শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

অঙ্কিতা সরকার


#শিক্ষা


         "রূপ তেরা মাস্তানা,পেয়ার মেরা দিওয়ানা,
          ভুল কোই হামসে না হো যায়ে।।"
          চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গানটা কানে এল পেখমের। রোজই আসে। আর রোজই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় ও। আসলে পড়াতে যেতে গেলে এই রাস্তা ছাড়া যাওয়ার কোন রাস্তা নেই।
         খুব বেশি খেয়াল করে দেখেনি কখনো পেখম যদিও। তবু বলে দিতে পারে, রোজই তিন থেকে চারটে ছেলে থাকে রোজ। সবাই কিন্তু গান করে না। একজন চুপই থাকে, আর বাকিরা অসভ্যতামি করে।
         পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তো ভদ্রবাড়ির শিক্ষিত ছেলেই মনে হয় কিন্তু ব্যবহারটা অশিক্ষিতের মত। বিকেলে যখন যায় তখন চায়ের দোকানে এদের কেউ থাকে না। থাকে পাড়ার কিছু বয়স্ক লোক,যাদের চাউনি এদের চেয়েও খারাপ।
          পেখমরা এই পাড়ায় ভাড়া এসেছে আড়াই মাস হল। রবীন্দ্রভারতী থেকে ইংলিশে এম.এ করছে। বাড়িতে মা বাবা ভাই আর ও ছাড়া কেউ নেই। বাবা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করত। বছর দুই হল রিটায়ার করেছে আর তাতেই আর্থিক অসুবিধায় পড়তে হয়েছে ওদের।
         পেখম টিউশানি পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচটা চালিয়ে নেয় বলে এখন সংসারে একটু সাশ্রয় এসেছে। কিন্তু রোজ রোজ ওকে দেখে গান কেন গায় বুঝে উঠতে পারে না ও। তবে নির্দ্বিধায় একটা কথা স্বীকার করে ও, কোনদিন ওদের বাজে নজর ছুঁয়ে যায়নি ওকে। ওই গানটুকু ছাড়া আর কোনদিন কিছুই করেনি।
         পরদিন যদি এরকম করলে ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে ও। ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকল। ওকে ঢুকতে দেখে মা বলল,
         - ইশ পুরো ঘেমে গেছিস তো!! যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। চিঁড়ের পোলাও করেছি খাবি।
           মুখ হাত ধুয়ে নাইটি টা পরে মায়ের দেওয়া চা আর চিঁড়ের পোলাও নিয়ে ঘরে এল পেখম। পরীক্ষা আর দুমাস বাকি। নষ্ট করার মত সময় নেই একেবারেই।
            চায়ের কাপটা রেখে সবে খাতাটা খুলেছে, হঠাত মায়ের আর্ত চিৎকার কানে এল। 
            - পেখম দেখ না তোর বাবা কেমন করছে। বুকে হাত দিয়ে কেমন করছে!!
            তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখে বাবা বুকের একদিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। মুখটা যন্ত্রণায় বেকে যাচ্ছে। জল মুখে দিলে সেটা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। 
           - তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাক পেখম। 
          মায়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেল পেখম। নাইটি পড়েই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এখানে ডাক্তার কোথায় বসে কিচ্ছু জানে না ও। হুশ ফিরতে ও নিজেকে চায়ের দোকানের সামনে দেখতে পেল।
          ছেলেগুলো ওকে দেখে উঠে এল। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে বুঝতে পেরে একজন জিজ্ঞেস করল,
          - কি হয়েছে?? আপনি এভাবে দৌড়ে কেন আসছেন!!
           অনেক কষ্টে হাপাতে হাপাতে পেখম বলল,
           - বাবা... বুকে ব্যথা... কেমন একটা করছে...ডাক্তার কোথায় পাব??
           এটুকু তেই যা বোঝার বুঝে গেল ওরা। সেই ছেলেটা যে পেখমকে দেখে মিষ্টি করে হাসত, সে ক্লাব থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে চলে গেল পেখম দের বাড়ি। বাবাকে ওরা নিয়ে গেল নার্সিংহোম। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
           শোকে দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেল পেখম। সেই সময় ওদের তিনজনকে সামলে রেখেছিল এই ছেলে গুলোই। শ্মশান থেকে বাড়িতে আনা, যাবতীয় কাজে সর্বক্ষন বুক দিয়ে আগলে রেখেছে ওদের।
          পেখম আজ বুঝতে পারে ওরা তথাকথিত একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও, ওরা মানবিকতা শিক্ষায় শিক্ষিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন