রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                 





 মৃত্যু অথবা  (পর্ব ২)


কিরণমালার ফোন ধরেই লাউডস্পিকারে দিয়ে দিল রাণা। দীপু সামনে রয়েছে। ওর সামনে আবার আড়াল কীসের? বরং ও সবটাই শুনুক। আলোচনা করতে সুবিধে হবে।  
মহিলাকণ্ঠ ভেসে আসে, “হ্যালো, এটা কি রাণা সেনগুপ্তর নম্বর?”
“হ্যাঁ বলছি।” 
“নমস্কার। আমাকে চিনবেন কি না জানি না। আমার নাম কিরণমালা রায়। আমি সায়েন্স কলেজের দু’হাজার চোদ্দ সালের পাস আউট। আমার সাবজেক্ট ছিল সাইকোলজি।” 
কিরণমালার শান্ত সৌজন্যের মধ্যে ‘আপনি’ সম্বোধন কান এড়াল না দুজনের। রাণাও অবশ্য ভীষণ সংযত গলাতেই কথা বলছিল।   
“বুঝেছি। আপনাকে বেশ মনে আছে। আমাদের চেয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। বলুন, বিশেষ কোনও প্রয়োজন?” 
“হুম, প্রয়োজন তো বটেই। এবং প্রয়োজনটা বিশেষ এবং ব্যক্তিগত। কাজেই বুঝতেই পারছেন সব কথা ফোনে বলা যাবে না।”  
“সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু, আপনি ... মানে আমাকে হঠাৎ খুঁজে ...এভাবে ফোন করছেন...” রাণার গলায় স্পষ্ট প্রশ্নচিহ্ন।   
“আমি যতদূর খবর পেলাম আপনি বেশ কিছুদিন হল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করছেন। অপরিচিত এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। আমারই এক ক্লাসমেট আপনার সন্ধান দেয়। আপনাকে আমার মনে আছে। আমার মনে হল, প্রোফেশনালি কাজ দিলে আপনাকেই ভরসা করা যায়। আফটার অল, আপনি খুব সামান্য হলেও চেনেন আমাকে।” কিরণমালার কথা শুনে রাণা দীপুর দিকে তাকায় একবার। 
“আপনি কি এখন কলকাতায়?”
“আমি কয়েকদিন হল এসেছি। কিছুদিন থাকার ইচ্ছে আছে। এর মধ্যেই একটা কাজ মিটিয়ে দিতে চাইছি, সেটা আপনাকে সাক্ষাতে বলব।” 
“বেশ, অবশ্যই আসুন। আমি আপনার এই নম্বরে আমার ঠিকানা পাঠাচ্ছি। গুগল ম্যাপ ধরে চলে আসা খুব সহজ। শুধু একটাই কথা...”  
রাণাকে থামিয়ে কিরণমালা জবাব দেয়, “আমি জানি, আপনি কাজটা সম্পর্কে জানতে চাইছেন... টেলিফোনে শুধু একটিই কথা বলছি, আমি একটি খুনের তদন্ত করাতে চাই। এর বেশি জানতে চাইবেন না।”   
রাণা থমকে যায় এক মুহূর্ত। তারপর সপ্রতিভ গলায় বলে, “আপনি কবে কখন দেখা করতে আসবেন?”
“কালই সকালে। ঠিক সাড়ে ন’টা। আই হোপ আপনার প্রবলেম নেই কোনও।”
“নট অ্যাট অল। আসুন।” 
“আমি পৌঁছে যাব।”  
কিছু বোঝার আগেই ফোন কেটে দেয় কিরণমালা।  
রাণা মোবাইলটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে কুশনের ওপরে। ভুরুদুটো কুঁচকে গেছে, চোখে অস্থিরতা। 
দীপু বলে, “কেসটা কী হতে পারে বল তো?”
“আন্দাজ করছি, শিওর নই। কিন্তু... একটাই মুশকিল...”
রাণার কথায় অস্থিরতা। 
দীপু জিগ্যেস করে,“কী মুশকিল?” 
“একরাত্তিরের মধ্যে আমাকে খুঁজে নিতে হবে কিরণমালা কেন আসতে চায় আমার কাছে। সময়টা বড্ড কম। ওর সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিয়ে রাখতে পারলে ভালো হত। অ্যাট লিস্ট কোথায় আছে, কী করছে...।”   
“কিন্তু রাণা, এত তাড়া কীসের? ওকে আগে আসতে দে। ও নিজেই এসে বলবে নাহয়...।” 
রাণা উঠে পড়ে। পায়চারি করতে করতে বলে, “তুই একটু তলিয়ে ভাব দীপু, এতদিন পরে তাকে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর খুঁজতে হচ্ছে কেন? তার যা সোশ্যাল স্ট্যাটাস সে পুলিশের বড়কর্তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে... তার ওপর খুন। খুন হলে পুলিশ জানবে না? না কি পুলিশ জেনে ফেললে খুনি পালিয়ে যাবে বলে সে ভয় পাচ্ছে? খুনি কি আরও প্রভাবশালী কেউ? খুন হলই বা কোথায়?...” পায়চারি করতে করতে মাথার চুলগুলো খামচে ধরে রাণা।    
