রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

মিনাক্ষী ঘোষ

               


দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে কেটে গেল একটা সপ্তাহ। এরমধ্যে এল পিজি ট্রান্সফার ও ব্যাঙ্কের আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম মেটাতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ছেলের টুয়েলভ ফাইনাল হয়ে গেছে।মেয়ের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ও নেওয়া হোলো। কোল্হাপুরে খুব নামকরা একটা কনভেন্ট রয়েছে মেয়েকে সেখানে গিয়ে অ‍্যাডমিশন করাতে হবে।  তার একটা চিন্তাও মাথায় আছে বৈকি! মিমি জানে একটা উপায় ঠিক হবেই।যত সমস্যাই আসুকনা কেন মিমির স্থির বিশ্বাস তার থেকে সে বের হয়ে আসতে পারবেই। এ বিশ্বাসটুকুকে ভর করেই অনেক দুরূহ বাধা সে অতিক্রম করেছে এখনো পর্যন্ত।
প্যাকার্স অ‍্যান্ড মুভার্সের দায়িত্বে মালপত্র  ন্যস্ত করে রবিবার মিমিরা রওনা হোলো নতুন শহরের উদ্দেশে।
সূর্য ই ড্রাইভ করছিলো। মিমি পাশে বসে  সমস্ত যাত্রাপথের ছবিটা কেবল বুকের ভেতর এঁকে রাখার চেষ্টা করে গেছে।
পুণে থেকে কোল্হাপুরের দূরত্ব প্রায় দুশো পঁচিশ কিলোমিটার। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার ধার ঘেঁষে এই  উপত্যকা শহরটি হোলো কোল্হাপুর।  মারাঠি ভাষায় 'কোল্হা'' শব্দের অর্থ হোলো উপত্যকা। কোল্হাপুরের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হোলো উপত্যকার শহর বা 'সিটি অব ভ্যালিজ'।
 মূলত ব্যাঙ্গালোর পুণে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই পুরোটা পথ চলা। এই দু' বছরে মিমি পুণের বাইরে কোথাও যায়নি। পুণে থেকে সাতারা পর্যন্তযেতে পথে দুটি ঘাট সেকশন পেরোলো ওরা। পাহাড়ী রাস্তা। খুব শার্প  চড়াই উৎরাই যদিও নয় তবুও চুলের কাঁটার মতো পাকদন্ডী পথ পেরোবার  সময় বুকের ভেতর শিরশির করে উঠছিল। এরপর কতবার এ পথে মিমি যাতায়াত করেছে তবু প্রতিবার ই বুকের ভেতরটা পাহাড় পেরোতে ধুকপুক করতে থাকে। নীচে অতলস্পর্শী খাদ। যদিও রাস্তা বেশ চওড়া তবু মূহুর্তের অসতর্কতায় খাদের গভীরে তলিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সূর্য ড্রাইভিংটা যথেষ্ট ভাল করে। পাহাড়ি রাস্তাতেও নিয়মকানুন মেনেই ফার্ষ্ট গীয়ারে আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠছিলো। একপাশে ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা পাহাড় অন্যদিকে খাদ। বেশ অনেকটা রাস্তাই সাতারা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের আওতায় পড়ে।  যদিও প্রচুর গাড়ি চলাচল করছিলো পাহাড়ি পথ বেয়ে মিমির মন কিন্তু ওই নিবিড় অরণ্যানীর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। এই পাহাড়ী পথেই শিবাজীর মারাঠা সৈন্যদল মোঘলশত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। 
তবু বশ্যতা স্বীকার করেনি।  এসব ভাবতে ভাবতে মিমি কখন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছিলো চমক ভাঙলো
সূর্যর ডাকে। সূর্যর গাড়ি ততক্ষণে সমতলের মাটি ছুঁয়েছে।
- 'মিমি সামনে একটা চায়ের দোকান আছে চলো একটু
দাঁড়িয়ে চা খাই।'
টানা দু ঘন্টা ড্রাইভ করে সূর্য একটু ক্লান্ত। আরো ঘন্টা
তিনেক ড্রাইভ করতে হবে। চা খেয়ে একটু ফ্রেশ হ য়ে নেওয়া এই আর কি! কাছের দোকানটায় একজন ভদ্রমহিলা চা  বিক্রি করছিলেন।
- 'কাকু দৌ কাপ চায়ে'
মারাঠীতে  কাকিমাকে কাকু বলা হ য়। সম্বোধনটির মধ্যে অপরিচয়ের আধিক্যের চাইতে অন্তরঙ্গতার আবেদনটুকু
অনেক বেশী। মিমি মারাঠি ভাল বলতে না পারলেও বুঝতে পারে একটু একটু। কাকুর কাছে শুনে বুঝলো বাকি রাস্তাটা মোটামুটি সমতল  আর ঘন্টা দেড়েক পথ পেরোলে কারাড শহর। এটিও বেশ বর্ধিষ্ণু একটি শহর।
কারাড থেকে কোল্হাপুর আরো ঘন্টা খানেকের পথ।
 কাকুর কাছে গরম গরম বড়া পাও পাওয়া গেল। পাঁউরটির ফাঁকে আলুর বড়া। এটা এখানকার খুব জনপ্রিয় খাদ্য। ছেলেমেয়ের ও খুব প্রিয়।
এরপর টানা ড্রাইভ। দেখতে দেখতে কারাড পেরিয়ে গেল। এরপর এলো ইচলকরঞ্জি। এখানে বেশ কয়েকটি টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে টেক্সটাইল হাব তৈরী করা হয়েছে।
ছোট্ট ছোট্ট টিলার ওপর বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর।
পথে কয়েকটি টোল পড়লো। মহারাষ্ট্র গভর্ণমেন্ট রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পে খানিকদূর পরপর এই টোল ট্যাক্স ধার্য করেছেন। রাস্তা যেমন চওড়া তেমন মসৃণ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রকল্পিত সোনালি চতুর্ভূজ সড়ক যোজনা বা গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল 
ন্যাশনাল হাইওয়ের অন্তর্গত এই মহাসড়কটি।
কোল্হাপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্যদেব  ততক্ষণে পশ্চিম দিগন্তের পথযাত্রী।
কোল্হাপুর প্রবেশের আগে মিমি দেখলো অদূরে বিরাট আকৃতির গণেশ মূর্তি। পরে জেনেছে এটি চিন্ময় গনেশ নামে খ্যাত।বিঘ্নহর্তা সমস্ত রকম আসন্ন বিপদের  হাত থেকে শহরটিকে রক্ষা করবার জন্য প্রবেশপথের নিকটে দন্ডায়মান।
ব্যাঙ্গালোর পুণে হাইওয়ে সোজা চলে গেছে ব্যাঙ্গালোরের দিকে। আরেকটা রাস্তা বাঁদিক ঘেঁষে নেমে গিয়েছে কোল্হাপুরের দিকে। সেই পথ ধরে মিমিদের গাড়ি এবার প্রবেশ করলো কোল্হাপুরের তোরণদ্বারে। সুন্দর একটি ফটকের ভেতর দিয়ে কোল্হাপুর শহরের  প্রবেশপথ।উল্টোদিকের রাস্তাটা চলে গেছে গান্ধীনগরের দিকে। মূলত সেটি বস্ত্রবিপণীর জন্য বিখ্যাত।
কোল্হাপুর শহরে ঢুকতেই মিমির চোখে পড়লো একেবারে কেন্দ্রস্থলে অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ়া এক নারীমূর্তি।হাতে সুউচ্চ উন্মুক্ত তরোয়াল। পরণে মারাঠি কায়দায় পরিহিত ন' ওয়াড়ি শাড়ি। মহারাণী তারাবাইয়ের মূর্তি এটি।
মহারাণী  তারাবাই ছিলেন  অসীম সাহসিকতার প্রতিমূর্তি।তিনি বিখ্যাত মারাঠা জেনারেল হাম্বিতরাও মোহিতের  কন্যা,মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী পুত্র রাজারাম ভোঁসলের  পত্নী এবং  শিবাজী দ্বিতীয়ের মাতা।তিনি স্বামী রাজারামের সম্পর্কিত ভগ্নী ও ছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় মহারাণী তারাবাই ছিলেন অতুলনীয়া।অশ্বচালনায় ও যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুচতুর।
১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী রাজারামের মৃত্যুর পরে তিনি  তাঁর নাবালক  শিশুপুত্র শিবাজী দ্বিতীয়কে উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন ও আওরেঙ্গজেবের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন।এবং মোগলবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ১৭০৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মোগল বাহিনীকে শর্তাধীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে মুঘল শাসক সেটা প্রত্যাখ্যান করেন।১৭০৭ পর্যন্ত তারাবাই তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে মোগল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তারাবাইয়ের নেতৃত্বে মারাঠা অঞ্চল বিপন্মুক্ত হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছিলেন ১৭০০ -১৭০৭পর্যন্ত মহারাণী তারাবাইয়ের অসীম সাহসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা মারাঠা জাতিকে ভয়াবহ সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।এবং এই সময়ের মধ্যে মহারাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনীর নির্দেশক রূপে বিধবা রাণী তারাবাই মোহিত ভিন্ন সেইসময় সঙ্কটকালীন উপদেষ্টা হিসাবে আর কোন মন্ত্রী ছিলোনা।
ক্রমশঃ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন