শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

          


    
মঞ্জিরা 



বন্দিশেরা নামছে সহস্রধারায় কৃষ্ণ অন্তরীক্ষ থেকে। নীলাদ্রি শুনছেন। বলা ভালো, শুষছেন। এই একটিই প্রেম তাকে কখনো গার্হস্থ্য চাওয়া পাওয়ার সরলবৃত্তে প্রবেশাধিকার দিলো না। উস্তাদ আমির খান যখন বিলাসখানি টোড়িতে "বাজে নিকি ঘুংঘরিয়া" ধরেন, ধর্মাচরন থেকে বহুদূরে থাকা নীলাদ্রির জগত, বৃন্দাবন হয়ে যায়। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান খান সাহেব "রহিয়ে অব এয়সি জাগা" গাওয়ার সময় গজলের শেষ মীরটি শুনতে স্বয়ং গালিব এসে দাঁড়ান তার পানপাত্র ফেলে রেখে। অশ্রুই তো সেই নিরপেক্ষ বহতা যা যে কোন স্থান কাল পাত্রকে নিমেষে অপ্রাঙ্গিক করে দিতে পারে অপ্রতিরোধ্য তাড়নায়।
 

নীলাদ্রির বিশ্বাস মানুষ তার মানবিক পৃথিবীতে যাবতীয় বিগ্রহ এবং ধর্মের রূপকল্প নির্মাণ করেছে সঙ্গীতের স্বার্থে। একমাত্র সুরই সেই অতীন্দ্রিয় শক্তি যা শরীরে অবস্থান করেও আত্মাকে ত্রিলোকের উপলব্ধি দিতে পারে যদি আদৌ অদ্বৈতের অস্তিত্ব থাকে। শ্যামসুন্দর তার কাছে নজরুলের কৃষ্ণসঙ্গীতের বাইরে কিছুই নয়। তিনি হরিকে জানতে ব্যগ্র হননি শুধু "সে হরি কেমন বল" শুনে ভেসে গেছেন। তার হরি ঐ সৃষ্টিজারিত তুমুল আবেগটিই, কোনো আধার নয়। 


সময় কী কখনো ভাবার মতো সময়ের সন্ধান নীলাদ্রি করেন নি। ওয়ার্কহোলিক নয়, কর্মযোগও নয়, গণিত আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, এই দুই গহীন তাকে এতোটাই দুর্গম করে রেখে দিলো এত বয়স অবধি যে, সেই অরণ্যে তার নিবিড়ে বসা পাখিরা কতটা অভিমান জমিয়ে মেঘ হয়ে উড়ে গেলো, জানতে পারলেন না। কী বিচিত্র দ্বন্দ্ব আকীর্ণ সংবেদন। গওহরজানের ঠুংরির একটা মুড়কি যাকে তোলপাড় করে দেয়, বড়ে গুলাম আলীর "প্রেম যোগন বনকে" যাকে প্রেমিক করে তোলে লাজিজ মরহুমে, তিনি একবার তাকিয়েও দেখলেন না এতগুলো বছর ধরে দাবানল খুঁজে না পেয়ে পাথর হয়ে যাওয়া বৃক্ষবিষাদের শরমকে। অজস্র সূঁচ বিঁধে থাকা চামড়ার ব্যথাবোধ শরীর হারালে সম্ভবত মেধাবী মস্তিষ্ক অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে অচেতনে। হয়তো তাই আখতারী বাঈ- এর একটি আলাপ মনে পড়ছে তার অতিরিক্ত, ঘুরে ফিরে, "ইয়ে না থি হামারি কিসমত" ।

এও এক বিস্ময় স্বধার কাছে। সারা জীবনে হারমোনিয়াম, তানপুরা অথবা তবলার মতো নিরীহ, সহজপাচ্য বস্তুগুলি, বাঙালী সংসারে বাসনপত্রের মতোই যাদের উপস্থিতি ছিলো অন্তত কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও, কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেন নি নীলাদ্রি অথচ এক পলের অধিক সময় তিনি কখনো নেন নি খমক আর একতারার পার্থক্য বলে দিতে। তড়পেছেন সঙ্গোপনে যখন মিউজিক ট্যালেন্ট হান্টে অংশগ্রহণকারী কোনো শিশু তার কাছে বলতে পারেনি সেতারে ১৭ টি তার থাকলেও সুর নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকে মাত্র তিনটিতে, বাকিগুলি 'তরপ'। নীলাদ্রির চরম শত্রুরাও তাকে প্রজন্মবিরোধী দলের শরিক এই অপবাদ দিতে পারবে না কিন্তু স্বধা তার উপর ক্রমবর্ধমান হতাশার ছায়ার অধিগ্রহণ দেখেছে নিয়ত যখন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, শিবকুমার শর্মা, উস্তাদ নিশাত খান, পাঁচুগোপাল দত্ত, শুভলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণার মতো ব্যক্তিত্বরা নিছক কতগুলো নাম হয়ে বন্দিত্ব নিয়েছে কম্পিটিটিভ এক্সাম প্রার্থীদের বৃত্তে।


এক ফাল্গুনী সন্ধ্যা তিনি উপহার দিয়েছিলেন স্বধাকে। সে তখন এক কলিগের বিয়েতে না গিয়ে উপায় নেই বলে তৈরী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো বাবার স্টাডিতে। নীলাদ্রি শুরু করেছিলেন "ফ্রী স্পিরিট" দিয়ে।

--"এসো, এসো, না হয় দেরীই হবে খানিক"


তারা পৌঁছেছিলো তারপর "ঘাট অব বেনারস" এ।

--"তুমি বিয়েবাড়ি যাচ্ছিলে না?
    অ্যারেঞ্জ না লাভ?
    বেশ, এই দুটো পরপর শোনো             তাহলে,
     "বিলাভেড কল" আর
     "মিসিং অব হার্ট"


ফল্গুর উচ্ছ্বাস স্মরণ করিয়ে স্বধাকে যখন শেষে শুনিয়েছিলেন নীলাদ্রি "হোলি ম্যাট্রিমনি", স্বধার জানা হয়ে গিয়েছিলো ভালোবাসা আর বিবাহের সংজ্ঞা শিখিয়ে দিতে একা বিসমিল্লা জন্ম জন্মান্তরের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। বিয়েবাড়ি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কী প্রয়োজন লোকসমাগমের? তার তো অভিসার অধিগত হয়ে গেছে সদ্য, সিঁদুরের রঙও মাখা শেষ। 


--"তোমার আনুষ্ঠানিক সম্প্রদান আমি করবো না কখনো। সেই অধিকার আমার নেই। কোনো নারীকেই দানের অধিকার কোনো পুরুষের থাকে না আরেক পুরুষের হাতে। স্বধা, আমি ব্রাহ্মণ যে। ব্রহ্মজ্ঞান না হোক, আত্মার বর্ণকে অশুক্ল করি কী ভাবে? তুমি আমার অংশবীজ। গ্রহন বা অর্পণের দায় মানুষের হাতে থাকে কি? যোগসূত্রকে অস্বীকার করে, অজ্ঞাত যেমত, অনুষ্কাকে শুনো, নোরাকেও। পন্ডিতজীর অবয়ব ভাসবে না? দ্যুতির আহুতিতে অঙ্গুলিত্রাণ জরুরী, শিরস্ত্রাণ নয় "


বহুবার জানতে চেয়েছে স্বধা, নীলাদ্রি উত্তর দেন নি। আজ মনে হলো বড় দেরী হয়ে গেছে। হয়তো জানিয়ে দিলেই পারতেন। হিন্দুস্থানী মার্গসঙ্গীতের একনিষ্ঠ শ্রোতা কিন্তু অভিনিবেশে স্পষ্ট হয় নীলাদ্রির ঝোঁক আবদুল করিম আর ফায়েজ খানের গমকে যতটা, তার থেকে অনেক বেশী তাদের গোবিন্দ বন্দনায়। কেন? নীলাদ্রি মনে মনে উচ্চারণ করলেন, জানেন স্বধা বুঝে নেবে একদিন ঠিক। ঈশ্বরের অর্থ যদি নিখাদ ব্রহ্ম হয় তাহলে নীলাদ্রি তীব্র আশ্বাস রাখেন সেই সমস্ত সুরসাধকদের গায়কীতেই অধিক যারা ধর্মকে শুধুমাত্র একটি শব্দে পরিণত করতে পেরেছেন। অতিক্রম করে গেছেন লোকায়ত ও প্রচলিত ধারণা ও আচরণ। পৌঁছে গেছেন অনাদির সেই অভেদ অবস্থানে যেখানে রসুলের সর্বনাম সরস্বতী। 


মাঝে মাঝে স্বধার মনে হয় চেতন অবচেতন থেকে ক্রমশ অচেতনের দিকে সরে যাওয়া তার বাবার এই পরিণতি হয়তো সিদ্ধান্ত মাত্র। এই মুহূর্তে যে রাষ্ট্রে তাকে শ্বাস নিতে হচ্ছে তা তার অপরিচিত ও অসূয়ার কারণ। তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন নিজেকে ক্রমেই। যেভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে নগরীদের নাম, হয়তো তার প্রাণপ্রিয় ঘরাণাদেরও বদলে ফেলা হবে তাদের স্রষ্টাদের ধর্মবিচার করে। জয়পুর আত্রাউলি, পাতিয়ালা, রামপুর মহাস্বন, ইন্দোর, কিরাণা, আগ্রা, গোয়ালিয়র, দিল্লী, ভেন্ডিবাজার, মেওয়াটি, শ্যাম চৌরাশিয়া- সবকটি এবং প্রতিটিরই প্রতিষ্ঠাতা প্রো-হিন্দুত্ব সাম্রাজ্যবাদীর ষণ্ড দৃষ্টিতে অপরাধী, যেহেতু বিধর্মী। সেই নরকজল বাইতে পারবেন না, এই আতঙ্কেই কি যাবতীয় চিকিৎসাকে প্রার্থিত ফলপ্রসব করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তিনি নিজেই?

বহুর মধ্যে বিশেষ করে একটি বিতর্ক বাকী থেকে গেছে স্বধা ও নীলাদ্রির। কেন এক জমিনে দুজনেই বিচরণ করেও তারা, পিতা ও কন্যা, মূল আদর্শগত কেন্দ্রে এতো বিরোধী। তাদের ফোর্ট এক নয়, আঙ্গিকও নয়। সেই কারণেই কি? নীলাদ্রি মানুষ থেকে ক্রমে দূরত্বে গেছেন যে পন্থায় ঠিক সেই প্রকরণে কেন স্বধা মানুষেরই মধ্যে খুঁজে ফিরছে পরশপাথর? পৃথিবীর যে তিনটি জায়গায় তাদের যাওয়ার কথা ছিলো অবরোধ উঠলেই, তাদের মধ্যে এই মুহূর্তেই তার পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করছে সিস্টিন চ্যাপেলে। নীলাদ্রি বারবার শেখাতেন স্বধাকে শিল্পীর জীবন নিয়ে না ভাবতে। শিল্পই শিল্পীর সাক্ষর। যন্ত্রণা, অর্জন ও প্রাপ্তি-প্রাকাম্যের। সৃষ্টি ও স্রষ্টা একীভূত। যখন নীলাদ্রির ডোবার কথা ছিলো "ও গ্রেসিয়াস লাইট" অথবা অন্যান্য ভেসপারের অতলে পিয়ানোয় চোখ রেখে, স্বধা দেখে বেড়াতো ফ্রেস্কো, এঞ্জেলোর মায়া ধার করে। এর কারণ কী? নিজেকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সামান্য কাঁপলো সে। তাহলে কি ব্যবধান রেখার কাছাকাছি পৌঁছাতে চাইছে সে ক্রুশ আর ক্রাইস্টের? ছুঁয়ে দেখতে চাইছে ইন্দ্রিয় সম্বল করে ফ্যান্টাসি আর স্পর্শযোগ্যতার লাইন অব কন্ট্রোল? বাবাকে বলা হলো না। আর কখনো সুযোগ আসবে কি?


ভোর হয়ে আসছে। ইডেনের কেবিন ওয়ানে ধ্রুপদে ভৈরবী ধরলেন আল্লাদিয়া খান। কে বলে 'হংসধ্বনি' রাগ মাত্র? কে বলে শুধু 'মিঞা কি মল্লার' পাবক শান্ত করে? অসংখ্য ভেজা ভেজা সাদা ডানা উড়ে যাচ্ছে কাদের তাহলে কাচ পেরিয়ে দিগন্তের দিকে? স্বধা দেখছে। অক্সিমিটারের নেমে যাওয়া কাঁটা তাকে বাধ্য করছে ডক্টর সেনকে ফোন করতে অথচ টের পাচ্ছে এ অন্যায়। যাত্রাপথে বাধা হতে নেই। হটাত তার সমস্ত কোষে জিহাদ জ্বলে উঠলো নৃশংস মাত্রায়। কেন প্রতিবার নির্লিপ্তিতে নীলাদ্রি পেরিয়ে যাবেন প্রতিটি সম্ভাব্য সংঘাত? অসীম নিস্তব্ধতা দিয়ে এড়িয়ে যাবেন অনিবার্য প্রতিরোধ? আজ তাকে ফিরতেই হবে। নাড়া স্বধার হাতেও বাঁধা হয়েছিল তিন বছর বয়সে ইলাহাবাদে। সে অন্য ইতিহাস। ইনশাল্লাহ, আজ সে হারবে না তার পঞ্চগুরুর প্রথম জনের কাছে।

ছবি - অন্তর্জাল 


১০টি মন্তব্য:

  1. অপূর্ব লিখেছিস। অনেক কথা বলেছিস।
    হজম করছি।

    উত্তরমুছুন
  2. তোমার ভাষা আমায় মুগ্ধ করে বারবার ❤

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ একটি আলেখ্য। সমৃদ্ধ হলাম 💕।‌

    উত্তরমুছুন
  4. ওহ। এই হচ্ছে লেখা। এমন 'ধনী' এর সমস্ত বিন্দু। গতানুগতিকতার বাইরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচার এই আয়োজন!

    উত্তরমুছুন
  5. গভীর এই যাত্রা... তোমার কলম কে শ্রদ্ধা করি...

    উত্তরমুছুন
  6. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এরকম আরও লেখা পড়বার জন্য অনেকদিন বেঁচে থাকা যায়।

      মুছুন