এই সংখ্যার কবি মৌমিতা মিত্র।জন্ম ১৯৯৫ । কলেজ জীবনে কবিতার হাত ধরেছেন।একটা সমস্যার মুখোমুখি ছেলেবেলা থেকেই হতে হতো — তা হল সকলের সাথে মিশতে না পারা। অনেক কথা থাকতো যা হয়তো বলার প্রয়োজন মনে করতেন কিন্তু বলা হয়ে উঠতো না। অনেকটা নিজের জগতে গুটিয়ে থাকা এই কবি কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজের না বলা কথাগুলোকে তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি কবিতায় নিজেকে জানতে চেয়েছেন সবসময়।
সন্ধে নামলে
সন্ধের নিস্তব্ধতায় এক অচেনা সন্ধ্যার নিঃশব্দ চলাচল;
পোশাক বদলে মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা!
কত মানুষ ঘর চিনে ফিরে আসে নি।
একাকী ঘরের দরজাগুলোয় আঁচড়ের দাগ
যেন হিংস্রতায় গিলে নেবে সকলকে
আর আমরাও নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পা গুটিয়ে
বসে যাবো বিশাল হা মুখের ভেতর; চোখ বুজে।
সন্ধের অন্ধকারে কালো হতে থাকা গাছের পাতাগুলোয়
পিতৃসুলভ অস্থিরতা; নিষেধাজ্ঞা আর সতর্কবার্তা―
হাওয়ার বেগ বদল কিংবা দিক বদল হয়েছিল
একবার; দূরে কোথাও; তাপমাত্রার তারতম্যে
তারপর থেকেই আকাশে বরাবরের মতো কালচে নীল
অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় রাতজাগা পাখি আর হারানো শিশুদের গান
ঘরের সুচিন্তিত উষ্ণতায় ওরা আমন্ত্রিত নয় কারণ
তুমি আর আমি সময়কে নাকি বন্দি করেছি
*****************************
মেঘরঙা পাখি আর
কাশফুলের প্রেমের
পরিণতিহীনতার স্পন্দনে
নদীতীর মুখর।
জীর্ণ গাছের গল্পে
অপেক্ষার রঙ বদলে বদলে যায়।
*****************************
ঝরা পাতার গল্প
ভাতের দাগ মুছে গেছে অনেকদিন।
ফুটপাতে এখন শুধু
ঝরাপাতার গল্প।
তারা পরিচয় খুঁজে পায়নি কোথাও
তারা গাছের পাশে বেঁচে আছে।
*****************************
চশমা
একটা চশমা উল্টো করে রাখা।
একটা ছায়া বড়ো হতে হতে
কাঁচদুটো চোখ হয়ে গেল।
সমীকরণ সহজ দেখে সেদিন সবাই
হাত তুলেছিল; দ্রুত সংখ্যা বসিয়ে
অনেক প্রকার সমাধানও উঠে এসেছিল।
বাগানের বালতিতে জমা জলে
মুখ দেখতে দেখতে গড়িয়ে যাচ্ছি ---
দেখে সে পেছন থেকে চুল টেনে ধরে।
কুসংস্কারের মতো। রোজ।
অনেক সরলরেখা ভেঙেচুড়ে, বাঁকিয়ে
নাম লিখে দিয়েছে ওরা সবাই ----
সকালগুলো বেঁধে দেবে বলে।
তারপরেও শ্যাওলা ধরা জলে মুখ ভাসে।
সবুজ হয়ে আসে জলের আকাশ।
চশমাটা উল্টো হয়ে পাশে থেকে যায়।
*****************************
ঘর
ছেলেটি নতুন জামা পেলে কাঁদতো।
মেয়েটি কোনোদিন জানতে চায়নি
বাড়ির নাম কেন কুয়াশা।
ডালভাত গড়িয়ে যেতে যেতে
থালার একপাশে একটা মাছি।
তারা ঘর বাঁধবে নৌকার
আলোছায়া আশ্রয়ে।
গল্পটা এগোতে থাকে।
সব কথা পাড় হয়ে যায় নদী;
মাছিগুলো এখন শহরের সেই দীর্ঘ পথে,
ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
*****************************
আপোসের পথে
কিছু কিছু বিকেল আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।
অনেকদিন পর আজ ক্যারাম খেলবো
ভাঙা ভাঙা কথা, দূরের হলুদ আলো,
মাটির ভাঁড়, এলোমেলো আমি ---
সব ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পথ।
দিন-শেষের আলোয়
অচেনা রাস্তার কাছে এসে দাঁড়াই
নতুন গলিপথের সন্ধানে।
ভুলগুলোর সাথে আপোস করতে পা বাড়াই।
*****************************
ঘুণ ধরা গন্ধে
শেষ সারির মৃতদের একজন
চোখ খুলে সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছিল
তারপর থেকেই আকাশের রং লাল
সোনালি ফল হাতে দুটো শরীরপাশাপশি এলেই হিংস্র ডালপালা
চেঁচে নিতে থাকে সমস্ত শাঁস
বাইরের ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস আর
বন্ধ ঘরের সোঁদা ঘুণ ধরা গন্ধে
নতুন পৃথিবী একে একে হাত পা তৈরি করছে
ভূমিষ্ঠ শিশু গতকালের চির ধরা টুকরোগুলো
সঠিক শূন্যস্থানে বসিয়ে
গল্পকথা বুনবে আর ক'দিন পরেই
রাত্রিকালীন বৈদ্যুতিক তারাগুলো
গলে গলে নিভে এলে
দেবদূতের পুরোনো কেল্লার
শেষ জানলা বন্ধ হয়ে যাবে নিঃশব্দে
প্রতিটা টোলে একেকটা স্বপ্ন ফেরত চাইছে সময়
*****************************
যুদ্ধভাঙা একটা শহরে
একে অপরের চোখে লুকিয়ে পড়ে নিলে
ভাতের থালার গন্ধ ভুলে যায় উত্তাপ
ত্রুটি আড়াল করতে শক্ত হয়ে ওঠা
বুকের ঠিক মাঝখানটায়
নিথর তখন সব ভাবাবেগ
সদ্য যুদ্ধভাঙা শহরে একটিমাত্র স্তব্ধদিবস
আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছি বলে।
কোনো এক ভবিষ্যতের বৃদ্ধ
তেল-নুন মাখাতে মাখাতে হিসেব দেয় সংস্কারের
আর তুমি, আমি একটা দাঁড়ি পেরিয়ে এসে
চোখ বুজে থাকার অভিনয়ে নামি।
প্রতিবেশীরা এখনও জানে না
আমাদের মায়ের আয় স্বল্প, বাবার আয়ে
একটাও আঙুল খরচ হয় না
আর আমাদের বুকের মাঝখানে শক্ত একটা কুণ্ডলী
তাই খবর ছড়িয়ে পড়ার আগে
আমরাই চোখ বুজিয়ে দিই
যাতে বোঝানো যায় আমরা কিছু বুঝিনি।
*****************************
সোমবারের বিকেলে
বাবার সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি;
ক্যারামবোর্ডের পেছনে দুটো মাকড়শা
ওদের ঘরে চারদিকে হাওয়া;
লাল কালি দিয়ে পাতার ওপর
ভুল সংশোধন করতে করতে
জানলাগুলো আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি জানি ঘুটির আঘাতে
উল্টোদিকের ঘরগুলো ভেঙে যাবে না।
শুধু ওরা জানতে পারবে
দমবন্ধ একটা ঘরের হাওয়াই
ওদের ছাদখোলা ঘরের চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
ওরা জানতে পারবে আমি ছিলাম এখানে।
একাই ছিলাম আর ওদের লক্ষ্য করছিলাম।
অনেকদিন পর আজ কাউকে ছাড়াই
নীল স্ট্রাইকারে কালো-সাদা রঙ চলকে পরবে
অথবা জার্সির অদলবদল হবে।
*****************************
একটা ঘরের খোঁজে
কথা বলার সংখ্যায় গভীরতা বাড়লে
সরে সরে আসে সব রঙপাখিরা
ছোটোঘাসে ফুল হবার আগে হাত ছুঁয়ে করা
যত ভোরের প্রার্থনা সাবেকি গন্ধে মিশে আসে
ছায়ারা পরতে ভুলে গেছে
সংজ্ঞাহীন পরিযায়ী পাখি ভেঙে যেতে যেতে
পথ দেখালে চোখের সামনে সে পথ এগিয়ে নেয়
নাকি উপহারে আসে একটা মৃত্যু?
কথা বলা ফুরিয়ে এলে কথা অনেক হয়
তখন গালিচাপাতা সন্ধেগুলো উত্তাপ নিভিয়ে ঘুমিয়ে এলে
আমাদের ঘর একইরকম পরিচয়হীন
এক পৃথিবী মেঘে সীমাবদ্ধ এক দৃষ্টি।
*****************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন