মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র


"মনের মানুষ" কালিকাপ্রসাদ 
……………………………………………………………………………………

যুগান্তর মিত্র 

"মায়াজালে বন্দি হয়ে আর কতকাল থাকিব, 
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নিবো।
আশা রাখি আলো পাবো ডুবে যাই অন্ধকারে।" 

কালিকাপ্রসাদের অন্যতম প্রিয় এক গান। শাহ আবদুল করিমের এই গানটি তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে গাইতেন। অবশ্য কোন্ গানটাই-বা তিনি দরদ দিয়ে গাইতেন না? তাঁর লোকগানের দল দোহার। সাম্প্রতিককালে বাংলা লোকসঙ্গীত ও দোহার যেন মিলেমিশে গিয়েছিল। কালিকাপ্রসাদের আরও একটি প্রিয় গান ছিল ছিল ~ 

"গান গাই আমার মনেরে বোঝাই মনটা যে পাগলপারা
আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া …" 

বাস্তবিক তিনি গান ছাড়া আর কিছুই বুঝি চাইতেন না। সেই গানের এক অনুষ্ঠানে গাইতে যাচ্ছিলেন বীরভূমের সিউড়িতে। যাওয়ার পথে হুগলির গুড়াপে এক পথদুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁদের গাড়িটি। পাশের নয়ানজুলিতে পড়ে যায় গাড়িটি। কালিকাপ্রসাদ প্রাণ হারান। বাকি ৬ জন সদস্যও গুরুতর আহত হন। 

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কালিকাপ্রসাদের মৃত্যু হয়নি। এই ধরনের শিল্পীদের মৃত্যু হয় না। এঁরা বেঁচে থাকেন নিজের শিল্পে, সৃষ্টিতে, মানুষের মনমন্দিরে। 

বন্ধু সোমব্রত সরকার যথার্থই লিখেছেন, "তাঁর গায়কিতে ছিল ভক্তি ও দরদ।" কালিকাপ্রসাদের গায়কির এটি ছিল অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। দরদ দিয়ে, প্রাণ ঢেলে তিনি গাইতেন। লোকগান অনেকেই গেয়েছেন। কতিপয় গায়ক যথাযথ উচ্চারণে লোকসঙ্গীতে ব্যবহৃত শব্দের সঠিক উচ্চারণ করতে পারতেন। তিনি পারতেন। তাঁর উচ্চারণ ও গায়কীর মধ্যে আছে মাটির গন্ধ। সোমব্রত সরকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া যাক। 


"গুরু মুর্শিদের পদ কত যত্ন নিয়ে গাইতেন তিনি। তাঁর গায়কিতে ছিল ভক্তি ও দরদ। রাধারমণের গান ছিল প্রিয়। প্রিয় ছিল সিলেট তথা গোটা হাওর। হাসন রাজা, ফকির লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ। তাঁর কথায় হাওরের গানের ঢেউ খেলত। বিচ্ছেদী, মনসার গান, মুসলিম বিয়ের গান, গুরুতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, রাসুলতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, ভাটিয়ালি সব তাঁর দরদে প্রাণ পেত। হাওর ও অসম ---- লোকায়ত গানের এই দুই অঞ্চল তাঁর সুরে বয়ে যেত। কালিকাপ্রসাদ, দোহার --- একই সত্তার ঘরবাড়ি। আজ চলে গেলেন। কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান , মুর্শিদাবাদের বাউল ফকিরি গান তাঁর মতো বিশুদ্ধতা নিয়ে গাইতে পারত কজন।"


এমন একজন মানুষের চলে যাওয়া বড় বেদনার। বাংলারই শুধু নয়, সকল ক্ষেত্রের লোকসঙ্গীতেরই অপূরণীয় ক্ষতি হল। 

বাংলাদেশে গত ৩ মার্চ মুক্তি পেলো ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রটি। এই সিনেমার সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন কালিকাপ্রসাদ। তিনি সেখানকার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, এই প্রথম তিনি কোনো সিনেমার জন্য গান লিখলেন। (যদিও মনের মানুষ, জাতিস্মর প্রভৃতি সিনেমাতেও তিনি কাজ করেছেন।) বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলনের সময় তিনি গান লিখেছিলেন। আসলে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আলাদা একটা টান ছিল। 

আসামের শিলচরের মানুষ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ ও কালিকাপ্রসাদের জন্মবছর একই, ১৯৭১ । তাই কি বাংলার জন্য এত টান ছিল। এ বোধহয় নিতান্তই সরীকরণ। তিনি বাংলার লোকসঙ্গীতের পাল তোলা নৌকো ছিলেন। তাই দুই বাংলার প্রতি, সমগ্র পূর্বাঞ্চলের প্রতিই তাঁর স্বাভাবিক ভালোবাসা ছিল।

বাবা, কাকারা ছিলেন গানের জগতের মানুষ। সেই স্রোতধারা তিনিও তাঁর রক্তে বহন করে চলেছিলেন। শিলচর থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়তে। কিন্তু সেই স্রোতধারা বয়েই চলছিল ভেতরে ভেতরে। তাই গানের প্রতি অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারেননি। গড়ে তুলেছেন দোহার ব্যান্ড। লোক-আঙ্গিকের বিভিন্ন গান তিনি তুলে ধরলেন বাংলার মঞ্চে, সঙ্গীতের অঙ্গনে। শুধু তো গান গাওয়াই নয়, তিনি ছিলেন লোকসঙ্গীতের একজন মরমী গবেষকও। তাঁর মৃত্যু সেই গবেষণারও ক্ষতি করে দিয়ে গেলো। লোকসঙ্গীতের উপর তাঁর দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল অপরিসীম।


শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তারা বেঁচে থাকেন তার সৃজনশীলতায়। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যও সেভাবেই থেকে যাবেন। 

তাঁর প্রতি রইল সৃজনের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন