বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

ভজন দত্ত



হামদের '' (ছো) 

বিশ্বায়ণের ধাক্কায় যখন সারা পৃথিবীর লোকসংস্কৃতি প্রায় বিপন্ন,বহুজাতিক কোম্পানীগুলি
  যখন বিজ্ঞাপনব্যয় কম করার জন্য পৃথিবীজুড়ে গড়ে তুলতে চাইছেন তাদের পছন্দমত একটাই সংস্কৃতি।  আরো নাফার ধান্দায় মগ্ন হয়ে গলা টিপে শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে, সেখানে একটি লোকসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, বেশ অবাক করার মতোই সংবাদ বই কি! প্রিয় পাঠক , একটু অনুধাবন করলেই জানতে পারবেন সত্যতা। হ্যাঁ,আমি 'ছো' করবো বলে কথটা বলছি না, ' ছো ' সম্পর্কে আমার জানা কিছু কথা লিখবো বলেই এমনতর অবতারণা। 

বরফি সিনেমাটা মনে আছে ! মনে আছে সেই বধির হিরোটিকে! ২০১২তে রিলিজ এই সিনেমাটিতে নানাভাবে ছৌ নৃত্য ও তার মুখোশকে
  ব্যবহার  করেছেন চিত্রপরিচালক অনুরাগ বসু! যা সিনেমাটোগ্রাফিতে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল।এর আগে ও পরবর্তীকালে আরো অনেক সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে এই নৃত্যশৈলী ও তার উপকরণকে। এই নাচ মানভূম সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 



বিখ্যাত "মুকাবিলা হো মুকাবিলা " গানের সঙ্গে প্রভুদেবার নাচটি মনে আছে! শুধু দুটি পা বা হাত বা মাথার ছন্দময় সেই আন্দোলনের কথা। " Chou Dance of Purulia " গ্রন্থে ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য এই নাচের অঙ্গ-সঞ্চালনাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। ১/ ছৌ নাচে সমস্ত শরীর স্থির রেখে মাথার মুকুটখানি নড়ানো - মস্তক সঞ্চালন ; ২/ সারা শরীর স্থির রেখে কাঁধটিকে শুধু নড়ানো। মাথা নড়বে না,শরীরের নীচের অংশটিও নড়বে না।শুধু কাঁধ দুটি নড়বে।এটি এই নাচের একটি গুরুত্বপূর্ণ
  মুদ্রা- কাঁধ সঞ্চালন; ৩/ গতিতে নাচতে নাচতে লাফিয়ে উঠে পা দুটি জোড় করে এক বা একাধিকবার তালে তালে বসে পড়া বা সামনে পিছনে চলা।এটি এই নাচের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ' উলফা' যা উল্লম্ফনের অপভ্রংশ রূপ। - উল্লম্ফন ; ৪/ সমস্ত শরীর স্থির রেখে শুধুমাত্র বক্ষদেশ নড়ানো। বাজনার তালে তালে চরিত্রের ঝলমলে পোষাকও নড়ে।- বক্ষ সঞ্চালন। ৫/ সানাই ও ঢোলের তালে তালে পদসঞ্চার বা পদক্ষেপ। এটি নানা রকম হয়। যেমন দেবতাদের চলা - দেবচাল,বীরের মত চলা - বীরচাল, রাক্ষসের মত চলা - রাক্ষসচাল বা পশুর মত চলা - পশুচাল প্রভৃতি।
এই চালগুলির মধ্যেও আবার নানা ভাগ আছে। যেমন - ডেগা,ফন্দি,উড়ামালট, উলফা,বাঁহি মলকা বা বাহু নড়ানো, মাটি দলখা।
সানাইয়ের সুর, ঢোলের সূক্ষ্ম তাল, মাত্রা ও কাড়া নাকড়ার আওয়াজে এই নাচের চরিত্ররা নূপুরধ্বনির সঙ্গে প্রয়োজন মত অঙ্গ সঞ্চালন করে থাকেন। অদ্ভূত নিয়ন্ত্রণ নূপুরের! তারা প্রয়োজন মতন নূপুরধ্বনি করে থাকেন। বর্তমানে ক্যাসিও,গীটার,ক্যাবাকাশ ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।


মানভূমের মানুষ এই নাচকে বলেন " ছো "। কেউ কেউ আবার বলেন " ছ"। ভারতে যেকটি নৃত্যের মধ্যে বীররস পাওয়া যায় তারমধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানটি এই ছৌ নৃত্য দাবি করে থাকে। পৌরুষদৃপ্ত এই নাচটির বাংলা, বিহার,ওড়িশা -- কোথায়
  উৎপত্তি তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য আজও বর্তমান।
বর্তমানে এই নৃত্যের যেসব ঘরাণা দেখা যায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১/ ঝাড়খন্ড-সেরাইকেলা, ২/ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ও চিলকিগড় ( ঝাড়গ্রামের কাছে), ৩/ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার।আবার ইন্দোনেশিয়া ও বালির ফ্রিশ ও বরং নৃত্যের সঙ্গেও এর সাদৃশ্য আছে।কেরালার কথাকলি নাচের সঙ্গেও কিছুটা মিল আছে। মাথায় মুকুট ও চিত্রিত মুখ যেন মুখোশকে মনে করায়। পুরুলিয়াতেও প্রথমে কথাকলি নাচের মত রং মেখে 'একুড়া ছো ' নাচা হত।পরে কাগজের আবরণ তার অনেক পরে এসেছে আজকের মুখোশ। মাটির ছাঁচে বিভিন্ন আকৃতির মুখ তৈরী করে তার উপর কাগজ,কাপড়,মাটির আস্তরণ দিয়ে ভেতরের অংশ বের করে কাগজ ও কাপড়ের অংশটি নিয়ে হালকা ও নৃত্যের উপযোগী মজবুত মুখোশটি তৈরী হয়। চরিত্র অনুযায়ী
  নানা রঙে রাঙিয়ে শিল্পীরা মুখোশগুলিকে জীবন্ত করে তোলেন । আবার নানান রকম পুঁতি,কাঠি, মালা, চুমকি, টিকলি,চুল, অলংকার,  ময়ূরপালক দিয়ে চারপাশে সাজানো হয় চরিত্র মতন।সাজ অনুযায়ী একেকটি মুখোশের ওজন ২০০- ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বেশ কয়েকটি গ্রামে মুখোশ তৈরী হলেও মুখোশ তৈরীতে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামটির খ্যাতি আন্তর্জাতিক। 

ছৌ নাচের মধ্যে সবদিক থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য, একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করে থাকেন।বর্তমানেও এই খ্যাতি অব্যাহত রয়েছে।
পুরুলিয়ার এই খ্যাতির পিছনে আছে ছৌ নৃত্যের মুখোশ ও পোষাক।কথায় আছে, " জমিদারও ভিকারি হয় ছো নাচে "। কারণ এই নৃত্যের জন্য ব্যবহৃত মুখোশ ও পোষাক নির্মাণব্যয় বেশ বেশী।

পুরুলিয়া জেলার মধ্যে বাগমুন্ডিতেই এই নাচের উৎপত্তি তা গবেষকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন।আর ছৌ নৃত্যের মহাগুরু হিসাবে যাঁর নাম সকলে একবাক্যে স্মরণ করেন তিনি হলেন গম্ভীর সিং মুড়া। জেলায় তাঁর পিতা চিপা সিং ও বাবুলাল মিস্ত্রিকে এই নাচের পথ প্রদর্শনকারী বলে মনে করা হয়।
পুরুলিয়া জেলার বাগমুন্ডি ছাড়াও ঝালদা, বলরামপুর,
  বরাবাজার, বান্দোয়ান, হুড়া, পুঞ্চাতেও এই নাচ দেখা যায়।তাদের নৃত্যশৈলীর মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্যও বিদ্যমান। তবে ছৌ বিশারদ যাঁরা, তাঁরা মনে করেন ঠাটে এবং ভাবে বাগমুন্ডি ও ঝালদার ছৌ অনবদ্য। 

(পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে)
 
চিত্রঋণ : উজ্জ্বল দাস


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন