|
এই সংখ্যার কবি অরিত্র চ্যাটার্জী।জন্ম ১১ এপ্রিল, ১৯৯৪। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে গবেষণারত। কবিতা লেখার সুত্রপাত স্কুল জীবনের শেষ দিকে। প্রকাশিত কবিতার বই একটি , "ঝরা পাতার সমাহার" (প্রকাশক - ৯ নং সাহিত্য পাড়া লেন, সন- ২০১৯)।
মবলগে মনোলগ
১
( ডিমেনশিয়া )
কে তুমি
জটিল জ্যামিতিতে
ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এসেছ
অনুজ্জ্বল ধ্বনির ভেতর
খসে পড়ে
যৌগ অক্ষরছবি
বিলীয়মান গেরস্তপ্রপাত
ও সন্নিহিত মুখেদের ভিড়ে
আমি আবারো
গুছিয়ে নিতে ভুলে যাই
যত ছিল বিগত দশকের স্খলন …
২
( পোর্ট্রেট অফ ভেনাস )
রাখা আছে নির্জন আপেল আর আমার এই শাদাটে তনুদেশ, একে তোমরা আরোহণ করবে ভাব, দড়ি ও কম্পাস সহযোগে তোমাদের এহেন নিষ্ফল অভিযান প্রতিবার উপত্যকার খাঁজে এসে থেমে যায় হায়, আর আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি কবে কেউ পেরিয়ে আসবে নীলচে ঠোঁটের সানুদেশ আর যাবতীয় প্রজননবেলা ক্রমে বয়ে গেলে, প্রতি রাতে কিভাবে আরেকটু বেশি করে মরে যাই, ওহ্ মৃত্যু, সেকথা কারুক্কে বোলোনা কখনো!
৩
কি প্রচণ্ড নির্বিকার
এই সারিসারি ধড় ও মুখোশরাশি
আমাকে লক্ষ্য করে
পুঞ্জীভূত ধোঁয়ার আড়ালে
অনায়াস সরিয়ে নেয় পাটাতন
আর
পতনোন্মুখ আমাকে
টেনে তোলে
আরেকটা অবাঞ্ছিত স্বপ্নের ভিতর
৪
বিক্ষিপ্ত কিছু সত্য উদ্ঘাটনের হেতু আমি অবশেষে সেই ধর্মযাজকটির সন্নিকটে গেছিলাম এবং তাঁর লোল করতল স্পর্শ করে অভিবাদন জানিয়ে আমি বলতে শুরু করেছিলাম যা কিছু সত্য বলে মনে হয় সেইসব অনাকাঙ্খিত সংশয়ের কথা, পর্ণমোচীর বাগানে সেই বৃদ্ধ ধর্মযাজক আমার কথার ভেতর সহসা জানতে চেয়েছিলেন পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কিত আমার মতামত এবং আমাদের কথোপকথনের সাময়িক নীরবতা ভেদ করে সকাতরে একটি পাখি ডেকে চলেছিল এবং ধর্মযাজক চোখ বুজে সেই সকরুণ সুরের ভিতর সুখবোধ কিভাবে মানুষকে এড়িয়ে চলেছে অনন্তকাল সে কথা বলে চলেছিলেন, এবং এমতাবস্থায়, তাঁর পশ্চাতে ডালা সাজিয়ে জনৈকা যুবতী এসে দাঁড়িয়েছিল, ধর্মযাজকের কথার ফাঁকেফাঁকে যার সুডৌল উরুদ্বয় আমি একাগ্র চিত্তে দেখেছিলাম…
৫
যে তুমি মনোলোভা,
এই আশ্চর্য নাচবুদ্ধি
জ্যামিতিভঙ্গিমা দেখব বলে আমরা পেরোই
সাড়ে আট, সাড়ে আট কৈশোরের কাঁটাতার
আর তুমি উঠে আসো অনাবিল বিভঙ্গে
কোন সামুদ্রিক পিপে হতে
সাইরেনদের গানে দোল খাও যেন সহস্র সাপিনী
যাজকের হাঁসফাঁস, যা কিছু বীতংস তা ছুঁয়ে
কাকে বলে রক্তাল্পতা
সে মুহূর্তে জেনেছি আমি
৬
দুঃখ,
প্রতিটি ঠাণ্ডা আত্মার
অনভিপ্রেত শীতঘুম ভাঙ্গানোর
পর্যাপ্ত বারুদের
রসদ না থাকার…
৭
( সোয়ান সং)
‘হিপোক্রিসি ‘কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ আছে অনেক
তবু সচেতন ভাবে আমি এই শব্দটা ব্যবহার করি
‘হিপোক্রিসি’ শব্দটা ভারীবিশেষ, যেন বাটখারার মতন
যা ছুঁড়ে মারলে সামনের লোকটার কপালে লাগে
আর সেইসব আহত শ্রোতাদের থেকে তিন সেকেন্ড বেশী সময় পাওয়া যায়
বিজয়ীর মত দাঁড়িয়ে থাকার অথবা পরবর্তী শব্দসমুহ সাজানোর
মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে
তোমাদের শব্দাঘাত করা আর সময়ে পরে নেওয়া লুকনো মুখোশ
তোমাদের সুখ দুঃখ আর সত্যিই নাড়ায় না আমায়
লঘু পায় আমি পেরিয়ে যাই মাটিদেশ,নগর,বন্দর
আর আমার পেছনে পড়ে থাকে সারিবদ্ধ সিরিয়া আর আমলাশোল
আর আমার পেছনে পড়ে থাকে শ’পাঁচেক নব্য শারুক্ষান
আর এইসব ছেড়ে আমি ফিরে যাই নিজ্স্ব সুড়ঙ্গে
যেখানে সযত্নে সাজানো একান্ত ব্যক্তিগত সমস্ত দুঃখ
যেমন করে প্রিয় ক্ষত চেটে নেয় সমস্ত কুকুর
প্রত্যেকটি বিষাদ আর প্রত্যাখ্যান জড়িয়ে আমি সুখনিদ্রা যাই
আর স্বপ্নে এই ছোট্ট দেহ, অন্ধকার কুঠুরি এই সব ছাড়িয়ে
অনেক অনেকটা বড় হয়ে ছেয়ে থাকি তোমাদের শহরের ওপর
মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে
তোমরা যাকে ‘হিপোক্রিসি’ বল সেইসব দ্বিভাব আমার মধ্যে প্রকট
কাঁপা হাতে জনপ্রিয় শব্দ সাজাই, নিঃশব্দে চিৎকার করি
লুটেপুটে নেই বিস্কুটের মত তোমাদের ছুঁড়ে দেওয়া সহানুভূতি
মনু, এইটুকু ছাড়া আর কি বা পারি বল ঠিকঠিক করে
পারলে তোমাদের কথা ভেবে স্বপ্নের ভিতর একদিন ঠিক মরে যেতাম।
নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ভাবনা
১
১৯৬২ সালের অগাস্ট মাসে একদিন বেমালুম উবে গেল একটা লোক।
তারপর কেটে গেল নির্ঝঞ্ঝাট সাত সাতটা বছর। তারপর একদিন আদালত তাকে ঘোষণা করে দিলে মৃত। এই নিয়ে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেললেন জাপান দেশের লেখক কোবো আবে। অথচ যতটা নির্লিপ্ত ভাবে এতদূর বললাম আদতে কিন্তু সেরকম নয়।
একবিংশ শতাব্দীর আমি ১৯৬২-র উপন্যাস পড়ি। ক্রমশ দ্বিধাগ্রস্ত হই। হারিয়ে যাওয়া তো হামেশাই ঘটে, নিরাসক্ত আবে লেখেন, প্রতি বছর জাপানে ফেরার হয় শয়ে’শয়ে মানুষ। বিগত ৫০ বছরে সফল ভাবে নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রক্রিয়া কি হারে জটিল হয়ে উঠেছে, এই বিষয়ে আবের সাথে আমার বিতর্ক চলে। তারপর সমীক্ষা খুঁজে দেখতে পাই ২০১৯ সালে জাপানে নিরুদ্দিষ্ট সাতাশি হাজারের সামান্য বেশি কিছু লোক। অথচ যতটা সহজে এই তথ্যটুকু লিখলাম আসলে কিন্তু তা নয়।
ভাবি অনায়াস প্রস্থান করব, তবু জোর করে কালো পোশাকের মানুষ। বালি চাপা রেখে যেতে বলে প্রত্নচিঠি ও বিগত ছাব্বিশ বছরের স্মারকসমূহ। বালিয়াড়ির ওপার থেকে দিকনির্দেশ করে সাতাশি হাজার নিরুদ্দিষ্ট হাত। সাতাশি হাজারের ভিড়ে আরও একজন হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ-ই মনে পড়ে, এখন আমার নিরুদ্দেশের জন্য অপেক্ষা করে নেই আর কোন লেখক, ঔপন্যাসিক।
২
দূর থেকে দেখতে আমার সচরাচর বেশ ভাল লাগে।
রাস্তায় পরিচিতদের দেখলে আমি ইদানীং নিজে থেকে ডাকি না;
তাদের আত্মমগ্নতা উপভোগ করি
দেখেছি বৃষ্টির ফোঁটা কি সহজ প্রকারে পুকুরের জলে লীন হয়; হাত বাড়িয়ে
সেই পরিণতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করে না আমার,
মনে আছে প্রিয় নারীরা যখন মৃদু হেসে এক এক করে তলিয়ে যাচ্ছিল
তাদের চিৎকার করে বাধা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি
এখন আমার গলায় কোন আওয়াজ নেই…
৩
প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে , শেষ বসন্তের এক বিকেলবেলায় আমার জন্ম হয়েছিল । অদ্ভুত কিছু নয়, তবু একটা ডুবন্ত সূর্য আর রাশি রাশি নিরুদ্দিষ্ট পাখিদের নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে খানখান করে একটি সদ্যোজাত শিশু কাঁদছে; এ দৃশ্যের কল্পনা আমায় আজও অভিভূত করে …
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন