এই সংখ্যার কবি সোনালী মিত্র।জন্ম ১৯৮৬ সালের ১৮ ই নভেম্বর নবদ্বীপ নদীয়ায়।এম এ পাশ করার পর কিছুকাল স্কুল শিক্ষকতায় নিযুক্ত থাকলেও বর্তমানে দিল্লিবাসী।লেখালিখি শুরু সেই স্কুল পত্রিকা থেকেই।বর্তমানে বহু পত্রিকায় লিখে চলা। সাহিত্য মূলক পত্রিকা "মায়াজম" এর হোতা তিনিই। প্রিন্ট এবং ওয়েব দুটি ভার্সনেই প্রকাশ হয়ে থাকে পত্রিকাটি। " স্পর্ধাকাল" তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ।
১) রানওয়ে /
ইদানিং মৃত্যুর পর আর জন্ম নিতে ইচ্ছে করে না
জন্ম মানেই একটা অজানা হারেম থেকে
লোকায়ত অদৃশ্য রাজা- বাদশার হারেম ! জন্ম নিলেই
সেই তো ঘোড়া , সেই তো হাতি, দাঁতে শান দেওয়া জন্তু জানোয়ার !
সেই তো হাজার ওয়াট মৌলবাদী লোলুপ থাবা
এর আগে কিছু নেই , পরে চিতাকাঠ
ছাই , ধোঁয়া , কার্বন
যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ
অনর্গল শ্বাসে মিথেন।
নদী ভেসে যাওয়া অসময়ের বৃষ্টি
শূন্য রানওয়ে
কয়েক কয়েক কয়েক কোটি হায়না দৌড়ে যায়
শূন্য মানুষের দিকে
শূন্যর দিকে…
****************************** ******
২
নেই কাব্য
না দানে , না ধ্যানে আমি কোথাও নেই ।
#
না রক্তদানে , না বন্যাত্রানে । না দয়ায় , না দাক্ষিণ্যে ।
আমি ঠিক যেন কোন ভূমিকাতেই নেই
না গরিষ্ঠ নায়কে না জ্ঞান বিতরণে
না পুজো প্যান্ডের ডালের হাতায় না সংসারের ছ্যাঁচড়া চাকায়
না মঞ্চের কেন্দ্রে না না , মঞ্চের পিছনে ।
#
লোকে আতেল বলে , অধঃপতনে সিদ্ধ বলে ।
কবিতা পাঠের শেষে হাততালি দিতে ভুলে যাই বলে
ইদানিং মহাকবিরা ডাকে না আর ,
কেরোসিনের লাইন দেখে আগুন আগুন চিৎকার করি বলে
রেশনকার্ড থেকে নাম বাদ গেছে আমার ।
#
প্রতিদিন দরজা বন্ধ ঘরে আত্মহত্যামূলক শব্দ দিয়ে
শরীরে পিন ফুটিয়ে প্রত্যক্ষ করি রক্ত ও শিরার ভালোবাসার গভীরতা
মৃত্যুর অভিনয়ের নাম জীবন - দুবার খাতায় লিখে কাটি
#
আমি জন্মে নেই , মৃত্যুতেও নেই । শোকে বা আনন্দে
শ্বাসে নেই , দীর্ঘশ্বাসে নেই , গাঁয়ে নেই শহরে
রাস্তায় হেঁটে যাই , বাচ্চারা পাথর ছোঁড়ে
আমি পাগলে নেই , প্রলাপেও নেই । তবু লোকে পাগল বলে ...
****************************** ********
৩
গন্তব্য
একত্রিশ বসন্ত ধরে হাঁটছি
দারুচিনি নির্জন দ্বীপে,প্রাক্তন প্রেমিকদের বলিষ্ঠ বাহুরেখায়
কত কি যেন তীব্রভাবে পেতে চেয়ে কান পাতে থাকি,
অচেনা বাঁশিওয়ালার সুরে!
আসলে কিই যে পেতে চাই গন্তব্যের দিকে!
শুনতে পেলাম কি পেলাম না,তুমি কি অসুস্থ বলে ডাকলে?
ওষুধের ধারাভাষ্য মিলিয়ে রোগ নির্ণয় লিখে রাখ,
অযথা জটিলতা নিয়ে,ক্ষয় নিয়ে,তার বিস্বাদ নিয়ে
বজ্র বিদ্যুৎ ছোটাও ঘরেলু ঝড়ে
আর বৃষ্টি মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড় আফিম খেতে।
আমায়ও আফিম ঘুম দেবে?
প্রেমিকের তৃপ্ত অবগাহন লেগে থাকবে একজন্ম সুস্থতায়।
****************************** *************
৪
শাকম্ভরী
তোমার চুলের রঙ সোনালি, তুমি নাবিক তুমি জলদস্যু।জন্মসূত্রে পাওয়া নীল চোখ নিয়ে পর্তুগাল থেকে ভেসেছিলে সমুদ্রে , ভরা তুফানের রাতে তোমার স্বপ্নে জেগেছিল ডাঙা। বহুদিন পরে বহুপথ ঘুরে তোমার জাহাজ নোঙর ফেলেছিল নারকেল বনের কাছে ।
#
সেখানে ভাঙা মন্দিরঘাট ,বিষ্ণুসত্যের দেবতা উলঙ্গ দেবীর থান আর খালিগায়ে নেংটি পরা মানুষের জঙ্গল । তুমি প্রেমঅজ্ঞপুরুষ , দুপাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে গাংচিল , সওদাগরি নৌকা ,তুমি রেশম থেকে খুঁটে নিচ্ছ বাংলা অপভ্রুংশের গৌরব।তোমার নামের পাশে লেখা হচ্ছে ভারত আবিস্কারক ।
#
আমি চন্ডালজাতিকা , শবরীগন্ধী।গুঞ্জরীমালী শরীরের কোণে কোণে। ভিজে কাপড়ে লেপ্টে থাকা শ্যামলা বুকের ইউরোপিয়ান শিল্পকলা ,আমার দেহের ভিতরে লুকনো স্যান্ধভাষার পদটিকা, ভূমি দখলের চিহ্ন।
#
তুমি ডোম্বিনীর অরণ্য ভাঁজে মুখ ঘষে খুঁজে চলেছ আমার পূর্বপুরুষের সংগ্রাম ,মোঘলের ধ্বব্জা , তোমার পূর্বজের অভিসম্পাত।এখানেই ভাসাও বজ্রা, খুঁজে নাও বঙ্গ, পুণ্ড্ৰ,হরিকেল,সমতট।
#
আমি গাছের আড়াল থেকে তোমাকে দেখি
সমুদ্রনীলের মতো তুমি নেশা। তোমার স্ত্রী দূরে , ছেলেপুলের মুখ দেখনি কতকাল। কোন এক ঝড়জলের রাত এনে ফেলুক তোমার এই শ্যামলা নাভিপ্রভায়। পৃথিবীর সব সমুদ্রই নারীর বুকে ভিতরে থাকে , ভেসে যেও।
****************************** ************
৫
নেশা
কবিতার সত্যমিথ্যা জানি না
কবিতায় আছে ব্যথার প্রলেপ , যুদ্ধবাজ রাফেল
গরুমারা অভয়ারণ্য , উন্মত্ত যৌনতা , নষ্ট বীর্যের ছলনা
কলের জলে বইয়ে দেওয়া বিকলাঙ্গ সন্তানের দায়ভার।
এসব কোথা থেকে পেয়েছি জানতে চেও না
তুমি কী চাও আমি জানি
মিথ্যার এসব উপকরণ খাদ্য , তোমাদের সম্বল
#
পাঠ কর পাঠক
আধখোলা যুবতীবুকের ডালিম জানি , খিদে পেলে
ডানা ঝাপটানো পাখিকেও চিনি
রাত নামলে যেসব চাঁদ সস্তা হয়ে যায় টাকার কাছে
তাদেরও চিনি , যাদের লুকিয়ে রাখা যায় মানিব্যাগের ছায়ায়
#
পড় পাঠক পড়
তুমি মিথ্যে প্রতারণায় খুঁজে পাও রাধাঘাট , একাডেমি ও সম্মান
আমি মিথ্যের সৃষ্টি জানি , সত্যির মধ্যে কিছুটা মিথ্যে মেশালে নেশার
ঘনত্ব বড় পাতলা
নিজেকে মিশিয়ে মিশিয়ে মিথ্যের সাথে ভাসিয়ে দিই সত্যতা।
#
নেশা কর পাঠক
কারণ আমি জানি না যতটুকু তুমি জানো
আমি লিখি তোমারই খননের কথাগুলো, জানা কথাগুলি
************★*****★*********** *****
৬
টার্গেট
বাবা তার যুবকবেলার বিশটা বছর ধরে শুধু যুদ্ধে লড়বার স্বপ্ন দেখে গেলো
বাবা বিশ বছর ধরে মুর্গী লড়াইয়ে বাজি রেখে দৌড়ে মরেছিলো
স্বপ্নদোজখের মধ্যে গামবুটসহ পায়ে শক্রু শিবির জিরো পয়েন্ট টার্গেট ,
সৈনিক হবার ব্যর্থ স্বপ্নের ভিতর খিদে আর বুলেট নিয়ে
বাবা লিখে ফেলেছিলো ২৪৫ টি বতন - এ -
গুলদস্তা
ফৌলাদি সিনা থেকে , বাবার শ্রমবিবর্ণ ফুটিফাটা পাঞ্জা থেকে চামড়া ছাড়ানোর উৎকট গন্ধ বের হয়
দেশ শান্ত হলে মা যত্ন করে মুছিয়ে দেন ঘর লাগোয়া রক্তের অপবাদ
অথচ আমাদের কুসুমকলি শিং নাড়িয়ে বকনা বিয়োলেই মহল্লায় মিঠাই বাটেন বাবা
গলায় ঘন্টি পড়িয়ে আদর করে নাম দেন তার 'আজাদ'
গাই কিচ্ছু বোঝে না , বাবাও না , বড় বড় চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে শুধু একে অপরের দিকে
আমরা বুঝি , বাবার স্বপ্ন -
যুদ্ধ নেমে আসে আমাদের রেশনের লাইনে ,
ভোটার কার্ডের থাপ্পায় , নামাজ পাটির চৌকাঠে
রোজ যুদ্ধ লিখে কাটি , শরীরের ফুটে থাকে পিন 'কাফের'
বাবা স্বপ্নের ভিতর , পতাকা উড়িয়ে বলেন , জয় হিন্দ জয় হিন্দ জয় হিন্দ
****************************** **************
৭
ঈশ্বরের খিদে
ঘরে ফেরা পাখির ডানায় গোধূলিআলোটুকুর
আয়ুকাল সুখ নামে ডাকি
ভোরশিশিরের শরীরে মিশে ছিল রোদের স্বার্থ
আত্মাবিসর্জন ও অন্ধকারের মধ্যে ফারাক যতখানি
ঠিক ততখানির মধ্যে আমাদের শ্বাসঘাত অবিরাম
ঘাসেদের শরীর ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছে খোকন...
খোকনের হাতে ঢোলকলমির ডাল ,সাঁইসাঁই ছুঁড়ে দিচ্ছে
আকাশমুখীন ,হাতের চলনের ছিঁড়েখুঁড়ে দেয় আগাছার যতশোক
শোকের ঊর্ধ্বে ঈশ্বর ,ঈশ্বরের পেটে সর্বগ্রাসী খিদে
সূর্যফুল ফোটার সাথে মায়ের আঙুল ও সিঁদুরের
টান ছোঁয়ায় বৃদ্ধি পেল সংসার আয়ুরেখা।
বাবার গায়ে বুনোফুলের গন্ধ ,বাবার হাতে ঘি আগুনের গন্ধ।
বাবার বাঁশ ও ঠেলা আগুনের তোড়ে মায়ের উষ্ণ ভাতের স্নেহ।
বটগাছ থেকে শ্মশান পর্যন্ত নিভে যাচ্ছে খোকনের পুতুলসংসার।
★★**************************** ★******
৮
একটা আঁচলের নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
গোলাপি আঁচল খসে গেলে বিধ্বংসী ঝড় ওঠে
পুরুষদ্বীপে , আসমানি দেবতা দোলে ঝড়ের দোলনায়
তোর আঁচল খসে গেলে কদম্বতরুতলে আড়বাঁশিতে
ভিখারি মাধব , উড়ে যায় শখের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
ওই,আঁচল খসে গেলে রাজা দেখে প্রজার ঘরে অফুরন্ত ধন ,
গুপ্তঘাতক অস্ত্র নামিয়ে ভক্ত বনে যায়
সনাতন আঁচল খসে গেলেই কে আপন কে পর!
দাদার হাতে বাবার চোখে আঁচলখোলা রাধিকার যৌবন ।
তোর,আঁচল খসে গেলে শিরায় শিরায় রাসায়নিক
যুদ্ধ প্রস্তাব , ঘাপটি মেরে প্রধানমন্ত্রী হালুমের প্রত্যাশায়
আঁচল খসে গেলে কে সীতা কেই বা দ্রৌপদীর বর
লোলুপজঙ্গলে সকলেই বাঘ , যতই তোর চোখে
থাকুক ধুলোবালির বৃন্দাবন ।
****************************** *********
৯
জন্মদিনের গল্প
বারোতম বছরের জন্মদিনে বাবা একটা স্টপ ওয়াচ দিয়েছিল
বলেছিল , সময় হিসাব করে খরচা করতে হয়।
মা ,কাকিরা একটা ফুলতোলা নক্সা কাটা ওড়না দিয়ে
বলেছিল মেয়েদের লুকিয়ে রাখতে হয় এর মধ্যে ।
পুতুল খেলা ঘরে সুব্রত বলেছিল কি দেবো তোকে বল ?
বুকের শুঁয়োপোকা দিয়ে দিলাম তোকে
খুব ভয়ে পেয়েছিলাম , সব দামি উপহারের মধ্যে
ওটা ছিল কুৎসিত ও হুলফোটানো দায়ক
ষোলতম জন্মদিনে চমকে গিয়েছিলাম
সেই শুঁয়োপোকাটা দিব্যি ডানা মেলে প্রজাপতি!
দারুণ লজ্জা আর সোহাগী আবেগ , কোথায় লুকাই !
কোথায় রাখি এই অদ্ভুত শিহরণ ?
অথচ সুব্রতদা শুঁয়োপোকাকে কি উড়তে দিতে চেয়েছিল ,
অথচ আমি কি বেড়ি দিয়েছিলাম পায়ে ?
আবার এক জন্মদিন এল আমার তেইশ বছরের
বিসমিল্লার সানাই সন্ধ্যা বুকে নিয়ে ছাব্বিশ বসন্তের
বুকে মুখ রেখে যখন খুঁজতে চাইছিলাম
প্রজাপতিটা কোথায় উড়ছে , উড়ছে কি কোন
নীলপাঁজরের ঘায়ে...
সুব্রতা দা আজকাল নাকি কবিতা লিখছে
খ্যাতির চুড়ায় অসংখ্য তার ময়ূর পালক
এখন নাকি অনেক প্রজাপতি ওর কবিতার খাতায়.....
****************************** ******
১০
মৃত্যুকালীন কাব্য
এত লোভ দেখাবেন না ঘাতক ...মৃত্যু এবং আমায়
সফেদ জ্যোৎস্নায় ঝলকে উঠছে আপনার উদ্ধত তরবারি
পবিত্র স্নান সেরে বসে আছি নগ্ন শরীরে
স্রোতের উজানে কপালে লাল তিলক, পেলব গ্রীবায় দোদুল্য জবার মালা
প্রিয় ঘাতক,এই গোলাপী গুহায় জেগে আছেন ঈশ্বরী,
অলৌকিক কবিতাদের জন্ম দান করুন এই কামাক্ষ্যাতট ছুঁয়ে
ঘাতক,রেশমী ঘাসের সুরম্য অরণ্যে কোন হেমলক রাখা নেই।
স্বর্গের খুব কাছাকাছি থাকে নরক,এসব ভেবে নষ্ট করবেন না সময়
অমরাবতীতে ধুয়ে নেবেন হন্তারক অস্ত্রসমূহ
কথা দিলাম,গোপন থাকবে কবিতা এবং হত্যা বিষয়ক অভিযান।
প্রিয় ঘাতক,
অন্তিম চিতার ভিতর শুয়ে যথার্থ একটি কবিতাই তো হতে চেয়েছিলাম।
খুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুনএক একটা লেখা তো নয়, যেন বারুদ! দুর্দান্ত রে।
উত্তরমুছুনএক একটা লেখা তো নয়, যেন বারুদ! দুর্দান্ত রে।
উত্তরমুছুন