রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১

রিনি গঙ্গোপাধ্যায়

                                     


এই সংখ্যার গল্পকার রিনি গঙ্গোপাধ্যায়৷


পাঁচভূত



প্ল্যানটা চলছিল অনেকদিন থেকেই! তবু কিছুতেই যেন দুয়ে দুয়ে চার করা যাচ্ছিল না। থুড়ি, চার নয়, পাঁচ। পাঁচভূত একসাত! কারো না কারো কোনো না কোনো অসুবিধে থেকেই যাচ্ছিল। আলাদা করে সকলের সঙ্গে সকলেরই যোগাযোগ আছে হোয়াটসঅ্যাপ এ, সোসাল সাইটে; আর ফোন তো আছেই। তবু স্কুলের পর আর পাঁচভূতের একসাথে দেখা করা,আড্ডা মারা হয়ে ওঠেনি। শনি-রবি ছুটির দিনেও কেন দেখা হয় না বলে যারা মন খারাপ করে থাকত একসময় আজ প্রায় এক দশকের ওপর হয়ে গেল তাদের দেখা হয়নি। এর-ওর বিয়েতে যদি বা উপস্থিত হয়েছে তবু একজোট হওয়া যায়নি নানা কারণে। স্কুলবেলার সেই এক বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি করে বসা পাঁচভূত আজ নিজের নিজের জীবনের পথে বিচ্ছিন্ন দিন যাপন করে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তের খবর দূরে থাক; জীবনের বড়সড় পরিবর্তনগুলোও আজকাল আর একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয় না। স্কুল পাশ করার পর কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে কতজনের সঙ্গে পরিচয় হল; সামান্য ঘনিষ্টতাও হল বৈকি! কিন্তু ওই পর্যন্তই! দীর্ঘস্থায়ী, নির্ভরযোগ্য বন্ধু আর জুটল কোথায়! হ্যাঁ,প্রেমিক জুটেছে, বর জুটেছে; কিন্তু বন্ধু! 'বন্ধু' শব্দটা বললেই ওরা আজও পিছিয়ে যায় সময়ের পথ বেয়ে। স্কুলবেলার লাল ফিতের বাঁধন এখনও ওদের আলগা হয়ে যায়নি।

সেই ছোটোবেলার মতো যথারীতি সবার আগে উপস্থিত হয়েছে ক্রন্দসী। ওর আর উর্বীর বাড়ি একই দিকে। তাই আসার সময় তাড়া দিয়ে উর্বীকে গাড়িতে তুলে নিয়েছে। শপিং মলে ঢুকেই ওরা চলে এসেছে ফুডকোর্টে। টেবিল-চেয়ার গুছিয়ে ছোটো একটা বৃত্ত তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের মতো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে উপস্থিত হয়েছে বহ্নিসখা। দূর থেকে ক্রন্দসী আর উর্বী কে দেখে এতোটাই উত্তেজিত হয়েছে যে ওর চিৎকারে আশেপাশের লোকজন পর্যন্ত ঘুরে তাকাতে আরম্ভ করেছে। ক্রন্দসীর সঙ্গে ওর প্রায় ছ'বছর বাদে দেখা হলো। 

কি রে! তুই এতো মোটা হয়ে গেলি কি করে! তোকে তো রাস্তায় দেখলে আমি চিনতেই পারতাম না!!

ক্রন্দসী হালকা হাসে; বলে, তুই তো একই রকম আছিস! একটুও বদলাসনি! সেই হৈ হৈ, চিৎকার! আজ যদি এখানে শর্মিলা দি থাকতেন তুই আজও বকা খেতিস!

বাবাঃ, কার কথা বললি!! উফফ, গোটা ইলেভেন টুয়েলভ জ্বালিয়েছেন! 

উর্বী বলে, মনে আছে, রোজ ক্লাসে এসে তোকে একবার বকুনি না দিয়ে উনি পড়ানো শুরু করতেন না!

তবে তার জন্য আমার কপালে প্রায়ই ক্যাডবেরি জুটতো,সেটা বল!

হ্যাঁ,আর প্রত্যেকবার তোর ক্যাডবেরির বেশিরভাগটাই গলাধঃকরণ করতাম আমি!

আরে!তুই কখন এলি! দেখি দেখি কি সুন্দর লাগছে রে তোকে!

বহ্নিসখা জড়িয়ে ধরে শুষ্মাকে। উর্বী, ক্রন্দসীও ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে। কান্না কান্না গলায় শুষ্মা বলে ওঠে,কত্তদিন পর!! 

ক্রন্দসীর চোখ ছলছল করে ওঠে।

ওরা চারজন গুছিয়ে বসে। উর্বী বলে,কিছু একটা অর্ডার দি? কি খাবি বল?

বহ্নি বলে, এখনই অর্ডার দিবি কি রে! আগে টলটলে কে আসতে দে! 

আরে তাই তো! স্রবন্তীটা এখনো এলো না কেন! ক্রন্দসী মোবাইলে স্রবন্তীর নম্বরটা ডায়াল করে।

আসছি,আসছি,এই আর দশ মিনিট!

তুই সেই লেটুই রয়ে গেলি রে! ফোন কেটে দেয় ক্রন্দসী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্রবন্তী এসে উপস্থিত হয়। আরে, আর বলিস না! আমার ছোটো টা কিছুতেই ছাড়বে না! আসবেই!

শুষ্মা বলে, নিয়ে এলে পারতি তো!

ওকে একা নিয়ে এলে হবে! বড়টাও তখন বায়না জুড়বে! 

বহ্নি বলে, দু'জনকেই তো আনতে পারতিস!

রক্ষে করো! ওদের নিয়ে এলে ওই দিকেই তাকিয়ে বসে থাকতে হবে! তোদের সঙ্গে কথাই বলা হবে না!

তা কেন! তুই কথা বলতি। আমরা সবাই মিলেই ওদের সামলাতাম! উর্বী চটে ওঠে।

ছাড় তো! সারাক্ষণ ভালো লাগে না। কতোদিন পর যে আমি একটু নিজের মতো বেরোলাম!

আচ্ছা বল কি খাবি? অর্ডার দিতে হবে তো? ক্রন্দসী তাড়া লাগায়।

বহ্নি বলে,আপাতত একটু ড্রিংকস নেওয়া যাক। আর কিছু স্ন্যাকস। দাঁড়া, আমি অর্ডার দিচ্ছি।

ওদিকে শুষ্মার ফোন বেজে উঠেছে, কি হয়েছে বন্ধু! তুমি কাঁদছ কেন! দিনদিন বকেছে! ওলে বাবা লে! আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দিনদিনকে গিয়ে বকে দেব। তুমি এখন নিজের মতো খেলা করো। বন্ধু তো আজকে ছোটোবেলার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে! হ্যাঁ,ওকে,তুমি ঘুম থেকে উঠেই বন্ধুকে দেখতে পাবে।ঠিক আছে! শুষ্মা ফোন কেটে দেয়। 

বহ্নি বলে, ও মা কি মিষ্টি! তোর মেয়ে তোকে বন্ধু বলে ডাকে!

শুষ্মা হাসে।

স্রবন্তী বলে, কেন রে বন্ধু ডাকতে শিখিয়েছিস? মা বলে ডাকলে কতো ভালো লাগে বল তো!

ক্রন্দসী বলে, মা বলে ডাকলে যে আবার বাবার খোঁজ পড়বে? তখন সামলাবি কি করে!

শুষ্মা বলে, হ্যাঁ রে, এমনিতেই সিংগল মাদার বলে নানা কথা শুনতে হয়! আমি অবশ্য বিশেষ পাত্তা দি না!

বহ্নি অর্ডার দিয়ে এসে কথায় যোগ দেয়, আসলে কি বলতো, আমাদের সমাজটা এখনও অতটা উন্নত হয়নি যে সিংগল মাদারকে মেনে নিতে পারবে! 

ঠিকই। ফার্টিলিটি সেন্টার থেকে যেদিন প্র্যাগনেন্সি পজিটিভ রিপোর্ট টা আনলাম সেদিন বাড়িতে বাবা-মা যেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছিল, ভাবতে পারবি না। 

উর্বী বলে, ওই সময়টা শুষ্মা নিজের বাড়িতেই এতটা একঘরে হয়ে গেছিল, বল! উর্বী হাত বাড়িয়ে দেয় শুষ্মার দিকে। আমার সঙ্গে তখন ওর রেগুলার কথা হতো!

হ্যাঁ,উর্বী ওই সময়টা খুব সামলে ছিল আমাকে। বাবা তো দ্যুতির মুখ দেখে প্রায় দশ মাস বাদে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।

কাকিমা তবু খেয়াল রাখতেন। উর্বী যোগ করে।

হ্যাঁ,মা খানিকটা বাধ্য হয়েই... আর শেষের দিকে জল ভেঙে খুব ক্রিটিক্যাল হয়ে গেছিলাম। তখন আর না এগিয়ে এসে উপায় ছিল না।

এখন বাড়ির পরিস্থিতি কেমন রে? ক্রন্দসী জিজ্ঞাসা করে।

এখন তো দ্যুতিকে একমুহূর্ত চোখের আড়াল করতে পারে না ওর দাদাই আর দিনদিন! সারাদিন ওকে নিয়েই কাটে!

তুই এতোটা রিস্ক না নিয়ে তো  একটা বাচ্চা এডপ্ট করলেই পারতিস! আমি তো শেষ অবধি তাই করলাম! বহ্নি বলে।

না রে, আমি ভীষণ ভাবে আমার নিজের বাচ্চা চেয়েছিলাম। যার মধ্যে আমার ছায়া দেখতে পাব আমি! 

এডপ্টেড চাইল্ডের মধ্যেও তুই নিজেকে খুঁজে পেতিস শুষ্মা। এই তো আমাকে আর ঋতকে রাস্তায় দেখে সকলেই মা-ছেলে বলে মিলিয়ে নেয়! বহ্নি ড্রিংকসে চুমুক দেয়। বলে, বাচ্চা তো কাদার দলা রে! যে পরিবেশে রাখবি তেমন করেই তৈরি হবে!

কথাটা কিছুটা ঠিক। সবটা নয় রে!  ছেলে-মেয়ের মধ্যে বংশের কারো জিন কাজ করবেই। এই দেখনা, আমার বর তো শান্ত।সাত চড়ে রা কাড়ে না! কিন্তু ছোটোটার যা রাগ, ভাবতে পারবি না! যেমন রাগ,তেমন জেদ। পুরোটা আমার শ্বশুরের মতো! স্রবন্তী ফিংগার চিপস খেতে খেতে বলতে থাকে।

আমারও সেটাই মনে হয়, উর্বী বলে। আমার বাচ্চাটা ওভাবে চলে যাওয়ার পর অনেকেই আমাকে এডপ্টেশনের কথা বলেছিল। কিন্তু আমার বর রাজি হয়নি। 

তোরা নিজেরা আর চেষ্টা করলি না কেন? ক্রন্দসী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উর্বীর দিকে।

করেছিলাম রে। কিন্তু... আমার ফার্স্ট প্র্যেগনেন্সির সময়ই ওভারিতে সিস্ট ছিল। ফলে আর...

তবে যাই বলিস না কেন! এডপ্টেড চাইল্ড সম্পর্কে তোদের ধারণাটা ঠিক নয়! বাচ্চা বাচ্চাই হয় রে! ঠিকমতো শিক্ষা-সুবুদ্ধি দিতে পারলে বাচ্চার মধ্যে জন্মগত কোনো প্রবণতা থাকলেও সে সেটা ওভারকাম করে যেতে পারে।

না রে বহ্নি, মেরিট, স্বভাব সব দিক থেকেই একটা পার্থক্য থেকে যায়! যদি ভালো হলো তো হলো! কিন্তু যদি খারাপ হয়,তখন সান্ত্বনার জায়গাটাও থাকে না! উর্বীকে বিষন্ন দেখায়।

 ্ই্্ই্ই্্্ই্্ই্ই্্ই্্ই্ই্্্ই্্ই্ই্্ই্্ই্ই্্্ই্্ই্ই্্ই্্ই্ই্্্ই্্ই্ই

স্রবন্তী বলে, তোদের ফাঁকা ফাঁকা লাগে না? সাধারণত তোদের মতো কাপলদের মধ্যে কিন্তু এডপ্ট করার প্রবণতা টা বেশি থাকে!


অয়ন ওর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বেশির ভাগ সময়ই ট্যুর থাকে ওর। আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। কখনো ইচ্ছে না হলে মা'র কাছে গিয়ে থাকি। উর্বী স্ট্রটাকে ড্রিংকসের গ্লাসে নাড়াচাড়া করতে থাকে।

শুষ্মা আর ক্রন্দসী একে অপরের দিকে তাকায়। খানিকটা কথা ঘোরানোর জন্যই শুষ্মা বলে ওঠে, তোর কি খবর বলতো ক্রন্দসী? বিয়ে করছিস কবে?

তোদের মনে হয় আমি বিয়ে করবো আর!

স্রবন্তী বলে, কেন নয়! বিয়ের বয়স কি তোর পেরিয়ে গেছে?

আজকের দিনে কি আর সত্যি সত্যি বিয়ের বয়স বলে কিছু হয়! বহ্নি বলে।

শুষ্মা বলে দাঁড়া দাঁড়া, অনেকক্ষণ তো হলো! লাঞ্চ করবি তো! আগে অর্ডার টা দি। তারপর না হয় ক্রন্দসীর পেট থেকে কথা বার করা যাবে!

উর্বী আর শুষ্মা মিলে খাবার অর্ডার করতে যায়। স্রবন্তী বলে শোন না, এই সুযোগে আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম গরম খাবার হাতে উপস্থিত হয় ওরা। স্রবন্তীও চলে এসেছে। বহ্নি বলে, কি রে! আমরা তো এখনো অবধি একটা ছবিও তুলিনি। শিগগিরি সেলফি তোল! আর শোন স্বপ্না দিকে কিন্তু পাঠাতেই হবে ছবি উইথ ক্যাপশান... পাঁচভূত এখনো একসাত!!

সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। ওদের কলরবে আশেপাশের লোকজন বারবার দেখতে থাকে। উর্বী বলে,কি রে তোরা! স্কুল পেয়েছিস না কি! এতো চেঁচালে আমাদের গার্ড দিয়ে বার করে দেবে।

ধুর! ভয় পাচ্ছিস কেন! এতো দিন পরে দেখা হলো,একটু হৈচৈ করব না! 

স্রবন্তী বলে, শোন, বেশি কিছু বলতে এলে আমরা ছোটো বেলার মতো আবার অপারেশন চালাবো! এই তোদের মনে আছে, নাইন সির কতগুলো মেয়ে এসে মধুজা কে ভয় দেখিয়েছিল!

শুষ্মা বলে হ্যাঁ, হ্যাঁ, কি যেন হয়েছিল ?

আরে মনে নেই নাইন সির একটা মেয়ের দাদার সঙ্গে মধুজা লুকিয়ে প্রেম করছিল।

উর্বী বলে, হ্যাঁ মনে আছে আমরা পাঁচভূত ওদের ওপর কেমন চড়াও হয়েছিলাম।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ,ঠিক, বহ্নি তুড়ি দিয়ে হেসে ওঠে।

স্রবন্তী বলে,তাহলে আমরা তো আজকেও একসাথে। কেউ কিছু বলুক দেখি!

ক্রন্দসী বলে, হ্যাঁ,কেউ কিছু বললেই স্রবন্তী টলটল করতে করতে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাবে!

সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

ওরা গুছিয়ে বসে খেতে শুরু করে। শুষ্মা বলে,এই মধুজার খবর কি রে!

মধুজা তো বাইরে থাকে। অস্ট্রেলিয়ায়। দুটো বাচ্চা। স্রবন্তী নান পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে জবাব দেয়।

ও, ওরও দুটো। গীতালিরও দুটো জানিস তো। বহ্নি যোগ করে।

 কোন গীতলি?

আরে,ওই যে রে, মাধ্যমিকে প্লেস পেলো। উর্বীর প্রশ্নের উত্তরে জবাব দেয় বহ্নি।

ও, ও তো ইউ এস এ তে থাকে, তাই না!

হ্যাঁ রে, ও ,সমীপর্ণা, ওরও দুটো। বাইরে যারা আছে তাদের বেশির ভাগেরই দুটো বাচ্চা। শুষ্মা জানায়।

আসলে কি জানিস তো, এখন যে লাইফস্টাইলে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি ধীরে ধীরে সেখানে তো একজন মানুষ আরেকজনের থেকে চূড়ান্ত বিচ্ছিন্ন, তাই না! বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও আজকাল আর তেমন স্ট্রং নয়।অন্তত সিবলিংস থাকলে তারা একে অপরের মনের কাছাকাছি হলেও হতে পারে।

ঠিক বলেছিস ক্রন্দসী। আমি তো ওই জন্যই দুটো বাচ্চা নিলাম। অন্তত আমাদের অবর্তমানে ওরা দুজনে দুজনের জন্য থাকবে। স্রবন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতে তবু দুটো বাচ্চা নেওয়া যায়। ওদের ওখানে কত রকম ফেসিলিটি রয়েছে। আর আমাদের এখানে জনসংখ্যার অবস্থাটা ভাব! ক্রন্দসী বলে,দেখবি একটু শিক্ষিত সমাজে কিন্তু একটা-দুটোই থাকে। আর ফুটপাতগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ? পালে পালে জন্মাচ্ছে। সব কিন্তু হয় ভিক্ষে করবে ,না হয় শিশুশ্রমিক!

উর্বী বলে, লোকাল এনজিওগুলোতে খোঁজ নিলেই জানতে পারবি শুধু কলকাতা শহরেই এই সংখ্যাটা কত!

ক্রন্দসী বলে, জানিসতো, আমি কলেজের পরে এইরকম কিছু এনজিও তে যাই, বাচ্চাগুলোকে পড়াই... ভালো লাগে। ওখানেই শুনছিলাম এতো বাচ্চা দিনের পর দিন অবহেলায় বড় হচ্ছে যে আমরা যদি একটু এগিয়ে আসি ওরা তাহলে অন্তত লেখাপড়াটা করতে পারে!

ও, তুই আবার কলেজের পর এসব করিস না কি!

ক্রন্দসী স্রবন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ, ভালো লাগে ওদের কাছে যেতে।

তা তুই তো নিজেই একজনকে এডপ্ট করলে পারতিস?

ক্রন্দসী বলে, না রে বহ্নি, একজনকে যত্ন করে বাড়িতে আনলেই তো আর সমস্যাটা মিটবে না! বললাম না সংখ্যাটা অগুন্তি।

না,সে তুই ওদের জন্য যতটা পারিস কর না, তার সাথে তোর নিজের বলেও কেউ থাকল! কাকিমার পর তুই তো একদম একা! শুষ্মা ক্রন্দসীর পিঠে হাত রাখে।

না রে, একটা বাচ্চার দায়িত্ব ওভাবে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। আমি তো আমার লেখালেখি,কলেজ, এনজিও এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাচ্চাটাকে সময় দেব কি করে!

আরে কাকিমা তো আছে! স্রবন্তী টেবিলে চড় মারে।

, মায়েরও তো বয়স হয়েছে! মা'র পক্ষে আর সম্ভব না। তাছাড়া যতদিন বাড়িতে থাকবে ততদিন একরকম! যখন স্কুলে ভর্তি হবে! বা পাশাপাশি একস্ট্রা ক্যারিকুলার এক্টিভিটির জন্য নানা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে তখন মা কি করে পারবে! আর আয়ার হাতে আমি বাচ্চাকে ছেড়ে দেব না। সত্যি কথা বলতে, সারাদিন বাদে বাড়ি ফিরে বাচ্চার ধকলটা আমার পোষাবে না!

এভাবে বলছিস কেন রে! দেখনা আমার দুটো তো সারাদিন মারপিট, দুষ্টুমি করেই চলেছে। আমিও হয়তো রাগের মাথায় দু-চার ঘা বসাই। কিন্তু দিনের শেষে যখন মা বলে জড়িয়ে ধরে কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দেয়, তখন অদ্ভুত একটা স্যাটিসফেকশান আসে।

দেখ স্রবন্তী,কিছু মনে করিস না,কথাটা আমি তোকে বলছি না, আমার পরিচিত আরো কতগুলো পরিবারের সূত্রেই বলছি, বাচ্চা কিন্তু শুধু স্যাটিসফেকশন বা আদিখ্যেতা দেখানোর জন্য নয়।একটা বাচ্চাকে বড় করতে গেলে অনেক প্ল্যানিং লাগে, ম্যাচিউরিটি লাগে। আমি এক বাবা-মাকে চিনি যারা পুরোপুরি আনপ্ল্যান্ড ওয়েতে একটা বাচ্চা এনেছে; বাচ্চাটাকে কি খাওয়ানো প্রয়োজন, কিভাবে খাওয়াতে হয় তাই তারা জানে না! সারাদিন শুধু বাচ্চার ভিডিও তুলে চলেছে! এভাবে বায়োলজিক্যালি বাবা-মা হয়ে একটা বাচ্চাকে বিনা যত্নে বড়ো করার তো কোনো মানে নেই! আর একটা বাড়িতে আমি দেখেছিলাম জানিস, বাচ্চা কে নিয়ে বাবা-মা গবেষণায় নেমেছে। তাঁরা বাচ্চাকে ভালো-মন্দ কোনো শিক্ষাই দেয় না। বাচ্চা নিজেই নাকি বড়ো হতে হতে সেসব বুঝে নেবে।তার ফলটাও হয়েছে তেমন! বাচ্চাটা অসভ্যের চূড়ান্ত। কারো কথা শোনে না। ক্রন্দসী উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

বহ্নি বলে, ঠিকই বলেছিস। আদর, যত্ন তো একটা ব্যাপার বটেই। সেই সঙ্গে যত বড়ো হবে তত মানসিকতার পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে অ্যাডোলেসেন্সের পিরিয়ডটায় একটা বাচ্চার প্রতি অনেকটা অ্যাটেনশন দিতে হয়।সেটা ওয়ার্কিং মাদারদের পক্ষে বেশ অসুবিধার।

সত্যি কথা বলতে কি আমিও কিন্তু সিংগল মাদার হিসেবে আমার বাবা মায়ের ওপর এ ব্যাপারে পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট। শুষ্মা মাথা ঝাঁকায়।

উর্বী বলে,দেখ একদিক থেকে ক্রন্দসীর কথা কিন্তু ঠিক। একটা বাচ্চার জন্য ইনভেস্ট না করে যদি সেই ইনভেস্টমেন্ট ও পরিশ্রমে অনেকগুলো বাচ্চাকে হেল্প করা যায় সেটাই বেটার।

আর কি জানিস তো, দিনের শেষে আমরা সবাই একা।আজ তোরা যে সন্তানদের বড় করছিস নিজেদের সবটা দিয়ে একদিন সে আরো ভালো কিছু করার জন্য তোদের ছেড়ে এখানে ওখানে চলে যেতে বাধ্য হবে। তোরাও কোনোভাবেই তার উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবি না। তখন তো সেই একা! এই একাকীত্ব আমাদের মেনে নিতেই হবে রে। ক্রন্দসী স্রবন্তীর হাতে হাত রাখে।

স্রবন্তী মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।

বহ্নিই বলে ওঠে, সত্যি দেখ, আমাদের ছোটোবেলাটা নিয়ে কি আমাদের বাবা-মারা এতো জটিল করে ভেবেছে! অথচ আমরা ভাবছি, ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।পৃথিবীটা কেমন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে।

ওরা সকলেই কেমন থম মেরে থাকে কিছুক্ষণ। নিজেদের অসহায়তাগুলো নিয়ে নিজেদের মনে নাড়াচাড়া করতে থাকে। এক বেঞ্চে ঠেসেঠুসে বসা এই পাঁচটি মেয়ে এদের আগামী প্রজন্মের জন্য কোন্ পৃথিবীকে রেখে যাচ্ছে তা নিয়ে বিপন্ন বোধ করে। এই প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় তাদের ছেলেমেয়েরা সত্যি আর কোনো বন্ধুকে খুঁজে পাবে কি না তারা জানে না। পাঁচবন্ধুকে পাওয়া তো দূরস্ত! সেই বিচ্ছিন্ন এককের কি সেই মনের জোর থাকবে যার দৌলতে তারা একা একাই পেরোতে পারবে জীবনের বন্ধুর পথ। জানে না;  তারা জানে না। তাই শুধু আশঙ্কা আর আতঙ্ককে সম্বল করেই তাদের গড়ে তুলতে হবে তাদের আগামী প্রজন্মকে; আরো এক ক্ষণভঙ্গুর প্রজন্মের জন্য।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন