শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ম্যারিনা নাসরীন




পারফিউম

এক
পারফিউমের খুব পরিচিত ভীষণ মিষ্টি একটা গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে অনুভদ্র মহিলাকে প্রথম দেখল।ক্যাপসুল লিফটে ওর প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলপরনে সরু পাড়ের সস্তা ধরণের মাড়হীন তাঁতের শাড়ি। চেহারায় কোন বিশেষত্ব নেই তবে জী বাংলায় আসক্ত অন্য দশটা সাধারণ বাঙালী রমণীর মত সুখী সুখী মধুবালা ধরণেরও নয়নাট বল্টু দিয়ে জোড়া লাগানো ধাতব কাঠামোর ন্যায় ঋজু শরীর লিফটের গায়ে জ্বলে ওঠা নম্বর গুলির দিকে ক্লান্ত চোখ দুটি নিবদ্ধ করে রেখেছিল। ভদ্রমহিলা সাত তলায় নেমে গেলে পারফিউমের নামটি অনুর জানা হয়নি
দুদিন বাদেই বাংলা নববর্ষ। একটা দিন বাঙালী সাজার জন্য কয়েক মাস ধরে মানুষের প্রস্তুতি চলছে। বিপণী বিতানগুলি সুযোগ বুঝে তাদের পুরনো পসারে নতুন মূল্যের ট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছে
এমনিতে জিন্স-টিশার্ট, পাকিস্তানী লন, ভারতীয় মনিপুরী, বা পশ্চিমার আঁটসাঁট টপস-লেগিংসে অভ্যস্থ হলেও বাংলা নববর্ষে দেশীয় শাড়ি চুড়িতে একদিনের বাঙালী সাজা হালের ফ্যাশন।
আজ ছুটি বারআট তলা পর্যন্ত বিশাল মার্কেটে মানুষ গিজগিজ করছে বিশেষ করে লোকজ পোশাকে সমৃদ্ধ শোরুম গুলো নারী পুরুষে বোঝাই। অনু টাইডাইয়ের উপর সুতীর কাজ করা একটি শাড়ি দেখছিল।মুল্য ট্যাগ দেখে চোখ কপালে উঠল। কাজ ছাড়া টাঙ্গাইল শাড়িটার দাম বড় জোর আটশ টাকা হবে তাতে পাড় আর আঁচলে একটু সূচ ছুঁয়ে দাম হাঁকিয়েছে চার হাজার পাঁচশ।
অনুর অত বড় বাজেট নেই। অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে সে আড়াই হাজার টাকায় একটি শাড়ি কিনে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। লম্বা কিউ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। লিফটের সেই পারফিউমওয়ালি ভদ্র মহিলা অনুর ঠিক সামনে, হাতে  বাচ্চাদের বেশ অনেকগুলো পোশাকপারফিউমের গন্ধটা ওকে বিবশ করে ফেলছে।এত পরিচিত গন্ধ অথচ নাম মনে করতে পারছে না। নামটি জিজ্ঞেস করবে কিনা যখন সে ভাবছে, তখন ভদ্র মহিলা নিজেই ঘুরে তাকায়,
অনুপমা আমাকে চিনতে পেরেছ?
অনুর পুরো নাম অনুপমা নূর।তার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর কিন্তু এই চেহারা কোথাও কখনো দেখেছে বলে স্মরণ করতে পারছে না।
অনুর বিভ্রান্ত চেহারা দেখে ভদ্র মহিলার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে।
আমাকেই ভুলে গেলে ? মনে করে দেখ, যশোর বেগম রোকেয়া কলেজ হোস্টেল। রুম নম্বর ১০৫। মিলা,অনু, রিমা, রুবা  ছাড়াও আর একজন ছিল।
অনুর সামনে ঝুপ করে নব্বই দশকের দুটি বছর নেমে আসে। ওর মুখ থেকে সমস্ত রক্ত উধাও হয়ে গিয়েছে।
লুবনা ...!
দুই
সে সময়ে মেয়েদের কলেজ হিসেবে যশোর বেগম রোকেয়া কলেজের বেশ নাম ডাকদূর দূরান্ত থেকে মেয়েরা হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতে আসে লিখিত মৌখিকের বৈতরণী পেরিয়ে বহু আপ্লিক্যান্টকে পেছনে ফেলে তবেই ছাত্রী হোস্টেলে জায়গা পাওয়া গিয়েছিল।যেদিন অনু ছাত্রী নিবাসের ১০৫ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেছিল সেদিনই প্রথম লুবনার সাথে পরিচয় হয়। খাটের পাশে চেয়ারে অসহায় ভঙ্গীতে বসেছিলপায়ের কাছে বিশাল দুটি সুটকেস, আট ইঞ্চি পুরু ফোমের সাথে তোশক,ফ্লাস্ক,ইস্ত্রি, সহ রাজ্যের জিনিস!
রুমের আর তিনটি সিটে তখনো কেউ আসেনি। অনুপমা নিজের বিছানা টেবিল গুছিয়ে যখন খাটে বসে শুকনো বিস্কিট খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন হাই হিলের খটখট আওয়াজ তুলে মেয়েটি কাছে আসে।
তোমার নাম কি ?
অনুপমা। তোমার ?
লুবনা ফয়েজ চৌধুরী।আমাকে একটু হেল্প করবে প্লিজ ?
প্রথম পরিচয়েই হেল্প ? অনুপমা একটু অবাক হয়ে বলেছিল, কি করতে হবে বল ?
আমার সাথে জিনিসগুলি একটু গুছিয়ে দেবে ?
লুবনা সাধারণ মেয়েদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। তার উপর তিন ইঞ্চি খুরতোলা স্যান্ডেলেরকারণে আরও বেশি লম্বা লাগছে।এক কথায় চেহারা আর পোশাক পরিচ্ছদে রাজ নন্দিনী
দুজন মিলে বিছানা, সুটকেস ইত্যাদি গোছগাছ করার ফাঁকে দুজন দুজনের প্রোফাইল আদান প্রদান করে ফেলল। যশোরের সবচেয়ে নাম করা ডাক্তার ফয়েজ চৌধুরী লুবনার বাবা। এই শহরের মেয়ে হয়ে হোস্টেলে কেন এল সে প্রশ্ন মনে জাগলেও অনু কিছু জানতে চায়নি। 
পরদিন মিলা, রুবা এবং রিমা যার যার সিট দখল করে উঠলে ১০৫ নম্বর রুম স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। মেয়েদের মধ্যে খাতির হতে সময় লাগে না।খুব দ্রুততারাবাড়ি থেকে আনা লাড্ডুটা আচারটা ভাগাভাগি করে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল। কিন্তু লুবনা নিজেকে ওদের কাছে ঠিক বন্ধুভাবে মেলে ধরতে পারছিল না। নিজেকে একটু আলাদা করে গুটিয়ে রাখে। বাঁচিয়ে চলে।
নামের পাশে বাপের বিখ্যাত নামের তকমা, অর্থ, সৌন্দর্য সবদিক বিবেচনায় সে অন্যদের চেয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরের মানুষ।এই বিষয়ে অতি সচেতনতা তাকে হয়ত দূরে রেখেছিল। দেমাগী ভেবে অন্য মেয়েরাও আগ বাড়িয়ে তার সাথে ভাব করতে যায়নি
একদিন রাত বেশ গভীর । সবাই যার যার বিছানায় ঘুমাচ্ছে । কি কারণে যেন অনুর ঘুম ভেঙে গেল । তখন শুনল লুবনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে । কাছে গিয়ে আলতো করে গাঁয়ে হাত রেখে বলল,
কি হয়েছে লুবনা ?
মাকে মনে পড়ছে।
মায়ের কথা শুনে অনুর চোখ ছলছল করে। কতদিন হল মায়ের সাথে দেখা হয়নি। ও শান্তনা দিয়ে বলে,
আমাদের সকলের মাই তো দূরে তাই না ? ঘুমাও ।
লুবনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
আমার মা দুনিয়াতেই নেই !
অনু কিছু সময়ের জন্য বিমুঢ় হয়ে গিয়েছিল।মাত্র তিন মাস আগে ওর মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। বাবা সারাদিন চেম্বারে ব্যস্ত থাকেন।বাসায় একা মেয়েকে রাখার সাহস পাননি তাই হোস্টেলে পাঠিয়েছেন।
পরদিন থেকেই রুমে লুবনার অবস্থান বদলে গিয়েছিল। রুবা বা রিমা কেউই আর আড়ালে বলেনি দেমাগীবরং আগ বেড়ে ওর মনকে ছুঁতে চেয়েছিল বারবার। অনু হয়ে উঠল লুবনার আত্মার আত্মীয়।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে লুবনাকে নিতে ওর বাড়ি থেকে গাড়ী আসত।একবার লুবনা অনুকে প্রায় জোর করে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল ।
অনুর বাবা ধনী না হলেও বেশ সচ্ছলকিন্তু লুবনার বাড়িতে এসে যেটা দেখল সেটা সে শুধুমাত্র সিনেমাতে দেখেছে। ঢাকা-যশোর হাইওয়ের পাশ ঘেঁষে অত্যাধুনিক বাংলো টাইপের বিশাল বাড়ি। উঁচু লোহার গেটে সেকেলে রাজা বাদশাহর প্রাসাদরক্ষীর মত উর্দি পরা দারোয়ান। গেট থেকে ব্রিক সোলিং করা রাস্তার দুপাশে বাহারি ফুলের বাগান। মাঝে মাঝে ছোট ছোট লাইট পোস্ট। সিমেন্টের তৈরি ছাতার ছাউনির নীচে বসার চেয়ার।
অনু মুগ্ধ হয়ে এসব দেখতে দেখতে ওদের মূল বাংলোয় ঢোকে। নিচের তলায় বিশাল হলরুম। ঝাড় বাতি,রঙ বেরঙের ঝালরে বিদেশী স্টাইলে সাজানো হিম ঠাণ্ডা ঘর। একপাশের ঘুরানো সিঁড়ি দিয়ে ওরা দোতলায় লুবনার রুমে উঠে আসে। পুরো ঘর জুড়ে ভারী কার্পেট। ওয়ালে গোলাপি রঙের পেইন্টের মাঝে নীল নীল তারা জ্বলছে
লুবনা বলে,
দিসইজমাইহ্যাভেন, বন্ধু।
‘হ্যাভেন’- ইজহোয়াট! আইক্যান্টরিচ!
অনু স্বগতোক্তি করে
তখন রাত প্রায় দশটা।লুবনার খাটের স্প্রিংওয়ালা নরম গদির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে দু-বান্ধবী গল্প করছিল।  এমন সময় দরজায় নক হল,
আমার মা জননী কই ?
ভরা পুরুষ কণ্ঠে ঘর গমগম করছে।
বাপী এসেছে, অনু ওঠ।
বাপী তুমি এত দেরী করলে কেন ? তুমি জানতে না আজ আমি আসব ?
সরি মা, চেম্বারে প্রচুর রোগী ছিল। কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে এবারো ওয়েট লস করে এসেছ।
আহ বাবা! কি যে বলনা। লস কোথায় ? বল গেইন করেছি।আমার ওয়েট দুপাউন্ড বেড়েছে।
অনু একপাশে দাঁড়িয়ে বাবা মেয়ের সংলাপ শুনছিল।ভাবনায় ছিল লুবনার বাবাও অনুর প্রফেসর বাবার মত রাশভারী বয়স্ক, আপাদমস্তক ভদ্রলোক হবেন।যার পরনে স্যুট টাই থাকবে, মুখে পাইপ।কিন্তু ডাক্তার ফয়েজ চৌধুরীকে লুবনার বড় ভাই বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে পাকা মরিচ রঙের টি-শার্টে  যুবক যুবক লাগছে। মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা ঘন কালো চকচকে চুল সম্ভবত জেল লাগানো পৌরুষদীপ্ত চেহারায় যে ধরণের কাঠিন্য রয়েছে সেটা সুঠাম দেহের সাথে চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। 
বাবা, ও অনুপমা।আমার রুমমেট, বন্ধু।
লুবনা পরিচয় করিয়ে দিলে ডাক্তার ফয়েজ আহমেদ অনুর দিকে তাকালেন।অনু একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। চাপা রহস্যে বিচ্ছুরিত এই পুরুষ চোখে অন্যরকম কিছু আছে যেটার সাথে ওর আজ প্রথম পরিচয়।
অনুপমা! চমৎকার নাম। তোমার বন্ধু তো আফ্রোদিতির মত সুন্দর। গ্রিক দেবী আফ্রোদিতিকে চেন অনু ?
সবাই ওকে অনু ডাকে তবুও ফয়েজ চৌধুরীর মুখে নামটা শুনে শরীরে শিহরণ উঠল। কেন ? মুখে লাল আভা ।
আরে তুমি দেখি লজ্জা পেয়েছ হাহাহা! আচ্ছা তোমরা খাবার টেবিলে বস আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।
লুবনার বাবা সম্প্রতি একটি মেডিক্যাল কনফারেন্সে জার্মান থেকে ঘুরে এসেছেন। খাবার টেবিলে তিনি সেসব গল্প শুনাচ্ছিলেন। অনুর মনে হল এত সুন্দর ভাবে এত আকর্ষণীয় করে কেউ গল্প করতে পারে না। ও মোহাবিষ্ট হয়ে শুনছিল
প্লেটে মাংসের টুকরো তুলে দিতে গিয়ে অনুর হাতটিকে তিনি  অসাবধানতা বশত ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। তাতেই অনুর শরীর জুড়ে অভূতপূর্ব আনন্দ ঘণ্টি বেজে উঠল
কিন্তু আমেজটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না । অকস্মাৎ অনুতাপে মন ছেয়ে গিয়েছিলএ কি ভাবছে সে ? বন্ধুর বাবা তো তার বাবারই সমান ছি ছি ! পোলাও রোস্ট মাটির দলার মত গলায় আটকে যেতে থাকে। কিছুতেই ভেতরে ঢুকছে না। মাথা উঁচু করতেও পারছে না।পাছে ওর মনের ভাবনা গুলো সামনের দুজন জেনে ফেলে।
এই অনু খাচ্ছিস না কেন ?
এই তো খাচ্ছি
লুবনার কথায় মাথা গুঁজে কোনরকমে খাবারগুলো গিলে সে দ্রুত উঠে পড়ে।
সে রাতে অনু দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আঠারো বছর বয়সের মেয়ে হয়ে কিভাবে বাবার বয়সী একজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।লুবনার বাবাকে সে একবারের জন্য চাচা বা আঙ্কেল এড্রেস করেনি।নিজের উপর ঘৃণায় মন রিরি করছে।
পরদিন কাকডাকা ভোরে অনু লুবনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছিল,
আমি হোস্টেলে চলে যাচ্ছি। তুই পরে আসিস।
লুবনা চোখ খোলার আগেই ঘোর কাটা মাতালের মত প্রাসাদসম বাড়ি থেকে অনু বেরিয়ে এসেছিল

তিন
অনু চল কোথাও বসি।
লুবনার কথায় অনু বর্তমানে ফিরে আসে।
ফুড কোর্টে দুজনে দুটো চেয়ার দখল করে মুখোমুখি বসেছেএই লুবনাকে একসময় কত খুঁজেছে। আজ সামনে অথচ কোন প্রয়োজন নেই। অনুর ভেতরে ভাংচুর চলছে। সে বুঝতে পারছে না লুবনা আজ কোন পথে এগোবে।
কি খাবে ?
লুবনা নীরবতা ভাঙ্গে।
তোমার যেটা ইচ্ছা।
লুবনা স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়ে আসে।
এতদিন কোথায় ছিলে ? এবার অনুই লুবনাকে প্রশ্ন করে।
জেনে কি হবে ? বেঁচে যখন আছি তখন নিশ্চয় কোথাও ছিলাম।
সেদিন তো আমাকে কোন কৈফিয়ত দেবারই সুযোগ দাওনি।
আমি তো কৈফিয়ত চাইনি শুধু তোমাদের মাঝ থেকে সরে গিয়েছিলাম।
বিয়ে করেছ ?
তোমাদের দেখার পর বিয়ের প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া কিছু নেই।
এখনো এত ঘৃণা কর ?
হ্যাঁ।
তাহলে ডাকলে কেন ?
জানিনা, হঠাৎ দেখা হল সামলাতে পারিনি হয়ত।
বাচ্চাদের জন্য অনেক গুলো কাপড় কিনেছ দেখলাম।
অরফ্যানেজের বেবিদের জন্য
অরফ্যানেজে কাজ কর ?
হু।
বাবার কথা জানতে চাও না ?
এই প্রশ্নের জবাবে লুবনা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে অনুর দিকে তাকায়।
ওর দীঘল কালো চোখে টলটলে নীল সমুদ্র
অনুর বিবমিষা ভাব হয়। লুবনার সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র কীটের মত মনে হচ্ছে।
চার
সেদিন ভোরে লুবনার বাড়ি থেকে নেশা কেটে যাওয়া মাতালের মত ফিরে এসেছিল সত্য, কিন্তু অনুর মনের সেই রি রি করা ঘৃণা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পিতার বয়সী ভদ্রলোকটি কোন এক মাধ্যাকর্ষণ শক্তিবলে ওকে ক্রমাগত কাছে টানছিল সেই দুর্দমনীয় আকর্ষণকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা অনুর ছিল না। ফলে পরের সপ্তাহে সে আবার লুবনার সঙ্গী হয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল
অনুকে দেখে এবার ফয়েজ চৌধুরীর চোখের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হল।
গাঢ়করে নিচু স্বরে বলেছিল, শোন আফ্রোদিতি, আমার মনে হয়েছিল তুমি আজ আসবে। আমি খুব খুশি হয়েছি। থ্যাংকস।
একটুখানি নিচু স্বর, কিন্তু এ যে নিষিদ্ধ মধুবচন! অনু আমূল কেঁপে ওঠে।
সে রাতে লুবনা ঘুমিয়ে পড়লেও ওরা ঘুমায়নি।লিভিং স্পেসে টিভি দেখতে দেখতে দেশ বিদেশের নানা গল্পে ডুবে গিয়েছিল অনু বুঝতে পারছিল যাদুর অদৃশ্য জালে ও আটকে পড়েছে। ওর প্রজাপতি মন নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে অবিরাম ঘুরতে থাকে। সেখান থেকে বেরোবার কোন পথ তার জানা নেই।
হোস্টেল থেকে মেয়েদের বের হওয়া বেশ কঠিন ছিল । নিয়মের খুব কড়াকড়ি । কিন্তু নিয়ম যেখানে থাকে, সেখানে নিয়মের ফাঁক ও থাকে । অনু আরও অনেক মেয়ের মত দারোয়ান মামাকে হাত করে নিল । ফয়েজ চৌধুরীর চেম্বার আর বাসা হয়ে উঠল ওর তীর্থস্থান । 
ফয়েজ চৌধুরীর স্ত্রী গত হয়েছে বছর ঘুরেছে ইতোমধ্যে কিছু আত্মীয় শুভাকাঙ্ক্ষী কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার ভার কমাতে তাঁরদ্বারস্থ হয়েছিল কিন্তুএত বড় মেয়ে ঘরে রেখে বিয়ে? লোকে কি বলবে? অথচ অনু মেয়েটি এসে সব হিসেব উল্টে পাল্টে দিয়েছে। হাঁটুর সমান বয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজ কি বলবে সেটা এখন মামুলি। তাঁর চিন্তা একটাই, লুবনা অনুকে বাবার স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে তো?
আর অনু ? ফয়েজ চৌধুরীর বাংলোর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত দারোয়ান তাকে দেখে সসম্মানে সালাম করে বাড়ির ঝি দৌড়ে এসে জানতে চায় সে কি খাবে। নিজেকে রাণী মহলের মহারাণী ভাবতে শুরু করেছিল। এতবড় নামকরা একজন ডাক্তার শুধুমাত্র তার জন্য চেম্বার বাদ দিয়ে বাসায় অপেক্ষা করছে ভাবতেই এক অনির্বচনীয় সুখে শরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে যেত। একজন বালিকার প্রতি পরিণত পুরুষের যে প্রশ্রয় সেটা মায়ার মত ওকে অষ্টপ্রহর ঘিরে রেখেছিল।
সবকিছু ভালই চলছিল কিন্তু এক রবিবারে লুবনা বাড়ি থেকে ফিরে গম্ভীর মুখে ওকে প্রশ্ন করল,
একটা সত্যি কথা বল, তুই কি এর মধ্যে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি ?
কি বলিস এসব ? তোকে ছাড়া কেন যাব?
কিন্তু মালি কাকা বলল বাপীর সাথে তোকে দেখেছে।
ছি! ঐ বুড়ো পুরো মিথ্যেবাদী।তোদের বাসায় যাব আর তুই জানবি না ?
লুবনা কথা বাড়ায়নি।অনু ভেবেছিল লুবনাকে সে বিশ্বাস করাতে পেরেছেকিন্তু সে জানত না ইতোমধ্যে পুরো হোস্টেল জুড়ে তার নামে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে ওর শরীরে জমা বাড়তি মেদ, স্বপ্ন কাতর চোখ,উড়ু উড়ু মন সবকিছুর মধ্যে বড় রকমের পরিবর্তনের আভাস ছিল ।
অনুর অন্তঃকরণ এত বেশি মোহাবিষ্ট ছিল যে তার প্রতি মেয়েদের বাঁকা দৃষ্টি বা ছুটে আসা বক্রোক্তি সবকিছুই নজরের আওতামুক্ত থেকে যাচ্ছিল। আর এ জন্যই সবাই যখন ক্লাসে ব্যস্ত, সেই ভরদুপুরে অনু ফয়েজ চৌধুরীর বাংলোর দিকে রওনা হল
বেড রুমের ডিভানে তখন ও আর ফয়েজ চৌধুরী ভিসিআরে একটা রোম্যান্টিক ইংলিশ মুভি চলছে, কিন্তু সেদিকে কারো মনোযোগ নেই। টি টেবিলে টাটকা কমলার জুস সেভাবেই পড়ে রয়েছে।প্রেমিক পুরুষটি ওর চুলে নাক ডুবিয়ে প্যান্টিনের ঘ্রাণ নিচ্ছে আর অনু মনে মনে ভাবছে এখানে তার অমরাবতী এটিই দেবালয়।
আচমকাকোনএকটিশব্দেঅনুদেবালয়থেকেছিটকেমর্ত্যেএসেপড়ে।
দরজার সামনে লুবনা। ওর চোখেবিস্ফোরন ঘটার প্রস্তুতি।ফয়েজ চৌধুরী দ্রুত সামলে নিয়ে মেয়ের দিকে এগোয়,
লুবনা ! তুই কখন এলি মা ?
খবরদার আমাকে মা বলবে না ? ছি ! শেষ পর্যন্ত মেয়ের বয়সী মেয়ের সাথেই ?
লুবনা একটু শান্ত হও। আমার কথা শোন আমি তোমাকে সব খুলে বলছি। সময় হলে তোমাকে আমি সবকিছু জানাতাম।
অনু খুব অবাক হয়ে দেখল একজন দুর্দান্ত প্রেমিক কত দ্রুত অসহায় পিতায় পরিণত হয়েছে।
সেদিন লুবনা তার বাবার কোন কথাই শোনেনি দমদম করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গিয়েছিল লুবনার সাথে সেই শেষ দেখা, তারপর আজ আবার
পাঁচ
মুখোমুখি ভাষাহীন হলেও অন্তরে অন্তরে অবিরাম বাক বিতন্ডায় বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছেআশেপাশের টেবিল থেকে আনন্দ হাসির টুকরো টুকরো গল্পে ওদের প্রত্নতাত্ত্বিক সময়ে ছায়া ফেলতে পারছে না।
লুবনার হাত দুটি টেবিলে আলগোছে পড়ে ছিল অনু সে হাত স্পর্শ করে বলে,
তোমাকে কোথায় না খুঁজেছি। এতদিন কোথায় ছিলে? সত্যি বলবে না?
লুবনা হুট করে দাঁড়িয়েপড়ে। আমি যাচ্ছি । দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
সেই জিদ! সেই তাড়াহুড়ো !
আর একটু বস। একটা সত্য তোমার জানা দরকার।
কি সত্য ?
তোমার বাবাকে সত্যি আমি ভালবেসেছিলাম। বাবার বয়সী হলেও বেসেছিলাম। কেন সেটা আমি জানিনা। তোমার বাবাও আমাকে ভালবাসতেন, কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি নয়।
হুহ! এজন্যই তো মেয়েকে ভুলে তোমাকে বিয়ে করেছে তাই না ? এসব কথা বাদ দাও। আমি আমার মত যেমন আছি তেমন থাকব। আমি এখন লুবনা ফয়েজ চৌধুরী না আমি লুবনা ডী কস্তা। আমি যাচ্ছিতোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই
কার কাছে অভিযোগ করবে ? তোমার অভিযোগ শোনার মত কেউ নেই।
মানে ?
তুমি চলে আসার কিছুসময় পরেই তোমার বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা ওঠেসাথে সাথেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।মাত্র দুদিন ছিলেন।হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমি পাশে ছিলাম। তাঁর চোখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে চোখ শুধু তোমাকে খুঁজছে। কিন্তু যে নিজেই হারিয়ে যায় তাকে আমরা কোথায় পাব, বল?তন্ন তন্ন করে খুজেও তোমাকে কোথাও পাইনি!
লুবনার মুখ বিবর্ণ। ওর নাটবল্টু লাগানো ইস্পাতে গড়া শরীর টেবিলের উপর নুয়ে আসে।
কিন্তু অনু থামে না ।
তুমি যেমন তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য আমাকে দোষারোপ কর তেমনি তাঁর মৃত্যুর জন্য, আমার এই একাকী জীবনের জন্য আমি তোমাকে দোষী মনে করি। তোমার মাত্রাছাড়া জিদ তিনটা জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে ।
লুবনার দু চোখের কোল বেয়ে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছে অলকানন্দার স্রোত । এ কান্না বাবা হারানোর শোকে, নাকি অনুতাপে, সে হিসাব অনু করেনা। কোন সান্ত্বনাও দেয়না বরং উঠে লিফটে পা রাখে।
অত্যাধুনিক ক্যাপসুল লিফটটি সাঁসাঁ করে নীচের দিকে নামছেচারপাশে ভিড়ে ঠাসা মানুষের শরীরে মিশেল গন্ধ। কিন্তু সেসব অনুর ইন্দ্রিয়ে প্রভাব ফেলে না।লুবনার শরির থেকে আসা পারফিউম ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু ও কেন পুরুষদের এই পারফিউম ব্যবহার করে? বাবাকে জড়িয়ে রাখতে? হয়তবা।
অনু চোখ বন্ধ করে। ও অনেক গুলো নির্জন দুপুরের কাছে ফিরে যায়। অনেকগুলো সুবাসিত বুক পকেট ছুয়ে আসে। যেসব বুক পকেটের তুমুল ঘ্রাণ ওকেনেশাগ্রস্থকরত, বিবশকরেফেলতো।
সাত, ছয়, পাচ ছুয়েকখন যেন লিফটগ্রাউন্ড ফ্লোর স্পর্শ করেছে। সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর অনুওএকটি বর্ণহীন গন্ধহীন দুনিয়ার দিকে পা বাড়ায়।



প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন