মিতায়তন কবিতার ঐশ্বর্য
সন্মাত্রানন্দ
ধরা যাক, এমন একটা দৃষ্টি আমরা পেয়ে গেছি, যা দিয়ে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও প্রত্যক্ষ করা যায়। ধরা যাক, এই মুহূর্তেই আমরা অবলোকন করছি বহু মহাযুগ মন্বন্তর আগের প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর একটি দৃশ্য। কপার-কোবাল্ট-নিকেল প্রভৃতি বহু ধাতব উপাদানে সমৃদ্ধ রক্তবর্ণের সেই সৃষ্টি-ঊষার মৃত্তিকা, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক এক অতিকায় প্রাণী ডাইনোসোর উত্তপ্ত আদিম সূর্যের বিপরীতে। বিশাল তার ছায়া মাটির উপর, উষ্ণ সলিলে পরিপূর্ণ এক বিপুলবেগাপন্না নদীর জলতলের উপর, নদীর পরপারে প্রাগৈতিহাসিক সবুজ বনস্পতির উপর, এইভাবে যোজন যোজন সেই মহাকায় প্রাণীর বিশাল প্রচ্ছায়া প্রলম্বিত হতে হতে দিগন্তকে যেন স্পর্শ করে আছে। আর দিক্চক্ররেখায় অবস্থিত ভীমাকার রুক্ষ শ্যামলিমাবর্জিত এক পর্বতের গায়ে এসে পড়েছে ডাইনোসোরটির ছায়া, সূর্যের নির্মম আলো ওই ছায়াকে নিয়ে খেলা করছে। পর্বতের সানুদেশে কী একপ্রকারের আদিম কীট খাদ্যকণার অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে দুয়েকপা হেঁটে যাবে ঠিক করেছে, এমন সময় কীটের অক্ষিপটে এসে পড়ল ডাইনোসোরের প্রতিবিম্ব। বিরাট প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটি কীটের চোখের মণিতে বিন্দুবৎ প্রতিবিম্ব ফেলেছে –সুদূর কালের সেই দৃশ্য যদি আমরা দেখতে সমর্থও হই, তবে এটুকুই আমরা শুধু দেখব, আর কিছু নয়। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কীট এই শুধু দেখবে না। বিরাটকায় প্রাণীটি যত ক্ষুদ্র প্রচ্ছায়াই ফেলুক না তার চোখে, ওই মিনিয়েচার প্রতিবিম্বের মধ্য দিয়েই কীটের প্রতীতি হবে যে, সে সেই ডাইনোসোরের বিরাট আকারটিকেই সম্পূর্ণত দেখছে। তার চেতনায় জেগে উঠবে ভয়, বিস্ময় ও দুর্বোধ্যতার অনুভূতি।
বিরাট ভাব যখন মিতায়তন ছোট কোনও কবিতায় প্রকাশ করেন সমর্থ কোনও কবি, তখন আন্তরিক পাঠকের মনে কবিতাটির মিতায়তনের মধ্য দিয়ে বিরাট এক ভাবরূপের বিস্তার এমনভাবেই জেগে উঠতে পারে। ছোট একটি কবিতা যে বিরাট ব্যাপ্তিকে ধরে রাখে তার আঁটসাঁট ঘনপিনদ্ধ অবয়বের ভিতর, তার সঙ্গে কীটের অক্ষিপটে এসে পড়া বিরাট প্রাণীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিবিম্বের তুলনা করা চলে।
ন্যায়শাস্ত্রে বলা হয়, ‘উপমা একদেশী’। অর্থাৎ উপমা সর্বাংশে হয় না, একদিক দিয়েই হয়। ‘বাঘের মত মুখ’– বললে মুখটা হাঁড়িপানা কিছু একটা বোঝায় না, মুখটা ভয়ংকর –এটুকুই শুধু বোঝায়। উপরের অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত উপমায় ডাইনোসোরটাকে যে দাঁড় করিয়েছি কীটের থেকে যোজন যোজন দূরে, তার থেকে কেউ যেন এমন না বোঝেন যে, আমি ছোট কবিতার কবিকে দাঁড় করাতে চাইছি সাম্প্রতিক কোনও পাঠকের থেকে কালগত দূরত্বে। এই দূরত্ব কালগত নয়, ভাবগত বা আরও পরিষ্কার করে বললে চেতনাগত। কবিতার উৎসমুখটি আমাদের পথচলতি চেতনার থেকে বহু দূরে, তবু সুদূর হলেও আমাদেরই লৌকিক চেতনায় তার ছায়া পড়ে, আমাদেরই জৈবনিক প্রসঙ্গকে আশ্রয় করে আমাদেরই তা টেনে নিয়ে যায় গহনাতীত গহনে, নিশিডাক দিয়ে প্রেত যেমন করে টেনে নিয়ে যায় ঘুমন্ত ব্যক্তিকে নদীর ভরাজলে। আকারে ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যে মহৎ, ছোট মিতায়তন কবিতার এই আবিশ্ব বিস্তার মুগ্ধ করে আমাদের, অনেক বন্ধ জানালা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
ছোট কবিতার, বিশেষত অণু-কবিতার আদর্শটি এসেছে জাপানি ‘হাইকু’র থেকে এমন একটা ধারণা অনেকে পোষণ করেন। এই ধারণা একেবারে ভ্রান্ত। মুখ্যত রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপান-ভ্রমণের অবসরে হাতপাখায়, রুমালে বা কাগজে দস্তখৎ দিতে গিয়ে ছোট ছোট কবিতা লিখেছিলেন, ‘স্ফুলিঙ্গ’ বা ‘কণিকা’য় যা সংকলিত হয়, সেই ঘটনার থেকেই এমন অলীক ধারণার জন্ম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুধু জাপানেই নয়, ভারতবর্ষেও ছিল ছোট কবিতার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। উর্দু শায়েরি কিংবা তামিল ভাষায় প্রণীত তিরুক্কুরালই শুধু নয়, প্রাকৃত ভাষায় প্রণীত কবি হালের ‘গাথাসপ্তশতী’ই কেবল নয়, সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত সুভাষিত-ভাণ্ডার, উদ্ভট শ্লোক ও খণ্ডকাব্যসমূহে অণুকবিতার বিস্ময়কর ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এসব কবিতার সমস্যা হল, এগুলোতে নীতিবচন বা দার্শনিক সিদ্ধান্তের প্রাচুর্য এদের সত্যিকারের কবিতা হয়ে উঠতে বাধা দিয়ে এসেছে, বিশুদ্ধ কবিতার রস এতে ক্ষুণ্ণ হয়। তবু তার মধ্যেও অস্তিত্বে অন্তর্লীন বেদনার নিরাশাকরোজ্জ্বলতা কোনও কোনও কবির দীর্ঘশ্বাসে স্মৃতিধার্য হয়ে আছে। যেমন ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতকে —
রম্যাশ্চন্দ্রমরীচয়স্তৃণবতী রম্যা বনান্তস্থলী
রম্যং সাধুসমাগমাগতসুখং কাব্যেষু রম্যাঃ কথাঃ।
কোপোপাহিতবাষ্পবিন্দুতরলং রম্যং প্রিয়ায়া মুখং
সর্বং রম্যমনিত্যতামুপগতে চিত্তে ন কিঞ্চিৎ পুনঃ।।
-জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভাসা রাত্রিগুলি রমণীয়, রমণীয় শ্যামপত্রী বন,
অরণ্যের প্রান্তদেশে মুথাঘাসে ঢাকা মাঠ স্নিগ্ধ করে আমাদের মন।
অনুভবী ভাবুকের প্রিয়সঙ্গ রসালাপ, রম্যসুখ কবিতা কথায়,
অশ্রুর শিশিরে ধোওয়া প্রিয়ার আনত মুখ, অভিমান চোখের পাতায়।
সুরম্য সমস্ত, তবু মদিরতা এরা সব আনেনা আমার চোখে আর,
রূপ, রঙ, অনুরাগ জ্বলে উঠে নিভে যায়, জানি আমি –সকলই অসার।
(অনুবাদ প্রাবন্ধিককৃত)
এখানে অন্তিম উচ্চারণে যে-দার্শনিক চেতনার প্রতিভাস ফুটে উঠেছে, তা প্রাক্প্রকল্পিত ছিল না। তা এসেছে আন্তরিক কবিতার ছায়াসরণি বেয়ে একান্ত অনর্গল উৎসারে।
আমি অবশ্য মিতায়তন কবিতা বলতে এখানে অণুকবিতাকেই বোঝাচ্ছি না। আট দশ লাইনে যেসব কবিতারা পূর্ণতা পেয়ে যায়, সরল বাগ্ভঙ্গিমায় কিংবা ঈষৎ অলংকৃত কারুকাজের ভিতর এক সুগভীর অনুভূতিকে তুলে ধরে সহসা চমৎকৃতি বা আচ্ছন্ন মধুর মেদুরতায় যা পাঠকের মনকে উজ্জ্বল বা মজ্জিত করে, সেই সব রচনার মূল করণকৌশল হচ্ছে তার অপার্থিব সংযম। তির্যক, সূত্রাকার, সাংকেতিক হয়ে ওঠে তাদের জাদু উচ্চারণ, এ ব্যাসকূট ভাঙবার জন্য মিতায়তন কবিতারা তাদের প্রেমিকদের চোখে চোখে ইঙ্গিত করে। পড়তে পড়তে তলিয়ে যাই এই কটাক্ষের পেছনে শিরা উপশিরার সংস্থানের কথা ভেবে, শিহরিত হই চাবুক শব্দে। আমরা বুঝতে পারি আরেকটি অসম্ভব ভাল লাগা কবিতা আমাকে ডাকছে।
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে। (কমলালেবু/জীবনানন্দ দাশ)
‘শীতের রাত’, ‘হিম কমলালেবুর করুণ মাংস’, ‘মুমূর্ষু’ –এই সব শব্দের অনুষঙ্গে জড়িয়ে আছে এক নিঃসহায় আর্তি। অথচ সেই আর্তির আয়োজনের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠছে নিঃসহায়তার বিপরীত এক বলিষ্ঠতা, এক সুগভীর জীবনানুগ প্রত্যয়। সেই ইতিবাচক প্রত্যয় দেহ থেকে বার হয়ে যাবার পর ফিরে আসার আকুতিময় জন্মান্তরবাদকেন্দ্রিক কোনও মরমী ভাবনার উপর ভর করেনি, মুমূর্ষুকে সেবা করার সরব মতবাদকেও আশ্রয় করেনি, যদিও ওই সব চিন্তা এ কবিতার অবয়ব থেকে ঝরে যাচ্ছে না। এ কবিতা প্রকৃতপক্ষে প্রেমেরই কবিতা, ‘মুমূর্ষু’র আগে ‘পরিচিত’ বিশেষণটি প্রেমের সংবেদনাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। তবু এই প্রেম আমাদের কালসীমিত ভালবাসা নয়, মৃত্যূত্তীর্ণ এক অনিবার্য মহত্ব প্রেমকে এখানে করেছে সুগম্ভীর আয়তনবান। সমস্ত কবিতাটি পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শব্দগুলি পরিচিত, আবহটি পরিচিত, মুমূর্ষুও পরিচিত, কিন্তু পরিচিত পৃথিবীর অনুষঙ্গে অপরিচিত এক ইতিবাচকতার ইশারা, শান্ত কন্ঠে সত্য উচ্চারণের নির্মেদ ঋজুতা, এ কবিতাকে অনন্য করেছে। অসুস্থতার ছায়ান্ধকার পরিসরের ভিতর পরম স্বস্থতা এখানে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। মিতায়তন কবিতাটি অনর্গল মনের ভিতর ঢুকে স্মৃতিতে বাসা বাঁধে, ফিরে ফিরে আসে জীবনের কঠিন ও সহজ মুহূর্তগুলোতে, কত কম আয়াসে, কত কম শব্দে বিরাটত্বের দ্যোতনাকে চিরায়মান করে তোলা যায় –এ কবিতা তারই সমর্থ দৃষ্টান্তস্থল।
মৃত্যূত্তর এই বিশ্বাসের কাছে যিনি যাবেন না, যাঁর সমস্ত প্রত্যয় এই জীবনের মধ্যেই সমর্পিত, যিনি ক্ষণিকার এই রাত্রি বা এই মুহূর্তটির আয়ুহীনতার বিলাপ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারেন না, জীবনে অঙ্গীকৃত, জীবনাতীত সত্যে অনঙ্গীকৃত কোনো কবি হয়ত বলতে পারেনঃ
‘ভুলিবো না’ -এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রীমায়া মিলাক, মিলাক
তৃণেপত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলেস্থলে,আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে তুমি ছিলে,তবু তুমি ছিলে। (কোনো মৃতার প্রতি / বুদ্ধদেব বসু)
তবু নিভৃত আলোটি হৃদয়ে জ্বালাতে ভুল হয় না তাঁরও। মৃতার মুখশ্রীমায়া পৃথিবীর তৃণে পত্রে ঋতুরঙ্গে জলেস্থলে আকাশের নীলে ব্যপ্ত দেখতে চান তিনিও। ‘তুমি ছিলে’ এই স্মৃতিপথোদ্ভাসিত বেদনাটি সুগভীর প্রত্যয়ের জায়গা নেয় এখানে।‘ভুলিবো না’ বলতে না চেয়েও ভুলতে পারেন না কবি। বিলাপের অতীত, স্থির ধৃতিমান অনাড়ম্বর আয়োজনের ভিতর এক মহান সুরস্রষ্টার বিষাদমধুর আলাপ মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে তোলে আমাদের মন। এ কবিতায় সংকেত কম, নির্বেদ বেশী। জীবন ও মৃত্যুর অবাধিত সমীকরণ একেবারে অন্যরকমভাবে মিতলেখ কবিতার আশ্রয়ে পরাক্রান্ত বোধের কাছে ঋণী করে তোলে আমাদের।
কিন্তু শুধু জীবন ও জীবনান্তের সমীকরণ নয়, আশ্রয় ও গম্যতার সমীভবন ছোট কবিতার পরিসরে যদি আত্মস্থ করতে চাই, তবে এ কবিতাটির কাছে লঘুপায়ে হেঁটে যেতে হয়ঃ
তুমিই মালিনী,তুমিই তো ফুল জানি ।
ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে,মালিনী,
বাতাসে গন্ধ,উৎস কি ফুলদানি,
নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?
দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নি
কালের বাগানে থামেনিকো আসা যাওয়া।
ত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,
একটি প্রহর ফুলহার দাও খুলে,
কালের মালিনী ! তোমাকেই ফুল জানি,
তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী,
তোমাকেই রাখী বেঁধে দিই করমূলে
অতীত থাকুক আগামীর সন্ধানী –
তাই দেখে ঐ কাল হাসে দুলে দুলে। (তুমিই মালিনী / বিষ্ণু দে)
বুদ্ধদেবের কবিতার মত স্মৃতির ধূপ জ্বালতে চান না বিষ্ণু দে। যে-সৌন্দর্য তাঁর গম্যভূমি, আর যে-আশ্রয়ে তিনি সেই গন্তব্যে পৌঁছুতে চান, এ দুয়ের সমীভবন, মুহূর্তের কেশগুচ্ছে ত্রিকালকে বেঁধে রাখার প্রয়াস এ কবিতাকে অনন্যতা দিয়েছে। পড়তে পড়তে দোলায়িত হতে হতে হঠাৎই অসম্ভব সচেতন হয়ে উঠি আমরা এই অনুভবে যে, ওই মালিনীই তো মুহূর্তের শরীর। অতীত মৃত, আগামী অজাত, এই মুহূর্তটিই তো চিরন্তন –দ্য ইটারনাল নাউ – ‘ক্ষণশাশ্বতী’। তাই ‘তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী’। কালের মালিনীর মাথার একটি ফুলহার, একটি অভিনিবিষ্ট প্রহরই তো সেই কালোত্তীর্ণ বাণীর কথা বলে। যাকে বলে সে সেই কথা, অথবা যিনি সেই কথা শুনতে পান, তাঁরই তো চিরবন্ধুতা মালিনীর সঙ্গে, মুহূর্তের মণিবন্ধে রাখী বেঁধে সমস্ত মজ্জমানতা থেকে ঘুম ভেঙে তিনিই জেগে উঠতে পারেন। এ কবিতা হতেই পারত কোনও জেন বৌদ্ধমঠে পঠিত একটি ‘কোয়ান’, মৌহূর্তিক এই কবিতায় বৃহতী প্রমার আভাষ সুপ্তোত্থিত করে তার পাঠককে সংশয়ের ঊর্ধ্বে।
সিদ্ধান্তের এই ভার, দর্শনচিন্তার এই চালচিত্র কবিতাকে সার্থক হতে দেয় না অনেক সময়ই। কবিতা বিশুদ্ধ অনুভূতির ব্যাপার। অনেক আঁঠা দিয়ে ঘুড়ির কাগজ চেটালে, সেই ঘুড়ি যেমন করে গোত্তা খেয়ে পড়ে যায় আকাশ থেকে, উড়তে পারে না বাতাস কেটে অবলীলায়, তেমনই কোনও কবিতা যখন তার অবয়বে লুকিয়ে ফেলতে পারে না বক্তব্যের মেদ, তখন ভাবনার আকাশে উড্ডীন হতে পারে না আর হংসবলাকার মতো। আমাদের অনিশ্চিত জীবন, অপেক্ষার প্রহর, সংশয়ের কম্পনকে কোনও দার্শনিকতার আধারে আধৃত যদি না করে তাকে মুক্তি দিতে পারা যায় কোনও কবিতায়, তবেই নির্মিত হতে পারে সার্থক কবিতার প্রমা। ছোট কবিতার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ তার গঠন, চলন ও বিভঙ্গ সংহতিকেই দাবি করে, বিস্তৃতিকে নয়। এই সংহতি দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে দর্শনচিন্তা এগিয়ে এলে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস সকলের আয়ত্তাধীন নয়। কবিকে বুঝতে হয়, দর্শন নয়, বক্তব্য নয়, সংশয় ও অনিশ্চয়তা দিয়েই হবে তার বাক্নির্মিতি। অশান্তি ও দ্বিধার অগ্নিপরিধির মধ্যেই তাঁকে নিয়ে যেতে হবে কবিতার পাঠককে। অপৃথুল কোনও কোনও কবিতার অবয়বে সেই সংশয়কে বৃহজ্জাতক করে তুলতে পারেন কেউ কেউঃ
রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায় ।
তুমি এখনো এলে না ।
সন্ধ্যা নেমে এলো পশ্চিমের করুণ আকাশেঃ
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর ধ্বনি। (বিরহ/সমর সেন)
এ কবিতা পোড়ায় আমাদের, এভাবে দগ্ধ হবার জন্যই তো শিল্প, এভাবে অনুমৃত হওয়ার মধ্যেই কবিতার পুনরুত্থান। ছোট কবিতার মধ্যে এই দহনের স্বাহা-কার ও স্বধা-কার যত ঋজু অথচ অস্ফুট উচ্চারণে ফুটিয়ে তুলতে পারা যায়, ততই তা স্মৃতিধার্য হয়ে ওঠে। শব্দের আলপনা নয়, পড়তে পড়তে বুঝি একটি সার্থক কৃশতনু কবিতা প্রকৃতই কৃশানু, সে আগুনে ইন্ধন হিসেবে জ্বলে উঠেছে কবির রুধিরাক্ত হৃদয়, গান ও প্রাণ যুগপৎ বিনিঃসৃত হয়ে গেলেও, জীবনের ওষ্ঠাধর থেকে মুছে যায়নি আরক্ত হাস্যরেখা।
সেই যে এক বাউল ছিল সঙক্রান্তির মেলায়
গানের তোড়ে দম বাধলো গলায়
হারানো তার গানের পিছে হারালো তার প্রাণ,
আহা,ভুলে গেলাম কি যেন তার গান!
প্রাণ দিয়েছে দেয়নি তার হাসি
গানের মতো প্রাণ ছেড়েছে খাঁচা।
সেই যে তার মরণাহত হাসি
ঝর্ণা,জানো,তারই নাম তো বাঁচা। (ঝর্ণা-কে/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
সংশয়ের বাতাবরণের ভিতর প্রত্যয়ের কোনও ঊর্ধ্বমুখ শিখাই খোঁজেন কবি, কিন্তু নিরীক্ষাবিহীন মতান্ধতার সঙ্গে তিনি অসহযোগী। মুঘল যুগের এক মরমী সাধক সারমাদ, দারাশিকোর বন্ধু, যিনি ইসলামের ধ্রুববাক্য (লা ইল্লাহা ইল্লাল্লাহা –আল্লা ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই)-এর অর্ধাংশ মাত্র উচ্চারণ করে বলতেন, লা ইল্লাহা, যার অর্থ দাঁড়াত, ঈশ্বর নেই। এমন বলার কারণ কী, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর আছেন কিনা আমি তা এখনও সম্যক জানি না যে। এই অপরাধে মতান্ধরা যখন মীনাবাজারে তাঁর গলা কেটে ফেলল, তখন মরণাহত হাসি জেগে উঠেছিল সেই ফকিরের ওষ্ঠে। উপরের কবিতার বাউলের মরণাহত হাসির সঙ্গে কোথায় যেন মিশে যায় সারমাদের হাসি, যে-হাসি আত্মপ্রত্যয়ের, সংশয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত থাকার দৃঢ়তার ও সততার। প্রত্যয়ের এই কেন্দ্র খুঁজতে গিয়ে কোনও কবি হয়ত হেঁটে যেতে পারেন তাঁর একতম প্রেমের কাছে, লিখতে পারেন, ‘আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই/ আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই/ কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই/তুমি আছো, তুমি’ (তুমি/শঙ্খ ঘোষ) অথবা এই প্রত্যয় একই কবির ক্ষেত্রে আসতে পারে অসমাকৃতিক কোনও উৎস থেকে। আমি যা, আমি যতটুকু, ততটুকুও হয়ে উঠতে পারি না পরিপার্শ্বের চাপে, আমাকে কেবলই বলা হয় এ বিশ্বসংসারে ছোট হয়ে যেতে, সরু হয়ে যেতে। এই না হয়ে উঠতে পারার, এই অবদমিত হবার যন্ত্রণাও হতে পারে সেই প্রত্যয়, নিতান্ত অসম্ভব মনে হলেও। শুধু কবি নন, মিতায়তন কবিতাটিই যেন পূর্ণরূপ না পাওয়ার বেদনা জানাচ্ছে এখানেঃ
‘ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘সরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না?
‘সরু হয়ে যান,ছোট হয়ে যান -'
আরো কত ছোট হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে !
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে,বাজারে,আড়ালে? (ভিড়/শঙ্খ ঘোষ)
কবি ও কবিতার একাত্মতা এত অমোঘ হয়ে উঠতে পেরেছে মিতবাচনিক পরিসরে, ছোট কবিতার সঙ্গে বোধ করি কবির একাত্মতা দীর্ঘ কবিতার তুলনায় অধিকতর সম্ভব, কারণ কবি তাঁর চেতনার রশ্মিগুলিকে ছোট কবিতার আতসকাচের ভিতর সংহত, নিবিষ্ট, কেন্দ্রিত করে তোলার প্রয়াস পান, যার অনিবার্য ফল উত্তাপ, আলোক ও দহনজ্বালা। সেই অর্থে ছোট কবিতাই হয়ে উঠতে পারে কবির প্রকৃত আত্মজীবনী। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাপুঞ্জের ভারে অবনত না হয়ে নৈর্ব্যক্তিক নির্মেদ আয়ত্ত হয়ে উঠতে পারে এমন কবিতায়। একটা গোটা জীবনকে কয়েক পংক্তির মধ্যে ধরে দিয়ে প্রায় এপিটাফ রচিত হতে পারে তন্বঙ্গী কবিতায়, যা কোনও সুবৃহৎ উপন্যাসেও ধার্য নয়ঃ
কিছুকাল সুখভোগ করে, হলো মানুষের মত
মৃত্যু ওর, কবি ছিল, লোকটা কাঙালও ছিল খুব।
মারা গেলে মহোৎসব করেছিলো প্রকাশকগণ
কেন না, লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে, বিরক্ত করবে না
সন্ধেবেলা সেজেগুজে এসে বলবে না, টাকা দাও
নতুবা ভাঙচুর হবে, ধ্বংস হবে মহাফেজখানা
চটজলদি টাকা দাও –নয়ত আগুন দেবো ঘরে।
অথচ আগুনেই পুড়ে গেলো লোকটা, কবি ও কাঙাল ! (কবি ও কাঙাল/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এই যে পরিমিতি, সংহতি ও গভীরতার প্রসঙ্গ উঠে আসে ছোট কবিতার আলোচনায়, সেই অনুষঙ্গে একটি প্রশ্ন স্বভাবতই উত্থাপিত হতে পারে। সে প্রশ্ন লাবণ্যবিষয়ে। মিতাকৃতি কবিতায় বিরাট ভাব আধৃত হতে পারে, কিন্তু অল্প কথার ফুলে ভরা কবিতার শাখায় লাবণ্যের পুষ্পসম্ভার আনা যেতে পারে কি? এক্ষেত্রেও, ‘যে পারে সে আপনি পারে’। বস্তুত, লাবণ্যের জন্য দীর্ঘ শব্দের করিডোর পেরিয়ে আসতে হবেই, এমন নয়। দীর্ঘ করিডোরের ভিতর এক বিশ্রান্ত নীলিমার নির্লিপ্তি আছে, সুদীর্ঘ কবিতায় তা সহজপ্রাপ্য। লাবণ্য কি ফোটে না মায়ের আটপৌরে খেতে আসার ডাকের ভিতর? হারিয়ে যাওয়া গোবৎসের গলার মৃদু মৃদু ঘন্টার শব্দে? অল্প শব্দে লাবণ্য ধরা আছে পূর্বোৎকলিত কবিতাগুলির ভিতর। তবু অলংকৃত লাবণ্যের নিদর্শন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নিম্নোদ্ধৃত কবিতাটিতে যেমন পেয়েছি, তা নিশ্চয়ই পৃথক উল্লেখ দাবি করতে পারে।
তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা হবে নমিতা নদী!
গোধূলি হলো।
তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে
মুখোশ খুলে দেবে বিভোরবিভা
অহংকার ভুলে অরুন্ধতী
বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে।
রাত্রি হলো।
এ কবিতায় সর্বোপরি নির্জনতা যেন থমথম করছে। সময় প্রাকারের গায়ে কে যেন সূচ দিয়ে এক নিগূঢ় কোটর বা পীপ-হোল তৈরী করছে, যত খুঁড়ছে, আবার ততই বুজে আসছে। সেই পীপ হোলে চোখ রেখে কখনও ঝকঝকে স্পষ্ট, কখনও আবছামতো দেখা যাচ্ছে ওদিকের দৃশ্যপট, সেখানে গোধূলি নামছে, নামছে রাত্রি; তোমার প্রতিশ্রুত সেই মুহূর্তগুলি এসে পড়বে এইবার? এই উৎকণ্ঠার মধ্যে যে এক নিষ্পলক প্রতীক্ষা আছে, এ কবিতা সেই মুহূর্ত-উন্মোচী। ছোট কবিতার মত ছোট গল্পেও এই বিশেষ মুহূর্তের দিকেই যাত্রা, সেই অভিগমনের দিক দিয়ে ছোট কবিতা ছোট গল্পেরও সমীপবর্তী হয়। তবু ছোট কবিতার মাল্টি ডাইমেনশন হয়ত ছোটগল্পের থেকে তাকে আলাদা করে দেয়। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ধ্বংসের ছবি যেমন মরণাহত দৃষ্টির সম্মুখে দুলে ওঠে, প্রেরণার মুহূর্তে আত্মবিনাশের সেই ছবি কোনও অসহায়তা-প্রিয় কবির চোখে হয়ত ধরা দিয়ে গণনীয় হয়ে উঠতেও পারে –
……………..তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে
তার আগে আকাশে লম্বা আগুনের ল্যাজ–একপলক
তার আগে ঝলকে সাদা গাছপালা ভূখণ্ড পাহাড়–একপলক
উড়তে উড়তে ফ্রিজ করছে সরীসৃপ পাখি
পৃথিবী ধ্বংসের ঠিক একপলক দেরি
মৃত্যুর আগের স্বপ্নে এই দৃশ্য ফিরে আসে,সেই থেকে,সব পাখিদেরই
(তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে / জয় গোস্বামী)
নাক্ষত্রিক জগতের সংকেতময়তা কবিতার অনুষঙ্গে উপচার হয়ে উঠেছে এখানে, কিন্তু প্রথম পংক্তি থেকেই অতবড় ক্যানভাস না খুঁজেও, অত্যন্ত নিরীহ শব্দমালা দ্রুতলিখিত কয়েকটি পংক্তির ধাক্কা পেরিয়ে, দুয়েকটি আঁচড়েই ভয়ানক নিষ্ঠুর সত্যকে তুলে ধরতেও পারে। শুরুতে যত নিরীহ থাকে, অন্তিমে ততই ধাক্কা দেয় তার নির্মম কশাঘাত। আপাতনিরীহ শব্দ ধরে ধরে সেই সুকঠিন মর্মন্তুদ সংবাদে উপনীত হওয়াই কিন্তু মিতলেখ কবিতার আদিতম অন্বেষা। তেমনই একটি প্রিয় কবিতা –
কালো কালির ওপর
লাল কালির মর্মান্তিক কাটাকুটি।
ব্যাপারটা কিছুই নয়।
ব্যাপারটা সত্যি তেমন কিছুই নয়
যদি না মনে পড়ে
কালো একটা ছেলে
রক্তাক্ত
ধানক্ষেতে শেষঘুমে ঘুমিয়ে আছে। (কাটাকুটি/ ভাস্কর চক্রবর্তী)
সাহিত্যের ইতিহাসে মানুষের প্রথম প্রয়াস প্রকাশ পেয়েছিলো কাব্যে – বস্তুত মহাকাব্যে। বিশাল তার বর্ণনার পরিসর, বিপুল তার কথনশক্তি, মহতী বাণীকে সে করত উদ্ঘোষণা। ধীরে ধীরে, অবশ্যই অত্যন্ত ধীরে ধীরে, আধুনিক যুগে সাহিত্যের অন্যান্য ফর্ম আবিষ্কৃত হতে থাকে। ফলত বর্ণনা, ঘোষণা ও কাহিনীকথনের দায়িত্ব তুলে নিতে থাকে সাহিত্যের অন্যান্য ফর্ম বা শাখা। কাহিনীকথনের দায়িত্ব নিল গল্পসাহিত্য, ঘোষণার দায়িত্ব নিল গদ্যময় ইস্তাহার আর বর্ণনার দায়ভার নিল আরও গদ্যমুখর সংবাদ-প্রতিবেদন, পত্রসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য কিংবা জার্নাল। কবিকে তাই বুঝে নিতে হল যে, কবিতার প্রধান কাজ বর্ণনা, ঘোষণা বা কাহিনীকথন নয়, কবিতার সার্থকতা দ্যোতনাতে। মুহূর্তের বুকে তাকে জ্বালতে হবে শব্দের পাথর ঠুকে চমৎকৃতির রঙমশাল। যত কম হবে তার আয়োজন, যত মিতবাক, নির্মেদ হবে তার অবয়ব, যত লক্ষ্যভেদী অমোঘ হবে তার পরিবেশন, ততই তা কবিকে ও কবিতার প্রকৃত পাঠককে তৃপ্তি দেবে। এই জন্যই কবিতা যতই বিকশিত হয়েছে, ততই তার আয়তন পরিমিত হয়েছে। গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে তাহলে দীর্ঘ কবিতার চল ফিরে এল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত একেক জন একেক রকমভাবে দেবেন। অনেকেই হয়ত আমার সঙ্গে সহমত হবেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার যা মনে হয়, আমাকে তা নির্ভয়ে বলতে হবে। আমার মনে হয়, বাচিক শিল্পের বিস্তারের ফলেই দীর্ঘ কবিতার পুনঃপ্রচলন ঘটছে। বাচিক শিল্প একটি পারফর্মিং আর্ট, শ্রোতৃমণ্ডলীকে বেশ কিছুটা সময় ধরে রাখতে হলে নাটকীয়তার প্রয়োজন, সর্বোপরি এমন একটা বিষয় প্রয়োজন, যা মানুষের চেতনাকে খুব গভীরে না গিয়েও সহজেই নাড়া দিতে পারবে। বর্ণনা, কাহিনীকথন বা ঘোষণার মত আর কী আছে, যা অপ্রস্তুত শ্রোতাকেও এক মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে? আর এই বর্ণনা, কাহিনীকথন বা ঘোষণাকেই আশ্রয় করে দীর্ঘ কবিতা গড়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘ কবিতার পরিধির বাইরে নিরালায় বসে লেখা, নিরালায় বসে পড়া ছোট কবিতায়, যা কোনও মঞ্চনটেশ পারফর্মারের উপস্থিতিকে দাবি করে না, তার মধ্যেই এই ‘দ্যোতনা’ – এক মুহূর্তে শব্দসংকেতে জ্বলে ওঠা ভাবপ্রতিভার আলো ফুটে উঠতে দেখি। সাজানো কথার খিল খুলে যে-‘পাগল’ পালিয়ে না যেতে পারে, সে কেমন করে দেখতে পাবে এই দ্যোতনাসংকেত? ভিড় থেকে অনেক দূরে ছোট অথচ অমোঘ একটি কবিতায় দেখতে পাই এই ফিরে আসার ইঙ্গিত –
পাগল পালিয়েছে
পালিয়েছে সহজতার দিকে
আমাদের সাজানো কথার খিল খুলে
আমাদের ছোটাছুটি কেনাকাটার দিকে
আমাদের খোঁজাখুঁজি দোকানির দিকে
পাগল পালিয়েছে অসীমের দিকে। (পাগল পালিয়েছে/মুকুল চট্টোপাধ্যায়)
মুকুল চট্টোপাধ্যায়ের এ কবিতা যেমন স্পষ্টভাষ, আরেক কবির কবিতা তেমনই সন্ধ্যা ভাষায় প্রণীত মরমী সাধনার সূত্রের মতো –
পুরুষ সে পোড়ানো অঙ্গার।
গা-ভরা ঘিয়ের ঘট মেয়ে।
‘না,যেয়ে এসো না কাছে আর';
সরু তার আর মোটা তার
সারা রাত যায় গান গেয়ে।
গেয়ে চলে সারা রাত ভোর;
'না,এসে যেয়ো না দূরে আর।'
অন্ধ ঠোকা লাগে এর ওর;
জ্বলে নেবে আহত পাথর :
সারা রাত গান অন্ধকার।
মেলা থেকে আরো সরে যেয়ে
মুছে যায় গলা দোতারার;
জেগে ওঠে এক আধটা পাখি;
আলো হয় অজয়ের ধার।
ওরা পোড়ে ভস্মে ঢালা ঘি। (সহজিয়া/ বীতশোক ভট্টাচার্য)
প্রমিত পরিসরে এই নিগূঢ় শব্দসিদ্ধিই তাই মিতায়তন কবিতার ঐশ্বর্য ।
ছবি : মলয় দত্ত
সন্মাত্রানন্দ
ধরা যাক, এমন একটা দৃষ্টি আমরা পেয়ে গেছি, যা দিয়ে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও প্রত্যক্ষ করা যায়। ধরা যাক, এই মুহূর্তেই আমরা অবলোকন করছি বহু মহাযুগ মন্বন্তর আগের প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর একটি দৃশ্য। কপার-কোবাল্ট-নিকেল প্রভৃতি বহু ধাতব উপাদানে সমৃদ্ধ রক্তবর্ণের সেই সৃষ্টি-ঊষার মৃত্তিকা, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক এক অতিকায় প্রাণী ডাইনোসোর উত্তপ্ত আদিম সূর্যের বিপরীতে। বিশাল তার ছায়া মাটির উপর, উষ্ণ সলিলে পরিপূর্ণ এক বিপুলবেগাপন্না নদীর জলতলের উপর, নদীর পরপারে প্রাগৈতিহাসিক সবুজ বনস্পতির উপর, এইভাবে যোজন যোজন সেই মহাকায় প্রাণীর বিশাল প্রচ্ছায়া প্রলম্বিত হতে হতে দিগন্তকে যেন স্পর্শ করে আছে। আর দিক্চক্ররেখায় অবস্থিত ভীমাকার রুক্ষ শ্যামলিমাবর্জিত এক পর্বতের গায়ে এসে পড়েছে ডাইনোসোরটির ছায়া, সূর্যের নির্মম আলো ওই ছায়াকে নিয়ে খেলা করছে। পর্বতের সানুদেশে কী একপ্রকারের আদিম কীট খাদ্যকণার অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে দুয়েকপা হেঁটে যাবে ঠিক করেছে, এমন সময় কীটের অক্ষিপটে এসে পড়ল ডাইনোসোরের প্রতিবিম্ব। বিরাট প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটি কীটের চোখের মণিতে বিন্দুবৎ প্রতিবিম্ব ফেলেছে –সুদূর কালের সেই দৃশ্য যদি আমরা দেখতে সমর্থও হই, তবে এটুকুই আমরা শুধু দেখব, আর কিছু নয়। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কীট এই শুধু দেখবে না। বিরাটকায় প্রাণীটি যত ক্ষুদ্র প্রচ্ছায়াই ফেলুক না তার চোখে, ওই মিনিয়েচার প্রতিবিম্বের মধ্য দিয়েই কীটের প্রতীতি হবে যে, সে সেই ডাইনোসোরের বিরাট আকারটিকেই সম্পূর্ণত দেখছে। তার চেতনায় জেগে উঠবে ভয়, বিস্ময় ও দুর্বোধ্যতার অনুভূতি।
বিরাট ভাব যখন মিতায়তন ছোট কোনও কবিতায় প্রকাশ করেন সমর্থ কোনও কবি, তখন আন্তরিক পাঠকের মনে কবিতাটির মিতায়তনের মধ্য দিয়ে বিরাট এক ভাবরূপের বিস্তার এমনভাবেই জেগে উঠতে পারে। ছোট একটি কবিতা যে বিরাট ব্যাপ্তিকে ধরে রাখে তার আঁটসাঁট ঘনপিনদ্ধ অবয়বের ভিতর, তার সঙ্গে কীটের অক্ষিপটে এসে পড়া বিরাট প্রাণীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিবিম্বের তুলনা করা চলে।
ন্যায়শাস্ত্রে বলা হয়, ‘উপমা একদেশী’। অর্থাৎ উপমা সর্বাংশে হয় না, একদিক দিয়েই হয়। ‘বাঘের মত মুখ’– বললে মুখটা হাঁড়িপানা কিছু একটা বোঝায় না, মুখটা ভয়ংকর –এটুকুই শুধু বোঝায়। উপরের অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত উপমায় ডাইনোসোরটাকে যে দাঁড় করিয়েছি কীটের থেকে যোজন যোজন দূরে, তার থেকে কেউ যেন এমন না বোঝেন যে, আমি ছোট কবিতার কবিকে দাঁড় করাতে চাইছি সাম্প্রতিক কোনও পাঠকের থেকে কালগত দূরত্বে। এই দূরত্ব কালগত নয়, ভাবগত বা আরও পরিষ্কার করে বললে চেতনাগত। কবিতার উৎসমুখটি আমাদের পথচলতি চেতনার থেকে বহু দূরে, তবু সুদূর হলেও আমাদেরই লৌকিক চেতনায় তার ছায়া পড়ে, আমাদেরই জৈবনিক প্রসঙ্গকে আশ্রয় করে আমাদেরই তা টেনে নিয়ে যায় গহনাতীত গহনে, নিশিডাক দিয়ে প্রেত যেমন করে টেনে নিয়ে যায় ঘুমন্ত ব্যক্তিকে নদীর ভরাজলে। আকারে ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যে মহৎ, ছোট মিতায়তন কবিতার এই আবিশ্ব বিস্তার মুগ্ধ করে আমাদের, অনেক বন্ধ জানালা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
ছোট কবিতার, বিশেষত অণু-কবিতার আদর্শটি এসেছে জাপানি ‘হাইকু’র থেকে এমন একটা ধারণা অনেকে পোষণ করেন। এই ধারণা একেবারে ভ্রান্ত। মুখ্যত রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপান-ভ্রমণের অবসরে হাতপাখায়, রুমালে বা কাগজে দস্তখৎ দিতে গিয়ে ছোট ছোট কবিতা লিখেছিলেন, ‘স্ফুলিঙ্গ’ বা ‘কণিকা’য় যা সংকলিত হয়, সেই ঘটনার থেকেই এমন অলীক ধারণার জন্ম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুধু জাপানেই নয়, ভারতবর্ষেও ছিল ছোট কবিতার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। উর্দু শায়েরি কিংবা তামিল ভাষায় প্রণীত তিরুক্কুরালই শুধু নয়, প্রাকৃত ভাষায় প্রণীত কবি হালের ‘গাথাসপ্তশতী’ই কেবল নয়, সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত সুভাষিত-ভাণ্ডার, উদ্ভট শ্লোক ও খণ্ডকাব্যসমূহে অণুকবিতার বিস্ময়কর ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এসব কবিতার সমস্যা হল, এগুলোতে নীতিবচন বা দার্শনিক সিদ্ধান্তের প্রাচুর্য এদের সত্যিকারের কবিতা হয়ে উঠতে বাধা দিয়ে এসেছে, বিশুদ্ধ কবিতার রস এতে ক্ষুণ্ণ হয়। তবু তার মধ্যেও অস্তিত্বে অন্তর্লীন বেদনার নিরাশাকরোজ্জ্বলতা কোনও কোনও কবির দীর্ঘশ্বাসে স্মৃতিধার্য হয়ে আছে। যেমন ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতকে —
রম্যাশ্চন্দ্রমরীচয়স্তৃণবতী রম্যা বনান্তস্থলী
রম্যং সাধুসমাগমাগতসুখং কাব্যেষু রম্যাঃ কথাঃ।
কোপোপাহিতবাষ্পবিন্দুতরলং রম্যং প্রিয়ায়া মুখং
সর্বং রম্যমনিত্যতামুপগতে চিত্তে ন কিঞ্চিৎ পুনঃ।।
-জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভাসা রাত্রিগুলি রমণীয়, রমণীয় শ্যামপত্রী বন,
অরণ্যের প্রান্তদেশে মুথাঘাসে ঢাকা মাঠ স্নিগ্ধ করে আমাদের মন।
অনুভবী ভাবুকের প্রিয়সঙ্গ রসালাপ, রম্যসুখ কবিতা কথায়,
অশ্রুর শিশিরে ধোওয়া প্রিয়ার আনত মুখ, অভিমান চোখের পাতায়।
সুরম্য সমস্ত, তবু মদিরতা এরা সব আনেনা আমার চোখে আর,
রূপ, রঙ, অনুরাগ জ্বলে উঠে নিভে যায়, জানি আমি –সকলই অসার।
(অনুবাদ প্রাবন্ধিককৃত)
এখানে অন্তিম উচ্চারণে যে-দার্শনিক চেতনার প্রতিভাস ফুটে উঠেছে, তা প্রাক্প্রকল্পিত ছিল না। তা এসেছে আন্তরিক কবিতার ছায়াসরণি বেয়ে একান্ত অনর্গল উৎসারে।
আমি অবশ্য মিতায়তন কবিতা বলতে এখানে অণুকবিতাকেই বোঝাচ্ছি না। আট দশ লাইনে যেসব কবিতারা পূর্ণতা পেয়ে যায়, সরল বাগ্ভঙ্গিমায় কিংবা ঈষৎ অলংকৃত কারুকাজের ভিতর এক সুগভীর অনুভূতিকে তুলে ধরে সহসা চমৎকৃতি বা আচ্ছন্ন মধুর মেদুরতায় যা পাঠকের মনকে উজ্জ্বল বা মজ্জিত করে, সেই সব রচনার মূল করণকৌশল হচ্ছে তার অপার্থিব সংযম। তির্যক, সূত্রাকার, সাংকেতিক হয়ে ওঠে তাদের জাদু উচ্চারণ, এ ব্যাসকূট ভাঙবার জন্য মিতায়তন কবিতারা তাদের প্রেমিকদের চোখে চোখে ইঙ্গিত করে। পড়তে পড়তে তলিয়ে যাই এই কটাক্ষের পেছনে শিরা উপশিরার সংস্থানের কথা ভেবে, শিহরিত হই চাবুক শব্দে। আমরা বুঝতে পারি আরেকটি অসম্ভব ভাল লাগা কবিতা আমাকে ডাকছে।
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে। (কমলালেবু/জীবনানন্দ দাশ)
‘শীতের রাত’, ‘হিম কমলালেবুর করুণ মাংস’, ‘মুমূর্ষু’ –এই সব শব্দের অনুষঙ্গে জড়িয়ে আছে এক নিঃসহায় আর্তি। অথচ সেই আর্তির আয়োজনের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠছে নিঃসহায়তার বিপরীত এক বলিষ্ঠতা, এক সুগভীর জীবনানুগ প্রত্যয়। সেই ইতিবাচক প্রত্যয় দেহ থেকে বার হয়ে যাবার পর ফিরে আসার আকুতিময় জন্মান্তরবাদকেন্দ্রিক কোনও মরমী ভাবনার উপর ভর করেনি, মুমূর্ষুকে সেবা করার সরব মতবাদকেও আশ্রয় করেনি, যদিও ওই সব চিন্তা এ কবিতার অবয়ব থেকে ঝরে যাচ্ছে না। এ কবিতা প্রকৃতপক্ষে প্রেমেরই কবিতা, ‘মুমূর্ষু’র আগে ‘পরিচিত’ বিশেষণটি প্রেমের সংবেদনাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। তবু এই প্রেম আমাদের কালসীমিত ভালবাসা নয়, মৃত্যূত্তীর্ণ এক অনিবার্য মহত্ব প্রেমকে এখানে করেছে সুগম্ভীর আয়তনবান। সমস্ত কবিতাটি পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শব্দগুলি পরিচিত, আবহটি পরিচিত, মুমূর্ষুও পরিচিত, কিন্তু পরিচিত পৃথিবীর অনুষঙ্গে অপরিচিত এক ইতিবাচকতার ইশারা, শান্ত কন্ঠে সত্য উচ্চারণের নির্মেদ ঋজুতা, এ কবিতাকে অনন্য করেছে। অসুস্থতার ছায়ান্ধকার পরিসরের ভিতর পরম স্বস্থতা এখানে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। মিতায়তন কবিতাটি অনর্গল মনের ভিতর ঢুকে স্মৃতিতে বাসা বাঁধে, ফিরে ফিরে আসে জীবনের কঠিন ও সহজ মুহূর্তগুলোতে, কত কম আয়াসে, কত কম শব্দে বিরাটত্বের দ্যোতনাকে চিরায়মান করে তোলা যায় –এ কবিতা তারই সমর্থ দৃষ্টান্তস্থল।
মৃত্যূত্তর এই বিশ্বাসের কাছে যিনি যাবেন না, যাঁর সমস্ত প্রত্যয় এই জীবনের মধ্যেই সমর্পিত, যিনি ক্ষণিকার এই রাত্রি বা এই মুহূর্তটির আয়ুহীনতার বিলাপ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারেন না, জীবনে অঙ্গীকৃত, জীবনাতীত সত্যে অনঙ্গীকৃত কোনো কবি হয়ত বলতে পারেনঃ
‘ভুলিবো না’ -এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রীমায়া মিলাক, মিলাক
তৃণেপত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলেস্থলে,আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে তুমি ছিলে,তবু তুমি ছিলে। (কোনো মৃতার প্রতি / বুদ্ধদেব বসু)
তবু নিভৃত আলোটি হৃদয়ে জ্বালাতে ভুল হয় না তাঁরও। মৃতার মুখশ্রীমায়া পৃথিবীর তৃণে পত্রে ঋতুরঙ্গে জলেস্থলে আকাশের নীলে ব্যপ্ত দেখতে চান তিনিও। ‘তুমি ছিলে’ এই স্মৃতিপথোদ্ভাসিত বেদনাটি সুগভীর প্রত্যয়ের জায়গা নেয় এখানে।‘ভুলিবো না’ বলতে না চেয়েও ভুলতে পারেন না কবি। বিলাপের অতীত, স্থির ধৃতিমান অনাড়ম্বর আয়োজনের ভিতর এক মহান সুরস্রষ্টার বিষাদমধুর আলাপ মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে তোলে আমাদের মন। এ কবিতায় সংকেত কম, নির্বেদ বেশী। জীবন ও মৃত্যুর অবাধিত সমীকরণ একেবারে অন্যরকমভাবে মিতলেখ কবিতার আশ্রয়ে পরাক্রান্ত বোধের কাছে ঋণী করে তোলে আমাদের।
কিন্তু শুধু জীবন ও জীবনান্তের সমীকরণ নয়, আশ্রয় ও গম্যতার সমীভবন ছোট কবিতার পরিসরে যদি আত্মস্থ করতে চাই, তবে এ কবিতাটির কাছে লঘুপায়ে হেঁটে যেতে হয়ঃ
তুমিই মালিনী,তুমিই তো ফুল জানি ।
ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে,মালিনী,
বাতাসে গন্ধ,উৎস কি ফুলদানি,
নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?
দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নি
কালের বাগানে থামেনিকো আসা যাওয়া।
ত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,
একটি প্রহর ফুলহার দাও খুলে,
কালের মালিনী ! তোমাকেই ফুল জানি,
তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী,
তোমাকেই রাখী বেঁধে দিই করমূলে
অতীত থাকুক আগামীর সন্ধানী –
তাই দেখে ঐ কাল হাসে দুলে দুলে। (তুমিই মালিনী / বিষ্ণু দে)
বুদ্ধদেবের কবিতার মত স্মৃতির ধূপ জ্বালতে চান না বিষ্ণু দে। যে-সৌন্দর্য তাঁর গম্যভূমি, আর যে-আশ্রয়ে তিনি সেই গন্তব্যে পৌঁছুতে চান, এ দুয়ের সমীভবন, মুহূর্তের কেশগুচ্ছে ত্রিকালকে বেঁধে রাখার প্রয়াস এ কবিতাকে অনন্যতা দিয়েছে। পড়তে পড়তে দোলায়িত হতে হতে হঠাৎই অসম্ভব সচেতন হয়ে উঠি আমরা এই অনুভবে যে, ওই মালিনীই তো মুহূর্তের শরীর। অতীত মৃত, আগামী অজাত, এই মুহূর্তটিই তো চিরন্তন –দ্য ইটারনাল নাউ – ‘ক্ষণশাশ্বতী’। তাই ‘তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী’। কালের মালিনীর মাথার একটি ফুলহার, একটি অভিনিবিষ্ট প্রহরই তো সেই কালোত্তীর্ণ বাণীর কথা বলে। যাকে বলে সে সেই কথা, অথবা যিনি সেই কথা শুনতে পান, তাঁরই তো চিরবন্ধুতা মালিনীর সঙ্গে, মুহূর্তের মণিবন্ধে রাখী বেঁধে সমস্ত মজ্জমানতা থেকে ঘুম ভেঙে তিনিই জেগে উঠতে পারেন। এ কবিতা হতেই পারত কোনও জেন বৌদ্ধমঠে পঠিত একটি ‘কোয়ান’, মৌহূর্তিক এই কবিতায় বৃহতী প্রমার আভাষ সুপ্তোত্থিত করে তার পাঠককে সংশয়ের ঊর্ধ্বে।
সিদ্ধান্তের এই ভার, দর্শনচিন্তার এই চালচিত্র কবিতাকে সার্থক হতে দেয় না অনেক সময়ই। কবিতা বিশুদ্ধ অনুভূতির ব্যাপার। অনেক আঁঠা দিয়ে ঘুড়ির কাগজ চেটালে, সেই ঘুড়ি যেমন করে গোত্তা খেয়ে পড়ে যায় আকাশ থেকে, উড়তে পারে না বাতাস কেটে অবলীলায়, তেমনই কোনও কবিতা যখন তার অবয়বে লুকিয়ে ফেলতে পারে না বক্তব্যের মেদ, তখন ভাবনার আকাশে উড্ডীন হতে পারে না আর হংসবলাকার মতো। আমাদের অনিশ্চিত জীবন, অপেক্ষার প্রহর, সংশয়ের কম্পনকে কোনও দার্শনিকতার আধারে আধৃত যদি না করে তাকে মুক্তি দিতে পারা যায় কোনও কবিতায়, তবেই নির্মিত হতে পারে সার্থক কবিতার প্রমা। ছোট কবিতার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ তার গঠন, চলন ও বিভঙ্গ সংহতিকেই দাবি করে, বিস্তৃতিকে নয়। এই সংহতি দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে দর্শনচিন্তা এগিয়ে এলে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস সকলের আয়ত্তাধীন নয়। কবিকে বুঝতে হয়, দর্শন নয়, বক্তব্য নয়, সংশয় ও অনিশ্চয়তা দিয়েই হবে তার বাক্নির্মিতি। অশান্তি ও দ্বিধার অগ্নিপরিধির মধ্যেই তাঁকে নিয়ে যেতে হবে কবিতার পাঠককে। অপৃথুল কোনও কোনও কবিতার অবয়বে সেই সংশয়কে বৃহজ্জাতক করে তুলতে পারেন কেউ কেউঃ
রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায় ।
তুমি এখনো এলে না ।
সন্ধ্যা নেমে এলো পশ্চিমের করুণ আকাশেঃ
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর ধ্বনি। (বিরহ/সমর সেন)
এ কবিতা পোড়ায় আমাদের, এভাবে দগ্ধ হবার জন্যই তো শিল্প, এভাবে অনুমৃত হওয়ার মধ্যেই কবিতার পুনরুত্থান। ছোট কবিতার মধ্যে এই দহনের স্বাহা-কার ও স্বধা-কার যত ঋজু অথচ অস্ফুট উচ্চারণে ফুটিয়ে তুলতে পারা যায়, ততই তা স্মৃতিধার্য হয়ে ওঠে। শব্দের আলপনা নয়, পড়তে পড়তে বুঝি একটি সার্থক কৃশতনু কবিতা প্রকৃতই কৃশানু, সে আগুনে ইন্ধন হিসেবে জ্বলে উঠেছে কবির রুধিরাক্ত হৃদয়, গান ও প্রাণ যুগপৎ বিনিঃসৃত হয়ে গেলেও, জীবনের ওষ্ঠাধর থেকে মুছে যায়নি আরক্ত হাস্যরেখা।
সেই যে এক বাউল ছিল সঙক্রান্তির মেলায়
গানের তোড়ে দম বাধলো গলায়
হারানো তার গানের পিছে হারালো তার প্রাণ,
আহা,ভুলে গেলাম কি যেন তার গান!
প্রাণ দিয়েছে দেয়নি তার হাসি
গানের মতো প্রাণ ছেড়েছে খাঁচা।
সেই যে তার মরণাহত হাসি
ঝর্ণা,জানো,তারই নাম তো বাঁচা। (ঝর্ণা-কে/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
সংশয়ের বাতাবরণের ভিতর প্রত্যয়ের কোনও ঊর্ধ্বমুখ শিখাই খোঁজেন কবি, কিন্তু নিরীক্ষাবিহীন মতান্ধতার সঙ্গে তিনি অসহযোগী। মুঘল যুগের এক মরমী সাধক সারমাদ, দারাশিকোর বন্ধু, যিনি ইসলামের ধ্রুববাক্য (লা ইল্লাহা ইল্লাল্লাহা –আল্লা ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই)-এর অর্ধাংশ মাত্র উচ্চারণ করে বলতেন, লা ইল্লাহা, যার অর্থ দাঁড়াত, ঈশ্বর নেই। এমন বলার কারণ কী, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর আছেন কিনা আমি তা এখনও সম্যক জানি না যে। এই অপরাধে মতান্ধরা যখন মীনাবাজারে তাঁর গলা কেটে ফেলল, তখন মরণাহত হাসি জেগে উঠেছিল সেই ফকিরের ওষ্ঠে। উপরের কবিতার বাউলের মরণাহত হাসির সঙ্গে কোথায় যেন মিশে যায় সারমাদের হাসি, যে-হাসি আত্মপ্রত্যয়ের, সংশয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত থাকার দৃঢ়তার ও সততার। প্রত্যয়ের এই কেন্দ্র খুঁজতে গিয়ে কোনও কবি হয়ত হেঁটে যেতে পারেন তাঁর একতম প্রেমের কাছে, লিখতে পারেন, ‘আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই/ আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই/ কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই/তুমি আছো, তুমি’ (তুমি/শঙ্খ ঘোষ) অথবা এই প্রত্যয় একই কবির ক্ষেত্রে আসতে পারে অসমাকৃতিক কোনও উৎস থেকে। আমি যা, আমি যতটুকু, ততটুকুও হয়ে উঠতে পারি না পরিপার্শ্বের চাপে, আমাকে কেবলই বলা হয় এ বিশ্বসংসারে ছোট হয়ে যেতে, সরু হয়ে যেতে। এই না হয়ে উঠতে পারার, এই অবদমিত হবার যন্ত্রণাও হতে পারে সেই প্রত্যয়, নিতান্ত অসম্ভব মনে হলেও। শুধু কবি নন, মিতায়তন কবিতাটিই যেন পূর্ণরূপ না পাওয়ার বেদনা জানাচ্ছে এখানেঃ
‘ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘সরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না?
‘সরু হয়ে যান,ছোট হয়ে যান -'
আরো কত ছোট হব ঈশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে !
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে,বাজারে,আড়ালে? (ভিড়/শঙ্খ ঘোষ)
কবি ও কবিতার একাত্মতা এত অমোঘ হয়ে উঠতে পেরেছে মিতবাচনিক পরিসরে, ছোট কবিতার সঙ্গে বোধ করি কবির একাত্মতা দীর্ঘ কবিতার তুলনায় অধিকতর সম্ভব, কারণ কবি তাঁর চেতনার রশ্মিগুলিকে ছোট কবিতার আতসকাচের ভিতর সংহত, নিবিষ্ট, কেন্দ্রিত করে তোলার প্রয়াস পান, যার অনিবার্য ফল উত্তাপ, আলোক ও দহনজ্বালা। সেই অর্থে ছোট কবিতাই হয়ে উঠতে পারে কবির প্রকৃত আত্মজীবনী। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাপুঞ্জের ভারে অবনত না হয়ে নৈর্ব্যক্তিক নির্মেদ আয়ত্ত হয়ে উঠতে পারে এমন কবিতায়। একটা গোটা জীবনকে কয়েক পংক্তির মধ্যে ধরে দিয়ে প্রায় এপিটাফ রচিত হতে পারে তন্বঙ্গী কবিতায়, যা কোনও সুবৃহৎ উপন্যাসেও ধার্য নয়ঃ
কিছুকাল সুখভোগ করে, হলো মানুষের মত
মৃত্যু ওর, কবি ছিল, লোকটা কাঙালও ছিল খুব।
মারা গেলে মহোৎসব করেছিলো প্রকাশকগণ
কেন না, লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে, বিরক্ত করবে না
সন্ধেবেলা সেজেগুজে এসে বলবে না, টাকা দাও
নতুবা ভাঙচুর হবে, ধ্বংস হবে মহাফেজখানা
চটজলদি টাকা দাও –নয়ত আগুন দেবো ঘরে।
অথচ আগুনেই পুড়ে গেলো লোকটা, কবি ও কাঙাল ! (কবি ও কাঙাল/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এই যে পরিমিতি, সংহতি ও গভীরতার প্রসঙ্গ উঠে আসে ছোট কবিতার আলোচনায়, সেই অনুষঙ্গে একটি প্রশ্ন স্বভাবতই উত্থাপিত হতে পারে। সে প্রশ্ন লাবণ্যবিষয়ে। মিতাকৃতি কবিতায় বিরাট ভাব আধৃত হতে পারে, কিন্তু অল্প কথার ফুলে ভরা কবিতার শাখায় লাবণ্যের পুষ্পসম্ভার আনা যেতে পারে কি? এক্ষেত্রেও, ‘যে পারে সে আপনি পারে’। বস্তুত, লাবণ্যের জন্য দীর্ঘ শব্দের করিডোর পেরিয়ে আসতে হবেই, এমন নয়। দীর্ঘ করিডোরের ভিতর এক বিশ্রান্ত নীলিমার নির্লিপ্তি আছে, সুদীর্ঘ কবিতায় তা সহজপ্রাপ্য। লাবণ্য কি ফোটে না মায়ের আটপৌরে খেতে আসার ডাকের ভিতর? হারিয়ে যাওয়া গোবৎসের গলার মৃদু মৃদু ঘন্টার শব্দে? অল্প শব্দে লাবণ্য ধরা আছে পূর্বোৎকলিত কবিতাগুলির ভিতর। তবু অলংকৃত লাবণ্যের নিদর্শন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নিম্নোদ্ধৃত কবিতাটিতে যেমন পেয়েছি, তা নিশ্চয়ই পৃথক উল্লেখ দাবি করতে পারে।
তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা হবে নমিতা নদী!
গোধূলি হলো।
তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে
মুখোশ খুলে দেবে বিভোরবিভা
অহংকার ভুলে অরুন্ধতী
বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে।
রাত্রি হলো।
এ কবিতায় সর্বোপরি নির্জনতা যেন থমথম করছে। সময় প্রাকারের গায়ে কে যেন সূচ দিয়ে এক নিগূঢ় কোটর বা পীপ-হোল তৈরী করছে, যত খুঁড়ছে, আবার ততই বুজে আসছে। সেই পীপ হোলে চোখ রেখে কখনও ঝকঝকে স্পষ্ট, কখনও আবছামতো দেখা যাচ্ছে ওদিকের দৃশ্যপট, সেখানে গোধূলি নামছে, নামছে রাত্রি; তোমার প্রতিশ্রুত সেই মুহূর্তগুলি এসে পড়বে এইবার? এই উৎকণ্ঠার মধ্যে যে এক নিষ্পলক প্রতীক্ষা আছে, এ কবিতা সেই মুহূর্ত-উন্মোচী। ছোট কবিতার মত ছোট গল্পেও এই বিশেষ মুহূর্তের দিকেই যাত্রা, সেই অভিগমনের দিক দিয়ে ছোট কবিতা ছোট গল্পেরও সমীপবর্তী হয়। তবু ছোট কবিতার মাল্টি ডাইমেনশন হয়ত ছোটগল্পের থেকে তাকে আলাদা করে দেয়। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ধ্বংসের ছবি যেমন মরণাহত দৃষ্টির সম্মুখে দুলে ওঠে, প্রেরণার মুহূর্তে আত্মবিনাশের সেই ছবি কোনও অসহায়তা-প্রিয় কবির চোখে হয়ত ধরা দিয়ে গণনীয় হয়ে উঠতেও পারে –
……………..তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে
তার আগে আকাশে লম্বা আগুনের ল্যাজ–একপলক
তার আগে ঝলকে সাদা গাছপালা ভূখণ্ড পাহাড়–একপলক
উড়তে উড়তে ফ্রিজ করছে সরীসৃপ পাখি
পৃথিবী ধ্বংসের ঠিক একপলক দেরি
মৃত্যুর আগের স্বপ্নে এই দৃশ্য ফিরে আসে,সেই থেকে,সব পাখিদেরই
(তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে / জয় গোস্বামী)
নাক্ষত্রিক জগতের সংকেতময়তা কবিতার অনুষঙ্গে উপচার হয়ে উঠেছে এখানে, কিন্তু প্রথম পংক্তি থেকেই অতবড় ক্যানভাস না খুঁজেও, অত্যন্ত নিরীহ শব্দমালা দ্রুতলিখিত কয়েকটি পংক্তির ধাক্কা পেরিয়ে, দুয়েকটি আঁচড়েই ভয়ানক নিষ্ঠুর সত্যকে তুলে ধরতেও পারে। শুরুতে যত নিরীহ থাকে, অন্তিমে ততই ধাক্কা দেয় তার নির্মম কশাঘাত। আপাতনিরীহ শব্দ ধরে ধরে সেই সুকঠিন মর্মন্তুদ সংবাদে উপনীত হওয়াই কিন্তু মিতলেখ কবিতার আদিতম অন্বেষা। তেমনই একটি প্রিয় কবিতা –
কালো কালির ওপর
লাল কালির মর্মান্তিক কাটাকুটি।
ব্যাপারটা কিছুই নয়।
ব্যাপারটা সত্যি তেমন কিছুই নয়
যদি না মনে পড়ে
কালো একটা ছেলে
রক্তাক্ত
ধানক্ষেতে শেষঘুমে ঘুমিয়ে আছে। (কাটাকুটি/ ভাস্কর চক্রবর্তী)
সাহিত্যের ইতিহাসে মানুষের প্রথম প্রয়াস প্রকাশ পেয়েছিলো কাব্যে – বস্তুত মহাকাব্যে। বিশাল তার বর্ণনার পরিসর, বিপুল তার কথনশক্তি, মহতী বাণীকে সে করত উদ্ঘোষণা। ধীরে ধীরে, অবশ্যই অত্যন্ত ধীরে ধীরে, আধুনিক যুগে সাহিত্যের অন্যান্য ফর্ম আবিষ্কৃত হতে থাকে। ফলত বর্ণনা, ঘোষণা ও কাহিনীকথনের দায়িত্ব তুলে নিতে থাকে সাহিত্যের অন্যান্য ফর্ম বা শাখা। কাহিনীকথনের দায়িত্ব নিল গল্পসাহিত্য, ঘোষণার দায়িত্ব নিল গদ্যময় ইস্তাহার আর বর্ণনার দায়ভার নিল আরও গদ্যমুখর সংবাদ-প্রতিবেদন, পত্রসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য কিংবা জার্নাল। কবিকে তাই বুঝে নিতে হল যে, কবিতার প্রধান কাজ বর্ণনা, ঘোষণা বা কাহিনীকথন নয়, কবিতার সার্থকতা দ্যোতনাতে। মুহূর্তের বুকে তাকে জ্বালতে হবে শব্দের পাথর ঠুকে চমৎকৃতির রঙমশাল। যত কম হবে তার আয়োজন, যত মিতবাক, নির্মেদ হবে তার অবয়ব, যত লক্ষ্যভেদী অমোঘ হবে তার পরিবেশন, ততই তা কবিকে ও কবিতার প্রকৃত পাঠককে তৃপ্তি দেবে। এই জন্যই কবিতা যতই বিকশিত হয়েছে, ততই তার আয়তন পরিমিত হয়েছে। গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে তাহলে দীর্ঘ কবিতার চল ফিরে এল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত একেক জন একেক রকমভাবে দেবেন। অনেকেই হয়ত আমার সঙ্গে সহমত হবেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার যা মনে হয়, আমাকে তা নির্ভয়ে বলতে হবে। আমার মনে হয়, বাচিক শিল্পের বিস্তারের ফলেই দীর্ঘ কবিতার পুনঃপ্রচলন ঘটছে। বাচিক শিল্প একটি পারফর্মিং আর্ট, শ্রোতৃমণ্ডলীকে বেশ কিছুটা সময় ধরে রাখতে হলে নাটকীয়তার প্রয়োজন, সর্বোপরি এমন একটা বিষয় প্রয়োজন, যা মানুষের চেতনাকে খুব গভীরে না গিয়েও সহজেই নাড়া দিতে পারবে। বর্ণনা, কাহিনীকথন বা ঘোষণার মত আর কী আছে, যা অপ্রস্তুত শ্রোতাকেও এক মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে? আর এই বর্ণনা, কাহিনীকথন বা ঘোষণাকেই আশ্রয় করে দীর্ঘ কবিতা গড়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘ কবিতার পরিধির বাইরে নিরালায় বসে লেখা, নিরালায় বসে পড়া ছোট কবিতায়, যা কোনও মঞ্চনটেশ পারফর্মারের উপস্থিতিকে দাবি করে না, তার মধ্যেই এই ‘দ্যোতনা’ – এক মুহূর্তে শব্দসংকেতে জ্বলে ওঠা ভাবপ্রতিভার আলো ফুটে উঠতে দেখি। সাজানো কথার খিল খুলে যে-‘পাগল’ পালিয়ে না যেতে পারে, সে কেমন করে দেখতে পাবে এই দ্যোতনাসংকেত? ভিড় থেকে অনেক দূরে ছোট অথচ অমোঘ একটি কবিতায় দেখতে পাই এই ফিরে আসার ইঙ্গিত –
পাগল পালিয়েছে
পালিয়েছে সহজতার দিকে
আমাদের সাজানো কথার খিল খুলে
আমাদের ছোটাছুটি কেনাকাটার দিকে
আমাদের খোঁজাখুঁজি দোকানির দিকে
পাগল পালিয়েছে অসীমের দিকে। (পাগল পালিয়েছে/মুকুল চট্টোপাধ্যায়)
মুকুল চট্টোপাধ্যায়ের এ কবিতা যেমন স্পষ্টভাষ, আরেক কবির কবিতা তেমনই সন্ধ্যা ভাষায় প্রণীত মরমী সাধনার সূত্রের মতো –
পুরুষ সে পোড়ানো অঙ্গার।
গা-ভরা ঘিয়ের ঘট মেয়ে।
‘না,যেয়ে এসো না কাছে আর';
সরু তার আর মোটা তার
সারা রাত যায় গান গেয়ে।
গেয়ে চলে সারা রাত ভোর;
'না,এসে যেয়ো না দূরে আর।'
অন্ধ ঠোকা লাগে এর ওর;
জ্বলে নেবে আহত পাথর :
সারা রাত গান অন্ধকার।
মেলা থেকে আরো সরে যেয়ে
মুছে যায় গলা দোতারার;
জেগে ওঠে এক আধটা পাখি;
আলো হয় অজয়ের ধার।
ওরা পোড়ে ভস্মে ঢালা ঘি। (সহজিয়া/ বীতশোক ভট্টাচার্য)
প্রমিত পরিসরে এই নিগূঢ় শব্দসিদ্ধিই তাই মিতায়তন কবিতার ঐশ্বর্য ।
ছবি : মলয় দত্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন