রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                                  


মৃত্যু অথবা  
 (পঞ্চম পর্ব)

চা অ্যান্ড টা--  বাঙালির রিল্যাক্স স্টেশন। বাঘাযতীন আই ব্লকে আনকোরা নতুন একটি টী-বুটিক। চায়ের সঙ্গে টা রয়েছে, আর রয়েছে অপূর্ব অন্দরসজ্জা। ঢুকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুটি ঘর। মুখোমুখি আর বৈঠকী। মুখোমুখিতে এসে বসে দুজন। রাণা আর দীপু। ওরা আসার মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পৌঁছয় কিরণমালা। 

“অত্যাধুনিক চায়ের দোকান, কী বলিস?” দীপুর কথায় হেসে ফেলে অর্ণব। এই বুটিকের তরুণ কর্ণধার। 
“তা বলতে পারেন দাদা। তবে কিরণদি এই প্রথম এল। ফেসবুকে রেগুলার ছবি দেখে, কমেন্ট করে, ভাবিনি বিদেশ থেকে এসে আমার এখানে পায়ের ধুলো দেবে।” 
“অর্ণব, তুই কি কি সার্ভ করবি দেখ, আমরা কাজের কথা সেরে ফেলি চটপট।” কিরণের কথায় একগাল হেসে অর্ণব বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। 
ইরাবতী সান্যালের মৃতদেহ পড়েছিল বাথরুমের দরজার বাইরে। অন্তত প্রত্যক্ষদর্শী মালতী তেমনই বলেছে সকলকে। সকালে আটটা নাগাদ ঘরের দরজা খুলে সে ভেতরে ঢোকে। বাথরুমের দরজায় মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন ইরাবতী। মালতী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে আর অনমিত্রকে ফোন করে। ডাক্তার এসে জানান প্রায় শেষরাতে মৃত্যু হয়েছে। তখন কিংশুক রায় কলকাতার বাইরে। তাঁকে খবর দিয়ে আনা হয়। আর বাড়িতে মানুষ বলতে ওই অনমিত্র। ইরাবতীর ভাই। পুলিশি ঝামেলা সন্তর্পণে এড়ানো হয়। কেউই পোস্টমর্টেমের নামে কাটাছেঁড়া করতে চাননি।  
“আচ্ছা, এই মালতী, যে আপনার মা’কে শেষবার দেখেছিল, সে এখন কোথায়?”   
কিরণমালা বলে, “সে নাকি সেইদিনই কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। এমনকি মায়ের দেওয়া কোনও জিনিস সে নিয়ে যায়নি। আমি কলকাতায় ফিরে অবধি তাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি, তার ফোন সুইচড অফ। মালতী আমাদের বাড়ির অনেক পুরনো লোক। তার চলে যাওয়াতেই আমার সন্দেহ বেড়েছে... তোমরা জানো, আগামী রবিবার, ঠিক সাতদিন পরে মায়ের স্মরণসভা। আমি খুব চেয়েছিলাম মালতীদি অন্তত সেইসময় আসুক। কিন্তু, আমি তো তার বাড়ি চিনি না, ফোনও বন্ধ...। যতদূর জানি তার বাড়ি ডায়মন্ডহারবারে, উস্থিতে।”  
“মালতীর ছবি থাকলে দিন। আর, অবশ্যই ফোন নম্বর। তিনজন সম্পর্কে একটু ডিটেলে দরকার। মালতী, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, অনমিত্র সান্যাল তো বটেই...।” 
রাণার কথায় কিরণমালা একবার তাকায় দেওয়ালের দিকে। সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত সিনেমার পোস্টার দিয়ে একটা চমৎকার কোলাজ টাঙানো রয়েছে দেওয়ালে। সেদিকে তাকিয়ে বলে, “ভালো করে দেখো, সবটাই কেমন মিলেমিশে একাকার করে দেওয়া হয়েছে। টোটালিটিতে কোলাজটা অপূর্ব, আবার ছবিগুলো আলাদাভাবেও...”, বলতে বলতে যেন সম্বিত ফিরে আসে কিরণমালার, “সহেলি নন্দী বাবার এখনকার পিএ। আগের পিএ ছিলেন রাজীব বর্মণ। তিনি মারা গেছেন। এর বেশি আমি এদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না। এখন আমাদের ডাক্তার বিতান রায়চৌধুরী, ওনার বাবা বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরী আসলে আমাদের এই পরিবারের ডাক্তার ছিলেন একসময়। ডাক্তারজেঠুকে আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি। ডাক্তারজেঠু কিন্তু আমার বাবার কাকার বন্ধু, কিন্তু তাঁকে দাদু না বলে জেঠু বলতাম। উনি খুব আসতেন, আমিও গিয়েছি ওঁদের বাড়িতে। ওনার বয়স হয়েছে অনেক। শুনেছি ডিমেনশিয়া ধরা পড়েছে। বিতানদাই এখন আমাদের বাড়ির ডাক্তার। ল্যান্সডাউনে বাড়িতে পুরনো চেম্বারে বসেন, আর নিজের আলাদা চেম্বার আছে বালিগঞ্জে। আমি বিতানদার পার্সোনাল নম্বর দিচ্ছি।” 
বিতান রায়চৌধুরীর নাম খুঁজে নম্বর বের করে দেয় কিরণমালা।    
“আর আপনার মামা, অনমিত্র...” 
কিরণমালা ঢোঁক গেলে। স্পষ্টই একটা অস্বস্তি। 
“আমার মা ইরাবতী সান্যালরা তিন ভাই-বোন। আমার মা বড়। তার পরে অনমিত্র আর অনিন্দিতা যমজ। অনিন্দিতা অর্থাৎ আমার মাসির বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে। ডাকসাইটে সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তা’ই ছিলেন।” 
“ছিলেন মানে?” কিরণমালাকে বাধা দিয়ে জিগ্যেস করে রাণা।
“ছিলেন, কারণ অকালবৈধব্য তাঁকে অনেক সমস্যায় ফেলে। একই সঙ্গে আমার মায়ের বাবার পক্ষে সওদাগরি অফিসের সামান্য বেতনের চাকরি সম্বল করে তিন ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করা কঠিন ছিল। যদিও আমার মায়ের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা খুবই গুণী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের ছিল বইয়ের নেশা। মেহগনি কাঠের দুটি আলমারি আর ট্রাঙ্কে ছিল প্রচুর বই। সাধ করে একটা পড়ার টেবিল পর্যন্ত বানিয়েছিলেন। আর একটি ইজিচেয়ার। কালক্রমে সেই টেবিল আমার মায়ের সম্পত্তি। শুনেছি দাদু কবিরাজি চর্চা করতেন। প্রচুর মানুষের উপকার করতেন এরা দু’জন। নিজেরা না খেয়ে অন্যকে খাবার খাইয়ে দিতেন। সংসারে একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না। মা তাঁদের ওই গুণটি পান। মায়ের বাবা-মা একটি বছর উনিশের বিধবা মেয়ে, একটি অপোগণ্ড ছেলে এবং একটি কলেজে পড়া বাইশ বছরের মেয়েকে পৃথিবীতে ফেলে রেখে অকালে অতি অবিবেচকের মতো মারা যান। তখনও আমার মায়ের ঠাকুর্দা বেঁচে। তিনি কি ভেবে, সেই একটি ছোট্ট বাড়ি, ঠাকুর্দার নিজের নামে, সেটি উইল করে দিয়েছিলেন আমার মায়ের নামে। কেউ জানত না। মা একদিন ট্রাঙ্কের ভেতর সেটি খুঁজে পান। মায়ের ডেস্কে সেই উইল আমি নিজে দেখেছি। ঠাকুর্দার একটা খাতা ছিল... অনেক কবিরাজি ওষুধ লেখা ছিল তাতে... সেটাও মা খুব যত্ন করে রেখেছিলেন।   
“মায়ের ঘাড়ে সংসারের চাপ এসে পড়ে। মা পড়তে পড়তেই চাকরির চেষ্টা করেন। নানানরকম কাজের অভিজ্ঞতা হয়। কখনও স্কুলের পার্ট-টাইম চাকরি, কখনও ছোট অফিসে রিসেপশনিস্ট, সেলস-গার্লের কাজও নাকি করেছেন। এতরকম জীবন দেখছেন বলেই বোধহয় অত সাবলীলভাবে সেসব লিখতে পারতেন মা।” 
দীপু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। সাহিত্যিক ইরাবতী সান্যালের এই অতীত জীবন কেউ জানেন কী? একটু উসখুস করে সে কিরণমালাকে প্রশ্নটা করেই ফেলে। 
কিরণমালা একটু হাসে। করুণ হাসি। “মায়ের অতীত জানি শুধু আমি। মা বাইরের কাউকে বলত না। মা অতীত ভাঙিয়ে খেতে চাইত না।”   
“কিংশুক রায়ের সঙ্গে বিয়েটা তাহলে...”
রাণার প্রশ্ন শুনে কিরণমালা বলে, “সেই কথাতেই আসছি। আমার মাসি অনিন্দিতা নিজের দুর্ভাগ্য মেনে নিতে পারেনি। পাশের পাড়ার একটি বাউণ্ডুলে ছেলের সঙ্গে সে ঘর ছাড়ে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। আর কোনও খোঁজ রাখেনি কেউ। আমার মামা বেশিদূর পড়েনি। কোনওক্রমে ঘষেমেজে পাস গ্র্যাজুয়েট। মাথার ওপরে কেউ নেই। এই সময়ে একটি কোম্পানিতে মা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন আমার বাবা কিংশুক রায়ের কাকা কল্যাণ রায়। এই কোম্পানির গোড়াপত্তন তিনিই করেন। চাকরি পাওয়ার প্রায় বছরতিনেক পরে এই বাড়িতে মায়ের বিয়ে। যদিও সেটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেকেই এই বিয়ে মেনে নেয়নি। একেবারে পিতৃ-মাতৃহীন একটি মেয়ে, তার বিধবা বোন পালিয়েছে, ভাই অকালকুষ্মাণ্ড... তবুও একেই কেন? তবে ডাক্তার জেঠু মা’কে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তিনি এই বিয়ে সমর্থন করেন। কল্যাণ রায় আর তাঁরই ছেলেবেলার বন্ধু ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরীর চেষ্টায় এই বিয়ে হয়। অদ্ভূত ব্যাপার হল, মায়ের বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যে কল্যাণ রায় আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে স্পষ্ট লিখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কিন্তু জেঠু বলতেন, কল্যাণের মৃত্যুর জন্য দায়ী সিস্টেম। সেটা ঠিক আজও আমি বুঝতে পারিনি।”             
“কিন্তু একটা বিষয় এখনও পরিষ্কার নয়। ইরাবতী সান্যালকে মেরে কার কী লাভ হতে পারে?”
“লাভ প্রত্যেকের। ইরাবতী সান্যালের নামে কোম্পানির শেয়ার, কল্যাণ রায় মা’কে বিয়ের সময় কোম্পানির কিছুটা অংশের ভাগ লিখে দিয়ে যান। এই বাড়ির অর্ধেক মালিকানা মায়ের। আমার মামা যে বাড়িতে থাকেন, সেটিও তাঁর নামে নয়। জানিনা, মা’কে চাপ দিয়ে মামা নিজের নামে বাড়ি লিখিয়ে নিয়েছেন কিনা। তবে মায়ের একটি অপ্রকাশিত আত্মকথা রয়েছে। সেটাতে মারাত্মক সব তথ্য লিখেছেন মা। সে তথ্য নাকি অনেকের জীবন উল্টেপাল্টে দিতে পারে। তার আভাস আমি পেয়েছি।”     
“আত্মকথা, আই মীন, নিজের জীবনের কথা?”   
“হ্যাঁ। আমি যতদূর জানি, সেটি ‘ভাষা আঙিনা’ পত্রিকার জন্য রেডি করছিলেন, শেষ পর্যন্ত মা জমা দিয়েছিলেন কিনা আমি জানি না। খুবই বিতর্কিত সব তথ্য রয়েছে। মা বলেছিলেন, ওই আত্মজীবনী প্রকাশিত হলে অনেকের খুব অসুবিধে হতে পারে...”     
“কার অসুবিধে? কিংশুক রায়ের?”
কিরণমালা চুপ করে থাকে। বলে, “আমি জানি না।” 
“আচ্ছা বেশ,” রাণা প্রশ্ন ঘুরিয়ে নেয়, “আপনার মামাকে তো দেখলাম। আপনার মাসি, যিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন, তিনি এখন কোথায়?”
কিরণমালা ঘড়ির দিকে তাকায় একবার। “তিনি বেঁচে নেই বলেই জানি। অন্তত মা আমাকে তাই বলেছিলেন। তাঁর কোনও ছেলে-মেয়ে ছিল কী-না... নাঃ, মা তাঁর কথা কখনও বলতেন না... কিন্তু মামা যে ফ্যাকটরিতে কাজ করতেন, সেটা বন্ধ হয়ে যাবার পর মা’ই বাবাকে বলে কিছু কাজ জোগাড় করে দেন। মামা প্রায়ই আসতেন। টাকা-পয়সা চাইতেন। কীরকম যেন হিংসে করতেন সকলকে... ভালো লাগত না। আমার বিয়ের পর ও-ই তো সব... যাক গে, আমাকে এবার উঠতে হবে। এবার তোমাদের হাতে বাকি কাজের ভার রইল,” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় কিরণমালা।   
“ইরাবতী সান্যাল বহরমপুরে থেকে চাকরি করেছেন বহুদিন। সেই সময়কার কথা জানেন কিছু?”
“নাঃ। মা কখনও অতীতের কথা চট করে বলতে চাইতেন না।” 
“ইরাবতী সান্যালের উইলটা দেখেছেন আপনি?”
কিরণমালা পিছন ফিরে তাকায়। “যতদূর জানি, মায়ের উইল অনুযায়ী মায়ের সব বইয়ের কপিরাইট আমার। আর মায়ের সেই বাড়িটি, যেটিতে এখন আমার মামা-মামী থাকেন, সেটিও আমার নামে ট্রান্সফার করেছেন...ডেস্কের ওই তালাটা তো নতুন। ভাঙলে হয়ত দেখা যাবে গয়নাগাঁটি কিছুই নেই...। এসে অবধি লেখার পাণ্ডুলিপিটাও খুঁজে পাইনি। মায়ের কম্পিউটারে যা রয়েছে, সব বছরখানেক আগের লেখা। সাম্প্রতিক লেখা কিচ্ছু নেই...।”   
“আপনি ব্যাংকের লকারে গিয়েছিলেন?”
“গিয়েছিলাম। লকারে খুব সামান্য কিছু রয়েছে। মায়ের গয়নার প্রতি মোহ ছিল না। শুধু একটা হিরের আংটি মায়ের ডেস্কে থাকত। আর একটা পুরনো ডিজাইনের কানপাশা, কঙ্কন আর বিছেহার। ওগুলো মা কেন জানি না ওই ডেস্কেই রাখতেন।” 
“ওই গয়নাগুলো কার দেওয়া কিছু জানতেন?” 
“বিয়েতে ডাক্তারজেঠু দেন।”   
( ক্রমশঃ)

1 টি মন্তব্য: