিনি বসবাস করতে এলেন, তাঁরা পপতিদিনকার মূর্ত নাগরিক অসুবিধা ও জাগতিক দুঃখকষ্টে ও অভাব প্রতিকারের বদলে সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, ভিয়েৎনাম, কিউবা, আমেরিকা, দিল্লী ইত্যাদি সুদূরবর্তী বিমূর্ত অদরকারি তর্কাতর্কিতে সময় ও ক্ষমতা অপচয় অপচয় করে আনন্দ পান । অর্থাৎ সুপ্রাইণ্ডিভিজুয়াল বা অধিব্যক্তিক ম্যাক্রোলেভেল ভাবুকদের পশ্চিমবাংলার মাটিপৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন তৎপরতার প্রেক্ষিতে, তাঁর মাইক্রোলেভেল খালাসিত্ব তাঁকে কল্যাণকামীতার স্বাভাবিক সনাতন মূল্যবোধে হায়ারার্কিবর্জিত করে রেখেছিল, এবং সেই ভূমিজ প্রবৃত্তিকে অবনী ধর কাজে লাগালেন ।
         তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে, বিশেষ করে শিক্ষক সমর ঘোষ, অশোকনগরে ডাকঘর বসানো, পৌরসভা গঠন, অসামাজিক কাজকারবার বন্ধ ইত্যাদির উদ্যোগ নিলেন । উদ্যোগটিকে কন্ঠস্বর দেবার জন্য, এবং তাঁদের অভাব-অভিযোগ যাতে কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছোয়, ১৯৬৪ সালে পপকাশ করা আরম্ভ করলেন ‘অশোকনগর বার্তা’ নামে একটি পাক্ষিক সংবাদপত্র, যেটি ছিল ওই অঞ্চলের প্রথম পঞ্জিকৃত সংবাদপত্র । পত্রিকাটির আয়ু ছিল তিন বছর, সম্ভবত যথেষ্ট । পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নিজের অভিজ্ঞতাকে কথাবস্তুতে রূপান্তরিত করে ছাপাবার কথা তাঁর মনে আসেনি কখনও ; পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত অন্যেরাও তাঁর মুখে ঘটনা শুনেও তাঁকে লিখতে বলেননি । সম্ভবত সমাজচিন্তনকে আত্মসাৎ করে ব্যক্তি-ক্রিয়াকরণের চিন্তা-পরিসর লালিত হবার মতো পৃথকত্ববোধ জাগার সুযোগ বা মনস্হিতি তাঁর হয়নি । ১৯৬৩ সাল থেকে চাকুরিহীন অবনীর কাছে আপনা থেকেই পরিত্যক্ত হয়েছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দর্শন ।
         অবনী ধরের কথাবস্তুগুলোকে দুটি পর্বে চি্‌হ্ণিত করা যায় । প্রথম পর্বটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্বটি ২০০০ সালের পর । মাঝে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন । প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন অর্থস্রোতহীন এবং কোনও সাহিত্যিক স্বকীয়তা আনার প্রয়াস করেননি । তা আপনা থেকে হয়ে গিয়েছিল তাঁর অনির্মিত লেখক-প্রতিস্বের কারণে । অবনী ধরের ডিসকোর্স, কখনও খালাসির, কখনও বা অসংগঠিত শ্রমিক বা কর্মহীনের, ভূপ্রকৃতির উথ্থানভূমিলব্ধ, স্হানিক, অবিমিশ্র, মুক্ত, যৌগিক, বর্ণিল, অনুভূমিক, প্রতিসংস্হাপিত, কৌমনিষ্ঠ এবং অতিজ্ঞাপনমূলক । প্রথম লেখাটি, ‘আমার দুঃখী মা’ রচনার পর তিনি তা লাবণ্য ধরকেই পড়ে শুনিয়েছিলেন । স্তম্ভিত মা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর. বলেছিলেন, ‘সত্য কথাই ল্যাখছস।’
         দ্বিতীয় পর্বের শুরু ২০০০ সালে । এই পর্বে অবনীর গদ্য-কাঠামোয় কয়েকটি কারণে সাইত্যিকতা এসে গেছে । তাঁর স্ত্রী, আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে একজোট হয়ে মামলা করে ১৯৯০ সালে চাকরি পাবার পর অবনীর আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটে । তাঁর মেয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ও বি এড এবং ছেলে বি এ পাশ করেন । অর্থাৎ প্রথম পর্বের জ্ঞান পরিমণ্ডলটি, তাঁর মেয়ে ও ছেলের প্রভাবে ক্রমশ অপসারিত হয়ে বাড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন, যা অবনীর কাছে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ঠেকে থাকবে, জ্ঞানপরিমণ্ডলের প্রবেশ ঘটিয়েছে । তৃতীয়ত, তাঁর প্রথম পর্বের রচনাগুলো, অন্তত কিছু সাহিত্যপাঠকের, হাতে গোনা হলেও, দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে, যাঁদের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়ে থাকবেন গদ্যগুলোকে একটি সাহিত্যিক আদল-আদরা দেবার । দ্বিতীয় পর্বের কথাবস্তুগুলোর গদ্যবিন্যাসে ধরা পড়ে যে প্রথাবাহিত গদ্যসাহিত্যের সঙ্গে, যেগুলো তাঁর ছেলে-মেয়ে নিজেরা পড়ার জন্য বাড়িতে এনে থাকবেন, তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে । অবনী নিজে চেষ্টা করলেও, এই বয়সে পৌঁছে, তাঁর পক্ষে মুকুরবিম্ব গড়া সম্ভবপর হয়নি, এবং তাঁর অপরত্ববোধ ও সাহিত্যিক অপরত্ব মুছে যায়নি । প্রথম ও দ্বিতীয়, দুটি পর্বেই, তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা তাড়িত হয়েছে অপরত্ববোধের অবস্হাননজনিত  বিপর্যয় দ্বারা। আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের কথাবস্তুতে, অপরত্ববোধের মাত্রাগুলোকে, অবনীর মতো করে ইতোপূর্বে উপস্হাপন করতে দেখা যায়নি । তাঁর মস্তিষ্কে আতিথ্য নেয়া কথাকারটি নিজেরই স্মৃতির ঐতিহাসিক হিসেবে অবনীর সামনে উদয় হয়েছে কখনও-সখনও, যিনি অতীতকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন না বা অতীতে বেঁচে থাকার কথা বলছেন না ; আসলে কথাকার ওই দূরবর্তী এবং নিকট অতীতের লোপাট হয়ে যাওয়া ও তাকে বাগে আনার বাচনক্রীড়ায় অংশগ্রহণকারীরূপে ‘অপর প্রতিসন্দর্ভের’ সতর্কতাগুলো জাহির করছেন ।
        অবনীর বইটি যদি আরেকবার প্রকাশ করা হয়, তাহলে গদ্যগুলোকে প্রকাশকাল অনুযায়ী সাজিয়ে নিলে ভালো হয় । সেই সঙ্গে বইয়ের নামটাও শুধরে নিতে হবে ; ওয়ান সট এর পরিবর্তে ‘ওয়ান শট’ করে দিতে হবে।
        ২০০৭ সালের ৯ অক্টোবর অবনী ধর মারা যান ।