দীপু বলে, “আমি যতটুকু বুঝলাম, জট পাকিয়ে যাচ্ছে একটাই কারণে। ক্লায়েন্টের নাম কিরণমালা রায়। আর সে চিরকাল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। কিন্তু তুই কী ভাবছিস রাণা?”  
দীপুর কথায় হুঁশ ফেরে। 
“সেরকম কিছু ভাবছি না। আমাদের ডিএসপি সাহেবের কথা মনে পড়ছে।” 
“কে? অরিন্দম? ও তো এখন বারাসতে পোস্টেড।” 
“আরে, যেখানেই পোস্টেড হোক, ক্লাসমেট তো রে বাবা। এই ঝামেলায় ওকে একবার লাগতে পারে।” 
“কিন্তু রাণা, কে কোথায় খুন হল, তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কিরণমালা আগে কাল আসুক। আর তাছাড়া, তোর এই শখের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে অরিন্দম খুব গাল দেয়, মনে নেই?”
“তা’ দিকগে। বন্ধুরা অমন বলেই থাকে। ভালোবাসে বলেই গাল দেয়। দেখ ভাই, রাজনীতি করতে গিয়ে কেরিয়ার ডুবিয়েছি। হাবিজাবি চাকরিবাকরি করে ওই ডালভাতের জীবন আমার পোষাবে না। আমার এই কাজই ভালো। থানাগুলো মোটামুটি চিনে নিয়েছে। জানে, আমি লোকটা চোর-ছ্যাচোড় নই। টুকটাক কেস সলভ করলে পুলিশেরও লাভ। আমারও মগজের ব্যায়াম। নির্মেদ নির্ভার মস্তিষ্কে হাওয়া খেলে...”  
রাণার কথা শুনতে শুনতে মন খারাপ হয় দীপুর। রাণা ছিল ব্যাচের ব্রাইট বয়। সত্যিই অনেক বেশি সময় দিয়ে ফেলেছিল ছাত্র-রাজনীতিতে। নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারেনি। যথারীতি রেজাল্ট হল একদম সাদামাটা। নম্বরের ফাঁদে অনেক বড় কেরিয়ারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। নেহাত কিছু পৈতৃক ধনসম্পত্তির ভরসা আছে। নিজের বাড়িতে একা মানুষের খাওয়া-পরার সংস্থানটুকু রয়েছে। বাকি সময়টা, এখন ওর নিজের ভাষায়, ‘মগজের ব্যায়াম’ করে। পুরোপুরি পেশাদার গোয়েন্দা না হলেও প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে বেশ কিছু কেস সামলেছে।  
“দীপু, আমি একটু কাজে বসি। তুই শুধু দেখিস কেউ ডিস্টার্ব না করে। আর হ্যাঁ... কিরণমালা রায়ের মা ইরাবতী সান্যাল আর বাবা কিংশুক রায়ের সব ডিটেল চাই চটপট। যেখানে যত ইন্টারভিউ আছে, নিউজ ক্লিপিংস আছে... সব খুঁজে জড়ো করি। দুজনেই সমাজের উঁচুতলার মানুষ, কিছু বেসিক ইনফো তো থাকবেই...।”   
দীপু উঠে পড়ে। মানিকতলায় রাণার আনঅফিসিয়াল অফিসঘরের চৌহদ্দির ঠিক ওপরের তলাতেই ওদের একত্রে বসবাস। দুই ব্যাচেলরের ভাগাভাগি জীবন। দীপুর নিশ্চিন্ত ব্যাংকের চাকরি রাণার পেশাদার গোয়েন্দা জীবনে কোনও অসুবিধে করেনি। বরং রাণার পৈতৃক বাড়ির একটা অংশে দীপু পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকায় এক অর্থে দুজনেরই সুবিধে। দীপু সুদূর মফঃস্বল থেকে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে চাকরি করতে আসার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত, রাণা তার পিতৃমাতৃহীন নিস্তরঙ্গ একলা জগতে একটা বন্ধুর সাহচর্য পেয়ে তৃপ্ত। দীপু তাকে প্রচুর সাহায্যও করে। ঠিক এই মুহূর্তে যেমন দীপু টেবিলের কম্পিউটার অন করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পাশে রতনের চায়ের দোকানে হাঁক দিয়ে এলে ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা চলে আসবে রাণার পাশে। রাতের খাবার চলে আসবে হোম ডেলিভারি মারফত সময়মতো। দীপু চুপচাপ এবার নিজের ঘরে। হয় সিনেমা কিংবা ওটিটিতে জমিয়ে সিরিজ। নয় গল্পের বই। রাণা ডাকলে তবেই আবার একসঙ্গে বসা। তার আগে রাণাকে কোনও ভাবে বিরক্ত করা যাবে না।    
রাতে চোখ বোজার আগে অবধি নিচের ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছে দীপু। 
ভাগ্যিস কাল রোববার।     
.......................................................................................................................................
( ক্রমশঃ)

৩টি মন্তব্য: