রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

                                




শ্রাবণের ধারার মতো


পর্ব-৩

বিন্দুবালা কিছুতেই স্বস্তি লাভ করিতে পারিতেছে না। যাহা ঘটিতেছে তাহার জন্যে কাহাকেও দোষারোপ করিবার উপায় নাই অথচ মনের ভিতর অভিমান ফেনাইয়া উঠিতেছে। সোহাগ নিজ হাতে ডাল বাটিয়া গয়না বড়ি বানাইয়া রান্না করিয়া দ্বিপ্রহরে সৌম‍্যাদিত‍্য খাইতে বসিলে তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে, বিন্দু সেইক্ষণে মাছের মুড়ার ঝোল সবে আগাইয়া দিয়াছে।

-মাছ খাইবার পূর্বে একবার দেখুন তো ইহা খাইবার যোগ‍্য হইয়াছে কিনা।

বিন্দু অবাক হইয়া দেখিল তাহার স্বামী পরম মমতায় গয়না বড়ির আলু ঝোল খাইয়া ঢেকুর তুলিয়া বলিল, 'আজ আর কিছু খাইতে ইচ্ছে করিবে না। বিন্দু মাছের মাথা আজ খাইব না।' বিন্দু ঘাড় নাড়িয়া উঠিয়া যায় তবে বুঝিতে পারেনা ইহা কী করিয়া সম্ভব। মাছের মাথা যাহার না খাইলে একটি দিনও চলে না সে কিনা বড়ির ঝোল চাটিয়া খাইয়া উঠিয়া যাইতেছে! একখানি গরম বাতাস সহসা ঘরময় দৌরাত্ম্য করিয়া বাহির হইয়া গেল। সোহাগের নিকট গিয়া বিন্দু চুপ করিয়া দাঁড়াইল।

-তুই ছোটো জাদু জানিস ভাই। আমার সোয়ামির মাছের মাথা খাওয়া ঘুচিল।

-জাদু জানি কিনা জানিনে। তবে তোমার সোয়ামিটির মাছের মাথার চাইতে অন‍্যকিছুর মাথা খাইতে সাধ জাগিয়াছে কিনা খোঁজ রাখিও। 

কথাটি বলিয়া দীর্ঘ বিনুনিটি দুলাইয়া নরম পায়ে হাঁটিয়া চলিয়া গেল। বিন্দু এসব দুর্বোধ‍্য কথা বিশেষ বোঝেনা। খাইতে বসিয়া অখাদ‍্য গয়না বড়ির ঝোল খাইয়া তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। ঘরে আসিয়া সৌম‍্যাদিত‍্যের দিকে তাকাইয়া কহিল, 'এ তোমার ভারি অন‍্যায়, অখাদ‍্য খাইয়া নিজের শরীরকে কষ্ট দিবার কোনো কারণ বুঝিনে।' 

-সব কারণ বুঝিবার মতো বুদ্ধি ঈশ্বর যদি তোমায় না দিয়া থাকেন তাহাতে তোমার কিছু করিবার নাই।

-সব সময় ঠাট্টা ভালো লাগেনা বাপু!

সৌম‍্যাদিত‍্য হাসিয়া কোলবালিশটিকে জড়াইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। বিন্দুর মনে অস্বস্তি বাড়িয়া চলিল। স্বামীর পাশটিতে বসিয়া বাম হাতখানি পিঠের উপর রাখিতেই টের পাইল, সে ঘুমাইয়াছে। চোখের কোণ দুইটিতে জল আসিয়া সব ঝাপসা করিয়া দিতেছে। সোহাগের প্রতি এই বিশেষ পক্ষপাতিত্ব কী স্নেহ না অন‍্যকিছু ইহা জানিবার কোনো উপায় কি নাই!

--------------------------------------------------------------
গোধূলি মাসির কথায় হতবাক হয়ে গেল দেবপ্রিয়া।ফোনের ভিতর দিয়ে গালে যেন সপাটে চড় পড়ল।

-মরুণকিশোরকে মনে পড়ছে কেন তোর? ওর ভিতরে আর কি কিছু বাকি আছে নিঃড়ে নেবার মত? 

দেবপ্রিয়া খানিকক্ষণ চুপ করে যায়। এত রোষ নিয়ে কথা বলছে কেন মাসি? কোনদিন তো এমন ভাবে কথা বলেনা।

-তুই যতদিন ওর কথা তুলিসনি আমার তোকে বলার মত কিছু ছিল না। কিন্তু একটা আত্মভোলা খ‍্যাপাকে আবারো খুঁচিয়ে তুই যন্ত্রণা দিবি সেটা আমি হতে দিতে পারিনা।

-মাসি আমি কখনো কাউকে যন্ত্রণা দিতে পারি? সে ক্ষমতা আমার কোনদিন ছিল?

-হাসালি প্রিয়া, তুই যন্ত্রণা ছাড়া আর কাউকে কিছু দিয়েছিস? মরুণকিশোর, অনুজ, তোর মা এমনকি বরুণকে পর্যন্ত তুই যন্ত্রণা দিয়েছিস। আমার তো ভয় হয় তুই নিজের মেয়েটাকে ছাড়বি তো!

কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে দেবপ্রিয়ার। এত রাগ, ঘৃণা তার প্রতি গোধূলি মাসির? ফোনটা রাখার আগে আশ্চর্য নরম গলায় বলল, 'কিছু মনে করিস না প্রিয়া, মরুণকিশোরের নাম তোর মুখে শুনতেই বড্ড রেগে গিয়ে এসব বললাম। ওর বিয়ে হয়েছে। ভালো আছে দুটিতে। তুই আর ওর ঠিকানা খুঁজিস না মা। আমি সামনের মাসে পারলে একবার যাব তোর কাছে। আদর করে আসব একটু। বড্ড কঠিন কথা বলে ফেললাম না রে মা?' 

মায়ের ঘরে ঢুকে ঊশ্রীর ভুরু কুঁচকে গেল। দেবপ্রিয়া রাইটিং টেবিলে মাথা নীচু করে বসে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর।

-মা!

ছোট্ট ডাকটায় মুহূর্তে সচেতন দেবপ্রিয়া।নিজেকে কুড়িয়ে নেয় অতীত থেকে। চোখটা আলতো হাতে মুছে বলে, 'বেড়াতে যাবি মুনিয়া?'


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন