রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                       





বেঁচে থাকা একটা সাধনা 

&&&&&&&&&&&&&&&&

     

      দিনের শেষে আমরা কি চাই? 

বাড়ি গাড়ি অর্থ না কি একটু শান্তি?

এক একসময় মনে হয়, সমস্ত কিছুর বিনিময়ে যদি শান্তি পাওয়া যেত! যদি, বালিশে মাথা দেওয়া মাত্র ঘুম এসে যেত! 

কখনো কখনো মনে হয়, চারিদিক অন্ধকার, সন্তান স্বামী অথবা অসুস্থ পরিজন নিয়ে পেরে ওঠা যায় না, একদিক সামলে উঠলে অন্যদিক ঝামেলায় পড়ে, সেজেগুজে ছবি তুলে আরো কত কী করে দেখাতে তো চাই, ভালো আছি, কিন্তু নকল হাসির বন্ধ দরজা ভেদ করে আলো আর ঢোকে না কিছুতেই। জীবনের শুরুতে যে পথ মনে হয়েছিল সহজ সরল, চলতে চলতে দেখতে পাই কত কাঁটা, ছোট ছোট কাঁটা কিন্তু ধারালো, আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ সমস্যা, কিন্তু আঘাত তীব্র, কর্কশ, ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় সাজানো জীবন, বলা যায় না, সহন করা যায় না, অভিনয় করে যেতে হয় তবু, সাজানো সুখের অভিনয়!

************ 


কেন হয় এমন? ত্রুটি করা হয় নি কোনো কাজেই, আকুল হয়ে ভাবতে থাকে মন, কোথায় হয়েছিল সমস্যা, কোথায় ছিল ঠিক সময়ে ঠিক কাজ না করার ভুল, নিজেকে দোষারোপ করতে করতে, অপরের থেকে দোষারোপ শুনতে শুনতে ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়ে দিতে, প্রাণ না থাকলে, থাকবে না ঝামেলা! 

এইভাবে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। পরিসংখ্যান বলছে-- গোটা পৃথিবী জুড়ে গড় আত্মহত্যার সংখ্যা যেখানে ৮ লাখ , সেখানে শুধু ভারতেই প্রায় ১ লাখের উপর। ভারতে জন সংখ্যা বেশি হলেও, জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রেকর্ড বলছে-- ভারতীয়রা আত্মহত্যা করছে বেশি, সমস্ত রকম শ্রেণীর মানুষ আছে সেখানে, উচ্চবিত্ত, সেলিব্রেটি, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে। সবচেয়ে বেশি, তামিলনাড়ু, কেরালা,পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, সুইসাইড করার বয়স গড়ে পনেরো থেকে চুয়াল্লিশ এর মধ্যে। মনের ডাক্তার বলে-- মানসিক চাপ ও হতাশার মোকাবিলা করার শক্তি যখন হারিয়ে যায়, মানুষ তখন জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে আয়ু কমিয়ে দেওয়ার 

পরিকল্পনা করতে থাকে, একসময় সফল হয়। 

***********

রামতনু বাবু আত্মহত্যা করেন কারণ,ছেলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য, শীলা সহ্য করতে পারেনি, শ্বশুরবাড়ির কথার আঘাত, এমন আরো কত...! যৌনতা সম্পর্কিত সমস্যা, রোগে জর্জর হয়ে যাওয়া, প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু, প্রিয় পোষ্যের মৃত্যু, সামাজিক খ্যাতি পড়ে যাওয়া-- তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই-- আশি পার্সেন্ট শিক্ষিত লোক বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। 

************

শিক্ষিত লোক  উদাহরণ দেওয়ার পিছনে কারণ হল, আত্মহত্যাই সমাধানের পথ, এমন যারা ভাবতে বাধ্য হন, শিক্ষা তাদের কী কাজে লাগল!

অনেকেই তর্ক করবেন, যুক্তি দেবেন, সুশান্ত সিং রাজ্পুতের মর্মান্তিক ঘটনাকে অনেকেই বলেছেন, খাদের কিনারায় এসে গেলে আর উপায় থাকে না, সুইসাইড অনিবার্য। আমিও তর্ক করেই উত্তর দেব, সুইসাইড করতে যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা, যেটা ছোট থেকে শেখানো উচিৎ, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজন সেই কৌশল শেখে না, তবে কি শেখে? কি করে সেরা হয়ে উঠতে হয়, কি করে সমাজের মাথা হয়ে উঠতে হয়, কি করে নিজের প্রিয় বন্ধুকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে হয়, মায়ের টেলিফোন কথোপকথন, বাবার মদ্যপান বিজনেস মিটিং-- সমস্ত সময় আলোচনা-- চারপাশ জুড়ে আছে কেবল খারাপ মানুষ! সকলে বিশ্বাসঘাতক, সকলে ফালতু, সকলে স্বার্থপর। 

এইরকম অবিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা সন্তান, একদিন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা, বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার মত পুষ্টি কি করে পাবে মানুষ? 

**********

মনের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় কখন? যখন আর উপায় থাকে না। শরীরের ডাক্তারের কাছেও তো যেতেই হয় শেষপর্যন্ত, কেন যেতে হয়? শরীরের যত্ন নেওয়া হয় না ঠিক মত, নিয়মিত চেকআপ যাওয়া হয় নি, হঠাৎ ধরা পড়ল ভিতরে ভিতরে বড়  একটা অসুখ বাসা বাঁধছে, তখন আর কোনো উপায় থাকে না। 

মনের চেক আপ করে নিয়মিত করা জরুরি বলে কেউ মনেই করে না। যেহেতু, মনের জীর্ণ দশা চোখে দেখা যায় না, অথবা, তাত্ক্ষণিকভাবে  খুশিতে থেকে, বেড়িয়ে এসে কেনাকাটা করে, ব্যাঙ্কে সম্পত্তির হিসাব মিলিয়ে খ্যাতির লিস্টি মিলিয়ে সুখী ভাবতে চাওয়ার মধ্যে থাকে মস্ত ফাঁকি। পরিসংখ্যান বলছে-- মোট আত্মহত্যার বেশির ভাগ পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে শেষ করে দেয়। আর এই মুহুর্তে অতিমারি একটা বিরাট কারণ। 

বোঝা যাচ্ছে, মনের জমিতে ফাটল ধরছে ক্রমাগত, সেই ফাটল মেরামত করতে হবে, ছোট  থেকেই গড়ে তুলতে হবে সুস্থ মন। সতর্ক থাকতে হবে, কোথাও টোল খেলো কি না! মানুষ ছাড়া জীবন কিসের? মানুষকে অবিশ্বাস করে ঠকে যাচ্ছেন না কি মানুষকে সব বিলিয়ে দিয়ে আশা করে আছেন? বাঁচতে হবে নিজের শর্তে, মানুষ পাশে থাকলে ভালো আর না থাকলে? আরো ভালো। প্রয়োজন নেই। নিজের শর্তে বাঁচতে হবে। সাফল্য নিতে পারব, পার্টি দেব আর ব্যর্থতা মানতে পারব  না? তখন গলায় দড়ি দেব? 

**********

জীবন একটা যুদ্ধ তো বটেই, ওঠা  পড়া  থাকবে, অপমান থাকবে, তবে শেষপর্যন্ত দেখতে হবে, হেরে যাই তো ঠিক আছে, আগের থেকে হার মানলে চলবে না। 

  মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, অমুক ওই করেছে, তমুক তাই করেছে, এগুলি না ভেবে দেখতে হবে আমি কি করেছি, সেটাই প্রয়োজন, সেটাই জরুরি। বাকি আর সব তুচ্ছ। 

   বেঁচে থাকা একটা সাধনা, প্রাণ আছে তো সমস্ত কিছু আছে। প্রাণের সাধনা করতে হবে প্রতিদিন। 

   চেষ্টা করি আসুন, সাধনা সফল হোক।

1 টি মন্তব্য: