মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১৮

স্বপন রায়


প্রথম পর্বের পর 

আহমেদ ফরাজের জীবন ও কবিতা  
.................................................................................................
      ‘অব কে বিছড়ে হ্যায় তো শায়দ কভি খ্বাবোঁ মে মিলে
      ‘ জিস তরহ সুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মিলে



আহমেদ ফরাজ, একদিকে যেমন পাকিস্তানের শ্রেণীবৈষম্য, একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানে নষ্ট হতে থাকা গণতন্ত্রের জন্য ‘আওয়াজ বুলন্দ’ করেছিলেন, অন্যদিকে একইভাবে লিখে গেছেন তাঁর বিখ্যাত গজলগুলি। লিখেছেন অজস্র ‘নজ্‌ম’ যা গদ্যকবিতার কাছাকাছি একধরণের আঙ্গিক। কখনো দেশবাসীর উদ্দেশ্যে লিখছেনঃ
‘খ্বাব মরতে নহি
খ্বাব দিল হ্যায়, না আখেঁ, না শ্বাসেঁ যো
রেজা রেজা হুয়ে তো বিখর জায়েঙ্গে
জিস্ম কে মৌত সে ইয়ে ভি মর জায়েঙ্গে..’
(স্বপ্ন মরেনা
স্বপ্ন তো হৃদয়, সপ্ন চোখ নয় অথবা নিশ্বাস
যে টুকরো টুকরো যদি হয় তো ছড়িয়ে পড়বে
মরে যাবে মৃতদেহের সঙ্গে )
কখনো সেই মৃত্যুর আরেক চেহারা দেখছেন বিষাদের অপরিমেয় স্তব্ধতা নিয়েঃ

‘গম-এ-হায়াৎ কা ঝগড়া মিটা রহা হ্যায় কোই
চলে ভি আও কে দুনিয়া সে যা রহা কোই
#
আজল সে কহে দো কে রুক যায়ে দো ঘড়ি
শুনা হ্যায় আনেকা ওয়াদা নিভা রহা হ্যায় কোই
#
ও ইস নাজ সে বয়ঠা হ্যায় লাশ কে পাস
জ্যায়সে রোতে হুয়ে কো মনা রহা হ্যায় কোই
#
পলট কর না আ যায়ে ফির সানা নব্জোঁ মে ‘ফরাজ’
ইতনে হাসীন হাথোঁ সে মইয়ত সজা রহা কোই’
#
 (দুঃখ এবং জীবন নিয়ে করেই যাচ্ছ ঝগড়া তুমুল
  কেউ যে এদিকে মরতে বসেছে, ফেরৎ এসো, আসছো ফেরৎ? 
#
  সময়, আরো একটু দাঁড়াও, অল্প সময় চাইছি তোমার
  শুনেছি সে ফিরেই আসছে, চেষ্টা করছে কথা রাখবার
#
  এসেছে, আর কি অপূর্বতায় বসেছে শান্ত লাশের পাশে
  মনে হচ্ছে, কান্না মুছিয়ে অভিমানগুলো সরিয়ে দিচ্ছে
#
  এমন ছোঁয়া! আবার ফরাজ ফিরে যেওনা ফালতু লেখায়
  সাজিয়ে তুলছে মৃত তোমাকেই যখন মিষ্টি হাতের মায়া)
#
প্রেম আর সামাজিক সংলগ্নতা, বিষাদ আর দ্রোহের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে ফরাজের কবিতাজগৎ!জিয়াউল হকের সময় বাংলাদেশে পাক বাহিনির অত্যাচার এবং সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার কারণ হিসেবে দেখানো হয় কোন একটি মুশায়রায়(কবিতাপাঠের আসর)তিনি ‘হুকুমত’-এর বিরুদ্ধে ‘শের’ পড়েছেন।ওইসময় ছ’বছর তিনি দেশান্তরে থাকেন।ব্রিটেন,কানাডা এবং ইওরোপের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান ফরাজ কবিতাকে আশ্রয় ক’রে তোপ দাগতে থাকেন সামরিক একনায়ক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে।তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মুহাসারা’(অবরোধ)এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই লেখা।তিনি স্বৈরাচারী শাসকের পরোয়া না ক’রে লেখেনঃ
ম্যায় কাট গিরুঁ কে সলামত রহুঁ ইয়াকিন হ্যায় মুঝে
কি ইয়ে হিসারে সিতম কোই তো গিরায়ে গা
তমাম উম্র কি ইজা-নসিবিয়োঁকি কসম
মেরে কলাম কা সফর রহেগা না জায়েগা
#
সরিস্ত-এ-ইশ্‌ক নে উফ্‌তাদগি নহি পাই
তো কদ-এ-সারভ নে বিনি ও সায়া পায়মায়ি

(ভাল থাকি বা খুন হয়ে যাই, বিশ্বাস শুধু আছে
 এই অত্যাচারীর দুর্গ কেউ ভেঙে দেবে একদিন
 জীবন, আমি  শপথ নিচ্ছি যাবতীয় দুর্ভাগ্যের
 আমার লেখা থামবে না আর ঝুঁকবে না কোনদিন
#
 মর্ষকামীর ইচ্ছে কখনো টিঁকবেনা দুনিয়ায়
 গাছের ছায়ায় হেঁটে চলে যাবে ভালবাসা দৃঢ় পায়..)
#
ফরাজের রাজনৈতিক অবস্থান বামপন্থী ছিল।কিন্তু অফিসিয়াল বামদলগুলি পাকিস্তানে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং বিলীন হতে থাকে স্বৈরাচার বিরোধী পাকিস্তান পিপলস পার্টির সঙ্গে। জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে থাকা ফরাজ জুলফিকার আলি ভূট্টো’র ঘনিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশের ঘটনায় ভূট্টোর বিরোধীতা করতে পিছপাও হননি।আহমেদ ফরাজ ‘ইকবাল’ আর ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজে’র পরে পাকিস্তানে প্রায় ‘কাল্ট ফিগার’ হয়ে ওঠেন।পাকিস্তানের নানাবিধ সাংস্কৃতিক পদ তিনি অলঙ্কৃত করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে ফরাজকে পাকিস্তানের একাডেমি অফ লেটারসের প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে এখানেই চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর শেষ সরকারী পদ ছিল পাকিস্তানের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানশিপ, তবে তাঁকে নিয়ে মাথাব্যথা লেগেই থাকতো সরকারের। পারভেজ মুশারফের বিরোধীতা ক’রে ফরাজ ২০০৬ সালে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ সিভিলিয়ান সম্মান ‘হিলাল-এ-ইমতিয়াজ’ ফিরিয়ে দেন। প্রত্যাখানের পরে দেওয়া তাঁর বিবৃতি এখনকার ভাষায় ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়ঃ
‘My conscience will not forgive me if I remained a silent spectator of the sad happenings around us,...the last I can do is to let the dictatorship know where it stands in the eyes of the concerned citizens, whose fundamental rights have been usurped’
#
আহমেদ ফরাজ তাঁর অসাধারণ গজলের জন্য ভারতেও সুপরিচিত ছিলেন।মেহেদি হাসান। গুলাম আলি যেমন তাঁর গজল গেয়েছেন,লতা মঙ্গেশকর, জগজিৎ সিং-এর কণ্ঠেও তাঁর লেখা গজল উঠে এসেছে। ফরাজের বোহেমিয়ান জীবনযাপন বিখ্যাত ছিল পেশোয়ারে। তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েই লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। তাঁর একটি প্রবল গর্জনওয়ালা বাইক ছিল।পেশোয়ার খাইবার পর্বতমালার ফুটহিল শহর হওয়ায় সৌন্দর্যে কোন খামতি ছিলনা। ফরাজের নেশা ছিল পান আর সিগারেটের।চেন স্মোকার ছিলেন। তো, ওঁর স্থায়ী দোকান থেকে পান মুখে দিয়ে, সিগারেট ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে ফরাজকে দেখা যেত প্রবল বেগে কোথাও যাচ্ছেন, যেন খুব জরুরী কাজ আছে তাঁর। অন্যমনস্ক ছিলেন পুরোদস্তুর।মৃত্যুর কয়েকবছর আগে ফরাজ ওয়াশিংটন ডি.সি. তে একটি অনুষ্ঠানে বিনা সিগারেটে প্রায় সারারাত মুশায়েরা ক’রে সিগারেটে খাওয়ার টানে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেন। ঘর আর চিনতে পারেন না। যে রুম নাম্বার বলেন, সেখানে চাবি ঢোকেনা। পরে দেখা যায় তিনি অন্য একটি হোটেলে এসে এসব ক’রে যাচ্ছেন। সারাজীবন ধরেই ভারত পাকিস্তানের বন্ধুত্বের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখা এই বিখ্যাত ‘শের’ এই দুই প্রতিবেশী দেশের জন্যই নিবেদিতঃ
‘অব কে বিছড়ে হ্যায় তো শায়দ কভি খ্বাবোঁ মে মিলে / জিস তরহ সুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মিলে..’ আহমেদ ফরাজের জীবনাবসান হয় ২৫ শে অগাস্ট, ২০০৮ সালে। কবির অবসানে কবিতা অবসৃত হয়না। থেকে যায়, থেকেই যায়, আহমেদ ফরাজের মত সংবেদনশীল মানতাবাদী কবিরা!তো, পড়ে ফেলা যাক, আহমেদ ফরাজের কিছু নজম এবং গজলের ভাবানুবাদ।
১.
বুঝি নজর তো করিশ্মে ভি রোজো শব কে গয়ে
কে অব তলক নহি পলটে হ্যায় লোগ কবকে গয়ে

করেগা কৌন তেরি বেওয়াফাইয়োঁ কা গিলা
এহি হ্যায় রশমে জমানা তো হম ভি কবকে গয়ে

মগর কিসিনে হমে হমসফর নহি জানা
ইয়ে আউর বাত কে হম  সাথ সাথ সবকে গয়ে

অব আয়ে হো তো ইহাঁ কেয়া হ্যায় দেখনে কে লিয়ে
ইয়ে শহর কবসে হ্যায় বিরান উও লোগ কবকে গয়ে

গিরফ্‌তা দিল থে মগর হৌসলা নহি হারা
গিরফ্‌তা দিল থে মগর হৌসলে ভি অবকে গয়ে

তুম আপনি শমে-তমান্না কো রো রহে হো ‘ফরাজ’
ইন আঁধিয়োঁ মে তো প্যারে চিরাগ সবকে গয়ে
.................................................................

ভাবনুবাদঃ
চোখ বুঁজলেই অবাকহারা ভাবনা যাচ্ছে দিন ও রাতের
পাল্টে যায়নি মুখচ্ছবি সেই কবেকার আয়না পেয়েও
#
বিশ্বাসঘাতী তোমার সঙ্গে হারিয়ে গেছে ভরসা আমার
এটাই যখন নিয়ম তখন আমিও চলে যাচ্ছি তবে
#
চেয়েছি আমিও সঙ্গী হতে কিন্তু পাইনি সঙ্গী কোনও
অথচ সবার সঙ্গে ছিলাম, যেমন তেমন সব যাওয়াতেই 
#
আবার এসেছো, কি আছে এখন, কি আর তোমায় দেখাবো বলো
এ শহরে আর থাকেনা কেউই, সব ফাঁকা ফাঁকা সব নির্জন
#
স্তব্ধ হৃদয়, হারিনি শধু ভরসা রেখেছি কিভাবে যেন
স্তব্ধ আমার হৃদয় কিন্তু হারিয়ে গেল নির্জনতায়
#
কাঁদছো ফরাজ , নিভে গেছে ব’লে নিজস্ব এক আলোর শিখা
আঁধি আর ঝড়ে সব নিভে গেছে সমস্ত আলো, কেন দেখলে না..
#
২.


ফরাজ, অব কোই সৌদা কোই জুনুন ভি নহি
মগর করার সে দিন কট রহে হো ইয়ুঁ ভি নহি

লব-ও-দহন ভি মিলা গুফ্‌তগুকা ফন ভি মিলা
মগর জো দিল পে গুজরতি হ্যায় কহে সকুঁ ভি নহি

মেরি জুবাঁকি লুক্‌নত সে বদগুমা না হো
যো তু কহে তো তুঝে ওম্র ভর মিলুঁ ভি নহি

‘ফরাজ’ জ্যায়সে কোই দিয়া তুর্‌বত-এ-হাওয়া চাহে হ্যায়
 তু পাস আয়ে তো মুমকিন হ্যায় ম্যায় রহুঁ ভি নহি
.....................................................................

ভাবানুবাদঃ
ফরাজ, কেনাবেচা শেষ, ইচ্ছেও গেছে ফুরিয়ে
ভাল আছি খুব, এ কথাও বলা যাবেনা
ভাষা আছে, আছে প্রকাশের যত বাহানা
আমি ভাল নেই বোঝাবো কিভাবে কি দিয়ে
#
আমার কথায় কিবা আসে যায়, যদি
তুমি না বলো, দূরে চলে যাবো ঠিকই
#
আমি কথা বলি সে কথার দোষে যেন
একটি আঁচড়ও না লাগে অধরা তোমার
#
যদি এসে পড়ো এমনিই কোনদিন
দেখবে যেভাবে মোমের আলো গায়ে ঢেলে নেয় নিজেই মৃত্যু-হাওয়া
আর নিভে যায় একা একা
ফরাজও কোন আসন্ন হাওয়ায় নিভে গেছে তেমনই
সে কি ডেকেছিল, সে কি তোমাকেই ডেকেছিল...
#
৩.
উস সখ্‌স সে বস ইতনা সা তাল্লুক হ্যায় ফরাজ
ও পরেশাঁ হো তো হমেঁ নিঁদ নহি আতি
...................................................
ভাবানুবাদঃ
  ওর সঙ্গে এভাবেই জুড়ে আছি, ‘ফরাজ’
    ওর কষ্ট হলে আমার ঘুম আসেনা
#
৪.
বরবাদ করনে কে আউর ভি রাস্তে থে ‘ফরাজ’
না জানে ওনহে মুহব্বত কা হি খয়াল কিঁউ আয়া
..............................................................
ভাবানুবাদঃ
আমায় বরবাদ করার তো অনেক রাস্তাই খোলা ছিল, ‘ফরাজ’
কেন কে জানে ওর  মনে পড়েছিল ভালবাসার কথা
#
৫.
তু ভি তো আইনে কি তরহ বেওয়াফা নিকলা ‘ফরাজ’
যো সামনে আয়া ওসি কা হো গয়া
.................................................................
ভাবানুবাদঃ
তুমিও তো আয়নার মত অবিশ্বস্ত, ‘ফরাজ’
 যে সামনে এল, তারই হয়ে গেলে
#
৬.
ওসনে মুঝে ছোড় দিয়া তো কেয়া হুয়া ‘ফরাজ’
ম্যায়নে ভি তো ছোড়া থা সারা জমানা উসকে লিয়ে
.....................................................................
ভাবানুবাদঃ
ও আমায় ছেড়ে চলে গেছে তাতে কী ‘ফরাজ’
আমিও তো পুরো দুনিয়া ছেড়ে এসেছিলাম ওর জন্য
#
৭.
অকেলে তো হম ভি জী রহে থে ‘ফরাজ’
কিউঁ তন্‌হা সে হো গয়ে তেরে জানে কে বাদ
........................................................................
ভাবানুবাদঃ
একা তো আমি আগেও ছিলাম, ‘ফরাজ’
কেন একাকী হয়ে গেলাম তুমি চলে যাওয়ার পরেই
#
৮.
কুছ এয়সে হাদসে ভি জিন্দেগি মে হোতে হ্যায় ‘ফরাজ’
কে ইনসান তো বচ যাতা হ্যায় মগর জিন্দা নহি রহতা
..........................................................................
ভাবানুবাদঃ
এমন কিছু দুর্ঘটনাও জীবনে হয়ে থাকে, ‘ফরাজ’
মানুষ বেঁচে থাকে কিন্তু জীবিত থাকেনা
..........................................................................................

সম্পাদকীয়

"জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ কিছুই রবেনা
লুকোচুরির এই যে খেলায় প্রাণের যত দেওয়া নেওয়া পূর্ণ হবেনা" 

জীবন মানেই খোলা খাতা ৷কিছু কথা থেকে যায় কিছু শেষ হয়ে যায় কিছু লেখা হয় না কোনদিনই ৷ এই খাতার রঙ হলুদ , সাদা কিংবা কালো হতে পারে ৷ শৈশবকাল থেকে যার রচনা সূচিত হয় সেই দাগ ঢেউয়ের উজান বেয়ে কোথায় যে গিয়ে শেষ হবে তা জানা নেই কারোর ৷ এক জীবনে বোধহয় কারোর দেওয়া নেওয়া সম্পূর্ণ হয় না ৷ বোধহয় না কখনই পরিপূর্ণতা পায় না দেওয়া নেওয়ার হিসেব ৷ যা পেলাম তা কতটুকু আমার ৷ কিংবা যা আমার তা সত্যিই কি আমার ! কোনদিন আমার ছিল , কখনও আমার হয়েছে । জোর দিয়ে বলাটা সত্যিই বড় কঠিন । এই শাক ,ভাত মাখা জীবনে কোন কিছুর জোর যেন পাওয়া যায় না ৷ জীবনের চোরাপথ দিয়ে হেঁটে যায় কিছু দেওয়া নেওয়ার হিসাব ৷ 


কতটুকু হাঁটব আর কতটুকুই বা বাকি এটা বুঝতে বুঝতে লেগে যায় সমস্ত জীবন ৷তবুও বোঝা হয় না কিছু ৷বোঝা বা ভার ৷ এ বড় কঠিন বস্তু I নিজে এর দায় বহন করা কঠিন আবার অন্যকে দিয়ে তার নিষ্কৃতি নেই I পুরোটাই জং ধরা তালায় সবুজ গাছের উত্থান । জং খুলতে খুলতে গাছ বড় হয়ে যায় । ধার বাকি জীবনে সবই ইতিহাস ভুলে ভবিষ্যতের হাত ধরে চলা ৷ কিন্তু ভবিষ্যত কি তা কি আমরা জানি কিংবা ভবিষ্যতকে সুনিশ্চিত করতে পারি ৷ বোধহয় না ৷ এই লুকোচুরি চলে নিরন্তর ৷ তার আড়ালে চলে দেখা না দেখার আদর । সোহাগ । নরম ছোঁয়ায় হিসাবের গড়মিল হয়ে যায় । কিন্তু তবুও পথ চলতে হয় ৷ আমাদের নামতা পড়া জীবনে একঝলক  খুশির ছোঁয়া নিয়ে আসে " সৃজন " । 

"সৃজন" আপনাদের একমাত্র আপনাদেরই ৷ যে ভাবে সৃজনের পাশে ছিলেন তেমনই থাকুন ৷ ভালোবাসায় থাকুন I সৃজনে থাকুন Iলেখা পাঠান আমাদের ইমেইলে ৷ 

অজিত রায়

বাংলা পর্নোগ্রাফির ভূত ও ভবিষ্যৎ
------------------------------------------------

পম্পেই মন্দির ও প্রাসাদ পৃষ্ঠে খোদাই করা মূর্তিগুলি ছিল পর্নোগ্রাফির  বেহতৃণ নমুনা, যা কালক্রমে একটি গ্রিক জঁর হিশেবে স্বীকৃতি পায়।  কিন্তু আমাদের অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহো-কোনারকের স্থাপত্য অমন কোনো পৃথক জঁর বলে দাগায়িত হয়নি।  কারণ এ দেশীয় অলঙ্কারশাস্ত্রে যৌনতা মোটেই অনৈতিক বা অবৈধ ছিল না।  যৌনতা বিষয়ে সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধটি ইসলামিক চাপে পিষ্ট হয়ে ছিটকে গিয়ে পড়েছিল বৃটিশ ইম্পিরিয়ালিজমের থাবায় তলায়।  ওই শ্বেতাঙ্গ বণিকরাই এ দেশে পর্নোগ্রাফি ইমপোর্ট করেছিল ফের তাকে নিষিদ্ধ করার আইনটিও।  সিকিভাগ রেনেসঁসের কৃপায় বাঙালির শব্দ ও তার অর্থ মেট্রপলিস গিল্টি পায় এবং বাংলা শব্দ ক্ৰমে 'নান্দনিক' হয়ে ওঠে।  বেশি নয়, উনিশ শতকীয় সহজ সরল শব্দ 'মাগী' কীভাবে কালক্রমে নিছক অবজ্ঞা, হীনতা ও খিস্তির রূপ পরিগ্রহ করল সেটি ঠিকঠাক গবেষিত হলে বাঙালি কৌমের স্মৃতি বিপর্যয়ের ধন্দটিও ফাঁস হয়ে যাবে।
বৃটিশ হস্তক্ষেপে বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের কর্তৃত্বটি চলে যায় 'ছোটো ইংরেজ', অর্থাৎ হিন্দু সবর্ণদের হাতে।  মানে, বাউন-কায়েত-বদ্যিদের কব্জায়।  ফের রবিবাবু নোবেল পেলে বাঙালি কবিসাহিত্যিকদের কৃশ গাঁড়ে 'বুদ্ধিজীবী'র ঠাপ্পাটাও গেঁথে বসে এবং সবর্ণপুঞ্জের উক্ত চাঙড়টি একটি 'সুবর্ণ মডেল' ধার্য করে বাংলা সাহিত্যের ন্যাড় আটকে দেন।  নিক্তির মাপে, এবং যষ্টির প্রহারযোগে তাঁরা বুঝিয়ে দেন, 'এটা' লিখবে কিন্তু 'ওটা' লিখবে না।  এ-ভাষায় লিখবে, ও-ভাষায় লিখবে না।  প্রেম লিখবে, কিন্তু রতি লিখবে না।  বোঝানো হলো :  জীবন সম্ভোগ মানে পাপ।  যাহা পাপ, তাহা সাহিত্যে বর্জ্যবস্তু।
কিন্তু ইতিহাস নামক গুনিনটি অতিশয় ঘাগু।  সে ওই ধাপকি ধরে ফেলল।  কলকাত্তাই সবর্ণপুঞ্জের সমস্ত গদ ও মালিন্য তথা জরা কালক্রমে ফাঁস হয়ে পড়তে থাকে একশ্রেণীর লেখকদের কাছে। তাঁরা বাংলা সাহিত্যের ওই কলোনিয়াল ভাবকল্পটিকে ক্রমশ ঘৃণিত ও ত্যাজ্য মনে করতে থাকেন।  তাঁরা বিশ্বাস করেন যে জীবন-সম্ভোগ মানে পাপ নয়।  জীবনে যা-কিছু সম্ভোগ, কোনোটাই পাপ নয়।  জীবনকে লেখা পাপ নয়।  সাহিত্যে ভদ্র-অভদ্র, শ্লীল-অশ্লীল, ছাপ্য-অছাপ্য বলে কিছুই হয় না।  সাহিত্যের ভাষা বা বিষয় কারুক্কে শ্লীল বা অশ্লীল করে না।  হিংসা, হত্যা ও রেন্ডিগিরি সমাজের আদিমতম এবং সবচেয়ে জমাটি বৃত্তি।  হিংসা ও হত্যার খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা হয় বেস্টসেলার ক্রাইম স্টোরি।  কেউ সেটাকে পাপ বলে না।  অশ্লীল বা অভদ্র বলে না।  এক মৈথুন বিষয়ক খুঁটিনাটি লিখলেই কাশীদাসী থানইট পাপবিদ্ধ হয়?
ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য 'পাপ' বা 'অশ্লীলতা'র তোয়াক্কা করেনি।  কারণ তা স্ফুরিত হতো মূলত দেশজ বাঙালি ----- কর্মকার-মালাকার-বৈরাগী-ময়রা-মুচি প্রভৃতির মাধ্যমে, ইংরেজদের জলচোয়া জ্ঞান-যুক্তি-এনলাইটেনমেন্টের আলোয় যাঁরা কখনই আছন্ন হয়নি।  তবু কেন-জানি বাংলায় কামসাহিত্যের আগাগোড়া অভাবই থেকে গেছে।  উনিশ শতকের আগে অব্দি ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর'ই ছিল বাংলা কামসাহিত্যের সম্ভবত একমাত্র, এবং অবশ্যই সর্বাধিক প্রভাবশালী নিদর্শন-গ্রন্থ।  বিদ্যাসুন্দরের জনপ্রিয়তা ছিল গগনস্পর্শী।  অতএব অনুমান করা যেতে পারে বিদ্যাসুন্দরের দেখাদেখি বা তাকে নকল করে বাংলায় সেসময় আরও অনেক বই লেখা হয়ে থাকবে।  কিন্তু সেইসব কাম ও যৌনকেন্দ্রিক তামাম 'অশ্লীল' সাহিত্যকর্মের সঙ্গে, লোকসমাজে প্রচলিত ধাঁধা-কৌতুকী-ছড়া এবং সামাজিক বিশ্বাসের মতই, ব্যবসায়িকতার সরাসরি কোন সম্পর্ক ছিল না বলে সেগুলি তেমন প্রচার পায়নি।  ফলে, সেহেন অজস্র বইয়ের হদিশও লঙ সাহেব বা তাঁর অনুচরের দল পায়নি।  বাংলায় তথাকথিত শিষ্ট সাহিত্যের পাশাপাশি আদিরসাত্মক বা পর্নোগ্রাফিক লেখার ঢল শুরু হয় ছাপা বইয়ের বাজার গড়ে ওঠার পর ----- উনিশ শতকের মাঝামাঝি।
সেসময় দেশীয় উচ্চবর্গের তথাকথিত 'শিষ্ট-ভদ্র' সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকদের হায়রার্কির চোখে বইগুলি 'বিপজ্জনক' প্রতিভাত হয়েছিল।  অর্থাৎ ঘুরেফিরে আবার সেই তথাকথিত ভদ্রপুঞ্জের লোকেদের নিরেট ধাপ্পাবাজির কথাই এসে পড়ে।  যাদের চিরাচরিত আতঙ্ক যে এহেন সাহিত্য অশ্লীল এবং এই অশ্লীলতার টুঁটি টিপে না ধরলে তাদের ভদ্দরপুঞ্জের সাহিত্য কলুষিত হয়ে পড়বে।  ভাষা ও সংস্কৃতির যে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশান প্রক্রিয়াটি সেদিন এলিট অভীষ্ট ছিল, সেই কর্তৃত্বের ধারণাটিকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ওইসব বটতলা ও আদিরসাত্মক বইপত্র।  দেশজ ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতা এবং ভিক্টরীয় মূল্যবোধ যুগপৎ মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল ভাষা-র ভিতর থেকে আদিরসাত্মক অনুষঙ্গ, শরীরী উল্লেখ বর্জন করার এই ক্ষমতা-প্রক্রিয়া।  স্পষ্টতই বটতলার আদিরসত্মক বই ছিল সেই ক্ষমতা-কাঠামোর প্রতি এক ধরনের অন্তর্ঘাত, বা ঘামলাঘাট।
যৌনতাকে 'অশ্লীলতা'র সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করতে হয়, সাহিত্যে যৌনতাকে কীভাবে আড়ালে-আবডালে রাখতে হয় ---- এর কেরদানি আমরা ইংরেজদের কাছে শিখলাম।  উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির এই যৌনসংস্কার ও যৌন-অবদমন পরবর্তী বাংলা সাহিত্যকে রাহুর মতো গ্রাস করেছিল।
কামসাহিত্য যদি পাপ হয়, মাঝেমাঝে অমন পাপ করা উচিত।  পুণ্যের মত।  পাপ না করলে পুণ্যের স্বাদ মেলে না।  শুধু কিনারে দাঁড়িয়ে আচমন-মাত্র করে সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া অসম্ভব, তাতে নামতে হয়।  বইপাড়া বা বইমেলায় সহজলভ্য যেসব ব্লো-হট উপন্যাস বিকোয় মনোলোভা ব্রেসিয়ারের মোড়কে, সেসব গল্প-আখ্যান আর যাই হোক ---- প্ৰকৃত কামসাহিত্য বা পর্নোগ্রাফি নয়।  তাছাড়া আজকের দিনে ফুটপাথে বস্তা বিছিয়ে যেসব চক্ষুহারী হলুদ বই দেখা যায়, সেগুলিও কাম সাহিত্য নয়।  সেসব ভুল বানান ও প্রমাদ-কণ্টকিত অক্ষরে ছাপা অতি-চটুল পুস্তিকা সমূহ আমাদের অভিনিবেশ দাবি করতে পারে না।  সেগুলিই আসল অশ্লীল বই।  সেগুলিই আসল মল, যা বর্জ্যবস্তু।  আদিরসত্মক ন্যারেটিভ বা পর্নোগ্রাফি ওসব নয়।  সত্যিকারের পর্নোগ্রাফি, যাহা একাধারে কাম ও সাহিত্য, যতই অশ্লীল বা পাপকর্ম হোক, পড়তে হয়।
অথচ বাংলা ভাষায় 'পর্নো' আর 'সাহিত্য' এখনো দু-ফালা বেদানার মত দু সাইডে আরক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।  শরৎচন্দ্র গৃহভৃত্য আর ঝি-এর মশলা-প্লট যদি বা এনেছিলেন, ----- ঝিয়ের সঙ্গে মালিকের গাবগুচিই দেখাতে পারলেন না।  তেমনি, দেওর-বৌদির প্রেম ও যৌন সম্পর্ক যদি-বা 'নষ্টনীড়ে' একটু-আধটু এল ---- কিন্তু বড্ড মিউমিউ করে।  পরবর্তীকালে সুপারহিট সুড়সুড়িবাজ নিমে ভটচাজও বউদিকে শাড়ি-ব্লাউজের ওপাশেই রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।  এমনকি, ---- বন্ধুর মা, মাতৃসমা নারী,  নয়নের সঙ্গে গোপালদেবের যৌনসম্পর্কও এনেছেন অসীম রায়, কিন্তু  সেখানেও 'অত হামলিয়ে আদর করিস নে, ওটা টেঁকে না' বলে শাড়ি জড়িয়ে ফেলেছে নয়ন।  ঝিয়ের সঙ্গে গৃহকর্তার গাবগুচির গল্প লিখেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ('মাঝের দরজা'), কিন্তু সেখানেও কন্ট্রাসেপ্টিভ লাগাবার পর মশারির অন্দরে অন্ধকার ঘনাইয়া আসে। 
এ কথা ঠিক যে প্রথম শ্রেণীর উচ্চাঙ্গ দেহব্রতী উপন্যাস রচনার চেষ্টা ---- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চতুস্কোণ', সমরেশ বসুর 'বিবর', কমল চক্রবর্তীর 'ব্রাহ্মণ নবাব', সুবিমল মিশ্রর কতিপয় গ্রন্থ, এমনকি অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস', 'ঘামলাঘাট' এবং 'খানাখারাব'কে মাথায় রেখেই বলছি ---- বাঙালি লেখকরা খুব-একটা করেননি।  কেননা যৌনতাকে নিয়ে লেখা সবচেয়ে কষ্টকর এবং সে-ক্ষমতার একান্ত অভাব থেকে গেছে তাঁদের মধ্যে।  এছাড়া কৈশোর থেকে কাম ও যৌন বিষয়ে নানারকম অবগুণ্ঠনজনিত বিকৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা বাঙালি লেখকদের মস্তিষ্কের কাছে যৌনতার মতো গম্ভীর বিষয় নিয়ে নিরপেক্ষ রচনা আশাও করা যায় না।
প্রকৃত সত্য হল, বাংলা সাহিত্যে 'পর্নো' আর 'সাহিত্যের' মাঝখানে এখনও সেই নষ্টনীড়ের দেওর-বউদি সম্পর্ক।  দুজনেই দুটি ভিন্-ভিন্ কামরায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।  বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যে তাদের ঠাঁই জোটেনি।

সুজাতা দে



প্রথম দেখার ক্ষণ/
সুজাতা দে

ভালোবাসা বুক দ্রিমিক দ্রিমিক তানে..
প্রথম দেখার খুঁজতে থাকে মানে-
মুগ্ধতায় অসীম আশার মনোজ্বরে
দৃষ্টি উপদৃষ্টিতে পলক না যে পড়ে।

প্রথম দেখা আউল-ঝাউল কথায়
উড়তে দিলাম প্রাণের ভোমর ডানা
কোথায় কোন রাজার পুরেতে বাস
জানতে মরিয়া লাজুক প্রশ্নরাজ।

কোথায় কখন দেখেছিলাম আগে
এই কি তবে সেই- স্বপ্ন পুরণ রাগে
অধীর অপেক্ষায় মুখর হয়ে থাকা
এতোদিনে কাঙ্খিত প্রেম মেলে পাখা।

বারে বারে স্বপ্নসম মুখচ্ছবি জাগে
মন রাঙাতে খোঁজা দুরন্ত অভিসার
কথাকলিরা মুগ্ধতায় লাজেতে ঢাকে
বন্ধ স্বরেতে বলতে চেয়ে-ই হোঁচট।

প্রথম দেখা বন্ধুতা হোক;তবু ভালো
দেখেই তোমায় মন- জানালায় আলো
ঠিকানাটা চাই বলেছিল ভীরু গলা
তোমাকে ভালো যে লেগেছে হয়নি বলা।

চোখ বুঝে নেয় চোখের মনের ভাষা
ঠিকানা কি হবে বলেছিলে অবহেলে
মন কি বুঝেছে ভালোবাসা অচেতনে
গোপনে বাঁধা হয়েছে যে প্রেম-গান।

অসম ধরম দেখেনি; মরণ-খাঁড়া
বাড়িয়ে হাত ঠিক বেঁধেছ গাঁটছড়া!
যতো বেদনায়; সমাজ, শিকড় টানে-
তবু ছেঁড়েনি কেন; তা প্রথম দেখা জানে।

ভজন দত্ত

ভরসা যখন "বাংলা"
                                    
পুরনো মদে না কি জম্পেশ নেশা হয় ?সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় একটি পুরানো বিল ( প্লিজ, মদ পড়বেন না ) বর্তমান সরকার সর্বসম্মতিতে নতুন করে বিধানসভায় পাশ করিয়ে নিলেন।যখন বাজারদামের বাড়বাড়ন্ত, বৃষ্টি না খরা,শিল্পের চপ না তেলেভাজা বড়া,না কি সি বি আই ,না কি সারদা- নারদা,না কি বেতন কমিশন,না কি রাজ্যের ঘরে ঘরে বেকার ভাই- বোন বা ভাইপো- ভাইঝি কিংবা পুত্র-কন্যা বাড়ন্ত--- তখন এসব সরিয়ে আবার বেশ মৌতাতে মজেেছে ' বাংলা '।
সকল সরকার বাহাদুরের অসীম ক্ষমতা।আর ক্ষমতা হাতে থাকলেই নাম বদলের খেলা তো বহুত পুরনো। সে সরকার বাম বা রাম বা অন্য যে কোনো সরকারই হোক না কেন !
এরাজ্যের নাম পরিবর্তনে সেই বস্তা পচা যুক্তি তো আছেই । "ওয়েস্ট বেঙ্গল" হলে তালিকার প্রায় শেষ নাম, মহাহুজুরদের ও শ্রোতৃবর্গের ধৈর্য না কি আর রয় না? তাই "প্রাণ ভরিয়ে " আমাদের রাজ্যের সমস্যাবলীর কথা না কি সেভাবে বলা হয়ে ওঠে না ? তাই ,নাম 'বাংলা' হলে বড়ো হুজুরের কাছে সব সমস্যার কথা তুলে ধরে আমাদের ভিক্ষার ঝুলি প্রসারিত করতে আর কোনো বাধা রইলো না।স্বাধীনতার পর থেকে তো আমরা তাই করে চলেছি।ঋণ নিচ্ছি আর ঘি খাচ্ছি ।ঋণ আমাদের অতীত, আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত ।আমাদের ঋণ মেটানোর জন্য ঋণের সুদ দেওয়ার জন্যও ঋণ করতে হয়।এমনকি কর্মচারীদের মাইনে দিতে ঋণ করতে হয়, উন্নয়নকাজ করতে বা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্যও ঋণ করতে হয় । বলতে পারবেন, রাজ্যের স্বনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো আর কবে গড়ে উঠবে , আম জনতা ? অথচ রাজ্য সরকারকে জনমনোরঞ্জনী কর্মসূচী বাড়িয়েই যেতে হচ্ছে ।ভোট বড়ো গরজ ।তাই সব সরকার একই পথের পথিক ।পাব্লিক কি আর সাধে বলেন ,যে যায় লঙ্কায় ...।দামে বড়ো ঝাল কাঁচায় বা শুকনোয়।
নাম নিয়ে নামমাত্র বিতর্ক হয়েছিল । 'বাংলা' না 'বঙ্গ' তাই নিয়ে হয়েছেও কিছু কিছু রঙ্গ । তো বিতর্কে তো আর অঙ্গহানি হয় না বরং মননে শান দেওয়াটা হয়।১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে রচিত " বঙ্গভাষা ও সাহিত্য " গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেন " বঙ্গ" শব্দটিকেই মর্যাদা দিয়েছেন । আরেকজন শ্রদ্ধেয় মানুষ সুকুমার সেন
"বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস" গ্রন্থের রচয়িতা ।গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে।মোট পাঁচ খণ্ডের এক অনবদ্য গবেষণামূলক কাজ তিনি করে গেছেন । দুজনেই কিন্তু শ্রদ্ধার সঙ্গেই 'বঙ্গ' শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন।
প্রাচীনতার দিক থেকে 'বঙ্গ' নামটির সমর্থন অনেক পাওয়া যায়। আবার আধুনিকতার বিচারে পাওয়া যায় 'বাংলা' নামটির সমর্থন । এখন বাংলা নামটি ব্যবহারের মুশকিল হোল
(১) না, 'বাংলা' কোনো মদের নাম নয়। ঐ নামে কোনো মদও পাওয়া যায় না। কিন্তু দেশজ পদ্ধতিতে তৈরি অনেক মদকেই 'বাংলা' বলা হয় ।অনেক মদ্যরসিক না কি সেটিকে আদর করে 'বাংলু' বলেও ডেকে থাকেন ! ভাবুন ' বাংলা '।
(২) 'বাংলা দেশ ' নামে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন দেশ আছে । আমাদেরই প্রতিবেশী রাষ্ট্র।তাদেরও জাতীয় সঙ্গীত  কবিগুরুর লেখা। " আমার সোনার বাংলা " গানটি শুনলেই সকল বাঙালির বুকে প্রাণ আসে।ভাবুন এবার সেই দেশের মানুষরা কী করবেন ? গানে কি 'দেশ' শব্দটি যোগ করবেন ? এমনিতেই না কি একটা চোরা স্রোত আছে গানটি বাতিল করার জন্য।তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির প্রতি সম্মান ও আন্তর্জাতিক সৌজন্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে 'বাংলা' নামটি গ্রহণ না করাই কি ভালো ছিল ?
(৩) রাজ্যের নাম যদি ছাড়তেই হতো , রাজ্য সারণীর উপরে যদি এভাবে উঠতেই হতো তবে বর্তমান নামের প্রথম অংশটি ছাড়লে তো সেই 'বঙ্গ'ই থাকতো।তবে ?
(৪) সব নামের পিছনে যেমন একটি ইতিহাস লুকিয়ে থাকে তেমনি পশ্চিম বঙ্গ নামটির পিছনেও আছে এক ইতিহাস।ক্ষমতা থাকলেই কী আর নাম পরিবর্তন করতে হয় ?
(৫) নাম পরিবর্তনের ফলে সরকারি, বেসরকারি স্তরে এক বিপুল পরিমাণ অর্থও তো খরচ হবে ? সেই তো আবার ঋণ করেই এসব করতে হবে।এত এত অফিস,আদালতের, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে, হোর্ডিং,লেটার হেড,কাগজপত্র সব ,সবকিছুই বদলাতে হবে । এরও তো একটা ব্যয় আছে ।জানিনা তার পরিমাণ কতো।যাইহোক ,যতটুকু হোক , তারও কী খুব প্রয়োজন ছিল ?
না,আমি নাম পরিবর্তনের পক্ষে একেবারেই নেই ।তাই বলে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবো,অকপটে বলছি তেমন কলিজার জোরও নেই। কিন্তু পরিবর্তন যদি করতেই হয় তবে তো ইতিহাসকে রক্ষা করেও করা যায়। ইতিহাসকে মুছে ফেলে করার কষ্টটা তো লাগবেই । তাই , ভাবুন আমরা কি ইতিহাসের প্রতি একটু শ্রদ্ধাশীল হতে পারি না?বাঙালি কি চিরকাল সেই আত্মবিস্মৃত জাতির কলঙ্ক বয়েই চলবে ?
যীশুখৃষ্টের জন্মের প্রায় ছ'শো বছর আগে যে জৈনধর্মের উৎপত্তি, সেই ধর্মের গ্রন্থ " ঐতরেয় আরণ্যক"(২-১-১-৫)-এ 'বঙ্গ' নামটির কথা পাওয়া যায়। তো,কত সহজেই পরিবর্তনের ফলে আমরা দুহাত তুলে সেই প্রাচীনতার অধিকার ছেড়ে দিলাম ?
ছাড়ুন , নাম বদলালেই বা কী এসে যায় ? আসুন একসাথে গাই , এই বেশ ভালো আছি ।খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি।আম আদমির আর কী ? নাম বদলালেও যা ,না বদলালেও তা।হে মহামহিম স্যার শেক্সপিয়ার আপনিই তবে ঠিক।আপনি তো সেই কবে বলে গেছেন ...।আহ ! এভাবে ভাবলে আর কী ? চালাও পানসি ।

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



খোসা 





- ডিম সেদ্ধ করতে খরচ কম। কিন্তু, সময়টা বেশি যাবে। 
- ধুর! এইভাবে হিসেব করে নাকি। ডিম ভাজবি একসাথে ক'টা? বড় জোর ডবল মামলেট। কিংবা ডিম পাউরুটি টোস্ট, সেও বেশি হ'লে একসাথে দু'টো ডিমের বেশি নয়। কিন্তু সেদ্ধ করলে, বড় ডেকচিতে একসাথে অনেকগুলো সেদ্ধ হয়ে যাবে। 

ডিম, ডেকচি, স্টোভ, কেরোসিন তেল, নুন, জলের ব্যবস্থা, বসার ব্যবস্থা... সব নিয়ে একটা হিসেব করে শুরু করার মত পুঁজি কত হ'তে পারে বুঝে নিলো প্রকাশ। সমান সমান হিসেবে তেল, পেঁয়াজ, পাউরুটি যোগ করলে খরচ অনেকটাই বেশি হয়ে যাচ্ছে। আপাতত সেদ্ধ ডিমেই খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। লাভের মুখ দেখলে তখন ধাপে ধাপে অন্য ব্যবস্থা... এক এক করে। কিন্তু একটা জিনিস কেমন খচখচ করছে... প্রশ্নটা নিরাপদদাকে করাই হ'ল না। এমন ভাবে হিসেব বোঝালো, যেন প্রচুর লাভ। তখন মনেও এলো না। এখন মনে হচ্ছে। 

--- --- --- 

অরুণার ওপর থেকে নেমে, চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পর হঠাৎই বলে ফেলল প্রকাশ  "আচ্ছা, লোকজন সেদ্ধ ডিম খেতে বেশি ভালবাসে? না মামলেট?" 
এইসময় এমন প্রশ্নর মানে বুঝতে পারল না অরুণা। বুকের ওপর আঁচলটা টেনে প্রকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল "কি?!" 
প্রকাশ আগের মতই চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের কাছে রাখা ডান হাতটায় কড় গুণতে গুণতে বলল "বুঝতে পারছি না। লোকে বিকেলে বা সকালে ডিম সেদ্ধ খায়। কিন্তু আমার থেকেই বা কেন খাবে? মামলেট, টোস্ট এগুলো তো বেশি খায়... তাই না? আমার তো সেদ্ধ ডিমের থেকে এইগুলোই বেশি ভাল লাগে!"  অরুণা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, অন্ধকারেও ওর চোখের বিরক্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এক ঝটকায় প্রকাশের বাঁ হাতটা সরিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে বলল "সময় অসময় বলে কিছু নেই... রাতে শোয়ার পরেও.. ছিঃ... স্বার্থঃপর একটা!" 
প্রকাশ কী বলবে বুঝতে পারলো না। কিছু বলার চেষ্টাও করল না। মশারীর বাইরে হাত বাড়িয়ে জলের বোতল থেকে দু' ঢোক জল খেলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। বিড়বিড় করে শুধু বলল "খুব ভুল হয়ে গেল... কাল আবার নিরাপদদাকে ধরতে হবে বাজারে গিয়ে।" অরুণা নিজের পা দু'টোও টেনে সরিয়ে নিলো, যাতে কোনও ভাবেই প্রকাশের ছোঁয়া না লাগে। 

--- --- ---  

"কেউ সেদ্ধ খায়, কেউ ভাজা... আবার সেদ্ধ আর ভাজাও আলাদা রকমের হয়। কীসব নাম আছে। দেখেছি। সবার ব্যবস্থা হ'লে লোক বেশি জুটবে।" 
সকাল থেকে এই প্রথম কথা বলল অরুণা। এতক্ষণ শুধু ঠুকঠাক জিনিসপত্র রাখা আর বাসনের শব্দ হচ্ছিল। কথাগুলো খুব একটা অন্যায্য বলেনি, কিন্তু প্রকাশের টাকার হিসেব করতে গেলেই টানাটানি পড়ে যাচ্ছে। অরুণার কথাগুলো শুনে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল "আমিও তো এই ভেবেই আর এগোতে পারছি না। শুধু সেদ্ধ থেকে কি আর লাভ আসবে?" 
রান্নাঘর থেকে উঠে এসে অরুণা জিজ্ঞেস করল - সেদ্ধ ডিমে খরচ কম?
- সেরকমই তো বলল নিরাপদদা। 
- কী বলল?
- ওই ডিমের দাম, ডেকচি, স্টোভ, কেরোসিন... সব মিলে। 
- দিনে ক'টা করে ডিম বেচবে?
- ক'টা বিক্রী হবে তা কি আর জানি? ওই দু' ডজন দিয়ে শুরু করব। তারপর তার থেকে যেমন বিক্রী হয়। 
- নিরাপদদা'র নিজের দোকানটা যেন কিসের?
- ও চায়ের দোকান...
- শুধু চা?
-  না না... চা বিস্কুট, সিগারেট, পাউরুটি টোস্ট, পান মশলা...
- আচ্ছাআআআআ... এবার বোঝা গেল। 
- অ্যাঁ?
- না... তুমি দু'ডজনের বদলে যদি দেড় ডজন নিয়ে যাও প্রথম দিন। আর ঘরের থেকেই ছোট কড়াটা, এক শিশি সরষের তেল, দুটো পেঁয়াজ আর ক'টা লঙ্কা... তাহ'লেও কি খুব বেশি খরচ হবে?
- না তো।
- তাহ'লে প্রথম দু-তিনদিন অল্প করে দেখো না। তারপর সেই মত না হয়...

বিকেল হওয়ার আগেই বাজারের দিকে সাইকেল নিয়ে চলে গেলো প্রকাশ। নিরাপদদা ব্যস্ত হওয়ার আগেই একবার ধরতে হবে। অরুণার কথা মত সব কাগজে লিখে নিয়েছে। এদিক-ওদিক মেরে কেটে সেদ্ধ, মামলেট দুটো দিয়েই শুরু কর যায়। খুব একটা হেরফের হচ্ছে না। 

--- --- --- 

"আসল কথাটাই নিরাপদদা সেদিন বলেনি... এইসব করতে ডেলি যা খরচ তা তো আছেই... এ ছাড়া ওই জায়গাটা পাওয়ার জন্য পার্টিকে কিছু অ্যাডভান্সও দিতে হবে... তারপর মাসে মাসে..."
সাইকেলটা এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখতে রাখতেই কথাগুলো জানিয়ে দিলো প্রকাশ... হাঁফাচ্ছিল, তাই সময় লাগল পুরোটে বলতে। অরুণা এই প্রসঙ্গে কোনও উত্তর দিলো না। নুন-চিনি মেশানো এক গ্লাস জল প্রকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধু বলল "বসো... চা খাও। শুনছি এক এক করে। বাসনগুলো মেজে নিই।" ঢকঢক করে সবটা জল খেয়ে জামার বোতামগুলো খুলে ফেলল ফেলল প্রকাশ। তারপর সেই জামা দিয়েই গায়ের ঘাম মুছে সেটা দিয়ে হাতপাখার মত নিজেকে হাওয়া করতে শুরু করল। অরুণার কাছ থেকে কোনও সাড়া না পেলেও নিজের মনেই এক এক করে বলে যেতে লাগল, চায়ের দোকানের নিরাপদর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে। যদিও তার থেকে কোনও নতুন অথবা বাড়তি তথ্য এলো না। তবে নিরুপায় মানুষের এতেই সান্ত্বনা, এক কথা বাড় বাড় বললেও মনে হয় কিছু কাজ এগোচ্ছে। কথা চলছে। 

অরুণা জানে, প্রকাশ অল্পেতেই ঘাবড়ে যায়, দুশ্চিন্তা করে... বেশি চাপ পড়লে দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। ইংরিজীতে যাকে বলে 'নার্ভাস'। শব্দটা জানা না থাকলেও, ধাতটা অরুণার চেনা। তাই ইচ্ছে করেই প্রকাশের এতগুলো কথার কোনও উত্তর দিলো না। ঘরের সব কাজ সেরে দরজার কাছে এসে শান্ত ভাবে বলল "বাইরে মশা কামড়াবে, ভর-সন্ধেবেলা চৌকাঠে বসলে দেনা হয়।"; তারপর ঘরের ভেতর ঢুকে গেল বিছানার চাদর ঝাড়তে। 

- নিরাপদদাও টাকা দেয়?
- পার্টিকে?
- হুম?
- বলল তো সবাই দেয়। দোকান থাকলে নাকি দিতেই হয়...
- তোমাকে ক'ত দিতে বলেছে?
- পাঁচ হাজার কম করে। 
- তারপর?
- তারপর কি? মাসে মাসে?
- হুম?
- সে সব অতটা বলতে পারল না নিরাপদদা। বলল ওদের সঙ্গে কথা বলে সব আগে সেট করে নিতে হয়। না হ'লে পরে ঝামেলা হবে। 
- কার সঙ্গে কথা বলবে? তুমি তো চেনোই না কাউকে!
- নিরাপদদা চেনে। বলেছে কথা বলিয়ে দেবে। 
- বাবা, নিরাপদদার যে তোমার থেকেও বেশি গরজ!

প্রকাশ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে অরুণার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভাতে খানিকটা ডালের জল ঢেলে খেতে শুরু করল। নিরাপদ'র বাড়তি আগ্রহটা প্রকাশও বোঝে। এসব সহজেই বোঝা যায়।

- হাজার পাঁচেক টাকা, তোমার কাছে হবে?
- দেখি। 
- কোথা থেকে দেখবে! ব্যাংকে তো ঐ ক'টা টাকা। ছেলে-পুলে এখনও কিছু নেই। কিন্তু ঘটির জল তো ওইটুকুই আছে। যদি ভালো-মন্দ কিছু...
- তাহ'লে আর কী করতে পারি বলো?!  
- হাতেরটা, গলারটা বেচে দাও... তাও আর বলতে পারছি না। আর টাকাগুলো নিয়েও যে সব মিটে যাবে... ওদের কথার দাম আছে? জানো না তুমি? মনে নেই?
- বাজারের দিকে নাকি এমনই রেট। অন্য দিকে কম। কিন্তু সেখানে কি  খদ্দের পাবো?

"শুরু করার আগেই পাঁচ হাজার। তারপর প্রতি মাসে নিয়ম করে... সময় মত। লাভের হিসেব যা করেছিল, তা আর থাকবে কী করে? ব্যবসা শুরু করার আগেই লসের খাতায় চলে যাবে। ওদের আর কি! ভালই কাটছে হারামখোরগুলোর এই করে! নাহ্‌... বাজারের দিকে বসা যাবে না। শ্মশানে যাওয়ার পথে নিমতলার মোড়, কিংবা স্টেশনের দিকে কলোনির রাস্তাটার কেমন রেট জিজ্ঞেস করতে হবে। যদি কিছু কমসম হয়..."
রাতের দিকে ভ্যাপসা গরম, তাই না ঘুমিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করে যাচ্ছে প্রকাশ। দু'জনেই দু'জনের দিকে পিঠ করে শুয়ে। অরুণারও ঘুম আসছে না। হাতের ওপর মাথাটা রেখে ঘুমনোর চেষ্টা করছে চোখ বন্ধ করে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সরু শাঁখাটা। ভাগ্যিস... এখনও ওদের কোনও ছেলে-মেয়ে হয়নি। 

--- --- --- 

কাজ শুরু করতে গিয়ে খাতায় কলমে বসে দেখা গেল যা হিসেব করেছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি খরচ। গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ হাজার টাকার অগ্রীম আর মাসিক হিসসার বাইরেও একটা ব্যাপার আছে - মাঝে মাঝে স্থানীয় থানা থেকে কেউ কেউ আসতে পারে। এটা বলে দেওয়া হয় না। ধরে নিতে হয়। পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়া ভাল থাকলে, চাপ কম থাকে। কিন্তু এইসব যেমন গোড়ায় বলতে ভুলে গেছিল নিরাপদ, সেরকম এটাও বলতে ভুলে গেছিল যে একটা গুমটির দরকার হয়। দুটো সাইকেলের চাকা লাগানো গুমটি। যেটা নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে সেখানে যাওয়া যায়, সেখানেই সরঞ্জাম রেখে ব্যবসা। সাময়িক এবং গমনশীল।  তারপর - 

 ডিমের খোসা (বিকল্প উপসংহার ১)
সব দিক ভেবে প্রকাশের শেষমেশ বাজারের আশা ত্যাগ করে শ্মশানের দিকের নিমতলা মোড়েই যেতে হ'ল। তাও মোড়ের মাথা নয়, সেখান থেকে একটু দূরে। অগ্রীমটা অনেক কমে গেল, কারণ শ্মশানে আসতে যেতে কেউ ডিম সেদ্ধ খায় না। হিসসা তখনই চাইবে, যদি কাস্টমার বেশি হয়। চাকা লাগানো গুমটিটা একজনের থেকে বাধ্য হয়ে কিনতে হ'ল। পার্টির চাপে। 
ডিম এমনিতেই অযাত্রা। তায় আবার সেদ্ধ। অরুণা বলল এক ডজনের বেশি রেখে লাভ নেই। চায়ের কেটলি আর প্লাস্টিকের কাপে একটু খরচ করল। আর কাজ চালানোর মত সিগারেট, বিস্কুট। সকালের দিকে প্রকাশ বসে, দুপুরের দিকে অরুণা, আবার সন্ধের পর প্রকাশ। একটু বেশি রাত অবধি থাকে, শ্মশান থেকে রাতে যারা ফেরে, মাঝে পাঁচ-ছজন দাঁড়িয়ে যায়। অরুণা রাতে থাকতে দিতে চায় না। নাহ'লে দিনে না বসে সারা রাত দোকান দিলেই ভাল হ'ত। দুপুর থেকে ভোর অবধি। 

যদিও একমাস হয়নি, তবে লাভ সামান্যই। আর এর থেকে বিশেষ বাড়ারও কথা নয়। মাঝে মাঝে এক আধ দিন দশ টাকাও লাভ হয় না। মাস গেলে কতই বা জমবে হাতে? এর ভরসায় বেশিদিন চলবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে। দু-তিন রকম ব্যবস্থা করতে হবে সংসার টানতে গেলে। অথচ পার্টির ছেলেগুলোকে বোঝানো মুশকিল। মাসের শেষ সপ্তাহ হ'তেই ওরা আসা যাওয়া শুরু করেছে। সত্যি হিসেব দেখালেও কি অমনি অমনি ছেড়ে দেবে? 

পেঁয়াজের খোসা (বিকল্প উপসংহার ২)
পাঁচ হাজার টাকা চাইলেই ওভাবে দিয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপর মাসে মাসে, তার ওপর আবার থানা। নিরাপদদা এই ব্যাপারে সরাসরি কিছুই করতে পারল না, শুধু গোবিন্দ হাঁসদা বলে একটা লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। তাকে একশো টাকা দিতে, সে নিয়ে গেল পার্টির ছেলেদের কাছে। পার্টি অফিস না, ক্লাব ঘর। ক্যারাম খেলতে খেলতে কথা বলল দু'টো ছেলে। নতুন কথা, পুরনো কথা... অনেক কিছু শোনার পরেও চুপচাপ রইল। পাত্তা দিলো না খুব একটা। সত্যি তো... প্রকাশ ওখান দোকান দিক বা না দিক, তাতে ওদের কী? প্রকাশের লাভ না হলেই বা ওদের কী? দোকান দিলে কিছু তো দিতেই হবে! বাজার একটা প্রাইম লোকেশন। প্রকাশ না বসলে ওই জায়গায় অন্য কেউ বসবে। এরা কেন লস খাবে? তাও প্রকাশ কিছুক্ষণ হাতকচলে গেলো। এক মিনিট করে চুপ করছিল, তারপর আবার নতুন করে বলছিল। জমিদার বা নায়েব-গোমস্তাদের কাছে যেমন চাষা-ভুষোরা হাত কচলে খাজনা মকুব করতে বলত। যেমন 'নার্ভাস' হ'লে প্রকাশ করে। শেষে একটা ছেলে বিরক্ত হয়েই বলল - "ঠিক আছে, আগে দু'হাজার দে... বাকিটা মাসে মাসে ভেবে দেখব।" এই ভেবে দেখার ব্যাপারটা প্রকাশ বুঝতে পারল না। গোবিন্দ হাঁসদা তাকে বুঝিয়ে দিলো - পাঁচ কমে দুই হয়েছে। বিশাল ব্যাপার। মাসে মাসে একটু বেশি দিয়ে বাকিটা পুষিয়ে দিতে হবে... ধারের সুদ দেওয়ার মত। 

বাজারে ব্যবসা করতে গেলে এতে রাজী না হয়ে উপায় নেই। ব্যাঙ্ক থেকে ঐ দু'হাজার তুলে দিয়ে দিলো প্রকাশ। কিন্তু এসবের কি আর সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে? সবই ভরসা করা। জনদরদী দলের দুঃখী-দরদী ছেলেরা কথা দিয়েছে। এই অনেক। তবে গোবিন্দ ছেলেটা চালাক, এইসব রফার কথা পাঁচকান করতে বারণ করল। অরুণা বলল - "নিরাপদকেও বলো না। দরকার নেই!"
আপাতত অরুণার কথা মত সেদ্ধ আর ভাজা দু'টোই রেখেছে। তার সঙ্গে পাউরুটিও পাঁচ-ছটা। কেউ টোস্ট চাইলেও দেয়। বাজারে এমন দোকান আরও আছে। একচেটিয়া ব্যবসার ব্যাপার নেই। আর নিরাপদদাকে চটানো যাবে না... তাই এর বেশি কিছু করার কথাও ভাবা যাচ্ছে না আপাতত। গোবিন্দ বলেছে, দু-তিন মাস আগে টিকে থাকো... টিকে থাকাই আসল। রয়ে সয়ে খেলে সব হয়। আঁকুপাকু করলেই গলায় আটকে যাবে। 
এদিকে, মাসের শেষ হয়ে এলো... এই নামমাত্র লাভের রাখবে কি আর পার্টির ছেলেগুলোকেই বা দেবে কি?! এই ভাবতে ভাবতে প্রকাশ বিছানায় ঘেমে ওঠে রাতে। অরুণারও মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। গোবিন্দ বলে ছেলেটার পান খাওয়া দাঁতের হাসিটা স্বপ্নে তাড়া করে। ছেলেটা আজকাল নিয়ম করেই সন্ধেবেলা বন্ধুদের নিয়ে এসে ডিম সেদ্ধ, কিংবা টোস্ট খেয়ে যায়। সন্ধেবেলাই আসে, কারণ ওইসময়টা অরুণা দোকান সামলায়। 


 মানুষের খোসা (বিকল্প উপসংহার ৩)
প্রকাশ সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না। অনেক কিছু বুঝতে পেরেও চুপ থাকে। মাঝে মাঝে মাথা গরম হয়, মাঝে মাঝে ঘাড়ের কাছটা টনটন করে... মাথা ঝিমঝিম করে। চেঁচিয়ে বা অশান্তি করে কিছু কাজের কাজ হয় না, এটা শেষ ছ'-সাত মাসে হাতে কলমে বুঝে গেছে। অরুণাও বুঝিয়েছে অনেক করে। নিরাপদ লোকটা নিজে পাক্কা ব্যবসাদার। এটা-সেটা বুঝিয়ে নিজেই কিছু টাকা হাতিয়ে নেবে। ওর চেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, ওর চেনা লোকের থেকে মাল সাপ্লাই নিতে হবে, ওর ঠিক করে দেওয়া জায়গায় দোকান দিতে হবে... সবই ও বলে দেবে। চালাকি! 
নিরাপদ আর ওর দেঁতো হাসি হাসা চেনা লোকগুলোকে কাটিয়ে নিজেই পার্টি অফিসে চলে গেছিল প্রকাশ। অফিস থেকে ক্লাব, ক্লাব থেকে আর এক পাড়ার অফিস, সেখান থেকে আর এক ক্লাব। মোটামুটি সব জায়গা ঘুড়ে স্পষ্ট বুঝে গেল... হাজার নাক রগড়েও টাকা না খসিয়ে এক পা এগনো যাবে না।  শেষে গায়ে পড়েই একটা ফালতু রফা করল। সামনের ইলেকশন, ওদের লোক দরকার। প্রকাশও যাবে অন্য গ্রামে ডিউটি দিতে। দলের যা যা দরকার লাগে। ছোট-বড় কাজ, যতটা পারবে। প্রকাশ কী জানে আর কী পারবে... তা নিয়ে পার্টির ছেলেদের তেমন মাথা ব্যথা নেই, কারণ ওকে দরকারও নেই। কেমন যেন কাকুতি-মিনতিতেই রাজী হয়ে গেল শেষমেশ। পার্টির হয়ে বেগার খাটার জন্য এক পয়সাও পাবে না। রাতও জাগতে হ'তে পারে। অন্য গ্রামে গিয়ে পড়েও থাকতে হ'তে পারে যতদিন বলা হবে। বদলে ওই পাঁচ হাজারটা কমে যাবে। আর পার্টির কাজ পাকাপাকি ভাবে করে গেলে হয়ত মাসে মাসেও কমই দিতে হবে। তবে এইসব কিছু মুখের কথা... মুখের কথা মেনেই কাজ করতে হয়। প্রকাশের আর দোকান দেওয়া হ'ল না। তবে দোকানটা হয়েছে বাজারেই, নিরাপদর দোকানের থেকে একটু দূরে... প্রকাশের বউ অরুণাই সামলায়। প্রকাশকে চলে যেতে হয়েছে পাশের গ্রামে, পঞ্চায়েৎ ভোট শেষ হ'লে তবে ফিরবে। ততদিন অরুণা একাই। 

পার্টির ব্যাপার-স্যাপার অরুণারও কানে আসে। প্রকাশদের সঙ্গেই কাজ করত সজল। পার্টির ছেলে। আলাদা সুবিধে ছিল। বাইক অ্যাক্সিডেণ্টে মরে যেতেই সব ফক্কা। পার্টি থেকে বলেছিল বউকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবে। মিথ্যে বলে লাভ নেই... পাইয়েও দিয়েছে। মাস মাইনে ভাল, মেয়েটার স্কুলের মাইনেও কুলিয়ে যায়। কিন্তু সজলদার বউ কাবেরীকে এক নেতার বাড়ি রান্নাটা করে দিতে হয়। সন্ধের দিকে চায়, রান্নাটা করে দিয়ে আসে। সেই নেতার বউয়ের নাকি হাঁটুর ব্যামো। নড়াচড়া বেশি করতে পারে না। অরুণা জানে, ওই রান্নার কাজটাই আসল... ওই দিকেই সংসারটা চলছে। খোঁজখবর রাখলে অরুণাও একটা রান্নার কাজ, কিংবা কাপড়-কাচা বা বাচ্চা-সামলানো, নাহ'লে নেহাৎ অথর্ব বাবা-মাকে দেখা... কিছু একটা জুটিয়েই নেবে। ভালমন্দ কিছু কপালে থাকলে শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে... তার কি ঠিক আছে? তার থেকে নিজেই যদি সময় থাকতে থাকতে একটা ব্যবস্থা করতে পারে... সংসারের অবস্থা থাকলে... সম্মানেরও ব্যবস্থা হয়ে যায়। 

--- --- ---  

এই তিনটে উপসংহারের মধ্যে কোনটা কতটা ভাল থাকা, তা আমি বা আপনি বলে দেওয়ার কেউ নই। আর বিচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কি জানেন... আমাদের, কিংবা প্রকাশ আর অরুণাকে কষ্ট করে ডিম সেদ্ধর কারবার নিয়ে এত কিছু ভাবতেই হ'ত না; যদি প্রকাশের কারখানাটা হঠাৎ বন্ধ না হ'ত। 
কী ভাবছেন? আসল অ্যান্টিক্লাইম্যাক্সটা ঠিক কোথায়? এই কারখানা লকআউটের পরিচিত খবর? তিনটে উপসংহারের মাঝে ঘেঁটে যাওয়া গল্প? নাকি... এই চরিত্রের নাম দু'টো... প্রকাশ আর অরুণা?! 



বনবীথি পাত্র

#অকূল_আঁধার

.
কাল রাতে পাগলটা বড্ড চিৎকার করেছে। এমন চলতে থাকলে আর কিন্তু বাড়িতে রাখতে পারব না। অস্থি-চর্ম-সার শরীরটায় ইঞ্জেকশনের মোটা সূঁচটা ঢোকানোর সময় প্রতিবাদী মানুষটা যেন কেঁপে ওঠে। স্বামীর হাতটা ধরতে গিয়েও থমকে যায়, দুদিন আগের মচকে দেওয়া হাতের ব্যথাটা এখনও যায়নি।
নিজেদের সর্বস্বটুকু উজাড় করে মানুষ করেছিল মেয়েকে।
গতরাতের পুরুষসঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের উচ্চশিক্ষিতা আদরের দুলালী। নতুন সঙ্গী নিয়ে ফিরবে দিনের শেষে....
ভোরের আলো ফুটছে বাইরে। অন্ধকার শুধু গাঢ় হচ্ছে সন্তানকে ভালোবেসে জীবন্মৃত মানুষদুটোর জীবনে.....


সিলভিয়া ঘোষ



অনুভব



বর্ষার জল শার্শী বেয়ে বেয়ে  নামছে তরতরিয়ে।আবছায়া কাঁচের জানালার দিকে অপলক দৃষ্টিতে দূরের রাস্তার দিকে চেয়ে  রয়েছেন মিসেস শর্বরী  মুখার্জী। আজকাল হলদেটে অতীতগুলো কেমন যেন টানে তাকে। দুই  মেয়েকে বিয়ে দেবার পর যেটুকু সঞ্চয় ছিল তার সেটুকুর জোরেই বাকী জীবনটা কাটাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু জীবন যে কত রকম ভাবে পরীক্ষা নেয়  তার হিসেব কেউ কোনদিন দিতে পারেনি হয়তো আগামীতে পারবেও না।
   স্বামীর মৃত্যুর পর একহাতে গ্রিলের  কারখানাটাকে সামলানো,  সংসারে দেওর, ননদ সকলের সঙ্গে যথাসম্ভব যোগাযোগ রক্ষা করা লোক লৌকিকতা এমন কি অসুস্থ  সৎ শাশুড়ির দেখাশোনার ভারও তিনি সামলেছেন কড়া হাতে এবং মমতার সঙ্গে। তখনও তো কেউ কোন আঙ্গুল তুলতে পারেনি তার দিকে । সকলেই বৌদি,  দিদি,  শর্বরী করে করে মাথায় তুলে রাখতো। অথচ আজকাল... আজকাল কেউ আর তার খোঁজ নেয় না,  নেয় শুধু সঞ্চিত অর্থের হিসেব নিকেশ আর খোঁচা দিয়ে দিয়ে মেয়েদের উস্কে দেয় তাদের সৎ মায়ের অস্তিত্বের কথা।
       অনেকটা দেরী হয়ে গেলেও আজই সিদ্ধান্ত নিলেন মিসেস মুখার্জী সঞ্চিত সম্পত্তি  ট্রাস্টি করে দেবেন তার তৈরি বৃদ্ধাশ্রমের জন্য।শেষ ঠিকানার নাম হবে  তার 'বানপ্রস্থ'। সবাই জানুক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এ মিসেস মুখার্জী হেরে যাবেন না।


রীনা রায়


#বিষয়:দ্বন্দ্ব

"সিদ্ধান্ত"
*******
রীনা রায় 
শুধু এক মিনিট, মাত্র এক মিনিট যদি বিবেকটাকে বিসর্জন দিতে পারে, নগদ পাঁচলাখ মধুরার হাতে আসবে! 
একসপ্তাহ ধরে মনের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করেও এখনো কাজটা করে উঠতে পারেনি।
বুড়ির তো হার্টের ব্যামো, কেউ সন্দেহও করবেনা, বুড়ির ছেলে মেয়ে তাকে এই টোপটা দিয়েছে।
বুড়ি না মরলে তারা সম্পত্তির ভাগিদার হতে পারছেনা।

বিদেশবাসী শিক্ষিত পুত্র কন্যার কাছে মা আজ মূল্যহীন, মা চোখ বুজলে, এই বাড়ি, সম্পত্তি বিক্রি করে ওরা বিদেশ ফিরে যাবে। একমাসের ছুটিতে এসে ওরা নার্স মধুরাকে এই টাকার অফার দিয়েছে।
একবছর ধরে পঁচাত্তর বছরের রেণুবালা দাশগুপ্ত বিছানায় শয্যাশায়ী, প্রথমদিকে উনি তো হাত পাও নাড়াতে পারতেন না, মধুরার পরিচর্যায় এখন অনেকটা সুস্থ।
মধুরার মনটা আনচান করে, এই মাসিমা ওকে মেয়ের স্নেহ দিয়েছেন, যখনি যা দরকার, সব দিয়েছেন, আর এই মাসিমাকে.....
কিন্তু পাঁচলাখ টাকা পেলে যে  মায়ের চিকিৎসার জন্য আর ভাবতে হবেনা, টাকাটা যে বড্ড দরকার, এত তাড়াতাড়ি এতগুলো টাকা যে আর কেউ ওকে দেবেনা।
"তুমি শুধু মিনিটখানেক বালিশটা চেপে ধরবে....", এইভাবেই বলেছিলো মাসিমার ছেলে, মেয়ে!
আজ ওরা আল্টিমেটাম দিয়েছে, ও না পারলে ওরা ওকে ছাড়িয়ে অন্য নার্স অ্যাপয়েন্ট করবে!
.....
মনের সব দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে , নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে মধুরা সোজা থানায় গেল ।
না ,ও পারবেনা। এক মাকে বাঁচাতে ও আর এক মায়ের জীবন নিতে পারবেনা!

রীনা রায়। 

ঋতুপর্ণা চৌধুরী




#নাম-  সংঘাতে মিলনে- দ্বন্দ্ব


স্বপ্নের ঘোরটা কাটতেই আমিনা বিবি শুনতে পেলেন দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। ধড়মড় করে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। একজন অচেনা যুবক দাঁড়িয়ে বাইরে, পরণে দামী স্যুট, জুতো; ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে দামী রিমলেস চশমা। বড়ো একটা ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। আমিনা খুব অবাক হয়ে গেলেন! কে এই বড়লোক ছেলেটি? ওদিকে ঘর থেকে শোনা গেল পুরুষ কন্ঠ, “ এত্ত সকালে কেডা আইলো বড়বিবি?” আমিনা উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ আফনে কে বাবা? আফনারে তো চিনলাম না!” 

যুবকটি জিনিসপত্র নামিয়ে এক লাফে আমিনার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ‘মা’ বলে। আমিনা স্তম্ভিত! কাঁদবে না আনন্দ করবে বুঝতেই পারছে না। তার থেকেও বড় প্রশ্ন এ কী সত্যিই সে? বছর কুড়ি আগে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া আমিনা বিবি আর রহমান মোল্লার একমাত্র সন্তান শাকিব? 

মধ্যাহ্নভোজনের পর মা-বাবা বসে শাকিবের কথা শুনছিলেন কীভাবে সে এখান থেকে পালিয়ে অনেক সংগ্রামের পর আজ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হতে পেরেছে। সবার চোখেই আনন্দাশ্রু। রহমান মোল্লা শাকিবের হাত ধরে বলছেন, “মোল্লার ছাওয়াল মোল্লাই হয় না। মোল্লার ছাওয়াল কলেজেও পড়াইতে পারে। মাপ কইর‍্যা দে বাপ! আমাগো ফালাইয়া আর যাস না।” 

আমিনা বিবি ভাবছিলেন, বাবা-ছেলের দ্বন্দ্বে এতদিন তিনি কেঁদেছেন আজ এই দ্বন্দে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারটা পেলেন। 
                                                 

শোভন বাগ



#খোঁজ


"ছোটু, একটা স্পেশাল।"

চা খেতে খেতে একবার সময়টা দেখে নিল। সাতটা বাজতে দেরী আছে। বউ বাপের বাড়ি। অন্যান্যদিন এত তাড়াতাড়ি বেরোয় না অফিস থেকে। বাড়ি ফিরলেই তো সেই এক চিৎকার, ঝগড়া। অসহ্য।

বন্ধু দিয়েছিল নম্বরটা। বলেছিল – দারুন জিনিস। একটা রাত কাটিয়ে আয়, দেখবি পুরো ফ্রেশ লাগবে।

হঠাৎই কেমন যেন একটা অস্বস্তি। তাকিয়ে দেখে, ছোটু চেয়ে আছে ওর দিকে। 
"গাড়ীটা তোমার?"
"হ্যাঁ"
"বড় হয়ে আমিও এমন একটা গাড়ী কিনব আর তোমার মত বেশ চা খাব।"

কী যে ছিল ওই বাচ্চাটার কথার মধ্যে, ওর চাউনিতে! নিজের ছেলেবেলা?

"দাদা, ছোটুকে একটু ছেড়ে দিতে হবে।"
"মানে ! আপনাকে চিনিনা জানিনা। তারপর এখন ব্যবসার সময়।"
অবশ্য একটা দু হাজার টাকার নোট পেয়ে দোকানী আর বেশি কথা বাড়ায়নি। ওটা দিয়ে ছেলের নতুন বইগুলো হয়ে যাবে।

তারপর ওরা দুজনে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছে। চা খেয়েছে। ধোসা। আইসক্রিমও। কখন পেরিয়ে গেছে সাতটা। ফোন বেজেছে, ধরেনি।

ফেরার পথে অবশ্য একবার মনে হয়েছিল, মালটাকে টেস্ট করা হল না।

ওদিকে কোন একটা ফ্ল্যাটে, নেলপালিশ পরা আঙুল বারবার টিপছিল মোবাইলের বোতামগুলো। রিং হয়েই যাচ্ছে। সাতটাও বেজে গেছে! একবার ভাবল, আজ আর বেরুবে না। শরীরটাও একটু বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু পরশুদিন যে মেয়েকে নতুন স্কুলে ভর্তি করার লাস্ট দিন। টাকার দরকার।
মনেমনে একটা চার অক্ষর উচ্চারণ করে, নতুন একটা নাম্বারে ফোন লাগাতে লাগল সে।

জয়তী রায়



সোনালী চিলের ডানা
------------------------------------
অফিস থেকে ফেরবার সময়, বাড়ির কাছে পার্ক টাতে একটু বসে যান , বিনয় বাবু। বাড়িতেও তো চাবি ঘুরিয়ে ঢুকতে হবে। রমা , নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই। বুবাই কে নিয়ে টিউশনিতে গেছে। সেই তো একলা বাড়িতে ঢোকা, পরে ঢোকা আর আগে-- ফারাক কি?  
রমা খুব সংসারী মহিলা। খুব গোছানো।  সবচেয়ে বড় গুন, নিজের অবস্থান কে ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, বিনয় বাবুর। সাধারণ গ্রামের মেয়ে হয়ে, এত উচ্চাশা কি করে নিজের ভেতরে , লুকিয়ে রেখেছিল, বুঝে পান না তিনি। 
বিয়ের পরে তো, বেশ সাধাসিধে, গোলগাল , মিষ্টি বউ হয়ে ঢুকলো, সোনারপুর এ বিনয়দের , যৌথ পরিবারে। 
বিনোয়বাবুর বাবা রা তিন ভাই। তিনজনে একসঙ্গে থাকেন। খোলামেলা বেশ বড়ো বাড়ি। বাংলাদেশ থেকে, ছিন্নমূল হয়ে ,আসবার পরে, নিজেদের চেষ্টায় একটু একটু করে বাবা , কাকা রা দাঁড়িয়েছেন। সুন্দর করে বাড়ি করেছেন। ফলফুলের গাছ লাগিয়েছেন। সময় মতন, বাড়ির বড়ো ছেলে, বিনয়ের বিয়ে দিয়েছেন , গ্রামের মেয়ে রমার সঙ্গে। 

 রমার ছিল, আকাশ ছোঁয়া উচ্চাশা। বিনয় চাকরি করতো কলকাতায়। রোজ যাতায়াত করতো সোনারপুর থেকে। রমা বায়না করতে থাকলো, কলকাতা তে থাকবার জন্য। এর মধ্যে, বুবাই এসেছে তাদের জীবনে। রমার বক্তব্য, বুবাই কে , ভালো করে মানুষ করতে হবে। তাই, শহরে গিয়ে থাকতেই হবে। তার জিদ এবং কৌশলের কাছে মাথা নত করে, শহরের ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে গিয়ে  উঠলেন। বুকের ওপরে, একমন ওজনের দুঃখের পাথর বয়ে নিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করলেন বিনয় বাবু। 
কর্মী মেয়ে রমা , খুব  তাড়তাড়ি, শহরের জীবনে , অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। বুবাই কে ভালো  স্কুলে ভর্তি করা শুধু নয়,বুবাইয়ে র জীবনের মধ্যে নিজের জীবন কে একবারে ঢুকিয়ে নিলো। নিজের কোনো আলাদা অস্তিত রাখলো না। বিনোয়বাবুর ও চাকরিতে উন্নতি হয়েছে। এক হাত পা ছড়ানো ফ্লাট কেনা হলো। বাবা , মারা গেলেন। মা কে নিয়ে আসবার কথা বলতেই, রমা হাঁ হাঁ করে উঠলো---" কেন? মা তো ভালোই আছেন ওখানে। সবার সঙ্গে আছেন। এখানে মা এলে আমি কি করে দেখবো? বুবাইকে দেখে , আমার কি আর সময় আছে? " 
*
ঠিক কথা। বিনোয়বাবু , অফিস ফেরত চাবি দিয়ে দরজা খোলেন, চা বানান। বারান্দাতে বসেন। মা র কথা ভাবেন। রমা , বুবাই কে  নিয়ে অংক টিউশনিতে গেছে।
সারাদিন শুধু বুবাই বুবাই আর বুবাই। সারাদিন বুবাইয়ে র কানে মন্ত্র পড়া,--"কোনো ছেলে কে খাতা দেখবি না।"
                             " কাউকে বেশী পাত্তা দিবি না।" 
                              এক ঘন্টা খেলবি। তার বেশী না."
                              ওর পায়ে ব্যাথা তো তোর কি? তুই ওকে পৌঁছে দিতে যাবি না।"
"ঠাকুমা কে দেখতে যেতে হবে না। তোকে ফার্স্ট হতে হবে বুবাই।  সময় নষ্ট করলে চলবে না।

*
বিনয় বাবু অবাক হয়ে দেখেন, সেজেগুজে একটা স্বার্থপর রোবটের মতো স্কুল যাচ্ছে বুবাই। কঠিন মুখ। সেই  চঞ্চল , বায়না করা ছেলে টা কোথায় হারিয়ে গেছে। তার বদলে , সে এখন কম কথা বলে। লড়াইয়ে র ময়দানের খেলোয়াড়ের মতো , তার মুখের পেশী গুলি শক্ত। কোনো দিকে দৃষ্টি নেই। শুধু ওকে ফার্স্ট হতে হবে , হতেই হবে। রাত বাড়তে থাকে। বুবাইয়ের ঘরের দরজার বন্ধ দরজার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়, চাঁদ, তারা, শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত। মা- ছেলে দুজনের চোখে জ্বলে, শিকারীর হিংস্রতা। 
*
অথচ, কি আশ্চর্য! এত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের পরেও, প্রত্যেক বার পরীক্ষা তে প্রথম হয়, তারই প্রতিবেশী র ছেলে সুমিত। সে ছেলে, হাসতে হাসতে রেজাল্ট নিয়ে তাদের বাড়ি ঢোকে। বিনয় কে প্রনাম করে। " কাকিমা" বলে, রমাকে জড়িয়ে ধরে। রমার চোখ ধক ধক করে জ্বলে। সুমিত খেয়াল ও করে না। আপনমনে খোলা হওয়ার মতো,নিজের বাড়ি চলে যায়। 
প্রত্যেক বছর একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হতে হতে, বুবাই ক্লাস টেন এ ওঠে।
*
রমা র মুখ দেখলে এখন ভয় করে, বিনয় বাবুর। সে মুখ মানুষের না এক ভয়ংকরী র? এক প্রেত সাধনা কারী ভৈরবী র মতো লাগে রমা কে। যন্ত্রে ফেলে লেবুকে চটকানোর মতো, নিংড়োতে থাকে বুবাই কে, রমা। বিনয় বাবু হাত জোড় করেন  রমা র সামনে -" ছেলে টা কে কি মেরে ফেলবে তুমি? সেকেন্ড তো হচ্ছে প্রত্যেক বার। তবে?"
" কেন পারবে না ফার্স্ট হতে? কি আছে ঐ সুমিতের মধ্যে? ফার্স্ট হতেই হবে। নইলে ওকে ছাড়বো না!"

বিনয় বাবু আর পারেন না। এটা একটা সংসার? মূল্যবোধ নেই। ভালোবাসা নেই। আছে শুধু, লোভ আর আকাঙ্খা র তীব্র বিষ! খুব শরীর খারাপ লাগে তার। আগামী কাল, ক্লাস টেনের ফার্স্ট টার্মিনাল এর রেজাল্ট বেরোবে। আগামী কাল , সুমিত আবার ফার্স্ট হবে। আবার মা ছেলে, ভাত খাবে না। আবার বাড়ী থেকে,শ্মশানে র চিতার  মরা পোড়ানো গন্ধ বেরোবে।
না, কাল ভোরে উঠেই , তিনি , সোনারপুর এ যাবেন। আর নিতে পারছেন না তিনি।
পরদিন ভোরের ট্রেনে, সোনারপুর চলে গেলেন , বিনয় বাবু। রমা শুধু একবার চোখ তুলে তাকালেন। বুবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একবুক কষ্ট নিয়ে , ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। আহারে! কি মায়াময়, ঘুমন্ত বুবাই। এক সুকুমার কিশোর, পরম শান্তিতে, বালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। একবার ভাবলেন, রমা কে কি হাতেপায়ে ধরবেন? বলবেন কি, ছেড়ে দাও ছেলেটা কে রমা। নষ্ট করো না ওর কৈশোর টা কে! 
নিঃশাস ফেলে  জুতো তে পা   ঢোকালেন ,বললেন," রমা, বুবাই যখন স্কুলে যাবে, যদি পারো , ইলেকট্রিসিটি বিল টা বিল টা দিয়ে এস। আজ লাস্ট ডেট। "  রমা ,কলের পুতুলের মতন মাথা নাড়ে। নিঃশাস ফেলে, সোনারপুর চলে গেলেন বিনয় বাবু।
*
সেদিন রাতেই ফোন এলো রমার।  উনি যেন এখুনি কলকাতায় চলে আসেন। একবুক  আশংকা নিয়ে পাখীর মতো উড়ে , বাড়ি চলে এলেন বিনয় বাবু। 
এসে যা দেখলেন, যা শুনলেন, তাতে মাথা ঘুরে গেল তার। বুবাই খুন করেছে সুমিত কে!  আকাশ যদি ভেঙে পড়তো মাটিতে, পৃথিবী তলিয়ে যেত অতলে, বিনয় বাবু, এত ভেঙে পড়তেন না। কিন্তু এ কি? এ কি করে সম্ভব? 
রেজাল্ট বেরোনোর পরে, দেখা গেল, সুমিত যথারীতি ফার্স্ট হয়েছে। বুবাই সেকেন্ড। ছুটির পরে, বুবাই , সুমিত কে,ডেকে নিয়ে আসে ওর বাড়িতে। রমা ছিল না। ফাঁকা বাড়িতে, সুমিত কে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে, ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে, কম্পাস দিয়ে খুঁচিয়ে , খুঁচিয়ে মেরেছে বুবাই।  মনের গোপন  কোনের সমস্ত হতাশা, রাগ, ঘৃণা সব দিয়ে মেরে ফেলেছে নিরীহ ছেলেটিকে।

রমা  হতবাক হয়ে বসে আছে। বুবাই ও তাই। সুমিতের মৃতদেহ ,সেপটিক ট্যাংক এ ফেলে দিয়েছে মা ছেলে মিলে। 
*
বিনয় বাবু ভাবলেন। অনেক ভাবলেন। তারপরে উঠে পুলিশ কে ফোন টা করলেন। 
 বুবাই একটা  কথা ও বলে নি। যে ছেলে ছিল , মায়ের হাতের যন্ত্র পুতুল, সে মার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। পুলিশ আসার পরে ছেলেকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন বিনয় বাবু। 
খুব শান্ত  স্বরে বুবাই বললো," ঠিক করেছ ফোন টা করে বাবা। তবে তুমি ও যদি মায়ের হাতের পুতুল না হতে, আমাকে এই ভাবে জেলে যেতে হতো না। সুমিত কেও মরতে হতো না। আসি বাবা।" 
,-------------------------------------------------------------------
    
                 সত্য ঘটনা অবলম্বনে

পিনাকী মুখোপাধ্যায়

ফেরা
-------------------------------------------
        কোর্টঅর্ডারে সাতদিন একসঙ্গে থাকতে এসেছে ওরা ।
        বাংলোর পিছনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার গায়ে হাত বোলাতে গিয়ে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে মীরার। দশবছর পরেও নামদুটো এত উজ্জ্বল ! 
         কে যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে , " খুব গভীরভাবে খোদাই করেছিলাম যে ... "
          উচ্ছসিত আবেগে থরথর করে কেঁপে ওঠে মীরা । দুহাতের ঘেরাটোপে বিভান বেঁধে ফেলে ওকে ।
                   

যুগান্তর মিত্র



কুসুমকথা
………………

যুগান্তর মিত্র

"কীরে, আমাকে ভুলেই গেলি ?” জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কুসুম।

বাবার বদলির চাকরি। মালতিপুর বিদ্যামন্দিরে ক্লাশ ফাইভে ভর্তি হলাম। সেই স্কুলে আমার প্রথম বন্ধু কুসুম। একসঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করি। একদিন মা বলল, "তোদের দুটিতে বড্ড মিল। বড়ো হলে তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো।" আমি সেকথা কুসুমকে বললাম। খুব খুশি হয়েছিল।

সেভেনে থাকতেই বাবার আবার ট্রান্সফার। এখন আমরা থাকি উত্তরবঙ্গে। জলপাইগুড়ির ছায়াঘেরা ছোট্ট জায়গায় আমাদের ভাড়াবাড়ি। কলেজের ছুটি চলছে; দুপুরে জানালার পাশে বসে আকাশ দেখছিলাম। হঠাৎ দেখলাম কুসুম জানালা দিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকল। সম্মোহিতের মতো বেরিয়ে গেলাম। দূরের বাগানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল কুসুম। সেই একইরকম মুখ। বয়স যেন থমকে আছে।

"না রে কুসুম। তোকে আমি ভুলিনি।"
আমি জানি এর থেকে বড়ো মিথ্যে আর নেই। কুসুমকে প্রথমদিকে খুবই মনে পড়ত। তারপর ধীরে ধীরে ভুলেই গিয়েছিলাম একসময়।

কুসুম আমার দিকে দৃষ্টি পেতে বলল, "বিয়ে করবি না আমাকে ?" ঘোরের মধ্যেই বললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ করব কুসুম।"

"তাহলে এখনই বিয়ে কর আমাকে।"

হাতের মুঠো খুলে সিঁদুর দেখাল। আমি মন্ত্রচালিতের মতো সিঁদুর পরিয়ে দিলাম কুসুমের সিঁথিতে। ও খুব জোরে হেসে উঠল। তারপর সেই সিঁদুর হাতের তালু দিয়ে মুছে শিরিষ গাছের গায়ে লাগিয়ে বলল, "পাগল একটা ! কেউ যদি দেখে ফেলে কী বলবে ?"

হাসতে হাসতে কুসুম গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছোটাছুটি করছে। আমিও পিছু নিলাম। অনেকক্ষণ এভাবে ছুটতে ছুটতে  কুসুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম আমাদের বাড়িতে চলে যায়নি তো ?

ঘরে ফিরে মার কাছে শুনলাম, ভূষণকাকু বাবার অফিসে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, দিন পনেরো আগে কুসুম জলে ডুবে…। বাজ-পড়া গাছের মতো আমি দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।

আমি সেদিন কুসুমকে সত্যিই বিয়ে করেছিলাম। সেই সিঁদুর, শিরিষ গাছে মুছে ফেলা, সব সত্যি। বিশ্বাস না-হলে দেখে নিও সেই দাগ এখনও আছে। এত ঝড়জলেও এতটুকু মোছেনি।



সৌমনা দাশগুপ্ত



আনএডিটেড

তোমরা হাওয়া চালিয়ে দিতেই পার
আমি তত সামাজিক নই
মেঘের ওপর মেঘ চাপিয়ে আস্ত একটা
লিখেই ফেলতে পার মেঘবাড়ি
আমি তত সামাজিক নই
বৃষ্টি নিয়ে এমন যে আদিখ্যেতা
জলে চুমুক দিতে দিতে জলই মদ হয়ে উঠল
আমি ততটাও সামজিক নই
আর হাসি ভেঙে যাচ্ছে আর কান্না ভেঙে যাচ্ছে
কাচের এপাশ থেকে জোনাকি দেখব
অথবা নক্ষত্রের পৃথিবী থেকে দুএকটা তারা
তুলে এনে ঝুলিয়ে দেব উঠোনে
আমি একেবারেই সামাজিক নই
বরং আলো থেকে
বরং আলপথ থেকে সরে এসে
মাঠে নেমে যেতে পারি, এতটাও
আলাভোলা ভেবো না আমাকে
রাতের ভেতর শুধু এক কুবোপাখি
ডানা খুলে রেখে দিয়ে চলে গেল


জয়িতা ভট্টাচার্য


ক্ষিদে   
______      ____________
বাড়িটা মাঠের প্রান্তে। রাতে একটা ধ্বংসস্তুপের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ।দিনে যেন হানাবাড়ি ।এই বাড়িটাই জুটলো শেষে আমার  অর্থাত  অনিমেষের ভাগ্যে ।সরকারী সমী়ক্ষক হিসেবে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয় ।থাকতে হয় মাসখানেক ।কিন্তু এমন বিদ্ঘুটে বাড়ি তে এর আগে আশ্রয় জোটেনি ।জনবসতি বহূদূর।বাড়িটা আগাছায় ভরা ।বহূকাল বাস করেনি কেউ ।পলেস্তারা খসা ,দেয়ালে শ্যাওলা ।
দিনের বেলা ঘুরে দেখার সময় হয়না ।গ্রামে ঘুরি ,সার্ভে করি।দু তিনটে গ্রাম ।
বিকেলে অনেক সময় বাড়িটার পেছনে যাই ।ঝোপঝাড় ,রাংচিতা আর বিছুটির মাঝে ঝিঙে লতা আর .....পচা মরা ইঁদুর বেড়ালের হাড় গোড় ।
বিশ্রী গন্ধ লাগে ।চলে আসি ঘরে ।
কড়িবরগায় পেঁচা ,রাতে পায়রা ঘোঁট বেঁধে থাকে ।ঘরের মধ্যে রাত হলেই উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় চামচিকেরা ।সরকারী গ্রুপ ডি কোনো ক্রমে রুটি মাংস করে পলায়ন ।
জানলা রাত পুরে ফেলে ঘরে ।আমার জন্য একতলার  দুটি ঘর
  ঘর বরাদ্দ হয়েছে।দোতলয়া ধুলো ়ধুসারিত আরো অনেক়ঘর, বারান্দা ।
___" যাই বাবু, রাত হলো। "
টিকারাম রাতের ়খাবার ,জল আর হ্যাজাক  জ্বেলে দিয়ে চলে যায়।
বলা হয়না
" এখন সবে সাতটা,আরেকটু থাকো"পাছে নিজের অস্বস্তি ধরা পড়ে যায়।
অন্য তালাবন্ধ ঘরগুলো কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে  রাত হলেই ।
কাগজ পত্র আর কলকাতা থেকে আনা হুইস্কি  নিয়ে বসি ।নেটের আওয়াতার বাইরে এসে কেমন যেন খালি খালি লাগে ।
রাগী চাঁদ কটমট করে চেয়ে থাকে ।
ওরা কেমন আছে কে জানে .......দূরত্বে সম্পর্কও আবছা হয়ে যায়।
রাত বাড়লে গেট খুলে যায় ।ধারি কালো কুকুরটা ঢোকে ,নিঃশব্দে উঠে যায় দোতলার ়ঘরটায়। পুরোনো তক্তপোষের মর্ মর্ আওয়াজ পাই ।সন্ধ্যাবেলা একবার দেখেছিলাম ওখানে সিঁড়ির কাছে বিরাট মাংশপিণ্ড পরে আ়ছে ।হয়ত ়টিকারাম রেখে যায় ।
সিঁড়িতে আমার সেই পায়ের ছাপ পড়ে আছে ।এখানে আসার পর দু একবার দোতলায় গেছিলাম ।সেই চিহ্ন এখনো ।অথচ,
চারপেয়েটার কোনো পদচিহ্ন নেই ।
ওপরে বিরাট দরদালান গাড়ি বারান্দা ।ঝুলের মোটা আস্তরন। মেঝেতে ফাট ধরেছে ।নেমে আসি ।
তবে সব ঘরই ত দেখলাম তালাবন্ধ।

সেদিন পূর্নিমা ।
কাজ কর়ছি আর পান করছি ।ভাবছি বাড়ির কথা,মৃত পরিজন ,মৃত সম্পর্কের কথা................

____" কেমন আছেন অনিমেষবাবু," চমকে তাকাই ।
মিশকালো কুকুরটা, সাধারন কুকুরের থেকে কয়েকগুণ বড়ো ।সামনে বসা ।নেশা টা বেশিই হয়ে গেছে ভাবলাম ।
___"আসলে কুকুর জীবনে আসার পর বিশেষ মানুষের সা়থে বাত্ চিত্ হয়ে ওঠেনা ,তাই ভাবলুম দুটো কতা বলি "।
না এবার আর কোনো ভুল নেই ।পরিস্কার বাংলা ভাষায় কথা বল়ছে ।চক্চক্ করছে ওর দেহ ।সামলে নিতে সময় লাগে ।এই পোড়া বাড়িতে একা বসে ,কয়েক ঢোক পান করে নি মনের জোড় বাড়াতে ।কাঁপা গলায় বলি
___" বলুন ।আপনার নামটা জানা হয়নি "
___" আমার নাম উমাপদ ভাণ্ডারী ।বাড়িটা আমারই ।কেয়ারি করা বাগান ।ঝক্ ঝক্ করত দরদালান ।ব্যবসাদার ছিলাম কিনা "
__"ও " আমি কলকাতার ছেলে স্মার্ট হবার চেষ্টা করি ।হুইস্কির এফেক্ট বোঝাই যাচ্ছে তারপর শূণ্য বাড়ি ,রাত।
আমি একবার চিন্তা করে নি উমাপদবাবুকে হুইস্কি অফার করব কিনা ।
___" আপনি খান অনিমেষবাবু,আমি  অন্য পানিয় খাই ।"
চমক। এ কি থটরিডিং জানে নাকি !
____"দুটি ছেলে বউ, ভরা সংসার ছিলো মশায়"
উমাপদ কিঞ্চিত উদাস। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা
"আপনি কুকুর হলেন কী করে " আপনা থেকেই প্রশ্ন আসে ।বলে ফেলে ভয় পাই। মানুষকে কুকুর বা কুকুরকে কুকুর.......বলা কি উচিত হলো !

কালো কুকুরটা যুত করে বসে। চোখ দুটো সবুজ আলো ঠিক্ রোয়।মাথা নীচু করে থাকে।প্রমাদ গুণি আমি।
"বলছি ভায়া। কেউ ত শোনে না। আসে না ।এলেও........
এর পর স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকি উমাপদর কাহিনী।
"সেসব অনেকদিন আগের কথা। আমার এ বাড়িটা সাহেব আমলে ঠাকুর্দা তৈরী করেছিলেন। আমি ব্যবসা করতুম আমদানি রফতানির ।এ গ্রামে আমিই সবচেয়ে ধনী প্রায় জমিদার ছিলাম।এমন নিঝুম ছিলোনা চারপাশ।
একবার ব্যবসার কাজে দিল্লী গেলাম দুদিনের জন্য । ফিরতে ফিরতে মাঝরাত
রাত হলো।ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা । দেখি বাড়ি শুনশান ।এখান ওখান রক্ত। কাপড়ের টুকড়ো ।টাকা পয়সা গয়না গাটি কিছু নেই ।দেহ গুলো পড়ে ।বউ।আরো সবার ।
ওপরের ঘরে আমার মেয়ের পচা লাশটা খাচ্ছে কালো একটা কুকুর ।
জানেন, ওদের মাটি চাপা দিলাম।
তারপর আর ঘর থেকে বেরোতাম না।
শুধু একটু খাবার কিনে আনতাম রাতের দিকে লোকের চোখ এড়িয়ে।
"পুলিশে জানান নি কেন?"আমি জানতে চাই।
" পাশের গাছটায় শকুনের বাস।হাড় গোড় ছাড়া আর কিছু নেই ।ওই পেয়ারা গাছের নীচে বাক্সে ৫০ লক্ষ আর গয়না লুকোনো আছে ।পুলিশ এলে নিয়ে নিত।যাই হোক ,
মাংস কিনে আনতাম সামান্য খাবার........
কুকুরটা রয়ে গেলো ।আমি আর সে ।শেষে আর মানুষের কাছে যেতে ইচ্ছে করতনা ।ওর সাথেই কথা বলতাম ।ফল পাতা খেতাম আর ইদুর বেড়াল ধরে কুকুরটাকে দিতাম ।
"পেয়ারা গাছের নীচে......" আমার মন দ্রুত কাজ করছে। উমাপতি জানলার দিকে তাকিয়ে........  বাইরে খস খস পাতা পড়ে
" দুজনে অনেক বছর কেটে গেলো ।ওর সাথে থাকতে থাকতে আমাকেও ওর মতোই যেন দেখতে হয়ে যাচ্ছিলো জানেন।এরকম হয়। ফ্রয়েড বলেছেন স্বামী স্ত্রী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে মিল হয়ে দেখতেও।ওই ওরকমই ছিলুম ত আমরা !
ফল পাতা ছেড়ে আমি়ও কাঁচা মাংস খেতে লাগলাম একসময় ।ঝামেলা নেই ।বেশ খেতে বু়ইলেন ।"
আমি কী বলব ভেবে পাইনা ।শরীর যেন বরফ। হুইস্কির বোতল প্রায় শেষ।
"খেলে একটু বেশি মাংসই ত লাগে দুজনের। তাইনা।
একদিন বুড়ো হয়ে মরেই গেল ব্যাটা।
নষ্ট না করে ওটাকেই কদিন খেলাম বুইলেন "
"আমি একদম ক্ষিদে সহ্য করতে পারিনা জানেন, এই এক দোষ আমার"
একটু অস্বস্তি হচ্ছে এবার ।
তারপর ়থেকে রোজ খুঁজে বেড়াই মাংস।
বাইরেটা হঠাত্ অন্ধকার। কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে চাঁদ ।হাওয়ায় লম্ফটা জ্বলছে নিবছে । দূরে বিদ্যুত চমকালো কি?
ভ়য় করছে যেন এবার।
ক্ষিদে পাচ্ছে.........
উমাপদ বলে চলেছে
__" আজ আর কাউকে পেলামনা ।ক্ষিদে পাচ্ছে খুব ।যদি কিছু মনে না করেন................বেশি লাগবেনা কিন্তু......"
অনিমেষ জ্ঞান হারায় ।কিন্তু তার আগে ভারি বোতলটা ভে়ঙে ঢুকিয়ে দেয় উমাপদর পেটে ।
সকালে চোখ খুলে ধরমর করে উঠে বসে অনিমেষ। বেরোতে হবে ।আয়নায়   চোখ পড়ে ।স্তব্ধ হয় অনিমেষ নিজেকে দেখে।

বড়ো কালো একটা কুকুর এখনো ঢোকে গেট খুলে ।মরা কুকুরটাও খেয়ে নিয়েছে সে । ক্ষিদে পায় আজকাল খুব। টিকারামের দেহ টা বেশ কিছুদিন খাওয়া গেছে।সুস্বাদু নর মাংস ।
অনিমেষ ভালো়ই আছে ।
তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
এখন অনিমেষ আর পুরোনো বাড়িটা প্রতিক্ষা করে নতুন আগন্তুকের
                  ____________