রবিবার, ১৫ মে, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

                      



শ্রাবণের ধারার মত


পর্ব-৮

সমুদ্রের নোনা হাওয়া চিটেচিটে জল নিয়ে ঝাপটা দিচ্ছে মুখে, চুল এলোমেলো হয়ে চরম বিভ্রাটে ফেলছে দুজনকেই। চোখ পিটপিটে হয়ে যাচ্ছে লক্ষ‍্য করে দুজনেই মৃদু হাসল। সমুদ্রের দিকে পিছন ঘুরে বসতেই প্রথম মেঘের গুরুম্ গুরুম্ আওয়াজ শোনা গেল।মেয়েটি নিজের বিনুনিতে আঙুল জড়িয়ে বলল, 'অকারণ সুখে বুকের ভেতর এমন করেই মেঘ ডাকে তাইনা?' 

-হ্যাঁ, খানিকটা তেমনি। তবে কারো মায়াভেজা চোখ দেখলেও এমনটাই হয়।

-মায়া ভেজা চোখ! সে কেমন জানিনা, তবে তোমার চোখের দিকে তাকাতে ভালো লাগে। কী ভীষণ নিষ্পাপ। তুমি লজ্জা পেলে? আমি সত‍্যি বলছি।

-যদি ভুল না বোঝ একটা অনুমতি চাইব?

-তোমায় ভুল বুঝব? অসম্ভব! বলো কিসের অনুমতি?

-একবার তোমার মাথার গন্ধ নিতে পারি?

-মাথার গন্ধ!

-না মানে তোমার চুলের।

খিলখিল করে হেসে মেয়েটি দুটো বিনুনি খুলে ফেলে। সমুদ্রের প্রবল হাওয়ায় রাশিরাশি নরম রেশমের মতো মেঘ চোখমুখ আবৃত করতেই দমবন্ধ হয়ে যাবার তীব্র অনুভবে উঠে বসে মরুণকিশোর। পাশে মিষ্টি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে বাইরে এসে একফালি বারান্দার বেতের চেয়ারে চুপ করে বসে মরুণকিশোর। যা কিছু শেষ পর্যন্ত পাওয়া হয় না, তার আকর্ষণ বা মোহ বোধহয় চিরকাল বিভ্রান্ত করে রাখে। ঘরের ভিতর যে নারী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তাকে সে গ্রহণ করতে পারল না কেন? বন্ধু চীরঞ্জীব তাকে মুখ খারাপ করে বলেছিল, 'চুপ কর শালা ন্যাকা। নিজের বউকে উপোসী রাখিস ভাবের ঘোরে! থাম শালা! আসলে শালা তুই নিমুরাইদ্যা। মিষ্টি যদি আমায় দাদা বলে রাখী না পরাত, তাহলে আমিই শালা...। তোকে না জ্যান্ত কবর দেওয়া উচিৎ।' মরুণকিশোর নিজের বুকের উপর হাত বোলাতে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় মায়াচোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, 'কী খুঁজছ তুমি মরুণ?' ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে 'তোমায় খুঁজছি, সেই কবে থেকে।'

"কি লাগিয়া ডাকরে বাঁশি আর কিবা চাও।
বাকি আছে প্রাণ আমার তাহা লইয়া যাও।"

গানের মৃদু সুরে মিষ্টির ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় বসে চাঁদের আলোয় প্রেতের মতো বসে থাকা মানুষটার জন্য বুক হুহু করে ওঠে। খুব জানতে ইচ্ছে করে এমন মানুষকে কোন মেয়ে ফিরিয়েছিল? তার চোখ চোখ রেখে প্রশ্ন করবে মিষ্টি, 'আমার বরকে হয় ফেরৎ নাও নয় ফেরৎ দাও।' বেয়ারা চোখের জল ঘর বারান্দা ভাসাতে থাকে সঙ্গে কাঁদে চণ্ডীদাস।

-------------------------------------------------------------

আদিত্য পাগল হইয়া উঠিয়াছে অপরদিকে সোহাগ অনড়। এতবড় অনাচার আর কাহাকেও বলিবার মতো শক্তি সে অর্জন করিতে পারে নাই। স্ত্রীর উপর শারীরিক জুলুম করিতেও তাহার রুচিতে বাধে। দাদার সহিত বাক্যালাপে সে কোন পথ দেখিতে পায় নাই বরং সৌমাদিত্য যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে কিছু। তার অন্যমনস্কতা দিশাহীন নৌকার পাল তুলিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে। 'কেহ বোধকরি ডাকিল আমায়।' আকস্মিক এমন কিছু বাক্য বলিয়া চলিয়া গিয়াছে আদিত্যর সম্মুখ হইতে।'  তবে কি দাদা সকলি জানেন? আজ সে আসিয়াছে মায়ের ঘরে। মেঝেতে মায়ের পার্শ্বে বসিবামাত্র তিনি বলিয়া উঠিলেন, 'এইবার কতদিনের জন্যে এয়েচ। এয়েচ কেন? টাকার দরকার? চুপ করে রয়েচ যে!'

-মা সোহাগ!

-শোনো বাপু গরীব ঘরের মা মরা মেয়ে সে, তাকে যদি আজ তোমার আর মনে না ধরে তুমি আবার বে করতে পারো কিন্তু এবাড়িতে তার ভাগ এতটুকু কমবে না এ আমি বলে দিচ্চি। এখন যাও নিজের ঘরে যাও।

-না!মা! তাহা নহে আমি জানিতে চাহিতেছি সোহাগের আচার আচরণ কী রূপ!

-দেকো বাছা, আমি শুদু এটুকু জানি সে তোমার চেয়ে দশগুণ ভালো। সংসার ধর্ম নিয়ে সকলের সাথে মিলেমিশে সে ভালো আচে।

-এর চাহিতে অধিক কিছুই আপনি দেখেন নাই!

-আমি ঠিক ততটুকুই দেকেচি যাতে আমার পরিবার সঠিক থাকে।

-না, আপনি দেখেন নাই। আর আপনার পরিবার সঠিক নাই।

এই বলিয়া আদিত্য প্রস্থান করিতেই যমুনাবতী চিন্তিত হইয়া উঠিল। কী ইঙ্গিত দিয়া গেল সে? তবে কী সোহাগের সহিত সৌমাদিত্যের ঘনিষ্টতা বাড়িয়াছে? তবে যে বড়বউ কহিয়াছিল ছোটবউ  সৌমাদিত্য কে দূর দূর করিয়া খেদাইয়াছে। আদিত্য কি নতুন কিছু দেখিয়াছে? 

আদিত্য বেগে ঘরে প্রবেশ করিয়া সোহাগকে দেখিয়া খানিক বিহ্বল হইয়া গেল। সোহাগ তাহার দিকে ফিরিয়াও চাহিল না। গলা ঝাড়িয়া কহিল, 'আমি বাড়ি ছাড়িয়া যাইতেছি, এরূপে বসবাস করা আমার দ্বারা অসম্ভব।' ভারী নরম করিয়া সোহাগ বলিল, 'বাড়ি ছাড়িবার কারণটি যদি আমি হই, তাহা হইলে তুমি অবলীলায় বলিতে পার, আমি চলিয়া যাইব। আর যদি কারণটি চন্দ্রনাথবাবু তবে আর বিলম্ব করিও না এখনি যাত্রা করো।' আদিত্য সোহাগের কাছে আসিয়া হাত ধরিয়া বলিল, 'কেবল উহার সহিত ভ্রমণে গিয়াছি বলিয়া তুমি এতখানি সর্বনাশ করিতে পারিলে সোহাগ? আমার ভালোবাসা ভালোবাসা রহিলনা কেবল কিছুদিনের নিমিত্ত মুক্তি চাহিয়াছি বলিয়া!' সোহাগ রঙ্গ করিয়া বলিল, 'একটি নারী শরীরের মাঝে আনন্দ পাইয়াছি বলিয়া আমার ভালোবাসা ভালোবাসা রহিল না নাথ! অন্য পুরুষ শরীর তো কামনা করি নাই।' আদিত্য থরথর করিয়া কাঁপিয়া বসিয়া পড়িল। সোহাগ উন্মাদের মতো উচ্চস্বরে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল খাটের উপর।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন