চক্রব্যূহ
পাঁচ বছর আগে কোন একদিন
ঘোর বর্ষা নেমেছে শহরের রাজপথে।গঞ্জের গলিতেও স্রোত।ধুয়ে যাচ্ছে জমে থাকা নোংরা।পোশাকের আবরণ ফুঁড়ে মনটাও কি দেখা যায়?আশেপাশে যে দু একজন হতভাগ্য এই বৃষ্টিতে বেরোতে বাধ্য হয়েছে তারা রুদ্রকে উপেক্ষা করে ছুটে চলেছে।কেবল রুদ্র ভাবছে সবাই বুঝি তাকেই দেখছে।তার ছাব্বিশ বছরের ছ ফুটের শরীরটা জরিপ করে নিচ্ছে,ফুলে ওঠা বাইশেপস্,চওড়া বুক,ভি শেপের শরীর,পুরুষ্টু গোঁফ,ব্রাউন মণির বড়ো বড়ো চোখ সবাই দেখছে।এইমাত্র নীল শাড়ি পরা মহিলা কেমন একটা হাসি ছুঁড়ে দিলো।কি অর্থ ঐ হাসিটার গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে?মাথাটা চেপে ধরে নোংরা ফুটপাতের ধার ঘেঁষে বসে পড়ে রুদ্র।পিঠের ব্যাগে পঞ্চাশ হাজার টাকা।এরপরেও বাকি থাকবে সাড়ে চোদ্দ লাখ।এখন আর নিজেকে নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই।এখন শুধু বয়ে যেতে হবে।
পাকাদেখা সকাল
দত্ত ভিলায় সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।এবাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ের পাকা কথা আজ।গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লী থেকে ব্যারিস্টার ওমপ্রকাশ দত্ত সস্ত্রীক এসেছেন।তাঁর ছোটো ভাইয়ের মেয়ে বড়োই ব্যতিক্রমী ফলত নিঃসন্তান ওম একটু পক্ষপাত দুষ্ট।তার ছোটোভাই স্নেহাংশু,মিতুনকে একদম সাদামাটা ভাবে মানুষ করেছেন।ওর বৌ তৃষার ভূমিকাই এক্ষেত্রে দেখবার মতো।মিতুন বোধহয় বড়ো হবার আগে জানতেই পারেনি ওর বাবা কতখানি বিত্তবান।বছরে একবার দিল্লী গেলে ওম প্রকাশের বাংলোর ঝাঁচকচকে রোশনাই মেয়েটাকে বিব্রত করে তুলতো।আরো অস্বস্তিতে ভুগতো ওমপ্রকাশের স্ত্রী মাধুরীর সামনে এলে।নিজের মাকে এতোটাই সাধারণ দেখেছে যে জ্যেঠিমার এতো জৌলুস ওকে কোণঠাসা করে দিতো।মাধুরী এবারো মিতুনকে বিব্রত করে দিয়েছেন।
-এতো কেন এনেছো জেম?
-আশ্চর্য তুই জানিস না তোর জ্যেঠু অবসেসড তোকে নিয়ে।আর আমিও কি তোকে কম ভালোবাসি হুম্?
-তা নয় আসলে আমি তো সাজিই না,এতো কসমেটিক, জুয়েলারি।অনেক খরচ।
-সত্যি তৃষা কি বানিয়েছিস মেয়েটাকে।
-আমি কিছুই করিনি দিভাই ও ওর মতো।আমি ওর থেকে বেশী সাজি।
-মিতুন আজ তোর তিনি কি পরছেন?মানে রঙ ম্যাচ করে নিয়েছিস তো?
-কি যে বলো জেম?ও ভীষণ সাধরণ।
-কাল সন্ধ্যায় তোর মা বললো বটে।ফ্যামিলি বিজনেসের প্রচুর লস,বাবার আত্মহত্যা।উফ্ পুরো ট্রাজ্যিক সিনেমা।সরি,ডোণ্ট মাইণ্ড।আসলে এতো কিছু সামলে ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা আবার সার্ভিস লাইফে ফ্লারিশ করা একটু অস্বাভাবিক লাগে।তাই বলছিলাম সবটা বুঝে নিয়েছিস তো?
মিতুন সদ্যঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতেই ঘরে ঝাঁপিয়ে এসেছেন মাধুরী নিজের উপহার নিয়ে।আজ সবে বিয়ের পাকা কথা তাতেই এতো গিফ্ট এমনিতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না তার উপর এসব কথায় ওর ভেতরটা কঠিন হয়ে উঠলো।মেয়ের মুখের এই রেখাগুলো তৃষা চেনেন।অস্থির হয়ে উঠলেন ভেতরে ভেতরে কিছু জবাব দিয়ে না বসে মেয়েটা।
-জেম আমি শুধু একটা কথা বুঝে নিয়েছি।ও পরিশ্রমী,সৎ আর আমাকে ভালোবাসে।
হঠাৎ জোরে হেসে উঠলেন মাধুরী।ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে বলে গেলেন,ভালোবাসা শব্দটা সবচেয়ে জঘন্য ঘুষ।এই শব্দটার মোড়কে মানুষ সব সত্যি ঢেকে দেয়।যাক তুই রেডি হয়ে নে।
সারাবাড়ি জুড়ে মাছ,মাংসের সুগন্ধ ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠলো।মিতুন নিজস্ব ভঙ্গিতে শ্লেট বেসের ঘিচা শাড়ি ঘন লাল ব্লাউজ দিয়ে পরলো।সাথে রূপোর গয়না।একটা সেলফি ব্যালকনিতে গিয়ে তুলে লাজুক মুখে সেণ্ড করেই দিলো।ঘড়ি বলছে প্রায় পৌনে বারোটা তবু ওদিকের মোবাইল অফলাইন।ভুরুটা কুঁচকে উঠতেই তৃষা ঘরে ঢুকলেন।
-তাড়াতাড়ি কর মা ওরা এসে যাবেন যে।একবার বাবার সাথে দেখা করে আয়।চুপচাপ মানুষ মুখে বলে না কিন্তু বোধহয় তোকে দেখতে চাইছে।
মিতুনের চোখে একটু জল ঘনিয়ে আসে।বাবারা এমন হয় কেন?
অন্য এক সন্ধ্যা
-এক বাত বাতায়ে রুদ্র?ইতনা কিঁউ সোচ রহে হো?পন্দরা লাখ রুপায়া ক্যায়সে চুকায়োগো?সোচো?ঔর নয়া বলা কোর্স মে যো ঘুঁসে হো উসকা রুপায় ক্যাহাসে লাওগো?
বীরেন সয়গালের কথার কোন উত্তর দেয়না রুদ্র।সংসার চালানো যদি কেবল টার্গেট হতো তাহলে এই টাকাতেই ঘষটে হয়তো চালিয়ে নিতো কিন্তু পরিস্থিতি সহজ নয়।জীবন কোন মোড়ে কি চমক রেখেছে কেউ জানেনা।বাবার সাথে অশান্তি করে চলেই তো এসেছিলো এক বছর আগে আমেদাবাদে।এই পনেরো হাজার টাকার চাকরী নিয়ে।সেই বাবার জন্যই আজ তার দরকার টাকা অনেক টাকা।আচ্ছা বীরেন কি ওর বন্ধু?না চরম শত্রু?গতমাসে টাকার সমস্যা মেটানোর সবচেয়ে সহজ অথচ জঘন্য উপায়টা ঐ দেখিয়েছিলো।
-ক্যায়া সোচ রহে হো?
-কিছু না,চলি।
-চলি মানে শনিবার মাউন্ট আবু?সলিড পার্টি।খুশি করতে পারলে টাকার অভাব হবে না।সোচো ইয়ার!
-ভেবে দেখার কিছু নেই বীরেন আমি যাবো।
-ইসবার সিধা পার্টি সে মিলায়েঙ্গে হাম তুমকো।
-তুই?
-হ্যাঁ ভাই।তোর মতো শরীর তো নেই।আমাকে দেখলে পার্টি বমি করে দেবে।তাই দালালি করে যদি কিছু পাই।
স্টেশনে যাবার পথে অটোতে একা একাই খানিক হেসে নিলো রুদ্র।মনে মনে বললো,শালা কে বলে টাকা কামানো কঠিন? কত ফিকির কত ফিকির।শুধু নিজের আত্মাটা বেচে দাও।টাকা লুটোবে তোমার পায়ে।
পাকাদেখা দুপুর
মিতুন সত্যি ভীষণ অবাক হয়ে গেছে।কি যে ভালো লাগছে ওকে।একটু নির্লজ্জ ভাবে হা করে তাকিয়ে ছিলো।মা হাত ধরতেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে।বড়োরা পাঠিপত্র,পুরুতমশাইয়ের কচকচানিতে মজে গেলে দক্ষিণের বারান্দার বড়ো ওপেন স্পেসটায় ভাইবোনেরা পাকড়াও করে ফেলে ওদের দুজনকেই।খানিকপর হাসি মশকরার মাঝে বেতের চেয়ার থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে।
-তোমাদের আপত্তি না থাকলে তোমাদের দিদিকে একটু সময়ের জন্য ঐ ব্যালকনিটায় নিয়ে যেতে চাই।পারমিশান পাবো।
মিতুনকে আজ চমকের পর চমক লাগিয়ে পুরো অধিকার করতে চায় বোধহয়।ওর ঘরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় দুজন।কি আছে চোখে আর কি দেখতে চায়!মিতুন বোঝেনা।দিশেহারা হয়ে বলে,প্লিজ।এভাবে দেখো না।
-চোখ নামিয়ো না।কিছু কথা বলতে চেয়েও বলা যায়না যে।দেখো না যদি দেখতে পাও তুমি।আমি আড়াল রাখতে চাইনা,দেখিয়ে দিতেও মন সায় দেয়না।
-কি যে হেঁয়ালী তোমার?
-শোনো তুমি আমায় কেন চাও?
-আর কতবার একই প্রশ্ন করবে?
-যদি কোনদিন উত্তর বদলায় তাই বারবার জানতে চাই।...তোমায় বলা হয়নি,খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।চুলটা বাঁধোনি বলেই বেশী ভালো লাগছে।
একটু কাছে এসে মাথায় চুমু খায় হাতটা ধরে।কি ভীষণ শান্ত অথচ ভেতরে ঝড় চলছে টের পাওয়া যায়।মিতুন বোঝে না কি বলতে চায়?
-বিয়ের আগে ঘনিষ্ঠতা এ বাড়ির রীতি নয় মিতুন।বাইরের ছেলে বিষয়গুলো না জানলেও তুমি তো জানো।
ছিটকে দাঁড়ায় দুজন।লজ্জায়,অপরাধ বোধে সিঁটিয়ে যাওয়া ছ ফুটের মানুষটা টাল খেয়ে গেলো যেন।শরীরে অন্ধকার মেখে ছুটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।মিতুন হতবাক।গলার ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া জিভ ফিসফিস করে বলে উঠলো,এটা কি করলে জেম?আমার সবচেয়ে সুন্দর সময়টা নষ্ট করে দিলে?
মাউন্ট আবুর রাতের পর
হাপুস চোখে কাঁদছেন মহিলা।রুদ্র চুপচাপ জানলা দিয়ে ন্যাড়া পাহাড়ে চাঁদের আলপনা দেখছে।বীরেন বারবার বলে দিয়েছে এই লাইনে আসল নাম ভুলেও না আর কনডোম মাস্ট।বাঁ পকেটটা হাতড়ে নিলো একবার।প্যাকেটটা ছুঁলেই ঘেন্না বেজে ওঠে শরীরে।তবু বড়ো বড়ো শ্বাসটেনে নিজেকে প্রস্তুত রাখে।মহিলা মদের নেশায় টলছেন।প্রায় বাহান্ন বছর হবে বয়স।গত আধঘন্টা ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে ছেলের আমেরিকা যাবার কথা বরের অক্ষমতা নিজের একাকীত্ব বলেই চলেছে।কালচে ত্বক বহু অর্থ ব্যয়ে ঝাঁ চকচকে।জানলায় উঠে এলেন মহিলা বাঁ হাতের তর্জনী রাখলেন রুদ্রর ঠোঁটে।ও আলতো করে হাতটা নামিয়ে দিতেই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন।বেসুর গান কেমন করে বাজে শ্রোতার কানে?যে যন্ত্র টানেনা তাকে কি বাজানো যায়?যায় বইকি।
দূরপাল্লার ট্রেনে একবার দুটো পাথরে ঠুকে কেরামতির শব্দ বার করার চেষ্টায় এক কিশোরের রক্তাক্ত হাত দেখেছিলো।জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল,ভুখ লাগতা হ্যায় সাব।হাম ক্যায়া করে।চোরি নেহি আতা।ইস লিএ সর ফোঁড়তে হ্যায়,হাথ মারতে হ্যায় পাত্থর পে।কি অদ্ভুত নিরাসক্ত ছিলো ওর চোখ।মনে পড়তেই জোর কদমে নিজেকে সক্রিয় করলো।আগুণের মতো জ্বলতে লাগলো সব।ঘন্টা খানেক পর ক্লান্ত অবসন্ন রুদ্র যখন সবে ঘুমিয়ে যাচ্ছে মহিলা সর্ব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারলেন ওর পিছনে।
-পয়সা লে ঔর নিকাল মেরে ঘরসে।চল উতার বেড সে।উতার আভি।
প্যান্টটা পরারো সময় পায়না।টাকাটা দিয়ে ধাক্কিয়ে,গালাগাল দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়।সেই শুরু,এরপর এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো রুদ্র ওরফে জুবিন।কখনো সিমলা,কখনো যোধপুর,লক্ষ্ণৌ,হায়দ্রাবাদ,চেন্ নাই,মুম্বাই, দিল্লী সর্বত্র মন শক্ত রেখেছে।কেউ ছিঁড়েছে,কেউ মেরেছে,কেউ উদ্ভট আচরণ করেছে,আবার কেউ শান্ত ভাবে দিয়েছে,নিয়েছে চলে গেছে।রুদ্র একটি সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানির ছাপোষা কর্মচারী,ম্যানেজমেন্ট কোর্স কমপ্লিট করতে চাওয়া স্ট্রাগলার যে অঢেল পয়সাওলা মহিলাদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করে নিজের পকেট ভরে জুবিন নাম নিয়ে।বাথরুমে শাওয়ারের তলায় লিকুইট সোপ ঢেলে রগড়াতে থাকে সব ঘেন্না।তবে হঠাৎ ভালো কিছু প্রাপ্তিও থাকো জিগোলো জুবিনের।বছর দেড়েকের তীব্র যন্ত্রণা অনেকটাই স্থির।নারী শরীর এখন তার কাছে যন্ত্র মাত্র।মেধা দ্রুত তাকে কর্মক্ষেত্র সফলতার মুখ দেখাতে শুরু করে,জুবিনও সফলতা পেয়ে ঋণমুক্ত প্রায়।বীরেনের একাধিক এ্যাসাইনমেন্ট ফিরিয়ে দিচ্ছে জুবিন।একদিন বীরেন খুব করে ধরলো।
-আরে ইয়ার আহুজা কে পার্টি মে তুমকে ইয়ে দেখি থি।কবসে পরিশান কর রাকখা হ্যায় চলো না।
-না বীরেন,আর আমার প্রয়োজন নেই দুমাস পর কোলকাতায় ট্রান্সফার পাচ্ছি প্রমোশানের সঙ্গে।আর দরকার নেই।
-ঠিক হ্যায় মেরে লিএ ইস্ বার চলো।ইসকে বাদ হাম কভি ভি নেহি বোলেঙ্গে তুঝে।
নাছোড়বান্দা বীরেনের জন্য একদিন বসতেই হলো ফাইভস্টার হোটেলের বারে।মহিলাকে দেখে তাক লেগে গেলো রুদ্রর।এতোদিন যাদের দেখেছে বেশিরভাগেরই শরীর থাকলেও মন বলে কোনো বস্তু ছিলনা।মেধা তো অনেক দূরের বিষয়।এই মহিলা হাঁটছেন আর অহংকার, মেধা,স্টাইল সাথে সাথে ছায়ার মতো চলছে।
-গ্ল্যাড টু মিট ইউ...
-জুবিন।
-ইয়েস,জুবিন।জুবিন ইউ আর আমেজিং।ইয়োর হাইট,আইজ,ফেস এ্যাণ্ড লিপস আর হাইলি ইন্টারেস্টিং।
-থ্যাঙ্কস্ ম্যাম।
-ওকে ক্যান ইউ গো উইথ মি গোয়া ফর আ ফাইভ ডেজ ট্রিপ।
-নো ম্যাম,আই কান্ট এক্সপেন্ড ফাইভ ডেজ।
-হোয়াই জুবিন?আই ক্যান পে হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট।
গোয়ায় ওনার সাথে শেষ পর্যন্ত তিনদিন কাটিয়েছিলো রুদ্র।সেরা অনুভূতিতে কেটেছে ঐ সময়টা।শরীর যে কত আদরের কত যত্নের কোনদিন টের পাওয়া হতো না যদি না এই ট্রিপটায় ও না যেতো।ভদ্রমহিলার কেয়া নামটা যে মিথ্যা সেটা রুদ্র জানতো।বাঙালি জানার পরেও কেউ কারো পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায় নি।নোনাপাওলা বিচে সমুদ্রের নোনতা স্বাদ গভীর হয়েছিলো কেয়া আর জুবিনের ঠোঁটে।এয়ারপোর্টে আলাদা হবার সময় হাত ধরে কাতর ভাবে বলেছিলো,তোমাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই জুবিন।রুদ্র দুপা পিছিয়ে ম্লান হেসে বলেছিলো,আমি বাঁচতে চাই ম্যাম।
একটা স্পষ্ট রাত
অস্হির ভাবে পাইচারী করেছেন স্নেহাংশু দত্ত।ওমপ্রকাশ দুটো হাত বুকের উপর রেখে স্হির হয়ে আছেন।মাধুরী নির্বিকার ভাবে ফাইলারে নখ ঘষছেন।তৃষা জানলার গ্রিল ধরে রাস্তায় চেয়ে আছেন অপলক।
-আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি,আমি নিজে যে ঘটনার সাক্ষী,তার সত্যতা বিচার করতে মিতুনকে তোমরা যেতে দিলে?
-প্লিজ,মাধুরী মেয়েটার কষ্টটা বুঝতে পারছো?ওর বিয়ে ভাঙতে বসেছে।
-ভাঙতে বসেছে?হোয়াট ডু ইউ মিন?একটা জিগোলোর সাথে তোমরা বিয়ে ভেঙে দাওনি এখনো?স্ট্রেঞ্জ!
-দিভাই এই শব্দটা আর উচ্চারণ করো না।আমি নিতে পারছি না।
বাড়ির গেটে আওয়াজ হতেই সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠলো অথচ স্থির হয়ে সবার মাঝে এলো মিতুন।না কোনো অতিনাটকীয় ছাপ চেহারায় নেই বরং একটু বেশী সহজ লাগলো মাধুরীর।বেতের রকিং চেয়ারটায় গা এলিয়ে বসলো।
-তোমরা সবাই উৎসুক হয়ে আছো জানি কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত।খিদেও পেয়েছে।অন্যান্য দিন ওর সাথে বাইরে গেলে খেয়ে আসি আজ তেমন সুযোগ হয়নি।
-চল খেয়ে নিবি।
-মা তুমি আমার খাবারটা ঘরে পাঠিয়ে দাও।আর বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন তোমরা বরং সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করো।খাবার পর ছাদে বসি আমরা।আমরা পাঁচজন আর কেউ না।
স্নেহাংশু,ওমপ্রকাশ কেউ কিছুই খেলেন না স্টু ছাড়া।মাধুরী সকলের সাথে গল্পগাছা করে সহজ হয়ে রইলেন নাকি ভান করলেন তৃষা বুঝতে পারলেন না।নিজে একটা বাটিতে একটু মুড়ি নিয়ে ডাল দিয়ে খেয়ে ছাদে এলেন।মিতুন আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখে জল।তৃষা মেয়ের পাশে গিয়ে হাতের উপর হাত রাখলেন।একে একে সবাই এলো।
-জ্যেঠু,একবার কালীঘাটে পুজো দিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো।গলিতে সারি সারি মহিলাদের দেখিয়ে আমি যখন প্রশ্ন করেছিলাম তুমি বলেছিলে,'ওরা দুখি মানুষ সেজেগুজে দুঃখকে ফাঁকি দেয়'
-হ্যাঁ মনে আছে রে।
-আজ আমার একটা নিজস্ব দুখি মানুষ আছে,আমি কি করবো বলো?
-মানে কালীঘাটের ঐ মেয়েরা অভাবে দেহ বেচে।একটা পড়াশোনা জানা,চাকরী করা বড়োলোক বাড়ির ছেলে যখন শরীর বিক্রি করে তখন তার অসহায়তা প্রকাশ পায়?নাকি লোভ মিতুন?
-জেম,তুমি ওর অসহায়তাটা জানো?
-না,জানিনা,জানতে চাইও না।
-জানতে হবে জেম,জানতে হবে।কতটা টাকার লোভ হলে একটা শক্ত সমর্থ পুরুষ মহিলাদের বিকৃত যৌনাচার সহ্য করে জানতে হবে বইকি?মোম গলিয়ে পুরুষের একান্ত অঙ্গটিতে ফোঁটা ফোঁটা ফেলে আনন্দে চিৎকার করছে একদল মহিলা অথচ পুরুষটি কেন চুপ করে আছে জানতে হবে তো।
-স্টপ ইট মিতুন।
-না,বাবা আজ চুপ করবো না।শোনো মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির জোনাল ম্যানেজারের শরীর বিক্রির সব ইতিহাস। শুনলে তোমাদের বাড়ির ভিত নড়ে যাবে।
-রাবিশ,একটা নোংরা ছেলের কথা শুনতে হবে এখানে বসে বসে।তুমি কিছু বলছো না কেন?এতো চুপ কেন তুমি?
ওমপ্রকাশ মাধুরীর দিকে তাকালেন।সেই দৃষ্টির ঔদাসীন্য আর নিস্পৃহতা জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরলো মাধুরীকে।
-আমি বুঝতে পারছি মাধুরী তোমাদের লেডিজ মিটে তুমি যা দেখেছো তাতে তোমার পক্ষে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা স্বাভাবিক কিন্তু জীবনটা মিতুনের ওকে বুঝে নিতে দাও।ওর কথা শোনাটাই এখন দরকার।
-জানো জেম আজ বিকেলে ওর মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে।আমার সাথে দেখা করার পনেরো মিনিট আগে।তাতে লেখা,"আমায় ফেরাও তুমি কোন স্পর্ধায় বারবার?তোমার আসল নাম,অফিস সব জেনে গেছি।এবার আমাকে ফেরানোর সাহস দেখিও না।গোয়ার দিনগুলো আমি ফেরৎ চাই।সবে তো বিয়ে ভেঙেছে এরপর নিজেকে শেষ হতে দেখার চেয়ে আমার কথা মেনে নেওয়া অনেক ভালো নয়কি?"এই মেসেজ কে করেছে জানো জেম?
-আশ্চর্য আমাকে এই প্রশ্ন কেন করছো তুমি ?
-জ্যেঠু পয়সার লোভে হোক,প্রয়োজনে হোক যে কারণেই হোক দেহ ব্যবসা একটা অত্যন্ত হীন কাজ বলেই সবাই মনে করে।আর যে পরিবার যতোই উদার হোক বেশ্যা বা জিগোলোর সাথে বিয়ে মানবে না।কিন্তু যে পরিবারের কোনো মানুষ বেশ্যা পাড়ায় যায় বা জিগোলো ভাড়া করে নিয়ে এনজয় করতে ট্যুরে যায় তাদের মুখে এসব কথা মানায় কি!
-কি বলছিস মা তুই?আমাদের পরিবারে এমন কাজ?
-হ্যাঁ জ্যেঠু।
-যতসব রাবিশ।মিথ্যে কথা বলেছে নোংরা ছেলেটা।
-তোমার কোমরের বাঁপাশে জোড়া লাল তিলের গল্প জুবিন যদি আমায় বলে থাকে তাহলেও কি মিথ্যা বলা হবে?
-জুবিন কে?তার কথা এখানে আসছে কেন মিতুন?
-জুবিনই রুদ্র মা।জিগোলোদের সত্যি নাম জানাতে নেই।জেমদের মতো মহিলারাও যেমন কেয়া হয়ে যায় ঠিক তেমন।
-সাট আপ মিতুন।
মাধুরী চিৎকার করে ওঠে।তৃষা অসহায় ভাবে স্নেহাংশুর দিকে তাকায়।
-মিতুন তুই চুপ করে যা।একটা বাইরের ছেলের কথায় এতো বিশ্বাস করছিস কি করে?
-বাইরের ছেলেটা ঠিক বলেছে কি না জ্যেঠু জানে বাবা।আমি শুধু বুঝতে পারছি জেম নিজেকে লুকিয়ে সকলের সামনে রুদ্রকে মেলে ধরেছে।সেটা অন্যায়।
মাধুরী হঠাৎ উদ্ধত ছোবল নিয়ে এগিয়ে আসে মিতুনের দিকে।
-কি জানো তুমি?কিচ্ছু জানো না।বছরের পর বছর আমি একা থেকেছি।আমাকে ভালোবাসেন বলেই দায় সেরেছেন ঐ চুপ করে বসে থাকা মানুষটি।আমি মা হতে পারিনি তার শারীরিক অক্ষমতায় তবু ভালোবেসে কাছে থেকেছি।সেই ভালোবাসা তিনি দয়া ভেবেছেন আর গুটিয়ে গেছেন সিঁটিয়ে গেছেন।কেন নেবো না আমি জীবনের আনন্দ?আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না?
-ঠিক বলেছো জেম সবার বাঁচতে ইচ্ছা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।তাহলে তুমি রুদ্রকে বাঁচতে দিতে চাইছো না কেন?যে পাঁক থেকে ও বেরিয়ে আসতে চায় সেখানেই ওকে আবার টেনে নামাতে চাইছো কেন?
-কারণ ও আর পাঁচটা জিগোলোর মতো টাকা চোষার যন্ত্র নয়।শরীরের লোভও নেই।ওর সাথে থাকতে ভালো লাগে।
-ব্যাস্ আমার আর কিছু বলার নেই।রুদ্রর সার্টিফিকেট এর থেকে বেশী আর কি হতে পারে বাবা?
ওমপ্রকাশ উঠে দাঁড়ান তারার মাঝে কি যেন খোঁজেন তারপর বলেন,আসলে অসহায় আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে।মাধুরীর কথার রেশ টেনে বলতে হয় আমার নিজের ভাবনা হয়তো মাধুরীকে একটু জটিল করে দিয়েছে।তবে,মিতুন তোমার সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন আমি তোমার পাশে থাকবো।
মিতুন তৃষার পাশে গিয়ে বসে।হাতটা নিজের হাতে নেয়।তারপর মোবাইলটা খোলে।
-ছাদে আসার পর রুদ্রর একটা মেসেজ পাই।তোমাদের একটু পড়ে শোনাই।
"মিতুন,তোমার মনের একটা সহজ সুন্দর কোমলতা আমাকে জীবনের সবচেয়ে নোংরা অধ্যায় ভুলতে সাহায্য করেছে।আমার বাবা যে পরিমাণ আর্থিক লোকসানের মুখে আমাদের ফেলে আত্মহত্যা করেছিলেন সেখান থেকে পরিবারকে বাঁচানোর আমি সত্যি আর কোনো রাস্তা পাইনি।ঐ জীবন তো আমি চাইনি।আমার কাঙ্খিত জীবনের এক পূর্ণ এবং পূণ্য ছবি ধরা দিয়েও দিলো না।আমি জানি তুমি সব জানার পরেও আমার সাথেই থাকতে চাইবে কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মাঝে যে সুন্দর নদীটা বয়ে যেতো সেটা শুকিয়ে যাবে চিরতরে।তোমার আমার স্বাভাবিক রাগ,অভিযোগে অতীতের ছায়া উৎকট হয়ে দেখা দেবে।কি দরকার বলো জীবনকে আরো তিক্ত করে।তার উপর কেয়া আসলে তোমার জ্যেঠিমা মাধুরী এ এক ভয়ংকর বিড়ম্বনা।তুমি হয়তো উপলব্ধি করতে পারছো কিন্তু স্বীকার করতে চাইছো না।আমায় চলে যেতেই হতো আজ অথবা কাল।তাই চলেই যাচ্ছি।জীবন যদি আবার কোন বাঁকে দেখা করায় সেদিন আবার নতুন করে ভাবা যাবে।মাধুরীর জীবনের অনেক না পাওয়া আছে পারলে তোমার জ্যেঠুকে বলো।জানি এমন কথা বলা যায়না এ অসম্ভব কিন্তু তুমি ঠাণ্ডা আগুণ কিছু না ভেঙেও ভাসিয়ে দিতে পারো।তাই চেষ্টা করে দেখতে পারো।কেউ ইচ্ছা করে জিগোলো হয়না বড়ো যন্ত্রণার সে জীবন আর কেউ ইচ্ছে করে জিগোলের সাথে ভ্যাকেশানে গিয়ে স্বামীকেই বারবার খুঁজে পেতে চায়না।আমি এখন এয়ারপোর্টে তাই অকারণ ফোন করে কষ্ট পেওনা।"
স্নেহাংশু 'হে ঈশ্বর'বলে চাপা আওয়াজ করলেন কেবল।বাকি সবাই নিশ্চুপ।তৃষা শক্ত করে চেপে রইলেন মেয়ের হাত।মাধুরী মুখ ঢেকে বসে আছেন ছাদের এক কোণে।
-জেম তুমি চাওনি ও আমার হোক অথচ ও চেয়েছে তুমি তোমার মানুষটা ফেরৎ পাও।আমি ওকে খুঁজে বের করবোই।তোমরা দেখো একদিন ওকে আমি খুঁজে নেবো ঠিক।তোমরা আশাকরি আমার পাশে থাকবে?
রাত বাড়লে ওমপ্রকাশের বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকে মাধুরী,অস্ফুটে বলে,ক্ষমা করতে পারবে?দত্ত বাড়ির আরেক ঘরে তৃষা কেঁদে চলে অবিরাম।স্নেহাংশু নিজেও বড়ো ধ্বস্ত।মিতুন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেসেজে লিখে চলে।
"তোমার মেসেজ সবাই কে শুনিয়েছি।দিল্লী নেমে একটা মেসেজ কোরো।তোমার জাপান যাবার বিষয়টা এবাড়িতে আগে কাউকে কিছুই বলিনি সুতরাং কোনো সমস্যা হবে না আশাকরি।দুমাস পর আমি পৌঁছে যাবো।লোক লৌকিকতার কোনো দরকার নেই।আমি জানি তুমি অন্তর থেকে শুদ্ধ।রুদ্র,একদম নিজেকে দুর্বল করবে না।আমি তোমার সাথে আছি।বড়ো বড়ো নীতিকথা শিখবো অথচ ভণ্ডামীতে ভরিয়ে রাখবো জীবন তা হয়না।আমি শুধু জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।আমি তোমার সাথেই জীবন কাটাবো।জুবিনের জন্য রইলো অনেকটা সহানুভূতি আর মমতার স্পর্শ।সাবধানে থেকো।শিগগিরই দেখা হবে।"
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে,চোখের কোণে জ্বালাটা ফিরে ফিরে আসছে।ফ্লাইট টেক ওভার করতেই অন্ধকারের ভেতর থেকে হাজার আলো জেগে ওঠে ওর চোখের তারায়।
অসম্ভব সুন্দর
উত্তরমুছুনভালোবাসা
উত্তরমুছুনচমৎকার লাগলো
উত্তরমুছুনআন্তরিক ধন্যবাদ🙏🏻
মুছুনঅনবদ্য.. অদ্ভুত সুন্দর লিখেছিস রে..খুব ভালো লাগলো শেষটা❤️❤️❤️❤️❤️❤️😘😘😘😘😘
উত্তরমুছুননাম শো করছে না তাই বুঝতে পারলাম না কে ...আন্তরিক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা
উত্তরমুছুনখুব ভালো লিখেছ সৌমী।
উত্তরমুছুনপ্রাপ্তি আমার দাদা
মুছুনস্তব্ধ হয়ে রইলাম সৌমী।এমন ভাবনা,ও তার রুপায়ন কে কুর্ণিশ
উত্তরমুছুননাম না থাকায় বুঝতে পারলাম না।তবে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই
উত্তরমুছুনবাহ্ সৌমী, আরো একটা সুন্দর লেখা পড়লাম। খুউব ভালো লাগলো। তোর আরো অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ার আশায় রইলাম। :-)
উত্তরমুছুন- সৌরভ চক্রবর্তী