খোঁজ (৭) নতুন বাড়িতে যাওয়ার পরেও রোজ বিকেলে অফিসফেরৎ অলোক আসতে শুরু করল এ বাড়িতে l আগের মতই চা - জলখাবার খেয়ে পার্টি অফিসে ঢুঁ মেরে রাত সাড়ে নটা- দশটা বাজিয়ে নিজের বাড়ি ফিরতে শুরু করল l ওখানে সারাদিন শবনম একা l দিনসাতেক পরে অপর্ণা অলোককে বললেন, --এভাবে তো চলতে পারে না, তুমি বরং শবনমকে বিকেলে এ বাড়িতে চলে আসতে বোলো l রাতে এখান থেকে একসঙ্গে খেয়ে বাড়ি ফিরবে l --আচ্ছা বৌদি l শবনমও বলছিল নতুন জায়গায় ওর একা একা থাকতে ভালো লাগে না l কারও সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়নি আর কাজকর্মও তো থাকে না বিশেষ l বি এসসি পাশ করে বসে আছে, এখানে এলে মুন্নিটাকে একটু অঙ্কটাও তো দেখিয়ে দিতে পারে l এবাড়িতে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত একটা জায়গা হয়েছে অপর্ণার l কালের নিয়মে শাশুড়ি যোগমায়ার কণ্ঠ এখন অনেকটাই স্তিমিত l অপছন্দ হলেও ছোটোছেলের বৌয়ের এ বাড়িতে আসাযাওয়া তিনি আটকাতে পারলেন না l একেই এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর ছোটছেলে যেন আরো দূরের মানুষ হয়ে গেছে l অবশ্য কোনোদিনই তার কার্যকলাপ তিনি বুঝতে পারেন না, এমনিতেই মায়ের থেকে বৌদির কথাই সে বেশী শোনে l বড় বৌয়ের মতামতই এখন তাঁর ছেলেমেয়ের কাছে বেশি মূল্যবান l তাছাড়া অরুণেরও অফিসে কিছুটা পদোন্নতি হয়েছে, আর সংসারের মূল আর্থিক দায়ভার তো অপর্ণার স্বামীরই l তাই বড় বৌকে আজকাল বেশ সমীহ করেই চলেন তিনি l এই পরিস্থিতিতে ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলাচলে চুপ করে থাকাটাই তিনি শ্রেয় মনে করলেন l শর্মিলা তখন একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছে l মায়ের কাছে বাংলা আর ইতিহাস-ভূগোল পড়লেও রাত্রিবেলা ইংরেজিটা পিসির কাছেই পড়ে l কিন্তু অঙ্ক ওর কাছে বিভীষিকা l কাম্মা এসে ওকে অঙ্ক আর সায়েন্স পড়াতে শুরু করল l আর আশ্চর্য ! যে অঙ্ককে ছোটবেলা থেকে ভয় পেয়ে কম কম নম্বর পেয়ে এসেছে, মাসদুয়েকেই সেটা ওর প্ৰিয় বিষয় হয়ে উঠল l সেবার সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময় অঙ্কে হায়েস্ট নম্বর পেল শর্মিলা l ঠাম্মা প্রথমদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই হয়ত ছোট বৌয়ের সঙ্গে একটুআধটু কথা বলা শুরু করলেন l একদিন নিজের বাক্সে লুকিয়ে রাখা একটা রূপোর সিঁদুরকৌটো দিয়ে বললেন --হিন্দুঘরের বৌ হইস, সিঁথায় একটু কইরা সিন্দুর দিও l আর আমি তোমারে ওই নামে ডাকুম না, শুভ্রা কইরা ডাকুম l --আপনার যা ডাকতে ভালো লাগে, তাই ডাকবেন না হয় l কাম্মার বিয়ে হয়েছিল রেজিস্ট্রি করে l বিয়ের জন্য সে নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেনি l বিয়ের পরেও ছোটকা বা মা তাকে শাঁখা-সিঁদুর পরার কথা বলেননি, কাম্মাও সেসব ব্যবহার করেনি এতদিন l কিন্তু ঠাম্মা সিঁদুর পরতে বলার পর কোনো আপত্তি না করে কাম্মা সিঁদুর পরা শুরু করল l ফর্সা, ফুটফুটে কপালে কাম্মা যখন সিঁদুরের টিপ পরত, মুগ্ধ হয়ে দেখত শর্মিলা l মায়ের মতই সুন্দর লাগত কাম্মাকে l পিসির সঙ্গেও কাম্মার সম্পর্কটা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছিল l টিউশন থেকে ফিরলে পিসিকে চা - জলখাবার দিয়ে কাম্মাকে ডাকত মা l ওকে অঙ্ক কষতে দিয়ে রান্নাঘরে বসে তিনজন একসঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করত l শর্মিলার মনে হত কাম্মা মানুষটা একেবারে জলের মত l যখন যে পাত্রে রাখা হয় তারই আকার ধারণ করতে পারে l কয়েকমাস বাদে শবনম তখন সদ্য অন্তঃসত্ত্বা, অপর্ণা সবাইকে বললেন --এই অবস্থায় শবনমের রোজ রোজ বাসে করে যাতায়াত করাটা তো ঠিক নয় l আমি একটা কথা বলছি l কেয়াদিদের পাশের বাড়িটা কালকেই খালি হয়েছে l যারা ভাড়া ছিল, নিজেদের বাড়ি করে উঠে গেছে l বাড়িটা নাকি বেশ বড় l একতলা -দোতলা মিলিয়ে পাঁচ-ছটা ঘর আর টানা বারান্দা আছে, বাইরে উঠোন, তাছাড়া দুটো বাথরুম, রান্নাঘর, ছোট্ট একটা খাবার জায়গাও আছে l ছাদটাও পাওয়া যাবে l তোমরা তাড়াতাড়ি একটু বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলবে? পাশের বাড়িতেই বাড়িওয়ালা থাকেন l পরেরদিন রবিবার l বাবা আর ছোটকা গিয়ে বাড়ি দেখে কথা বলে এল l ভাড়াটা অনেকটা বেশী, আটশো টাকা l কিন্তু বাড়িটা ওদের খুব পছন্দ হয়েছে l বিশেষ করে ছাদটা l শীতের দুপুরের রোদ আর গরমের সন্ধ্যায় লোডশেডিং হলে হাওয়াটুকুর বড্ড লোভ ছিল ওদের, এগুলো তো এতদিন জোটেনি l দুই ভাই অনেক আলোচনা আর হিসেবনিকেশ করে বাড়িটা ভাড়া নেওয়াই মনস্থ করলেন l রাজশ্রী বললেন তোমরা এত চিন্তা করছ কেন? আমিও না হয় কিছু দেব l এই সংসারে থাকি যখন এটা দেওয়া আমার কর্তব্য l সংসারখরচ যা দিই, তার থেকে আরো দু- একশো টাকা বেশী দিতে আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না l আমারও পড়াশোনা করার জন্য একটা আলাদা ঘর দরকার l মায়ের সঙ্গে একঘরে থাকতে সত্যিই আমার খুব অসুবিধা হয় l --না রাজু, তোমারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে l এরপর বিয়ে - থা হলে তারও তো একটা খরচ আছে l ওই টাকাটা বরং ব্যাংকে রাখলে কাজে দেবে l সংসারে তো টাকা দিচ্ছই l বাকিটুকু তোমার দাদা আর ভাইকে সামলাতে দাও l --বৌদি তুমি এখনও ভাবো যে আমার বিয়ে হবে ! আমি তো বলেছি আমার বিয়ে নিয়ে তোমরা কোনো আলোচনা করবে না l সবাই চুপ করে গেল হঠাৎ l দুদিনের মধ্যেই অ্যাডভান্স দিয়ে বাড়িভাড়া নেওয়া হয়ে গেল l শর্মিলাদের তখন ডে শিফটের স্কুল l চুনকামের পর বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে কেয়ামাসির সঙ্গে একদিন শর্মিলাও গিয়ে বাড়িটা দেখে এল l এত বড় বাড়িতে রাখার মত তেমন জিনিসপত্র ছিল না ওদের l এরই মধ্যে মা আর পিসি মিলে কিছু কিছু জিনিস কিনে ঘরগুলো গুছিয়ে রেখেছে l পিসির ঘরে নতুন খাট, স্টিলের আলমারি আর পড়ার টেবিল - চেয়ার এসেছে l খাবারঘরে একটা বড় খাওয়ার টেবিল আর ছটা চেয়ার l একতলার সামনের বড় ঢাকা বারান্দায় মায়ের আর ছোটকার ঘরের বুককেস দুটো রাখা হয়েছে l কয়েকটা কাঠের চেয়ার আর সেন্টার টেবিল রেখে জায়গাটা একটা বসার ঘরের চেহারা পেয়েছে l শর্মিলা পরে শুনেছিল এসবই কেনা হয়েছিল পিসির ইচ্ছেতে, তারই টাকায় l হুট করে এত জিনিস কেনার সামর্থ্য মায়ের ছিল না l কলকাতায় মধ্যবিত্তের হেঁসেলে তখন সদ্য রান্নার গ্যাসের প্রচলন শুরু হয়েছে l কেয়ামাসিও কয়লার উনুনের পাট তুলে গ্যাস কিনেছিলেন l নতুন বাড়িতে আসার আগে মায়েরও হয়ত খুব ইচ্ছে ছিল গ্যাস কেনার l একদিন রাতে অপর্ণা হিসেব করে অরুণকে বোঝাচ্ছিলেন কয়লার উনুনের থেকে গ্যাসের উনুন কত বেশী সাশ্রয়ী l প্রয়োজনমত জ্বালানি খরচ করা যায়, তাছাড়া অনেক চটপট রান্না হয়ে যায় l রান্নাঘরও পরিষ্কার থাকে l প্রাথমিকভাবে কিছুটা খরচ হলেও পরে জ্বালানিখরচ অনেকটাই কম হয় l কিন্তু অরুণের হাত -পা বাঁধা l অলোকের নতুন চাকরি, তারও সংসার বাড়ছে l অরুণের মাইনের প্রায় সব টাকাই সংসারে খরচ হয়ে যায় l তার মধ্যে থেকেই মেয়ের জন্য যৎসামান্য সঞ্চয় করতে হয়, তারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে l বাড়িভাড়া নিয়ে সংসারখরচ অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় সে সময় আর গ্যাস কেনা হল না l বাড়ির অন্যান্য কারুর মধ্যেও এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না l আসলে রান্নাঘরের সম্পূর্ণ দায়িত্বটুকু মায়েরই ছিল l তাঁর কোনো সাধ-আহ্লাদ বা অসুবিধের কথা মুখ ফুটে কাউকে কোনোদিন বলেননি অপর্ণা l তাই এই পরিবারের জীবনযাপনের মান হঠাৎ করে বেশ কিছুটা উন্নত হলেও তাঁর ভাগ্যে সেই ঝুলকালিমাখা অন্ধকার রান্নাঘরই পড়ে রইল l মার্চ মাসের এক তারিখেই লরি ডেকে সব আসবাবপত্র নিয়ে ওরা নতুন বাড়িতে উঠে এল l ছোটকারাও তিলজলার ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে সব জিনিসপত্র নিয়ে এ বাড়িতে চলে এল l দোতলায় রাস্তার দিকের ঘরটা শর্মিলার খুব পছন্দ ছিল l কিন্তু ওই ঘরটা ঠাম্মাকে দেওয়া হল l ওই ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটা ঠাম্মার ঠাকুরঘর হল l দোতলায় মাঝের বড় ঘরটা পিসির আর পিছনদিকের ছোট ঘরটা মা নিলেন l একতলায় বসার ঘরের পিছনের বড় ঘরটা ছোটকা আর কাম্মার l এরমধ্যে কাম্মার ছাত্রীসংখ্যাও বেড়েছে l শম্পা, শর্বরীদি, সুদেষ্ণা আর পুরোনো পাড়ার শেলী-মিলিরাও পড়ে ওর কাম্মার কাছে l ওই ঘরের পাশে রাস্তারদিকের ছোট্ট ঘরটায় একটা চৌকির বিছানায় কাম্মা সন্ধ্যেবেলা তার ছাত্রীদের পড়াতে বসত l ওই ঘরেই শর্মিলার হারমোনিয়াম, তানপুরা রাখা হল l পড়তে বসার আগে ওখানে বসেই গানের রেওয়াজ করত শর্মিলা l মাসদুয়েক পরে এক সন্ধ্যেবেলা ক্লাস চলছে এমন সময় ছোটকা একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত l শর্মিলাদের থেকে বেশ খানিকটা বড়, বেশ লম্বা, ফর্সা সুদর্শন ছেলেটি l --শবনম দেখো, কে এসেছে l কাম্মা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল --রিজ্জু, কেমন আছিস? ছেলেটির নাম রিজওয়ান l শবনমের সবথেকে ছোটভাই l বি ই কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র l বাড়িতে না জানিয়ে হোস্টেলে আসাযাওয়ার পথে রিজ্জুদা মাঝেমধ্যেই আসতে লাগল ওদের বাড়ি l কাম্মার ভাই হলেও তাকে দাদা বলেই ডাকতে শুরু করল শর্মিলা l (চলবে ) |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন