রবিবার, ১৩ জুন, ২০২১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                



ষষ্ঠ পর্বের পর 


 #৭

সেদিনের আনন্দ ফিকে হয়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না যদিও। রাতেই টিভির খবরে লকডাউনের ঘোষণা শুনল সারা গ্রাম। পাগলের মতো ট্র্যাভেল এজেন্টদের ফোন করা শুরু করল সামুয়েল আর অভিজিৎ। অভিজিৎ তার চেনা সূত্রের সকলকে ধরাধরি করল, তবুও কিছু উপায় বেরল না। দুদিনের মধ্যে টিকিট পাওয়া গেল না সামুয়েলের। তার যাওয়া আপাতত স্থগিত হল। নিরুপায়, অসহায় সে কী করবে ভেবে পেল না। সে এতই হতাশ হয়ে পড়ল যে, সকালে উঠে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াবার কথা পর্যন্ত মনে পড়ল না ওর। অভিজিৎ নিঃস্পন্দ হয়ে বসে রইল। বাড়ি জুরে শোকের ছায়া নেমে এলো যেন! কেউ আর সামুয়েলের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। কী বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে সেও ভেবে পাচ্ছে না। কবে লক ডাউন উঠবে, কবে অতিমারির প্রকোপ কমবে, কেই বা জানে। এই অবস্থায় কী করণীয় এখন কেউ জানে না। যে বাড়ি ফেরার আনন্দে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে মনে করে সামুয়েলের মন খারাপ হচ্ছিল, সেই গ্রাম এখন তার কাছে বিষ হয়ে উঠল। দেশের অবস্থাও ভালো না। আত্মীয় স্বজনের অকাল মৃত্যুর খবর পাচ্ছে যেটুকু তাতেই ও বুঝেছে, ব্যাপারটাকে আর লঘু করা যাবে না। বা যাচ্ছে না। সারা পৃথিবী জুড়ে এক সঙ্কটকাল এসে উপস্থিত।

সারাদিন কেটে গেল। বিকেলে কফি নিয়ে বুলবুল এলো সামুয়েলের ঘরে। কফি রেখে কিছু বলবে বলে উশখুশ করছিল ও। কিন্তু কী যে বলবে সেটাই ভুলে গেছে এখন। সামুয়েলের মুখে কেউ যেন একপোঁচ কালি ঢেলে দিয়েছে। অনেক চেষ্টার পর বুলবুল অস্ফুটে বলল, ‘কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খাও’। ম্লান হেসে কফিতে চুমুক দিল সামুয়েল। অনেক শক্তি সঞ্চয় করে এবার বুলবুল ফরফর করে বলতে শুরু করল…’লক ডাউন হয়েছে তো কী হয়েছে? তুমি কি আমাদের গ্রামে আর কটা দিন থাকতে পারবে না? এই গ্রামের মানুষ, আমরা সবাই তো তোমাকে ভালোবাসি। আপন মনে করি। তাহলে অসুবিধে কোথায়? মানছি, বাড়ির জন্য মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দেশে, বিদেশে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছ। বাড়িতে আর কদিন থাকতে? দেশে ফেরার উপায় যখন নেই তখন এখানেই মানিয়ে গুছিয়ে থেকে যাও। আমরা হয়ত গরিব, তবু তোমার আদর যত্নের অভাব কখনও হবে না, এটুকু আমি জানি’। বুলবুলের কথার তোরেই হোক, আর কফির প্রভাবে সামুয়েল চাঙ্গা হয়েছে কিছুটা। এবার বুলবুলের ঠানদি মার্কা কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল। ওকে হাসতে দেখে বুলবুল অবাক। ‘হাসছ যে বড়? আমি কি হাসির কথা বললাম?’ হাসি চেপে সামুয়েল বলল, ‘খুব পাকা হয়েছে তো! এমন গিন্নিবান্নিসুলভ কথাবার্তা বোধহয় মেয়েরাই বলতে পারে। যাক্‌, তুমি ঠিকই বলেছ, থাকতে যখন এখানে হবেই, তখন আর মন খারাপ করে লাভ নেই। নাও এই গানটা শোন…’    

Yo no sé por qué a veces me pierdo
Los ojos se me dan vuelta y me muero por dentro
Y me encierro otra vez y no puedo salir
No puedo ver lo lindo de cada momento

গান থামিয়ে বুলবুলকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই সামুয়েল বলতে থাকল…

‘আমি জানি না কেন আমি মাঝেমাঝে হারিয়ে যাই

আমার চোখ মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়ায় আর তার ভেতরে আমি মরে যাই

আবার আমি নিজেকে বন্দি করে ফেলি আর কোথাও যাই না

প্রতিটি মুহূর্ত যে কত সুন্দর আমি দেখতেও চাই না…’      

 

‘কিন্তু এবার আমি মরে যাব না কিছুতেই। প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করব চোখ খোলা রেখে। এই গ্রামের সবটুকু আমার চাই!’ এই বলে সামুয়েল বুলবুলকে কাছে ডাকল হাত বাড়িয়ে। খানিক ইতস্তত করে বুলবুল কাছে এলো বটে। কিন্তু ওর মুখ দেখেই বোঝা যাছিল ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সামুয়েলের গান, আবেগ ওকে স্পর্শ করেছে আগেই। এরপর সামুয়েলের হাতের স্পর্শ পেয়ে সে থরথর করে কেঁপে উঠল। সামুয়েল ওর হাত ধরে ধীরে ধীরে, কেটে কেটে উচ্চারণ করল—‘তুমি আমাকে যত্ন কর। তুমি আমাকে এভাবেই আলো দেখিও’। কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে বুলবুল দৌড়ে এ ঘর থেকে চলে গেল আচমকা। ওর যাওয়া দেখতে দেখতে সামুয়েল আবার কোলে গিটার তুলে নিল। কী একটা গানের সুর বাজিয়ে চলল একটানা।    


1 টি মন্তব্য: